সিরাতের প্রধান উৎস কোরআন এবং সুন্নাহ। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনের ঘটনাগুলো প্রজন্মের পর প্রজন্মে অন্তর থেকে মুখে মুখে প্রচারিত হয়েছে এবং তা অত্যন্ত যত্নসহকারে সংরক্ষিত হয়েছে। মুসলিম পণ্ডিতরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনের বর্ণনাগুলো সংরক্ষণের জন্য নির্ভুল পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। মিথ্যা বা ভুল তথ্যের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক থেকেছেন। সিরাতের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হলো, এটি শুধুমাত্র একটি ঐতিহাসিক বিবরণ নয়; বরং এটি নবুয়তের বিশেষ বৈশিষ্ট্য এবং অলৌকিক ঘটনার বর্ণনাও ধারণ করে। মুসলিম পণ্ডিতরা সিরাতের বর্ণনাকে এই বৈশিষ্ট্যগুলোসহ গ্রহণ করেছেন, যা ইসলামি বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত এবং আধ্যাত্মিক শ্রেষ্ঠত্বকে প্রতিফলিত করে।
রাসুলুল্লাহ (স.)-এর জীবনী অধ্যয়নে প্রাচ্যবিদদের সিরাত অধ্যয়নের পদ্ধতির ব্যাপারে সতর্ক থাকা জরুরি, কারণ তারা প্রায়ই সিরাত বোঝার মৌলিক দিকগুলো উপেক্ষা করে। তারা সিরাতের বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে অথবা কৌশলে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনের বিভিন্ন দিকের ওপর প্রাচ্য ও প্রাশ্চাত্যে ফেতনা ছড়িয়েছে। এজন্য সিরাতুন্নবিকে শুধু একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে বিচার না করে; বরং ইসলামের মূল্যবোধ ও আদর্শের প্রতিফলন হিসেবে দেখা উচিত।
সিরাতুন্নবি ইসলামের মূল শিক্ষা ও মূল্যবোধের অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে কাজ করে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন কোরআনের জীবন্ত ব্যাখ্যা—যা মুসলমানদের জন্য অনুপম আদর্শ। সিরাত পাঠের মাধ্যমে শরিয়তের মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যগুলো বোঝা যায়। এই শিক্ষা শুধু আইনগত দিক নয়; বরং সমাজের মানবিক ও নৈতিক উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন কোরআনের পাঠ ও উদ্দেশ্য স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত করে। সিরাতের ব্যাখ্যা ছাড়া কোরআনের গভীর তত্ত্ব ও আদর্শ সঠিকভাবে বোঝা সম্ভব নয়। তাই সিরাতুন্নবির পাঠ কোরআনের মূল উদ্দেশ্য এবং ইসলামিক শিক্ষার গভীরতার প্রতিফলন। আয়েশা (রা.)-এর পরিভাষায় সমগ্র কোরআনই রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সিরাত তথা জীবনকর্ম। যে সামগ্রিক কর্ম অন্যান্য সকল সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অধিকারের সঙ্গে নারীর মুক্তি ও অন্যান্য ধর্মবিশ্বাসীদের অধিকার সমুন্নত করেছে। বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে আন্তঃধর্মীয় সাম্যের শিক্ষার যে ঘাটতি আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনী থেকে এর শিক্ষা ও দীক্ষা নিতে হবে।
সিরাতুন্নবি থেকে আমরা যে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ও মূল্যবোধ পাই, এর মধ্যে অন্যতম হলো সমাজের ন্যায়পরায়ণতা, মানবিক অধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। সিরাতের শিক্ষা হলো শ্রেণিবিভাগ, দাসত্ব, এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা এবং সমাজের প্রতিটি ব্যক্তিকে সমান মানবিক মর্যাদা প্রদান করা। মদিনার জীবনে নবিজি (সা.)-এর সংগ্রাম এবং হিজরতের ঘটনা মানবসমাজের মুক্তি ও ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে কাজ করে। হিজরত ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যা ঈমান রক্ষার জন্য আত্মত্যাগের নির্দেশ দেয়। এটি মুসলমানদের জন্য একটি প্রতিরোধের প্রতীক, যা তাদের বিশ্বাস ও মানবিক মর্যাদা রক্ষায় উৎসাহিত করে।
সিরাতের শিক্ষা শরিয়তের মূল উদ্দেশ্য ও বিধানগুলো সঠিকভাবে বুঝতে সহায়ক। সিরাতের মাধ্যমে মুসলিম পণ্ডিতরা শরিয়তের বিধানগুলো সঠিকভাবে উপলব্ধি করেন এবং এর রুহ বা আত্মা সম্পর্কে ধারণা পান। শরিয়তের রাজনৈতিক, সামাজিক ও মানবিক দিকগুলো সিরাতের আলোকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করা প্রয়োজন—যাতে তা সমাজের কল্যাণে প্রয়োগ করা যায়। বাংলাদেশে বর্তমানে দুর্নীতির যে রাহুগ্রাস, সামাজিক অবিচার আর বৈষম্যের মাধ্যমে নৈতিকতার যে খরা চলছে; এ থেকে উত্তরণে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনী উত্তম নেয়ামত হতে পারে। এ জন্য শিক্ষা ব্যবস্থায় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সিরাত অন্তর্ভুক্ত করা উচিত বলে অনেক ইসলামি বিশেষজ্ঞ মতামত দিয়েছেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনকর্ম ইসলামি চিন্তা ও আদর্শের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস। সিরাতের শিক্ষা ইসলামি সমাজের বিকাশের জন্য অপরিহার্য—কারণ এটি মানবিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে একটি সুষ্ঠু সমাজ গঠনের নির্দেশ দেয়। সিরাত আমাদের শিক্ষা দেয় যে, সমাজের কল্যাণের জন্য ত্যাগ ও আত্মত্যাগ অপরিহার্য এবং ইসলামের মূল মূল্যবোধগুলো সর্বদা সমাজে প্রতিফলিত হতে হবে। সিরাতুন্নবি আমাদেরকে সমাজের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকতে এবং আমাদের বিশ্বাস ও নৈতিক আদর্শকে সবসময় রক্ষা করতে শেখায়। এই শিক্ষাগুলো ইসলামি সমাজের জন্য একটি স্থায়ী আদর্শ হিসেবে কাজ করে, যা তাদের নৈতিক ও মানবিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয়। আরলন্ড, বেকনসহ অনেক পাশ্চাত্যের পণ্ডিতরাও জীবন চলার পথে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন চেতনা থেকে শিক্ষার অপরিহার্যতা স্বীকার করেছেন।
সত্যিকারার্থে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন ইসলামি মূল্যবোধের একটি অনন্য উৎস—যা শরিয়তের মূল উদ্দেশ্য এবং ইসলামের নৈতিকতা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের মূল ভিত্তি তৈরি করে। সিরাতুন্নবি মানবসমাজের জন্য একটি আদর্শ—যা সমাজের নৈতিক ও মানবিক উন্নয়নের লক্ষে কাজ করে। ইসলামের মূল আদর্শ ও মূল্যবোধ বোঝার জন্য সিরাতের পাঠ অপরিহার্য।
লেখক: অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়