অ্যালবার্ট কামু লিখেছেন, আমি আমার মধ্যে একটি অদম্য গ্রীষ্ম দেখতে পেলাম। ঋতুর অন্ধকারে, আমরা ইসরায়েল, লেবানন বা গাজার সন্তানদের আশা খুঁজতে বলতে পারি না। বিশ্বে এমন কেউ কি নেই? যেখানে কোনো সম্ভাবনা নেই, সেখানে শান্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। বিশ্বের চারদিকে শুধু অশান্তি, সেখানে সান্ত্বনার বাণী খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
দুঃস্বপ্ন সব সময়ই থাকে। ৭ অক্টোবরের গণহত্যার ভয়াবহতা এবং জিম্মিদের অমানবিকভাবে জব্দ করার এক বছর অতিক্রম হলো। এই নিরলস বোমা হামলার পর ৪০ হাজারের বেশি জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে। যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। যুদ্ধবিরতি এখনো অনেক দূরে বলে মনে হচ্ছে। তবু ধ্বংসস্তূপ এবং ছিন্নভিন্ন অবস্থার মধ্যেও শান্তির স্বপ্ন দেখতে হয়। এর মধ্যেই আমাদের শান্তির আশার লক্ষণগুলো খুঁজে বের করতে হবে।
দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের বিশদ পরিকল্পনা ধূলিকণায় পরিণত হচ্ছে। এটি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য শুধু কথায় নয়, কাজে বিশ্বব্যাপী সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির জন্য আমাদের প্রচেষ্টা বাড়াতে হবে এবং জিম্মিদের মুক্তির জন্য চাপ জোরদার করতে হবে। আজ যখন হৃদয় ভেঙে গেছে, আমাদের প্রতিশ্রুতি যে, পুনর্গঠনে সমর্থন করার জন্য আমাদের শক্তিতে যা কিছু করব, তা অবশ্যই অটুট হতে হবে।
আমরা তীরে প্রহরীদের অনুরূপ বোধ করতে পারি। কিন্তু আমাদেরও এমন একটি সময়ের কথা ভাবতে হবে, যখন অস্ত্রগুলো নীরব হয়ে যায়। তাই যাদের দুঃখ-কষ্ট ছাড়া আর কিছুই নেই, তাদের প্রয়োজনীয় সমর্থনের জন্য পরিকল্পনা করা এবং প্রস্তুত করতে আমাদের মোটেও দেরি করা উচিত নয়। গাজার ১ মিলিয়ন শিশুর জন্য ভালো কিছু নেই।
জি-২০-এর নেতৃত্বে যা প্রধান অর্থনীতির দেশগুলোর সমন্বয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ঘোষণা করা উচিত যে, এই শিশুদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যত্ন এবং অপরিহার্য মানসিক স্বাস্থ্য-সহায়তার কর্মসূচিতে অর্থায়ন করবে। যারা সংঘাতের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছে, এখনো যাদের বাড়ি ধ্বংসপ্রাপ্ত, জীবিকা নির্বাহের প্রান্তে বসবাস করছে তাদেরও সহযোগিতা করা জরুরি। যে স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে এবং সংকটের পরে তা পুনরায় খোলা দরকার। শুধু তাই নয়, প্রতিটি পুনর্গঠন কর্মসূচিতে যা উপেক্ষিত হয়েছে তা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এগিয়ে নিতে হবে।
আমরা জানি, একটি শিশুর জীবনের প্রথম ৪৮ মাস মস্তিষ্কের বিকাশের ক্ষেত্রে পরবর্তী ৪৮ বছর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের অনেক জায়গায় প্রাথমিক শিক্ষাকে বিলাসিতা হিসেবে নয়, বরং একটি অধিকার হিসেবে দেখা হয়, যা প্রতিটি শিশুর উপভোগ করা উচিত। কিন্তু শৈশবের বিকাশ বিভিন্নভাবে হয়ে থাকে। সুস্বাস্থ্য হতে হবে এবং খেলাসহ বিভিন্ন মাধ্যমে শিশুরা জ্ঞান অর্জন করবে। বিশ্বের সবচেয়ে কম বয়সী ছেলেমেয়েদের চাহিদার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, এমন কোনো একক সংস্থা নেই। যদি আমরা কিছুই না করি, তাহলে মানসিক আঘাতে ভুগছে, এমন শিশুরা ভবিষ্যতে হতাশায় পড়বে।
পুনর্গঠনে প্রস্তাবিত পরিকল্পনার সঙ্গে আমাদের কাছে সেই পার্থক্য দেখানোর সুযোগ রয়েছে, যা প্রাথমিক বছরগুলোতে বিনিয়োগ করতে পারে। বর্তমানে গাজার ১.৯ মিলিয়ন বাস্তুচ্যুত জনসংখ্যার অর্ধেকই শিশু। নবজাতক, শিশু, বাচ্চা, গর্ভবতী এবং বুকের দুধ খাওয়ানো নারীদের জন্য অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ও মৃত্যু অপেক্ষা করছে। প্রকৃতপক্ষে গাজায় এখন সব কিছুরই অভাব। প্রতি ৮৫০ জন মানুষের জন্য একটি টয়লেট রয়েছে। ৮৫ শতাংশ অভিভাবক রিপোর্ট করেছেন যে, তাদের বাচ্চারা অনেক সময় পুরোদিন না খেয়েই দিন কাটায়। এখন পাঁচ বছরের কম বয়সী ৩ লাখ ৫৬ হাজার শিশুর সম্পূরক খাবার এবং পুষ্টির প্রয়োজন। কমপক্ষে ৫০ হাজার লোক তীব্রভাবে অপুষ্টিতে ভুগছে।
গাজার ৪০ শতাংশেও বেশি পরিবার তাদের নিজের সন্তান নয়, এমন শিশুদের যত্ন নিচ্ছে।
সব মিলিয়ে ২০ হাজার শিশু এতিম হয়েছে, যারা তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। কিছু শিবিরে প্রতি ১০ শিশুর মধ্যে ছয়টি শিশুর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এবং পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতাজনিত সমস্যা দেখা দিচ্ছে। যুদ্ধে আঘাত এবং অঙ্গবিচ্ছেদের শিকার হয়েছে এমন অনেকের শুধু জরুরি চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচারের সেবাই নয়, মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং তাদের ট্রমা মোকাবিলার জন্য বিশেষভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের যত্নকেন্দ্র, যত্নদাতা, শিক্ষক, মনোবিজ্ঞানী এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থার প্রয়োজন।
আমরা ইউক্রেন, বাংলাদেশ, লেবানন এবং এর বাইরের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে পারি- কীভাবে জরুরি পরিস্থিতিতে প্রাথমিক বছরগুলোতে কোন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা যায়। বিশ্বের সবচেয়ে বড় কর্মসূচিগুলো থেকে অনেক কিছু শেখা যাবে, যা আমি আমার সরকারের সময় সমর্থন করেছিলাম। যেমন: ব্রিটেনে ‘শিওর স্টার্ট’ প্রোগ্রাম।
এই উদ্যোগটিকে কার্যকরের জন্য সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। যারা এই প্রোগ্রামে প্রথম প্রবেশকারী ছিল, চূড়ান্ত পরীক্ষা শেষে তাদের ফল পর্যালোচনা করা হয়। শিশুদের বিশ্লেষণ করে বোঝা যায়, পাঠ্যক্রমজুড়েই তাদের কর্মক্ষমতার তিনটি গ্রেড বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে যেসব শিশু ‘শিওর স্টার্ট’ সেন্টারের কাছে বসবাস করত তাদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার এবং মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম ছিল এবং কিশোরদের অপরাধের হারও কম ছিল। ব্রিটেনে মানসম্পন্ন প্রাথমিক শৈশব যত্ন এবং শিক্ষার অধিকারী শিশুরা চার গুণ বেশি মেধাবী হয়, যা অন্যান্য দেশে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেই শিক্ষা ও মেধার বিকাশ হয় না। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করার জন্য ব্রিটেন সবচেয়ে বেশি পছন্দের। সংঘাত থেকে পুনরুদ্ধার করা অঞ্চলে আরও বেশি কার্যকর ফল পাওয়া যেতে পারে।
পরবর্তী পদক্ষেপ হলো ফিলিস্তিনি জনগণের কণ্ঠস্বর শোনা। আমি জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসকে রিপোর্ট করেছি। আমাদের আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর একটি জোট তৈরি করতে হবে- যার মধ্যে থাকবে ইউনিসেফ, ওসিএইচএ, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউএনআরডব্লিউএ।
আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং এনজিওগুলোর সঙ্গে কাজ করে এবং স্থানীয় অংশীদারদের সঙ্গে সমন্বয় করে আমরা গাজার জন্য ব্রিটেনের ‘শিওর স্টার্ট’ প্রোগ্রামের সমতুল্য তৈরি করতে পারি। বর্তমানে গাজায় শিশুদের শিক্ষার জন্য নিরাপদ বলে বিবেচিত কোনো স্থান নেই। ১১ হাজার শিশু এবং ৪১১ শিক্ষক শুধু নিহত নয়, আনুমানিক ১৫ হাজার ৩৯৪ ছাত্র এবং ২ হাজার ৪১১ শিক্ষক আহত হয়েছেন। প্রায় সব স্কুল এবং অনেক কিন্ডারগার্টেন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে। জুলাই মাসে ‘গ্লোবাল এডুকেশন ক্লাস্টার’-এর ধারণ করা স্যাটেলাইট চিত্রগুলো প্রকাশ করেছে যে, ৯৩ শতাংশ স্কুলের বেশির ভাগই ক্ষতি হয়েছে এবং ৮৫ শতাংশ পুনর্গঠন করা খুবই দরকার।
ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজ এবং ‘সেন্টার ফর লেবানিজ স্টাডিজ’ শিক্ষাবিদদের একটি নতুন প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রথমে করোনা মহামারি এবং এখন যুদ্ধের কারণে গাজার ছাত্ররা প্রায় দুই বছরের পড়ালেখা হারিয়েছে। সেখানে ১০ থেকে ২০ বছর বয়সীরা মৌলিক পাঠ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এতে শিশুদের শিক্ষাবঞ্চিতের অনুপাত বৃদ্ধি পেয়েছে। পুনর্গঠন শুরু হওয়ার আগে গাজাজুড়ে অস্থায়ী শিশু কেন্দ্রগুলো নিরাপদ স্থান হিসেবে তৈরি করা উচিত, যেখানে শিশু এবং গর্ভবতী মায়েদের পুষ্টি, মানসিক সহায়তা, যত্ন এবং প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া হয়। শিক্ষাগত সুবিধার কোনোটিতে আবার কোনো সামরিক ঘাঁটি হোস্ট করার অনুমতি দেওয়া যাবে না।
তহবিল একটি সমস্যা হবে। মানবিক আবেদনে সামগ্রিকভাবে শিক্ষাকে কখনোই অগ্রাধিকার দেওয়া হয় না। ৩.৪২ বিলিয়ন ডলারের সহযোগিতা বিভিন্ন খাতে করা হচ্ছে, যেমন- খাদ্য, স্বাস্থ্য এবং আশ্রয়। এই তহবিলের মাত্র ৩.৫ শতাংশ শিক্ষায় বরাদ্দ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে দ্বিপক্ষীয় সহায়তার অনুপস্থিতিতে শিক্ষা থেমে থাকতে পারে না। দাতব্য সংস্থা ‘আই চেয়ার’, যা বাস্তুচ্যুত এবং উদ্বাস্তু শিশুদের শিক্ষা পেতে সহায়তা করে। এই সংস্থাটি তৃতীয় বৃহত্তম দাতা হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। তবুও শিশুদের জন্য বিশ্বব্যাপী যথেষ্ট উদ্বেগ রয়েছে। শিশুদের কল্যাণার্থে প্রয়োজনীয় নগদ অর্থ সংগ্রহ করা যেতে পারে।
‘ইন দ্য মিডস্ট অব ইন্ডিয়া’য় অ্যালবার্ট কামু লিখেছেন, আমি আমার মধ্যে একটি অদম্য গ্রীষ্ম দেখতে পেলাম। ঋতুর অন্ধকারে, আমরা ইসরায়েল, লেবানন বা গাজার সন্তানদের আশা খুঁজতে বলতে পারি না। বিশ্বে এমন কেউ কি নেই? যেখানে কোনো সম্ভাবনা নেই, সেখানে শান্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। বিশ্বের চারদিকে শুধু অশান্তি, সেখানে সান্ত্বনার বাণী খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
এখন পরিবর্তনের দায়িত্ব আমাদের ওপর পড়ে, যাতে আমরা বিশ্বের সবচেয়ে শোচনীয় শিশুদের জন্য একটি শান্তিপূর্ণ আগামী দিতে পারি। এই অন্ধকার সময়ে আমাদের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে হবে। আরও সুরক্ষিত ভবিষ্যতের জন্য এবং শান্তির বন্দোবস্তে আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে।
লেখক: যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী
দ্য গার্ডিয়ান থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল