বাংলাদেশে জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি প্রতিরোধ, শনাক্তকরণ ও মোকাবিলা করার জন্য কতটুকু সক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছে, তার একটা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের মূল্যায়ন হয়ে গেল গত ৭ থেকে ১১ জুলাই ২০২৪। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধিতে (আইএইচআর) বর্ণিত ১৯টি কারিগরি বিষয়ে এ মূল্যায়ন করা হয়।
আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধিটা কী? এর পুরো নাম হচ্ছে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধি ২০০৫। এ বিধি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ১৯৬টি সদস্যরাষ্ট্রের জন্য আইনত বাধ্যতামূলক; যা জনস্বাস্থ্যের জরুরি পরিস্থিতি শনাক্ত ও রিপোর্ট করা, প্রস্তুতি, মোকাবিলা প্রভৃতি ক্ষেত্রে দেশগুলোর অধিকার ও দায়িত্বগুলো সংজ্ঞায়িত করে। ১৯৬৯ সালে এ বিধি প্রথম চালু হয়েছিল। তখন শুধু ছয়টি রোগকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে দেশগুলোকে রিপোর্ট করতে হতো। ২০০৩-০৪ সালে সার্স মহামারির অভিজ্ঞতায় আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধি ২০০৫ সালে ব্যাপক সংশোধন করা হয়েছে।
তাই এটার নাম হয়েছে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধি (আইএইচআর) ২০০৫। এ সংশোধনীর পর শুধু ছয়টি রোগ নয়, জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যের যেকোনো ঘটনা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে রিপোর্ট করার জন্য সদস্যদেশগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দেশগুলো নিজেরা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পত্রিকার প্রতিবেদন, অনানুষ্ঠানিক সূত্র থেকে প্রাপ্ত যেকোনো খবর, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তা সক্রিয়ভাবে আমলে নেবে ও যাচাই করবে। তবে মহামারি কিংবা মহামারি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সদস্যদেশগুলো আন্তর্জাতিক ভ্রমণ ও বাণিজ্য যতটা সম্ভব উন্মুক্ত রেখে তা নির্ধারণ করবে। কোভিড-১৯ মহামারির অভিজ্ঞতায় এবারও বিধিটির উল্লেখযোগ্য সংযোজন ও হালনাগাদ হয়েছে।
জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি আমরা কাকে বলব? দুর্যোগ, সংক্রামক রোগের আকস্মিক ও উল্লেখযোগ্য প্রাদুর্ভাব, জৈব সন্ত্রাস বা অন্যান্য উল্লেখযোগ্য বা বিপর্যয়কর ঘটনার মোকাবিলা করতে স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবাগুলোকে জরুরি ব্যবস্থা নিতে হয়, সে পরিস্থিতিই জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি। এক দেশ থেকে তা আরেক দেশে ছড়িয়ে পড়লে বা পড়ার হুমকি সৃষ্টি করলে এবং সেটা কোনো এক দেশের পক্ষে এককভাবে মোকাবিলা করতে না পারলে সেটা জনস্বাস্থ্যের আন্তর্জাতিক জরুরি পরিস্থিতি সৃষ্টি করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞ দল এ দেশে আসার আগে এ দেশের সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা নিজেরা এই ১৯টি বিষয়ে পর্যালোচনা করেছেন। পর্যালোচনায় অংশ নিয়েছেন মানবস্বাস্থ্য, প্রাণিস্বাস্থ্য, পরিবেশস্বাস্থ্য, কৃষি, শিল্প, পরমাণু সংস্থা, স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষাসহ জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা।
দেশের মূল্যায়ন দলের প্রতিবেদন আগেই আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দলের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তারা সেগুলো পর্যযালোচনা করে ৭ থেকে ১১ জুলাই দেশীয় প্রতিনিধিদলের সঙ্গে একত্রে বসে চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন। শেষ দিন ১১ জুলাই এ প্রতিবেদন স্বাস্থ্যমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়।
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ এবং কর্মকর্তা সমন্বয়ে যৌথ মূলায়নের জন্য এটির নামকরণ হয়েছে যৌথ বহির্মূল্যায়ন (জয়েন্ট এক্সটার্নাল এভালুয়েশন)। তারা প্রাথমিকভাবে যে সামগ্রিক মূল্যায়ন করেছেন সেটা দেখা যেতে পারে।
তিনটি বিষয়ে আমাদের সীমিত সক্ষমতা রয়েছে। সেগুলো হলো- (১) সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ, (২) খাদ্য নিরাপদতা ও (৩) অর্থ সংস্থান। আটটি বিষয়ে আমাদের সক্ষমতা আছে বলা যেতে পারে- (১) আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধি বাস্তবায়ন-সম্পর্কিত সমন্বয়, এ বিষয়ে জাতীয়ভাবে দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাজ এবং এর পক্ষে প্রচার, (২) জৈব নিরাপদতা ও জৈব নিরাপত্তা, (৩) জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষকে যুক্ত করা, (৪) স্বাস্থ্যসেবা প্রদান ব্যবস্থা, (৫) রাসায়নিক দুর্ঘটনা, (৬) প্রাণিবাহিত রোগ, (৭) আইনি উপকরণ ও (৮) স্বাস্থ্যের জরুরি পরিস্থিতি ব্যবস্থাপনা।
যৌথ বহির্মূল্যায়নেরর সারাংশ, মন্তব্য ও সুপারিশগুলোও আমরা দেখে নিতে পারি। তারা যেটা পেশ করেছেন তা নিম্নরূপ:
বাংলাদেশে বিস্তৃত আইনি উপকরণ রয়েছে, যা কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। মহামারির অভিজ্ঞতায় প্রয়োজনীয় আইন পর্যালোচনা ও সংশোধন বা প্রণয়নের উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করার জন্য দরকার এ বিষয়ে বিদ্যমান আইনসমূহ শনাক্ত করা, বিশ্লেষণ এবং পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নে সহায়তা করা।
আরও দরকার বিদ্যমান আইনগুলোর জন্য বিধি তৈরির কাজের খোঁজ রাখা; ইতোপূর্বে তৈরি করা কর্মকৌশল, নীতি ও নির্দেশিকা অনুমোদন করানো। এ ছাড়া যেসব নীতি, কর্মকৌশল ও নির্দেশাবলি প্রণয়ন করা হয়েছে, সেগুলো কার্যকর করার জন্য পরিবীক্ষণ এবং জবাবদিহি কাঠামো প্রতিষ্ঠা। এক স্বাস্থ্য (ওয়ান হেলথ) পদ্ধতির মাধ্যমে স্বাস্থ্য সুরক্ষা জোরদার করার জন্য প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
কোভিড-১৯ মহামারির পূর্ববর্তী দশকে ৬.৬ শতাংশের গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধির (জিডিপি) নজরকাড়া হারের ফলে যে গতি তৈরি হয়েছিল– মহামারি যা প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে তুলনামূলকভাবে হ্রাস করেছে, তবু তা বাংলাদেশকে ২০২৬ সালের মধ্যে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের পথে রেখেছে।
বিশ্বব্যাংক ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উচ্চ মধ্যম আয়ের মর্যাদা অর্জনের লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম করে তুলতে উন্নয়নের জন্য আরও অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায়ে রাজস্ব সংস্কারের পক্ষে পরামর্শ দিচ্ছে।
স্বাস্থ্যসহ বাংলাদেশের সামগ্রিক ও খাতভিত্তিক উন্নয়ন কর্মসূচি দারিদ্র্যবিমোচন, মানব উন্নয়ন এবং গড় আয়ু বাড়িয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং পরিষেবা সরবরাহের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি এবং উদ্ভাবনী শক্তির কারণে। পরিবেশগত এবং রোগতাত্ত্বিক ঝুঁকির দ্রুত এবং জটিল পরিবর্তনগুলো পূরণ করার জন্য, মানব, প্রাণী এবং পরিবেশগত স্বাস্থ্যসেবাগুলোর প্রাপ্যতা সহজতর, গুণমান নিশ্চিত করা এবং এসবের আওতা বাড়ানো প্রয়োজন।
এ জন্য বিদ্যমান এক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য রেফারেল ব্যবস্থার একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা অপরিহার্য। তাহলে স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতিরক্ষা এবং ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করার সক্ষমতা নিশ্চিত হতে পারে।
আন্তর্জাতিক প্রবেশ পথসমূহে ওয়ান হেলথ রোগতাত্ত্বিক ও ল্যাবরেটরিভিত্তিক রোগ নজরদারি, রোগতাত্ত্বিক ও ল্যাবরেটরি সক্ষমতা বেড়েছে। এসব স্থানে ঝুঁকিভিত্তিক জনস্বাস্থ্য এবং সামাজিক ব্যবস্থা (যেমন- কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন) নিশ্চিত করার সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়েছে।
গত ২০১৬ সালের যৌথ মূল্যায়নের তুলনায় এবারে এ উন্নতি লক্ষণীয়। এই নজরকাড়া অর্জনকে শক্তিশালী ও টেকসই করার জন্য পরবর্তী প্রজন্মের সহযোগিতামূলক মাল্টি-সোর্স ওয়ান হেলথ সার্ভিলেন্স সিস্টেমের দিকে অগ্রসর হওয়া অপরিহার্য। এটি দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং ঝুঁকিভিত্তিক মোকাবিলার জন্য দরকার। এটা ডিজিটাল উদ্ভাবন এবং অংশীজনদের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন তথ্য বিনিময়কে উৎসাহিত করে।
জেলা পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত রোগতত্ত্বসংক্রান্ত ইউনিটগুলো আরও শক্তিশালী এবং প্রসারিত করে রোগতাত্ত্বিক সক্ষমতা আরও গভীর করা প্রয়োজন। অবকাঠামো, মানবসম্পদ ও সক্ষমতা জোরদার করা এবং আইএইচআর মনোনীত এবং অমনোনীত উভয় প্রকার আন্তর্জাতিক প্রবেশগুলোর ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। বিশেষত, জাতীয় নজরদারি এবং স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা এবং দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থার সঙ্গে স্থল সীমান্ত বন্দরগুলোকে নির্বিঘ্নে সংযুক্ত করা দরকার।
আমরা আশা করি, আগামী দুই বছর পর আবার যখন যৌথ বহির্মূল্যায়ন অনুষ্ঠিত হবে, আমরা আরও সক্ষমতা অর্জন করতে পারব। বাংলাদেশে জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় অন্য দেশের কাছে উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারব, যেমনটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় আমরা পৃথিবীতে সামনের সারিতে রয়েছি।
লেখক: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, রোগতত্ত্ব রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)
[email protected]