ঢাকা ২৫ কার্তিক ১৪৩১, রোববার, ১০ নভেম্বর ২০২৪

পশ্চিমবঙ্গে সরকার কেন রাজধর্ম পালন করছে না

প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২৪, ১১:১৭ এএম
পশ্চিমবঙ্গে সরকার কেন রাজধর্ম পালন করছে না
গৌতম রায়

পশ্চিমবঙ্গে এখন শারদীয় উৎসব শুরু হয়ে গেছে। বিগত কয়েক বছর ধরে হিন্দু বাঙালির এই উৎসবের সঙ্গে রাষ্ট্র নিজেকে সংযুক্ত করে ফেলেছে। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের কোনো নিজস্ব ধর্ম নেই। সব ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি, ধর্মের প্রতি, মতাদর্শের প্রতি, রাষ্ট্র সমান আচরণ করে চলবে- এটাই ভারতীয় সংবিধানে স্বীকৃত ব্যবস্থা।

কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে সংবিধান প্রদত্ত রাষ্ট্রের ভূমিকা সঠিকভাবে পালন করা হচ্ছে না। পশ্চিমবঙ্গ সরকার নানাভাবে হিন্দু বাঙালির ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে। আজ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে কোনো মুসলমান মুখ্যমন্ত্রী হননি। অতীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি হিসেবে যেসব বাঙালি হিন্দু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তাদের মধ্যে ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী বিধানচন্দ্র রায়ের মতো মানুষ যেমন ছিলেন, প্রচলিত হিন্দু ধর্মের রীতিনীতির প্রতি আস্থাবান প্রফুল্লচন্দ্র সেন ছিলেন, অজয় মুখোপাধ্যায় ছিলেন। আবার জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মতো নাস্তিক মানুষও ছিলেন। 

এরা কেউ কখনো রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র থেকে এক মুহূর্তের জন্য বিচ্যুত হননি। যাদের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে আস্থা ছিল, তারা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে প্রকাশ্য ধর্ম পালন প্রায় এড়িয়েই চলতেন। ব্রাহ্ম মতাদর্শের প্রতি আস্থাশীল বিধানচন্দ্র রায়, তার ব্যক্তিগত জীবনে ধর্ম পালন ঘিরে আদৌ মনোযোগী ছিলেন না। একই কথা বলতে হয় তার উত্তরাধিকারী প্রফুল্লচন্দ্র সেন সম্পর্কে। তিনি প্রচলিত হিন্দু ভাবধারায় বিশ্বাসী হয়েও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে কখনোই মনোযোগী হননি।

অজয় মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে সে কথা প্রযোজ্য। তবে সিদ্ধার্থশংকর রায় একটা ব্রাহ্ম ভাবধারার মধ্যে নিজের প্রথম জীবন গড়ে তুললেও ধর্ম আর রাজনীতির এক অদ্ভুত মিশ্রণ ঘটিয়ে রাষ্ট্রধর্ম পালনের ক্ষেত্রে প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে লঙ্ঘন করেন। কলকাতার রেড রোডে পবিত্র ঈদের নামাজে ফেজ টুপি পরে তার অংশগ্রহণ আর যা-ই হোক, ভারতের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের সঙ্গে মেলে না।

রাজনীতিগত ক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিদ্ধার্থশংকরকে তার গুরু বলে অনেক সময় ঠাওরান। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার বাসনায় মমতা যখন নানা ধরনের রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত, তখন তিনি নানাভাবে মুসলমান সম্প্রদায়ের বহু ন্যায্য অধিকারের প্রতি নিজের একটা সহানুভূতিশীল আচরণের চেষ্টা করে গেছেন। সেই চেষ্টাকে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজের একটা বড় অংশ বিশ্বাস করেছিল। বিশ্বাস করেছিল এ কারণে যে, জ্যোতিবাবুর মুখ্যমন্ত্রিত্বকালে মুসলমান সমাজের আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়- যে নিরাপত্তা পশ্চিমবঙ্গের বুকে ছিল, সেই নিরাপত্তা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আমলে থাকবে কি না, এ নিয়ে তাদের মধ্যে একটা সংশয় তৈরি হয়েছিল।

বুদ্ধদেববাবু মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার অব্যবহিত পরে মাদ্রাসা ঘিরে কিছু মন্তব্য করার পরিপ্রেক্ষিতে এই ধারণা তৈরি হয়েছিল। বুদ্ধদেববাবুর সেই মন্তব্য, যার সঙ্গে তৎকালীন উপ-প্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদভানির বিভিন্ন বক্তব্যের একটা অদ্ভুত সাদৃশ্য পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজ অনুভব করেছিল। 

সেই অনুভূতিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেভাবে ব্যবহার করেছিলেন, সেটি ছিল পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজের প্রতি সার্বিক প্রতারণা। অথচ সেই প্রতারণাকে বুঝতে না পেরে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজ দুই হাত তুলে ভোট রাজনীতিতে সমর্থন জানিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। কিন্তু এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কুরসিতে বসার পরেই পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি হিন্দু সমাজের একটা বড় অংশকে শরৎকালের দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে যেভাবে তোষামোদ করতে শুরু করেন, তা পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজের একটা অংশকে ধীরে ধীরে মমতা সম্পর্কে মোহের অবসান ঘটাতে সাহায্য করেছিল।
তবে পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ গরিব খেটে খাওয়া মুসলমান সমাজ তাদের উন্নয়নের নাম করে, কেবল ধর্মীয় আবর্তে টেনে রেখে নিজের সম্পর্কে তাদের ভেতরে একটা মোহ তৈরি করেছিলেন মমতা।

 ওয়াকফ বোর্ড মুসলমানদের নিজস্ব অর্জিত অধিকার। ওয়াকফ বোর্ডের জমি থেকে টাকা, সবটাই মুসলমান সমাজের স্ব-অর্জিত। এটা কারও দয়ার দান নয়। অথচ এই ওয়াকফ বোর্ড থেকে মমতা তার দল তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থক একাংশের ইমাম- মুয়াজ্জিনদের সামান্য কিছু ভাতা দিয়ে, সেটাকেই তার মুসলমান সমাজের প্রতি ভালোবাসা, তাদের উন্নতির চেষ্টা বলে, একেবারে দলীয় স্বার্থে রাজনীতি করতে শুরু করে দেন।

মুসলমান সমাজের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, বিশেষ করে আধুনিক শিক্ষা, চাকরিতে তাদের ন্যায্য অধিকার দেওয়া, সামাজিকভাবে তাদের ন্যায্য অধিকার দেওয়া- এসব কিছু সম্পর্কেই মুখ ঘুরিয়ে থাকেন মমতা। সেই ধারা আজও চলছে পশ্চিমবঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নিজস্ব ভাঁড়ার থেকে হিন্দু বাঙালির ধর্মীয় উৎসবে বিভিন্ন ক্লাবকে মমতা হাজার হাজার টাকা দিয়ে চলেছেন বিগত কয়েক বছর ধরে। এ বছর সেই টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ক্লাবপ্রতি ৮৫ হাজার টাকা। সেই সঙ্গে বিদ্যুৎ খরচ ইত্যাদির ক্ষেত্রেও বিশেষ ধরনের সুযোগ মমতার সরকার ক্লাবগুলোকে দিচ্ছে।

মুসলমান সমাজের কিছু ইমাম-মুয়াজ্জিনদের যে সামান্য ভাতা দেওয়া হয়, সেটা দেওয়া হয় মুসলমানদের স্ব-অর্জিত ওয়াকফ বোর্ডের মাধ্যমে। আর হিন্দু বাঙলিদের একটা বড় অংশকে দুর্গাপূজা পালনের জন্য যে টাকা দেওয়া হয়, সেটা দেওয়া হয় সাধারণ মানুষের করের টাকায়। যে টাকা হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান, শিখ, জৈননির্বিশেষে ভারতীয় নাগরিকরা দিচ্ছেন।
ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী কোনো সরকারই নিজস্ব তহবিলের অর্থ এভাবে কোনো একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়কে তাদের ধর্মীয় উৎসব পালনের জন্য দিতে পারে না। এই মুহূর্তে কমিউনিস্টশাসিত রাজ্য কেরালায় সংবিধানগতভাবেই ধর্মবিষয়ক একটি আলাদা দপ্তর আছে। সেই দপ্তরের নির্দিষ্ট বাজেট আছে।

 সংবিধানগতভাবেই সেই দপ্তরের তহবিলে অর্থ আসে। যে দল যখন সে রাজ্যে ক্ষমতাসীন থাকে, তারা সংবিধান মোতাবেক সেই অর্থ ব্যয় করে।
ঐতিহাসিক কারণেই এমন কোনো ব্যবস্থা পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে নেই। তাই সরকার তার নিজস্ব ভাঁড়ারের টাকা, যা সাধারণ মানুষের করে পুষ্ট, সেই টাকা হিন্দু বাঙালির উৎসবে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বা শাসক দলের অনুগ্রহভাজন ক্লাবগুলোকে দেওয়ার যে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চলেছে, তা সম্পূর্ণভাবে ভারতীয় সংবিধানকে লঙ্ঘন করা। হিন্দু-মুসলমাননির্বিশেষে সাধারণ নাগরিকদের করের টাকায় কোনো একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পূজা-অর্চনায় সরকারি কোষাগার থেকে টাকা দেওয়া সম্পূর্ণভাবে শাসকের একটি সাম্প্রদায়িক অবস্থান গ্রহণের শামিল।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গল্পকার
[email protected]

বিশেষ সাক্ষাৎকার: নুরুল হক নুর ১৮ জুলাইয়ের পর আন্দোলন  ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৫০ এএম
১৮ জুলাইয়ের পর আন্দোলন 
ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না

নুরুল হক নুর। সবাই তাকে ভিপি নুর হিসেবেই চেনে, জানে। ২০১৮ সালের কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি সবার কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে নির্দলীয় প্ল্যাটফর্ম থেকে নির্বাচিত হন ভিপি। তার পর থেকে শুরু তার অগ্রযাত্রা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেপথ্যের কারিগর এই তরুণ নেতা একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়ে জেলে গেছেন। নির্যাতনের শিকার হয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের পুলিশের। তার উদ্যোগে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। একপর্যায়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পতন হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের। খবরের কাগজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারের সেই অভিজ্ঞতাই বর্ণনা করেছেন নুরুল হক নুর। তিনি বলেছেন, ১৮ জুলাই সব রাজনৈতিক দল মিলে সর্বদলীয় মিছিল কর্মসূচি দেওয়া হয়েছিল ছাত্রদের ওপর হামলার প্রতিবাদে এবং সেই দিন থেকে সে আন্দোলন আর ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এটা একটা গণ-আন্দোলন এবং জাতীয় আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খবরের কাগজের সিটি এডিটর আবদুল্লাহ আল মামুন।

খবরের কাগজ: বাংলাদেশের মানুষ সবাই আপনাকে চেনে, জানে এবং পজিটিভ ধারণা রাখে। এই যে আপনি একজন ভিপি নুর হয়ে উঠলেন, কীভাবে?
নুরুল হক নুর: আমাকে যারা দেখেছেন, তারা তো বলতে পারবেন কীভাবে ভিপি নুর হয়ে উঠলাম। আমি দক্ষিণাঞ্চলের প্রত্যন্ত একটা গ্রামে বড় হয়েছি, গ্রামের স্কুলে লেখাপড়া করেছি। ২০০৮ সালে গাজীপুর থেকে এসএসসি পাস করেছি। ২০১২ সালে উত্তরা হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। ২০১৪ সালে দ্বিতীয় দফায় ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হই। পরিবার স্থানীয় রাজনীতিতে যুক্ত ছিল। আমার বাবা ’৯০-এর দশকে বিএনপির প্রথম সরকারের সময় ইউপি সদস্য ছিলেন। পরিবারের অন্য সদস্যরাও স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে টুকটাক যুক্ত ছিলেন। সেখান থেকে রাজনীতি বিষয়ে আগ্রহ তৈরি হয়। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো রাজনীতির জন্য একটা তীর্থভূমি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর কাছ থেকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দেখেছি। কিছুটা অংশগ্রহণও করেছি। কিন্তু লক্ষ্য রাজনীতি ছিল না। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের একটা সন্তানের যে রকম লক্ষ্য থাকে একটা ভালো চাকরি করে ফ্যামিলিকে সাপোর্ট দেওয়া। সেই চাকরির অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন করি।
সে আন্দোলন থেকেই উদ্বুদ্ধ হয়ে পরে ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি এবং জয়লাভ করি। ডাকসু নির্বাচনের পর থেকেই লোকজন ভিপি নুর ডাকা শুরু করে। তখন থেকেই পরিচিতি পেতে থাকি। এর পর শুধু সামনে এগিয়েছি। ২০২১ সালে গণ অধিকার পরিষদ নামে আমরা একটি রাজনৈতিক দল গঠন করি। ২০২৪-এ নিবন্ধন পাই। জার্নিটা পর্যায়ক্রমে হয়েছে। একটা সময়ের মধ্য দিয়ে আস্তে আস্তে এই জায়গায় এসেছি।

খবরের কাগজ: কী চাকরি করার ইচ্ছে ছিল? 
নুরুল হক নুর: ইন্টারমিডিয়েটের পর আগ্রহ ছিল মেডিকেলে পড়ার। হাইস্কুল লাইফে রচনা পড়ানো হতো ‘এইম ইন লাইফ’। না বুঝে মুখস্থ বিদ্যা পড়ে কেউ ফার্মার, কেউ টিচার, কেউ ডাক্তার হওয়ার কথা বলত। 
এই রচনা পড়ার সময় মনে হয়েছে আমি আসলে কী হতে চাই? আমার তো একটা লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থাকা দরকার। সেখান থেকেই আগ্রহ তৈরি হয়। এই দেশের চিকিৎসার দুরবস্থা, গ্রামের মানুষ চিকিৎসা পেতে কী ধরনের ভোগান্তির শিকার হয়, সেটা আমরা কাছ থেকে দেখেছি। ধরেন, রংপুর কিংবা বরিশালের মানুষ হঠাৎ করে একটা জটিল রোগে আক্রান্ত হলো। তার চিকিৎসা রংপুর কিংবা বরিশালে সম্ভব নয়। প্রথমে সে উপজেলা থেকে আসবে জেলা হাসপাতালে। সেখান থেকে আসবে বিভাগীয় শহরে। শেষ পর্যন্ত তাকে ঢাকায় আসতে হচ্ছে। একমুখী চিকিৎসা বা ঢাকামুখী চিকিৎসাব্যবস্থা। তখন মনে হয়েছিল আমার চিকিৎসক হওয়া দরকার। সেখান থেকেই চিকিৎসক হওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ তৈরি হয়। বলতে গেলে প্রচণ্ড রকমের ‘প্যাশন’ ছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত চিকিৎসক হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি।


খবরের কাগজ: মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলেন? 
নুরুল হক নুর: পরীক্ষা দিয়েছিলাম, হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর ইচ্ছে হয় বিসিএস ক্যাডার হওয়ার। চিন্তাভাবনা করে দেখেছিলাম অ্যাডমিন ক্যাডার হলে একটা বৈচিত্র্যময় কাজের অভিজ্ঞতা তৈরি হবে, যেটা পরবর্তী লাইফেও কাজে লাগবে। রাজনীতি করার একটা টুকটাক আগ্রহ ছিল। কিন্তু ফ্যামিলির অবস্থা এবং নানান কারণেই মনে হয়েছিল যে শুরুর দিকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়া ঠিক হবে না। কারণ বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট তো ভিন্ন। ৫ আগস্টের আগেও যে প্রেক্ষাপট দেখেছি তাতে রাজনীতি করার জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার দরকার ছিল। একটা ইউপি নির্বাচনেও মানুষ ২ থেকে ৩ কোটি টাকা খরচ করে। এমপি নির্বাচনে ১০ কোটি টাকা খরচ করে। আমার তো সেই টাকা নেই। তার জন্য টার্গেট ছিল অন্তত একটা চাকরি বা ব্যবসা-বাণিজ্য করে আর্থিক নিশ্চয়তা তৈরি করা, এরপর রাজনীতির দিকে যাওয়া। 
কোটা ছাত্রদের একটা সমস্যা, ছাত্রদের একটা বঞ্চনার জায়গা ছিল। এই দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সমাজের বিভিন্ন সেক্টরে, শত-সহস্র অনিয়ম এবং বৈষম্য আছে। সেগুলো বিলোপ করা দরকার। রাষ্ট্রের বৈষম্য কীভাবে সমাধান হবে? সেই জন্যই রাজনীতিতে আসা এবং আলহামদুলিল্লাহ মানুষের ব্যাপক সমর্থন এবং সহযোগিতায় খুব অল্প সময়ে সারা বাংলাদেশ তথা বহির্বিশ্বে যেখানে বাংলাদেশিরা আছে তাদের কাছে গণ ধিকার পরিষদ পরিচিতি পেয়েছে। গণ অধিকার পরিষদ একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল। খুব অল্প সময়ের মধ্যে একটা বড় অবস্থান তৈরি হয়েছে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এই গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী বিকল্প রাজনীতি, বিকল্প নেতৃত্বের প্রতি মানুষের যে আগ্রহ তৈরি হয়েছে, সেখানে গণ অধিকার পরিষদ একটা ভালো অবস্থানে থাকবে এবং বাংলাদেশে নতুন নেতৃত্ব তৈরিতে গণ অধিকার পরিষদ একটা আদর্শ প্ল্যাটফর্ম হবে। 
খবরের কাগজ: ছাত্রজীবন থেকেই আপনার রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল। আপনি চেয়েছিলেন মানুষের সেবা করতে- এই তো?
নুরুল হক নুর: মানুষ দুনিয়ায় বাঁচবে কতদিন, কত বছর? একটা সময় পর তাকে চলে যেতেই হবে। আর সব মানুষই চলে যাবে। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ- ওই যে আমরা ভাব সম্প্রসারণ পড়েছিলাম- মানুষ বাঁচে তার কর্মের মধ্যে, বয়সের মধ্যে নয় বা জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভালো। সেই জায়গা থেকে মনে হয়েছে, একটা ভালো কর্মের মধ্য দিয়ে, মরার পরও মানুষ বেঁচে থাকতে পারে এবং মানুষের দোয়া পেতে পারে। সে জায়গা থেকে মনে হয়েছে পরিবারের পাশাপাশি সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য কিছু কাজ করা এবং নিদর্শন রেখে যেতে হবে। যাতে আমি না থাকলেও মানুষ আমাকে মনে রাখে। সে জন্যই মনে হয়েছে মানুষের সেবা করার জন্য রাজনৈতিক দল একটা উপযুক্ত প্ল্যাটফর্ম হতে পারে। রাজনীতি তো আলটিমেটলি মানুষের জন্য কাজ করা। জনগণের উন্নয়ন, সুবিধা-অসুবিধা দেখা। সে জায়গা থেকেই রাজনীতিতে আসা।
খবরের কাগজ: কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন শুরু করেন, তখন কি মনে হয়নি যে আন্দোলনে আপনি সফল হবেন কি না? আপনার নিজের মধ্যে কোনো সংশয় ছিল?
নুরুল হক নুর: না, শুরুর দিকে কিছুটা কনফিউশন ছিল, আসলে ছাত্ররা শেষ পর্যন্ত আন্দোলনে থাকবে কি না। ছাত্রলীগ হামলা করলে আমাদের আন্দোলন চলবে কি না। কারণ, ১৫ বছরে এটি একটি কমন চিত্র ছিল সরকারি দলের বাইরে কোনো ছাত্রসংগঠন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ক্যাম্পাসে দাঁড়াতে পারেনি। সেখানে দাবিদাওয়া তোলা তো পরের কথা। আমরা এই আন্দোলন করতে গিয়েও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছি। ধাক্কাধাক্কি, কিল, ঘুসি, হামলা- এগুলো ফেস করেছি এবং দেখেছি শুরুর দিকে কিংবা যখন বাধাহীনভাবে আন্দোলন চলছিল তখন হাজার হাজার শিক্ষার্থী আন্দোলনে এল এবং হামলা হয়েছে। হেলমেট বাহিনীর তাণ্ডব চলেছে। তখন আবার অনেকে মিছিল-মিটিং থেকে চলে যায়। 
কিন্তু মনে হয়েছিল আমরা নেমেছি, রক্ত ঝরেছে, হামলা হয়েছে, এর শেষ দেখে ছাড়ব। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে ৯ মাস। আমরা কোটা সংস্কার আন্দোলন করেছি সোয়া ৮ মাস। ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ৪ অক্টোবর পর্যন্ত আমরা আন্দোলন করেছি। এর মধ্যে প্রজ্ঞাপন, দাবিদাওয়া মেনে নেওয়া নিয়ে সরকারের নানা রকম টালবাহানা ছিল। আমরাও নাছোড়বান্দা ছিলাম। প্রজ্ঞাপন জারির পর আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছিলাম।
আবার যখন ২০২৪ সালের জুনে আদালতের রায়কে কেন্দ্র করে, আমাদের যে পলিটিক্যাল লিগ্যাসির অবস্থানটা, এই কোটা সংস্কার আন্দোলনকে তৈরি করেছে। কোটা সংস্কারের আন্দোলনের সারা দেশে তারুণ্যের যে বিপ্লব এবং বিদ্রোহের মনোভাব, সেটা আমরা সমাজের মানুষকে দেখিয়েছি। সরকার সেটা মুছে দিতে চেয়েছিল। কারণ তাদের জন্য থ্রেট হচ্ছে এই তরুণ ফোর্স গণ অধিকার পরিষদ। কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বের হয়ে আসা ফোর্স।

সরকার আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে কোটা আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছিল। তখন আমরা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছি এবং কৌশলগতভাবে আমরা তখন নেতৃত্বে না থেকে, নতুন নেতৃত্বের সুযোগ দিয়েছি। কারণ আমরা যদি নেতৃত্বে থাকতাম তাহলে ছাত্রলীগ, যুবলীগ শুরুতেই হামলা করে এটা বানচাল করে দিত। আমরা সেই কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্বকে গাইড করার পাশাপাশি কোটা সংস্কার আন্দোলনকে রাষ্ট্র সংস্কার, ফ্যাসিবাদ নিরসনের এক দফা আন্দোলনে নিয়ে যাই। সে বিষয়ে রূপরেখা, প্ল্যান, প্রোগ্রাম করেছি। বিএনপির মতো একটা বড় রাজনৈতিক দল, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছি। ১৭ জুলাই ২০২৪ সব রাজনৈতিক দল মিলে গায়েবি জানাজার কর্মসূচি দিয়েছিলাম। ১৮ জুলাই সব রাজনৈতিক দল মিলে সর্বদলীয় মিছিল কর্মসূচি দেওয়া হয়েছিল ছাত্রদের ওপর হামলার প্রতিবাদে এবং সেই দিন থেকে সে আন্দোলন আর ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এটা একটা গণ-আন্দোলন এবং জাতীয় আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। রাজনৈতিক দলগুলো এই আন্দোলনে কতটুকু অবদান রেখেছে, সেটা সবাই জানে এবং সেখানে আমাদের কতটুকু নেতৃত্ব ছিল সেটাও সবাই জানে। এই আন্দোলনের সঙ্গে আমি সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলাম। ১৮ জুলাই রাত ১২টার পর মানে ১৯ তারিখ (জুলাই) আমি আবার অ্যারেস্ট হই। 
খবরের কাগজ: কোটা সংস্কার আন্দোলনে দাবি আদায়ের পর আপনার কি মনে হয়েছিল যে, আওয়ামী লীগের পতন ঘটাতে হবে?
নুরুল হক নুর: ২০১৪ সালে বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগের একদলীয় শাসন, কর্তৃত্ববাদী শাসনের যাত্রা শুরু হয়। নির্বাচনের আগে তারা বলতে বাধ্য হয়েছিল এটা নিয়ম রক্ষার নির্বাচন, পরে আবার দ্রুতই নির্বাচন হবে। কিন্তু তারা ক্ষমতায় গিয়ে সে কথা রাখেনি। তখনই মানুষ পরিষ্কারভাবে বুঝতে পেরেছিল আওয়ামী লীগের জেনেটিক্যাল গুণ বাকশালী চেতনা থেকে তারা বের হতে পারেনি। এখনো বাকশাল কায়েম করবে। 


খবরের কাগজ: আপনার কী মনে হয়েছিল? 
নুরুল হক নুর: তখন আমরা ধারণা করেছিলাম, এই ব্যবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার। সে জন্য রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলন করেছে। কিন্তু পারেনি। আমরা সুযোগ পেয়েছি ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময়। আমাদের কাজ ছিল প্রাথমিকভাবে এই মৃতপ্রায় প্রজন্ম এবং জাতিকে জাগিয়ে তোলা। তাদের মধ্যে জাগরণ তৈরি করা। দেশে যেটা হচ্ছে এভাবে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চলতে পারে না। 
কোটা সংস্কার আন্দোলনে আমরা নাড়া দিয়েছিলাম। একই বছর আবার নিরাপদ সড়ক আন্দোলন গ্রো করেছিল। একটা আন্দোলনের মধ্যে আর একটা আন্দোলন তৈরি হয় না। যখন কোটা সংস্কার আন্দোলনে আমরা হামলা-মামলায় কোণঠাসা, তখন শিক্ষার্থীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন হয়েছিল। আমরা চেষ্টা করেছিলাম শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করা যায়, সারা দেশে শিক্ষার্থীদের কীভাবে রিলেট করা যায়। শিক্ষার্থীরা সে সময় বলেছে- আমরা দেখেছি কোটা সংস্কার আন্দোলনে কীভাবে ভাইদের পেটানো হয়েছে। হেলমেট বাহিনীর তাণ্ডব চলেছে। সেটা তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছাত্র আন্দোলন ছিল এবং ছাত্রদের একটা বড় জাগরণ ছিল। সে সময় অনেক পত্রপত্রিকা একে কিশোর বিদ্রোহ বলেছিল। তখনই আমরা পরিষ্কার হয়েছি, এই প্রজন্মের তরুণরা দূরদর্শী চিন্তা নিয়ে এগোচ্ছে। তারা রাষ্ট্রের সবকিছু দেখছে, বুঝছে। কিন্তু বলতে পারছে না। রাস্তার মাঝে প্ল্যাকার্ড তুলে বলছে যে, রাষ্ট্র সংস্কার চলছে সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত। তারা রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে ভাবছে। তার ফলে এই কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ২০২৪ সালের ঘটনা ঘটানো সম্ভব হয়েছে। ওই যে ১৮ সালের কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, আন্দোলনে হেলমেট বাহিনীর হামলা ও তাণ্ডব ছাত্ররা দেখেছে। তখনকার স্কুলের ছাত্ররা এখন বিশ্ববিদ্যালয় এসেছে। তাদের মধ্যে বিপ্লবের, প্রতিবাদের বা দ্রোহের আগুন ছিল। সময়মতো তারা সেটা এক্সপোজ করেছে। ফলে ফ্যাসিবাদী সরকারের অবসান হয়েছে।
খবরের কাগজ: কোটা সংস্কার এবং নিরাপদ সড়ক আন্দোলন একই সময়ে হয়েছিল। তাহলে সেই আন্দোলনের সুপ্ত বাসনা ছিল ফ্যাসিবাদ দূর করা এবং আওয়ামী লীগের পতন দরকার। এটা সুপ্ত বাসনা ছিল?
নুরুল হক নুর: জি। এবং সেই পতনে একমাত্র ভূমিকা রাখতে পারবে তরুণ প্রজন্ম, নিউ জেনারেশন।  কারণ, রাজনৈতিক দলগুলো তখন ব্যর্থ হচ্ছিল। তারা বলছিল, বাধ্য হয়ে ইলেকশনে যাচ্ছে। একদিকে বলছে ইলেকশন অবৈধ। আবার তারা নির্বাচনে যাচ্ছে। আবার বলছে, ফেয়ার নির্বাচন হচ্ছে না। তারা স্থানীয় নির্বাচনেও গেছে। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে গেছে। কিন্তু আমরা বুঝতে পারছিলাম তরুণ প্রজন্মের জাগরণ ছাড়া একটা বিপ্লব কিংবা গণ-অভ্যুত্থান সম্ভব নয়। যে কারণে আমরা দায়িত্ব নিয়েছিলাম তরুণদের কানেক্ট করা এবং তাদের মধ্যে একটা জাগরণ ঘটানো।


খবরের কাগজ: এরপর আপনি ডাকসু নির্বাচন করলেন। তার মানে আপনি কি মনে করেছিলেন যে এই ধরনের আন্দোলনের জন্য আপনার পরিচিতির দরকার আছে, সে জন্য ডাকসু নির্বাচন করেছিলেন?
নুরুল হক নুর: আমাকে অনেকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছিল যে, নুরা কি ভিপি-জিএস হবে! ওর থেকে আমাদের সঙ্গে আসুক। একটা সম্পাদক পদে নির্বাচন করুক। এজিএস পদে নির্বাচন করুন। এ রকম আমাকে বলেছিল। এই অবহেলায় আমার মধ্যে আরও জেদ তৈরি হয়েছিল। দেখুন, এ রকম একটা সময়ে এত বড় একটা ছাত্র আন্দোলন করলাম, আমাদের নিয়ে তাদের অবজারভেশন এই। তারপর আমরা দেখিয়ে দিই আমাদের অবস্থান বা শিক্ষার্থীরা কী চায়। তরুণ প্রজন্মের যে একটা চিন্তার নতুন জগৎ তৈরি হয়েছে, তাদের ভাবনা যে অ্যানালগ বা ওল্ড জেনারেশন পলিটিক্স থেকে ভিন্ন- সেটা দেখানো দরকার। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৪ জেলার ছেলেমেয়েরা পড়ে। একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে শহরের ছেলেমেয়েরা আসে। তাদের নানা রকমের চিন্তাভাবনা রয়েছে। তারা দেখিয়ে দিয়েছে।
আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে ২০১৮ সালের নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে, মধ্যরাতে নির্বাচন হয়েছে। বিএনপির সাতজন সংসদ সদস্য শপথ নিয়েছিলেন। আমি তখন ভিপি হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছি। দায়িত্ব নেওয়ার পরে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ করার আরও বড় সুযোগ হয়েছিল। যদিও আমাকে খুব বেশি মুভ করতে দেওয়া হয়নি। যেখানে গেছি সেখানেই হামলা হয়েছে। হামলার পরও থামিনি। এ পর্যন্ত ২৫ বার হামলা হয়েছে। কিন্তু কখনো থামাতে পারেনি। দেশবাসীর প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে গেছি। 


খবরের কাগজ: আপনার কাছে ছাত্র আন্দোলন ও কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্ব এবং ভিপি হওয়ার আগে ও পরের অনুভূতিটা কেমন ছিল? 
নুরুল হক নুর: আমি নেতা হয়েছি- এই অনুভূতিটা কখনো কাজ করেনি। ২৮ বছর পরে ডাকসু নির্বাচন হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে চরিত্র সব সময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, প্রতিবাদ করা গণমানুষের পক্ষে থাকা, স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম- আমরা সেটাকে আমলে নিয়েই কিছু করার চেষ্টা করেছিলাম। ফলে গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট তৈরি করা সম্ভব হয়েছে।
আজকে যারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে উপদেষ্টা আছেন, যারা নেতা রয়েছেন- তাদের অনেকে ওই থেকে কাজ করেই একটা রাজনৈতিক অবস্থা তৈরি করেছেন। আমার একটা সন্তুষ্টির জায়গা যে, আমি অল্প সময়ের মধ্যে আমার চেয়ে বড় নেতা তৈরি করতে পেরেছি। আমার সঙ্গে যারা রাজনীতি করেছেন তারা এখন সরকারের মন্ত্রী। কেউ কেউ এখন ন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল বিভিন্ন জায়গায় আছেন। আমি এটা মনে করি যে, কোনো রাজনৈতিক নেতা বা প্রফেশনাল ব্যক্তি হিসেবে, সাংবাদিক হোক, শিক্ষক হোক তার সফলতা তার সঙ্গে যারা কাজ করেছে, তাদের বড় অবস্থানে পৌঁছে দেওয়া। 


খবরের কাগজ: ছাত্র নেতৃত্ব গড়ে ওঠার পেছনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা নিয়ে আপনি নিশ্চয়ই গর্ববোধ করেন?
নুরুল হক নুর: শুধু ছাত্র অন্দোলন না। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আরও এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিসের মাধ্যমে তার মধ্যে থাকা সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের জায়গা। নানাভাবে এক্সপ্লোর করা নিজেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভালো ভালো একাডেমিশিয়ান তৈরি করেছে। সোশ্যাল ওয়ার্কার, এনজিও কর্মী, বিজ্ঞানী, গবেষক, শিক্ষক সাংবাদিক এবং রাজনীতিবিদ তৈরি করে যাচ্ছে। 
আমি ডাকসুর ভিপি ছিলাম এখন একটা রাজনৈতিক দলের প্রধান।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা যেকোনো প্রতিষ্ঠান আলোকিত হয় বা পরিচিত হয় তার ছাত্রদের দ্বারা। তার প্রতিনিধিদের দ্বারা। প্রতিনিধিরা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে পরিচিত হয় সেটা নয় বরং ওই প্রতিনিধিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ করেছে। ছাত্রদের কন্ট্রিবিউশন, প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন গর্বের তেমনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়েন তাদের জন্য গর্বের। 

দ্বিতীয় পর্ব আগামীকাল...

বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক অপরিবর্তনশীল থাকবে

প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪৯ এএম
বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক অপরিবর্তনশীল থাকবে
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ

ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ এশিয়ায় হয়তো তারা একটি বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে চেষ্টা করবে। এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় পরিষ্কার করে বলা যায়। প্রথমত, আমেরিকা চাইবে বাংলাদেশে যেন খুব তাড়াতাড়ি একটি নির্বাচন হয়। তার একটি রোডম্যাপ যেন সামনে নিয়ে আসা হয়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি তাগিদ থাকবে বাংলাদেশের নির্বাচনের ব্যাপারে। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাপারে কবে নির্বাচিত সরকার হতে যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র সে ব্যাপারে একটা রোডম্যাপ দ্রুতই দেখতে চাইবে।...

ডোনাল্ড ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি ইলেকটোরাল ভোটে বিশাল ব্যবধানে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কমলা হ্যারিসকে হারিয়ে আমেরিকার ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। অনেকে ভেবেছিলেন, এবারের নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। কিন্তু তা হয়নি। তিনি ইলেকটোরাল ভোটের পাশাপাশি জনগণের ভোটেই এগিয়ে গেছেন। সিনেটেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টি এগিয়ে ছিল। ‘হাউস অব রেড’ সেটিও রিপাবলিকানের দিকে গেছে। একই সঙ্গে বলা যায়, গাজার ঘটনায় জো বাইডেন ও তার টিম রীতিমতো জেনোসাইডের জটিলতার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন। সেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে তরুণ ভোটাররা যথেষ্ট ভোট দিয়েছে বোঝা গেছে। 

সেটিও রিপাবলিকানদের দিকে চলে গেছে। এখানে বলে রাখা দরকার যে যুদ্ধ যদি কোনো পার্টি থামাতে পারে, সেটি ডোনাল্ড ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টিই পারবে। আমরা যদি আমেরিকার ইতিহাস দেখি, সেখানেও আমরা দেখেছি যে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় রিপাবলিকান পার্টি যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছিল। ডেমোক্র্যাটরা পারেনি। সে হিসাবে রিপাবলিকানদের ম্যান্ডেড ক্লিয়ার হয়ে গেছে। আর একটি বিষয় বলা দরকার, তা হলো দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি করতে চেষ্টা করবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর ব্যাপারে আমেরিকানরা বরাবরই বলে আসছিল- এই যুদ্ধ করে আমেরিকার কোনো লাভ হচ্ছে না। এখন ট্রাম্প প্রশাসন কী করবে, তা দেখার বিষয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিষয়ে তাদের নজর থাকবে।

 নরেন্দ্র মোদির সঙ্গেও বড় ধরনের সম্পর্ক গড়তে চেষ্টা করবে তারা। তাদের বাড়তি একটা চেষ্টা থাকবে ভারতকে আমেরিকার দিকে টানার। কারণ বাইডেনের সময় ভারত, রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে যে বৈরী সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, তা আমেরিকার জন্য অস্বস্তিকর ছিল। তবে কী ধরনের পরিবর্তন হবে, সেটি বলা মুশকিল। সারা বিশ্বের মতো দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের দৃষ্টিও ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের দিকে। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফলাফল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং অভিবাসী নীতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। 

ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ এশিয়ায় হয়তো তারা একটি বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে চেষ্টা করবে। এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় পরিষ্কার করে বলা যায়। প্রথমত, আমেরিকা চাইবে বাংলাদেশে যেন খুব তাড়াতাড়ি একটি নির্বাচন হয়। তার একটি রোডম্যাপ যেন সামনে নিয়ে আসা হয়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি তাগিদ থাকবে বাংলাদেশের নির্বাচনের ব্যাপারে। অন্তর্বর্তী সরকারের দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতায় ফিরিয়ে আনার। ট্রাম্প ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক করতে চেষ্টা করবেন। এ কারণে আমরা যে উৎসাহটা দেখতে পাচ্ছি বাংলাদেশের ব্যাপারে, সেটায় ভাটা পড়ার আশঙ্কা আছে। চীন, ভারত ও রাশিয়ার মতো বড় দেশগুলোর বিষয়ে ব্যস্ত থাকবে। সেই জায়গায় বাংলাদেশ যে মনোযোগ চেয়েছিল সেটা নাও পেতে পারে। তাই আমাদের ওপর কী প্রভাব পড়বে, সেটা এখনই বলা মুশকিল। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাপারে কবে নির্বাচিত সরকার হতে যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র সে ব্যাপারে একটা রোডম্যাপ দ্রুতই দেখতে চাইবে। 

অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্ক অপেক্ষাকৃত জোরদার হবে। বিশেষ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির গণতান্ত্রিক চর্চা নিয়ে ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে যথেষ্ট সমালোচনা ছিল। ট্রাম্প সেই বিষয়টি সামনে আনবে না, বরং তাদের একটি চেষ্টা থাকবে অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি করতে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন হলে তার প্রভাব দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশের ওপর পড়বে কি না, সেটি দেখতে হলে আরও কিছুটা সময় লাগবে। বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে, বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে খুবই স্পষ্ট ছিলেন। সেই জায়গায় একটি বড় পরিবর্তন আসার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। ফিলিস্তিনের ব্যাপারে বলতে গেলে বলা যায়, সে ক্ষেত্রেও নতুন করে একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে। 

ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক একই থাকবে বলেই মনে হয়। কারণ যুক্তরাষ্ট্র একটি প্রাতিষ্ঠানিক রাষ্ট্র। এটি ব্যক্তিনির্ভর কোনো রাষ্ট্র নয়। এখানে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। এটি নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই। যুক্তরাষ্ট্র একটি বৈশ্বিক শক্তি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তারা বড় রাষ্ট্রগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বিশেষ করে রাশিয়া, চীন ও ভারত এসব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন। 

এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্কের কোনো পরিবর্তন হওয়ার মতো তেমন কিছু নেই বলেই মনে হয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর অভিবাসী নীতি নিয়ে ভিন্ন কোনো সিদ্ধান্ত নিলে বাংলাদেশ একটু চাপে পড়বে। কারণ বাংলাদেশের অনেকেই অবৈধভাবে সেখানে আছেন। আবার অনেকেই এখনো নাগরিকত্ব পাওয়ার পর্যায়ে রয়েছেন। সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় ডোনাল্ড ট্রাম্প যে মন্তব্য করেছেন, এটি হতে পারে আমেরিকার সংখ্যালঘুদের ভোট পাওয়ার জন্য তিনি এটি করেছেন। তবে সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় বড় রকম সজাগ থাকবেন। এটি নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই। ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক মূলত একই থাকবে। 

তবে বিশ্বজুড়ে আমেরিকার মানবিক সহযোগিতার জায়গা কমে আসতে পারে। সেদিক বিবেচনায় দুই দেশের সম্পর্কে কিছু ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসতে পারে। বাংলাদেশের জন্য অনিশ্চয়তার জায়গা হিসেবে আছে রোহিঙ্গা ইস্যু। কারণ জাতিসংঘের মাধ্যমে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের জন্য যে সহায়তা আসে, তার একটি বড় অংশই আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। আমেরিকার ইতিহাসে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ঠিক প্রথাগত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখা যায়নি। তিনি যেভাবে বৈদেশিক নীতির জায়গাগুলো বিবেচনা করেন, সেটি ঘিরেও বেশ অনিশ্চয়তা থাকে। যেখানে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে উন্নয়ন, সংস্কার ও অন্যান্য সহায়তা বা সমর্থন করছে, সে ক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প বর্তমান সম্পর্কের কাঠামোকে সম্পূর্ণ সমর্থন করবেন বলে ঠিক মনে হয় না। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের বহমান সম্পর্ক বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে কোন পথে এগিয়ে যাবে, সেটি বুঝতে হলে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। 

লেখক: শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষক

পরিবেশ রক্ষায় পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করা জরুরি

প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪২ এএম
পরিবেশ রক্ষায় পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করা জরুরি
সৈয়দ ফারুক হোসেন

বাজারগুলোতে প্রকাশ্যে পলিথিনের ব্যবহার হলেও এ আইনের কোনো প্রয়োগ নেই। সরকারের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে তা দ্রুত বাস্তবায়ন দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। রাজধানীসহ সারা দেশে প্রায় ৩ হাজার কারখানায় দিনে ১ কোটি ৪০ লাখ নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ তৈরি হচ্ছে। এগুলোর সিংহভাগই পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক। রাজধানীর ৬৪ শতাংশ মানুষ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে। তার মধ্যে শুধু ঢাকা শহরে প্রতিদিন প্রায় আড়াই কোটিরও বেশি পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার করে বাইরে ফেলে দেওয়া হয়।...

পলিথিন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অনিবার্য অংশ হয়ে উঠেছে। আর তার পরিণতি আমরা ভোগ করছি প্রতিনিয়তই। ক্যানসারসহ নানা রোগব্যাধি বাসা বাঁধছে শরীরে। চিকিৎসায় ব্যয় হচ্ছে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। অবশেষে টেনে নিয়ে যাচ্ছে অকালমৃত্যুর করুণ পরিণতির দিকে। অত্যধিক পলিথিন ব্যবহার নিয়ে চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা এমন কথাই বলছেন। পলিথিন বা প্লাস্টিকের ব্যবহারের ফলে হরমন বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফলে দেখা দিতে পারে বন্ধ্যত্ব, নষ্ট হতে পারে গর্ভবতী মায়ের ভ্রুণ, বিকল হতে পারে লিভার ও কিডনি। পৃথিবীব্যাপী তাই পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে। অনেক দেশ আইন করে তা নিষিদ্ধও করেছে। সহজলভ্যতা, বহুমুখী ব্যবহার, স্বল্পমূল্য, হালকা ওজন ও উচ্চ স্থায়িত্বের ফলে নানা ধরনের প্লাস্টিকসামগ্রী যেমন- প্লাস্টিক ব্যাগ, ফিল্ম, সিনথেটিক পোশাক, কার্পেট, থালাবাসন, ঘটিবাটি, বোতল, টায়ার, খেলনা, প্যাকেটজাত দ্রব্য, সার, যন্ত্রপাতি, যানবাহনের বডি ও যন্ত্রাংশ ইত্যাদি পরিণত হয়েছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এক অনিবার্য উপাদানে। নিত্যব্যবহার্য এসব প্লাস্টিকসামগ্রী, সিনথেটিক টেক্সটাইল ও কলকারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে প্রতিনিয়ত ছড়িয়ে পড়ছে পরিবেশে। যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে সাগরের তলদেশ থেকে মাউন্ট এভারেস্ট পর্যন্ত পৃথিবীর সর্বত্র, এমনকি মেরু অঞ্চলেও প্লাস্টিক বর্জ্য ছড়িয়ে পড়েছে। 

ইতোমধ্যেই পৃথিবীর মাটি, পানি, বায়ুমণ্ডল, বন্যপ্রাণী, জীববৈচিত্র্য ও মানবস্বাস্থ্যে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে এই প্লাস্টিকদূষণ। একসময়ের উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার প্লাস্টিক এখন পরিবেশদূষণ নামের দুঃস্বপ্নের শামিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর অপব্যবহার এবং অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ফলে বিশ্বব্যাপী বাস্তুতন্ত্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। প্লাস্টিকজাত দ্রব্যের বিস্তৃত ব্যবহারের মধ্যে থাকা একবার ব্যবহারযোগ্য পণ্য থেকে শুরু করে দীর্ঘস্থায়ী উপকরণ, সবই পরিবেশ ক্ষয়ে অন্যতম অবদান রাখে। মূল সমস্যাটা হচ্ছে প্লাস্টিক বর্জ্যের অব্যবস্থাপনার কারণে। একটি বড় পরিমাণের প্লাস্টিক বর্জ্য গিয়ে জমা হয় ভাগাড়ে, যেগুলো পচতে সময় গেলে যায় বছরের পর বছর। 

এ ছাড়া অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ফলে একটি মোটামুটি পরিমাণে প্লাস্টিক বর্জ্যের গন্তব্য হয় জলাশয়গুলো, যার জের ধরেই ক্রমবর্ধমান সমুদ্রদূষণের সমস্যাটি আরও বৃদ্ধি পায়। সমুদ্র যেন প্লাস্টিক বর্জ্যের এক বিশাল মজুত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে করে বিপর্যস্ত হচ্ছে সামুদ্রিক জীবন। জাতিসংঘের পরিবেশ প্রোগ্রামের (ইউএনইপি) পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ৮ মিলিয়নেরও বেশি মেট্রিক টন প্লাস্টিক বর্জ্য প্রতিবছর সমুদ্রে প্রবেশ করে। এই প্লাস্টিকদূষণ সামুদ্রিক প্রাণীদের জন্য বিশাল হুমকির রূপ নেয়, কেননা তারা প্রায়ই ভুল করে প্লাস্টিককে খাবার মনে করে বা বিভিন্নভাবে তাদের শরীর প্লাস্টিকের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ৪৫ কোটি টন প্লাস্টিক বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ছে। প্লাস্টিক বর্জ্য ৪০০ বছর পর্যন্ত পরিবেশে বিরাজ করে জীব ও প্রকৃতির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। উন্নত দেশে সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা থাকায় ব্যবহৃত প্লাস্টিক পরিবেশে কম ছড়িয়ে পড়ছে। প্রায় সব ধরনের মোড়ক ও বোতল প্লাস্টিকের তৈরি। ব্যবহৃত প্লাস্টিকের কিছু অংশ রিসাইকেল করা হলেও বেশির ভাগই বর্জ্য হিসেবে ছড়িয়ে পড়ছে। প্লাস্টিক কৃত্রিমভাবে তৈরি একটি পলিমার। এটি জীবাশ্ম জ্বালানি বা প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে রাসায়নিক উপায়ে তৈরি করা হয়। 

অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারের বিষয়ে জোরালো অবস্থান নিয়েছেন। দেশের কোনো সুপারশপে পলিথিন ব্যাগ রাখা যাবে না। এর পরিবর্তে পাট বা কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহার করতে হবে। ১ নভেম্বর থেকে ঢাকার ১০টি কাঁচাবাজারে পলিথিন ব্যবহার বন্ধে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। দেশব্যাপী পলিথিন উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধেও অভিযান চালানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এদিকে সুপারশপগুলোর পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে, ক্রেতারা যেন নিজস্ব ব্যাগ সঙ্গে নিয়ে কেনাকাটা করতে আসেন। ব্যাপক হারে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট পরিবেশগত বিপর্যয় সম্পর্কে এখন আর কারও দ্বিমত নেই। দেশের পরিবেশ বিজ্ঞানী ও পরিবেশ আন্দোলনকর্মীদের দীর্ঘদিনের দাবি এবং ঢাকা শহরের চারপাশের নদ-নদীদূষণ, সামান্য বৃষ্টিতে পানিবদ্ধতা, পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ার মতো বাস্তব সংকটের প্রেক্ষাপটে বিগত সরকার আইন করে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করলেও আইনের বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতার কারণে নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার বেড়েই চলেছে। বর্তমান সরকার পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে।

 এটা সময়োপযোগী, বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ। গত ২২ বছরে আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় পলিথিনের ব্যবহার কমেনি এতটুকুও। বর্তমানে বাজারগুলোতে প্রকাশ্যে পলিথিনের ব্যবহার হলেও এ আইনের কোনো প্রয়োগ নেই। সরকারের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে তা দ্রুত বাস্তবায়ন দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী আরও অবাক করা বিষয় হচ্ছে, রাজধানীসহ সারা দেশে প্রায় ৩ হাজার কারখানায় দিনে ১ কোটি ৪০ লাখ নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ তৈরি হচ্ছে। এগুলোর সিংহভাগই পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে প্রতিদিন যে পরিমাণ পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়, অনেক দেশে তা ১০ মাসেও হয় না। এদিকে বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রাজধানীর ৬৪ শতাংশ মানুষ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে। তার মধ্যে শুধু ঢাকা শহরে প্রতিদিন প্রায় আড়াই কোটিরও বেশি পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার করে বাইরে ফেলে দেওয়া হয়। অপচনশীল ও সর্বনাশা পলিথিনের এমন যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে বিশেষ করে বর্ষাকালে নগর-মহানগরে পয়োনিষ্কাশনের ড্রেন, নালা, নর্দমা, খাল, বিল ও নদীগুলো ভরাট হচ্ছে আর দূষিত হচ্ছে পানি। ২০২৩ সালে এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ঢাকা শহরে একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে পাঁচটি করে পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার করে। 

সে হিসাবে শুধু ঢাকা শহরে প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি পলিথিনের ব্যাগ একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। দেশে পরিবেশদূষণের অন্যতম কারণ পলিথিন হলেও এর সঙ্গে নতুন করে যোগ হয়েছে টিস্যু ব্যাগ। ওভেন পলি প্রোপাইলিন দিয়ে প্লাস্টিক পণ্য তৈরির পাশাপাশি টিস্যু ব্যাগ তৈরি করা হচ্ছে। বিভিন্ন রঙের ও মোটা হওয়ায় অনেকেই ব্যবহার করায় প্রতিনিয়ত বাড়ছে টিস্যু ব্যাগের ব্যবহার। টিস্যু ব্যাগ অপচনশীল। এই বস্তুটি ব্যবহারের পর যত্রতত্র ফেলে দেওয়া হয়। যা পয়োনিষ্কাশন নালায় আটকে গিয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। পরিবেশের প্রতিটা উপাদানের সুসমন্বিত রূপই হলো সুস্থ পরিবেশ। এই সুসমন্বিত রূপের ব্যত্যয়ই পরিবেশেরদূষণ ঘটায় এবং পরিবেশের স্বাভাবিক মাত্রার অবক্ষয় দেখা দেয়। পরিবেশ বিভিন্ন কারণে দূষিত হতে পারে। প্রাকৃতিক কারণের পাশাপাশি মানবসৃষ্ট কারণও এর জন্য দায়ী। মানুষের অসচেতনতা এবং অনিয়ন্ত্রিত আচরণের কারণেই পরিবেশদূষণ হচ্ছে ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। পলিথিন উৎপাদনকারী থেকে শুরু করে এটির বাজারজাতকারী ও ব্যবহারকারীরা পর্যন্ত জটিল স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে রয়েছে। পলিথিন জমা হয়ে নদীর তলদেশ ভরাট করে ফেলে। 

পলিথিন পোড়ালে বাষুদূষণ ঘটে। পলিথিন এবং প্লাস্টিকের বর্জ্যগুলো মাটিতে পড়ার দরুন মাটি তার মৌলিকত্ব হারাচ্ছে এবং এসব মাটিতে কোনো ভৌত কাঠামো নির্মাণ করলে তা দুর্বল হতে পারে। গ্রামে প্রত্যেক বাড়িতেই তরিতরকারির খোসা, মাছের অপ্রয়োজনীয় অংশ, বাড়িঘর, উঠান ঝাড়ু দেওয়ার পর ময়লা-আবর্জনাগুলো একটা নির্দিষ্ট গর্তে ফেলা হয় এবং যেগুলো কয়েক মাস পর কৃষক জৈব সার হিসেবে কৃষিকাজে ব্যবহার করে। পলিথিন এবং প্লাস্টিকের বর্জ্য ড্রেন, নদী-নালা, খাল-বিলে ফেলার দরুন ময়লা পানি নিষ্কাশনে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, পাশাপাশি মাছ চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পলিথিন ব্যাগ সহজলভ্য হওয়ায় শহর এলাকায় তরিতরকারির খোসা, মাছের অপ্রয়োজনীয় অংশ, খাবারের উচ্ছিষ্ট এবং বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনা পলিথিন ব্যাগে ভরার পর সেগুলো কোনো ডাস্টবিনে অথবা রাস্তার পাশে ফেলা হয়। বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক বর্জ্যে অনেক আগেই বিষাক্ত হয়েছে বুড়িগঙ্গার পানি। বাতাসে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ।

 নদীর তলদেশে জমাট বেঁধেছে ৮ ফুট পুরু পলিথিনের স্তর। বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা পলিথিন এবং প্লাস্টিকের বর্জ্যগুলো একত্রিত করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে এবং প্রজ্বলিত পলিথিন এবং প্লাস্টিক থেকে নির্গত ক্ষতিকর গ্যাস গাছপালার মাধ্যমে পরিশোধিত হতে পারে। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক পলিথিনের কুফল থেকে দেশবাসীকে রক্ষার জন্য সরকার ইতোমধ্যে সারা দেশে পলিথিন শপিং ব্যাগের উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ ও বিক্রয় বন্ধ ঘোষণা করেছে। কিন্তু এর সঙ্গে মানুষের দীর্ঘদিনের অভ্যাস পরিবর্তনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ অর্থাৎ পলিথিন শপিং ব্যাগ বন্ধের আইন কার্যকর করার লক্ষ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের উদ্যোগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় বিভিন্ন উৎপাদনকারী কারখানা বন্ধ ও শপিং ব্যাগ জব্দ করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে। 

এখন কাগজ ও পাটের ব্যাগের ব্যবহারই আমাদের পলিথিনের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করতে পারে। পাটের ব্যাগ পরিবেশবান্ধব। পলিথিনের উৎপাদন ও বাজারজাত বন্ধে সরকারের ব্যাপক নজরদারিসহ প্রচার মাধ্যমগুলোতে (রেডিও, টেলিভিশন, পত্রপত্রিকা) ব্যাপক প্রচার দরকার। এভাবে পলিথিনের ক্ষতিকারক দিকগুলো সাধারণ মানুষের দৃষ্টিগোচর করার পর কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে পলিথিন ও প্লাস্টিকের বর্জ্যগুলোর ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ব্যাপারে বর্তমান সরকারের গৃহীত পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানিয়ে আপামর জনসাধারণকে সহযোগিতা করতে হবে।

লেখক: সাবেক রেজিস্ট্রার, বিএসএফএমএসটিইউ
[email protected]

ট্রাম্পের বিজয় বিস্ময়কর

প্রকাশ: ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৪৫ পিএম
ট্রাম্পের বিজয় বিস্ময়কর
ওয়েন জোন্স

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনি প্রচারণার শেষ দিনগুলোতে আমি যেখানেই গিয়েছি, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকরা আমাকে একই কথা বলেছেন, তিনি বিজয় হবেন।  উইসকনসিন থেকে পেনসিলভানিয়া পর্যন্ত সব জায়গাতেই ট্রাম্পের জয়গান ছিল। তবে তাদের কিছু আপত্তি ছিল; অভিবাসী, মুদ্রাস্ফীতি এবং যুদ্ধ। এবার বিশ্বে শান্তি ফিরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে অনেক।
 
ট্রাম্পকে হোয়াইট হাউসে ফিরে আসাটা অনেকটা বিস্ময়কর। আমেরিকানদের বেশির ভাগ মানুষই অনেক খুশি। কমলা হ্যারিসকে অনেকে কেবল ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখেছিলেন। জো বাইডেন এমন একজন প্রেসিডেন্ট, যিনি দীর্ঘদিন ধরে নেতিবাচক ভাবমূর্তি ধরে রেখেছিলেন। গত মাসে যখন হ্যারিসকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল,  তিনি জো বাইডেন থেকে আলাদাভাবে কী করবেন? হ্যারিস উত্তর দিয়েছিলেন: এমন কিছু নেই যা মাথায় আসে না, আমার বেশির ভাগ সিদ্ধান্তের মধ্যে তার অংশগ্রহণ রয়েছে। 

দেশটির রাজ্যেগুলোতে আমেরিকানদের তেমন কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না। কোনো ক্রোধ ছিল না।  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হ্যারিসের কিছু নির্বাচনি প্রচারণায় কিছু ভুল সিদ্ধান্ত ছিল, যার কারণে ট্রাম্পের বিজয় কিছুটা নিশ্চিতের পথে চলে যায়। ট্রাম্পবাদী আন্দোলনের অস্তিত্ব ছিল যুক্তরাষ্ট্রজুড়েই।
 
অবশ্যই অভিবাসীদের প্রতি কঠোরতা অর্থনৈতিকে দুর্বল করতে পারে। ট্রাম্পবাদী আন্দোলনের একটি অংশ ভয় পায়, যা তারা শ্বেতাঙ্গ আমেরিকার জন্য অস্তিত্বের হুমকি হিসেবে দেখে এবং বিশ্বাস করে যে ডেমোক্র্যাটদের বহিষ্কার না করা হলে যুক্তরাষ্ট্র  বিপদের সম্মুখীন হবে। অন্যদের জন্য এটি কেবল অন্ধ বর্ণবাদ নয়, বরং সামাজিক অসন্তোষের কারণ হতে পারে। অন্যরা অভিবাসীদের নিজেদের দুর্বল মজুরি বা কাজের অভাবের জন্য দায়ী করেছে। বাধ্যতামূলক বিকল্প ব্যাখ্যা দিয়ে সেই শূন্যতা পূরণ করেছে ট্রাম্প। 

ডেমোক্র্যাটরা মুদ্রাস্ফীতির দিকে ইঙ্গিত করতে পারে,  যা ২০২২ সালের জুনে ৯.১%-এ পৌঁছেছিল।  এটি ইতিবাচক হিসাবে ২.৪%-এ হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে মূল্য ফিরে এসেছে। এর মানে হলো যে তারা আরও ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ই-তৃতীয়াংশ আমেরিকান বিশ্বাস করে যে দেশের অর্থনীতির অবস্থা খারাপ বা তেমন ভালো নয়। হ্যাঁ, প্রকৃত মজুরি সামগ্রিকভাবে বেড়েছে, কিন্তু কয়েক দশকের স্থবিরতার পরে এ রকম অপেক্ষাকৃত কম বৃদ্ধি অসন্তোষ বাড়িয়ে তোলে। 

ট্রাম্প অত্যন্ত ধনী ব্যক্তি যা কোনো বিষয় নয়। তবে তিনি তার কর্মীদের যথেষ্ট মূল্যায়ন করেছেন। কারণ ট্রাম্প ভেবেছিলেন যুক্তরাষ্ট্র ভালো অবস্থানে নেই। দেশটিতে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা দরকার। 
চারদিকে যুদ্ধ চলছে। ট্রাম্প সমর্থকরা চারপাশের যুদ্ধ দেখে ভাবছে বিশ্ব ভেঙে পড়ছে বলে মনে হচ্ছে এবং তাদের কিছু পরিবর্তন আনা দরকার। বাদামি বর্ণের একজন নারী ঈশ্বর, বন্দুক এবং ট্রাম্প খোদাই করে তার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। ইউক্রেনের যুদ্ধ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্ম দেবে। তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন রাশিয়া তার আগ্রাসন এড়াতে পারত 
যদি ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হন। বিভিন্ন কারণে ট্রাম্পের 
জয় এসেছে। 

রাশিয়া  ও ইউক্রেন যুদ্ধ দিন দিন অনেক বাড়ছে। ডেমোক্র্যাটিক দলের প্রশাসন নিরলসভাবে ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র পাঠিয়েছে, কারণ যা  গণহত্যার রূপ নিয়েছে, যা আমেরিকানরা ভালোভাবে নেয়নি। এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ট্রাম্প ফিলিস্তিনিদের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে তার ইচ্ছামতো কাজ করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে পিছিয়ে আসতে বলেছিলেন। কিন্তু বাইডেন প্রশাসন তা ভালোভাবে নেয়নি। বরং তিনি বিশ্বকে হিংসাত্মক বিশৃঙ্খলার মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে আমেরিকানরা যুদ্ধ চায় না। যার কারণেই ট্রাম্প বিজয়ের চূড়ায় পৌঁছেতে পারে। 

অন্যদিকে মিশিগানের ডিয়ারবোর্নে আমি মুসলিম আমেরিকানদের কাছ থেকে শুনেছি, যারা সব সময় ভোট দিতে চেয়েছে, যারা মুসলমানদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। সে ক্ষেত্রে ডেমোক্র্যাটরা বেশি রক্তাক্ত যুদ্ধ করে গণহত্যায় রূপ দিল। এ জন্য তারা কমলা হ্যারিসকে ভোট দিতে অস্বীকৃতি জানায়। কারণ ডেমোক্র্যাটরা রাষ্ট্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে সাহায্য করেছে। আবার কেউ কেউ ট্রাম্পের বক্তৃতার মাধ্যমে প্রলুব্ধ হয়েছিল। এ কারণেই ডেমোক্র্যাটদের ব্যর্থতার এসেছে। 

হ্যারিস দলগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্র যে নীতিতে চলছে সেভাবেই চলবে। কিন্তু মার্কিন জনগণ ভিন্ন কিছু চেয়েছিল। হ্যারিসের অর্থনৈতিক এজেন্ডাগুলো আমেরিকানদের বড় অংশজুড়ে মেনে নিতে পারেনি। তার অর্থনৈতিক কর্মসূচিতে যুক্তরাষ্ট্র আরও  ভেঙে পড়ত। আমেরিকানরা চেয়েছিল তাদের দেশ অর্থনৈতিকভাবে আরও প্রগাঢ় হোক।  আর যুদ্ধ নয়, নতুনভাবে দেশ এগিয়ে নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে ট্রাম্প অনেক আশার বাণী শোনাতে পেরেছেন, যার ফলে ট্রাম্পের বিজয় এসেছে। 

কমলা হ্যারিস গণতন্ত্রের সংরক্ষণ না করে বিভাজনে পরিণত করেছিলেন। কিছু ভোটারের জন্য আশার বাণী শোনালেও তার চিন্তার মধ্যে বিমূর্তভাব ছিল। আমেরিকানরা চেয়েছিল যে রাজনীতিবিদরা তাদের সব সমস্যার সমাধান করুক। এই অভিযোগগুলো সন্তুষ্ট করতে ব্যর্থ হলে যুক্তরাষ্ট্র এবং এর বাইরেও ব্যয়বহুল পরিণতি হবে, যা আমেরিকানরা বুঝতে দেরি করেনি। ডেমোক্র্যাটিক দলকে এ কারণেই অনেকে ভোট দেয়নি। ট্রাম্পের 
বিজয়ের পেছনে অনেক কারণ নিহিত ছিল। ট্রাম্পের বিজয় ছিল এক অবিস্মরণীয়, যা আমেরিকানরা মনেপ্রাণে চেয়েছিল।

লেখক: গার্ডিয়ানের কলামিস্ট
দ্য গার্ডিয়ান থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল

অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হলে শেষ আশাও হারিয়ে যাবে

প্রকাশ: ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৩৫ পিএম
অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হলে শেষ আশাও হারিয়ে যাবে
রায়হান আহমেদ তপাদার

দীর্ঘদিনের অপশাসন, দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ পাচার, স্বৈরতন্ত্র- এসব বিষয়ে মানুষ একেবারে ক্ষিপ্ত হয়ে ছাত্রদের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতা একটা বিজয় অর্জন করেছে। এখন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের দাবি- তারা অপশাসন, দুঃশাসন দূর করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে। বিচারব্যবস্থা ও নির্বাহী বিভাগসহ সব বিভাগ যেন রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকে। ব্যবসা-বাণিজ্যে যে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছিল বিগত সরকারের আমলে, তা ভেঙে যেন দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনে। একটা বৈষম্যহীন রাষ্ট্র তৈরির মাধ্যমে সব ক্ষেত্রে সংস্কার করে একটি কল্যাণকর রাষ্ট্রে পরিণত করে- এটাই সবার প্রত্যাশা।

 সম্প্রতি দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে নাগরিকদের প্রত্যাশা শীর্ষক জরিপের ফলাফল চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রকাশিত হয়েছে। এতে দেশের ৯৭ শতাংশ ভোটার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আস্থাশীল। এই সরকারের মেয়াদ তিন বছর বা তার বেশি হওয়া উচিত বলে মনে করেন ৪৭ শতাংশ ভোটার। আর ৫৩ শতাংশ মনে করেন, এই সরকারের মেয়াদ দুই বছর বা তার কম হওয়া উচিত। বেসরকারি নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (এনএসইউ) সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (এসআইপিজি) পরিচালিত এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। গত ৯-১৯ সেপ্টেম্বর দেশের আটটি বিভাগের ১৭টি জেলায় মোট ১ হাজার ৮৬৯ জনের ওপর জরিপটি করা হয়। উত্তরদাতাদের বৃহত্তম অংশ মধ্যবয়সী। ২২ শতাংশ জেনারেশন জেড। ১৪ শতাংশের বয়স ৫০ বছরের ওপরে। এ ছাড়া জরিপের উত্তরদাতাদের ৫৪ শতাংশ শহরাঞ্চলের। ৪৬ শতাংশ গ্রামাঞ্চলের। ফলাফলে দেখা গেছে, জরিপে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের ৭২ শতাংশ ছাত্রদের নেতৃত্বে রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে।
উত্তরদাতাদের ৯৬ শতাংশ প্রধানমন্ত্রী পদে এক ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি থাকতে পারবেন না- এমন বিধান করাকে সমর্থন করেন। ৪৬ শতাংশ মনে করেন, উল্লেখযোগ্য সাংবিধানিক পরিবর্তন প্রয়োজন। 

সংবিধানে ছোটখাটো সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন ৩৫ শতাংশ। আর ১৬ শতাংশ সম্পূর্ণ নতুন করে লেখা সংবিধানের পক্ষে মত দিয়েছেন। বাকি ৩ শতাংশ সংবিধানে পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই বলে মত দেন। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বর্তমান সরকারের প্রতি মানুষের ব্যাপক আস্থা ও আকাশচুম্বী প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে, যা এই জরিপেও উঠে এসেছে। এর বিপরীতে এই প্রত্যাশার ব্যবস্থাপনা করাটাই সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। আগেও দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু তার সুফল পাওয়া যায়নি। এর বড় কারণ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি।

 এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তন না হলে রাজনৈতিক দলগুলো যেসব অঙ্গীকার করে ক্ষমতায় গিয়ে সেসব বাস্তবায়ন না করলে সবই হবে পণ্ডশ্রম। রাজনৈতিক দলগুলোকেও গণতান্ত্রিক হতে হবে। সংস্কার কমিশনগুলো সুপারিশ দেওয়ার পর সরকার হয়তো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করবে। এরপর হয়তো একটি রোডম্যাপ ও নির্বাচনের তারিখ ঠিক করা হবে। এই সরকারের দুই মাস হয়ে যাচ্ছে। আর এখনই ‘আগেই তো ভালো ছিলাম’ রব উঠেছে। উঠবেই না কেন? আগের সরকার যে প্রশাসন রেখে গেছে, তা দিয়ে গাড়িকে চালানো সম্ভব নয়। আর আমাদের অন্তর্বর্তী সরকার সম্ভবত সিস্টেমের ভেতর থেকে সিস্টেম ভালো করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু ভালোবাসা দিয়ে এই দেশে কেউ কি খুব ভালো হয়েছে? সরকারি বিভিন্ন অধিদপ্তরের আগের অভিজ্ঞতায় বলা যায়, এই সরকারের প্রথম সমস্যা হচ্ছে উপদেষ্টাদের মধ্যে বিশাল জেনারেশন গ্যাপ। এই দলে ৬০ বছর বয়সীদের ঊর্ধ্বে যেমন অনেক, আবার ২৫ বছরের নিচের উপদেষ্টাও আছেন।

আসলে কাজ করে ৩৫ থেকে ৫০ বছরের মানুষ, যারা অভিজ্ঞদের সঙ্গে তারুণ্যকে সংযুক্ত করে। বিভিন্ন গবেষণায়ও জীবনের সবচেয়ে দক্ষতার জন্য এই সময়ের কথাই বলা হয়। একমাত্র বিডার চেয়ারম্যান বাদে কোনো জায়গায় এই বয়সী মানুষকে নেওয়া হয়নি। ফলে উপদেষ্টাদের বিশাল অভিজ্ঞতা কর্মে পরিণত করা যাচ্ছে না। বর্তমান সরকার টেকনোক্র্যাট সরকার। তাত্ত্বিক মতে, এই সরকারের আসল শক্তি ঠিক পজিশনে ঠিক মানুষকে নিয়োগ দেওয়া। এই সরকারে নেই কোনো প্রকৌশলী। মেগা প্রজেক্টগুলোয় কাজ করার অভিজ্ঞতায় জানি, কীভাবে সরকারি প্রকৌশলীরা ফাঁকি দেন। এই জিনিস অন্য কেউ ধরতে পারবে না। তেমনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ডাক্তার ছাড়া অন্য উপদেষ্টা দেওয়ায় এই খাত এখন অনেক অরাজক অবস্থায় আছে।

 দেশকে বাঁচিয়ে রাখে কৃষি। এই পরিষদে কোনো কৃষিবিদও নেই। ফলাফল ডিম, ইলিশ আমদানি-রপ্তানির জন্য আমরা আমলাদের তথ্যের ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। সরকার উপদেষ্টাদের অধীনে সর্বদলীয় কমিটি গঠন করতে পারে, যার কাজ হবে সংসদীয় কমিটির আদলে। তাহলে অনেক সিদ্ধান্ত মানুষের কাছে সহজে পৌঁছাবে। পরের বিষয়টি হচ্ছে অর্থনীতি। বিদেশি ঋণ আর সাহায্যে অর্থনীতিতে সুবাতাস দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এই ঋণকে কাজে লাগানোর মতো প্রশাসন কি সরকারের হাতে আছে? এই খাতে কাজ করা দেশে-বিদেশে কিছু চমৎকার মানুষ আছেন, যারা দেশের কর্মপরিকল্পনার স্ট্যান্ডার্ডই বদলে ফেলতে পারেন। 

এখন একটি বড় সমস্যা বেকারত্ব। বেকারত্ব কোনোভাবেই সরকার দূর করতে পারবে না। এমনকি মোটামুটি পর্যায়েও কমাতে পারবে না। এ অবস্থায় বেসরকারি খাত ছাড়া কীভাবে তারা বেকারত্ব কমানোর কথা ভাববে? সরকারের প্রশাসনব্যবস্থা তাদের বিপদে ফেলতে পারে, কিন্তু ব্যবসায়ীরা সব সময়ে যে সরকারই আসুক সহায়ক পরিবেশ চান। তাই তাদের আস্থায় আনা অনেক বেশি সহজ।

অবৈধ বিদেশি বিতাড়নের মাধ্যমে বেকারদের জন্য সাময়িক কিছু চাকরির সুবিধা দেওয়া যায়। তাদের পরীক্ষা পদ্ধতি সহজ-ব্যাংক ড্রাফটের মাধ্যমে অতিরিক্ত অর্থ আদায় কাগজের স্তূপ দিয়ে আবেদনপত্রের ঝামেলা কমাতে হবে। তাদের জন্য চেষ্টা হচ্ছে- এটি তাদের বোঝানোটা খুব জরুরি। এ ছাড়া বিদেশি ডেটা সেন্টারগুলোকে দেশে নিয়ে এলে ৫০ মিলিয়ন ডলার রক্ষা করা সম্ভব এবং দেশেই অনেক হাই প্রোফাইল কাজের সুযোগ তৈরি করা সম্ভব। এদিকে তরুণদের আউটসোর্সকে সহজলভ্য করতে পেওনেয়ারকে সহজলভ্য করতে হবে। দুদককে এই দুই মাসে খুব বেশি দেখা যায়নি। এখন তো তাদের সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকার কথা। দুর্নীতিবাজ ধরতে হলে বেসরকারি কোম্পানিতে যারা কাজ করছে, তাদের কাছে গেলেই সহজে খুঁজে পাওয়া যাবে। 

আবার আগের প্রশাসন, পুলিশ বা আর্মির অনেক লোক এখনো আগের অবস্থানে আছে। তাদের যদি তদন্তের আওতায় আনা না হয়, তাহলে কিছুই করতে পারবে না। সরকারের কোনো অনলাইন উপস্থিতি নেই বললেই চলে। ফলে আগের আমলের লুটেরারা এখন অনলাইনে অবস্থান নিয়ে সরকারের সব কাজকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে মানুষকে হতাশ করার চেষ্টা চলছে। আগের কালো আইনগুলো এখনো বর্তমান। সেগুলো বাতিল করে ভুক্তভোগীদের রক্ষা করা জরুরি। মানুষের প্রাণের দাবি ‘আন্তর্জাতিক নদী কনভেনশন’-এ এখনো স্বাক্ষর করা হয়নি। এভাবে চললে মানুষ কিছুদিনের মধ্যেই আশা হারাবে। তাদের এদিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এই আন্দোলনের শহিদ এবং আহতদের তালিকা করা। হতাহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া। তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। সেনাবাহিনী প্রধান ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন হওয়ার বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন। 

এখানে দুটি চাওয়া, দেশের মানুষ চায় সংস্কার করে নির্বাচন। সরকার যেভাবে শম্বুক গতিতে এবং নরমভাবে চলছে, তাতে এখনই মানুষ চিন্তায় পড়ে গেছে- এই সরকার সংস্কার করতে পারবে কি না। এত এত দাবি মানা সম্ভব নয় এবং সব দাবি মানা তাদের কাজও নয়। ভুয়া সমন্বয়ক বা অযৌক্তিক দাবিদারদের বিরুদ্ধে মানুষ কঠোরতা দেখতে চাচ্ছে। তাই যারা কাজ করতে চাচ্ছে না, তাদের বাদ দিয়ে প্রশাসন ঢেলে সাজানো যেতেই পারে। আশার কথা, বিএনপিসহ প্রধান দলগুলো সমর্থন দিয়েছে। তাদের মূল নেতাদের কথায় কিছুটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। যদিও তাদের প্রান্তিক নেতাদের এই উপলব্ধি এখনো আসেনি। যদি এই সরকার ব্যর্থ হয়, তাহলে বাংলাদেশের মানুষের শেষ আশাও হারিয়ে যাবে। আমরা তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি হয়ে দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করতে চাই। 

দেশ ও দশের কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে চাই। আমরা কখনো পরিচ্ছন্নতাকর্মী হয়ে রাস্তা, ড্রেন পরিষ্কার করতে এগিয়ে এসেছি, আবার কখনো ট্রাফিক পুলিশের রূপ নিয়ে রাস্তায় যানজট নিরসন করেছি। সুতরাং সমৃদ্ধ একটি দেশ গড়তে আমরা তরুণ প্রজন্ম অঙ্গীকারবদ্ধ। একজন দেশপ্রেমী সচেতন নাগরিক হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রত্যাশা, তিনি তার পরিষদ নিয়ে প্রথমে দেশকে একটি স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসবেন। এর পর সরকারি কার্যালয়সহ সব সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মপরিবেশ ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান সংস্কার করা, বিদেশের সব মিশনকে প্রবাসীদের আস্থা ও ভরসার জায়গায় নিয়ে আসা, বিমানবন্দরে ও বিমানকে রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য বিশেষ মর্যাদা দেওয়াসহ স্থানীয় সরকারের সব কার্যালয়, যেমন- সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন কার্যালয়কে গতিশীল করা।

এ জন্য এই সরকারকে যতদিন সময় প্রয়োজন তা তাদের দেওয়া এবং সব রাজনৈতিক দলকে এই সরকারকে সার্বিক সহযোগিতা করা উচিত। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও অন্যান্য উপদেষ্টার কাছে আমার প্রত্যাশা- চিকিৎসা খাতে এমনভাবে নজর দেওয়া হোক যেন দু-এক বছর পর বিদেশ থেকে মানুষ এই দেশে চিকিৎসা নিতে আসে। বাংলাদেশের চিকিৎসা খাতকে কেন্দ্র করে ভারত প্রতিবছর হাজার কোটি টাকা আয় করছে। এবার আমাদের দেশেই বিশ্বমানের চিকিৎসাব্যবস্থা চাই। সঙ্গে সঙ্গে এ সরকারের কাছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতিসহ সব জায়গায় নারীর সক্রিয় ও অবাধ অংশগ্রহণের জন্য সব প্রতিবন্ধকতা দূর করে নারীবান্ধব সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রত্যাশা করি। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান শহিদ শিক্ষার্থীরা যে পরিবর্তনের জন্য রক্ত দিয়েছেন সেটা যেন বৃথা না যায়। কেউ যেন ফ্যাসিস্ট হতে না পারে, ফ্যাসিস্ট হয়ে ক্ষমতায় থাকতে না পারে, তেমন ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। 

মানুষ পরিবর্তন চায়; ঘুষ-দুর্নীতির অভিশাপ থেকে মুক্তি চায়; সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও মাদকমুক্ত সমাজ চায়। আমরা দূষণমুক্ত পরিবেশ, ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন চাই। সর্বোপরি আমাদের তরুণ প্রজন্মের আত্মত্যাগ, রক্ত, চোখের জল যেন বৃথা না যায়, সেদিকে যেন সবার দৃষ্টি থাকে। মানুষের মধ্যে অনেক আস্থা ও আকাশচুম্বী প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। এই প্রত্যাশার অর্থ হলো সরকারের দায়িত্ব। মানুষ ভরসা করতে চায়। তাই অন্তর্বর্তী সরকার যেন দেশ ও 
দেশের মানুষের স্বপ্ন পূরণ করতে সচেষ্ট হন, এটাই সবার প্রত্যাশা।

লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক 
[email protected]