কেন রাজনীতি ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন তানজিম আহমদ সোহেল তাজ? কেন ছেড়েছিলেন মন্ত্রিত্ব। বাংলাদেশের প্রথম
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের একমাত্র পুত্র সোহেল তাজ খবরের কাগজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সে কথাই বলেছেন। ইতিহাসের অজানা কিছু অধ্যায় নিয়েও আলোচনা করেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের গত সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামল নিয়ে খোলামেলা মন্তব্য করেছেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজ। তার মতে, আওয়ামী লীগের শাসনামলে অনেক ইতিহাস আড়াল করার পাশাপাশি
বিকৃতও করা হয়েছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খবরের কাগজের সিটি এডিটর আবদুল্লাহ আল মামুন।
আওয়ামী লীগে গণতন্ত্র নেই এটার প্রমাণ পেয়েছি আমার মাকে দিয়ে। আমার মা, তিনি সারা জীবন নীতি-আদর্শ নিয়ে কাজ করেছেন এবং আমি দেখেছি আমার মা যখন কথা বলতেন দলীয় প্ল্যাটফর্মে, তিনি কীভাবে নিগৃহীত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের ভেতরে কয়েকটা ব্লক ছিল। সিনিয়র নেতা যারা ছিলেন, দেখা গেল যাদের ভয়েস ছিল, সেই ভয়েসগুলো আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে গেল। সেই ভয়েসগুলো আস্তে আস্তে নীরব হয়ে গেল। একচ্ছত্র একটা ক্ষমতার বেজ তৈরি করা হলো। দেখা গেল এই ক্ষমতা কুক্ষিগত করা হলো একটি পরিবারের মাধ্যমে। ওই পরিবারের সদস্যরাই আওয়ামী লীগের সব গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করল। আজকে যে পরিস্থিতি হয়েছে, এটার জন্য আমি দায়ী করছি পরিবারতন্ত্র কায়েম করা। যারা সুবিধাভোগী, তেলবাজ, দলবাজ, যাদের আমরা বলি হাইব্রিড, এরা দলটিকে সম্পূর্ণভাবে দখল করে নিয়েছিল। বাংলাদেশকে একটি ব্যুফে টেবিলের মতো ট্রিট করা হয়েছে। এখানে খাই খাই, সবাই খাই, যারা ক্ষমতায় আছে।...
খবরের কাগজ: কেন রাজনীতি ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন? আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন, না দেশ ছেড়েছেন- আপনি কোনটা মনে করেন?
সোহেল তাজ: জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে। আমি সেই মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলাম। আমারও খুব বড় স্বপ্ন ছিল দিনবদলের। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে আমরা পরিবর্তন করব। গতানুগতিক রাজনীতি থেকে সরে আসব, প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে সরে আসব। কিন্তু দুঃখ হচ্ছে এখানেই, আমরা সে ওয়াদা রাখিনি। জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। আমরা প্রতিহিংসা রাজনীতিতে মেতে উঠেছিলাম।
খবরের কাগজ: এটা কে করেছিল, আওয়ামী লীগের ভেতর থেকে কোন পর্যায়ে একটু যদি পরিষ্কার করে বলতেন?
সোহেল তাজ: আপনি জানেন কি না, এখানে (আওয়ামী লীগ) তো কোনো গণতন্ত্র নেই। গণতন্ত্র শেষ হয়ে গেছে ৯০ দশকে। ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে দলটিকে আমার মা (জোহরা তাজউদ্দীন) পুনজ্জীবিত করেছিলেন। আপনি আমাকে বলেন, গত ২০ বছরে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক প্রসেসটা কি কাজ করেছে? আওয়ামী লীগের যেসব ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য, তারা তো বাসায় শোকেসের সাজানো জিনিস।
খবরের কাগজ: এই যে আওয়ামী লীগে গণতন্ত্র নেই, এটা আপনি কখন বুঝেছেন?
সোহেল তাজ: আওয়ামী লীগে গণতন্ত্র নেই এটার প্রমাণ পেয়েছি আমার মাকে দিয়ে। আমার মা, তিনি সারা জীবন নীতি-আদর্শ নিয়ে কাজ করেছেন এবং আমি দেখেছি আমার মা যখন কথা বলতেন দলীয় প্ল্যাটফর্মে, তিনি কীভাবে নিগৃহীত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের ভেতরে কয়েকটা ব্লক ছিল। সিনিয়র নেতা যারা ছিলেন, দেখা গেল যাদের ভয়েস ছিল, সেই ভয়েসগুলো আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে গেল। সেই ভয়েসগুলো আস্তে আস্তে নীরব হয়ে গেল।
একচ্ছত্র একটা ক্ষমতার বেজ তৈরি করা হলো। দেখা গেল এই ক্ষমতা কুক্ষিগত করা হলো একটি পরিবারের মাধ্যমে। ওই পরিবারের সদস্যরাই আওয়ামী লীগের সব গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করল। আজকে যে পরিস্থিতি হয়েছে, এটার জন্য আমি দায়ী করছি পরিবারতন্ত্র কায়েম করা। যারা সুবিধাভোগী, তেলবাজ, দলবাজ, যাদের আমরা বলি হাইব্রিড, এরা দলটিকে সম্পূর্ণভাবে দখল করে নিয়েছিল। বাংলাদেশকে একটি ব্যুফে টেবিলের মতো ট্রিট করা হয়েছে। এখানে খাই খাই, সবাই খাই, যারা ক্ষমতায় আছে।
খবরের কাগজ: হাইব্রিডরা দখল করে নিয়েছিল। এটা যে দলের প্রধান শেখ হাসিনা কি বুঝতেন না? না কি তার প্রচ্ছন্ন বা সরাসরি কোনো ভূমিকা আছে?
সোহেল তাজ: আমি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আমাদের দলীয় নেত্রীকে শ্রদ্ধা করতাম। কারণ ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল, আমার সুযোগ হয়েছিল বিরোধীদলীয় রাজনীতি করার এবং তার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাছাকাছি এসে কাজ করার। কিন্তু আমি যখন দেশে আসি আমার সামনে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছিল।
খবরের কাগজ: এটা কারা করেছিল?
সোহেল তাজ: এটা করেছিল দলের একেবারে উচ্চ মহল থেকে।
খবরের কাগজ: উচ্চ মহল বলতে কাদের বোঝাচ্ছেন? একটু পরিষ্কার করে যদি বলতেন।
সোহেল তাজ: ১৯৭৪ সালে আমার বাবা তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভা থেকে বাধ্য হয়েছিলেন পদত্যাগ করতে। সেই সময় কাপাসিয়ায় যেসব নেতা ছিলেন, যারা তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছিলেন। সেই গোষ্ঠীকে আবার সক্রিয় করা হয়েছিল আমার বিরুদ্ধে। আমি যেই ‘লিগ্যাসি ক্যারি’ করছি, এই লিগ্যাসির একটা ইতিহাস আছে। সেটা চলে আসছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে। এটা টানলে চলে আসবে মুক্তিবাহিনী এবং মুজিব বাহিনী। এটা টানলে চলে আসবে ১৯৭১ সালে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা।
খবরের কাগজ: আপনি মনে করেন কি না, বিরোধিতার যে ধারাবাহিকতা, সেটা কি আপনার ক্ষেত্রে ওই পরিবারের পক্ষ থেকে হয়েছিল?
সোহেল তাজ: আমি বিশ্বাস করতে চাইনি, আমি সব সময় মনে করতাম, বিশ্বাস করতাম এটা ভুল-বোঝাবুঝি। হয়তো আমি এই বিভেদকে নিরসন করতে পারব। কিন্তু একটা পর্যায়ে দেখলাম এই বিরোধটা অনেক গভীরে।
১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করল বাংলার বুকে। আমার বাবা গিয়েছিলেন ৩২ নম্বরে। বঙ্গবন্ধুর কাছে এবং পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তার একটা ঘোষণা দেওয়ার কথা ছিল স্বাধীনতার। আমার বাবা সেই কাগজটিতে স্বাক্ষর করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে বারবার অনুরোধ করেছিলেন। একপর্যায়ে তিনি সেটা না করাতে আমার বাবা বাসায় চলে আসেন। আমার মায়ের মুখ থেকে শুনেছি, আমার বাবা খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন এবং তিনি খুব হতাশ হয়েছিলেন। বাসায় এসে সব ফাইলটাইল ছুড়ে বলেছিলেন এই ২৩ বছরের আন্দোলন বৃথায় গেল, সবকিছু নষ্ট হয়ে গেল। আমরা দেখেছি যে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে গেলেন। বিষয়টি খুব মজার, তাজউদ্দীন আহমদ যখন সিদ্ধান্ত নিলেন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে সরকার গঠন করে যুদ্ধটা পরিচালনা করা অতি গুরুত্বপূর্ণ। তখন আমরা দেখেছি একটি গোষ্ঠী বিরোধিতা করেছিল।
খবরের কাগজ: এই গোষ্ঠীটি বলতে কে কে ছিল? যদি একটু স্পষ্ট করে বলতেন।
সোহেল তাজ: এখানে শেখ মনির নেতৃত্বে ছাত্র নেতারা ছিলেন এবং আমরা যতটা জানি তারা একটা গোয়েন্দা সংস্থার ছত্রছায়ায় অ্যাক্টিভিটিসগুলো করেছিলেন। আমরা জানি মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী। কিন্তু মুজিব বাহিনীকে ট্রেনিং দিয়েছিল ‘র’ (ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা)। আমরা জানি ৯ মাসের ইতিহাসে মুজিব বাহিনী এবং মুক্তি বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল বেশ কয়েকবার। এটা কেন? এটা একটা প্রশ্ন। আমার প্রত্যাশা ইতিহাসবিদরা এটাকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করবেন এবং সঠিক ইতিহাস আমাদের জানতে হবে। কার কী ভূমিকা ছিল? আমার বাবা মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত দুঃখ করে বলেছিলেন- মুজিব ভাই একবারও জানতে চাইলেন না কীভাবে আমি যুদ্ধটা (মুক্তিযুদ্ধ) পরিচালনা করলাম!
খবরের কাগজ: বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ রাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তাটি চট্টগ্রামের স্থানীয় আওয়ামী লীগের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। পরে স্থানীয় নেতা আবদুল হান্নান কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে ২৬ মার্চ ঘোষণা করেন। এ সম্পর্কে আপনি আপনার বাবার কাছে কী শুনেছিলেন?
সোহেল তাজ: আমি যতটুকু জানি আমার বাবা বঙ্গবন্ধুর কাছে অনুরোধ করলেন। বঙ্গবন্ধু সাইন করলেন না, তিনি চলে এলেন। তারপর আমার বাবার সঙ্গে কিন্তু বঙ্গবন্ধুর দেখা হলো ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে।
কী কী ঘটেছে এগুলোই কিন্তু আমাদের অনুসন্ধান করা প্রয়োজন? আমরা জানি চিটাগাংয়ের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়া একটি ঘোষণা দিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান তো দিয়েছিলেন ঘোষণা, এটা তো অস্বীকার করার কিছু নেই। এগুলো আমাদের ক্লিয়ার করতে হবে। অনেক তথ্য-উপাত্ত আছে ইতিহাসবিদদের নিরপেক্ষভাবে কাজ করে এগুলো বের করে নিয়ে আসতে হবে, রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের জন্য।
খবরের কাগজ: ২৫ মার্চ রাতে কী ঘটেছিল, যেটা আমরা জানি না?
সোহেল তাজ: এটা অনেকটা ‘১৯৮৪’-এর মতো হয়ে যাচ্ছে। সেই বইটা পড়েছেন জর্জ অরওয়েল এর। যে ক্ষমতায় আসছে সেই ইতিহাস লিখছে। এটা তো এরকম হওয়ার কথা না। সঠিক ইতিহাসকে সংরক্ষণ করার দায়িত্ব আমাদের প্রত্যেকের। এটা প্রত্যেক বার হয়েছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগের মতো ইতিহাস করে। বিএনপি ক্ষমতায় এলে বিএনপির মতো করে ইতিহাস। আরেকজন এলে আরেকজনের মতো করে ইতিহাস। এটা কেন হবে?
খবরের কাগজ: তার মানে আওয়ামী লীগের আমলে ইতিহাস বিকৃতি হয়েছে?
সোহেল তাজ: আওয়ামী লীগের আমলে অনেক অর্থে ইতিহাস আড়াল করা হয়েছে, কিছুটা বিকৃত করা হয়েছে।
খবরের কাগজ: আর অন্য সময়ে?
সোহেল তাজ: অন্য সময়েও বিকৃত করা হয়েছে এবং আড়াল করা হয়েছে।
খবরের কাগজ: সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন ২৫ মার্চ রাতে কি ঘটেছিল? তাজউদ্দীন আহমদ যে ঘোষণাপত্র বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধু সেই ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেননি। কেন করেননি এটা জানতেন?
সোহেল তাজ: আমাদের জানতে হবে কেন করেননি। নিশ্চয়ই কোনো যুক্তি ছিল, নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য ছিল, লজিক ছিল। একটা প্ল্যান করা ছিল, তার পরও সেখান থেকে কেন সরে গেলেন। এটা তো তদন্ত করা উচিত। জাতির তো জানার অধিকার আছে কেন হলো। আমি তো এটা সাক্ষী ছিলাম না, কিন্তু এটা আমরা প্রশ্ন করতে পারি।
খবরের কাগজ: তার মানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, আওয়ামী লীগের আমলে কিছু কিছু ইতিহাস আড়াল করা হয়েছে?
সোহেল তাজ: আড়াই হাজার বছর আগে সক্রেটিস ছিল, প্লেটো ছিল, অ্যারিস্টটল ছিল। আমরা কি ছিলাম সেখানে? আমরা কি দেখেছি? বাট এভিডেন্স ছিল। ছোট ছোট ক্লু ছিল, সেগুলোকে সমন্বয় করে আমরা একটা চিত্র বের করে নিয়ে আসতে পারি।
খবরের কাগজ: একটা নিরপেক্ষ ইতিহাস আমরা বের করতে বের করে আনতে পারি?
সোহেল তাজ: এটা ৫০-৫২ বছর আগের ঘটনা। এখানে যারা সম্পৃক্ত ছিলেন তারা এখনো অনেকে জীবিত আছেন। এদের মধ্য থেকে যাদেরগুলো গ্রহণযোগ্য, তাদেরগুলো নিয়েই তো আমরা গঠন করতে পারি একটা চিত্র, কী হয়েছিল আসলে?
খবরের কাগজ: আপনি কি মনে করেন, গত সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের শাসনামলে ফ্যাসিবাদ এমন এক পর্যায়ে গিয়েছিল যার চিত্র আমরা জর্জ অরওয়েলের ‘নাইনটিন এইট্টি ফোর’ গ্রন্থে পাই?
সোহেল তাজ: আমি গত সাড়ে ১৫ বছর বিশেষ করে গত ১২-১৩ বছরে যে ঘটনাগুলো দেখেছি, দেশে যাতায়াত করেছি এবং গত পাঁচ ছয় সাত বছর দেশেই আছি। আমার কাছে হুবহু মিলে যাচ্ছিল সেই ‘১৯৮৪’এর সঙ্গে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে মনে হয়েছে ‘১৯৮৪’ বইয়ের সেই চিন্তক পুলিশের মতো। জর্জ অরওয়েল যদি বেঁচে থাকতেন, তিনি ভাবতেন ওয়াও আমাকেও ছাড়িয়ে গেছে। এভাবে চিন্তা করেন যে গণতন্ত্র যদি একটা ফুটন্ত ডেকচি হয় ওই ডেকচির ভেতরে মানুষ আমরা ফুটেছি পানির ভেতর। গত ১৫ বছর যেটা হয়েছিল এই যে অনিয়ম, দুর্নীতি, মৌলিক অধিকার হরণ হত্যা, গুম, নির্যাতন, লাগামহীন দুর্নীতি অর্থ পাচার। এই অবস্থায় আপনি জ্বালটা বাড়িয়ে দিয়েছেন আবার ঢাকনাটা চেপে রেখেছেন। ৫ আগস্ট এই ডেকচিতে অনিবার্য বিস্ফোরণ ঘটেছে। আওয়ামী লীগ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।
খবরের কাগজ: এই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াটা- আপনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে কাজ করছিলেন। হঠাৎ করে আপনি পদত্যাগ করলেন। আপনার পদত্যাগের পরিষ্কার কোনো কারণ যদি বলতেন।
সোহেল তাজ: একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে, তখন প্রধানমন্ত্রী বললেন, কী রাজাকারদের নাতি-পুতিদের দেব? জনগণের সেন্টিমেন্ট বুঝতে পারলেন না। সার্বিকভাবে নতুন জেনারেশনের সেন্টিমেন্টটা কি? তার মধ্যে ফুটন্ত ডেকচি আছে। ফলাফল হলো কি- আমি কে তুমি কে? রাজাকার রাজাকার! এই স্লোগানের প্রথম অংশ নিয়ে অপপ্রচার হলো। আমি কে তুমি কে? রাজাকার রাজাকার! কে বলেছে, কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার! এই লাইনটা বাদ দিয়ে প্রোপাগান্ডা ছড়াল।
খবরের কাগজ: স্লোগানটিকে বিকৃত করে একটা অংশকে প্রচার করা হয়েছে- আপনি বলছেন?
সোহেল তাজ: ইয়েস, সমাধানের পথ না বেছে confrontation-এর পথকে বেছে নেওয়া হলো। আমার পয়েন্টটা এখানে। শত শত মানুষকে মেরে ফেলার মাধ্যমে গণবিস্ফোরটা ঘটে গেল।
খবরের কাগজ: বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেন। তার মেয়ে শেখ হাসিনা শেষ দিকে এসে এমন একটি ঘটনা-
সোহেল তাজ: আমি মনে করি, আদর্শ কারও ব্যক্তিগত সম্পদ না। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল পূর্ব বাংলার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। পূর্ব পাকিস্তানের সব জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। মানুষ জেগে উঠেছিল দুঃশাসনের বিরুদ্ধে। যেখান থেকে একটা আদর্শ বেরিয়ে এসেছিল মুক্তির জন্য, স্বাধীনতার জন্য।
সেই আদর্শের সিম্বল ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশের সব জনগোষ্ঠী ছিল এই আদর্শের মালিক। কিন্তু সিম্বল ছিলেন বঙ্গবন্ধু। এটা একক কারও আদর্শ ছিল না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত আমাদের দেশের ইতিহাসটা আরেকবার আমাদের পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ১৯৭২ সালের পর থেকে কি এখানে সুশাসন ছিল?
খবরের কাগজ: ১৯৭২ থেকে ৭৫ বঙ্গবন্ধু নেতৃত্বে যে সরকার ছিল আপনি তার কথায় বলছেন যে সেখানে সুশাসন ছিল কি না?
সোহেল তাজ: তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন বাকশাল তৈরি করার আগে যে আপনি এই কাজ করলে আপনাকে শান্তিপূর্ণভাবে সরাবার পথ বন্ধ করে দেবেন এবং আপনাকে সরাবার একমাত্র পথ হবে আপনাকে হত্যা করা এবং আপনিও যাবেন আমরাও যাব আপনার সঙ্গে।
খবরের কাগজ: বাকশালের বিরোধিতার কারণেই কি তাজউদ্দীন আহমদকে সরকার থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল?
সোহেল তাজ: আমরা যদি বিষয়টি পর্যালোচনা করি, এনালাইসিস করি, তাহলে সেদিকেই ইঙ্গিত করছে।
খবরের কাগজ: আপনার পদত্যাগের পেছনে এরকম কোনো ঘটনা ঘটেছিল?
সোহেল তাজ: আমি আপনাকে শুরুতেই বলেছিলাম আওয়ামী লীগের দিনবদলের সনদ ছিল। আমি কেঁদে ফেলেছিলাম, যেদিন আমি শপথ নিয়েছিলাম মন্ত্রী (প্রতিমন্ত্রী) হিসেবে। ১৬ কোটি মানুষের দায়িত্বভারের একাংশ আমার কাছে। আমার আস্থা ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর। কিন্তু কিছু কিছু ঘটনা আমি যখন প্রত্যক্ষ করলাম।
খবরের কাগজ: কি প্রত্যক্ষ করেছিলেন?
সোহেল তাজ: একটা ঘটনা আমাকে খুব নাড়া দিয়েছিল। একদিন আমার নেত্রীকে বলতে শুনলাম, বিএনপি-জামায়াত অনেক টাকা কামিয়েছে। এখন আমাদের দুই হাতে টাকা কামাতে হবে। এটা আমাকে শক করেছিল।
খবরের কাগজ: এটা কোন ফোরামে বলেছিলেন?
সোহেল তাজ: অনেক সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে একটি ইনফরমাল মিটিংয়ে।
খবরের কাগজ: যমুনাতে না কি গণভবনে?
সোহেল তাজ: এটা যমুনাতে। এরকম ঘটনা আমি সংসদ ভবনেও শুনেছি।
খবরের কাগজ: তখন নেতারা কি বলেছিলেন?
সোহেল তাজ: নেতারা তো লাইসেন্স পেয়েছেন দুর্নীতি করার। কিন্তু এখানে আবার একটা বিষয় আছে, আপনাকে লাইসেন্স দেওয়া হলো দুই হাতে টাকা কামাবার। আবার আপনাকে কিন্তু বলা হচ্ছে, আপনার ফাইলও আমার কাছে আছে। তার মানে আমার লাইনের বাইরে গেলেই কিন্তু আপনার খবর হয়ে যাবে। হাউ ইজ ওয়ার্ক। দলীয় নেতা-কর্মীদের কীভাবে লাইনে রাখতে হয়, এটা একটা মেকানিজম। আপনাকে এলাও করা হচ্ছে অনিয়ম-দুর্নীতি করতে। কিন্তু শর্ত হচ্ছে আমাকে মানতে হবে। আপনি যেই মুহূর্তে আমার লাইনে বাইরে যাবেন আপনি এক্সপোজ হয়ে যাবেন। আমরা এটার একটা ছোট্ট উদাহরণ পেয়েছিলাম ক্যাসিনো সম্রাটের কাহিনিতে। এখানে ফ্যামিলির ভেতরে আবার ভাগাভাগি আছে। সম্রাট ছিল আর এক অংশের রিপ্রেজেন্টেটিভ। তারা যখন লাইনের বাইরে গিয়েছে তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আবার সমঝোতা করে ঠিক করা হয়েছে।
খবরের কাগজ: এই যে আদর্শ থেকে সরে গিয়ে, দিনবদলের সনদ বাস্তবায়ন করে ক্ষমতায় এসে সরাসরি দুর্নীতিকে উৎসাহিত করা, এটাও কি মূল কারণ ছিল আপনার পদত্যাগের?
সোহেল তাজ: না না, এটা তো একটা কারণ।
খবরের কাগজ: সুনির্দিষ্ট কারণটা কী?
সোহেল তাজ: আপনার সঙ্গে আমার ওই দিন (পদত্যাগের দিন রাতে) কথা হয়েছিল। প্রত্যকটি মন্ত্রণালয়ে অনিয়ম। মন্ত্রীর কাজ সরকার পরিচালনা করা। সরকারের কাজ দলীয় যে ম্যান্ডেট পেয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করা। কয়জন মন্ত্রী জানত তার কাজ কী? খুব কম মন্ত্রিরা জানতেন। কাজগুলো করেছে সচিবরা। মন্ত্রীরা হচ্ছে ফানফেস। অনিয়ম যদি চলতে থাকে মন্ত্রীরা সেভ। মন্ত্রীর কাজগুলো করা হয় সচিবদের মাধ্যমে। মুখ্য সচিব ছিলেন এটার মূল। আমার নিজের অভিজ্ঞতা এমপি, মন্ত্রীদের ইন্ট্রোগেট করত ডিজিআইএফ-এর লোকজন।
খবরের কাগজ: আপনার ক্ষেত্রে?
সোহেল তাজ: আমি বলেছি গেট লস। প্রধানমন্ত্রীকে গিয়ে বলেন, আমি কোনো কথা বলব না। ডিজিএফআই দিয়ে যখন দল পরিচালনা করা হয় এবং দলের কোর পলিসি সেট করা হয়, তার মানে বুঝতে পারছেন?
আরেকটা বিষয়, দুর্নীতি-অনিয়মের পাশাপাশি আমার কাজ করার কোনো স্কোপ ছিল না। একটা ঘটনা ঘটেছে, যেটা আমি পরে জানতে পেরেছিলাম। আমাকে বারবার আন্ডার মাইন্ড করা হচ্ছিল। আমি দেখতাম, আমি একটি ইনস্ট্রাকশন দিচ্ছি, ইনস্ট্রাকশন ফলো করা হচ্ছে না। পরে আমি জানতে পারলাম, একেবারে ওপর থেকে বলা হয়েছিল ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাকে এবং আমার অধীন যারা আছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর কোনো ইনস্ট্রাকশন ফলো করা যাবে না।
শেষ পর্ব আগামীকাল...