ঢাকা ১৭ কার্তিক ১৪৩১, শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪

কলকাতার চিঠি আন্দোলনমুখর পশ্চিমবঙ্গ, শেষ কোথায়!

প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৩৩ পিএম
আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৩৫ পিএম
আন্দোলনমুখর পশ্চিমবঙ্গ, শেষ কোথায়!
দীপঙ্কর দাশগুপ্ত

কলকাতার আরজি কর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে মহিলা চিকিৎসক ধর্ষণ ও নৃশংস হত্যার পর যেভাবে প্রতিবাদ আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল এবং এখনো যার রেশ পুরোমাত্রায় রয়েছে, তা এই বাংলায় বিগত কয়েক দশকের মধ্যে দেখা যায়নি। ভারতের স্বাধীনতা দিবসের রাতকে যেভাবে মেয়েরা জাগিয়ে দিয়েছিলেন, প্রতিবাদের সেই তরঙ্গ বঙ্গভঙ্গ বা ইংরেজ ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পর যে আর দেখা যায়নি, সে কথাও নির্দ্বিধায় বলা যায়। মেয়েরা সেদিন কেবল পথে নামেননি, তারা সবাই প্রকাশ্যে তাদের মত প্রকাশ করেছেন, সমাজের সামনে প্রশ্ন তুলেছেন।

অন্যদিকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সাধারণ মানুষও সমস্বরে সুবিচারের দাবি করছেন, দোষীর শাস্তি চাইছেন, শাসকপ্রধানের পদত্যাগ চাইছেন, সেই সঙ্গে ঘটনায় জড়িত সব স্তরের অভিযুক্তদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির দাবি করছেন। বিচারে কঠোর শাস্তি হওয়াটা যে দরকার সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। কিন্তু বিচারের প্রক্রিয়া কী আজ পর্যন্ত এক ধাপও এগিয়েছে? কার্যত তা এগোয়নি। আন্দোলনের চাপে মেয়েদের নিরাপত্তা রক্ষায় আরও বেশি সংখ্যক পুলিশি ব্যবস্থা, আরও বেশি বেশি সিসিটিভির নজরদারি এবং পুলিশ কমিশনারের কথা অনুযায়ী, নারী-হিংসার প্রতি পুলিশ ‘জিরো টলারেন্স’ নিয়ে চলবে- এমনটাই বলা হচ্ছে। ওদিকে বিচারপর্বে দেশের সর্বোচ্চ আদালত প্রশ্নবাণ তুলছে ঠিকই, কিন্তু সময় তো দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন জাগছে, মহামান্য আদালত কি বাবা বাছা বলে আন্দোলনের ধার ভোঁতা করতে চাইছেন, নাকি জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতি তুলে দিয়ে রাজ্য সরকারের অস্বস্তি কমাতে চাইছেন? আসল বিষয় তো ‘তিলোত্তমা’ বা ‘অভয়া’র ধর্ষণ ও হত্যার বিচার ও অভিযুক্তদের শাস্তি, আশার কোনো আলো তো দেখা যাচ্ছে না।

একথা হাজার ভাগ সত্য, মেয়েরা যাতে নির্ভয়ে অবাধে চলাফেরা করতে পারে, কাজের জায়গায় কাজ করতে পারে, তার জন্য নিরাপত্তা সব ক্ষেত্রেই জোরদার হওয়া দরকার। কোনো একজন মেয়ে বিপদে পড়ে ডাকলেই যাতে কাছাকাছি কোনো পুলিশের সহায়তা পেতে পারে তার ব্যবস্থা হওয়াটাও খুব জরুরি। তার জন্য পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো এবং সর্বত্র সিসি ক্যামেরার নজরদারি দরকার। কারণ, কোনো অপরাধ ঘটলে তার তদন্তে পুলিশ এবং ক্যামেরা অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা নিতে পারে। তার মানে মেয়েদের ওপর আক্রমণ হবেই, বিপদ ঘটবেই এটা আজ ধরেই নিতে হচ্ছে। প্রশ্ন, পুলিশের সংখ্যা আরও বাড়িয়ে এবং চারপাশে আরও বেশি সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে সত্যি কি মেয়েদের ওপর ক্রমাগত বাড়তে থাকা আক্রমণ প্রতিরোধ করা যাবে অথবা কমানো যাবে? মেয়েদের নিগ্রহ কিংবা ধর্ষণ-হত্যার বিরুদ্ধে অত্যন্ত কড়া আইন দিয়ে, অপরাধীকে কঠিন শাস্তি দিয়ে কি এই অপরাধ রোখা যাবে? উল্লেখ্য, নির্ভয়াকাণ্ডের পরে প্রবল গণবিক্ষোভের চাপে ধর্ষণ-খুন সংক্রান্ত আইন বদলানো হয়, সাজা আগের তুলনায় অনেক কঠোর হয়। দেখা যাক, ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরোর তথ্য কী বলছে? বলছে, ২০১৮ সালে প্রতি ১৫ মিনিটে দেশে একজন মহিলা ধর্ষিতা হয়েছেন। ওই তথ্যই জানাচ্ছে, ২০২২ সালেও প্রতি ১৫ মিনিটে ধর্ষিতা নারীর সংখ্যা একটিও কমেনি।

তার মানে এটা বুঝতে হবে, সংখ্যায় পুলিশ যতই বাড়ানো হোক, প্রকাশ্যে আড়ালে সিসি ক্যামেরা যতই বাড়ানো হোক, আইনকে যত কঠিন কঠোর করা হোক, মেয়েদের ওপর অত্যাচার বা ধর্ষণ-খুনের সংখ্যাটা অনেক বেশি এবং তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কেবল তথ্যেই নয়, বাস্তবিকই বাড়ছে এবং সেই ক্রমবৃদ্ধির গতি এতটাই দ্রুত যে তার সঙ্গে পেরে উঠতে ব্যর্থ হচ্ছে যেকোনো রাজ্যের প্রশাসনিক ব্যবস্থা। সাধারণ মানুষকে এটা আজ বুঝতে হবে, কেবল আইন কঠোর করে, আরও পুলিশ বাড়িয়ে, চারদিকে সিসি ক্যামেরার নজরদারি বাড়িয়ে নিরাপত্তাবলয় তৈরি করা গেলেও মেয়েদের ওপর নির্যাতন কমানো যাবে না, অপরাধ মোকাবিলাও করা যাবে না। সাধারণ মানুষ তো তার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝেছে, আমাদের পুলিশব্যবস্থা ও প্রশাসনের রন্ধ্রে দুর্নীতি কৃমি কীটের মতো কিলবিল করছে। কেবল কি তাই? পুলিশকর্তারা ক্ষমতাসীন দলের অনুগত সেবক হিসেবে কাজ করতে করতে নিজেদের দলদাসে পরিণত করেছে। দীর্ঘ যুগের কালের অভ্যাসে পুলিশের পক্ষে আর পক্ষে যেমন স্বাধীনভাবেও নয় তেমনি নিজের বিবেক দিয়েও কাজ করা সম্ভব নয়। বিশদ ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই, আরজি কর হাসপাতালের ঘটনার পুলিশি তদন্ত তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। চূড়ান্ত দুর্নীতিগ্রস্ত শাসক তথা দলগুলো আজ রাজনীতির যে দুর্বৃত্তায়ন ঘটিয়েই চলেছে তাতে এটাই দেখা যাচ্ছে যে, এই সমাজের যত ধর্ষক-খুনি তাদের অধিকাংশই সেসব দলের ছত্রছায়ায় লালিত-পালিত। সাধারণ মানুষকে ত্রাসে রাখা থেকে শুরু করে ভোট লুট- এসব কাজেই শাসকদল তাদের ব্যবহার করে। তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শাসকদল শাস্তি দেওয়ার পরিবর্তে তাদের অপরাধ আড়াল করতেই ব্যস্ত থাকে। তা সে যে রাজ্যের যে সরকারই হোক, পার্কস্ট্রিট, কাটোয়া, কামদুনি, ধূপগুড়ি, মধ্যমগ্রামের সরকার হোক অথবা উন্নাও, হাথরস, কাঠুয়ার সরকারই হোক বা তার আগের সরকারই হোক। 

পুলিশ নিজেই তো বহু রাজ্যে নানা অপরাধে অভিযুক্ত, এমনকি ধর্ষক, নারী নির্যাতনকারীদের আড়াল করার জন্য। পাশাপাশি এই প্রশ্নও এসে পড়ছে- ভারতের সর্বোচ্চ আদালত দায়িত্ব নেওয়ার পরে এক সপ্তাহের বেশি কেটে গেলেও তদন্ত কত দূর এগিয়েছে, তা প্রকাশ্যে এল না। কেবল প্রশ্ন আর প্রশ্ন তাতেই কি আমরা সন্তুষ্ট থাকব?

যেকোনো মূল্যে সুবিচার পেতেই হবে, দোষীদের শাস্তি দিতে হবে, এই দাবি থেকে এক চুল সরে আসা যাবে না। পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো, কোনায় কোনায় সিসি ক্যামেরা ইত্যাদি কথায় চিঁড়ে ভিজবে না। কিন্তু ভুললে চলবে না শুধু আইন দিয়ে, পুলিশের সংখ্যা বাড়িয়ে এই অপরাধ কমানো যাবে না। এটি সমাজের একটি গভীর অসুখ, মানসিকতা- এই অসুখ কঠোর আইন করেও বদলানো যাবে না। এই বিষয়ে তলিয়ে ভাবতে হবে আন্দোলনকারীদের। এই ভাবনার দায় তাদের, ভোটের রাজনীতি করা দল বা কর্মী-নেতাদের নয়। স্বভাবতই তারা আন্দোলনে শামিল আছেন কেবলমাত্র ভোটের ফায়দা তুলতেই। তারা ভোট ছেড়ে সমাজব্যবস্থা, মনন বা মানসিকতা বদলের কথা ভাববেন না। গভীর ভাবনা ভাবার দায় আন্দোলনকারীদেরই। দাবি যেমন আদায় করতে হবে, ভাবতেও হবে তলিয়ে। কারণ একদিন এই আন্দোলনের আগুনের আঁচ নিভে যাবে, ঝিমিয়ে পড়বে গতি, তীব্রতা। তারপর…।

লেখক: কলকাতা প্রতিনিধি, খবরের কাগজ

বিশেষ সাক্ষাৎকার: তানজিম আহমদ সোহেল তাজ দেশের এই পরিণতির জন্য পরিবারতন্ত্র দায়ী

প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৪৯ এএম
দেশের এই পরিণতির জন্য পরিবারতন্ত্র দায়ী

কেন রাজনীতি ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন তানজিম আহমদ সোহেল তাজ? কেন ছেড়েছিলেন মন্ত্রিত্ব। বাংলাদেশের প্রথম 
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের একমাত্র পুত্র সোহেল তাজ খবরের কাগজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সে কথাই বলেছেন। ইতিহাসের অজানা কিছু অধ্যায় নিয়েও আলোচনা করেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের গত সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামল নিয়ে খোলামেলা মন্তব্য করেছেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজ। তার মতে, আওয়ামী লীগের শাসনামলে অনেক ইতিহাস আড়াল করার পাশাপাশি 
বিকৃতও করা হয়েছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খবরের কাগজের সিটি এডিটর আবদুল্লাহ আল মামুন।


আওয়ামী লীগে গণতন্ত্র নেই এটার প্রমাণ পেয়েছি আমার মাকে দিয়ে। আমার মা, তিনি সারা জীবন নীতি-আদর্শ নিয়ে কাজ করেছেন এবং আমি দেখেছি আমার মা যখন কথা বলতেন দলীয় প্ল্যাটফর্মে, তিনি কীভাবে নিগৃহীত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের ভেতরে কয়েকটা ব্লক ছিল। সিনিয়র নেতা যারা ছিলেন, দেখা গেল যাদের ভয়েস ছিল, সেই ভয়েসগুলো আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে গেল। সেই ভয়েসগুলো আস্তে আস্তে নীরব হয়ে গেল। একচ্ছত্র একটা ক্ষমতার বেজ তৈরি করা হলো। দেখা গেল এই ক্ষমতা কুক্ষিগত করা হলো একটি পরিবারের মাধ্যমে। ওই পরিবারের সদস্যরাই আওয়ামী লীগের সব গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করল। আজকে যে পরিস্থিতি হয়েছে, এটার জন্য আমি দায়ী করছি পরিবারতন্ত্র কায়েম করা। যারা সুবিধাভোগী, তেলবাজ, দলবাজ, যাদের আমরা বলি হাইব্রিড, এরা দলটিকে সম্পূর্ণভাবে দখল করে নিয়েছিল। বাংলাদেশকে একটি ব্যুফে টেবিলের মতো ট্রিট করা হয়েছে। এখানে খাই খাই, সবাই খাই, যারা ক্ষমতায় আছে।...

খবরের কাগজ: কেন রাজনীতি ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন? আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন, না দেশ ছেড়েছেন- আপনি কোনটা মনে করেন?
সোহেল তাজ: জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে। আমি সেই মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলাম। আমারও খুব বড় স্বপ্ন ছিল দিনবদলের। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে আমরা পরিবর্তন করব। গতানুগতিক রাজনীতি থেকে সরে আসব, প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে সরে আসব। কিন্তু দুঃখ হচ্ছে এখানেই, আমরা সে ওয়াদা রাখিনি। জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। আমরা প্রতিহিংসা রাজনীতিতে মেতে উঠেছিলাম। 

খবরের কাগজ: এটা কে করেছিল, আওয়ামী লীগের ভেতর থেকে কোন পর্যায়ে একটু যদি পরিষ্কার করে বলতেন?
সোহেল তাজ: আপনি জানেন কি না, এখানে (আওয়ামী লীগ) তো কোনো গণতন্ত্র নেই। গণতন্ত্র শেষ হয়ে গেছে ৯০ দশকে। ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে দলটিকে আমার মা (জোহরা তাজউদ্দীন) পুনজ্জীবিত করেছিলেন। আপনি আমাকে বলেন, গত ২০ বছরে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক প্রসেসটা কি কাজ করেছে? আওয়ামী লীগের যেসব ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য, তারা তো বাসায় শোকেসের সাজানো জিনিস।

খবরের কাগজ: এই যে আওয়ামী লীগে গণতন্ত্র নেই, এটা আপনি কখন বুঝেছেন?
সোহেল তাজ: আওয়ামী লীগে গণতন্ত্র নেই এটার প্রমাণ পেয়েছি আমার মাকে দিয়ে। আমার মা, তিনি সারা জীবন নীতি-আদর্শ নিয়ে কাজ করেছেন এবং আমি দেখেছি আমার মা যখন কথা বলতেন দলীয় প্ল্যাটফর্মে, তিনি কীভাবে নিগৃহীত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের ভেতরে কয়েকটা ব্লক ছিল। সিনিয়র নেতা যারা ছিলেন, দেখা গেল যাদের ভয়েস ছিল, সেই ভয়েসগুলো আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে গেল। সেই ভয়েসগুলো আস্তে আস্তে নীরব হয়ে গেল। 

একচ্ছত্র একটা ক্ষমতার বেজ তৈরি করা হলো। দেখা গেল এই ক্ষমতা কুক্ষিগত করা হলো একটি পরিবারের মাধ্যমে। ওই পরিবারের সদস্যরাই আওয়ামী লীগের সব গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করল। আজকে যে পরিস্থিতি হয়েছে, এটার জন্য আমি দায়ী করছি পরিবারতন্ত্র কায়েম করা। যারা সুবিধাভোগী, তেলবাজ, দলবাজ, যাদের আমরা বলি হাইব্রিড, এরা দলটিকে সম্পূর্ণভাবে দখল করে নিয়েছিল। বাংলাদেশকে একটি ব্যুফে টেবিলের মতো ট্রিট করা হয়েছে। এখানে খাই খাই, সবাই খাই, যারা ক্ষমতায় আছে।

খবরের কাগজ: হাইব্রিডরা দখল করে নিয়েছিল। এটা যে দলের প্রধান শেখ হাসিনা কি বুঝতেন না? না কি তার প্রচ্ছন্ন বা সরাসরি কোনো ভূমিকা আছে?
সোহেল তাজ: আমি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আমাদের দলীয় নেত্রীকে শ্রদ্ধা করতাম। কারণ ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল, আমার সুযোগ হয়েছিল বিরোধীদলীয় রাজনীতি করার এবং তার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাছাকাছি এসে কাজ করার। কিন্তু আমি যখন দেশে আসি আমার সামনে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছিল।

খবরের কাগজ: এটা কারা করেছিল?
সোহেল তাজ: এটা করেছিল দলের একেবারে উচ্চ মহল থেকে।
খবরের কাগজ: উচ্চ মহল বলতে কাদের বোঝাচ্ছেন? একটু পরিষ্কার করে যদি বলতেন।
সোহেল তাজ: ১৯৭৪ সালে আমার বাবা তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভা থেকে বাধ্য হয়েছিলেন পদত্যাগ করতে। সেই সময় কাপাসিয়ায় যেসব নেতা ছিলেন, যারা তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছিলেন। সেই গোষ্ঠীকে আবার সক্রিয় করা হয়েছিল আমার বিরুদ্ধে। আমি যেই ‘লিগ্যাসি ক্যারি’ করছি, এই লিগ্যাসির একটা ইতিহাস আছে। সেটা চলে আসছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে। এটা টানলে চলে আসবে মুক্তিবাহিনী এবং মুজিব বাহিনী। এটা টানলে চলে আসবে ১৯৭১ সালে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা।

খবরের কাগজ: আপনি মনে করেন কি না, বিরোধিতার যে ধারাবাহিকতা, সেটা কি আপনার ক্ষেত্রে ওই পরিবারের পক্ষ থেকে হয়েছিল?
সোহেল তাজ: আমি বিশ্বাস করতে চাইনি, আমি সব সময় মনে করতাম, বিশ্বাস করতাম এটা ভুল-বোঝাবুঝি। হয়তো আমি এই বিভেদকে নিরসন করতে পারব। কিন্তু একটা পর্যায়ে দেখলাম এই বিরোধটা অনেক গভীরে। 
১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করল বাংলার বুকে। আমার বাবা গিয়েছিলেন ৩২ নম্বরে। বঙ্গবন্ধুর কাছে এবং পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তার একটা ঘোষণা দেওয়ার কথা ছিল স্বাধীনতার। আমার বাবা সেই কাগজটিতে স্বাক্ষর করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে বারবার অনুরোধ করেছিলেন। একপর্যায়ে তিনি সেটা না করাতে আমার বাবা বাসায় চলে আসেন। আমার মায়ের মুখ থেকে শুনেছি, আমার বাবা খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন এবং তিনি খুব হতাশ হয়েছিলেন। বাসায় এসে সব ফাইলটাইল ছুড়ে বলেছিলেন এই ২৩ বছরের আন্দোলন বৃথায় গেল, সবকিছু নষ্ট হয়ে গেল। আমরা দেখেছি যে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে গেলেন। বিষয়টি খুব মজার, তাজউদ্দীন আহমদ যখন সিদ্ধান্ত নিলেন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে সরকার গঠন করে যুদ্ধটা পরিচালনা করা অতি গুরুত্বপূর্ণ। তখন আমরা দেখেছি একটি গোষ্ঠী বিরোধিতা করেছিল। 

খবরের কাগজ: এই গোষ্ঠীটি বলতে কে কে ছিল? যদি একটু স্পষ্ট করে বলতেন।
সোহেল তাজ: এখানে শেখ মনির নেতৃত্বে ছাত্র নেতারা ছিলেন এবং আমরা যতটা জানি তারা একটা গোয়েন্দা সংস্থার ছত্রছায়ায় অ্যাক্টিভিটিসগুলো করেছিলেন। আমরা জানি মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী। কিন্তু মুজিব বাহিনীকে ট্রেনিং দিয়েছিল ‘র’ (ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা)। আমরা জানি ৯ মাসের ইতিহাসে মুজিব বাহিনী এবং মুক্তি বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল বেশ কয়েকবার। এটা কেন? এটা একটা প্রশ্ন। আমার প্রত্যাশা ইতিহাসবিদরা এটাকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করবেন এবং সঠিক ইতিহাস আমাদের জানতে হবে। কার কী ভূমিকা ছিল? আমার বাবা মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত দুঃখ করে বলেছিলেন- মুজিব ভাই একবারও জানতে চাইলেন না কীভাবে আমি যুদ্ধটা (মুক্তিযুদ্ধ) পরিচালনা করলাম!
খবরের কাগজ: বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ রাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তাটি চট্টগ্রামের স্থানীয় আওয়ামী লীগের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। পরে স্থানীয় নেতা আবদুল হান্নান কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে ২৬ মার্চ ঘোষণা করেন। এ সম্পর্কে আপনি আপনার বাবার কাছে কী শুনেছিলেন?

সোহেল তাজ: আমি যতটুকু জানি আমার বাবা বঙ্গবন্ধুর কাছে অনুরোধ করলেন। বঙ্গবন্ধু সাইন করলেন না, তিনি চলে এলেন। তারপর আমার বাবার সঙ্গে কিন্তু বঙ্গবন্ধুর দেখা হলো ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে।
কী কী ঘটেছে এগুলোই কিন্তু আমাদের অনুসন্ধান করা প্রয়োজন? আমরা জানি চিটাগাংয়ের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়া একটি ঘোষণা দিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান তো দিয়েছিলেন ঘোষণা, এটা তো অস্বীকার করার কিছু নেই। এগুলো আমাদের ক্লিয়ার করতে হবে। অনেক তথ্য-উপাত্ত আছে ইতিহাসবিদদের নিরপেক্ষভাবে কাজ করে এগুলো বের করে নিয়ে আসতে হবে, রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের জন্য।
খবরের কাগজ: ২৫ মার্চ রাতে কী ঘটেছিল, যেটা আমরা জানি না?
সোহেল তাজ: এটা অনেকটা ‘১৯৮৪’-এর মতো হয়ে যাচ্ছে। সেই বইটা পড়েছেন জর্জ অরওয়েল এর। যে ক্ষমতায় আসছে সেই ইতিহাস লিখছে। এটা তো এরকম হওয়ার কথা না। সঠিক ইতিহাসকে সংরক্ষণ করার দায়িত্ব আমাদের প্রত্যেকের। এটা প্রত্যেক বার হয়েছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগের মতো ইতিহাস করে। বিএনপি ক্ষমতায় এলে বিএনপির মতো করে ইতিহাস। আরেকজন এলে আরেকজনের মতো করে ইতিহাস। এটা কেন হবে? 
খবরের কাগজ: তার মানে আওয়ামী লীগের আমলে ইতিহাস বিকৃতি হয়েছে?
সোহেল তাজ: আওয়ামী লীগের আমলে অনেক অর্থে ইতিহাস আড়াল করা হয়েছে, কিছুটা বিকৃত করা হয়েছে।

খবরের কাগজ: আর অন্য সময়ে?
সোহেল তাজ: অন্য সময়েও বিকৃত করা হয়েছে এবং আড়াল করা হয়েছে।
খবরের কাগজ: সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন ২৫ মার্চ রাতে কি ঘটেছিল? তাজউদ্দীন আহমদ যে ঘোষণাপত্র বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধু সেই ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেননি। কেন করেননি এটা জানতেন? 
সোহেল তাজ: আমাদের জানতে হবে কেন করেননি। নিশ্চয়ই কোনো যুক্তি ছিল, নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য ছিল, লজিক ছিল। একটা প্ল্যান করা ছিল, তার পরও সেখান থেকে কেন সরে গেলেন। এটা তো তদন্ত করা উচিত। জাতির তো জানার অধিকার আছে কেন হলো। আমি তো এটা সাক্ষী ছিলাম না, কিন্তু এটা আমরা প্রশ্ন করতে পারি।

খবরের কাগজ: তার মানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, আওয়ামী লীগের আমলে কিছু কিছু ইতিহাস আড়াল করা হয়েছে?
সোহেল তাজ: আড়াই হাজার বছর আগে সক্রেটিস ছিল, প্লেটো ছিল, অ্যারিস্টটল ছিল। আমরা কি ছিলাম সেখানে? আমরা কি দেখেছি? বাট এভিডেন্স ছিল। ছোট ছোট ক্লু ছিল, সেগুলোকে সমন্বয় করে আমরা একটা চিত্র বের করে নিয়ে আসতে পারি।
খবরের কাগজ: একটা নিরপেক্ষ ইতিহাস আমরা বের করতে বের করে আনতে পারি?
সোহেল তাজ: এটা ৫০-৫২ বছর আগের ঘটনা। এখানে যারা সম্পৃক্ত ছিলেন তারা এখনো অনেকে জীবিত আছেন। এদের মধ্য থেকে যাদেরগুলো গ্রহণযোগ্য, তাদেরগুলো নিয়েই তো আমরা গঠন করতে পারি একটা চিত্র, কী হয়েছিল আসলে?
খবরের কাগজ: আপনি কি মনে করেন, গত সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের শাসনামলে ফ্যাসিবাদ এমন এক পর্যায়ে গিয়েছিল যার চিত্র আমরা জর্জ অরওয়েলের ‘নাইনটিন এইট্টি ফোর’ গ্রন্থে পাই?
সোহেল তাজ: আমি গত সাড়ে ১৫ বছর বিশেষ করে গত ১২-১৩ বছরে যে ঘটনাগুলো দেখেছি, দেশে যাতায়াত করেছি এবং গত পাঁচ ছয় সাত বছর দেশেই আছি। আমার কাছে হুবহু মিলে যাচ্ছিল সেই ‘১৯৮৪’এর সঙ্গে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে মনে হয়েছে ‘১৯৮৪’ বইয়ের সেই চিন্তক পুলিশের মতো। জর্জ অরওয়েল যদি বেঁচে থাকতেন, তিনি ভাবতেন ওয়াও আমাকেও ছাড়িয়ে গেছে। এভাবে চিন্তা করেন যে গণতন্ত্র যদি একটা ফুটন্ত ডেকচি হয় ওই ডেকচির ভেতরে মানুষ আমরা ফুটেছি পানির ভেতর। গত ১৫ বছর যেটা হয়েছিল এই যে অনিয়ম, দুর্নীতি, মৌলিক অধিকার হরণ হত্যা, গুম, নির্যাতন, লাগামহীন দুর্নীতি অর্থ পাচার। এই অবস্থায় আপনি জ্বালটা বাড়িয়ে দিয়েছেন আবার ঢাকনাটা চেপে রেখেছেন। ৫ আগস্ট এই ডেকচিতে অনিবার্য বিস্ফোরণ ঘটেছে। আওয়ামী লীগ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।

খবরের কাগজ: এই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াটা- আপনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে কাজ করছিলেন। হঠাৎ করে আপনি পদত্যাগ করলেন। আপনার পদত্যাগের পরিষ্কার কোনো কারণ যদি বলতেন।
সোহেল তাজ: একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে, তখন প্রধানমন্ত্রী বললেন, কী রাজাকারদের নাতি-পুতিদের দেব? জনগণের সেন্টিমেন্ট বুঝতে পারলেন না। সার্বিকভাবে নতুন জেনারেশনের সেন্টিমেন্টটা কি? তার মধ্যে ফুটন্ত ডেকচি আছে। ফলাফল হলো কি- আমি কে তুমি কে? রাজাকার রাজাকার! এই স্লোগানের প্রথম অংশ নিয়ে অপপ্রচার হলো। আমি কে তুমি কে? রাজাকার রাজাকার! কে বলেছে, কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার! এই লাইনটা বাদ দিয়ে প্রোপাগান্ডা ছড়াল।
খবরের কাগজ: স্লোগানটিকে বিকৃত করে একটা অংশকে প্রচার করা হয়েছে- আপনি বলছেন?
সোহেল তাজ: ইয়েস, সমাধানের পথ না বেছে confrontation-এর পথকে বেছে নেওয়া হলো। আমার পয়েন্টটা এখানে। শত শত মানুষকে মেরে ফেলার মাধ্যমে গণবিস্ফোরটা ঘটে গেল। 

খবরের কাগজ: বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেন। তার মেয়ে শেখ হাসিনা শেষ দিকে এসে এমন একটি ঘটনা-
সোহেল তাজ: আমি মনে করি, আদর্শ কারও ব্যক্তিগত সম্পদ না। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল পূর্ব বাংলার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। পূর্ব পাকিস্তানের সব জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। মানুষ জেগে উঠেছিল দুঃশাসনের বিরুদ্ধে। যেখান থেকে একটা আদর্শ বেরিয়ে এসেছিল মুক্তির জন্য, স্বাধীনতার জন্য।
সেই আদর্শের সিম্বল ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশের সব জনগোষ্ঠী ছিল এই আদর্শের মালিক। কিন্তু সিম্বল ছিলেন বঙ্গবন্ধু। এটা একক কারও আদর্শ ছিল না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত আমাদের দেশের ইতিহাসটা আরেকবার আমাদের পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ১৯৭২ সালের পর থেকে কি এখানে সুশাসন ছিল?
খবরের কাগজ: ১৯৭২ থেকে ৭৫ বঙ্গবন্ধু নেতৃত্বে যে সরকার ছিল আপনি তার কথায় বলছেন যে সেখানে সুশাসন ছিল কি না?
সোহেল তাজ: তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন বাকশাল তৈরি করার আগে যে আপনি এই কাজ করলে আপনাকে শান্তিপূর্ণভাবে সরাবার পথ বন্ধ করে দেবেন এবং আপনাকে সরাবার একমাত্র পথ হবে আপনাকে হত্যা করা এবং আপনিও যাবেন আমরাও যাব আপনার সঙ্গে। 

খবরের কাগজ: বাকশালের বিরোধিতার কারণেই কি তাজউদ্দীন আহমদকে সরকার থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল?
সোহেল তাজ:  আমরা যদি বিষয়টি পর্যালোচনা করি, এনালাইসিস করি, তাহলে সেদিকেই ইঙ্গিত করছে। 
খবরের কাগজ: আপনার পদত্যাগের পেছনে এরকম কোনো ঘটনা ঘটেছিল? 
সোহেল তাজ: আমি আপনাকে শুরুতেই বলেছিলাম আওয়ামী লীগের দিনবদলের সনদ ছিল। আমি কেঁদে ফেলেছিলাম, যেদিন আমি শপথ নিয়েছিলাম মন্ত্রী (প্রতিমন্ত্রী) হিসেবে। ১৬ কোটি মানুষের দায়িত্বভারের একাংশ আমার কাছে। আমার আস্থা ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর। কিন্তু কিছু কিছু ঘটনা আমি যখন প্রত্যক্ষ করলাম।
খবরের কাগজ: কি প্রত্যক্ষ করেছিলেন?
সোহেল তাজ: একটা ঘটনা আমাকে খুব নাড়া দিয়েছিল। একদিন আমার নেত্রীকে বলতে শুনলাম, বিএনপি-জামায়াত অনেক টাকা কামিয়েছে। এখন আমাদের দুই হাতে টাকা কামাতে হবে। এটা আমাকে শক করেছিল। 
খবরের কাগজ: এটা কোন ফোরামে বলেছিলেন? 
সোহেল তাজ: অনেক সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে একটি ইনফরমাল মিটিংয়ে। 
খবরের কাগজ:  যমুনাতে না কি গণভবনে? 
সোহেল তাজ: এটা যমুনাতে। এরকম ঘটনা আমি সংসদ ভবনেও শুনেছি। 

খবরের কাগজ:  তখন নেতারা কি বলেছিলেন? 
সোহেল তাজ: নেতারা তো লাইসেন্স পেয়েছেন দুর্নীতি করার। কিন্তু এখানে আবার একটা বিষয় আছে, আপনাকে লাইসেন্স দেওয়া হলো দুই হাতে টাকা কামাবার। আবার আপনাকে কিন্তু বলা হচ্ছে, আপনার ফাইলও আমার কাছে আছে। তার মানে আমার লাইনের বাইরে গেলেই কিন্তু আপনার খবর হয়ে যাবে। হাউ ইজ ওয়ার্ক। দলীয় নেতা-কর্মীদের কীভাবে লাইনে রাখতে হয়, এটা একটা মেকানিজম। আপনাকে এলাও করা হচ্ছে অনিয়ম-দুর্নীতি করতে। কিন্তু শর্ত হচ্ছে আমাকে মানতে হবে। আপনি যেই মুহূর্তে আমার লাইনে বাইরে যাবেন আপনি এক্সপোজ হয়ে যাবেন। আমরা এটার একটা ছোট্ট উদাহরণ পেয়েছিলাম ক্যাসিনো সম্রাটের কাহিনিতে। এখানে ফ্যামিলির ভেতরে আবার ভাগাভাগি আছে। সম্রাট ছিল আর এক অংশের রিপ্রেজেন্টেটিভ। তারা যখন লাইনের বাইরে গিয়েছে তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আবার সমঝোতা করে ঠিক করা হয়েছে। 
খবরের কাগজ: এই যে আদর্শ থেকে সরে গিয়ে, দিনবদলের সনদ বাস্তবায়ন করে ক্ষমতায় এসে সরাসরি দুর্নীতিকে উৎসাহিত করা, এটাও কি মূল কারণ ছিল আপনার পদত্যাগের?
সোহেল তাজ: না না, এটা তো একটা কারণ। 

খবরের কাগজ: সুনির্দিষ্ট কারণটা কী?
সোহেল তাজ: আপনার সঙ্গে আমার ওই দিন (পদত্যাগের দিন রাতে) কথা হয়েছিল। প্রত্যকটি মন্ত্রণালয়ে অনিয়ম। মন্ত্রীর কাজ সরকার পরিচালনা করা। সরকারের কাজ দলীয় যে ম্যান্ডেট পেয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করা। কয়জন মন্ত্রী জানত তার কাজ কী? খুব কম মন্ত্রিরা জানতেন। কাজগুলো করেছে সচিবরা। মন্ত্রীরা হচ্ছে ফানফেস। অনিয়ম যদি চলতে থাকে মন্ত্রীরা সেভ। মন্ত্রীর কাজগুলো করা হয় সচিবদের মাধ্যমে। মুখ্য সচিব ছিলেন এটার মূল। আমার নিজের অভিজ্ঞতা এমপি, মন্ত্রীদের ইন্ট্রোগেট করত ডিজিআইএফ-এর লোকজন। 

খবরের কাগজ: আপনার ক্ষেত্রে?
সোহেল তাজ: আমি বলেছি গেট লস। প্রধানমন্ত্রীকে গিয়ে বলেন, আমি কোনো কথা বলব না। ডিজিএফআই দিয়ে যখন দল পরিচালনা করা হয় এবং দলের কোর পলিসি সেট করা হয়, তার মানে বুঝতে পারছেন? 
আরেকটা বিষয়, দুর্নীতি-অনিয়মের পাশাপাশি আমার কাজ করার কোনো স্কোপ ছিল না। একটা ঘটনা ঘটেছে, যেটা আমি পরে জানতে পেরেছিলাম। আমাকে বারবার আন্ডার মাইন্ড করা হচ্ছিল। আমি দেখতাম, আমি একটি ইনস্ট্রাকশন দিচ্ছি, ইনস্ট্রাকশন ফলো করা হচ্ছে না। পরে আমি জানতে পারলাম, একেবারে ওপর থেকে বলা হয়েছিল ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাকে এবং আমার অধীন যারা আছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর কোনো ইনস্ট্রাকশন ফলো করা যাবে না।
শেষ পর্ব আগামীকাল...

বাজার ব্যবস্থাপনায় সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে

প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১১:০৬ এএম
বাজার ব্যবস্থাপনায় সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান

সম্প্রতি আমরা দেখেছি, অন্তর্বর্তী সরকার মুরগি ও ডিমের দাম নির্ধারণের চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি। পূর্ববর্তী সরকারও অনুরূপ চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কোনো সফলতা পায়নি। কেন এই ধরনের প্রচেষ্টা বারবার ব্যর্থ হচ্ছে?

যদি কেউ এই নিয়ন্ত্রিত মূল্যের ওপর ভিত্তি করে ভোক্তাদের চাহিদার প্রতি সাড়া দেয়, বিশেষ করে ভোক্তাদের কল্যাণ্যের কথা চিন্তা করে, তাহলে এটি তেমন কোনো কাজে আসবে না। সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের, অর্থাৎ সরকারকে সরবরাহ ধাপগুলোর বাস্তবতা সম্পর্কে বাস্তব বোঝাপড়া থাকতে হবে, তাত্ত্বিকভাবে বুঝলে হবে না। তাদের বুঝতে হবে কোথাও ব্লক আছে কিনা এবং সেই ব্লকগুলো কাটিয়ে ওঠা যাবে কিনা। যেমন- এমন কোনো গোষ্ঠী আছে কিনা, যারা বাজারের দামের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। 

বহু বছর ধরে সিন্ডিকেট একটি বহুল ব্যবহৃত শব্দ। সিন্ডিকেট আছে, এটিই বাস্তবতা। আর বাজার নিয়ন্ত্রণের সমন্বিত একটি গ্রুপ, যারা সরবরাহের চেইন নিয়ন্ত্রণ করে। তারা সেই জায়গা থেকে নীতিনির্ধারকদের প্রভাবিত করতে পারে। ক্ষমতাচ্যুতের শাসনামলে আমরা সেটাই দেখেছি। 

হাসিনা সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী যখন বলেছিলেন, তিনি বেশি কিছু করতে পারবেন না, তখন তার মানে বুঝে নিতে হবে যে, তিনি সিন্ডিকেটের একটা অংশ। তাই তিনি বেশি কিছু করতে পারেননি।

এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। আমাদের বুঝতে হবে, সিন্ডিকেট এখনো সরবরাহে কতটা প্রভাব ফেলছে। তারা এত সহজেই অদৃশ্য হওয়ার সম্ভাবনা নেই। যদিও বর্তমান নীতিনির্ধারকদের তাদের সঙ্গে কোনো যোগসূত্র নেই। তবে তাদের অবশ্যই সরবরাহ চেইন ব্যবস্থাপনাকে বোঝা ও প্রভাবিত করার ক্ষেত্রগুলো বুঝতে হবে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করতে হবে। যদি তারা সরবরাহ চেইনকে প্রভাবিত করতে পারে বা এমন কোনো পরিবর্তনশীল দ্রব্যের ওপর কাজ করতে চায়, তাহলে সেদিকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। 

অরাজনৈতিক হলেও সরকার এই বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। তাদের বুঝতে হবে, এই প্রভাবটা কি নীতি প্রক্রিয়ায় আছে নাকি তা শুধু আমলাতান্ত্রিক ব্যাপার। নীতিনির্ধারকরা কি আমলাদের ওপরে? তাদের কি বোঝার কোনো বিষয় আছে? সরবরাহ চেইন ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রে বাস্তবতা বোঝার জন্য বর্তমান সরকারের খুব বেশি প্রচেষ্টা আমি দেখিনি। তাদের নিজেদেরই উত্তর খুঁজে বের করতে হবে। আমি এই মুহূর্তে সরবরাহের ধাপগুলোর বাস্তবতা সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত নই। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও তেমন কাজ হচ্ছে না। 

অন্যান্য ব্যবস্থা থাকতে পারে। যখন ব্যবসায়ীরা স্টোরেজে সরবরাহ রাখে, তখন তারা এই ধরনের ব্যবসার জন্য ব্যাংক ক্রেডিটের ওপর নির্ভর করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ব্যাংক ক্রেডিট ঋণ নেওয়ার সুযোগ থাকে। ধরুন, আমি একজন সরবরাহকারী এবং আমি ১ কোটি টাকা ব্যাংক লোন নিয়েছি, আমি সরবরাহগুলো স্টোরেজে রাখছি এবং বাজারে ছাড়ছি না।

 এভাবে রাখলে আমার ঋণ ৯০ দিনের মধ্যে ম্যাচিউরড বা পরিপক্ব হবে। এখানে নীতিনির্ধারকরা ঋণের মেয়াদ ৩০ দিনে পরিবর্তন করে পরিপক্ব করতে পারেন। তখন মাল বিক্রি করা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় থাকে না। এই ধরনের হস্তক্ষেপের জন্য মাল সরবরাহ চেইন প্রক্রিয়া এবং বর্তমান বাস্তবতা বোঝা দরকার। সরবরাহের প্রকৃত অভাবের কারণে কি দাম বেশি হচ্ছে? সরবরাহ কোথাও কি আটকে রাখা হয়েছে এবং তা ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে না বলেই কি দাম এত বেশি?
উৎপাদনকারীরা যদি বলে যে, তাদের উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় তাদের বেশি দাম নেওয়া দরকার, তাহলে প্রশ্ন হওয়া উচিত কীভাবে উৎপাদন খরচ কমানো যায়।

এ ছাড়া সরকার সর্বদা খোলা বাজার বিক্রয় (ওএমএস) এবং অন্যান্য সরঞ্জামের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তারা ওএমএস নীতিকে আরও বড় আকারে প্রসারিত করতে পারে, যা সরবরাহকারীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে যারা সরবরাহ আটকে রাখছে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে। অবশ্যই, এটি সরকারের আর্থিক সক্ষমতা আছে কিনা তার ওপর নির্ভর করে।

আরেকটি উপায় হলো- উৎপাদক, বীজ উৎপাদক, ব্যবসায়ী, রপ্তানিকারক বা পশুখাদ্য বা বিভিন্ন ধরনের কৃষি উপকরণের আমদানিকারকদের প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে। সরকার পুরো প্রণোদনা ব্যবস্থার দিকে নজর রাখতে পারে এবং সৃজনশীলভাবে তাদের উৎসাহিত করার চেষ্টা করতে পারে, যারা সরবরাহ চেইন উন্নত করতে পারে। তাহলে দাম আরও যুক্তিসঙ্গত হবে বলে আশা করি। 

তিনটি ক্ষেত্রে সরকারের নজর দেওয়া উচিত: ১) উৎপাদক ও আমদানিকারকদের জন্য প্রণোদনা এবং কীভাবে উৎপাদন বাড়ানো যায় তা দেখা, ২) সরবরাহ নীতির শাসন, যেখানে ঋণের পরিপক্বতার মতো আর্থিক উপকরণগুলো নিয়ন্ত্রণের সরঞ্জাম হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে এবং ৩) শাসন-সংক্রান্ত সমস্যা, যেমন চাঁদাবাজিতে বাধা। পরিচিত চাঁদাবাজ এখন আশপাশে নাও থাকতে পারে, তবে কি নতুন চাঁদাবাজ আছে? আমরা কি তাদের কোনো উপায়ে ধরতে পারি?

এর মধ্যে কিছু সিন্ডিকেট বা যারা উচ্চমূল্যের জন্য দায়ী তারা প্রায়ই পাল্টা যুক্তি দিয়ে থাকে। তারা বলে, এটা হলো বাজারের একটি প্রক্রিয়া। তারা দাম বেশি রাখে এবং তাদের নিজের স্বার্থে বাজারের এই প্রক্রিয়াগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। তবে সরকারের উচিত সাধারণ মানুষের স্বার্থে বাজার প্রক্রিয়া পরিচালনা করা। এটি করার জন্য সরকারের সব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রয়েছে। এটি কেবল আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর ওপর নির্ভর করতে পারে না, মাঠেও যেতে পারে। 

আমরা আমলাতান্ত্রিক সমাধান খুব পছন্দ করি। বাজার মনিটরিং প্রক্রিয়া মানে যদি আরেকটি কমিটি নিয়োগ করা হয়, তা হলে আমি সে বিষয়ে সন্দিহান। মনিটরিং একটি গতিশীল কার্যকলাপ এবং কয়েকটি পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়া ইতোমধ্যেই বিদ্যমান আছে। যেমন- বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) নিয়মিতভাবে ভোক্তা মূল্য সূচক তৈরি করার কথা। বিবিএসকে এই বিশেষ কাজের জন্য তাদের ক্ষমতা প্রদান করা এবং সময়োপযোগী তথ্য সংগ্রহ করার অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে।
 এছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন, যার কিছু বাজার পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব রয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক, এসব প্রতিষ্ঠান সবই পাঠ্যপুস্তকে আবদ্ধ এবং আমলাতান্ত্রিক একঘেঁয়েমি রয়েছে। তারা শুধু শাস্তির দিকে নজর দেয় কিন্তু কার্যকর করে না। আমলারা শাস্তি খুব পছন্দ করে। তারা বাজারে যায় এবং নিয়ম ভঙ্গকারীদের শাস্তি দেয়। যদিও শাস্তি কখনো কখনো কাজ করে। 

বাজার পর্যবেক্ষণের জন্য হালনাগাদ ও ব্যবহারযোগ্য ডেটা প্রয়োজন, যা নীতি প্রক্রিয়ায় একাধিক ব্যবহারকারীর কাজে লাগে। এ ছাড়া কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের মতো সুশীল সমাজের সংস্থাগুলোকেও বড় ভূমিকা পালনে সক্রিয় করা যেতে পারে। এই সরকারের নতুন কিছু করার সুযোগ রয়েছে। তারা মাঠে যেতে পারে এবং বাজার নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে। 
এটি হচ্ছে সরবরাহের মূল বাস্তবতা। যেমন- কী ধরনের মূল্য সংযোজন ঘটছে? ধানের দামে লক্ষ করা যায়, সাধারণত ফসল কাটার পরে তা কমে যায়। কয়েক বছর ধরে, এটি হচ্ছে না। এই পুরো প্রক্রিয়ায় রাইস মিল মালিকরা জড়িত। ২০০৮ সালে তৎকালীন বাণিজ্য উপদেষ্টা হিসেবে আমি নওগাঁ গিয়েছিলাম এই বিষয়ে একটি প্রথম ধারণা পেতে। কারণ, নওগাঁ বাংলাদেশের মিলের রাজধানী।

মিল মালিকরা বাজার তাদের দখলে রাখার জন্য বড় বিনিয়োগ করেন এবং তারা এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু তারা কি সিন্ডিকেট? বাজার থেকে একটি পণ্য আটকে রাখা বা না রাখার ক্ষমতা তাদের কতটুকু? চাল সরবরাহের ক্ষেত্রে সরকারি ক্রয়প্রক্রিয়া খুবই রাজনৈতিক। তবে প্রকৃত কৃষকরা এতে কোনো উপকার পান না।

তাহলে কি দাম ধীরে ধীরে নিচের দিকে যাবে না? অনেক ক্ষেত্রে তা হয় না। আমাদের এটাকে পরীক্ষামূলকভাবে দেখতে হবে। আমরা অনুমান করতে পারি না যে, এটি হয় না। ঢাকার ভোক্তারা সব ক্ষেত্রেই মধ্যস্বত্বভোগীদের ভিলেন বলে মনে করে। আমরা বিপণন প্রক্রিয়ার ওপর PPRC থেকে ২০০৬ সালে একটি গবেষণা পরিচালনা করেছিলাম।

আমরা দেখেছি, ফড়িয়া- যারা বাইরে গিয়ে কৃষক বা সরাসরি বাজার থেকে পরবর্তী বাজার পর্যায়ে স্থানান্তরিত করার জন্য পণ্য সংগ্রহ করেন, তারাও চরম দরিদ্র গোষ্ঠীর অংশ। তাদের প্রায়ই আর্থিক অবস্থা ভালো থাকে না। কৃষি ব্যবসা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসা, বিশেষ করে যারা সেখানে পুঁজি বিনিয়োগ করে। যদিও কিছু মধ্যস্বত্বভোগী ভিলেন হয়ে যায়, তবে আমরা সবাইকে এক কাতারে গণ্য করতে পারি না। মধ্যস্বত্বভোগী ছাড়া ফসল মাঠ থেকে আপনার টেবিলে যাবে না। এখানে পণ্য সরবরাহের একাধিক স্তর রয়েছে। মানুষ এই প্রক্রিয়ার বিভিন্ন স্তর থেকে লাভবান হয়ে থাকে। 

লেখক: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ও নির্বাহী চেয়ারম্যান, পিপিআরসি

মার্কিন নির্বাচন এবং আমেরিকার ভবিষ্যৎ

প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১০:৪১ এএম
আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১২:৩৭ পিএম
মার্কিন নির্বাচন এবং আমেরিকার ভবিষ্যৎ
উইটনি আরানা

যত দিন যাচ্ছে হোয়াইট হাউসের প্রতিযোগিতার দৌড় তত গভীর হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে দুই প্রার্থী কমলা হ্যারিস এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প পাল্লা দিয়ে দৌড়াচ্ছেন। ভোটারদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অর্থনীতি। কমলা হ্যারিস এক মাসের ব্যবধানে তার প্রতিপক্ষ ডোনাল্ট ট্রাম্পের চেয়ে নিম্নগামী অবস্থানে রয়েছেন। ডোনাল্ট ট্রাম্প অনেকদূর এগিয়ে রয়েছেন। 

নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির নুরিয়েল রুবিনি যুক্তি দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব এমন এক বিষয়, যা ট্রাম্পের প্রাপ্য নয়। কমলা হ্যারিস এবং ট্রাম্পের মধ্যে আর্থিক, বাণিজ্য, জলবায়ু, অভিবাসন, মুদ্রা এবং চীননীতি নিয়ে তাদের মত ভিন্ন। ট্রাম্পের নির্বাচনি এজেন্ডা হলো মূল্যস্ফীতি কমানো, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস করা (শুল্ক, মুদ্রার মূল্যহ্রাস এবং অভিবাসনের বিধিনিষেধের মাধ্যমে)। তবে ট্রাম্পের অর্থনীতি বাজারের যে কী পরিমাণ ক্ষতি করবে তার বাজারমূল্য এখনো নির্ধারণ করা হয়নি।
 
নোবেল বিজয়ী জোসেফ ই. স্টিগলিৎজের মতে, দুই প্রার্থীর মধ্যে তাদের স্বাধীনতা ও মতের পার্থক্য দেখা দিয়েছে। এই নির্বাচনে প্রতিটি বড় ইস্যু, যেমন- নারীদের শারীরিক স্বায়ত্তশাসন, ড্রাগের ব্যবহার এবং আবাসনের দামের ব্যাপারে কমলা হ্যারিস আমেরিকানদের স্বাধীনতাকে আরও প্রসারিত করবেন। ডোনাল্ট ট্রাম্প সেগুলোকে আরও হ্রাস করবেন। কমলা হ্যারিসের এজেন্ডা হলো সাধারণ আমেরিকানদের সাহায্য করা এবং তাদের সেই ধরনের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। অন্যদিকে ট্রাম্প দেশের অর্থনীতিকে নিম্নগামীর দিকে নিয়েছেন। 

ট্রাম্পের জন্য এবারের নির্বাচন বড় একটা বিষয় হতে পারে। নিউ স্কুলের নিনা এল ক্রুশ্চেভা বলেছেন, ট্রাম্প মুক্ত ও সমৃদ্ধ আমেরিকাকে নেতৃত্ব দেওয়ার চেষ্টা করা থেকে অনেক দূরে রয়েছেন। তিনি ট্রাম্পকে দেখিয়েছেন, তিনি অত্যন্ত দুর্বল, বিভক্ত এবং দুর্দশাগ্রস্ত সমাজের ওপর শাসন করতে আগ্রহী। তিনি একজন ভয়ানক একনায়ক। আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নির্বাসন প্রচেষ্টা যা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসনীতি যেখানে অনথিভুক্ত অভিবাসীরা শুধু ভুগতেই থাকবে। ট্রাম্প যত প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সেই পরিমাণে তেমন কোনো কথা রাখেননি। 

হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের সিনিয়র ফেলো এডোয়ার্দো ক্যাম্পানেলা বলেছেন, ডোনাল্ট ট্রাম্পের আরেকটি প্রেসিডেন্টের মেয়াদে কয়েক দশকের পুরোনো আমেরিকার ঐতিহাসিক বর্ণগত ও রাজনৈতিক বিভাজনের সংগ্রাম আরও বাড়তেই থাকবে। যদি ট্রাম্প নির্বাচনে হেরে যান, তাহলে জনসংখ্যার প্রবণতা বাড়বে এবং ট্রাম্পপন্থি রিপাবলিকান পার্টি ভেঙে পড়বে। আগামীতে আমেরিকার গণতণত্রে অনেক পরিবর্তন আসবে। 

কমলা হ্যারিসের বিজয় হয়তো আমেরিকার গণতন্ত্রের সংকটের অবসান ঘটাতে পারবে না। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের টম গিন্সবার্গ এবং আজিজ হক উল্লেখ করেছেন, হ্যারিস আমারিকার প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর সরাসরি আক্রমণ বন্ধ করে দেবেন। কেউ দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হলে রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ অর্জন করে এবং স্বৈরাচারী আচরণ করে। হাঙ্গেরি, ভারত এবং পোল্যান্ডের বর্তমান পরিস্থিতি দেখে যে কেউ সেই অভিজ্ঞতা নিতে পারে। ডোনাল্ট ট্রাম্প দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এলে তার প্রশাসন হবে আরও নিষ্ঠুর। তখন তার ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য যা করা দরকার তাই তিনি কার্যকর করবেন। 

ট্রাম্প যদি আমেরিকার অর্থনীতি, সমাজ এবং গণতন্ত্রের জন্য এত বড় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তিনি কীভাবে এত সমর্থন পেয়েছেন? রিড গ্যালেন যিনি দ্য লিঙ্কন প্রজেক্টের একজন সহপ্রতিষ্ঠাতা ও জয়েন দ্য ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট গণমাধ্যমে বলেছেন, কয়েক দশক ধরে অত্যন্ত আসক্তিপূর্ণ ডানপন্থির কারণে আমেরিকা বসবাসের মতো আর অবস্থানে নেই। 

কমলা হ্যারিস জয়ী হলে গণমাধ্যম আবার ফুঁসে উঠবে, জোর গলায় কথা বলবে, অসভ্য ভাষায় কথা বলবে এবং বাস্তবতাকে এড়িয়ে যাবে। আমেরিকানদের কঠোর পরিশ্রম করার ওপর জোর দিতে হবে। আমেরিকানদের নিজেদের জায়গায় হয়তো স্বস্তি ফিরে পাবে না এবং তাদের আবার ২০২৮ সালের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। 

লেখক: সম্পাদক, প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল

সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় সংস্কার

প্রকাশ: ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ১২:২০ পিএম
সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় সংস্কার
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

আর্থিক খাতের সংস্কার

বাংলাদেশের আর্থিক খাতে মূলত বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় এখন পর্যন্ত যে সংস্কার হয়েছে, সেগুলো ব্যাংকঋণ বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি উন্নতকরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। নির্দিষ্ট খাতটির উন্নতিকল্পে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগগুলো বেশির ভাগ ব্যাসেল-১, ২ বা ৩-এর আলোকে গৃহীত তথা ঝুঁকির বিপরীতে মূলধন ব্যবস্থাপনাভিত্তিক।

বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বাড়লেও অনেক জ্ঞাত-সংকট দীর্ঘদিন ধরেই সমাধানে ব্যর্থ। কোনো দেশ তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ততক্ষণ পর্যন্ত টেকসই করতে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না আর্থিক খাতে গভীরতা আনে এবং রপ্তানিমুখী অর্থনীতি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। যেসব দেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ক্রমাগত ৬ বা ৭ শতাংশ করে বাড়িয়েছে, তারা এ পথেই এগিয়েছে। সেসব দেশ বেসরকারি খাতকে চালকের আসনে বসিয়েছে। ১৮ কোটি জনসংখ্যার দেশ হিসেবে বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারে সম্ভাবনা প্রচুর। অথচ আর্থিক খাতের গভীরতা ও পণ্য বা পরিষেবা বিবেচনায় এশিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে। যেমন খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে, কস্ট অব ডুইং বিজনেসের বেপরোয়া বৃদ্ধি থামানোয় সুশাসন বা গুড গভর্ন্যান্স কার্যকর করা যায়নি। 

কারা ব্যাংকের মালিক, কারা বেশি বেশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যাচ্ছেন, মন্দ ঋণ আদায়ে কারা অভিনবত্ব ও দক্ষতা দেখাচ্ছেন, পণ্যস্বল্পতা ও প্রযুক্তির ব্যবহার, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহনশীলতা, আর্থিক খাতের ব্যবস্থাপনায় কতটুকু মেধা লালন করতে পারছে, আর্থিক খাতের পরিচালকদের ভূমিকা ইত্যাদি বিষয়ে অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি কোন দিকে যাবে, তা নির্ধারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দাবিদার। 

এখনো মূলত পরিচালকরাই ব্যাংকের মালিক এবং তারা ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের কাজে হস্তক্ষেপ করেন। এর একটা সুরাহা ও কঠোর নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা, প্রোডাক্টের বৈচিত্র্য এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা- এই তিন দিকে নজর দিতে হবে। বিকাশমান রপ্তানি ও বেসরকারি খাতভিত্তিক অর্থনীতিতে নিয়মকানুন সব মান্ধাতা আমলের হলে চলবে না। যেমন- ১৯৪৭ সালের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইনে চলার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন যুগের সমস্যা সমাধানে হিমশিম খাচ্ছে।

আবার সবকিছুতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অসীম ক্ষমতার কারণে সেখানকার শীর্ষ কর্তাদের মধ্যে আমলাতান্ত্রিক চিন্তভাবনার জন্ম নিয়েছে। বাংলাদেশে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে কঠিন শর্তে বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হয়, যখন দেখা যায় ওই প্রকল্প লাভজনক হতে যে সময় প্রয়োজন তার কোনো ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল নেই। বাংলাদেশে তিন বছরের বেশি মেয়াদি কোনো ফিক্সড ডিপোজিট নেই। বেশির ভাগ ফিক্সড ডিপোজিটের মেয়াদ এক বছর। এ রকম অবস্থায় অন্যান্য দেশ বাজারে বন্ড ছাড়ে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের উৎসাহ থাকার পরও বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদি বন্ড ছাড়তে পারেনি। ফলে বাংলাদেশের মুদ্রাবাজারে তেমন গভীরতা নেই। 

আর্থিক খাত ব্যবস্থাপনায় পাকিস্তান, ভারত ও শ্রীলঙ্কার মতো প্রতিযোগী দেশ বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে। গ্রাহকদের নতুন নতুন চাহিদা মেটাতে প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর নতুন সেবাপণ্য আনতে পারছে না। পরিচালনা পর্ষদ ব্যাংক ঠিকভাবে চালাতে পারেনি, এমডি-ডিএমডিদের কাজ করতে দেওয়া হয়নি। এখন সময় এসেছে এসব বিচার-বিবেচনার। প্রয়োজন কার্যকর দিকনির্দেশনার। 
বাংলাদেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাতে খেলাপি ঋণের মতো এ খাতের সংস্কারও বকেয়া রয়েছে দীর্ঘদিন। শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়ানো আর্থিক খাতের গভীরতা ছাড়া একটি দেশ তার উন্নয়ন আর অগ্রগতিকে টেকসই করতে পারে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের আর্থিক খাত কয়েক বছর ধরে সবচেয়ে খারাপ সময় অতিক্রম করছে।
 
সম্প্রতি বাংলাদেশে তার প্রথম সফর শেষে এক বিবৃতিতে বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অপারেশনস) আন্না বিজার্ড বলেছেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে, জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ও আর্থিক খাতের সংস্কার প্রয়োজন। বাংলাদেশে বেসরকারি ব্যাংক কাজে বড় না হয়ে সংখ্যায় বড়। এই ব্যাংকগুলো অনেক দিন ধরে ভালোই চলছিল। কিন্তু গত ১৫ বছরে জনগণের টাকা নিয়ে ব্যাংকিং করা এসব প্রতিষ্ঠানে মালিক নামের একশ্রেণির লোকের জমিদারি কায়েম করা হয়। 

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগের প্রসার ও অর্থনৈতিক উনয়নে ব্যাংক ও আর্থিক খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এলেও সেই ব্যাংকিং খাতের স্বাস্থ্য ক্রমাগত দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়ায় এ খাতের নানা কেলেঙ্কারির ঘটনার পেছনে রয়েছে দুর্বৃত্তদের রাজনৈতিক প্রশ্রয়, দুর্বল ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবস্থাপনার চর্চা ও যথাযথ অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণের ঘাটতি। আইনের মাধ্যমে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে ব্যাংকগুলোর দৈনন্দিন কাজে মালিকরা হস্তক্ষেপ করেন, নিজেরা নামে-বেনামে ঋণ নিয়েছেন। ব্যক্তি খাতের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোনো না কোনো ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর যোগ থাকায় এরা সবাই প্রতিপত্তিশালী এবং ক্ষমতা কাঠামোর ভেতরে ছিল এদের অবস্থান। ব্যাংক ও আর্থিক খাতের চলমান সংকটাবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সমস্যা ও চ্যালেঞ্জগুলো সবার এখন মোটামুটি জানা, তাই সমাধানের উদ্যোগ এখনই প্রয়োজন। স্বল্প ও মধ্যম মেয়াদে পরিকল্পনা গ্রহণ করে আইনি ও কাঠামোগত সংস্কার জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

ব্যাংক ও আর্থিক খাতের ওপর সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর ছাড়তে হলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে পুনর্গঠনের প্রয়োজন হতে পারে। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও অনেক বেশি বিকেন্দ্রীকরণের কথা চিন্তা করতে হবে। বড় বড় ঋণখেলাপি আর দুর্বৃত্তদের কিছু করতে না পারলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ক্রমেই নিজের হাতে অনেক ক্ষমতা নিয়ে আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী খেলাপি ঋণে কী পরিমাণ সুবিধা দেওয়া হবে, সেটা পুরোটা ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ওপর। ফলে ব্যাংক মালিকরাই তখন ঠিক করতেন কে খেলাপি আর কে খেলাপি নয়। এতে করে জাল-জালিয়াতি, অনিয়ম আর প্রতারণাই নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়। 

রাজস্ব ও উন্নয়ন ব্যয় বাজেটের দুটি অংশ। একটি অংশ রাজস্ব বাজেট এবং অন্যটি উন্নয়ন বাজেট। একটি অংশ সরকারের যে ব্যয় সেটিতে বর্তমান পরিস্থিতির নিরিখে একটু পরিবর্তন প্রয়োজন হতে পারে। এর একটি উদাহরণ হতে পারে ল অ্যান্ড অর্ডারে। যেমন- আমাদের অনেক থানা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এগুলো সংস্কার প্রয়োজন। এ ছাড়া এ বাজেট যখন করা হয়েছিল তখনকার পরিস্থিতি আর বর্তমান পরিস্থিতি পুরোপুরি ভিন্ন। কাজেই বাস্তবতার নিরিখে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাজেট পুনর্বিন্যাসের প্রয়োজন রয়েছে। রাজস্ব আয় ও ব্যয় যেটি প্রাক্কলন করা হয়েছে, সেটিও পুনরায় প্রাক্কলন করার প্রয়োজন হবে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে যে রাজস্ব পাওয়ার কথা, সেটিকে পুনরায় নির্ধারণ করতে হবে। আবার বৈদেশিক সহায়তার ক্ষেত্রেও অনেক ভাবতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আয় ও ব্যয় উভয় ক্ষেত্রেই ভাবতে হবে।

যেটি উন্নয়ন বাজেট, সেখানেও অনেক প্রকল্প রয়েছে। যেগুলোকে গুরুত্ব বিবেচনায় পুনরায় নির্ধারণ করা প্রয়োজন। এ ছাড়া এখানে অনেক প্রকল্প আছে যেগুলো রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত করা হয়েছে, সেগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। অনেক প্রকল্প আছে যেগুলোর অ্যালোকেশন নেই। গোটা বাজেটটাকে কিন্তু পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার। বিভিন্ন খাতভিত্তিক ব্যয়ও বাস্তবতার আলোকে পুনরায় নির্ধারণ করতে হবে। 

আরেকটা জিনিস হচ্ছে- অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণ যা আছে, তা তো পরিশোধ করতেই হবে। কারণ ঋণ সময়মতো পরিশোধ করতে না পারলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটা দুর্নাম হবে। ঋণমান কমে যাবে, যা পরবর্তী সময়ে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। যেমন- বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ড, শিক্ষা, জ্বালানিসহ রাষ্ট্রের অন্যান্য যে কর্মকাণ্ড আছে, অর্থসংকটের কারণে সেগুলো ঠিক রাখা কঠিন হবে। যেসব ক্ষেত্রে সরকারের পরিবর্তনের সুযোগ খুব একটা নেই, সেসব দিক বিবেচনায় নেওয়া দরকার। একই সঙ্গে রাজস্ব আয়কে শক্তিশালী করতে হবে। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় যেসব ভুলত্রুটি রয়েছে, সেগুলোকে মাথায় রেখে আগামীতে কাজ করতে হবে। রাজস্ব আয়ের পাশাপাশি বৈদেশিক সহায়তা কীভাবে বৃদ্ধি করা যায়, সেটি ভাবতে হবে। কীভাবে রেমিট্যান্স বাড়ানো যায় বা রপ্তানি আয় কীভাবে বৃদ্ধি করা যায়; সেসব ভাবতে হবে। আমদানি কমাতে হবে। যদিও অর্থনীতি আমদানিনির্ভর কিন্তু সেখানে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে যদি আমরা সহজ শর্তে নিতে পারি, তাহলে আমাদের জন্য ভালো হয়। দেশে তো বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিদ্যমান। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর অবস্থা ভালো না। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের খুব বেশি ঋণ পাওয়ার সুযোগ নেই। ফলে আয় বৃদ্ধি করা ছাড়া সরকারের সামনে ভালো কোনো পথ খোলা নেই। আর অপ্রয়োজনীয় ব্যাংক যেগুলো আছে, এগুলোকে যতটুকু সম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। কারণ দুর্নীতি-অপচয় কিন্তু অনেক আছে। সেসব বন্ধ করতে হবে। অপচয়টা বেশি। এটা বন্ধ হওয়া উচিত। রাজস্ব আয়ের একটা বড় অংশ অপচয় হয়ে যায়। আরেকটা অংশ দুর্নীতির মাধ্যমে বেহাত হয়। এই দুই জায়গায় ভালোভাবে কাজ করতে হবে। অপচয় ও দুর্নীতি যদি বন্ধ করা যায়, তাহলে সরকারের জন্য বাকি কাজ করা সহজ হবে। অর্থের সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে। সে ক্ষেত্রে সরকারকে অবশ্যই খুব হিসেবি হতে হবে।

মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনার সফলতার সূচক মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে পারঙ্গমতার ওপর নির্ভরশীল। সরকারকে যদি মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়; অর্থাৎ পণ্য, সেবা, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এবং টাকার অবমূল্যায়ন নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, তাহলে আগামী তিন বছরের মধ্যেই এ সমস্যা সমাধানের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। নানা ধরনের সংস্কারের মধ্য দিয়ে এটি সুরাহা করা প্রয়োজন। এ সময়ের মধ্যে সরকার কোনোভাবেই বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম আর বাড়াবে না। মূল্যবৃদ্ধিতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের প্রভাব ৬ শতাংশের বেশি। এ সময়ে সরকারকে সব উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ করে এ খাতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে হবে। এ অঙ্গীকার করেই সরকারকে মাঠে নামতে হবে।

 এটি সরকারের জন্য কঠিন একটি চ্যালেঞ্জ। আর এ চ্যালেঞ্জ যদি সরকার মোকাবিলা করতে না পারে, তাহলে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুরক্ষা হবে না, কর্মসংস্থান হবে না, উৎপাদনশীলতা ব্যাহত হবে। রপ্তানি হুমকিতে পড়বে এবং আরও আমদানিনির্ভর হতে হবে। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে দিন শেষে সরকারের আয় আরও সীমিত হয়ে পড়বে। ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করে কতটা কৃচ্ছ্রসাধন করা যাবে, সেটা বলা মুশকিল। অর্থাৎ সংকট নিরসনের সুযোগ বা সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসবে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সরবরাহ এবং রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা, জ্বালানি নিরাপত্তা সমুন্নত রাখাই সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। সরকারের কাজ হবে ব্যয় সাশ্রয় করা ও ব্যয় বৃদ্ধির জায়গাগুলো চিহ্নিত করা। চিহ্নিত করে সেই ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে আনা।

লেখক: সাবেক সচিব ও এনবিআরের চেয়ারম্যান

যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নির্বাচন এবং শ্রমিকদের সুরক্ষা

প্রকাশ: ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ১২:১৫ পিএম
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নির্বাচন এবং শ্রমিকদের সুরক্ষা
এনগায়ার উডস

যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বামপন্থি ও ডানপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো ভোটারদের দেখানোর জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে যে, তারা শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে সব সময় কাজ করছে। প্রশ্ন হলো- শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য প্রচলিত যে উপায়গুলো রয়েছে, যেমন- শিল্পনীতি, বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও অভিবাসনের ওপর বিধিনিষেধ, এগুলো কি শ্রমিকদের স্বার্থের কথা চিন্তা করে সমন্বয় করা হয়েছে। 
শ্রমিকদের রক্ষা করা মূলত সুরক্ষাবাদের সমার্থক হয়ে উঠেছে। বর্তমানে অনেক দেশের ভোটারই তাদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত। মুক্তবাণিজ্য, অভিবাসন ও অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ শ্রমিকদের বিপক্ষে চলে গেছে। যেসব নেতা এ ধরনের জাতীয় নীতি দীর্ঘদিন ধরে প্রচার করে যাচ্ছেন, সেই সব নেতা বা দলকে ভোটাররা প্রত্যাখ্যান করছেন। 

ইউরোপে এই বিষয়টি বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ২০০৭-০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের কারণে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো আর্থিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। ভোটাররা তাদের সুরক্ষার জন্য মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে গিয়ে পক্ষে অবস্থানকারী নেতা বা দলের দিকে মনোনিবেশ করছেন। বিশ্বব্যাপী মহামারি জীবনযাত্রার ব্যয়সংকট আরও বাড়িয়ে তুলেছে। অস্ট্রিয়া, জার্মানি, ইতালি এবং নেদারল্যান্ডসের সাম্প্রতিক  নির্বাচনে অভিবাসনবিরোধী দলগুলো বেশি সমর্থন লাভ করেছে। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নতুন রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব ঘটেনি। তবে অনেক নতুন নেতা তৈরি হয়েছে। ২০১৬ সালের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার বিনিয়োগ নষ্ট করার কথা বলে বিশেষ করে চীনের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্যকে দোষারোপ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে জয়ী হন। তা ছাড়া আমেরিকার রাস্ট বেল্টে বিনিয়োগের ক্ষতি ও চাকরি হারানোর কথাও বলেছিলেন। মুক্তবাজার ও  পুঁজিবাদের সমালোচনা করার সময় বামদের সংরক্ষণ করা হতো, এমনকি আমেরিকান কনজারভেটিভ ম্যাগাজিন বাণিজ্য, অভিবাসন এবং  পুঁজির অবাধ বিচরণ বিচ্ছিন্নকরণের সংবাদ প্রকাশ করেছিল।

ট্রাম্প যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন নতুন করে শুল্কারোপ করেছিলেন, যা তার নির্বাচনে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। ২০২০ সালের নির্বাচনে জো বাইডেন ট্রাম্পকে পরাজিত করেছিলেন। কারণ, তিনি শুল্কগুলো বজায় রেখেছিলেন, এমনকি নতুন শুল্কারোপ করেছিলেন। বছরের শুরুর দিকে জো বাইডেন চীনের তৈরি বৈদ্যুতিক গাড়ির ওপর ১০০ শতাংশ শুল্কারোপ করেন। যদিও তা চীন থেকে মার্কিন আমদানি করা ছোট একটা আংশকে প্রভাবিত করেছে। ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি যদি পুনরায় নির্বাচিত হন, তাহলে চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ৬০ থেকে ১০০ শতাংশ শুল্ক প্রয়োগ করবেন। 

সুরক্ষাবাদী বার্তা শ্রমিকরা সব সময়ই শুনতে চান। ২০১৮ সালে ট্রাম্প যখন কানাডা, ইউরোপ এবং মেক্সিকো থেকে ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর শুল্কারোপ করেছিলেন, তখন ব্যবসায়িক অংশীদারদের মধ্যে প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। এভাবে বৈদেশিক বাজারে দেশের অ্যাক্সেস কমে যায় এবং পণ্যের দাম বাড়ায়। ফলে দেশীয় পণ্য উৎপাদনে ও কাঁচামাল সংগ্রহে ব্যাপক বাধা সৃষ্টি হয়। এতে অনেক লোকের কর্মসংস্থান নষ্ট হয়। 

সুরক্ষাবাদীদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ‘পুনরায় সংশোধিত’ চাকরির মাধ্যমে এই ক্ষতিগুলো পূরণ সম্ভব হবে না। কারণ, কম মজুরির চাকরিগুলো এখন মেশিন দিয়ে করা হয়, শ্রমিক দিয়ে নয়। ইতোমধ্যেই চীনে এই ধরনের ঘটনা ঘটছে, যেখানে সম্পূর্ণরূপে রোবট দিয়ে পরিচালিত হয়। চীনে জরাজীর্ণ কারখানায় অনেক ভালো জিনিস উৎপাদন করা হচ্ছে রোবট দিয়ে। উৎপাদনে চাকরি রক্ষা করে চীনের উচ্চ যুব বেকারত্বের হার সমাধান করা সম্ভব নয়। বরং রাস্ট বেল্টকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করা উচিত। 

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্টের প্রশাসন যেমন ১৯৩০-এর দশকে দেখিয়েছিল। শ্রমিকদের সুরক্ষার আরও ভালো উপায় রয়েছে যা অভ্যন্তরীণ শ্রম আইন যা ইউনিয়নকরণকে সমর্থন করে। শ্রমিকদের জন্য শালীন জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত করার পরিবর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে শ্রমজীবী জনগণকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত করছে। তারা শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠছে। 

যুক্তরাজ্যের নতুন সরকার একটি কর্মসংস্থান অধিকার বিল পেশ করেছে, যা কম বেতন, সময়সূচিতে নমনীয়তা ও অন্যায়ভাবে চাকরি থেকে বরখাস্তের বিপক্ষে সুরক্ষার ক্ষেত্রে শ্রমিকদের অধিকার আরও প্রসারিত করবে। এই বিলটি ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করা, শ্রমিকদের ধর্মঘটের অধিকারের ওপর বিধিনিষেধ অপসারণ, লিঙ্গভেদে বেতনবৈষম্যের সমাধান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে সুরক্ষা জোরদার করার পথ প্রশস্ত করবে। এই বিল পাস হওয়ায় নিয়োগকর্তাদের মধ্যে কিছু মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। এই বিষয়ে যুক্তরাজ্য সরকার নিয়োগকর্তাদের সঙ্গে বিস্তৃত পরামর্শে যাবে। কারণ, বিলটি দ্রুতই আইনে পরিণত হবে। 

বাণিজ্যনীতি শ্রম রক্ষা করতেও ব্যবহার করা হয়। যদি আমরা শুল্কের বাইরে দেখি, ২০১৮ সালে ডোনাল্ট ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো-কানাডা চুক্তিকে নাফটার উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচনা করেছিল। কারণ, এতে মার্কিন মুক্তবাণিজ্য চুক্তির সবচেয়ে শক্তিশালী শ্রম বিধান রয়েছে। এই চুক্তির মূল অংশে শ্রমের বাধ্যবাধকতাগুলো স্থাপন করা হয়েছে এবং সেগুলোকে সম্পূর্ণরূপে প্রয়োগযোগ্য করে তুলতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। ইউএসএমসিএর সদস্যদেশগুলো শ্রমিকদের দেশীয় কর্মসূচির মাধ্যমে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করতে পারে। যেমন- মার্কিন বাণিজ্য সমন্বয় সহায়তা কর্মসূচি, যা ১৯৬২ সাল থেকে শ্রমিকদের  চাকরি হারানো থেকে নতুন কর্মে নিযুক্ত করতে সাহায্য করে। ইউএসএমসিএ প্রমাণ করে, কর্মীদের সুরক্ষা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার সঙ্গে সব সময় সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে। 

সুরক্ষাবাদী বাণিজ্যনীতির জন্য রাজনৈতিক সমর্থন আদায় করা সহজ। শিল্পোন্নত এলাকায় শ্রমজীবী মানুষ মনে করে, তারা প্রকৃতপক্ষে আগের প্রজন্মের তুলনায় কম প্রতিনিধিত্ব পায় এবং তেমন সুরক্ষিত নয়। সেখানে চীনের কারখানা ও অভিবাসী শ্রমিকরা দখল করে নিয়েছে। যখন রাজনীতিবিদরা এই ভোটারদের হতাশা দেখতে পান, তখন তারা বৈদেশিক আমদানির ওপর অতিরিক্ত শুল্কারোপ করেন এবং অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে তাদের জীবন উন্নত করার প্রতিশ্রুতি দেন। এতে ভোটাররা বা সাধারণ শ্রমিকরা সহজেই সম্মতি দিয়ে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে শ্রমিক বা সাধারণ মানুষ এতে তেমন কোনো সুফল পান না। নির্বাচনের সময় রাজনীতিবিদরা রাজনৈতিক কারণে এমন আশ্বাস দিয়ে থাকেন, কিন্তু ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না।

লেখক: ডিন, ব্লাভাটনিক স্কুল অব গভর্নমেন্ট অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় 
আরব নিউজ থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল