আমাদের মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকা সাহায্য করেনি। সাহায্য করবে কী, যতভাবে পারে বিরোধিতা করেছে। কারণ ওই একই। তাদের ধারণা ছিল, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে রাষ্ট্রটি চরমপন্থিদের হাতে চলে যাবে। চরম বলতে তারা আওয়ামী লীগকে মনে করেনি, বামকেই মনে করেছে। এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, শুরুতে শেখ মুজিবুর রহমান মোটেই মার্কিনবিরোধী ছিলেন না। তিনি ছিলেন সোহরাওয়ার্দীপন্থি এবং সোহরাওয়ার্দী ছিলেন ঘোরতর মার্কিনপন্থি।
আওয়ামী লীগ ভেঙে যখন ন্যাপ বের হয়ে যায়, তখন শেখ মুজিব যে ন্যাপের অর্থাৎ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার লাইন নেবেন, এটা অস্বাভাবিক ছিল না। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী জীবিত থাকলে শেখ মুজিব ছয় দফা দিতে পারতেন কিনা সন্দেহ। দিতে হলে বিদ্রোহ করতে হতো। ১৯৭১-এ আমেরিকানদের বিশ্লেষণ ছিল যে, শেখ সাহেব চরমপন্থিদের হাতে পড়ে গেছেন, তার পক্ষে আর বের হয়ে আসা সম্ভব নয়। তবু তারা আশা ছাড়েনি।
যুদ্ধ যখন চলছে, সেই সময়ে আওয়ামী লীগের দক্ষিণপন্থি নেতা খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে তারা গোপনে যোগাযোগ করেছে, চরমপন্থিদের (তাদের ভাষায়) হাত থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদী (তাদের ভাষায়) আন্দোলনকে উদ্ধার করার জন্য। সফল হয়নি, তাই বাংলাদেশকে শেষ পর্যন্ত তারা মেনে নিয়েছে। মেনে নেওয়ার পর স্বভাবতই তাদের চেষ্টা ছিল দেশের ভেতরে নিজেদের শক্তির ভিতকে শক্ত করা। প্রথমে কথা ছিল, বাংলাদেশ সরকার মার্কিন সাহায্য নেবে না। পরে কথা দেওয়া হলো, নেবে, তবে শর্তহীন হতে হবে। আরও পরে শর্ত তো মানা হলোই না, উল্টো কোন সরকার কতটা সাহায্য আনতে পারে তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল।
স্বৈরাচারবিরোধী বিগত আন্দোলনে গৌরবের দিক ছিল এটা যে, রাস্তার মানুষ আপস করতে চায়নি। লজ্জার দিক ছিল যে, বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ উভয়েই বিদেশিদের প্রতি অনুগত। সরকারবিরোধী বড় দল যখন মুরুব্বির কাছে গিয়ে তদবির করে তখন বোঝা যায় যে, সরকার পরিবর্তন হবে হয়তো, তবু দেশের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না। হ্যাঁ, সরকার পরিবর্তন হয়েছে বৈকি, কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। বিদেশ-নির্ভরতা কমবার কোনো লক্ষণ নেই। নির্ভরতা বরঞ্চ বেড়েই চলেছে। অর্থনীতির সব নীতিই এখন মোটামুটি বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের নিয়ন্ত্রণাধীন। বিরাষ্ট্রীয়করণের নীতি আগেই পরিত্যক্ত হয়েছিল, এখন বাজার অর্থনীতির পোয়াবারো চলবে।
এই যে ‘উন্নতি’র ধারা এরই প্রতিফল হচ্ছে দেশে বৈষম্য ও দারিদ্র্য বৃদ্ধি এবং হেফাজত ও জামায়াতের শক্তি সঞ্চয়। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে তাদের সঙ্গে বুর্জোয়াদের তফাত আকাশ-পাতালের। তা বটে। আচার-আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদিতে তফাত আছে, ভাষাও হয়তো ভিন্ন। কিন্তু এসবই আপাতত মাত্র। ভেতরে উভয়েই সমান রাঙা। উভয়েই চায় দেশে একটি আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা ক্রমাগত শক্তিশালী হোক। বুর্জোয়ারা চায় এই রাষ্ট্রে তথাকথিত আধুনিকতার চর্চা হবে, জামায়াত ও হেফাজত চাইবে চর্চা ঘটুক পুরাতনের। একপক্ষ বুর্জোয়া সংস্কৃতি চায়, অপরপক্ষ চায় সামন্তবাদী সংস্কৃতি। কিন্তু অবকাঠামোতে, অর্থাৎ অর্থনীতিতে, উভয়পক্ষেরই লক্ষ্য পুঁজিবাদী ব্যবস্থা।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ফলে উপরকাঠামোতে পরিবর্তন ঘটেছিল। নতুন রাষ্ট্র, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে উৎসাহ- এসব সৃষ্টি হয়েছিল; কিন্তু অর্থনৈতিক কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। উপরকাঠামোতেও সামন্তবাদী উপাদান যেগুলো ছিল সেগুলো রয়েই গেল; বরঞ্চ হতাশা, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, কুসংস্কার, সর্বোপরি পুরাতন অভ্যাসের দরুন সামন্তবাদী উপাদানগুলো ক্রমাগত শক্তিশালী হয়েছে। ওদিকে দুর্বল এবং গ্রহ-নক্ষত্রে বিশ্বাসী বুর্জোয়ারা যে উন্নত কোনো সাংস্কৃতিক আদর্শ স্থাপন করবে, তাও পারেনি। আধুনিক ব্যান্ডবাদকেরা পুরাতন মাইজভান্ডারী গান ধরেছে; চলচ্চিত্রের উন্নত প্রকৌশল ব্যবহৃত হয়েছে রূপকথা, জমিদার, গুন্ডা-বদমাশ ও পীর-ফকিরের কাহিনি নিয়ে চিত্রনির্মাণে। পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদের যৌথ তৎপরতা চমৎকার নিদর্শন সন্দেহ কী। পর্যুদস্ত হচ্ছে শিল্প-সংস্কৃতির সুস্থ ধারা, যে ধারা গণতান্ত্রিক ও ইহলৌকিক, আধুনিক ও মানবিক। অর্থনৈতিক অবকাঠামোটি কী হবে তা নিয়ে কিছুটা দ্বিধা আছে। সংবিধানে সমাজতন্ত্রের কথা স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছিল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে অর্থনীতিকে সেদিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়নি।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্তকরণ না করে উপায় ছিল না। কিন্তু এই অনিবার্য কাজের ফলে সমাজতন্ত্রের কোনো সুবিধা হয়নি, সুবিধা যা হওয়ার হয়েছে সমাজতন্ত্রবিরোধী আমলা ও টাউটদের। ওদিকে সবচেয়ে বড় যে উৎপাদন এলাকা, কৃষি, তা ব্যক্তিমালিকানাতেই রয়ে গেছে, আগে যেমন ছিল। শেখ মুজিবের সময়ে তবু দ্বিধা ছিল, পরের সরকারগুলো ছিল সব দ্বিধা-দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে। তারা ছিল পুঁজিবাদের নিরাবরণ সমর্থক। বস্তুত, তাদের ক্ষমতা গ্রহণ সম্ভব হয়েছিল পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারের দরুনই। দ্বিধান্বিত শেখ মুজিবকে সরিয়ে নিয়ে দ্বিধাহীন জিয়াউর রহমান এলেন।
বিরাষ্ট্রীয়করণ ও বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের ব্যস্ততার ভেতর দিয়ে তিনি পুঁজিবাদের জন্য খাল নয়, রাস্তাই বরঞ্চ প্রশস্ত করে দিলেন। কিন্তু পুঁজিবাদ ক্রমেই অস্থির ও হিংস্র হয়ে উঠছিল; জিয়াকেও তার যথেষ্ট অনুগত মনে হয়নি। তাই তাকেও সরিয়ে দিল। নিয়ে এল এরশাদকে, যিনি আর কোনো ঝামেলা করলেন না, সামরিক-বেসামরিক আমলা এবং লুটপাটকারী টাউট ও ব্যবসায়ীদের জন্য সব দরজা খুলে দিলেন। বাংলাদেশের পুঁজিবাদের অগ্রগমন আরও শক্তিশালী হলো। বর্তমান সরকারও কিন্তু পুঁজিবাদী বিকাশের ব্যাপারে সমান কৃতসংকল্প। এই আমলেও বাজারব্যবস্থার থাবা মনে হয় আরও শক্ত হবে। লোক ও সাইন বোর্ডের তফাত, অর্থনৈতিক আদর্শ একই।
লক্ষ্য করবার বিষয়, এ পর্যন্ত কোনো সরকারই হেফাজত ও জামায়াতকে তাদের প্রধান শত্রু মনে করেনি। এমনকি শেখ মুজিবুর রহমানও নন। তিনি বামপন্থিদের একাংশকে দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ দিয়েছেন, এবং ওই হাতেই নির্দেশ দিয়েছেন রাজাকার আলবদরদের ক্ষমা করার। পক্ষপাতটা খুবই স্পষ্ট ছিল সেদিন। তার রক্ষীবাহিনী বহু বামপন্থিকে গুম করে দিয়েছে। ‘কোথায় সিরাজ সিকদার’ বলে তিনি গর্ব করেছিলেন; ‘কোথায় আলবদর-রাজাকার’ বলে গর্ব করেননি। ঠিক তেমনি জিয়াউর রহমানের আমলেও দেখেছি একদিকে কর্নেল তাহের নিহত হচ্ছেন, অন্যদিকে অধ্যাপক গোলাম আযম ফেরত আসছেন। একই নীতির দুটি দিক। এরশাদের আমলে স্বাধীনতাবিরোধীরা আরও তৎপর হয়েছে অনুকূল পানি পেয়ে। জিয়াউর রহমান ধর্মনিরপেক্ষতা শেষ করেছিলেন, এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম প্রবর্তন করে আরও এক কাঠি এগিয়ে গেলেন।
এতসব কথার ভেতর আসল কথাটা হলো এই যে, আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ফেরত এসেছে, তাই তার সুবিধাভোগী ও অনুচর লুটেরা ধনী ও ধর্মান্ধপন্থি; এরাই শক্তিশালী হয়ে উঠবে। এই মূল ঘটনাটা না বুঝলে আমরা লক্ষণ দেখেই উত্তেজিত হব শুধু, তাতে রোগের নিরাময় হবে না। পুঁজিবাদী দেশগুলোতে দেখা যায় যে, দরিদ্র এলাকাগুলোতে একই সঙ্গে ড্রাগ-ব্যবসায়ী ও পাদ্রিরা অত্যন্ত তৎপর। দরিদ্র এলাকায় বাড়িঘরগুলো দরিদ্র, কিন্তু মদের দোকান ও গির্জাগুলো চোখে পড়বার মতো উজ্জ্বল। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার নিয়ম এটাই। ধনীরা এগিয়ে যাবে, গরিবরা বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক উভয়বিধ সুরাপান করে মাতলামি করবে। এর ব্যতিক্রম অন্যত্র নেই, বাংলাদেশে কেন ঘটবে?
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়