অতিবৃষ্টি এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যা নদীমাতৃক বাংলাদেশে নতুন কোনো দুর্যোগ নয়। তবে বন্যার প্রকোপ কম বা বেশি তা নির্ভর করে মূলত মৌসুমি বায়ুর গতি-প্রকৃতি, বর্ষার তীব্রতা ও প্রতিবেশী দেশের উজান থেকে আসা পানির ওপর।
বাংলাদেশে বন্যা সাধারণত মৌসুমি ঋতুতে, অর্থাৎ জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং গড়ে প্রতিবছর প্রায় ২৬ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা বা দেশের মোট আয়তনের ১৮ শতাংশ বন্যায় প্লাবিত হয়। বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া বন্যার ইতিহাস থেকে দেখা যায়, দেশের প্রায় ৮০ ভাগ এলাকা কোনো না কোনো সময়ে বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে।
তবে উল্লেখযোগ্য বন্যার ধ্বংসযজ্ঞ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি ১৯৬৬, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৪, ২০০৮, ২০১৭ ও ২০২২ সালে। আপাতদৃষ্টিতে বলা যায়, ২০০০ সালের আগে পর্যন্ত প্রতি এক দশকে বাংলাদেশে একটি বড় বন্যা হতো কিন্তু বন্যার সংখ্যা ও তীব্রতা বেড়েছে ২০০০ সাল-পরবর্তী বছরগুলোয়, যেটিকে মোটা দাগে জলবায়ু পরিবর্তনের ফল হিসেবে দেখা যেতে পারে।
১৯৮৮-এর বন্যা ছিল বাংলাদেশে সংঘটিত প্রলয়ংকরী বন্যাগুলোর অন্যতম, যেটি আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসজুড়ে দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ বা প্রায় ৮২ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা প্লাবিত করেছিল এবং স্থানভেদে এই বন্যার পানির স্থায়িত্ব ১৫ থেকে ২০ দিন পর্যন্ত হয়েছিল।
এ ছাড়া ১৯৮৭, ১৯৯৮, ২০০৪ এবং ২০০৭ সালের বন্যায় দেশের প্রায় ৫৭ হাজার ৩০০, ১ লাখ ২৫০, ৫৫ হাজার এবং ৬২ হাজার ৩০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হয়েছিল।
বাংলাদেশে চলতি বছরের মে মাসে শুধু সিলেট জেলায় ৭৭৫ মিলিমিটার এবং মৌলভীবাজার জেলায় ৭০৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। মে মাসের শেষ সপ্তাহে ঘূর্ণিঝড় রিমাল আঘাত হানার পর সিলেট জেলার সাতটি উপজেলা আকস্মিক বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে।
আকস্মিক বন্যাগুলো ভারী বৃষ্টিপাতের ব্যাপ্তির সঙ্গে সম্পর্কিত, দৈবাৎ তৈরি হয়, সাধারণত বন্যার বিস্তার খুব বেশি এলাকাজুড়ে হয় না, স্বল্প সময়েই নদ-নদীতে পানি বাড়ে, স্বল্প সময়েই নেমে যায় এবং সাধারণত এটি স্থায়ী হয় না।
গত ২৭ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত সিলেট ও চেরাপুঞ্জিতে অব্যাহত বৃষ্টিপাত চলমান ছিল। ৩১ মে রাতে ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলোয় ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়, পানিবন্দি হয় প্রায় সাড়ে ৫ লাখ মানুষ। ভারতের চেরাপুঞ্জির রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাতের প্রভাবে এই বন্যার উৎপত্তি হয়েছিল।
মেঘনা অববাহিকায় অবস্থিত সিলেট অঞ্চলে প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিকভাবেই দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়। কিন্তু সিলেট ও তার আশপাশের এলাকার বন্যা পরিস্থিতি মূলত প্রভাবিত হয় ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বৃষ্টিবহুল এলাকা চেরাপুঞ্জির ভারী বৃষ্টিপাত দ্বারা।
চেরাপুঞ্জিতে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত প্রায় ১১৫০০ মিলিমিটার। এই এলাকায় সর্বোচ্চ বার্ষিক মোট বৃষ্টিপাতের রেকর্ড ছিল ২৬৪৬৭ মিলিমিটার, যা ১৮৬০ সালের আগস্ট থেকে জুলাই ১৮৬১ পর্যন্ত ঘটেছিল। ওই বছর শুধু জুলাই মাসেই বৃষ্টি হয়েছিল ৯২৯৬ মিলিমিটার।
ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর (আইএমডি) জানায়, ২০২৪-এর ১৭ জুন চেরাপুঞ্জিতে ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, যা ১২২ বছরের মধ্যে এক দিনে তৃতীয় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত। সেখানে ১৫ থেকে ১৭ জুন পর্যন্ত প্রায় ২৫০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এটিও গত ২৭ বছরের মধ্যে তিন দিনে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের রেকর্ড।
তিস্তা নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মাত্রায় বেড়ে গেলে বাংলাদেশের তিস্তা অববাহিকার জেলাগুলোতে বন্যার পানি ঢুকে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। গত ১২ জুনের পর থেকে টানা আট দিন ধরে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয় দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্রের পানি।
তিস্তা, ধরলা ও ঘাঘট নদীর পানি বাড়তে শুরু করে এবং কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। গত ৩ জুলাই গাইবান্ধা জেলায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে, বন্যায় ডুবে যায় ২৬ ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম, প্রায় ৩৬ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়।
বৃষ্টিপাত আর উজানের পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়, পানিবন্দি হয়ে পড়ে প্রায় ৪০০ পরিবার। যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে এবং সিরাজগঞ্জের পাঁচ উপজেলার চরাঞ্চলবেষ্টিত ৩৪টি ইউনিয়নের ২১ হাজার পরিবারের প্রায় ৯৪ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে।
ঝিনাই এবং ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ-নদীর পানির অব্যাহত বৃদ্ধিতে টাঙ্গাইলের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সুরমাসহ সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে সুনামগঞ্জে তৃতীয় দফায় আবারও ১২ উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়।
বন্ধ হয়ে যায় সিলেট জেলার ২৭৩টি প্রাথমিক ও ৬৬টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসা। এ ছাড়া জামালপুর, বগুড়া, টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ জেলার ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ-নদীসংলগ্ন নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি স্বল্প মেয়াদে বিদ্যমান ছিল।
আবারও চলতি মাসে অতিবৃষ্টি ও ভারতসৃষ্ট বন্যায় দেশের ১১ জেলায় পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে ১০ লাখ ৪৭ হাজার ২৯ পরিবার, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রায় ৫২ লাখ মানুষ, এ পর্যন্ত ১৮ জনের প্রাণহানি হয়েছে এবং নিখোঁজ রয়েছেন অনেকেই। কুমিল্লায় গোমতী ও সালদা নদীর বাঁধ ভেঙে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে শতাধিক গ্রাম এবং ইতোমধ্যে জেলার ১৪টি উপজেলা বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে।
চট্টগ্রামে ২ লাখ ৬০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছেন। অব্যাহত ভারী বৃষ্টি ও মেঘনা নদীর জোয়ারের ঢলে লক্ষ্মীপুর জেলার ৮০ শতাংশ এলাকা তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন জেলার সাড়ে ৬ লাখ মানুষ। নোয়াখালীর ৮ উপজেলার ৮৭ ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এতে বিভিন্ন উপজেলা পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ২০ লাখ মানুষ। জেলার ৫০২টি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন লক্ষাধিক মানুষ।
নোয়াখালীতে পানি নিষ্কাশনব্যবস্থা বেহালের কারণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা পরবর্তী সময়ে পানির ঢলের সঙ্গে একাত্ম হয়ে বন্যায় রূপ নিয়েছে। সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ভারী বর্ষণ ও ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে ফেনীর মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর পানি বিপৎসীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ভারী বর্ষণের কারণে চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি এলাকার কোথাও কোথাও ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে।
অতিবৃষ্টির পানি সমুদ্রে চলে যাওয়ার যে সহজ পথ, সেগুলোতে নানা কারণে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। হাওরের বুক চিরে কিশোরগঞ্জের ইটনা-অষ্টগ্রাম-মিঠামইনের অল-ওয়েদার সড়ক দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে। প্রতিযোগিতামূলক শিল্পায়ন, দ্রুত নগরায়ণ ও বিভিন্ন অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণের কারণে নিচু জমিগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানির আধারগুলো নষ্ট হয়েছে।
দেশব্যাপী চলমান বর্জ্য অব্যবস্থাপনা, বিভিন্ন পয়েন্টে নদীমুখগুলো পলি ও বালু জমে বন্ধ হয়ে গেছে, পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে আসা পলিমাটির কারণে বিভিন্ন নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় নদীর গভীরতা কমেছে, কমেছে নাব্য ও নদীর ব্যাস এবং বেড়েছে বন্যার তীব্রতা। বন্যাক্রান্ত অনেক এলাকায় বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে, ডুবেছে নলকূপ, পানির ট্যাংক।
শুকনো খাবার খেয়ে কোনো রকমে দিনযাপন করছেন লক্ষাধিক মানুষ, সড়ক যোগাযোগ বন্ধ, প্রায় ১১ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎহীন। বন্যাক্রান্ত ১১টি জেলায় ১ হাজার ২২৩টি মোবাইল টাওয়ার বন্ধ রয়েছে। তবে আশার বিষয় হলো, গত দুই দিনে পূর্বাঞ্চলীয় ভারতীয় ত্রিপুরা প্রদেশের অভ্যন্তরীণ অববাহিকায় উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাত হয়নি এবং উজানের নদ-নদীর পানি হ্রাস অব্যাহত আছে।
কমতে শুরু করেছে হালদা, চট্টগ্রামের ইছামতী, সাঙ্গু, কর্ণফুলী নদীর পানি। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদ-নদীর পানি হ্রাস পেতে শুরু করেছে। এমতাবস্থায় দ্রুততার সঙ্গে সর্বোচ্চ সহযোগিতা নিয়ে চলমান বন্যা ও বন্যা-উত্তর পরিস্থিতি মোকাবিলায় এবং বন্যাকবলিত এলাকার পুনর্গঠনে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
অধিক গুরুত্ব দিতে হবে বন্যা-উত্তর পুনর্বাসন কর্মসূচিতে। বন্যা-পরবর্তী অবস্থায় নানাবিধ পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেবে। বন্যাক্রান্ত এলাকায় জনদুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করবে, সংকট হবে খাবার ও সুপেয় পানির। সংকট দেখা দিতে পারে চাষযোগ্য জমির, শিশুখাদ্য এবং ওষুধের।
এ পরিস্থিতিতে ত্রাণ ও উদ্ধারকর্মীদের জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত জলযান, নৌকা ও স্পিডবোটের। নলকূপ ও সুপেয় পানির উৎসগুলো তলিয়ে যাওয়ায় নতুন করে তা পুনঃস্থাপনের দরকার হবে। প্রয়োজনীয় ওষুধ, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, ওরাল স্যালাইন ও চিকিৎসা উপকরণের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
বিদ্যুৎ সরবরাহ ও বিচ্ছিন্ন যোগাযোগব্যবস্থার সংস্কার, কৃষিক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় চারা ও বীজ সরবরাহসহ নানা কার্যক্রম পুনর্বাসন কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা আবশ্যক। বেসামরিক প্রশাসন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, অগ্নিনির্বাপণ বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ আপামর জনসাধারণের আন্তরিক সহযোগিতা ও প্রচেষ্টায় এই ক্রান্তিলগ্ন মোকাবিলা করতে হবে।
যে কর্মোদ্যোগ, কর্মস্পৃহা, মানবিকতা, সহযোগিতার মানসিকতা ও সর্বোপরি যে অপ্রতিরোধ্য মনোবল নিয়ে দেশের আপামর জনসাধারণ ও শিক্ষার্থীরা একযোগে এই দুর্যোগ মোকাবিলায় কাজে নেমেছেন, তাতে শিগগিরই সব অমানিশা কেটে নতুন আলোয় উদ্ভাসিত ভোর আসবে, এই প্রত্যাশা করি।
লেখক: অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ [email protected]