দীর্ঘদিন থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর সরকারি ছাত্রসংগঠনের নিয়ন্ত্রণ ছিল চোখে পড়ার মতো। বলা যেতে পারে, শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থা একধরনের ভীতি এবং শঙ্কার মধ্য দিয়ে এগিয়েছে সব সময়। এসব ভীতি ও শঙ্কার কারণে শিক্ষার্থীরা তাদের মেধাকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে। নিজেদের জীবন একধরনের রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় পরিচালিত হয়েছে বিধায় তারা তাদের মেধার যথাযথ বিকাশও ঠিকমতো করতে পারেনি। বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও শিক্ষার্থীরাও সম্পূর্ণভাবে শঙ্কা এবং ভীতি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। অবশ্য এর জন্য কিছুটা সময় লাগবে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম লক্ষ্য হলো দেশের সর্বস্তরে সংস্কার সাধন করা। আর এই সংস্কার রাতারাতি সম্ভব নয়। কিছুটা সময় নিয়ে সুচিন্তিতভাবে সামনে এগিয়ে সংস্কারের সঠিক পথ খুঁজে নিতে হবে।
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন থেকে তরুণ যুবগোষ্ঠীকে দক্ষ করে তোলার একটি দাবি রয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে আশানুরূপ ফল ইতোপূর্বে চোখে পড়েনি। তরুণ-যুবাদের মনে সব সময়ই নানা ধরনের হতাশা ও আশঙ্কা কাজ করে। তাদের নিজেদের দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় পরিমাপে আত্মবিশ্বাসের সংকট রয়েছে। তাদের বিদ্যমান এই শঙ্কা ও হতাশা দূর করতে হলে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে এবং ব্যক্তিগতভাবে জোরালো উদ্যোগ গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তরুণ-যুবগোষ্ঠীর জন্য উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়ন করতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সাংস্কৃতিক খাতে শুধু বরাদ্দ বাড়ানো নয়, সেটির যথাযথ ব্যবহার করার পরিবেশ তৈরি করা এখন সময়ের দাবি।
দেশের বেশির ভাগ জনগোষ্ঠী তরুণ। তাদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হলে দেশকে কোনোভাবেই এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ এই তরুণ গোষ্ঠীই সবচেয়ে বেশি সৃজনশীল এবং কর্মক্ষম। তাদের সৃজনশীলতা কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন দ্রুততর এবং টেকসই করা সম্ভব। আর এ জন্য শুধু রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ নয়, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগের যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু আমরা ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছি। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, দেশে বিনিয়োগের কার্যকর অনুকূল পরিবেশ নেই। বাংলাদেশ যদি আগামী দিনের কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে চায়, তা হলে অবশ্যই তরুণ-যুব সম্প্রদায়কে যথাযথ এবং দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলার প্রতি আন্তরিক দৃষ্টি স্থাপন করতে হবে।
আমরা জানি, দেশের শিক্ষার্থীরা অনেক মেধাবী। সঠিক সুযোগ পেলে তারা তাদের মেধার চমক দেখাতে পারে। শিক্ষকদেরও অনেকেই অত্যন্ত দক্ষ এবং মেধাবী- এটা স্বীকার করতেই হবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেক সময় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে সংযোগ হয় না এবং এই সমন্বয়ের অভাবে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী পড়াশোনায় তাদের মনোযোগ হারিয়ে ফেলেন। বিশেষ করে যেসব শিক্ষক প্রশাসনিক পদে থাকেন- তাদের লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি, চাটুকারিতা, উচ্চপদে যাওয়ার লোভ প্রভৃতি কারণে শিক্ষার্থীদের তুচ্ছ অবস্থানে রাখতে চায়। ওই সব প্রশাসকও শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের খড়্গ চাপিয়ে দেন। একদিকে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের চাপ, অন্যদিকে ওই সংগঠনের চাটুকার প্রশাসকদের কারণে প্রকৃত মেধাবীরা তাদের বিভিন্ন ধরনের সুযোগ থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হয়। ফলে তাদের মেধা ক্রমেই সংকটাপন্ন এবং মোষিত হতে থাকে। ফলে দেশের উন্নয়নে প্রকৃত মেধাবীরা এগিয়ে আসতে পারে না।
উচ্চশিক্ষায় আমাদের শিক্ষার্থীদের একাডেমিক এক্সপেরিয়েন্স অসম্ভব রকম ভালো করতে পারে যে বিষয়গুলো, তার মধ্যে ন্যায্য এবং যোগ্য একাডেমিক প্রশাসক নিয়োগ। আর এটা শুধু উচ্চশিক্ষায় নয়, শিক্ষার প্রতিটি স্তরেই দরকার। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যা নিরূপণে আরও বেশি গবেষণা করা দরকার। যে সমস্যা মোকাবিলায় শিক্ষা প্রশাসকদের যোগ্য এবং অবশ্যই প্রশিক্ষিত হতে হবে। প্রশাসকদের পরামর্শ শিক্ষার্থীদের ওপর কেমন প্রভাব ফেলছে তা নিরূপণ করার জন্যও নিয়মিত গবেষণা হওয়া উচিত।
কিন্তু শঙ্কার বিষয় হলো, দেশের প্রতিটি সেক্টর দুর্নীতিতে আক্রান্ত হয়েছে। দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ দেশ না হলে কোনোভাবেই তরুণ জনগোষ্ঠীকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হবে না। গত ২৬ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকাররের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার দেওয়া জাতির উদ্দেশে ভাষণে উল্লেখ করেন, ‘দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে দুর্নীতি। এমন এক দেশে আমাদের দেশ রূপান্তরিত হয়েছে, যেখানে স্বৈরাচারের পিয়নও দুর্নীতির মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার সম্পদ করার মতো অকল্পনীয় কাজ করে গেছে নির্বিবাদে। শিক্ষা খাতকে পঙ্গু করে দিয়েছে, ব্যাংকিং ও শেয়ারবাজার খাতে লুটপাট, প্রকল্প ব্যয়ে বিশ্ব রেকর্ড, অবাধ সম্পদ পাচার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাকে নিজ দলের পুতুলে রূপান্তর, বাকস্বাধীনতা হরণ, মানবাধিকার হরণ- এসবই হিমশৈলের অগ্রভাগ মাত্র।’ এমন সংকটময় পরিস্থিতি থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হয়ে দেশকে সুন্দরভাবে সাজাতে না পারলে কোনোভাবেই শিক্ষার্থীদের স্বপ্নকে যথাযথভাবে পূরণ করা সম্ভব নয়।
প্রায়ই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমার কথা হয় তাদের বিদ্যমান দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে। মূলত তারা কীভাবে জীবন অতিবাহিত করছে, তাদের আগামীর সম্ভাবনাটা কেমন- এসব বিষয়ে বেশি আলাপ হয়। এটি জানতে কিংবা বুঝতে কারও অসুবিধাই হবে না যে, বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশেও বেকারত্ব বেড়ে চলেছে। যদিও বেকারত্ব বাংলাদেশের একটি নিয়মিত সংকট। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটি ক্রমেই অস্বাভাবিক রূপ ধারণ করছে। কর্মসংস্থানের অভাব এ দেশের উচ্চশিক্ষিত বেকারদের জীবনযাপনে সব সময়ই একটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বর্তমানে ওই সব নেতিবাচক প্রভাবের ধরন আরও তীব্র মাত্রায় সামনে এসেছে।
বেকার শিক্ষার্থীদের সামনে অনেক অন্ধকার থাকলেও বাংলাদেশের মতো একটি সম্ভাবনাময় দেশে তারা স্বপ্ন দেখে প্রতিনিয়ত। অনেক সময় স্বপ্নই তাদের বাঁচার একমাত্র অবলম্বন হয়। উচ্চশিক্ষিতদের মূল অবলম্বনই হলো একটি ইতিবাচক স্বপ্ন। তারা স্বপ্ন দেখে, শিগগিরই একটি ভালো কিছু হবে। তারা একটি চাকরিতে আবেদনের সময়েই স্বপ্ন দেখতে শুরু করে যে, ওই চাকরিটা হবে। এভাবে একের পর এক চেষ্টা করতে করতে হয়তো ধরা দেয় সেই কাঙ্ক্ষিত চাকরিটি। এখন বেসরকারি খাতে চাকরির বিজ্ঞাপন নেই বললেই চলে। বলা যায়, বেসরকারি খাতে সম্ভাবনাগুলো শেষ হয়ে গেছে। অনেকেই চাকরিচ্যুত হয়েছেন এবং হচ্ছেন। নানা সংকটে ওই চাকরিচ্যুতরা জীবন অতিবাহিত করছে।
কাজেই সার্বিকভাবে বলা যায়, বিভিন্ন প্রেক্ষিতেই বর্তমান এবং সদ্য পাস করে যাওয়া শিক্ষার্থীরাই এখন সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। শিশু থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা সবাই কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং হচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে বর্তমান অন্ধকার পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে সুস্পষ্ট পরিকল্পনা দাঁড় করানোর চিন্তাভাবনা শুরু করা দরকার। যাতে দ্রুততম সময়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে আমূল সংস্কার করে তরুণ জনগোষ্ঠীকে দেশের উন্নয়নে শতভাগ কার্যকর করে তোলা যায়।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]