সম্প্রতি আমরা দেখেছি, অন্তর্বর্তী সরকার মুরগি ও ডিমের দাম নির্ধারণের চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি। পূর্ববর্তী সরকারও অনুরূপ চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কোনো সফলতা পায়নি। কেন এই ধরনের প্রচেষ্টা বারবার ব্যর্থ হচ্ছে?
যদি কেউ এই নিয়ন্ত্রিত মূল্যের ওপর ভিত্তি করে ভোক্তাদের চাহিদার প্রতি সাড়া দেয়, বিশেষ করে ভোক্তাদের কল্যাণ্যের কথা চিন্তা করে, তাহলে এটি তেমন কোনো কাজে আসবে না। সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের, অর্থাৎ সরকারকে সরবরাহ ধাপগুলোর বাস্তবতা সম্পর্কে বাস্তব বোঝাপড়া থাকতে হবে, তাত্ত্বিকভাবে বুঝলে হবে না। তাদের বুঝতে হবে কোথাও ব্লক আছে কিনা এবং সেই ব্লকগুলো কাটিয়ে ওঠা যাবে কিনা। যেমন- এমন কোনো গোষ্ঠী আছে কিনা, যারা বাজারের দামের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।
বহু বছর ধরে সিন্ডিকেট একটি বহুল ব্যবহৃত শব্দ। সিন্ডিকেট আছে, এটিই বাস্তবতা। আর বাজার নিয়ন্ত্রণের সমন্বিত একটি গ্রুপ, যারা সরবরাহের চেইন নিয়ন্ত্রণ করে। তারা সেই জায়গা থেকে নীতিনির্ধারকদের প্রভাবিত করতে পারে। ক্ষমতাচ্যুতের শাসনামলে আমরা সেটাই দেখেছি।
হাসিনা সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী যখন বলেছিলেন, তিনি বেশি কিছু করতে পারবেন না, তখন তার মানে বুঝে নিতে হবে যে, তিনি সিন্ডিকেটের একটা অংশ। তাই তিনি বেশি কিছু করতে পারেননি।
এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। আমাদের বুঝতে হবে, সিন্ডিকেট এখনো সরবরাহে কতটা প্রভাব ফেলছে। তারা এত সহজেই অদৃশ্য হওয়ার সম্ভাবনা নেই। যদিও বর্তমান নীতিনির্ধারকদের তাদের সঙ্গে কোনো যোগসূত্র নেই। তবে তাদের অবশ্যই সরবরাহ চেইন ব্যবস্থাপনাকে বোঝা ও প্রভাবিত করার ক্ষেত্রগুলো বুঝতে হবে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করতে হবে। যদি তারা সরবরাহ চেইনকে প্রভাবিত করতে পারে বা এমন কোনো পরিবর্তনশীল দ্রব্যের ওপর কাজ করতে চায়, তাহলে সেদিকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।
অরাজনৈতিক হলেও সরকার এই বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। তাদের বুঝতে হবে, এই প্রভাবটা কি নীতি প্রক্রিয়ায় আছে নাকি তা শুধু আমলাতান্ত্রিক ব্যাপার। নীতিনির্ধারকরা কি আমলাদের ওপরে? তাদের কি বোঝার কোনো বিষয় আছে? সরবরাহ চেইন ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রে বাস্তবতা বোঝার জন্য বর্তমান সরকারের খুব বেশি প্রচেষ্টা আমি দেখিনি। তাদের নিজেদেরই উত্তর খুঁজে বের করতে হবে। আমি এই মুহূর্তে সরবরাহের ধাপগুলোর বাস্তবতা সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত নই। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও তেমন কাজ হচ্ছে না।
অন্যান্য ব্যবস্থা থাকতে পারে। যখন ব্যবসায়ীরা স্টোরেজে সরবরাহ রাখে, তখন তারা এই ধরনের ব্যবসার জন্য ব্যাংক ক্রেডিটের ওপর নির্ভর করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ব্যাংক ক্রেডিট ঋণ নেওয়ার সুযোগ থাকে। ধরুন, আমি একজন সরবরাহকারী এবং আমি ১ কোটি টাকা ব্যাংক লোন নিয়েছি, আমি সরবরাহগুলো স্টোরেজে রাখছি এবং বাজারে ছাড়ছি না।
এভাবে রাখলে আমার ঋণ ৯০ দিনের মধ্যে ম্যাচিউরড বা পরিপক্ব হবে। এখানে নীতিনির্ধারকরা ঋণের মেয়াদ ৩০ দিনে পরিবর্তন করে পরিপক্ব করতে পারেন। তখন মাল বিক্রি করা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় থাকে না। এই ধরনের হস্তক্ষেপের জন্য মাল সরবরাহ চেইন প্রক্রিয়া এবং বর্তমান বাস্তবতা বোঝা দরকার। সরবরাহের প্রকৃত অভাবের কারণে কি দাম বেশি হচ্ছে? সরবরাহ কোথাও কি আটকে রাখা হয়েছে এবং তা ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে না বলেই কি দাম এত বেশি?
উৎপাদনকারীরা যদি বলে যে, তাদের উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় তাদের বেশি দাম নেওয়া দরকার, তাহলে প্রশ্ন হওয়া উচিত কীভাবে উৎপাদন খরচ কমানো যায়।
এ ছাড়া সরকার সর্বদা খোলা বাজার বিক্রয় (ওএমএস) এবং অন্যান্য সরঞ্জামের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তারা ওএমএস নীতিকে আরও বড় আকারে প্রসারিত করতে পারে, যা সরবরাহকারীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে যারা সরবরাহ আটকে রাখছে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে। অবশ্যই, এটি সরকারের আর্থিক সক্ষমতা আছে কিনা তার ওপর নির্ভর করে।
আরেকটি উপায় হলো- উৎপাদক, বীজ উৎপাদক, ব্যবসায়ী, রপ্তানিকারক বা পশুখাদ্য বা বিভিন্ন ধরনের কৃষি উপকরণের আমদানিকারকদের প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে। সরকার পুরো প্রণোদনা ব্যবস্থার দিকে নজর রাখতে পারে এবং সৃজনশীলভাবে তাদের উৎসাহিত করার চেষ্টা করতে পারে, যারা সরবরাহ চেইন উন্নত করতে পারে। তাহলে দাম আরও যুক্তিসঙ্গত হবে বলে আশা করি।
তিনটি ক্ষেত্রে সরকারের নজর দেওয়া উচিত: ১) উৎপাদক ও আমদানিকারকদের জন্য প্রণোদনা এবং কীভাবে উৎপাদন বাড়ানো যায় তা দেখা, ২) সরবরাহ নীতির শাসন, যেখানে ঋণের পরিপক্বতার মতো আর্থিক উপকরণগুলো নিয়ন্ত্রণের সরঞ্জাম হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে এবং ৩) শাসন-সংক্রান্ত সমস্যা, যেমন চাঁদাবাজিতে বাধা। পরিচিত চাঁদাবাজ এখন আশপাশে নাও থাকতে পারে, তবে কি নতুন চাঁদাবাজ আছে? আমরা কি তাদের কোনো উপায়ে ধরতে পারি?
এর মধ্যে কিছু সিন্ডিকেট বা যারা উচ্চমূল্যের জন্য দায়ী তারা প্রায়ই পাল্টা যুক্তি দিয়ে থাকে। তারা বলে, এটা হলো বাজারের একটি প্রক্রিয়া। তারা দাম বেশি রাখে এবং তাদের নিজের স্বার্থে বাজারের এই প্রক্রিয়াগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। তবে সরকারের উচিত সাধারণ মানুষের স্বার্থে বাজার প্রক্রিয়া পরিচালনা করা। এটি করার জন্য সরকারের সব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রয়েছে। এটি কেবল আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর ওপর নির্ভর করতে পারে না, মাঠেও যেতে পারে।
আমরা আমলাতান্ত্রিক সমাধান খুব পছন্দ করি। বাজার মনিটরিং প্রক্রিয়া মানে যদি আরেকটি কমিটি নিয়োগ করা হয়, তা হলে আমি সে বিষয়ে সন্দিহান। মনিটরিং একটি গতিশীল কার্যকলাপ এবং কয়েকটি পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়া ইতোমধ্যেই বিদ্যমান আছে। যেমন- বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) নিয়মিতভাবে ভোক্তা মূল্য সূচক তৈরি করার কথা। বিবিএসকে এই বিশেষ কাজের জন্য তাদের ক্ষমতা প্রদান করা এবং সময়োপযোগী তথ্য সংগ্রহ করার অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে।
এছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন, যার কিছু বাজার পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব রয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক, এসব প্রতিষ্ঠান সবই পাঠ্যপুস্তকে আবদ্ধ এবং আমলাতান্ত্রিক একঘেঁয়েমি রয়েছে। তারা শুধু শাস্তির দিকে নজর দেয় কিন্তু কার্যকর করে না। আমলারা শাস্তি খুব পছন্দ করে। তারা বাজারে যায় এবং নিয়ম ভঙ্গকারীদের শাস্তি দেয়। যদিও শাস্তি কখনো কখনো কাজ করে।
বাজার পর্যবেক্ষণের জন্য হালনাগাদ ও ব্যবহারযোগ্য ডেটা প্রয়োজন, যা নীতি প্রক্রিয়ায় একাধিক ব্যবহারকারীর কাজে লাগে। এ ছাড়া কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের মতো সুশীল সমাজের সংস্থাগুলোকেও বড় ভূমিকা পালনে সক্রিয় করা যেতে পারে। এই সরকারের নতুন কিছু করার সুযোগ রয়েছে। তারা মাঠে যেতে পারে এবং বাজার নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে।
এটি হচ্ছে সরবরাহের মূল বাস্তবতা। যেমন- কী ধরনের মূল্য সংযোজন ঘটছে? ধানের দামে লক্ষ করা যায়, সাধারণত ফসল কাটার পরে তা কমে যায়। কয়েক বছর ধরে, এটি হচ্ছে না। এই পুরো প্রক্রিয়ায় রাইস মিল মালিকরা জড়িত। ২০০৮ সালে তৎকালীন বাণিজ্য উপদেষ্টা হিসেবে আমি নওগাঁ গিয়েছিলাম এই বিষয়ে একটি প্রথম ধারণা পেতে। কারণ, নওগাঁ বাংলাদেশের মিলের রাজধানী।
মিল মালিকরা বাজার তাদের দখলে রাখার জন্য বড় বিনিয়োগ করেন এবং তারা এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু তারা কি সিন্ডিকেট? বাজার থেকে একটি পণ্য আটকে রাখা বা না রাখার ক্ষমতা তাদের কতটুকু? চাল সরবরাহের ক্ষেত্রে সরকারি ক্রয়প্রক্রিয়া খুবই রাজনৈতিক। তবে প্রকৃত কৃষকরা এতে কোনো উপকার পান না।
তাহলে কি দাম ধীরে ধীরে নিচের দিকে যাবে না? অনেক ক্ষেত্রে তা হয় না। আমাদের এটাকে পরীক্ষামূলকভাবে দেখতে হবে। আমরা অনুমান করতে পারি না যে, এটি হয় না। ঢাকার ভোক্তারা সব ক্ষেত্রেই মধ্যস্বত্বভোগীদের ভিলেন বলে মনে করে। আমরা বিপণন প্রক্রিয়ার ওপর PPRC থেকে ২০০৬ সালে একটি গবেষণা পরিচালনা করেছিলাম।
আমরা দেখেছি, ফড়িয়া- যারা বাইরে গিয়ে কৃষক বা সরাসরি বাজার থেকে পরবর্তী বাজার পর্যায়ে স্থানান্তরিত করার জন্য পণ্য সংগ্রহ করেন, তারাও চরম দরিদ্র গোষ্ঠীর অংশ। তাদের প্রায়ই আর্থিক অবস্থা ভালো থাকে না। কৃষি ব্যবসা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসা, বিশেষ করে যারা সেখানে পুঁজি বিনিয়োগ করে। যদিও কিছু মধ্যস্বত্বভোগী ভিলেন হয়ে যায়, তবে আমরা সবাইকে এক কাতারে গণ্য করতে পারি না। মধ্যস্বত্বভোগী ছাড়া ফসল মাঠ থেকে আপনার টেবিলে যাবে না। এখানে পণ্য সরবরাহের একাধিক স্তর রয়েছে। মানুষ এই প্রক্রিয়ার বিভিন্ন স্তর থেকে লাভবান হয়ে থাকে।
লেখক: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ও নির্বাহী চেয়ারম্যান, পিপিআরসি