দেশে বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়েছে। একটি বড় পরিবর্তনের পর সবারই নানা ধরনের চিন্তাভাবনার বহিঃপ্রকাশ থাকে। ’৭১-এ আমরা স্বাধীনতা দেখেছি এবং একটি নতুন দেশ পেয়েছি। এরপর আমরা ধারাবাহিকভাবে অনেক ধরনের পরিবর্তনের মুখোমুখি হয়েছি। সেই পরিবর্তনেরই আরেকটি পর্যায় আমরা এখন দেখছি।
পরিবর্তনের এই ধারায় দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে একটা বড় ধরনের সংস্কার খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দলীয় রাজনীতিমুক্ত করার পদক্ষেপ নিতে হবে। তা ছাড়া অনেক দিন ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হল-বাণিজ্য শুরু হয়েছে। দলীয় রাজনীতির কারণে মেধাবীরা পড়াশোনার পরিবর্তে নানা রকম বাণিজ্যের মধ্যে পড়ে গেছে।
বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসেছে। শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠনের জন্য তাদের ব্যাপকভাবে সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করা দরকার। সংস্কারের নানাবিধ কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। তবে তা এখনো বিক্ষিপ্তভাবে আছে। সেগুলো গবেষণার মধ্যে নিয়ে আসা দরকার। শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তনটি বড়, একই সঙ্গে ব্যাপক আকারে হওয়া দরকার। সে জন্য আমাদের ধৈর্য ধারণ করতে হবে। নতুন সমস্যা এলে আমরা আবার ভিন্নমুখী হয়ে যাই। আমরা দেখতে পাচ্ছি, এরই মধ্যে ছাত্র-শিক্ষক অনেকেই নানামুখী সমস্যায় পড়ে গেছেন। সেগুলো বন্ধ করা জরুরি।
যারা দুর্নীতি অথবা ক্ষমতার অপব্যবহারের মধ্যে আটকে থাকে, তাদের এহেন আচরণ পরিবর্তন করা দরকার। দুর্নীতির মাধ্যমে এমন কিছু হয়েছে, সেগুলোর পরিবর্তন দরকার। তবে একটি ভালো পরিবর্তনের জন্য দুই সপ্তাহ খুব একটা বেশি সময় নয়। সে জন্য আমাদের কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যেভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়, সেই নিয়োগ-প্রক্রিয়া নানা কারণেই প্রশ্নবিদ্ধ। প্রথমে সরকার নিয়োগ দেয় এবং সেটাকে প্রমাণ করার জন্য নির্বাচনে যেতে হয়। যখনই নির্বাচনে যাওয়া হয়, তখনই সেটা দলীয়করণ হয়ে যায়। দলীয়করণে আবার বিভিন্ন ধরনের গ্রুপ তৈরি হয়; যেমন- নীল দল, সাদা দল, লাল দল ইত্যাদি। এগুলো পরিবর্তন করা খুব দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যদি আমরা নির্বাচনে নিয়ে আসি, সেটি বোধহয় ভালো কথা নয়। এসব ক্ষেত্রে দেখা যায়, একজন প্রফেসর একজন লেকচারের কাছে ভোট চাচ্ছেন। তিনি আবার রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঘোরাফেরা করছেন, যাতে করে তার নামটা যায়।
এসব সংস্কৃতি চললে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ঠিক করতে পারব না। এ ধরনের সংস্কৃতি পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে নেই। একমাত্র বাংলাদেশেই এসব নির্বাচনের মাধ্যমে শিক্ষকদের দলভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে গেছে একটি রোল মডেল। সব ধরনের আন্দোলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করা হয় এবং সেখানে বিভিন্ন দল ঢুকে পড়ে শিক্ষাঙ্গনের সুস্থ গতিধারাকে কলুষিত করে। সেদিক বিবেচনা করে অবশ্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় ধরনের সংস্কার খুব দরকার।
একজন ভালো মানুষ অথবা নিরপেক্ষ একজন লোককে বসিয়ে দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, ব্যাপারটা ঠিক এমন নয়। বিশেষ করে ভিসি নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয়করণ হয়ে গেলে তিনি দলের বাইরে বিশ্ববিদ্যালয় অথবা সাধারণ ছাত্রদের জন্য তেমন কিছু করতে পারেন না। ফলে শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে বড় ধরনের একটা ব্যবধান তৈরি হয়ে যায়। এই ব্যবধানটুকু অবশ্যই বন্ধ করা দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মেধাবৃত্তিক সংস্কৃতি তৈরি করতে হলে বড় ধরনের সংস্কার ব্যতীত তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের মতভেদ আছে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৯৩ শতাংশ ছাত্র শিক্ষাঙ্গনকে রাজনীতিমুক্ত দেখতে চায়। এই রাজনীতি বলতে দলীয় রাজনীতিকে বোঝায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা গঠনমূলকভাবে রাজনীতি করবে। রাজনীতি নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা হবে। তারা তাদের দাবিদাওয়া পেশ করবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। মেধাভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি সমস্যা নয়।
তবে দলভিত্তিক শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। শিক্ষকরা যে রাজনীতি করেন তারা মূলত পদ পাওয়ার জন্য রাজনীতি করেন। সে ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ড’ তৈরি করতে পারেনি। একটি বিশ্ববিদ্যালয় একটি নতুন দেশ তৈরি করতে পারে। কিন্তু আজকাল দেখা যায়, দেশের মেধাবীরা, যাদের হাতে আগামীর ভবিষ্যৎ, তারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনার ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। তা ছাড়া দেশের যারা নীতিনির্ধারক তাদের ছেলেমেয়েরাও দেশে পড়াশোনা না করে দেশের বাইরে চলে যায়। কাজেই তাদের মধ্যেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা গ্রহণের সুস্থ পরিবেশ তৈরি করে দিতে একধরনের উদাসীনতা দেখা যায়।
মেধাবীদের দেশে রাখতে হবে; অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা মেধাবী শিক্ষকদেরও দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। সে জন্য শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় বড় আকারের সংস্কার দরকার। এখন যারা দায়িত্বে আছেন তাদের মূল কাজ হবে শিক্ষাব্যবস্থার বড় ধরনের সংস্কার ঘটানো। সেটা না করে যদি সেই রাজনৈতিক পরিচয়ধারী শিক্ষকদের বসানো হয়, তাহলে ছাত্ররা দলীয় রাজনীতির মধ্যেই ঘুরপাক খেতে থাকবে। সে ক্ষেত্রে ভালো কিছু আশা করা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয় হলগুলোতে পরিবর্তন আবশ্যিক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল সমস্যা শিক্ষক রাজনীতিতে, ছাত্ররাজনীতিতে নয়। শিক্ষকদের রাজনীতি বাদ দিয়ে প্রথমত পড়াশোনায় মনোযোগী হতে হবে। গবেষণার সময় দিতে হবে। ছাত্রদের কাছে ডাকতে হবে। তাদের কাজের পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। তখন স্বাভাবিকভাবেই ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষকের সঙ্গে একই সঙ্গে মাঠপর্যায়ে কাজের আগ্রহ সৃষ্টি হবে। শিক্ষার্থীরা শিখতে চায় ও জানতে চায়। কিন্তু শিক্ষার্থীরা যখন দেখে শিক্ষক ডিন অথবা ভিসি হয়ে যাচ্ছেন, অথচ সেই অর্থে কোনো চর্চা নেই, প্রকাশনা নেই, তখন ছাত্ররা শিক্ষককে মূল্যায়ন অথবা সম্মান করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
ছাত্রছাত্রীরা যখন দেখবে শিক্ষকরা নিজেরা রাজনীতি, দুর্নীতি বাদ দিয়ে গবেষণামুখী হয়েছে, বাংলাদেশের উন্নয়ন কীভাবে হবে সেগুলো নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, বিভিন্ন ধরনের জার্নাল তৈরি হচ্ছে, সেমিনার হচ্ছে, একই সঙ্গে তারা দলীয় রাজনীতির মধ্যে নেই- স্বাভাবিকভাবেই ছাত্রছাত্রীরা তখন উৎসাহী ও মনোযোগী হবে এবং সেটাই হবে নতুন রোল মডেল। দলীয় রাজনীতি করলেই আগামীকাল আমিও চ্যান্সেলর হয়ে যেতে পারি; এ মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। গঠনমূলক সংস্কারের মাধ্যমে শিক্ষাঙ্গনকে কী করে দলীয় রাজনীতিমুক্ত করা যায়, সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে।
সে ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোকে উদাহরণ হিসেবে নেওয়া যেতে পারে। তাহলে ছাত্ররা পড়াশোনার বিষয়ে নতুন করে মনোযোগী হয়ে উঠবে। তাদের মধ্যে এই ধ্যান-ধারণা হবে না যে, রাজনীতি করে আমি অনেক কিছু হয়ে যেতে পারি। কাজেই যদি গঠনমূলক পরিবর্তন ঘটানো যায়, তাহলে ছাত্ররাও নতুনভাবে মনোযোগী হবে। সবকিছু রাতারাতি সম্ভব হবে এটা মনে করা অমূলক। ভালোভাবে সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে সময় দিতে হবে। সত্যিকার অর্থে পরিবর্তন হতে যাচ্ছে কি না অথবা সঠিকভাবে অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে কি না; সে জন্য আমাদের আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষক