২০২৫-২৬ এর নয়া বাজেট প্রণয়ন ও পাঠপর্ব যখন চলছে তখন সকাল থেকে মুখ ভার করে আছে আকাশ। সাগরের পানিও অস্থিরমতি। শুকলাল বৈদ্যের ট্রলার এখন দক্ষিণ তালপট্টি থেকে ১২ মাইল দক্ষিণে। পনেরো দিন হলো সে সাগরে আছে একটানা। মহাজনের টাকা তোলার মতো মাছ হলেই সে মাটিতে ফিরতে পারে। মাছের আকাল। লাভের আশা আর নেই। মহাজনের টাকা শোধ হলেই সে বেঁচে যায়। রমজাননগরের শুকলাল ও ফকিরচান আর আড়মগাছার আরজান মোড়ল- এরা সবাই একসঙ্গে পাস নিয়ে সুন্দরবন পাড়ি দিয়ে সাগরে নেমেছে ভালো মাছ পাবে, এ আশায়।
গেল খেপে তাদের লাভ হয়েছিল ভালোই। বাড়িতে মাস দুয়েকের খোরাকি আর বউয়ের হাতে নগদ ৯ হাজার করে টাকা দিয়ে এসেছে। আসার সময় কইখালীর অমেদালী মেম্বার দাবি করেছে- তারে কিছু দেওয়া লাগবে। সে টাকা তারা কোথায় পাবে? সাগরের মাছ, বাদার মধু আর কাঠ কি অমেদালী মেম্বারদের পৈতৃক সম্পত্তি? হায়রে, কার সম্পত্তিতে কে কার ভাগ বসায়! ক্ষমতা এখন তাগোর হাতে। তাদের কাছ থেকেই পারমিট নিতে হয় আর তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে ফিরতে হয়, নজরানা না দিয়ে উপায় আছে? কথা কিন্তু সেই একই থেকে গেল। আগে জমিদারকে নজরানা দিতে হতো। এখন দিতে হয় ক্ষমতা যার হাতে। যাকে সবাই ভয় পায়। ভয় পাওয়ার কারণও সোজা- জোর যার মুলুক তার। একাল আর সেকালের পার্থক্য কই? কালে কালে বড় কথার ফুলঝুরি। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। বুলি আওড়ানো হয় কত তন্ত্রের। আসলে সবই গরল ভেল। কর্তা ভজার দেশেই তো চলে ‘বিচার-আচার যাই বলো তাল গাছ আমার’।
আলমপুরে আজকাল রাতে ডাইল টানে যারা, তারাও সেদিন টাকা চেয়েছে-
‘চাচা আমাদের কথা মনে রাইখেন’।
‘আচ্ছা, বাপু।’
এসব ভাতিজা নতুন আমদামি এ জগতে। পড়াশোনা থেকে অনেক দূরে তারা। তাদের মহিলা চেয়ারম্যান আর মহিলা হেডমাস্টার দুজনেরই বিদ্যার দৌড় সবার জানা। মহিলা হেডমাস্টার আসার পর থেকে বিদ্যালয়ের বারোআনা বাজতে বাকি। হেডমাস্টার প্রতিবেশী দেশে তার স্বামী-শ্বশুর-সন্তান সব রেখে এখানে বিদ্যা বিতরণ করেন আর আখের গোছান ওপারে। বলা যায়, বিদ্যালয়ে তিনি বেড়াতে আসেন মাঝে-সাজে। ওপরে হাত রেখে খাতির পাতিয়ে বহাল তবিয়তে আছেন। কিন্তু ভাতিজাদের বিদ্যার দৌড় বোতল পর্যন্ত গিয়ে যে ঠেকেছে, সে কথা বলার বা ভাবার যেন কেউ নেই। হেডমাস্টারেরও বা কী এসে যায় তাতে। তিনি তো এ এলাকার কেউ নন। এখানকার ছেলেমেয়েরা গোল্লায় গেলে তার লাভক্ষতি কোনোটাই নেই। কেননা, তার ছেলেমেয়েরা বশিরহাটে বিশেষ বিদ্যালয়ে বাবার বজরায়। অথচ কত সম্ভাবনাময় এ লোকালয়। সম্ভাবনা ছাড়াও মানুষের মতো মানুষ হওয়া সবার দায়িত্ব শুধু নয়, অধিকারও।
আকাশ আর সাগর আজ মিতালি পাতিয়েছে বুঝি? ট্রলারগুলো আজ মাছ ধরার কাজে নেই। আরজান রেডিও বাজাচ্ছে। মোবাইল ফোন এখানে কাজ করে না। শুকলাল সকালে সুখটান দিচ্ছিল বিড়িতে। ফকিরচান এখনো ঘুমাচ্ছে। বেলা ১০টা বাজল বলে। অন্যদিন অন্তত একবার জাল ফেলা শেষ।
আজকার দিনটা অবশ্য অন্য দিনের মতো নয়। মাছেরাও আজ মনে হয় অন্য মুডে আছে। বাবাহকুর মৎস্য বিভাগে আজ সকালে এক কর্মশালার আয়োজন চলছে। সেখানে ডেলিগেট হয়ে গেছে কেউ কেউ। সাগরের মাছেরা আবার প্রবাসীদের মতো প্রজ্ঞায় পয়মন্ততায় সেরা। নদীর মাছের ওপর তাদের সবাই একটু আলাদা খাতির করে। সমুদ্রের মতো বিশাল খালে বা পুকুরে বংশীয় মাছের মতো তারা চলাচল করছে। মনে মনে অহংকার তাদের। তাদের কথা কেউ জানতে চাক এ ধরনের আশা-প্রত্যাশা তাদের সবার। তারা এমন যেমন দুর্বল কারও কাঁধে বন্দুক রেখে, নিজেদের নিরাপদ দূরত্বে রেখে কাজ হাসিলে যারা নিজেদের পারঙ্গম ও বুদ্ধিমান ভাবে। জাপানের মতো দেশে নদীর বা মিষ্টি পানির মাছ কেউ ধরেও না, খায়ও না। তাদের পছন্দ সমুদ্রের মাছ, আয়োডিনযুক্ত মুক্ত পানির মাছ। এর একটা বড় কারণ তারা কাঁচা মাছ বিশেষ প্রক্রিয়ায় খায়। সুতরাং বদ্ধ পানির মাছে যেসব ঘাটতি, গন্ধ কিংবা সীমাবদ্ধতা আাছে তা থেকে নিজেদেরও আলাদা করে সমুদ্রের মাছে উদার উন্মুক্ততার স্বাদ ও সৌন্দর্য উপভোগে তারা পক্ষপাতি। সমুদ্রের মাছের তাই কদর বেশি।
দুপুরের দিকে সমুদ্রের পানির রং কেমন যেন পাল্টাতে শুরু করল। শুকলাল পুরোনো মানুষ। সে আঁচ করতে পারল সমুদ্রের ভাব ভালো নয়। ‘ভাব ভালো ঠেকতেছে না বলো’- আরজানের ট্রলারের দিকে তাকিয়ে বলল সে। ‘রেডিওতে কিছু বুলতেছে নাকি?’ আরজান মাথা নাড়ল। না কিছুই বলেনি। রেডিওতে বরং বলতেছে আকাশ পরিষ্কার, আবহাওয়া চমৎকার।
বঙ্গোপসাগরের মাছ ধরার ট্রলারের সামনে মুখ কালো করে থাকা মেঘ তো আর আবহাওয়া দপ্তরের ডিসপ্লে বোর্ডে ফুটে উঠবে না। উঠলে এভাবে চমৎকার আবহাওয়ার কথা বলা যেত না। আসলে যাত্রীরা শোনে না, জানে না যাত্রাপথের আসল হাল-হকিকত কী। হঠাৎ করে আক্রমণের মতো পথে, বাইপাসে, বাঁক বা মোড় পার হওয়ার সময় পাশের খাদে খালে পড়ে যায়, নদীর মোহনায় স্রোতের তোড়ে পড়ে তলিয়ে যায়, ঈশান কোনের মেঘ এসে মুলাদীর চরে আটকিয়ে দেয় বিশাল স্টিমার। আবহাওয়া দপ্তর ‘হতে পারে’ ‘সম্ভাবনা আছে’ ধরনের কথাবার্তা বলে ঘুমাতে যায়। রাত ১টার সময় দেখা গেল টর্নেডো ভিজিট করেছে দু-চারটি গ্রাম। রাজা ডানকানের মতো ঘুমন্ত অবস্থায় নিহত হয় হরেক বয়সের মানুষ। আবহাওয়া দপ্তর বলুক আর নাই বলুক, এক সময় মস্কোয় বৃষ্টি হলে ঢাকায় ছাতা ধরার ঝোঁক চালু হয়েছিল।
‘কেমনে?’
নাহার জানতে চায় তার বাম থেকে ডানে আসা আঁতেল স্বামী যতি চৌধুরীর কাছে।
‘এমনে...’ বর্ণচোরাদের বন্যায় ভাসে যখন দেশ সমাজ সকাল বিকাল
কপোতাক্ষীর তীরে মোরা আর জনমের হংস মিথুনেরাও দেখে অকাল
বেহুলারা লখিন্দরের জন্য কাটায়না নির্ঘুম রাত আর
ফেসবুকে বিছড়ানো বন্ধুর তালাসে একাকার তার
সকল সময়... নষ্ট ভ্রষ্ট সময়ের তারে বাঁধো সুর, জাগো
বল বাহে...’
স্বরোচিত কবিতা আউড়িয়ে চৌধুরী কখনো সলিল চৌধুরী, কখনো সৌমেন চ্যাটার্জি কখনো নুরল দীনের আসাদুজ্জামান নূর হয়ে যায়।
‘‘আরে রাখো তোমার আগর গাওয়ের আবহাওয়া অফিস। গোটা দেশের ওপর দিয়ে কত কেসমের সুনামি বয়ে যাচ্ছে জান? ফরমালিন এখন মাছে নয় আঁতেলদের চিন্তার ভেতরও ঢুকে পড়েছে। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বলার চল চালু হয়েছে মিষ্টি শোতে সরগরমকারীদের মধ্যে। রাজনীতির ভেতর যেমন ঢুকেছে পলিটিক্স, মেহনতী জনতার মধ্যে ‘অন্যরাও’ দরখাস্ত করেই ঢুকে পড়েছে। দরবেশায়িত হয়ে পড়ছে নিরপেক্ষতার রাস্তাঘাট।’’ যতিকে থামাতে পারে না নাহার। যতির মতিগতি বোঝা ভার। ডান-বাম তো কম করল না।
বিকেল বেলা বাতাস ছাড়ল মনে হলো। আরজান রেডিও খোলে। ‘পারে নিয়ে যাও আমায়...’ বলে একটা গান সুর মিলিয়ে শেষ হয়ে গেল। মনটা তার ছ্যাৎ করে উঠল। তার মনে হলো এ গান এ সময় কেন? বউ, ছেলেমেয়ের মুখ মনে পড়ল তার। আড়মগাছার বড় বটগাছের তলা দিয়ে এ সময় তার মেয়ে শরীফা বাড়ি ফিরছিল স্কুল থেকে। হঠাৎ গাছের একটা ছোট ডাল ভেঙে পড়ল তার সামনে। চমকিয়ে ওঠে শরীফা। ফকিরচানের মা হনুফা বিবি তার মুরগির বাচ্চা দুটো বিছড়াচ্ছে রমজাননগরের হুলোয় তার বাড়ির উঠানে। তার হঠাৎ মনে হলো ফকিরচান কেমন আছে?
দুবলার চর থেকে ২০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, কইখালীর ফরেস্ট অফিস থেকে ৮৫ মাইল দক্ষিণে আরজান, ফকিরচান আর শুকলালের ট্রলার। সন্ধ্যায় ঝড় উঠল। ‘রেডিও ধরতিছে না। কেম্মায় কী করব?’ তিনজন তিন ট্রলারে। কেউ তাদের বলেনি, জানায়নি চার দিন ধরে একটা নিম্নচাপ ঘুরপাক খাচ্চে রায়মঙ্গল আর কালিন্দির মোহনায়। কাকদ্বীপের আবহাওয়া সংকেত দেখানো মেশিন ঠিকই ধরেছে, তারা লালবাতি দেখিয়েছে সকাল থেকে, সেখানকার রেডিও বলেছে, উত্তর বঙ্গোপসাগরের ট্রলারদের তীরের কাছাকাছি সাবধানে চলাচল করতে। আর ঢাকার আবহাওয়া অফিস সঞ্চরণশীল মেঘের আনাগোনা আর মৌসুমি বৃষ্টির কথা বলেই খালাস। নিম্নচাপ দেশ ও দেশের সীমানা মেনে চলাচল করতে শেখেনি- ঢাকা তো এখান থেকে অনেক দূর...।
বিশাল ঢেউয়ের পাহাড়। ট্রলারের বাতি নিবে গেল আরজানের। ট্রলারের দোলায়, ধাক্কায় মাথা ফেটে গেল মনে হলো, বমি হলো। দাঁড়াতে পারল না। পড়ে গেল মেঝেতে। বিছানাপত্তর, মাছ, চালডাল, মাল-মসলার সঙ্গে সেও মিশে গেল। তার মায়ের কথা, বাপের কথা মনে পড়ল। তার মা মারা গেছে কয়েক বছর আগে। তার মা তার নাম ধরে ডাকছে... আরজান আয় বাপজান আয়... ইদিকি আয় দিনি...।
ফকিরচানের বউ নামাজের পাটিতে। রাত ৯টা হবে। হঠাৎ মনে হলো তার মিনসে তাকে ডাকতাছে। মনটা মোচড় দিয়ে উঠল। ও আল্লা এরাম ল্যাগদেছে ক্যান। হুঁশ হারিয়ে ফেলে রহিমা। ফকিরচানের নতুন বিয়ে করা দ্বিতীয় বউ।
শুকলাল শক্ত মনের মানুষ। এ ধরনের ঝড়ের বেকায়দায় সে এর আগেও কয়েকবার পড়েছে। এ তারিখ তার ভুল হয়েছে শালার রেডিওর ওপর ভরসা করা। গত তিন-চার দিন ধরেই তো সে দেখছিল আকাশ আর সমুদ্রের ভাব ভালো না। তালপট্টির দিকে এগিয়ে থাকা উচিত ছিল। যাক, যা হওয়ার হয়েছে। এখন এই অতি বাজে অবস্থায় টিকে থাকা লাগবানে। তার ট্রলারটা ওদের দুজনের চেয়ে একটু বড় আর শক্ত-সামর্থ্য। নুরনগরের নগেন ময়রার ট্রলার। নগেন মিষ্টিতে চিনি নয়ছয় করলেও ট্রলারের ব্যাপারে খুব সজাগ, যত্ন নেয়। ‘ও বাছাড়ের পো, আমার ট্রলার যেম্মায় ঠিক থাকা দরকার সেম্মায় যেন থাকে। কোনো খুঁত থাকলি পানিতি নেবা না।’ এবারও সাড়ে ৫ হাজার টাকার জিনিসপত্তর লাগিয়ে দিয়েছে। না আর পারা গেল না। শুকলাল দেখল ট্রলারে থাকলে ডুবে মরতে হবে। সে ট্রলার থেকে ঝাঁপ দিল সাগরে। সাগরের ঢেউ আর স্রোতের সঙ্গী হলো অজানার উদ্দেশে। সাগরের পানি তত ঠাণ্ডা মনে হলো না। তবে ঢেউগুলো বড্ড বেয়াড়া। নুরনগর স্কুলে বিমল বাবুর ব্যাকরণ পড়ানোর কথা তার মনে পড়ে গেল। আশ্চর্য। ১৮ বৈশাখের এই রাত ১২টায় অথই জলের আহ্বানে সাড়া দেওয়ার সময়। হঠাৎ শুকলাল পায়ের তলায় মাটির স্পর্শ পেল মনে হলো। হ্যাঁ, তাই তো, ভালো মাটি। ঢেউয়ের দুলুনিতে সে দেখল ছোট একটা দ্বীপ, একেক ঢেউয়ের দোলায় ডুবে যাচ্ছে আবার জেগে উঠছে। ‘এখানে দাঁড়াতি পারলি এ যাত্রায় বাঁচার একটা উপায় হতো।’ কিন্তু এখানে ধরবার মতো আঁকড়ে থাকার মতো কিছু দেখছে না সে। বিজলীর আলোয় একটু সামনে দেখল না উঁচু জায়গা আছে। সেখানে পানি উঠতেছে না। তবে বাতাস প্রচণ্ড। তা থাক, সেখানে মাটিতে সটান হয়ে শক্ত করে মাটি ধরে শুয়ে রইল শুকলাল।
ঢাকার আবহাওয়া অফিস রাত দেড়টায় তাদের কুতখালী অফিস থেকে খবর পায়, জবর ঝড়ের খবর। তারা তাড়াতাড়ি তিন থেকে নয় নম্বর মহা বিপদসংকেত জারি করে ফেলে। জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা যা হওয়ার তাই হয়। অর্থমন্ত্রীদের মাথাব্যথা তাতে বাড়ে-কমে বৈকি। কিন্তু তিন থেকে নয়ে ব্যারোমিটার তুলেও কী হলো? আড়মগাছার আরজান আর রমজাননগরের ফকিরচানের লাশ আজও পায়নি তাদের ছেলেমেয়েরা। শুকলালের ট্রলারটা কোসটগার্ডের লোকেরা শ্যামনগর থানায় ওয়ারলেস করে জানিয়েছে। শুকলাল তখনো নিখোঁজ।
লেখক: সরকারের সাবেক সচিব