এর মধ্যে একটা বিচিত্র ধরনের প্রদর্শনী দেখার সুযোগ হলো। আমি সিনিয়রদের মধ্যে সিনিয়র সিটিজেন হওয়ার কারণে এবং টাকমাথা ও অল্পস্বল্প সম্পূর্ণ সাদা চুলে সেটা বিশ্বাসযোগ্য করে রাখি বলে, বেশির ভাগ সময়ে নানা প্রদর্শনীর উদ্বোধন ব্যাপারটার সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে দেওয়া হয়। আগে যখন একটা পদে ছিলাম তখন লোকেরা বলত, আমি পকেটে একটা ছোট কাঁচি নিয়ে ঘুরে বেড়াই, যাতে ফিতে কাটার ডাক এলেই আমি প্রস্তুত থাকতে পারি। এটা একটু অতিরঞ্জিত, কারণ যাদের ফিতে কাটার তারা নিজেরাই চমৎকার কাঁচি তৈরি রাখেন। তবে এখন আর কাঁচি-ফিতের উদ্বোধন তত হয় না। প্রদীপ জ্বালানো, জলভর্তি গামলায় ফুল বা ফুলের পাপড়ি ঢালা, টবভর্তি মাটির গর্তে চারাগাছ রেখে তার গোড়ায় জল ঢালা- ইত্যাদি নানা অভিনব উপায়ে উদ্বোধন হয়, তাই আমার পকেটে কাঁচির দুর্নাম এখন একটু স্তিমিত হয়েছে।
কিন্তু এ প্রদর্শনীটা ঠাট্টা করার মতো বিষয় নয়। পনেরোই আগস্টে উদ্বোধন হলো, তার কারণ প্রদর্শনীটির বিষয় ‘পনেরো আগস্টের দিকে’। অর্থাৎ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে পেছন ফিরে তাকানো। উদ্বোধন হলো মায়া আর্টস স্পেসে, যেটা শুনেছিলাম মধুচ্ছন্দা সেনের নির্মাণ। মধুচ্ছন্দার স্বামী একজন বিখ্যাত গায়ক এবং বর্তমান সরকারের মন্ত্রীও বটে, কিন্তু সে বিখ্যাত স্বামীর স্ত্রীর পরিচয়ের বাইরে নিজের একটা স্বাধীন আর সম্ভ্রান্ত পরিচয় তৈরি করেছে, বাড়িতে একটি প্রশস্ত প্রদর্শনী কক্ষ আর প্রকাশনা সংস্থা তৈরি করে। সবটাতেই সৌন্দর্য, রুচি, স্বাচ্ছন্দ্য আর আভিজাত্য-চিহ্নিত তার কাজের ঘরে বসলেই চারদিকে নানা শিল্পীর ছবি আপনার দিকে তাকিয়ে থাকবে। তারই প্রশ্রয়ে ‘কলকাতা কথকতা’ বলে একটি ওয়াটসঅ্যাপ সংস্থা এই প্রদর্শনীটির আয়োজন করেছিল।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, স্বাধীনতা সংক্রান্ত প্রদর্শনী, তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী? আমি স্বাধীনতা-সংগ্রামী নই, ঐতিহাসিক নই, নেতা নই- আমাকে কেন ডাকা হবে উদ্বোধন করতে? সেটা উদ্যোক্তারা জানে, বোধ হয় আমার মতো টাকমাথা আর স্বাধীনতার এক যুগেরও বেশি আগে জন্মানো বুড়ো আর হাতের কাছে পায়নি বলে। আপনারা জানেন, প্রায়ই বার্ধক্য একটা ‘যোগ্যতা’ হয়ে যায়, তার অযৌক্তিক কিছু সুবিধেও পায়। একবার বাংলাদেশ থেকে পথে ফিরছিলাম, বর্ডারে বাংলাদেশের দিকে দীর্ঘ লাইন- কিন্তু একজন প্রহরী আমাকে সামনে নিয়ে গেলেন। বললেন, আমরা বাংলাদেশে ‘মুরুব্বি’দের খুব সম্মান করি। তাই দেখছি, ‘মুরুব্বি’ হওয়ার নানা সুবিধে।
যাই হোক, এতে আমারই বেশ লাভ হলো- প্রদর্শনীটি দেখে আমি বেশ ‘শিক্ষিত’ হলাম বলা চলে, আর আনন্দও পেলাম। স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ের নানা চিহ্ন, আন্দোলনের মূলধারার যেমন, তেমনই বিপ্লবীদেরও নানা স্মৃতি রক্ষা করেছেন বেশকিছু উৎসাহী মানুষ। বেশকিছু পুরোনো কাগজের কর্তনী, বিজ্ঞাপন, কংগ্রেসের নানা সম্মেলনের প্রস্তাবের ছবি, খান আবদুল গফ্ফর খানের সই, গান্ধীজি ও পণ্ডিত নেহরুর হতের লেখা- কত কী? অন্যদিকে বিপ্লবী গণেশ ঘোষের চিঠি, আন্দামানে তার পড়া বই, বীণা দাশের সই করা বই- সে সবও ছিল। ছিল এমন অনেকের নিজেদের হাতের লেখা চিঠি। এগুলো শ্রী অরূপ রায়ের সংগ্রহ। তিনি শতাধিক স্বাধীনতা সংগ্রামী তথা বিপ্লবীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। পরিমল রায় উপহার দিয়েছেন স্বদেশি অ্যানামেল বোর্ড ও সূচিশিল্পের নানা নিদর্শন। আশুতোষ কলেজের রাশিবিজ্ঞানের অধ্যাপক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ও সংগ্রহ করেছেন বিপ্লবীদের চিঠি, খবরের কাগজের সংবাদ, আর নানা রকমের স্মারকবস্তু। দেখে তো আমি তাজ্জব। এত সব জিনিস এরা বসে বসে সংগ্রহ করেছেন, যত্ন করে রক্ষা করেছেন- মূল্যবান ইতিহাসের চিহ্ন হিসেবে। ফাল্গুনী দত্ত রায় এনেছেন পুরোনো প্রচুর ছবি আর নানা নথি ও দলিল। মলয় সরকার দিয়েছেন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দুষ্প্রাপ্য স্বাক্ষরের নমুনা। অনিন্দ্য কর আর রবি শর্মা এনেছেন স্বাধীনতার আগেকার মুদ্রা আর নোটগুলোর ধারাবাহিক বিবর্তনের নমুনা, তাই বা কজনের দেখার সুযোগ ঘটে? হাজার টাকা থেকে এক টাকা পর্যন্ত প্রতিটি নোট প্রথম কবে ছাপা হয়েছিল, আর তার শেষতম রূপ কী দাঁড়াল, কোনো কোনোটি লুপ্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত- তার ছবি দেখে শরীরে রোমাঞ্চ হয়। কেউ এনেছেন স্বাধীনতার আগেকার দেশি দিয়াশলাই, আস্ত নমুনা ও তার বিজ্ঞাপন; কেউ এনেছেন খাদি বস্ত্রের দেশি দোকানের বিজ্ঞাপন ও পুরোনো চরকার ছবি। কেউ রেখেছেন দেশি কালি ও কলম, শিশিতে সেই কালির বড়ি- যে বড়ি গুলে আমরা এক সময় কালি তৈরি করতাম। কেউ রেখেছেন পুরোনো খবরের কাগজ- শুধু এই সেদিনের অধুনালুপ্ত ‘যুগান্তর’ নয়, সেই কবেকার Friend of India-র কপি দেখলাম এই চর্মচক্ষে- কেমন যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। প্রসিদ্ধ সংগ্রাহক জয়ন্ত ভট্টাচার্য প্রচুর নিদর্শন সাজানোর পাশাপাশি একটি বইও প্রস্তুত করেছেন ইংরেজিতে এসব উপাদান দিয়ে। পাতায় পাতায় রঙিন ছবি তার, বেশ বড় হবে বইটি, দামিও হবে। সেটিও হবে সংগ্রাহকদের কাছে লোভনীয় এক প্রকাশনা। সেদিন বইটির ‘ডামি’ দেখানো হলো দর্শকদের। কিছু দর্শকের ভিড় হয়েছিল সেদিন।
সবার নাম, বা সব দ্রষ্টব্যের কথা হয়তো গুছিয়ে লিখতে পারলাম না। কিন্তু এদের কাছে একদিকে যেমন জাতির কৃতজ্ঞ থাকা উচিত- এই কারণে যে, এরা গভীর মমতার সঙ্গে এসব দুর্লভ নিদর্শন রক্ষা করছেন, তেমনই ঐতিহাসিকদেরও কৃতজ্ঞ থাকা উচিত যে, তাদের ইতিহাস রচনার জন্য কী অশেষ মূল্যবান তথ্যবস্তু এরা প্রস্তুত রেখেছেন। এগুলো ‘অণু-ইতিহাসের’ উপাদান, কিন্তু এগুলো থেকেই তো ‘মহা-ইতিহাস’ রচিত হবে। আর কলকাতার কথকতার চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় নিজেও সংগ্রহক বটে। তার সংগ্রহ থেকে পেলাম একটি অভিনব ‘তাসের’ সংগ্রহ, যেগুলোতে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ছবি দেওয়া। বেশকিছু ওই সময়কার ডাকটিকিটও ছিল। তাকে আলাদা করে ধন্যবাদ, কারণ এদের সে একটি ওযাটসঅ্যাপের দলে যুক্ত করেছে, এবং সবার কাজকে এই প্রদর্শনীতে দেখানোর ব্যবস্থা করেছে, মধুচ্ছন্দাও যত্ন করে তকে আশ্রয় দিয়েছে। এমন প্রদর্শনী তো সারা দেশে সর্বত্র হওয়া দরকার।
দেশের ইতিহাস এসব নমুনা আর বইপত্র থেকে আমাদের শিশুদের স্মৃতিতে কীভাবে পৌঁছবে, কীভাবে তারা ওই ইতিহাসের পটভূমিতে নিজেদের অবস্থান তৈরি করবে, তা সব দেশের কাছেই একটা চ্যালেঞ্জ। প্রতিবেশী নানা দেশে আমরা তার বিপর্যয় নানা সময়ে লক্ষ করি। আমাদের এই নানা ভাষা, নানা সংস্কৃতির দেশে সেটা আরও বড় একটা চ্যালেঞ্জ। আমরা যেন এই প্রদর্শকদের সাহায্য ও সমর্থন নিয়ে এই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারি।
লেখক: ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়