আমরা বাঙালিরা, এপার বা ওপারের, এখন চারদিক থেকে আক্রান্ত। একদল মানুষ ধর্মীয় উন্মাদনা এবং জিগিরে মেতে উঠেছে। এ ছাড়া আছে মূল্যবৃদ্ধি ও বেকার সমস্যা। তার ওপর জঘন্য নারী নির্যাতন। এর শেষ কোথায়? আজ এই প্রশ্ন সর্বস্তরের মানুষের মনে।
আজ থেকে ১০ দিন আগে কলকাতার সরকারি হাসপাতাল আর জি করে যে অমানবিক কাণ্ড ঘটেছে, তারই ফল ভোগ করতে হচ্ছে সারা পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে। হাসপাতালের ভেতরেই একজন জুনিয়র নারী ডাক্তারকে শুধু ধর্ষণ করাই হয়নি, তাকে অন্যান্য সব দিক থেকে আক্রমণ করে নৃশংসভাবে মেরে ফেলা হয়েছে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নির্বিকার। ঘটনার তিন ঘণ্টা বাদে মেয়েটির বাড়িতে খবর দেওয়া হয়। বিষয়টির প্রতিবাদে গোটা ভারতে সোচ্চার হয়েছেন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে শিক্ষাবিদ, ছাত্র, বিজ্ঞানী, শিল্পী। সব শ্রেণির মানুষ গর্জে উঠেছে। ব্যাপারটা এত গুরুতর যে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের চিফ জাস্টিস চন্দ্রচুড় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা করেন দোষীদের বিরুদ্ধে।
সেই মামলায় কোর্ট পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে এখনো কোনো রায় দেননি। মমতা অনেক চেষ্টা করে চলেছেন সুপ্রিম কোর্টে নিজেকে ও তার সরকারকে নির্দোষ প্রমাণ করার।
দেশের শীর্ষ আদালত নারকীয় এ ঘটনার তদন্তের ভার দিয়েছে কেন্দ্রীয় সংস্থা সিবিআইকে। গত তিন-চার বছরের যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, এ রাজ্যে ৩১ লাখ নারী নিগৃহীত ও ধর্ষিত হয়েছেন। মানুষ বুঝতে পারছে, সরকার চাকরি দিতে অপারগ, তাই নিজেদের দোষ ঢাকার জন্য যাবতীয় অভিযোগ শুধু অস্বীকার করেনি, রাজ্য সরকার দেশের সেরা আইনবিদদের নিজের পক্ষে লড়াই করার জন্য দাঁড় করিয়েছে।
কিন্তু চন্দ্রচুড় চাঁছাছোলা ভাষায় বলে দিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পুলিশের ওপরে সাধারণ মানুষের আস্থা চলে গেছে। আমরা এতদিন ধরে জানতাম, কলকাতা কল্লোলিনী তিলোত্তমা। সেই কলকাতা এখন হয়ে গেছে ধর্ষণ এবং দুর্নীতির আখড়া।
সিবিআই ইতোমধ্যে আর জি কর হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট ও প্রিন্সিপাল সন্দীপ ঘোষকে কঠোর জেরার মুখে ফেলেছে। ৯ দিন ধরে জেরা চলছে। এ লেখা যখন লিখছি, সন্দীপ ও তার আরও চারজন সহকর্মীকে লাই ডিটেক্টর দিয়ে জেরা করা হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের চিকিৎসক মহলের ধারণা, সন্দীপের কোনো সাজা না-ও হতে পারে, কারণ তিনি মমতার অত্যন্তও ঘনিষ্ঠজন। যখন রাজ্যবাসী প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমে পড়েছেন, ঠিক সেই সময়ে পুলিশের অত্যাচারও সব সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ কোথায় যাবেন?
ঘটনার কোনো বিরাম নেই। শুধু কলকাতা বা এ রাজ্যে নয়, গোটা ভারতে একটার পর একটা ঘটনা ঘটেই চলেছে। মনে হচ্ছে, গোটা রাজ্যে ধর্ষণ একটি শিল্পে পরিণত হয়েছে। এটা কোনো সাংবাদিকের কথা নয়, সাধারণ মানুষের মনের কথা। সবার মনেই একই প্রশ্ন- সাংবাদিকদের ওপরও অত্যাচারের মাত্রা শত গুণ বেড়ে গেছে।
বিশেষত বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোতে। মমতা ও বিজেপি কেউই রাজধর্ম পালন করছেন না। তাই প্রতিবাদে গত সপ্তাহে লাখ লাখ মেয়ে নিহত মেয়েটির জন্য বিচার চাই বলে সারা রাত রাস্তা দখল করেছেন। তার পর থেকে সব শ্রেণির মানুষ প্রতিদিনই মিছিলে শামিল হয়েছেন। যেন এক উৎসব।
যে পৈশাচিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাত দখলের এই কর্মসূচি, তার আড়ালে রয়েছে ভয়ংকর এক সত্য। শাসকদের প্রচণ্ড তৎপরতায় শেষ পর্যন্ত এই সত্য হয়তো আড়ালেই থেকে যাবে। এই সমাজে প্রতিনিয়তই চলে নারীকে প্রান্তিক করে রাখা, তাকে নানান মাত্রায় অসম্মান করার চেষ্টা, তাদের গতিবিধিকে সামাজিক অনুশাসন অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়াস।
নারীর নিজস্ব ইচ্ছা-অনিচ্ছা মূল্যহীন। এমনকি এই মর্মান্তিক ঘটনার পরও সেই মেয়েটির দিকেই ওঠে অভিযোগের আঙুল- রাতের বেলায় সে ওখানে কী করছিল, কেন গিয়েছিল ইত্যাদি প্রশ্নের মাধ্যমে মেয়েটির চরিত্র নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করা হয়। এমনকি ক্ষমতার শীর্ষে একজন নারী থাকলেও মেয়েরা এই প্রশ্নবাণ থেকে রেহাই পাননি।
ভারতের স্বাধীনতা দিবসের আগের রাতে সামাজিক অনুশাসনকে তোয়াক্কা না করে মেয়েরা রাত দখলের লড়াইয়ে এগিয়ে এসেছেন, বয়স-শ্রেণিনির্বিশেষে। এই প্রতিবাদের আয়োজন হয়তো প্রতীকী, কারণ এক রাতের কর্মসূচি সার্বিকভাবে এ রাজ্যে বা কোথাও মেয়েদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে পারবে না।
এ কথা কারোরই অজানা নয়। তবু মেয়েদের নেতৃত্বে এই প্রতীকী আন্দোলন নিঃসন্দেহে এক নতুন ইতিহাস রচনা করেছে এই স্থবির রাজ্যে। প্রকাশ্যে মেয়েদের স্বাধীনতার দাবি পশ্চিমবঙ্গকে নতুন মর্যাদা এনে দিয়েছে।
এখন পর্যন্ত জানা গেছে, আর জি কর হাসপাতালের সাবেক অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের বাড়িতে আর্থিক দুর্নীতি প্রসঙ্গে সিবিআই দীর্ঘক্ষণ জেরা করেছে। একই সঙ্গে ওই হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য চিকিৎসক, ঠিকাদার ও ব্যবসায়ীদের বাড়িতেও তল্লাশি অভিযান চালানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দলের আধিকারিকরা অন্তত ১৭টি জায়গায় হানা দেন।
আর জি কর কাণ্ড ঘিরে এই বৃহৎ জনজাগরণ পশ্চিমবঙ্গের সামনে এনে দিয়েছে এক বিরল সুযোগ, আত্মসম্মান ফিরে পাওয়ার সুযোগ। এই লড়াইকে পশ্চিমবঙ্গের জনগণ যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে পারলে তবেই ইতিহাস নতুন করে রচিত হবে।
কলকাতা তথা বাংলার সব গর্ব ধ্বংস হতে বসেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কল্যাণে। এর থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী? খোঁজ করছে ছাত্র-শিক্ষকসহ প্রত্যেক শিক্ষিত মহল, কিন্তু কোনো পথের নিশানাই পাওয়া যাচ্ছে না এখন অবধি। কলকাতা আর সে তিলোত্তমা নেই।
লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক