জুলাই ও আগস্ট মাসে তরুণ ও ছাত্রদের এক বিশাল কলধ্বনি বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটিয়েছে তা ওপর কাঠামোর। অনেক মানুষ একে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে উল্লেখ করেছেন। এর আগে বেআইনি এবং স্বেচ্ছাচারী শাসনকালের সাধারণ মানুষ, চিকিৎসক খুন এবং প্রতিবাদী মিছিলের ওপর পুলিশের ট্রাক উঠিয়ে মধ্যযুগীয় অনিয়মতান্ত্রিকতার কথা হয়তো তারা ভুলে গিয়েছিলেন।
তবে হ্যাঁ, সেটি ছিল ৯ বছরের। আর গত সরকারের মেয়াদকালকে মোটামুটিভাবে সাড়ে ৫ বছর + আড়াই বছর, অর্থাৎ ৮ বছর ধরা যায়। কারণ ১৯৯৬-২০০০ সালের ৫ বছর এবং ২০০৯-২০১৩-এর পাঁচ বছর সরকার দুটি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সুশাসন দেওয়ার ব্যাপারে সচেষ্ট ছিল বলে ধরা যায়।
তাদের স্বৈরাচারী রূপ বিশেষ করে ২০১৮ সালের এবং ২০২৩ সালের ভোটবিহীন নির্বাচনে প্রকট আকার ধারণ করে। এর প্রেক্ষাপটে ওই সরকারের পতন জনমনের একটি অংশকে নতুনভাবে আশান্বিত করেছে। এই সূত্রেই আন্দোলনকারী এবং তাদের সমন্বয়করা সংস্কার নামে একটি ধারণাকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করছেন।
এ প্রসঙ্গে ইংরেজ কর্তৃক ১৯০ বছর ভারত শাসন এবং বিশেষ করে ১৮৫৭ সাল থেকে তাদের প্রণীত নানাবিধ আইন, পদ্ধতি, বিধিবিধান এবং ব্যবস্থাসমূহের আলোকে কিছু বিষয় স্মরণ করা প্রাসঙ্গিক হবে।
ভূমি জরিপ ও মালিকানা, প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা, আইন ও বিচার, সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা, গৃহায়ণ, কর আদায় ও হিসাব নিরীক্ষা, শুল্ক, রাজনৈতিক দল ও ভোটাধিকার, বিভিন্ন সরকারি সার্ভিসের সদস্যদের ক্ষমতা, বেতন, চাকরির শর্তাবলি এবং মর্যাদা, ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা, সামাজিক সুরক্ষা, মুনাফা নির্ণয়, ব্যাংকিং ও অর্থ, সংস্কৃতি ও সাহিত্য, মতপ্রকাশ, ধর্মীয় বিষয়, উপাসনালয় এবং ওয়াক্ফ বিষয়াবলি, সংগঠন ও ক্লাব তথা কলা, বিজ্ঞান, বাণিজ্য অর্থাৎ মানুষের ইহকাল এবং পরকাল সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে অধিকাংশ জনগণের মতভিত্তিক রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সবকিছুর ব্যবস্থা ব্রিটিশ শাসকরা প্রতিষ্ঠা করে ভারত ও পাকিস্তানকে স্বাধীনতা দিয়ে ১৯৪৮ সালে তারা উপমহাদেশ ত্যাগ করে।
এসবের কিংবা এসবের বিকৃতির ভিত্তিতে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ তাদের জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করেন।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ ওই রাজনৈতিক ব্যবস্থা তথা নির্বাচন এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামতের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের প্রথম শাসনতন্ত্রটিও ড. কামাল হোসেন এবং তার সহযোগী আইনপ্রণেতারা সম্পূর্ণ ব্রিটিশ মডেলে মুসাবিদা করেন। এর পর থেকে বিভিন্ন শাসক তাদের প্রয়োজনে এই শাসনতন্ত্রের নানাবিধ পরিবর্তন করতে করতে পঞ্চদশ সংশোধনী পর্যন্ত নিয়ে আসেন।
এতে কখনো বহু দলের পরিবর্তে এক দল, রাষ্ট্রপ্রধানের খুনিদের বিচার থেকে অব্যাহতি, রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের প্রবর্তন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতিষ্ঠা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার খারিজ করা ইত্যাদি বিষয় সংঘটিত হয়। দেশের কোনো আইনই শাসনতন্ত্রের মূলনীতির পরিপন্থী হতে পারে না। যেমন- সামরিক আইন জারি, বিশেষ ক্ষমতা আইনের প্রবর্তন, ডিজিটাল সিকিউরিটি, আইনের প্রবর্তন কিংবা সামরিক আইনের অধীনে সম্পাদিত সরকারের সব কার্যাবলিকে দেশের সব আদালতের এখতিয়ারবহির্ভূত করে দেওয়া ইত্যাদি।
কিন্তু সময়ের দীর্ঘ পরিসরে এই ঋণাত্মক কাজগুলো করা হয়েছে কখনো শাসনতন্ত্রকে অক্ষুণ্ন বা স্থগিত রেখে। এর পরবর্তী স্তরে গুম, রাষ্ট্রীয় নির্দেশনায় খুন এবং শাসন বিভাগের হেফাজতে থাকা অবস্থায় বিচারের জন্য সোপর্দ করার আগেই কোনো সন্দেহভাজনকে হত্যা করার কাজগুলো ঘটেছে।
এগুলো সংঘটন শাসনতন্ত্র বা প্রশাসন পরিচালনার জন্য প্রণীত আইনের দোষ নয়, দোষ এর ব্যবহারকারী শাসকদের। ফৌজদারি অপরাধ বিচারের ক্ষেত্রে পুলিশ ও অধস্তন বিচার বিভাগের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ছাড়া পুলিশ কোনো স্থানে অভিযান পরিচালনা, মালামাল জব্দ, সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার, থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ, গুলিবর্ষণ এবং তদন্ত করতে পারে না।
এর ওপর সামগ্রিক তত্ত্বাবধায়নের ব্যবস্থা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপর ন্যস্ত করে ব্রিটিশরা আইন প্রণয়ন করে গেছে। কিন্তু সময়ের দীর্ঘ পরিসরে দেখা গেছে যে, শাসকরা এগুলো লঙ্ঘন করে বিরোধী মতাবলম্বীদের সঙ্গে বেআইনি আচরণ করে গেছেন।
এ ক্ষেত্রে কোনো কোনো শাসক আইনকে উপেক্ষা করেছেন, কেউ কেউ আইনটা পরিবর্তন করে নিয়েছেন। যেমন- ১৯৭৭ সালে জেনারেল জিয়াউর রহমান জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক পুলিশের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন প্রতিপাদন করার আইনটি রদ করে দেন। আবার গত ১০ বছরের সরকার এসব আইনকে পরিবর্তন না করেও অগ্রাহ্য করে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থমাফিক বেআইনি কাজ করেন।
ফলে হাজার হাজার ভিন্ন মতাবলম্বী মানুষ কারারুদ্ধ এবং খুনের শিকার হন। শেষ পর্যায়ে ছাত্রদের তীব্র গণ-আন্দোলনকে একই বেআইনি পন্থায় দমন করার চেষ্টা করতে গিয়ে বিভিন্ন সূত্রমতে, অন্তত ৬০০-এর অধিক আন্দোলনকারী নিহত হন এবং অন্তত ৪ হাজার কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
এই আন্দোলনকারীদের অভিভাবক, সমন্বয়কারীরা যেসব সংস্কারের কথা বলছেন, তার কোনো বিষয়বস্তু বা শিরোনামের কথা আমরা এখনো অবহিত নই। তাদের কল্পনামতে, যে সংস্কার করলে বৈষম্য দূর হবে সেগুলোর নাম সারা জাতিতে আলোচিত না হলে সেগুলো জনসমর্থনপুষ্ট কি না, তা বোঝা যাবে না। সংস্কারের জন্য শাসনতন্ত্র হচ্ছে বুনিয়াদি দলিল।
সেখানে ১৯৭২ সাল থেকেই বলা আছে, রাষ্ট্র তার নাগরিকদের জীবন-জীবিকা নির্বাহ, নিরাপত্তা বিধান এবং বিচার প্রাপ্তির অধিকারের ক্ষেত্রে কোনো ভিত্তিতেই নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য করবে না। পুলিশ তার কাজ কীভাবে করবে তা পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল এবং সিআরপিসিতে আছে। বিচার বিভাগ কীভাবে বিচার করবে তার সুস্পষ্ট বিধানসংবলিত আইন, ম্যানুয়াল, নির্দেশিকা এবং রেফারেন্স রয়েছে।
তেমনি কর কীভাবে আদায় হবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কীভাবে চলবে, কীভাবে পরীক্ষা নেওয়া হবে, বিভিন্ন চাকরিতে কীভাবে নিয়োগবিধি প্রণয়ন করতে হবে, একটি রাজনৈতিক দল কীভাবে গঠন ও পরিচালনা করতে হবে, সরকারি কর্মচারীরা চাকরিবিধি লঙ্ঘন করলে বিভাগীয় শাস্তি কীভাবে প্রযোজ্য হবে, সচিবালয় কোন আইনে কী কাজ করবে ইত্যাদি বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে আইন রয়েছে।
এগুলো যথাযথভাবে প্রয়োগ এবং তার তত্ত্বাবধায়ন ও পরিবীক্ষণ যেসব ক্ষেত্রে হয়নি সেসব ক্ষেত্রেই হয়েছে অনিয়ম, অন্যায়, প্রাণহানি, কর ফাঁকি, সম্পদের মালিকানায় ব্যাপক বৈষম্য, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি তথা কোটি কোটি নাগরিকের আইনগত অধিকার হরণ।
সমন্বয়কদের এই অনুরোধ করব যে, সংস্কারের আগে ২০০ বছরের বেশি সময় ধরে প্রচলিত আইন ও বিধিবিধানগুলো আগে পরীক্ষা করুন। সেগুলোকে পুনঃপ্রবর্তন এবং বলবৎ করতে জনমত গড়ে তুলুন। এগুলো করলে প্রচুর শ্রমসাধ্য, ব্যয়বহুল এবং দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ সংস্কারের খুব সামান্যই প্রয়োজন পড়বে।
এ দেশে কোটি কোটি টাকা করের বা বৈদেশিক ঋণের অর্থে নানাবিধ অপ্রয়োজনীয় সংস্কারের নামে বিভিন্ন কনসালট্যান্সি করা হয়েছে। যা ক্লায়েন্টদের কোনো উপকারে আসেনি। বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও কলার ক্ষেত্রে ব্রিটিশদের করা প্রায় সব আবিষ্কারই বিশ্বমানের।
৩০০ বছর পরও এগুলো যুগোপযোগী। তবে পুঁজিবাদে শ্রেণিবিভক্ত সমাজ থাকবেই, থাকবে সম্পদের মালিকানায় বিভিন্ন শ্রেণি। তার পরও এরই মধ্যে একটি জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের চিত্রকল্প আঁকতে হবে। বৈষম্যের প্রধান বিষয়টি যে সম্পদের মালিকানার, সেই কথাটি সমন্বয়করা একবারও বলেননি।
এটি নিয়ে ভাবুন। কোনো সংস্কারের আগে সব বিভাগের জন্য প্রযোজ্য সংশ্লিষ্ট আইনকানুনগুলো সমন্বয়করা দয়া করে নিবিড়ভাবে পাঠ ও পরীক্ষা করুন এবং তার পর নির্ধারণ করুন সংস্কারের প্রয়োজন কোথায় আছে। সাধারণত যত গর্জে তত বর্ষে না।
লেখক: সাহিত্যিক
[email protected]