হুমায়ূন আহমেদের একটি নাটকের অংশ। বাবা আসাদুজ্জামান নূর তার দুই শিশুসন্তানের সঙ্গে কথা বলছিলেন। স্কুলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত তারা। হঠাৎ স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠল। বাবা তার দুই সন্তানের (একজন ছেলে অন্যজন মেয়ে) উদ্দেশে বললেন, স্বাধীনতা হচ্ছে নিজের ইচ্ছেমতো বাঁচবার অধিকার। ধরো, আমি যদি নিজের ইচ্ছেমতো চলাফেরা করি, অন্যের কথায় না, তাহলে আমি স্বাধীন বলা যাবে। মানে আমি যদি কিছু করতে চাই, সেটা অন্য কারও কথায় নয়।
বাবার কথা শুনে ছেলে বলল, বাবা আমার যে খুব স্বাধীন হতে ইচ্ছে করে।
বাবা অবাক হয়ে ছেলেকে প্রশ্ন করলেন, বুঝলাম না। স্বাধীন হয়ে তোমরা কী করবে?
ছেলে বলল, নিজের ইচ্ছেমতো থাকব। স্কুলে যাব না। সন্ধ্যেবেলা পড়তে বসব না।
বাবা ও ভাইয়ের কথা বেশ মনোযোগসহকারে শুনছিল ছোট্ট মেয়েটি। ভাইয়ের কথায় সায় দিয়ে বলল, দুধ খাব না।
ছেলে বলল, ভাতও খাব না।
বাবা ভেবে নিয়ে বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে, এখন থেকে তোমাদের যে কাজ করতে ইচ্ছে করবে না, সে কাজগুলো আর তোমাদের করতে হবে না। তোমরা পুরোপুরি স্বাধীন।
ছেলে খুশি হয়ে বাবাকে বলল, সত্যি..?
বাবা বললেন, হু...।
ছোট্ট মেয়ে বলল, বাবা আমি জামা খুলে ফেলব?
প্রিয় পাঠক, নাটকের আরও কিছু অংশ বাকি আছে। পরে লিখছি। তার আগে একটু বরিশালে যেতে চাই। বরিশাল সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ ক্যাম্পাসে একটি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কলেজটির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে অতি সম্প্রতি। সংঘর্ষে উভয় পক্ষে প্রায় দেড় শ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। আহত অনেকের অবস্থা গুরুতর। ঘটনার সূত্রপাত কিন্তু লেখাপড়াসংক্রান্ত কোনো বিষয় নিয়ে নয়।
আশফিয়া আক্তার নামে বিএম কলেজের এক শিক্ষার্থীর পরিবারের সঙ্গে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাসনুভা চৌধুরীর পরিবারের জমিজমা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছিল। দুই শিক্ষার্থীর বাড়ি বরিশাল শহরের ব্যাপ্টিস্ট মিশন রোডে। আশফিয়া ও তাসনুভা একে অন্যের প্রতিবেশী। যত দূর জানা যায়, দুই পরিবারের বিরোধ মেটাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিএম কলেজের একজন সমন্বয়কের নেতৃত্বে ১৫-২০ জন শিক্ষার্থী প্রথমে আশফিয়াদের বাড়িতে যান।
পরে তারা আশফিয়াদের পক্ষ নিয়ে তাসনুভাদের বাড়িতে গেলে আলোচনার একপর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে কথা-কাটাকাটি শুরু হয়। ঘটনার সময় তাসনুভা ফোনে বিষয়টি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সহপাঠীদের জানালে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী আশফিয়াদের বাড়িতে ছুটে আসেন। দুই পক্ষের মধ্যে তীব্র বাগবিতণ্ডার একপর্যায়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিএম কলেজ শাখার সমন্বয়ক লাঞ্ছিত হন। এরপর উভয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মারমুখী উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। রাতভর দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাত চলে। উভয় পক্ষে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী অংশ নেন।
এখন প্রশ্ন হলো, বরিশালে দুটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে জড়িয়েছেন, তা কি সমর্থনযোগ্য? কার জমি কে দখল নেবে? অথবা কে দখল করে দেবে এটাও কি শিক্ষার্থীদের কর্মকাণ্ডের মধ্যে পড়ে? অবিস্মরণীয় ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের মূল রূপকার আমাদের প্রিয় শিক্ষার্থীরা। তারা দেশ গঠনের দায়িত্ব নিয়েছেন। তাই বলে কারও জমি দখল করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব তারা নিতে পারেন কি না, তা ভেবে দেখা জরুরি।
তবে আমরা বরিশালের ঘটনাকে খুব বেশি গুরুত্ব দিতে চাই না। এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তার আগে আবারও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই দেশ গঠনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যুগান্তকারী ভূমিকার কথা। স্বৈরাচার পতনের এক মাস পূর্তি উপলক্ষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ৫ সেপ্টেম্বর ঢাকাসহ সারা দেশে ‘শহিদি মার্চ’ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। দুরন্ত সাহস এবং অটুট ঐক্যের দ্যুতি ছড়িয়ে সব বৈষ্যমের বিরুদ্ধে আবারও শিক্ষার্থীরা দীপ্ত স্লোগান দিলেন।
আবারও স্যালুট শিক্ষার্থীদের। আমরা এবার দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কথা বলতে চাই। করোনাকালে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই দেশের শিক্ষাঙ্গন, শিক্ষাব্যবস্থা। এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার আগেই দেশব্যাপী শিক্ষার্থীদের কাঁধে একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এসে পড়ে। কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন তারা। সময়ের প্রয়োজনে এই আন্দোলন সরকারবিরোধী ছাত্র গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানে টিকতে না পেরে স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন।
শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে গণ-অভ্যুত্থানের ফলস্বরূপ প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে নতুন রূপে আবিষ্কার করেছি আমরা। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ সবার প্রিয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুজন কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছেন। নতুন দেশে নতুন প্রত্যাশা, নতুন সম্ভাবনার আলো দেখতে পারছে দেশের মানুষ।
সারা দেশে এই আলো ছড়িয়ে দিতেই এবার শিক্ষাঙ্গনকে ব্যস্ত দেখতে চায় দেশের সাধারণ মানুষ। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার পরিবেশ ফিরে আসুক। পড়াশোনার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখতে চায় দেশের মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্রছাত্রী সংসদ কার্যকর হোক। খেলাধুলার সুস্থ পরিবেশ ফিরে আসুক।
মেধাচর্চায় ব্যস্ত হয়ে উঠুক দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান- এই প্রত্যাশা দেশের সাধারণ মানুষের। অচিরে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সচল না হলে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মারাত্মক সেশনজট দেখা দেবে। দেশের ৫৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৯টিরই উপাচার্য পদত্যাগ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ তিন-চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতোমধ্যে ভিসি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যোগ্যতর শিক্ষাবিদ খুঁজে না পাওয়ায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভিসি নিয়োগ বিলম্বিত হচ্ছে বলে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। সত্যিকার অর্থে এটি আশঙ্কার কথা।
একটি নতুন দেশ উপহার দেওয়ার জন্য স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে আবারও স্যালুট জানাই। দেশে বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে এখনো অনেক কাজ বাকি আছে। সে জন্য অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। শিক্ষার্থীরা নিশ্চয়ই ভ্যানগার্ড হিসেবে এই সরকারকে সহযোগিতা করবেন। দেশের ১২টি জেলার ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় শিক্ষার্থীরা অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এবার বোধকরি তাদের উচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আরও বেশি সক্রিয় হওয়া।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই যদি ধরি। টিএসসি শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব গণতন্ত্রমনা মেধাবী শিক্ষার্থী বিশেষ করে সংস্কৃতিকর্মীদের মেধা বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা। অথচ বিগত ১০-১৫ বছরে টিএসসি ছিল অনেকটাই অবরুদ্ধ। এবার শিক্ষার্থীরা অচলায়তন ভেঙেছেন। বানভাসি মানুষকে ত্রাণসহায়তা দেওয়ার কর্মসূচি পালনকে কেন্দ্র করে টিএসসি আবার তার অতীত গৌরব ফিরে পেয়েছে।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার সাংস্কৃতিক চর্চার সেই গৌরবোজ্জ্বল পরিবেশ ফিরে আসুক। ডাকসু আবার সরব হোক। তাহলে গোটা দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে জাগরণ শুরু হবে। এ জন্য শিক্ষার্থীদের উচিত আরও বেশি করে ক্লাস, পরীক্ষা ও লাইব্রেরিমুখী হওয়া। শহিদি মার্চ কর্মসূচি পালনের দিনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্বয়ং শিক্ষার্থীদের এবার ক্লাসে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
এবার হুমায়ূন আহমেদের সেই নাটকের প্রসঙ্গে ফিরে যাই। স্কুলে না যাওয়ার আনন্দে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে দুজন শিশু, দুই ভাইবোন। তাদের সামনে দিয়ে স্কুলে যাচ্ছিল ৫-৭ জন ছেলেমেয়ে। তাদেরই একজন দুই ভাইবোনকে জিজ্ঞেস করল- কী রে, তোরা স্কুলে যাবি না।
ভাই উত্তর দিল- আমরা স্কুলে যাব না। কারণ আমরা স্বাধীন। স্কুলগামী ছেলেমেয়েরা দুই ভাইবোনকে কোনো গুরুত্বই দিল না। তারা স্কুলের দিকে হাঁটতে থাকল। দুই ভাইবোন ফিরে এল বাবার কাছে। পোশাক পাল্টে স্কুলের পোশাক পরতে পরতে ছেলে বাবাকে বলল- বাবা আমরা স্কুলে যাচ্ছি... বাবা খুশি হয়ে বললেন- গুড, ভেরি গুড...।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার
সম্পাদক, আনন্দ আলো