ঢাকা ২২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, বৃহস্পতিবার, ০৫ জুন ২০২৫
English
বৃহস্পতিবার, ০৫ জুন ২০২৫, ২২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় সক্ষমতা কতদূর?

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:১৫ এএম
জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় সক্ষমতা কতদূর?
ডা. মুশতাক হোসেন

বাংলাদেশে জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি প্রতিরোধ, শনাক্তকরণ ও মোকাবিলা করার জন্য কতটুকু সক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছে, তার একটা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের মূল্যায়ন হয়ে গেল গত ৭ থেকে ১১ জুলাই ২০২৪। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধিতে (আইএইচআর) বর্ণিত ১৯টি কারিগরি বিষয়ে এ মূল্যায়ন করা হয়। 

আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধিটা কী? এর পুরো নাম হচ্ছে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধি ২০০৫। এ বিধি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ১৯৬টি সদস্যরাষ্ট্রের জন্য আইনত বাধ্যতামূলক; যা জনস্বাস্থ্যের জরুরি পরিস্থিতি শনাক্ত ও রিপোর্ট করা, প্রস্তুতি, মোকাবিলা প্রভৃতি ক্ষেত্রে দেশগুলোর অধিকার ও দায়িত্বগুলো সংজ্ঞায়িত করে। ১৯৬৯ সালে এ বিধি প্রথম চালু হয়েছিল। তখন শুধু ছয়টি রোগকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে দেশগুলোকে রিপোর্ট করতে হতো। ২০০৩-০৪ সালে সার্স মহামারির অভিজ্ঞতায় আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধি ২০০৫ সালে ব্যাপক সংশোধন করা হয়েছে। 

তাই এটার নাম হয়েছে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধি (আইএইচআর) ২০০৫। এ সংশোধনীর পর শুধু ছয়টি রোগ নয়, জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যের যেকোনো ঘটনা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে রিপোর্ট করার জন্য সদস্যদেশগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দেশগুলো নিজেরা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পত্রিকার প্রতিবেদন, অনানুষ্ঠানিক সূত্র থেকে প্রাপ্ত যেকোনো খবর, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তা সক্রিয়ভাবে আমলে নেবে ও যাচাই করবে। তবে মহামারি কিংবা মহামারি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সদস্যদেশগুলো আন্তর্জাতিক ভ্রমণ ও বাণিজ্য যতটা সম্ভব উন্মুক্ত রেখে তা নির্ধারণ করবে। কোভিড-১৯ মহামারির অভিজ্ঞতায় এবারও বিধিটির উল্লেখযোগ্য সংযোজন ও হালনাগাদ হয়েছে।

জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি আমরা কাকে বলব? দুর্যোগ, সংক্রামক রোগের আকস্মিক ও উল্লেখযোগ্য প্রাদুর্ভাব, জৈব সন্ত্রাস বা অন্যান্য উল্লেখযোগ্য বা বিপর্যয়কর ঘটনার মোকাবিলা করতে স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবাগুলোকে জরুরি ব্যবস্থা নিতে হয়, সে পরিস্থিতিই জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি। এক দেশ থেকে তা আরেক দেশে ছড়িয়ে পড়লে বা পড়ার হুমকি সৃষ্টি করলে এবং সেটা কোনো এক দেশের পক্ষে এককভাবে মোকাবিলা করতে না পারলে সেটা জনস্বাস্থ্যের আন্তর্জাতিক জরুরি পরিস্থিতি সৃষ্টি করে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞ দল এ দেশে আসার আগে এ দেশের সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা নিজেরা এই ১৯টি বিষয়ে পর্যালোচনা করেছেন। পর্যালোচনায় অংশ নিয়েছেন মানবস্বাস্থ্য, প্রাণিস্বাস্থ্য, পরিবেশস্বাস্থ্য, কৃষি, শিল্প, পরমাণু সংস্থা, স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষাসহ জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা। 

দেশের মূল্যায়ন দলের প্রতিবেদন আগেই আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দলের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তারা সেগুলো পর্যযালোচনা করে ৭ থেকে ১১ জুলাই দেশীয় প্রতিনিধিদলের সঙ্গে একত্রে বসে চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন। শেষ দিন ১১ জুলাই এ প্রতিবেদন স্বাস্থ্যমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়। 

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ এবং কর্মকর্তা সমন্বয়ে যৌথ মূলায়নের জন্য এটির নামকরণ হয়েছে যৌথ বহির্মূল্যায়ন (জয়েন্ট এক্সটার্নাল এভালুয়েশন)। তারা প্রাথমিকভাবে যে সামগ্রিক মূল্যায়ন করেছেন সেটা দেখা যেতে পারে।

তিনটি বিষয়ে আমাদের সীমিত সক্ষমতা রয়েছে। সেগুলো হলো- (১) সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ, (২) খাদ্য নিরাপদতা ও (৩) অর্থ সংস্থান। আটটি বিষয়ে আমাদের সক্ষমতা আছে বলা যেতে পারে- (১) আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধি বাস্তবায়ন-সম্পর্কিত সমন্বয়, এ বিষয়ে জাতীয়ভাবে দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাজ এবং এর পক্ষে প্রচার, (২) জৈব নিরাপদতা ও জৈব নিরাপত্তা, (৩) জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষকে যুক্ত করা, (৪) স্বাস্থ্যসেবা প্রদান ব্যবস্থা, (৫) রাসায়নিক দুর্ঘটনা, (৬) প্রাণিবাহিত রোগ, (৭) আইনি উপকরণ ও (৮) স্বাস্থ্যের জরুরি পরিস্থিতি ব্যবস্থাপনা। 

যৌথ বহির্মূল্যায়নেরর সারাংশ, মন্তব্য ও সুপারিশগুলোও আমরা দেখে নিতে পারি। তারা যেটা পেশ করেছেন তা নিম্নরূপ: 
বাংলাদেশে বিস্তৃত আইনি উপকরণ রয়েছে, যা কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। মহামারির অভিজ্ঞতায় প্রয়োজনীয় আইন পর্যালোচনা ও সংশোধন বা প্রণয়নের উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করার জন্য দরকার এ বিষয়ে বিদ্যমান আইনসমূহ শনাক্ত করা, বিশ্লেষণ এবং পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নে সহায়তা করা। 

আরও দরকার বিদ্যমান আইনগুলোর জন্য বিধি তৈরির কাজের খোঁজ রাখা; ইতোপূর্বে তৈরি করা কর্মকৌশল, নীতি ও নির্দেশিকা অনুমোদন করানো। এ ছাড়া যেসব নীতি, কর্মকৌশল ও নির্দেশাবলি প্রণয়ন করা হয়েছে, সেগুলো কার্যকর করার জন্য পরিবীক্ষণ এবং জবাবদিহি কাঠামো প্রতিষ্ঠা। এক স্বাস্থ্য (ওয়ান হেলথ) পদ্ধতির মাধ্যমে স্বাস্থ্য সুরক্ষা জোরদার করার জন্য প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

কোভিড-১৯ মহামারির পূর্ববর্তী দশকে ৬.৬ শতাংশের গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধির (জিডিপি) নজরকাড়া হারের ফলে যে গতি তৈরি হয়েছিল– মহামারি যা প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে তুলনামূলকভাবে হ্রাস করেছে, তবু তা বাংলাদেশকে ২০২৬ সালের মধ্যে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের পথে রেখেছে। 

বিশ্বব্যাংক ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উচ্চ মধ্যম আয়ের মর্যাদা অর্জনের লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম করে তুলতে উন্নয়নের জন্য আরও অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায়ে রাজস্ব সংস্কারের পক্ষে পরামর্শ দিচ্ছে। 

স্বাস্থ্যসহ বাংলাদেশের সামগ্রিক ও খাতভিত্তিক উন্নয়ন কর্মসূচি দারিদ্র্যবিমোচন, মানব উন্নয়ন এবং গড় আয়ু বাড়িয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং পরিষেবা সরবরাহের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি এবং উদ্ভাবনী শক্তির কারণে। পরিবেশগত এবং রোগতাত্ত্বিক ঝুঁকির দ্রুত এবং জটিল পরিবর্তনগুলো পূরণ করার জন্য, মানব, প্রাণী এবং পরিবেশগত স্বাস্থ্যসেবাগুলোর প্রাপ্যতা সহজতর, গুণমান নিশ্চিত করা এবং এসবের আওতা বাড়ানো প্রয়োজন।

এ জন্য বিদ্যমান এক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য রেফারেল ব্যবস্থার একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা অপরিহার্য। তাহলে স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতিরক্ষা এবং ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করার সক্ষমতা নিশ্চিত হতে পারে।

আন্তর্জাতিক প্রবেশ পথসমূহে ওয়ান হেলথ রোগতাত্ত্বিক ও ল্যাবরেটরিভিত্তিক রোগ নজরদারি, রোগতাত্ত্বিক ও ল্যাবরেটরি সক্ষমতা বেড়েছে। এসব স্থানে ঝুঁকিভিত্তিক জনস্বাস্থ্য এবং সামাজিক ব্যবস্থা (যেমন- কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন) নিশ্চিত করার সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়েছে। 

গত ২০১৬ সালের যৌথ মূল্যায়নের তুলনায় এবারে এ উন্নতি লক্ষণীয়। এই নজরকাড়া অর্জনকে শক্তিশালী ও টেকসই করার জন্য পরবর্তী প্রজন্মের সহযোগিতামূলক মাল্টি-সোর্স ওয়ান হেলথ সার্ভিলেন্স সিস্টেমের দিকে অগ্রসর হওয়া অপরিহার্য। এটি দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং ঝুঁকিভিত্তিক মোকাবিলার জন্য দরকার। এটা ডিজিটাল উদ্ভাবন এবং অংশীজনদের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন তথ্য বিনিময়কে উৎসাহিত করে।

জেলা পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত রোগতত্ত্বসংক্রান্ত ইউনিটগুলো আরও শক্তিশালী এবং প্রসারিত করে রোগতাত্ত্বিক সক্ষমতা আরও গভীর করা প্রয়োজন। অবকাঠামো, মানবসম্পদ ও সক্ষমতা জোরদার করা এবং আইএইচআর মনোনীত এবং অমনোনীত উভয় প্রকার আন্তর্জাতিক প্রবেশগুলোর ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। বিশেষত, জাতীয় নজরদারি এবং স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা এবং দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থার সঙ্গে স্থল সীমান্ত বন্দরগুলোকে নির্বিঘ্নে সংযুক্ত করা দরকার।

আমরা আশা করি, আগামী দুই বছর পর আবার যখন যৌথ বহির্মূল্যায়ন অনুষ্ঠিত হবে, আমরা আরও সক্ষমতা অর্জন করতে পারব। বাংলাদেশে জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় অন্য দেশের কাছে উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারব, যেমনটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় আমরা পৃথিবীতে সামনের সারিতে রয়েছি।

লেখক: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, রোগতত্ত্ব রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)
[email protected]

প্রবৃদ্ধি বাড়ানো সম্ভব হলে রাজস্ব বাড়বে

প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২৫, ০২:৫২ পিএম
প্রবৃদ্ধি বাড়ানো সম্ভব হলে রাজস্ব বাড়বে

রাজস্ব আদায় বাড়াতে যে ক্ষেত্রগুলো করহারের অধীনে আসেনি সেগুলোকে করহারের আওতায় আনতে হবে। আমাদের সে ক্ষেত্রে অটোমেশনে যেতে হবে। যাদের ঢাকা শহরে অনেক বাড়ি আছে, অথচ তারা সরকারকে কর ফাঁকি দিচ্ছে। এ রকম উদাহরণ বহু আছে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে কিন্তু আয়কর রিটার্ন দিচ্ছে না, ফাইভ স্টার হোটেলে ডিনার করছে, অথচ কর দিচ্ছে না, কোম্পানির ডিভিডেন্ট দেয় না, অথচ ওই কোম্পানির এমডি পাজেরো গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়ান, তাদের জরিমানাসহ করের আওতায় আনতে হবে। অর্থনীতি যদি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে থাকে সাড়ে ৫ থেকে ৬ শতাংশ করে তাহলে এর রাজস্ব আয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়বে। বাজেটঘাটতি মোকাবিলায় সরকারকে ব্যয় সংকোচন করতে হবে।…

২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের বাজেট তুলনামূলক ভালো হয়েছে। রাজস্ব বাজেটের আকার বেড়েছে; যা এডিপির তুলনায় প্রায় আড়াই গুণ বেশি। রাজস্ব নিয়ে আমাদের আগে থেকেই আরও চিন্তাভাবনা করা উচিত ছিল। দেশের অর্থনীতির সংস্কারের দিকে আমাদের আরও গুরুত্ব দেওয়া দরকার। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে হলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুকূলে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, দেশের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি করে ভালো কিছু আশা করা যায় না। আগের সরকার নির্বাচনের নামে নানারকম প্রহসন করেছে।

 ফলে অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। কাজেই গণতন্ত্রের নামে আমরা এখনো যদি বিভাজন করি, তাহলে কোনোভাবেই সামনে এগোনো সম্ভব নয়। বলা বাহুল্য, সবারই নজর আগামী নির্বাচনের দিকে। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করার ব্যাপারে সবার মধ্যেই একটা মতানৈক্য হয়েছে। কাজেই সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচন হলেই দেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হবে। ব্যবসা ও বিনিয়োগ সৃষ্টিতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আস্থা ফিরে পাবেন।

আমরা জানি, বিগত সময়ে আর্থিক খাতে ব্যাপক দুর্নীতি ও লুটপাট হয়েছে। নজিরবিহীন অপশাসনের মাধ্যমে ব্যাংক খাতকে প্রায় ধ্বংসের মধ্যে ফেলে দেওয়ার অপচেষ্টা করা হয়েছিল। ব্যাংকগুলো লুটপাটের কারণেই আর্থিক খাতের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের পুঁজিবাজারেও। দেশ থেকে প্রচুর টাকা পাচার হয়েছে। ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র এখন সামনে আসতে শুরু করেছে। ২০২৩ সালের জুন মাসে খেলাপি ঋণের হার ছিল ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ২০ শতাংশে। অর্থাৎ খেলাপি ঋণ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ৫ আগস্ট ২০২৪-এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে, ব্যাংকিং খাতের দীর্ঘদিনের কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও আমানতকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারে সরকার গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে।

 ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি, তারল্যসংকট, দেউলিয়া বা অস্তিত্বের জন্য হুমকি- এমন সব ঝুঁকির সময়োপযোগী সমাধান এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণে ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ-২০২৫ প্রণয়ন করা হয়েছে। এ ব্যাংকগুলোকে প্রায় শেষ করে দিয়েছে মাফিয়া গ্রুপ। এ সরকারের সময় আর সে সুযোগ নেই। এদের বিচারের আওতায় আনতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। 
এবারের বাজেটে শেয়ারবাজারকে পুনরায় চাঙা করে তুলতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির মধ্যকার করপোরেট করহারের ব্যবধান বৃদ্ধি এবং ব্রোকারেজ হাউসের লেনদেনের ওপর ধার্য কর কমানো। এসব প্রণোদনার সুবিধাভোগী শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সরাসরি বিনিয়োগকারীরা কোনো সুবিধা পাবেন না।

 যদিও বাজেটের আগে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ আয় থেকে শুরু করে মূলধন মুনাফার ওপর থেকে কর প্রত্যাহারের জন্য দাবি জানানো হয়েছিল। আমরা যে বাজেট প্রণয়ন করি, তার ৭০ শতাংশই রাজস্ব বাজেট। এর কারণ হলো, আমাদের অর্থনীতির তুলনায় বিশাল আকারের সরকার নিয়ে আমরা বসে আছি। এখন এ বিশাল আকারের সরকারকে চালাতে হলে জনগণকে কর দিতে হবে। সরকার দক্ষ না হলে দেশের অর্থনীতিকেও দক্ষ মাত্রায় আনা যাবে না। বড় অর্থনীতির দেশ অথচ সরকারের পরিধি অনেক ছোট, এমন অনেক দেশ আছে। তারা পারছে। কাজেই আমাদেরও সেটা পারতে হবে। বাজারে কোম্পানি যখন কোনো লাভ করতে পারছে না, সেটাকে ভর্তুকি দিয়ে রাখার কোনো দরকার নেই। কৃষকের জন্য কোনো কিছুর ভর্তুকি দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু একটি লোকসানি শিল্পকে কেন সরকারের মধ্যে রাখতে হবে?  আমাদের কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আমরা বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে যাচ্ছি। যতদিন এ ভর্তুকির সংস্কৃতি থেকে বের হতো না পারব, ততদিন আমাদের অর্থনৈতিক দৈন্য থেকেই যাবে। আর এসব কারণেই আমরা কর সংগ্রহ যতটুকুই করি, খরচটা অপব্যয় হচ্ছে এবং সেটা রোধ করতে হবে।

 রাজস্ব আদায় বাড়াতে যে ক্ষেত্রগুলো করহারের অধীনে আসেনি সেগুলোকে করহারের আওতায় আনতে হবে। আমাদের সে ক্ষেত্রে অটোমেশনে যেতে হবে। যাদের ঢাকা শহরে অনেক বাড়ি আছে, অথচ তারা সরকারকে কর ফাঁকি দিচ্ছে। এ রকম উদাহরণ বহু আছে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে কিন্তু আয়কর রিটার্ন দিচ্ছে না, ফাইভ স্টার হোটেলে ডিনার করছে, অথচ কর দিচ্ছে না, কোম্পানির ডিভিডেন্ট দেয় না, অথচ ওই কোম্পানির এমডি পাজেরো গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়ান, তাদের জরিমানাসহ করের আওতায় আনতে হবে। অর্থনীতি যদি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে থাকে সাড়ে ৫ থেকে ৬ শতাংশ করে তাহলে এর রাজস্ব আয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়বে। বাজেটঘাটতি মোকাবিলায় সরকারকে ব্যয় সংকোচন করতে হবে। এ ছাড়া আর কোনো বিকল্প এই মুহূর্তে আমরা দেখছি না। সরকারের পরিধি বা আয়তনটা ছোট করতে পারলে, সেটা সবচেয়ে বড় কাজ হয়। কিন্তু আমাদের দেশে একটা সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে গেছে যে, সরকারের আকার ছোট করা যাবে না। সুতরাং সরকারের আয়-ব্যয়ের সমন্বয়হীন অসম আকার অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবেই।

বিগত সরকারের আমলে পুঁজিবাজার নিয়ে যথেষ্ট অবহেলা করা হয়েছে। বড় সব জুয়াড়ি সরকারের পৃষ্ঠপোষতায় স্টক মার্কেট থেকে টাকা নিয়ে গেছে। কোম্পানির লাভ নেই, কিন্তু সেগুলো বাজারে রেখে দেওয়া হয়েছে। কোম্পানি যখন কোনো লাভ করতে পারছে না, সেটাকে ভর্তুকি দিয়ে রাখার কোনো দরকার নেই।  কৃষকের জন্য কোনো কিছুর ভর্তুকি দেওয়া- সেটা হয়তো ঠিক আছে। কিন্তু আমি কেন একটি লোকসানি শিল্পকে, যেটা দিয়ে কিছু হবে না সেটাকে কেন সরকারের মধ্যে রেখে দিয়েছি। আমাদের কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আমরা বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে যাচ্ছি। যতদিন এ ভর্তুকির সংস্কৃতি থেকে বের হতে না পারব, ততদিন আমাদের অর্থনৈতিক দৈন্য থেকেই যাবে। 

আর এসব কারণেই আমরা কর সংগ্রহ যা কিছুই করি, খরচটা অপব্যয় হচ্ছে আমাদের এবং সেটা রোধ করতে হবে। পুঁজিবাজারকে দুর্নীতিমুক্ত করা, ভালো কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করা, কোম্পানিগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনার পাশাপাশি কেউ হিসাব গোপন করে কি না, এগুলো যাচাই করে দেখা ছিল আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি। এসব উদ্যোগ নেওয়া হলে শেয়ারবাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং পুনরায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করা সম্ভব হবে। 

লেখক: অর্থনীতিবিদ

বাজেটে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সমন্বয় জরুরি

প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২৫, ০২:৪৫ পিএম
বাজেটে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সমন্বয় জরুরি

বাংলাদেশে নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা, দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনা এ খাতের অগ্রগতিকে প্রতিনিয়ত বাধাগ্রস্ত করছে। ফলে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেও অনেক তরুণ-তরুণী কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে না। শিক্ষায় বিনিয়োগ মানেই ভবিষ্যতে সুদে-আসলে লাভ। উন্নত দেশের অভিজ্ঞতা বলে দেয় শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়ানো মানেই কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি এবং জাতীয় প্রবৃদ্ধির টেকসই ভিত্তি গড়া।...

বর্তমানে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নানা সংকটে জর্জরিত। নতুন অর্থবছরের জন্য যে বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে সেখানে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ জিডিপির অনুপাতে কিছুটা কমেছে। বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দকে ‘হতাশার’ বলে আখ্যায়িত করেছেন অনেকেই। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৮৯ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকার যে বাজেট উত্থাপন করা হয়েছে সেখানে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১৪ শতাংশ এবং জিডিপির ১.৭৭ শতাংশ। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছর শিক্ষা খাতে মূল বাজেটের আকার ছিল ১ লাখ ১১ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা, যা সংশোধনে ৯৯ হাজার ১১৪ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। খরচ করা ওই টাকার পরিমাণ ছিল সংশোধিত বাজেটের ১৩.৩২ শতাংশ এবং জিডিপির ১.৭৮ শতাংশ। অথচ, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে একটি দেশের শিক্ষা খাত জিডিপির ৬ শতাংশ বা বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ পেলে তা আদর্শ ধরা হয়। শিক্ষামানের দিকে যখন সবাই জোর দিচ্ছে, তখন জিডিপির অনুপাতে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কমার বিষয়টি কিছুটা হতাশার। কারণ যেকোনো উদ্যোগের মেরুদণ্ড হলো ফাইন্যান্স। বরাদ্দ না থাকলে শিক্ষার মানোন্নয়নের উদ্যোগ আমরা কীভাবে আশা করব?

শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে শুধু ভবিষ্যতের মানবসম্পদই গড়ে তোলা হয় না; একই সঙ্গে জাতির উন্নয়ন কাঠামোর ভিত্তিও নির্মিত হয়। আজকের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক পৃথিবীতে জনশক্তিকে দক্ষ ও উপযোগী করে তুলতে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে উন্নত বিশ্ব এই বিনিয়োগ শুধু জ্ঞান অর্জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা সরাসরি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ও অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতেও মুখ্য ভূমিকা পালন করে। উন্নত দেশগুলো কীভাবে শিক্ষায় বাজেট বাড়িয়ে জাতীয় উন্নয়নে ব্যবহার করছে, তা বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয় যে, এ নীতি কেবল একটি খাত নয়, বরং পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাকে গতিশীল করার মূল হাতিয়ার। 

জার্মানি পৃথিবীর অন্যতম উদাহরণ, যারা ডুয়াল এডুকেশন সিস্টেম’-এর মাধ্যমে শিক্ষাকে সরাসরি কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত করেছে। এখানে শিক্ষার্থীরা স্কুলে পাঠ গ্রহণের পাশাপাশি বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কাজ করে থাকে। রাষ্ট্রের বাজেটে বিশাল অংশ বরাদ্দ থাকে এ কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থার জন্য। জার্মান সরকার প্রতি বছর শিক্ষা খাতে প্রায় ১৩০ বিলিয়ন ইউরো ব্যয় করে, যার বড় অংশ পেশাগত ও কারিগরি শিক্ষায়। ফলে জার্মানির যুব বেকারত্বের হার ইউরোপের মধ্যে সর্বনিম্ন ২০২৪ সালে যা ছিল মাত্র ৫.৭ শতাংশ। এখানকার শিক্ষার্থী মাত্র ১৮ বা ১৯ বছর বয়সেই চাকরির জন্য প্রস্তুত হয়ে যায় এবং শিল্পক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেলে।

ফিনল্যান্ড সরকার বিশ্বাস করে, শক্তিশালী জনশক্তি গড়ে তোলার পূর্বশর্ত হলো মানসম্পন্ন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা। ফলে ফিনল্যান্ডে ১৫-২৪ বছর বয়সী কর্মক্ষম জনগণের মধ্যে ৯৮ শতাংশ কোনো না কোনো ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যুক্ত। এ ধারাবাহিকতা দেশের অর্থনীতিকে টেকসই করেছে এবং উচ্চ প্রযুক্তিনির্ভর পেশায় ফিনিশ যুবসমাজের অংশগ্রহণ অনেক বাড়িয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পুরোপুরি বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার উঠে আসার অন্যতম রহস্য শিক্ষায় অগ্রাধিকার। ১৯৬০ সালে যেখানে দেশটির সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ২২ শতাংশ, সেখানে ২০২৩ সালে তা দাঁড়ায় ৯৯ শতাংশে। বর্তমান বাজেটের প্রায় ১৫ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় হয়। সরকার শিক্ষা খাতে প্রচুর বিনিয়োগ করে প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণায়। এ বিনিয়োগ সরাসরি ফল দিয়েছে: স্যামসাং, এলজি, হুন্দাই-এর মতো বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠেছে দক্ষ কোরিয়ান কর্মীর মাধ্যমে। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও কোরিয়ান শিক্ষিত তরুণদের জন্য চাহিদা ক্রমবর্ধমান।

কানাডা শিক্ষা খাতে প্রতি বছর গড়পড়তা ৪০ বিলিয়ন কানাডিয়ান ডলার বরাদ্দ দেয়। দেশটির বিশেষত্ব হলো- শিক্ষাকে তারা শুধু জাতীয় উন্নয়নের অংশ হিসেবে দেখেই না, বরং সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহার করে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, আদিবাসী, অভিবাসী- সবার জন্য উচ্চশিক্ষায় সহজ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করেছে।

ফলস্বরূপ, কানাডায় বিভিন্ন জাতি ও শ্রেণির মানুষ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায়। ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে বহু গুণ। এখন কানাডার অর্থনীতির একটি বড় চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ও প্রযুক্তিনির্ভর কর্মী।

বাংলাদেশে নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা, দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনা এ খাতের অগ্রগতিকে প্রতিনিয়ত বাধাগ্রস্ত করছে। ফলে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেও অনেক তরুণ-তরুণী কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে না। শিক্ষায় বিনিয়োগ মানেই ভবিষ্যতে সুদে-আসলে লাভ। উন্নত দেশের অভিজ্ঞতা বলে দেয় শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়ানো মানেই কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি এবং জাতীয় প্রবৃদ্ধির টেকসই ভিত্তি গড়া। বাংলাদেশ যদি এ দিকগুলো মাথায় রেখে নীতি প্রণয়ন করে, তাহলে কর্মসংস্থানের সংকটও কমবে এবং একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের তরুণ প্রজন্ম প্রস্তুত হবে দৃঢ়ভাবে।

প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দের প্রসঙ্গটি কীভাবে আরও কর্মসংস্থানবান্ধব হবে তা খুঁজে দেখার ন্যায্যতা অনেক বেশি। বেকারদের আগামীর জীবন অনিশ্চয়তা থেকে কাটিয়ে তুলতে কর্মসংস্থানকেন্দ্রিক ভাবনা অধিকভাবে বাড়ানোর ন্যায্যতা অতিমাত্রায় অনুভূত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আশার বাণী হলো, দেশের উন্নয়নে তরুণদের আরও বেশি সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে আগামী অর্থবছরে (২০২৫-২৬) ‘তারুণ্যের উৎসব’ উদ্যাপনের জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। 

২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় এ তহবিল গঠনের প্রস্তাব করে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য এমন তহবিল এবারই প্রথম।’ আমরা জানি, বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশই তরুণ। যারা দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিশাল এই তরুণ জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে সরকারের বিভিন্ন নীতি থাকা সত্ত্বেও পরিকল্পনা, অগ্রাধিকার ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় রয়েছে ব্যাপক ঘাটতি।

শুধু তরুণ উদ্যেক্তাদের জন্য নয়, প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত কীভাবে শিক্ষা কাঠামোকে কর্মসংস্থানমুখী করে তোলা যায়- সে বিষয়ে সুস্পষ্ট পরিকল্পনা দাঁড় করানোর বিষয়টি এখন গুরুত্বপূর্ণ। আর এজন্য বাজেটের প্রসঙ্গ নিয়ে পুনরায় ভেবে দেখার যথেষ্ট প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে বিদ্যমান শ্রমবাজারের সংকট কাটিয়ে উঠতে কীভাবে শিক্ষাব্যস্থাকে আরও কর্মসংস্থানবান্ধব করে তোলা যায়- সে বিষয়ে একটি কমিশন গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে বরাদ্দের বিষয়টি বিশেষভাবে ভেবে দেখা যেতে পারে। 

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]



নয় নম্বর নাটকীয়তা

প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২৫, ০২:১৮ পিএম
নয় নম্বর নাটকীয়তা


২০২৫-২৬ এর নয়া বাজেট প্রণয়ন ও পাঠপর্ব যখন চলছে তখন সকাল থেকে মুখ ভার করে আছে আকাশ। সাগরের পানিও অস্থিরমতি। শুকলাল বৈদ্যের ট্রলার এখন দক্ষিণ তালপট্টি থেকে ১২ মাইল দক্ষিণে। পনেরো দিন হলো সে সাগরে আছে একটানা। মহাজনের টাকা তোলার মতো মাছ হলেই সে মাটিতে ফিরতে পারে। মাছের আকাল। লাভের আশা আর নেই। মহাজনের টাকা শোধ হলেই সে বেঁচে যায়। রমজাননগরের শুকলাল ও ফকিরচান আর আড়মগাছার আরজান মোড়ল- এরা সবাই একসঙ্গে পাস নিয়ে সুন্দরবন পাড়ি দিয়ে সাগরে নেমেছে ভালো মাছ পাবে, এ আশায়। 

গেল খেপে তাদের লাভ হয়েছিল ভালোই। বাড়িতে মাস দুয়েকের খোরাকি আর বউয়ের হাতে নগদ ৯ হাজার করে টাকা দিয়ে এসেছে। আসার সময় কইখালীর অমেদালী মেম্বার দাবি করেছে- তারে কিছু দেওয়া লাগবে। সে টাকা তারা কোথায় পাবে? সাগরের মাছ, বাদার মধু আর কাঠ কি অমেদালী মেম্বারদের পৈতৃক সম্পত্তি? হায়রে, কার সম্পত্তিতে কে কার ভাগ বসায়! ক্ষমতা এখন তাগোর হাতে। তাদের কাছ থেকেই পারমিট নিতে হয় আর তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে ফিরতে হয়, নজরানা না দিয়ে উপায় আছে? কথা কিন্তু সেই একই থেকে গেল। আগে জমিদারকে নজরানা দিতে হতো। এখন দিতে হয় ক্ষমতা যার হাতে। যাকে সবাই ভয় পায়। ভয় পাওয়ার কারণও সোজা- জোর যার মুলুক তার। একাল আর সেকালের পার্থক্য কই? কালে কালে বড় কথার ফুলঝুরি। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। বুলি আওড়ানো হয় কত তন্ত্রের। আসলে সবই গরল ভেল। কর্তা ভজার দেশেই তো চলে ‘বিচার-আচার যাই বলো তাল গাছ আমার’। 

আলমপুরে আজকাল রাতে ডাইল টানে যারা, তারাও সেদিন টাকা চেয়েছে- 
‘চাচা আমাদের কথা মনে রাইখেন’।
‘আচ্ছা, বাপু।’

এসব ভাতিজা নতুন আমদামি এ জগতে। পড়াশোনা থেকে অনেক দূরে তারা। তাদের মহিলা চেয়ারম্যান আর মহিলা হেডমাস্টার দুজনেরই বিদ্যার দৌড় সবার জানা। মহিলা হেডমাস্টার আসার পর থেকে বিদ্যালয়ের বারোআনা বাজতে বাকি। হেডমাস্টার প্রতিবেশী দেশে তার স্বামী-শ্বশুর-সন্তান সব রেখে এখানে বিদ্যা বিতরণ করেন আর আখের গোছান ওপারে। বলা যায়, বিদ্যালয়ে তিনি বেড়াতে আসেন মাঝে-সাজে। ওপরে হাত রেখে খাতির পাতিয়ে বহাল তবিয়তে আছেন। কিন্তু ভাতিজাদের বিদ্যার দৌড় বোতল পর্যন্ত গিয়ে যে ঠেকেছে, সে কথা বলার বা ভাবার যেন কেউ নেই। হেডমাস্টারেরও বা কী এসে যায় তাতে। তিনি তো এ এলাকার কেউ নন। এখানকার ছেলেমেয়েরা গোল্লায় গেলে তার লাভক্ষতি কোনোটাই নেই। কেননা, তার ছেলেমেয়েরা বশিরহাটে বিশেষ বিদ্যালয়ে বাবার বজরায়। অথচ কত সম্ভাবনাময় এ লোকালয়। সম্ভাবনা ছাড়াও মানুষের মতো মানুষ হওয়া সবার দায়িত্ব শুধু নয়, অধিকারও।

আকাশ আর সাগর আজ মিতালি পাতিয়েছে বুঝি? ট্রলারগুলো আজ মাছ ধরার কাজে নেই। আরজান রেডিও বাজাচ্ছে। মোবাইল ফোন এখানে কাজ করে না। শুকলাল সকালে সুখটান দিচ্ছিল বিড়িতে। ফকিরচান এখনো ঘুমাচ্ছে। বেলা ১০টা বাজল বলে। অন্যদিন অন্তত একবার জাল ফেলা শেষ। 

আজকার দিনটা অবশ্য অন্য দিনের মতো নয়। মাছেরাও আজ মনে হয় অন্য মুডে আছে। বাবাহকুর মৎস্য বিভাগে আজ সকালে এক কর্মশালার আয়োজন চলছে। সেখানে ডেলিগেট হয়ে গেছে কেউ কেউ। সাগরের মাছেরা আবার প্রবাসীদের মতো প্রজ্ঞায় পয়মন্ততায় সেরা। নদীর মাছের ওপর তাদের সবাই একটু আলাদা খাতির করে। সমুদ্রের মতো বিশাল খালে বা পুকুরে বংশীয় মাছের মতো তারা চলাচল করছে। মনে মনে অহংকার তাদের। তাদের কথা কেউ জানতে চাক এ ধরনের আশা-প্রত্যাশা তাদের সবার। তারা এমন যেমন দুর্বল কারও কাঁধে বন্দুক রেখে, নিজেদের নিরাপদ দূরত্বে রেখে কাজ হাসিলে যারা নিজেদের পারঙ্গম ও বুদ্ধিমান ভাবে। জাপানের মতো দেশে নদীর বা মিষ্টি পানির মাছ কেউ ধরেও না, খায়ও না। তাদের পছন্দ সমুদ্রের মাছ, আয়োডিনযুক্ত মুক্ত পানির মাছ। এর একটা বড় কারণ তারা কাঁচা মাছ বিশেষ প্রক্রিয়ায় খায়। সুতরাং বদ্ধ পানির মাছে যেসব ঘাটতি, গন্ধ কিংবা সীমাবদ্ধতা আাছে তা থেকে নিজেদেরও আলাদা করে সমুদ্রের মাছে উদার উন্মুক্ততার স্বাদ ও সৌন্দর্য উপভোগে তারা পক্ষপাতি। সমুদ্রের মাছের তাই কদর বেশি। 

দুপুরের দিকে সমুদ্রের পানির রং কেমন যেন পাল্টাতে শুরু করল। শুকলাল পুরোনো মানুষ। সে আঁচ করতে পারল সমুদ্রের ভাব ভালো নয়। ‘ভাব ভালো ঠেকতেছে না বলো’- আরজানের ট্রলারের দিকে তাকিয়ে বলল সে। ‘রেডিওতে কিছু বুলতেছে নাকি?’ আরজান মাথা নাড়ল। না কিছুই বলেনি। রেডিওতে বরং বলতেছে আকাশ পরিষ্কার, আবহাওয়া চমৎকার। 

বঙ্গোপসাগরের মাছ ধরার ট্রলারের সামনে মুখ কালো করে থাকা মেঘ তো আর আবহাওয়া দপ্তরের ডিসপ্লে বোর্ডে ফুটে উঠবে না। উঠলে এভাবে চমৎকার আবহাওয়ার কথা বলা যেত না। আসলে যাত্রীরা শোনে না, জানে না যাত্রাপথের আসল হাল-হকিকত কী। হঠাৎ করে আক্রমণের মতো পথে, বাইপাসে, বাঁক বা মোড় পার হওয়ার সময় পাশের খাদে খালে পড়ে যায়, নদীর মোহনায় স্রোতের তোড়ে পড়ে তলিয়ে যায়, ঈশান কোনের মেঘ এসে মুলাদীর চরে আটকিয়ে দেয় বিশাল স্টিমার। আবহাওয়া দপ্তর ‘হতে পারে’ ‘সম্ভাবনা আছে’ ধরনের কথাবার্তা বলে ঘুমাতে যায়। রাত ১টার সময় দেখা গেল টর্নেডো ভিজিট করেছে দু-চারটি গ্রাম। রাজা ডানকানের মতো ঘুমন্ত অবস্থায় নিহত হয় হরেক বয়সের মানুষ। আবহাওয়া দপ্তর বলুক আর নাই বলুক, এক সময় মস্কোয় বৃষ্টি হলে ঢাকায় ছাতা ধরার ঝোঁক চালু হয়েছিল। 
‘কেমনে?’
নাহার জানতে চায় তার বাম থেকে ডানে আসা আঁতেল স্বামী যতি চৌধুরীর কাছে।
‘এমনে...’ বর্ণচোরাদের বন্যায় ভাসে যখন দেশ সমাজ সকাল বিকাল
কপোতাক্ষীর তীরে মোরা আর জনমের হংস মিথুনেরাও দেখে অকাল 
বেহুলারা লখিন্দরের জন্য কাটায়না নির্ঘুম রাত আর 
ফেসবুকে বিছড়ানো বন্ধুর তালাসে একাকার তার
সকল সময়... নষ্ট ভ্রষ্ট সময়ের তারে বাঁধো সুর, জাগো 
বল বাহে...’
স্বরোচিত কবিতা আউড়িয়ে চৌধুরী কখনো সলিল চৌধুরী, কখনো সৌমেন চ্যাটার্জি কখনো নুরল দীনের আসাদুজ্জামান নূর হয়ে যায়।
‘‘আরে রাখো তোমার আগর গাওয়ের আবহাওয়া অফিস। গোটা দেশের ওপর দিয়ে কত কেসমের সুনামি বয়ে যাচ্ছে জান? ফরমালিন এখন মাছে নয় আঁতেলদের চিন্তার ভেতরও ঢুকে পড়েছে। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বলার চল চালু হয়েছে মিষ্টি শোতে সরগরমকারীদের মধ্যে। রাজনীতির ভেতর যেমন ঢুকেছে পলিটিক্স, মেহনতী জনতার মধ্যে ‘অন্যরাও’ দরখাস্ত করেই ঢুকে পড়েছে। দরবেশায়িত হয়ে পড়ছে নিরপেক্ষতার রাস্তাঘাট।’’ যতিকে থামাতে পারে না নাহার। যতির মতিগতি বোঝা ভার। ডান-বাম তো কম করল না। 

বিকেল বেলা বাতাস ছাড়ল মনে হলো। আরজান রেডিও খোলে। ‘পারে নিয়ে যাও আমায়...’ বলে একটা গান সুর মিলিয়ে শেষ হয়ে গেল। মনটা তার ছ্যাৎ করে উঠল। তার মনে হলো এ গান এ সময় কেন? বউ, ছেলেমেয়ের মুখ মনে পড়ল তার। আড়মগাছার বড় বটগাছের তলা দিয়ে এ সময় তার মেয়ে শরীফা বাড়ি ফিরছিল স্কুল থেকে। হঠাৎ গাছের একটা ছোট ডাল ভেঙে পড়ল তার সামনে। চমকিয়ে ওঠে শরীফা। ফকিরচানের মা হনুফা বিবি তার মুরগির বাচ্চা দুটো বিছড়াচ্ছে রমজাননগরের হুলোয় তার বাড়ির উঠানে। তার হঠাৎ মনে হলো ফকিরচান কেমন আছে?

দুবলার চর থেকে ২০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, কইখালীর ফরেস্ট অফিস থেকে ৮৫ মাইল দক্ষিণে আরজান, ফকিরচান আর শুকলালের ট্রলার। সন্ধ্যায় ঝড় উঠল। ‘রেডিও ধরতিছে না। কেম্মায় কী করব?’ তিনজন তিন ট্রলারে। কেউ তাদের বলেনি, জানায়নি চার দিন ধরে একটা নিম্নচাপ ঘুরপাক খাচ্চে রায়মঙ্গল আর কালিন্দির মোহনায়। কাকদ্বীপের আবহাওয়া সংকেত দেখানো মেশিন ঠিকই ধরেছে, তারা লালবাতি দেখিয়েছে সকাল থেকে, সেখানকার রেডিও বলেছে, উত্তর বঙ্গোপসাগরের ট্রলারদের তীরের কাছাকাছি সাবধানে চলাচল করতে। আর ঢাকার আবহাওয়া অফিস সঞ্চরণশীল মেঘের আনাগোনা আর মৌসুমি বৃষ্টির কথা বলেই খালাস। নিম্নচাপ দেশ ও দেশের সীমানা মেনে চলাচল করতে শেখেনি- ঢাকা তো এখান থেকে অনেক দূর...। 

বিশাল ঢেউয়ের পাহাড়। ট্রলারের বাতি নিবে গেল আরজানের। ট্রলারের দোলায়, ধাক্কায় মাথা ফেটে গেল মনে হলো, বমি হলো। দাঁড়াতে পারল না। পড়ে গেল মেঝেতে। বিছানাপত্তর, মাছ, চালডাল, মাল-মসলার সঙ্গে সেও মিশে গেল। তার মায়ের কথা, বাপের কথা মনে পড়ল। তার মা মারা গেছে কয়েক বছর আগে। তার মা তার নাম ধরে ডাকছে... আরজান আয় বাপজান আয়... ইদিকি আয় দিনি...।

ফকিরচানের বউ নামাজের পাটিতে। রাত ৯টা হবে। হঠাৎ মনে হলো তার মিনসে তাকে ডাকতাছে। মনটা মোচড় দিয়ে উঠল। ও আল্লা এরাম ল্যাগদেছে ক্যান। হুঁশ হারিয়ে ফেলে রহিমা। ফকিরচানের নতুন বিয়ে করা দ্বিতীয় বউ। 
শুকলাল শক্ত মনের মানুষ। এ ধরনের ঝড়ের বেকায়দায় সে এর আগেও কয়েকবার পড়েছে। এ তারিখ তার ভুল হয়েছে শালার রেডিওর ওপর ভরসা করা। গত তিন-চার দিন ধরেই তো সে দেখছিল আকাশ আর সমুদ্রের ভাব ভালো না। তালপট্টির দিকে এগিয়ে থাকা উচিত ছিল। যাক, যা হওয়ার হয়েছে। এখন এই অতি বাজে অবস্থায় টিকে থাকা লাগবানে। তার ট্রলারটা ওদের দুজনের চেয়ে একটু বড় আর শক্ত-সামর্থ্য। নুরনগরের নগেন ময়রার ট্রলার। নগেন মিষ্টিতে চিনি নয়ছয় করলেও ট্রলারের ব্যাপারে খুব সজাগ, যত্ন নেয়। ‘ও বাছাড়ের পো, আমার ট্রলার যেম্মায় ঠিক থাকা দরকার সেম্মায় যেন থাকে। কোনো খুঁত থাকলি পানিতি নেবা না।’ এবারও সাড়ে ৫ হাজার টাকার জিনিসপত্তর লাগিয়ে দিয়েছে। না আর পারা গেল না। শুকলাল দেখল ট্রলারে থাকলে ডুবে মরতে হবে। সে ট্রলার থেকে ঝাঁপ দিল সাগরে। সাগরের ঢেউ আর স্রোতের সঙ্গী হলো অজানার উদ্দেশে। সাগরের পানি তত ঠাণ্ডা মনে হলো না। তবে ঢেউগুলো বড্ড বেয়াড়া। নুরনগর স্কুলে বিমল বাবুর ব্যাকরণ পড়ানোর কথা তার মনে পড়ে গেল। আশ্চর্য। ১৮ বৈশাখের এই রাত ১২টায় অথই জলের আহ্বানে সাড়া দেওয়ার সময়। হঠাৎ শুকলাল পায়ের তলায় মাটির স্পর্শ পেল মনে হলো। হ্যাঁ, তাই তো, ভালো মাটি। ঢেউয়ের দুলুনিতে সে দেখল ছোট একটা দ্বীপ, একেক ঢেউয়ের দোলায় ডুবে যাচ্ছে আবার জেগে উঠছে। ‘এখানে দাঁড়াতি পারলি এ যাত্রায় বাঁচার একটা উপায় হতো।’ কিন্তু এখানে ধরবার মতো আঁকড়ে থাকার মতো কিছু দেখছে না সে। বিজলীর আলোয় একটু সামনে দেখল না উঁচু জায়গা আছে। সেখানে পানি উঠতেছে না। তবে বাতাস প্রচণ্ড। তা থাক, সেখানে মাটিতে সটান হয়ে শক্ত করে মাটি ধরে শুয়ে রইল শুকলাল। 

ঢাকার আবহাওয়া অফিস রাত দেড়টায় তাদের কুতখালী অফিস থেকে খবর পায়, জবর ঝড়ের খবর। তারা তাড়াতাড়ি তিন থেকে নয় নম্বর মহা বিপদসংকেত জারি করে ফেলে। জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা যা হওয়ার তাই হয়। অর্থমন্ত্রীদের মাথাব্যথা তাতে বাড়ে-কমে বৈকি। কিন্তু তিন থেকে নয়ে ব্যারোমিটার তুলেও কী হলো? আড়মগাছার আরজান আর রমজাননগরের ফকিরচানের লাশ আজও পায়নি তাদের ছেলেমেয়েরা। শুকলালের ট্রলারটা কোসটগার্ডের লোকেরা শ্যামনগর থানায় ওয়ারলেস করে জানিয়েছে। শুকলাল তখনো নিখোঁজ। 

লেখক: সরকারের সাবেক সচিব

বাজেট কতটা ভরসা দেবে?

প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২৫, ০২:১২ পিএম
বাজেট কতটা ভরসা দেবে?

পরিবর্তনের আশা এবং বৈষম্য মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে গণ-অভ্যুত্থান ২০২৪ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দুর্নীতি আর দুর্বিনীত শাসক জনগণের ক্ষোভ শুধু বাড়িয়ে তোলেনি, মানুষের মনে এই প্রত্যাশা জাগিয়ে তুলেছিল যে শাসক পরিবর্তনের ফলে মানুষের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের পথ রচনা শুরু হবে। দেশ গণতন্ত্রের পথে হাঁটবে, টাকা পাচার বন্ধ হবে, শ্রমিক-কৃষকের আকাঙ্ক্ষা পূরণ না হলেও তাদের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করবে পরবর্তী সরকার। দেশের সামর্থ্য অনুযায়ী বাজেট হবে এবং সেই বাজেটে সাধারণ মানুষের প্রতি সরকার তার দায়িত্বের প্রতিফলন ঘটাবে। এই ধরনের প্রত্যাশা আর ১০ মাসের প্রতীক্ষার পর বাজেট ঘোষণা হলো ২০২৫-২৬ অর্থবছরের। 

অর্থ উপদেষ্টা ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য মোট ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন। এই বাজেটের মধ্যে সাধারণভাবে দেখা যাচ্ছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে মোট ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। মোট ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা বা জিডিপির ৯ শতাংশ রাজস্ব আয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য উৎস থেকে ৬৫ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

সামগ্রিকভাবে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে মোট ঘাটতির মধ্যে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস এবং ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক উৎস থেকে সংগ্রহের প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকারের ব্যয়ের খাতের মধ্যে এডিপি বা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাবদ ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। বেতন-ভাতা বাবদ বরাদ্দ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। ঋণের সুদ ব্যয় ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা এবং বিদ্যুৎ ও সার বাবদ ভর্তুকি দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থনৈতিক এই হিসাব-নিকাশ বুঝতে অসুবিধা হলেও এর প্রভাব অর্থনীতিতে কী পড়বে তা সাধারণ মানুষ জীবন দিয়েই বুঝবেন।

 অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা কোনো অর্থনৈতিক ব্যাখ্যার বিষয় নয়, এর প্রভাব বাজারে পড়ে এবং সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে তার প্রভাব লক্ষ করা যায়। এ ক্ষেত্রে নতুন করে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে, যা প্রফেসর ইউনূস দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে এনে একটি উন্নত সমাজ বিনির্মাণের উদ্দেশ্যে আমরা যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করেছি, তার মূল লক্ষ্য হচ্ছে শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব ও শূন্য কার্বনভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ। যার মাধ্যমে আমূল পরিবর্তন হবে এ দেশের মানুষের জীবনমানের এবং মুক্তি মিলবে বৈষম্যের দুষ্টচক্র থেকে।’ 

অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘যে স্বপ্নকে ধারণ করে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ভিত রচিত হয়েছিল, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে আগামী প্রজন্মের জন্য আমরা একটি সুন্দর, বাসযোগ্য আবাসস্থল রেখে যেতে চাই, জনগণের জীবনযাত্রায় নিয়ে আসতে চাই এক সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের ঢেউ। আমরা সে লক্ষ্য সামনে রেখে এবারের বাজেট সাজানোর চেষ্টা করেছি। তার এই বক্তব্যকে বিবেচনায় রেখে বাজেটের প্রাথমিক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, আশাবাদ থাকলেও আশার রেখা এত ক্ষীণ যে তার ওপর ভরসা করা কঠিন। 

প্রথমত রাষ্ট্রের আয়ের উৎসগুলো আগের মতোই আছে। এ কথা সবাই জানে, রাষ্ট্রের আয়ের কতকগুলো উৎস আছে। নাগরিকদের কাছ থেকে নানাভাবে কর আদায় করাই রাষ্ট্রের আয়ের প্রধান উৎস। এগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়- প্রত্যক্ষ কর, পরোক্ষ কর ও করবহির্ভূত আয়। প্রত্যক্ষ করের মধ্যে আছে ব্যক্তিশ্রেণির আয়কর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের আয়ের ওপর কর (করপোরেট কর), দান কর, উত্তরাধিকার কর, যানবাহন কর, মাদক শুল্ক, ভূমি রাজস্ব ইত্যাদি। আর পরোক্ষ কর হচ্ছে আমদানি কর, আবগারি শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), সম্পূরক শুল্ক- এ রকম নানা ধরনের কর।

কর ছাড়া আরও আয় আছে। যেমন বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের লাভ, সুদ, সাধারণ প্রশাসন থেকে আয়; ডাক, তার ও টেলিফোন থেকে আয়; পরিবহন আয়, জরিমানা ও দণ্ড থেকে আয়; ভাড়া, ইজারা, টোল ও লেভি থেকে আয় ইত্যাদি। এসব আয়ের খাতগুলো খুব কি পরিবর্তিত হয়েছে এবারের বাজেটে? বাজেটকে বলা হয় দেশের জনসাধারণের দেওয়া নানা রকম ট্যাক্স বা কর হিসেবে যা পাওয়া যাবে ও করের বাইরে থেকে যা পাওয়া যাবে, এসব মিলিয়ে একটা সম্ভাব্য আয়ের পরিকল্পনা এবং উন্নয়ন ও চলতি (রাজস্ব) খাতে ওই আয় খরচ করার একটি বার্ষিক হিসাব। এখানে দেখতে হবে রাষ্ট্র কার কাছ থেকে আয় করে কাদের জন্য ব্যয় করে। এর মাধ্যমেই প্রতিফলিত হয় রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য। 

বহুল কথিত কালো টাকা সাদা করার নীতি বহাল থাকছে। আয়করের ঊর্ধ্বসীমা বাড়ানো হয়নি, সেই সাড়ে ৩ লাখ টাকাই থাকছে, কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়ে বেকারত্ব কমবে- এমন দিশা দেখা যাচ্ছে না। তরুণদের উদ্যোক্তা বানানোর পুরোনো কথাই নতুন করে বলা হলো কিন্তু ১০০ কোটি টাকার স্টার্টআপ ক্যাপিটালে তা কতটুকু গতি পাবে, সেটা আশাজাগানিয়া নয়। অর্থনীতি নিয়ে যারা ভাবেন তারা বলছেন, দেশ বহুমাত্রিক সংকটের মুখোমুখি। বিশ্বব্যাংকের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, দারিদ্র্যের হার ২০২৪ সালে ২০ দশমিক ৫ থেকে বেড়ে ২০২৫ সালে ২২ দশমিক ৯ শতাংশে পৌঁছাবে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে স্বল্প ব্যয় (জিডিপির যথাক্রমে ২ ও ২ দশমিক ৩৪ শতাংশ) এবং শিক্ষার দুর্বল ফলাফল ও তরুণদের মধ্যে উচ্চশিক্ষা, কর্মসংস্থান বা প্রশিক্ষণ না থাকার হার (জাতীয়ভাবে ৪১ শতাংশ এবং নারীদের ক্ষেত্রে ৬২ শতাংশ)। ফলে জনসংখ্যার সুফল পাওয়ার কথা বলা হলেও তা অর্জন করার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পথ দেখা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে বহুমুখী সমস্যার কারণে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করাও কঠিন বলে মনে করছেন তারা। বাজেট এই আশঙ্কা দূর করার কোনো পথরেখা দেখাতে পারেনি এবারও।

গ্রামে কাজ নেই, শহরে চলে আসছেন কর্মক্ষম মানুষেরা। পুঁজি সঞ্চয়নের ফলে দ্রুত নগরায়ণ ঘটছে, কিন্তু শহরগুলো বাসযোগ্য হচ্ছে না। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার ঘনত্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতার সমপরিমাণ বৃদ্ধি ঘটছে না। জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর তাত্ত্বিক আলোচনা নয়, ভয়াবহ পরিস্থিতির লক্ষণ দেখছেন মানুষ। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এর কারণে বাংলাদেশের জিডিপির ৫ থেকে ৭ শতাংশ ক্ষতি হতে পারে। এ থেকে রক্ষা পাওয়ার পথ কী এবং পদক্ষেপ কী তা দেখা গেল না বাজেটে।

 আন্দোলনরত শ্রমিকরা মজুরি চান মালিকদের কাছে, কিন্তু সরকারের কাছে চান বাজারদর নিয়ন্ত্রণের কর্মসূচি। রেশন দরে খাদ্য, খাদ্যনিরাপত্তার জন্য কৃষি খাত, ভবিষ্যৎ জনগোষ্ঠীর উন্নতির লক্ষ্যে স্বাস্থ্য-শিক্ষা খাত আর বেকারদের কর্মসংস্থানের জন্য শিল্পসহায়ক অর্থনীতির প্রত্যাশা এবারের বাজেটেও আশা জাগাল না। গত বছরগুলোর ছায়া থেকে বের হওয়ার জন্য অর্থনীতিতে বাকবদল দরকার ছিল। সেটা যেহেতু ঘটেনি ফলে বাজেট তা করতে সক্ষম হবে, এমন ভরসা কি পাবেন জনগণ? করের বোঝা, দাম ও মূল্যস্ফীতি, কাজের সন্ধানে তরুণদের ছোটাছুটি আর ব্যবসায়ীদের নানা সুবিধার যে পুরোনো পথ, সেই পথ পরিত্যাগের লক্ষণ দেখা গেল না। ফলে তিন শূন্যের কথা শুনেও প্রতিশ্রুতি পূরণের শূন্যদশা থেকে মুক্তি মিলবে, এমন ভরসা বাজেট দেখাতে পারেনি।  

লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)
[email protected]

যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র কেন ব্যর্থ হচ্ছে?

প্রকাশ: ০২ জুন ২০২৫, ০২:৪১ পিএম
যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র কেন ব্যর্থ হচ্ছে?

বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র প্রায় এক দশকের বেশি সময় ধরে পিছিয়ে পড়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচন এবং হোয়াইট হাউসে আসার প্রথম মাসগুলোতেই যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বব্যাপী এক মহাসংকটে ফেলে দিয়েছে। এমনকি এটি গুরুত্বপূর্ণ বিন্দুও চিহ্নিত হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এমন কর্তৃত্ববাদী পরিবর্তন অনুমানযোগ্য নয়। এর জন্য অনেকে ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে দোষারোপ করছেন। কারণ তারা আমেরিকার জনগণ থেকে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন। 

অনেক বিশ্লেষক দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক মেরুকরণের মূল কারণ হিসেবে জাতি, গর্ভপাত অথবা তথাকথিত ‘জাগ্রত মতাদর্শ’-এর মতো সাংস্কৃতিক কারণগুলোকে নির্দেশ করেছেন। অন্যরা যুক্তি দেন, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে তার নাগরিকদের অংশগ্রহণ হারিয়ে ফেলছে। গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অবনতির দিকে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক নীতি কেবল ধনীদের স্বার্থে কাজ করছে।

যদিও এসবের পেছনে সত্য ঘটনা রয়েছে। তবুও এগুলো মূলত বিশ্বাসযোগ্য পথের চাইতে ক্ষয়িষ্ণু গণতন্ত্রের লক্ষণগুলো প্রকাশ করে। আমেরিকান গণতন্ত্র কেন তার নাগরিক কণ্ঠস্বর হারাচ্ছে? রাজনীতিবিদরা কেন গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ভঙ্গ করেন? কেন অর্থনৈতিক নীতি ধনীদের স্বার্থে কাজ করে এবং অন্যদের নয়? যদি আমরা এ প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারি, তাহলে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য আমরা সুসংগত রোডম্যাপ তৈরি করতে পারব না।

গণতন্ত্রের পতনের পেছনে দুটি শক্তি কাজ করেছে। প্রথমটি হলো তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) বিপ্লব; যা ১৯৭০-এর দশকে অর্থনীতিকে নতুন রূপ দিতে শুরু করে। দ্বিতীয়টি হলো ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের প্রশাসন কর্তৃক প্রবর্তিত মুক্তবাজার নীতির এজেন্ডা। ২০২০ সাল পর্যন্ত রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাটিক প্রশাসন উভয়ই এ এজেন্ডাকে সমর্থন করেছিল; যা ‘ওয়াশিংটন কনসেনসাস’-এর ব্যানারে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল। 

এই দুটি শক্তির সমন্বয়ে সম্পদ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা খুব কম সংখ্যক মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এটি প্রথমবার নয়। যদিও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের পূর্ববর্তী পর্যায়গুলোতে যথেষ্ট সুবিধা ছিল। শ্রমিকদের মধ্যে এক ধরনের গতিশীলতা আনতে সক্ষম করেছিল যা, গত চার দশক থেকে ভিন্ন ছিল। এ সময়ে, প্রযুক্তি এবং নীতি বিশেষ করে অল্প শিক্ষিত কর্মী যারা মার্কিন শ্রমশক্তির ৬২ শতাংশে তাদের চাকরির জন্য বিপজ্জনক ছিল। 

যেহেতু অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত শক্তি গণতন্ত্রের পতনকে ব্যাখ্যা করে। তাই এ প্রবণতাকে রোধ করতে জননীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন প্রয়োজন। ট্রাম্পের প্রেসিডেন্টের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম কয়েক মাসেই বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ও অনির্বাচিত ব্যক্তি যিনি নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের পাশে আনন্দে মেতে থাকেন, যা দৃষ্টিকটু।  

সবাই জানেন, মার্কিন অর্থনীতি বিশাল ব্যক্তিগত সম্পদ তৈরি করেছে। কিন্তু এটি কীভাবে তৈরি হয়েছে? আমার ২০২৩ সালের বই, ‘দ্য মার্কেট পাওয়ার অব টেকনোলজি: আন্ডারস্ট্যান্ডিং দ্য সেকেন্ড গিল্ডেড এজ’-এ আমি দেখাই কীভাবে উদ্ভাবন ও নতুন প্রযুক্তি অর্থনৈতিক অগ্রগতির অন্যতম উৎস। বাজারের ক্ষমতা কীভাবে বৃদ্ধি করে। একটি ফার্মের পণ্য উৎপাদন খরচের চেয়ে বেশি দাম নেওয়ার ক্ষমতা, ফলে একচেটিয়া মুনাফা হয়, তা দেখিয়েছি। 

আমার বিশ্লেষণে দেখা যায়, মুক্তবাজার অর্থনৈতিক নীতিতে উদ্ভাবকদের প্রথমদিকে বাজার ক্ষমতা প্রদান করা অর্থনীতির অন্যতম স্থায়ী বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। প্রযুক্তি প্রতিযোগিতায় জয়ী উদ্ভাবকরা তাদের প্রাথমিক সাফল্যকে আটকে রাখতে এবং তাদের বাজার ক্ষমতা তৈরি করতে বিভিন্ন ধরনের কৌশল ব্যবহার করতে পারেন।

একচেটিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবিশ্বাস নীতি থেকে অব্যাহতি দেওয়া বাজার ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এ অব্যাহতি অবিশ্বাস এবং বিশেষ সুবিধা আইনের মধ্যে দ্বন্দ্ব রোধ করতে পারবে। প্রযুক্তি হলো বেশির ভাগ একচেটিয়া ক্ষমতার উৎস। একচেটিয়া মুনাফা অর্জন হলো বেশির ভাগ ব্যবসায়িক উদ্ভাবনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, সিলিকন ভ্যালির ‘ব্যাঘাত’ সম্পর্কে ক্রমাগত আলোচনার বিপরীতে প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতা বাজারের ক্ষমতাকে দূর করে না। গবেষণায় এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়- প্রযুক্তিগত একচেটিয়া বাজার বিভাজনকে রক্ষা করবে এবং এটি খুব কমই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। প্রতিযোগিতার পরিবর্তে প্রযুক্তিভিত্তিক সংস্থাগুলো প্রায়শই যৌথ প্রকল্পগুলো অনুসরণ করে। ছোট সংস্থাগুলোকে গবেষণা ও উন্নয়নে সহযোগিতা করে, যা সফল হলে অধিগ্রহণ করা হয়।

প্রায় প্রতিটি সিলিকন ভ্যালি তাদের সূচনালগ্ন থেকেই তাদের নতুন ধারণাকে কিছুটা উন্নত করার পরিকল্পনা করে। তার পর একটি শীর্ষস্থানীয় সংস্থা কর্তৃক অধিগ্রহণ করা হয়। এ সত্যটি প্রতিফলিত করে যে, মূল্যের যোগসাজশ অবৈধ হলেও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা অবৈধ নয়। উন্মুক্ত এআই-এর কথাই বলা যায়। এটির সফটওয়্যার নেতৃত্বদানকারী মাইক্রোসফটের প্রতিযোগী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু প্রতিযোগিতা করার পরিবর্তে, ওপেনএআই মাইক্রোসফট থেকে ১৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ নিশ্চিত করেছে। অনেক বড় সংস্থার অংশীদার হয়ে উঠেছে। সব তরুণ এআই সংস্থাগুলোতে একই কাজ করছে।

আমাদের গণতন্ত্র অথবা মুক্তবাজার অর্থনৈতিক নীতি থাকতে পারে। কিন্তু দুটোই আমাদের থাকতে পারে না। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য দুটি কেন্দ্রীয় লক্ষ্য অর্জন করা প্রয়োজন। প্রথমত, ব্যক্তিগত ক্ষমতা দমন করা এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য দূর করা যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একটি অভিজাততন্ত্রে পরিণত করেছে। দ্বিতীয়ত, উদ্ভাবন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুবিধাগুলো আরও সমানভাবে ভাগ করে নেওয়া নিশ্চিত করা, যাতে কোনো গোষ্ঠী পিছিয়ে না পড়ে। 

বাজারের ক্রমবর্ধমান শক্তি এবং এর সঙ্গে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য কাম্য নয়। নীতিগত সংস্কার এটিকে বিপরীত করতে পারে। অবিশ্বাসের নীতি এবং প্রয়োগ বড় সংস্থাগুলোকে ছোট সংস্থাগুলো অধিগ্রহণ করা থেকে বিরত রাখতে পারে। অবিশ্বাস এবং করের সংমিশ্রণ বাজারের শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে।

নীতিনির্ধারকদের ইউনিয়ন গঠনের ওপর আইনি বিধিনিষেধ দূর করা উচিত। পাশাপাশি দুর্নীতি রোধে ইউনিয়নগুলোর আর্থিক হিসাব এবং শাসনব্যবস্থার কঠোর পাবলিক অডিট বাধ্যতামূলক করা উচিত। যেহেতু ইউনিয়নগুলো শ্রমিকদের সংস্থাকে শক্তিশালী করে এবং বাজারে ক্ষমতার ভারসাম্য উন্নত করতে সহায়তা করে। তাই তারা কাউকে পেছনে না রেখে দ্বিতীয় নীতিগত লক্ষ্যকেও এগিয়ে নিয়ে যায়। 

এটি আমাদের গণতান্ত্রিক পুনরুদ্ধারের দ্বিতীয় উপাদানে নিয়ে আসে: প্রযুক্তি এবং প্রবৃদ্ধির সুবিধাগুলো আরও সমান ভাগাভাগি। এর অর্থ হলো আমেরিকার উদ্ভাবন এবং প্রবৃদ্ধির জন্য নতুন নীতিগত পদ্ধতির প্রয়োজন। প্রচলিত মুক্তবাজার পদ্ধতি এ ধরনের কাজকে উৎসাহিত করছে। নীতিনির্ধারকদের নিশ্চিত করা উচিত, বিজয়ীরা তাদের কিছু লাভ ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে ভাগ করে নেবে।

সহজে ব্যবহারযোগ্য ও রক্ষণাবেক্ষণযোগ্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)-ভিত্তিক পণ্য এবং পরিষেবা উদ্ভাবনের প্রচারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ভর্তুকি চালু করা উচিত। এতে আরও উন্নত প্রযুক্তিগত কর্মসংস্থান তৈরি হবে, যার জন্য উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন হবে না। বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা-উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে কম শিক্ষিত কর্মীদের ভালো চাকরির সম্ভাবনা বাড়াবে। এর জন্য ট্রেড স্কুল, কমিউনিটি কলেজ এবং শিক্ষানবিশ কর্মসূচিতে আরও বিনিয়োগ দরকার। 

শ্রম ও ব্যবস্থাপনার মধ্যে সহযোগিতা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান এবং প্রত্যাশিত প্রযুক্তির জটিলতার কারণে সহযোগিতা আরও গঠনমূলক হতে হবে। কর-অর্থায়নকৃত জীবিকা পুনরুদ্ধার-নীতি কার্যকর হলে সংস্থাগুলো তাদের প্রযুক্তি এবং শ্রমশক্তি সমন্বয় করার জন্য আরও বেশি স্বাধীনতা পাবে। এ অর্থনৈতিক নমনীয়তা শেষ পর্যন্ত নিয়োগকর্তা এবং শ্রমিক উভয়কেই উপকৃত করবে।

ট্রাম্পের নির্লজ্জ আইন বহির্ভূতকাজ আমেরিকানদের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি ফেলে দিচ্ছে। কারণ অভিজাততন্ত্র যুক্তরাষ্ট্রে তার নিয়ন্ত্রণ আরও সুদৃঢ় করছে। আমরা যদি একটি ন্যায়সঙ্গত গণতান্ত্রিক সমাজ চাই, তাহলে আমাদের অবশ্যই ব্যক্তিগত ক্ষমতা এবং একচেটিয়া মুনাফা মোকাবিলা করতে হবে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করবে এমন একটি জোটকে ক্ষমতায় আনতে অনেক কিছু পরিবর্তন করতে হবে। কিন্তু এ ধরনের পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে উঠছে, কারণ ট্রাম্প প্রশাসন তাদের ক্ষমতায় আনা শ্রমিকদের জীবন উন্নত করতে চায় না। 

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়
যুক্তরাষ্ট্র। প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে সংক্ষেপিত 
অনুবাদ: সানজিদ সকাল