ঢাকা ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪
English

বিশেষ সাক্ষাৎকার: তানজিম আহমদ সোহেল তাজ দুর্নীতি অন্যায় অনিয়ম মেনে নিতে পারিনি

প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৫৮ এএম
দুর্নীতি অন্যায় অনিয়ম মেনে নিতে পারিনি

তানজিম আহমদ সোহেল তাজ। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে বিরাগভাজন হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তার পরের ঘটনার কিছু প্রকাশ্যে এসেছে। কিছু রয়ে গেছে অন্তরালে। কিন্তু কেন তিনি ইস্তফা দিয়েছিলেন? খবরের কাগজের কাছে সেসব ঘটনা উন্মোচন করেছেন সোহেল তাজ নিজেই। তিনি বলেছেন, অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা, অন্যায়গুলো মেনে নিয়ে জি হুজুর বলে থাকার মানুষ না তিনি। চূড়ান্ত প্রতিবাদ হিসেবে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন জানিয়ে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদপুত্র সোহেল তাজ বলেন, ‘পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর হাতে নিজে জমা দিয়েছি। পরের দিন আমাকে জোর করে যমুনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।’ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খবরের কাগজের সিটি এডিটর আবদুল্লাহ আল মামুন।

খবরের কাগজ: এটা কি সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন?
সোহেল তাজ: তারা (মন্ত্রণালয়ের সচিবরা) নির্দেশ নেন শুধু একজনের। একজন প্রতিমন্ত্রী বা মন্ত্রী দেখেন তার ইনস্ট্রাকশন ফলো করা হচ্ছে না। আরেকটা বিষয় আমাকে নাড়া দিয়েছিল, সেটা হলো বিডিআর হত্যাযজ্ঞ। এ বিষয়ে অনেকে আমাকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করেছিল। আমি সে সময় যুক্তরাষ্ট্রে ছিলাম। সেখান থেকে দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছি। প্রধানমন্ত্রী কেন তার সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছেন সেটা আমি বলতে পারব না। কেন তিনি রাজনৈতিক সমাধানে গেলেন, সেটা তিনি বলতে পারবেন।

খবরের কাগজ:  আপনি কি কখনো জানার চেষ্টা করেছিলেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিসেবে…
সোহেল তাজ: আমি একটা টার্গেট নিয়ে এসেছিলাম যে, এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করতে হবে। এসে আমি হতাশ হলাম কেন জানেন? এর সম্পূর্ণ তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হলো একজন কো-অর্ডিনেটরকে। তার মানে আমাদের হাত থেকে সবকিছু সরিয়ে ফেলা হলো। সব ফাইলপত্র ও দায়িত্ব দেওয়া হলো বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল ফারুক খানকে এবং আমাদের কাছ থেকে কিছু জানার চেষ্টাও করা হয়নি।

খবরের কাগজ: আমরা সে সময় জেনেছিলাম শেখ ফজলুল করিম সেলিমের সঙ্গে আপনার একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল?
সোহেল তাজ: এটা সম্পূর্ণ ভুল। এটা বলা হয়েছে আসল কারণ পদত্যাগকে ‘ডিফ্লেক্ট’ করার জন্য। যারা প্রিভিয়াস সরকারে দুর্নীতি করেছেন, তাদের বিদেশ ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। যারা সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজ সেই তালিকাতে ছিলেন বিএনপির ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। রাতে আমাকে এসবি প্রধান ফোন করে বলেন তিনি (টুকু) যাচ্ছেন, আমি বললাম তিনি কি তালিকায় আছেন? বলেন, জি আছেন। আমি বললাম আপনাদের যেটা করার সেটা করতে হবে। এই বিষয়টা মনে হয় তিনি (শেখ ফজলুল করিম সেলিম) জানতে পেরেছিলেন। এটা নিয়ে তার সঙ্গে আমার কোনো দ্বন্দ্ব মতবিরোধ হয়নি।
খবরের কাগজ: তার অর্থ শেখ সেলিম আপনাকে তার বেয়াই ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে কিছু বলেননি?
সোহেল তাজ:  না।

খবরের কাগজ: গুজব ছিল আপনি তাকে (ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু) বিদেশ যেতে দেননি।
সোহেল তাজ: এই গুজবটা ছড়িয়েছিল একটা গোষ্ঠী। যারা চেয়েছিল আমার পদত্যাগের আসল কারণগুলো ঢাকা দিয়ে একটা ফলস কারণ দাঁড় করাতে।
খবরের কাগজ: শেখ সেলিম আপনাকে ফোন করেছিলেন?
সোহেল তাজ: আমাকে ফোন করে থাকলে মনে থাকত।
খবরের কাগজ: একবার আপনি আমাকে বলেছিলেন তিনি (শেখ সেলিম) আপনাকে ফোন করে রিকোয়েস্ট করেছিলেন তাকে (ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু) যেন ছেড়ে দেওয়া হয়।
সোহেল তাজ: আমি এসবি প্রধানকে বলেছিলাম নিয়মের মধ্যে যেটা আছে, তালিকা যদি থাকে তাহলে নিয়মের মধ্যে থেকে যেটা করার সেটাই করবেন।

খবরের কাগজ: আপনি তো ওই রাতেই পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছিলেন?
সোহেল তাজ:  না।
খবরের কাগজ: কিন্তু আমরা জেনেছিলাম যে প্রধানমন্ত্রী আপনার পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে ফেরত দিয়েছিলেন?
সোহেল তাজ: না, এখানে আরেকটা ঘটনা আছে। আমি ৩১ মে পদত্যাগপত্র দিয়েছিলাম। আমি অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা, অন্যায়গুলো মেনে নিয়ে জি হুজুর বলে থাকার মানুষ না। চূড়ান্ত প্রতিবাদ হিসেবে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর হাতে নিজে জমা দিয়েছি। পরের দিন আমাকে জোর করে যমুনায় নিয়ে যাওয়া হলো। প্রধানমন্ত্রী কথা বলবেন, তাই যমুনায় আমাকে নিয়ে গেলেন।

খবরের কাগজ: পরের দিন কোন সময়ে?
সোহেল তাজ: রাত ৮টায়।
খবরের কাগজ: তার মানে সারা দিন পার করে?
সোহেল তাজ: আমাকে যমুনায় নিয়ে যাওয়া হয়। যমুনায় নিয়ে যাওয়ার পর দেখি সবাই বসে আছেন।
খবরের কাগজ: আপনাকে কীভাবে নিয়ে যাওয়া হয়? ডেকে নিয়ে যায়?
সোহেল তাজ: সৈয়দ আশরাফ ভাই এসে বললেন নেত্রী কথা বলবেন। আমি যেতে চাইনি। বলেছি পদত্যাগপত্র দিয়েছি, আমি যাব না। আমি তাকে অসম্মান করতে চাইনি। এ অবস্থায় আমাকে সৈয়দ আশরাফ বললেন, সোহেল চলো চলো। আশরাফ ভাইয়ের কথায় রাজি হলাম। আমি ভাবলাম তিনি হয়তো আমাকে বলবেন, জিজ্ঞেস করবেন, কেন তুমি পদত্যাগটা করছ? হয়তো আমার থেকে জানতে চাইবেন এবং অ্যাড্রেস করবেন ইস্যুগুলো। আমি গেলাম এবং দেখলাম সাজেদা চৌধুরী, শামসুল হক টুকু, আশরাফ ভাই, ফিজার সাহেব। সবাই বসে আছেন, খোশগল্প করছেন। পাঁচ মিনিট চলে গেল, দশ মিনিট চলে গেল, আমি বসে আছি তারা খোশগল্প করছেন। তখন আমার রিয়েলাইজেশন হলো এটা আমাকে বোঝাবার কিছু না। এটা হচ্ছে জনগণকে একটা মেসেজ দেওয়া- সোহেলকে ম্যানেজ করা হয়েছে এবং সবকিছু ঠিকঠাক। তখন একপর্যায়ে আমি বলে বসলাম আমাকে কি ডেকেছেন আলাপ শোনার জন্য নাকি আমাকে আপনারা বোঝাবেন?

খবরের কাগজ: তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না?
সোহেল তাজ: হ্যাঁ, আমি প্রধানমন্ত্রীকেই বললাম- আমাকে ডেকেছেন কথা বলার জন্য না আপনাদের আলাপ শোনার জন্য। ১৫ মিনিট হয়ে গেছে!
খবরের কাগজ: তিনি কি কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না?
সোহেল তাজ: নাথিং। তারা শুধু আলাপ করছেন আর আমি বসে আছি। প্রধানমন্ত্রী বললেন তুমি এটা কি করছ? আমি বললাম, আমি তো আপনাকে বলেছি আমি পদত্যাগ করেছি। আমি থাকব না। তখন প্রধানমন্ত্রী বললেন- তুমি পদত্যাগ করলে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে এবং তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন।

খবরের কাগজ:  কী বললেন ক্ষিপ্ত হয়ে?
সোহেল তাজ: সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি সোচ্চার হচ্ছে। তখন আমি তাকে বললাম আমরা যে নির্বাচনি ইশতেহার দিয়েছিলাম, আমাদের বাংলাদেশকে পুনর্গঠন করার কথা ছিল। আমরা যদি সঠিক পথে কাজটা করতাম, তাহলে চেয়ারের নিচে ডানে-বামে আমাদের ষড়যন্ত্র খোঁজা লাগত না। আমরা এখন ভাবছি সব জায়গায় ষড়যন্ত্র। আমরা সঠিক পথটা বেছে নিইনি। তখন সাজেদা চৌধুরী বললেন, এই তুমি এভাবে কথা বলছ কেন? ১৫ আগস্ট এর পরে আমরা তাকে… তখন আমি সাজেদা চৌধুরীকে বলেছিলাম, দেখুন, আপনাদের কারণেই দলের এ অবস্থা। কারণ সঠিক কথাটা আপনারা বলার সাহস রাখেন না। তিনি যা শুনতে চেয়েছেন আপনারা তাই বলেছেন। আমি বলেছি আপনাদের যদি আমাকে কিছু বলার না থাকে চলে যাচ্ছি। পদত্যাগপত্র আমি গতকাল দিয়েছি।

খবরের কাগজ: যমুনায় গিয়েই দিয়েছিলেন?
সোহেল তাজ: হ্যাঁ, তারপর আমি চলে গেলাম। তারপরও রিকোয়েস্ট করা হলো। পরবর্তী সময়ে দেখেছি যে, আমাকে নানাভাবে চাপ দেওয়া হচ্ছে। একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিলাম আমেরিকা চলে যাব। তার তিন-চার দিন পরে আমেরিকা গিয়ে তাকে ফোন করেছি। একটা কথা বলি- আমাকে জোর করে রাখা হয়েছিল তিন দিন।
খবরের কাগজ: এখানে কি কোনো এজেন্সির ভূমিকা ছিল?
সোহেল তাজ: এ রকম একটা প্রেশার সিচুয়েশনে..

খবরের কাগজ: সে সময় আমি যখন আপনার সঙ্গে দেখা করতে যমুনায় যাই আপনি বলেছিলেন...
সোহেল তাজ: দেখেন আমার বক্তব্যটা খুব সিম্পল ছিল এই যে, দিন বদলের সনদের ওয়াদাগুলো যদি বাস্তবায়ন করতাম, যদি নির্বাচন কমিশনকে একটি নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে পারতাম, প্রশাসনকে দলীয়মুক্ত করতে পারতাম, পুলিশ বাহিনীকে কার্যকর জনবান্ধব করে গড়ে তুলতে পারতাম, তাহলে পরবর্তী নির্বাচনে মানুষ আপনাকে ভোট দিয়ে নিয়ে আসত। আপনার তো ভয় পাওয়ার কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু আপনি সেই পথে গেলেন না। আমি সেই কথাটাই বলেছিলাম। বলেছিলাম আমরা তো একই কাজ করছি, যেটা বিএনপি জামায়াত করেছে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত।

খবরের কাগজ: এই কথাগুলো আপনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলেছিলেন? এই যে দল নীতি আদর্শ থেকে সরে গেছে, আমি এগুলোকে মেনে নিতে পারছি না?
সোহেল তাজ: হ্যাঁ, আমি বলেছি।
খবরের কাগজ: আগে বলেছিলেন?
সোহেল তাজ: না, যখন আমাকে ডাকল সাজেদা চৌধুরী, আশরাফ ভাইসহ।
খবরের কাগজ: তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কী বলেছিলেন?

সোহেল তাজ: তিনি কোনো কথা বলেননি। তার মুখ একদম ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল, আমি তখন উঠে চলে এসেছি।
খবরের কাগজ: আপনি তিন দিন পর চলে গিয়েছিলেন স্ত্রী-সন্তানদের কাছে। সে সময় আপনি আমাকে একটা ইন্টারভিউয়ে বলেছিলেন- খেলোয়াড় বদলেছে কিন্তু খেলা একই আছে। আপনি বলেছিলেন যে আওয়ামী লীগের ভেতরে চিত্র এক রকম। বাইরে চিত্র আরেক রকম। আপনি বলেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপনাকে ফোন করেছিলেন এবং বলেছিলেন দলীয় পদ দেওয়ার জন্য, পূর্ণমন্ত্রী করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এ বিষয়ে পরিষ্কার করে যদি বলতেন।
সোহেল তাজ: আমি বাংলাদেশ থেকে কোনোমতে বের হয়ে আমেরিকায় গিয়ে তাকে (শেখ হাসিনা) ফোন দিয়েছি। রিকোয়েস্ট করেছি আমাকে দয়া করে ছেড়ে দেন। আমি পদত্যাগপত্র আপনাকে দিয়েছি ৩১ মে। আমি থাকতে চাই না। তিনি আমাকে বললেন থাকো।
এটা হাস্যকর শোনাবে আমি বলতে চাচ্ছি না। পাঁচ মিনিট ধরে আমি বলছি আমাকে ছেড়ে দেন, তিনি বলছেন, তোমাকে ছাড়ব না। তারপর তিনি গান গেয়েছেন, আমি হতভম্ব হয়ে যাই।

খবরের কাগজ: কী গান গেয়েছেন?
সোহেল তাজ: আমি তোমাকে ছাড়ব না, আমি কাউকে ছাড়ি না, আমি তোমাকে ছাড়ব না। এভাবে সুর করে ২-৪ মিনিট গান গাইলেন। ফোনে শুনে আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে একটা দেশের প্রধানমন্ত্রী এভাবে গান গাইবেন! কিন্তু এটা আমার কাছে ‘নট আ ম্যাটার অব জোকস’। আমার মনে পড়েছিল ৩১ তারিখের চেহারা। এগুলো যদি আপনি মিলিয়ে দেখেন ইট ওয়াজ আ বিগ থ্রেট। তার আগে তিনি বলেছিলেন, তোমার কী লাগবে? তুমি আসো সেক্রেটারির একটা পদ খোলা আছে। মন্ত্রিত্বের অফার করা হয়েছে। কী লাগবে বারবার বলা হয়েছে। আমি বলেছি আমাকে ছেড়ে দেন। তখন তিনি ওই গানটা গাইলেন। আমার মনে আছে আমি প্রতি উত্তরে তাকে বলেছিলাম- দেখেন আপনাকে যা বলার আমি বলে দিয়েছি, আপনি আপনারটা করুন আর আমি এখন যা করার সেটা করব।
খবরের কাগজ: তার মানে আপনি সবকিছু বলে দেওয়ার জন্য…
সোহেল তাজ: আমি মিন করেছি বেরিয়ে আসার জন্য, যা করা দরকার তাই করব। কারণ তিনি তো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন আমাকে ছাড়বেন না। আমি তাকে চ্যালেঞ্জ দিলাম আমি বের হব। এই শুরু হলো খেলা। আমার শেষ খেলাটা খেললাম।

খবরের কাগজ: কী খেললেন?
সোহেল তাজ: সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করলাম। আমার প্যাডে সাইন করে স্পিকার বরাবর পাঠিয়ে দিলাম। স্পিকারকে ফোন করে বললাম হামিদ কাকু এই যে আমার পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছি, এটা আমার স্বাক্ষর করা। তিনি প্রেসকে বললেন, এটা কে দিয়েছে না দিয়েছে আমি তো জানি না। কারণ তাকে বলা হয়েছে এটা গ্রহণ না করতে। তিনি অজুহাত দিলেন সশরীরে থাকতে হবে। তখন আমি নিজে চলে এলাম এবং পদত্যাগপত্র দিলাম। প্রথমটা দিয়েছিলাম এপ্রিল মাসে, দ্বিতীয়টা দিলাম জুলাই মাসে। জুলাই মাসে পদত্যাগপত্র দিলে আবার আমাকে ডেকে পাঠালেন প্রধানমন্ত্রী। গণভবনে তিনি আমার সঙ্গে কথা বলছেন- তুমি এখন কী করবা? আমি বললাম, আমি তো পদত্যাগপত্র দিয়েছি। হ্যাঁ তুমি পদত্যাগপত্র দিয়ে এখানে এসেছ। আমি ভেবেছিলাম তুমি আগে আমার কাছে আসবা। আমি বললাম, আমি তো পদত্যাগপত্র দিয়েছি।

খবরের কাগজ: আপনি ওই সময় বলেছিলেন আর রাজনীতি করবেন না। সর্বশেষ আওয়ামী লীগের কাউন্সিলের আগে একটা আলোচনা ছিল আপনাকে দলে ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে বা আপনার দলে কাজ করার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এই বিষয়টা কী ছিল?
সোহেল তাজ: কবে এটা?
খবরের কাগজ: সর্বশেষ আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে।
সোহেল তাজ: দেখেন আমি বারবার একটা কথা বলেছি আওয়ামী লীগে ছিলাম, আছি, থাকব। কিন্তু এই আওয়ামী লীগে না। এটা আমার আওয়ামী লীগ না। এটা কোনো আওয়ামী লীগ না। এটা হচ্ছে লুটেরা লীগ, এটা হচ্ছে খুনি লীগ, এটা হচ্ছে গুম লীগ, এটা হচ্ছে অব্যবস্থাপনা লীগ, দুর্নীতি লীগ। এটা সাধারণ মানুষ হত্যাকারী লীগ। এই আওয়ামী লীগের তো আমি হতে চাইনি।
খবরের কাগজ: কিন্তু আপনার বোন তো আওয়ামী লীগের টিকিটে একই আসন থেকে এমপি হয়েছেন।
সোহেল তাজ: আমার বোনকে রীতিমতো জোর করে নমিনেশন দেওয়া হয়। কারণ আমার পথটা যে বেকায়দায় ফেলেছিল সরকারকে, তাজউদ্দীন পরিবার থেকে পদত্যাগ করেছে, সেটাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা। যে যাই বলুক না কেন, আমাদের জননেত্রী শেখ হাসিনার একটা গুণ আছে। তার সংস্পর্শে এলে কেন জানি সবাই নিজেকে হারিয়ে ফেলে। এটা অ্যামেইজিং ট্যালেন্ট কারিশমা বলে। আপনি তার সামনে গেলে একদম দুর্বল হয়ে যাবেন।

খবরের কাগজ: এখন আলোচনা হচ্ছে আপনি আওয়ামী লীগের হাল ধরবেন। আপনার মায়ের মতো। এই আলোচনার সত্যতা কতটুকু?
সোহেল তাজ: ছাত্র আন্দোলনের ঘটনাগুলো বিবেককে এমনভাবে নাড়া দিয়েছে যে, আমি বাধ্য হয়েছি প্রতিবাদ করতে। আমি আমার অবস্থান থেকে প্রতিবাদ করেছি। আমি ২৭ জুলাই ডিবি অফিসে গিয়েছি ছাত্র সমন্বয়কদের সেখানে আটকে রাখা হয়েছিল। আন্দোলন প্রত্যাহারের ফলস স্টেটমেন্ট যখন দেওয়া হলো, আমি আশ্চর্য হয়েছি যখন দেখলাম প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) মেট্রোরেলের সামনে গিয়ে কান্নাকাটি করছেন যে আমাদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অথচ শত শত প্রাণ আমরা হারিয়েছি। আমি মানুষের কাছে মেসেজটা দিতে চেয়েছিলাম। কারণ সাংঘাতিকভাবে মিডিয়াতে একই জিনিস রিপিট করা হচ্ছিল, মেট্রোরেলের ক্ষতি হয়েছে, অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে। আমি আশ্চর্য হলাম যে মানুষ ভুলে যাচ্ছে মেট্রোরেল, পদ্মা ব্রিজ- এগুলো জনগণের টাকায় তৈরি হয়েছে। এগুলো আবার পরে গড়ে নিতে পারব। যারা প্রাণ হারিয়েছে তাদের তো আমরা ফিরে পাব না। তখন আমি এই মেসেজটা দিলাম- একটা প্রাণ হচ্ছে অমূল্য।

খবরের কাগজ: মেসেজটা কীভাবে দিয়েছিলেন?
সোহেল তাজ: আমি ডিবি অফিসে যখন গেলাম তখন সংবাদ মাধ্যম ছিল। সেই সংবাদ মাধ্যমে আমি জানালাম যে সমন্বয়করা সেফ কাস্টডিতে না। তারা গ্রেপ্তার অবস্থায় আছে, তারা গ্রেপ্তার অবস্থায় থাকা মানে আমি ইন্ডিকেট করলাম ‘স্টেটমেন্ট ইজ নট ভ্যালিড’। দ্বিতীয়ত হচ্ছে- ক্ষয়ক্ষতি কিছুই না, প্রাণ হচ্ছে অমূল্য। তৃতীয় মেসেজ নতুন প্রজন্ম তোমরাই পারবে, তোমাদের দেশ এটা, আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।  
খবরের কাগজ: এই যে এত ছাত্র-জনতা মারা গেছে, এটাকে গণহত্যা হিসেবে দাবি করছে বর্তমান সরকার এবং আন্দোলনকারী ছাত্ররা। আপনি মনে করেন কি না যে সেটা গণহত্যা হয়েছিল আর গণহত্যা হয়ে থাকলে আওয়ামী লীগের ক্ষমা চাওয়া উচিত?
সোহেল তাজ: দেখেন যে ঘটনাটা ঘটেছে এখানে হাজারের ওপরে মারা গেছে। মারা গেছে নিরীহ ছাত্র, পোশাক শ্রমিক, রিকশাচালক, সাধারণ মানুষ। বাংলাদেশের ইতিহাসে কেন, গত ৫০ বছরে এশিয়ার ইতিহাসে নেই এ রকম জঘন্য হত্যাকাণ্ড। নির্বিচারে গুলি করা হয়েছে। পুলিশ গুলি করেছে, বিজিবি গুলি করেছে, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা গুলি করেছে, যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা গুলি করেছে। যারা এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেককে বিচারের আওতায় আনতে হবে। গত ১৫ বছর যারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, যারা টাকা পাচার করেছে বিদেশে তাদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় এনে বিচার করতে হবে। যারা অনিয়ম করেছে, হত্যা, গুম, নির্যাতনের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের প্রত্যেককে বিচারের আওতায় আনতে হবে। সে আওয়ামী লীগার হোক আর না হোক। এই শুদ্ধি অপারেশন করার পর যদি কোনো আওয়ামী লীগার থাকে তাকে অনুশোচনা করতে হবে। আত্মসমালোচনা করতে হবে, আত্মোপলব্ধি করতে হবে।

খবরের কাগজ: এখন অনেকে অ্যারেস্ট হয়ে, অনেকে আত্মগোপনে আছেন। অনেকে পালিয়ে গেছেন। এই পরিস্থিতিতে আপনি কি মনে করেন আওয়ামী লীগ আবার ঘুরে দাঁড়াবে? ঘুরে দাঁড়ালে সেটা কতদিন লাগতে পারে?
সোহেল তাজ: আমি আশ্চর্য হয়েছি এই যে. আত্মোপলব্ধি, আত্মসমালোচনা, অনুশোচনা, এটা দেখছি না আওয়ামী লীগের ভেতর। এটা আমাকে খুব হতাশ করেছে। আমি মনে করি এখনো আওয়ামী লীগের ভেতরে ভালো মানুষ আছে।
খবরের কাগজ: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার এসেছে। এই সরকারের কাছ থেকে আপনি কী আশা করছেন?
সোহেল তাজ: নতুন প্রজন্মের স্বপ্ন দুর্নীতিমুক্ত, বৈষম্যহীন, ন্যায়ভিত্তিক একটা সমাজ- এটাই তারা চাচ্ছে। এটাও মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ছিল। এটা আমারও স্বপ্ন ছিল।

খবরের কাগজ: তার অর্থ আপনি আশাবাদী?
সোহেল তাজ: আমি আশাবাদী। কিন্তু কাজ করতে হবে। আমি জাস্ট ওয়ার্নিং দিয়ে রাখি, যারা হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে তারা প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে চাই না এই আন্দোলনটা বৃথা যাক।
খবরের কাগজ: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
সোহেল তাজ: আপনাকেও ধন্যবাদ।

ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক হতে হবে বন্ধুত্বপূর্ণ ও সমমর্যাদার

প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৩১ এএম
ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক হতে হবে বন্ধুত্বপূর্ণ ও সমমর্যাদার
আনু মুহাম্মদ

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের যে জটিলতা এখন দেখা যাচ্ছে, সেটা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত। এটাও আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ভারতের এই আধিপত্যবাদী যে চেহারা, সেই চেহারার উন্মোচন ঘটানো দরকার। শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নয়, দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও তাদের আধিপত্যবাদী চরিত্র বিদ্যমান। এই সরকারের আগেও ছিল। মূলত এটা তৈরি হয়েছে ভারতে যে বৃহৎ পুঁজির বিকাশকেন্দ্রিক ভবন তার সম্প্রসারণের তাগিদ থেকে। বর্তমানে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সমস্যা, এটিকে হিন্দু-মুসলমান সমস্যা হিসেবে দেখা খুবই ভুল। কারণ নেপাল হিন্দু রাষ্ট্র, তার সঙ্গেও ভারতের অনেক সমস্যা আছে। এ ছাড়া মালদ্বীপ, ভুটান, শ্রীলঙ্কা- এসব দেশের সঙ্গে ভারতের একপেশে মনোভাব বিদ্যমান।

 ফলে এসব দেশের মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ ভারতের শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে, তার প্রকাশ ঘটেছে সেসব দেশের সরকারের মধ্যেও। বর্তমানে বাংলাদেশ হচ্ছে সর্বশেষ তালিকায়। সেখানে ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের ক্ষোভ আগে থেকেই ছিল। সরকার পতনের পর ক্ষোভের প্রকাশটা এখন হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধেও পরিচালিত হয়েছে। হাসিনা সরকার ভারতের সঙ্গে নানা শর্তে এমন অনেক চুক্তি করেছে, এমনভাবে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ধারণ করেছে যে, এতে বাংলাদেশের মানুষের ক্ষোভ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের আপামর মানুষকে ভারতের বিরুদ্ধে জাগিয়ে তুলতে বাধ্য করেছে।

আমাদের অভিযোগ সুনির্দিষ্ট। এটা কোনো সাম্প্রদায়িক সমস্যার বিষয় নয়। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আমাদের সীমান্ত হত্যা চলছে বহুদিন ধরে। হাসিনা সরকারের সময় ছিল, এখনো সেটা অব্যাহত আছে। পানিবণ্টন সমস্যা ভারত কখনো সমাধান করতে চায়নি। অসম বাণিজ্য, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশে একচেটিয়া বাণিজ্য করে। কিন্তু ভারত বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের বাধা দিয়ে থাকে।

 নেপাল, ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক সৃষ্টির একটা খুব ভালো সুযোগ ছিল। সেখানেও ভারত নানা রকমভাবে বাধা দেয়। তা ছাড়া তারা একচেটিয়াভাবে ট্রানজিটসহ অন্যান্য নানা ধরনের সুবিধা চায়। হাসিনা সরকার তার ক্ষমতার শেষ প্রান্তে এসে ট্রানজিটের এমন অনেক ধরনের সুবিধা ভারতকে দিয়েছে, সেগুলো খুবই অস্বচ্ছ এবং বাংলাদেশের জন্য বিভিন্নভাবে ক্ষতিকর। সেগুলো নিয়ে জনগণের মতামত নেওয়াও হয়নি। জনগণের সম্মতির বিরুদ্ধে গিয়ে এ ধরনের চুক্তিগুলো করা হয়েছে। 

ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা। আমরা নিশ্চয়ই এটা স্বীকার করি যে, ভারত রাষ্ট্র বাংলাদেশের পাশেই ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় সহযোগিতা করেছে। তবে এখানে মনে রাখতে হবে যে, রাষ্ট্রের কোনো মায়ামমতা বা সহানুভূতি থাকে না। রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করে তার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কৌশলগত স্বার্থ বিবেচনা করে। সেই স্বার্থ বিবেচনা করে ভারত রাষ্ট্র তখন বাংলাদেশের জনগণকে সহায়তা করেছে। আমাদের এটা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করতে হবে যে, ভারতের জনগণ বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার মানুষ বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর বোঝা বহন করেছে, তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। তাদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করেছে।

ভারতের জনগণের সেই ভূমিকাকে আমরা কোনো দিন ভুলতে পারব না। সব সময় তা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করতে হবে। সেই সঙ্গে এটাও আমাদের মনে রাখতে হবে, ভারতের জনগণের এই ভূমিকার কারণে ভারতের বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী বা বিজেপি সরকারের যেকোনো দাবি মেনে নেওয়ার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। ১৯৭১ সালে বিজেপি বলে কোনো দলও ছিল না। নরেন্দ্র মোদির ভূমিকাও সে সময় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল না। ভারতের জনগণের সহায়তা আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করার অর্থ এই নয় যে, আদানিকে ব্যবসা দিতে হবে। কিংবা নরেন্দ্র মোদির যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কৌশলগত স্বার্থ সেগুলো পূরণ করতে হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কটা হতে হবে বন্ধুত্ব ও সমমর্যাদার।

 যেখানে ভারতের শাসক শ্রেণি সব সময় চাইবে বাংলাদেশ অধস্তন রাষ্ট্র হিসেবে থাক। সে ক্ষেত্রে হাসিনা সরকার একটা চরম গ্রুপ তৈরি করেছিল এবং ভারত বাংলাদেশকে অধস্তন রাষ্ট্র হিসেবে অভ্যস্ত হয়ে যেতে বাধ্য করেছিল। হাসিনা সরকারের পতনের পর তাদের মধ্যে ভয় তৈরি হয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ অধস্তন অবস্থান থেকে সরে যাচ্ছে বা যেতে পারে। সেই আশঙ্কা থেকে বিজেপির সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন গোষ্ঠী ভারতে বাংলাদেশবিরোধী একটা ব্যাপক, খুবই অসম্মানজনক, বিতর্কিত, অপপ্রচারে লিপ্ত হচ্ছে এবং সেই অপপ্রচারের মূল বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু জনগণ, হিন্দু জনগোষ্ঠী নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছে। এর থেকে মনে হতে পারে যে, ভারতের সরকার হিন্দু জনগণের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল কিংবা তাদের স্বার্থ রক্ষায় খুবই আগ্রহী। এটা যদি সত্য হতো তাহলে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগণ অনেক ভালো অবস্থায় থাকত।

ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এবং তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হলো হিন্দু জনগোষ্ঠী, হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তারা যে ধরনের শাসন-নিপীড়নের মধ্যে বাস করে এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে বাস করে সেটার চিত্র আমরা বিভিন্ন সময় দেখেছি। বিজেপির সবচেয়ে বেশিসংখ্যক গরিব মানুষ ভারতেই বাস করে। এদের ভারতের সামরিক, বেসামরিক নিপীড়ন-নির্যাতনের বিভিন্ন রকম প্রক্রিয়া তৎপরতা ভারত রাষ্ট্রে আছে। সুতরাং বাংলাদেশের কথা যখন তারা বলে, হিন্দু জনগণের প্রতি মায়া-মহব্বতের ব্যাপার নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করে, তখন তারা আসলে এটাকে একটা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে।

 সেই কারণে বিজয়ের মাসে আমাদের কয়েকটা জিনিস নিশ্চিত করতে হবে- ভারত সেটাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে, এই হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়ন, সেই ধরনের ঘটনা যেন কোনোভাবেই না ঘটে। সে ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। কারণ বাংলাদেশে কিছু উন্মাদ লোক থাকতে পারে। যারা সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন এবং সাম্প্রদায়িক তৎপরতা কিংবা জমি দখলের লোভে হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপরে আক্রমণ করতে পারে বা নিপীড়ন করতে পারে। সে রকম ঘটনা যেন না হয়। সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। পাশাপাশি এটা পরিষ্কার করতে হবে যে, যারাই বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা তৈরি করবে তারা আসলে বিজেপির স্বার্থ রক্ষা করছে। 

দ্বিতীয়ত, আমাদের মনে রাখতে হবে যে, বর্তমান বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে ভারতের জনগণ ব্যাপক লড়াইয়ের মধ্যে আছে। শোষণ, নিপীড়ন এবং আধিপত্য, সাম্প্রদায়িকতার জন্য ভারতের জনগণও লড়াই করছে। সেখানে বামপন্থি, সংখ্যালগিষ্ঠ জনগণ একই সঙ্গে সংখ্যালঘিষ্ঠ জনগণের চেতনাসম্পন্ন যারা, তারা বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি, নিপীড়নমূলক ভূমিকা, শোষণ এবং আধিপত্য, বৃহৎ পুঁজির স্বার্থ রক্ষা করার জন্য জনগণকে উচ্ছেদ করা- এর জন্য তারাও লড়াই করছে।

 সে জন্য বাংলাদেশের দিক থেকে আমাদের উচিত হবে, কীভাবে ভারতের সেই নিপীড়িত জনগণকে সঠিক তথ্য জানানো যায় এবং তাদের সঙ্গে একাত্ম সংহতি করা যায়। একই সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গেও এই সংহতিটা তৈরি করতে হবে। যাতে দক্ষিণ এশিয়া একটা গণতান্ত্রিক অঞ্চলে পরিণত হতে পারে। গণতান্ত্রিক দক্ষিণ এশিয়া প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ভারত একটা বাধা। সুতরাং সেই আধিপত্যবাদী ভূমিকার বিরুদ্ধে দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের সংহতি তৈরি করতে পারলে সেটা সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের জন্য গণতান্ত্রিক এবং বৈষম্যহীন যাত্রার পথ সুগম করবে।

 বাংলাদেশে এই বিজয়ের মাসে আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ থেকে ২০২৪ গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যে বাংলাদেশের জনগণ শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সব সময় সজাগ-সচেতন ও সক্রিয় আছে। এই লড়াইয়ের ফলাফল হিসেবে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে হলে দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের সঙ্গে সমঝোতার মধ্যে যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই আরও বেশি সক্রিয় ভূমিকা রাখার পাশাপাশি দেশের প্রতি মনোযোগ বৃদ্ধি করতে হবে।

লেখক: শিক্ষাবিদ

নিয়ন্ত্রণহীন জীবনরক্ষাকারী ওষুধের দাম

প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:২৮ এএম
আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৩২ এএম
নিয়ন্ত্রণহীন জীবনরক্ষাকারী ওষুধের দাম
এস এম নাজের হোসাইন

নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের বাজার প্রতিনিয়তই অস্থিতিশীল হয়ে যাচ্ছে। কয়েক মাস পরেই মুসলিম সম্প্রদায়ের পবিত্র মাস মাহে রমজান। এ উপলক্ষে আবার রমজানে ব্যবহার্য সব নিত্যপণ্যের দাম আরেক দফা বাড়া শুরু হয়েছে। এর বাইরে মানুষের জীনরক্ষাকারী ওষুধের দামও মাস গেলেই বাড়ে। যারা প্রতিনিয়ত শাসকষ্ট, ডায়াবেটিস ও হার্টের রোগী তারা জানেন মাস পেরোলেই তাদের ওষুধের দাম বাড়ে। 

এর বাইরে আবারও বাড়ানো হয়েছে কয়েকটি ওষুধের দাম। ফামের্সিগুলোয় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্যথানাশক ট্যাবলেট, অ্যান্টিবায়োটিক, ডায়াবেটিস, ভিটামিন, গ্যাস্ট্রিকসহ বিভিন্ন ধরনের ওষুধ, ইনজেকশনসহ কোনো কোনো কোম্পানির ওষুধ এক পাতার দাম ১২০ টাকা থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এই হিসাবটি যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলে ওষুধের দাম বেড়েছে ৬৭ শতাংশ পর্যন্ত। আর নিত্যপণ্যের দামের মতো লাগামহীনভাবে দাম বাড়ার ফলে জিম্মি হয়ে পড়ছেন রোগীরা। বিশেষ করে যারা দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত ওষুধ সেবন করেন, তাদের অবস্থা শোচনীয়। একদিকে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি, অন্যদিকে ওষুধের দাম বৃদ্ধি নিয়ে আছেন মহাযন্ত্রণায়।
 
সাধারণ ও সীমিত আয়ের মানুষের এমনিতেই যেখানে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে নাভিশ্বাস অবস্থা, সেখানে জীবনরক্ষাকারী ওষুধের দাম বৃদ্ধি তাদের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট, গ্যাস্টিক, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীর প্রতি মাসের ওষুধের খরচ দ্বিগুণ বেড়েছে। ফলে একদিক খাদ্যপণ্য, অন্যদিকে অনেক সময় কাঁটছাট করে ওষুধ কিনে জীবন বাঁচাতে বাধ্য হচ্ছেন। যেহেতু ওষুধ জীবনরক্ষাকারী পণ্য এবং অনেক সময় ইংরেজিতে দাম লেখা থাকে, সে কারণেই সাধারণ মানুষ ওষুধের দর-কষাকষি বা যাচাই-বাছাই করে ক্রয়ের সময় ও সুযোগ কোনোটিই পান না। সেখানে প্রতিনিয়তই নানা অজুহাতে দাম বৃদ্ধি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। 

স্বাস্থ্য ও ওষুধ বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষের চিকিৎসা বাবদ মোট খরচের একটি বড় অংশ ব্যয় হয় ওষুধ কিনতে। এতে ওষুধভেদে বড় ব্যবধানে ঘন ঘন দাম বাড়ায় বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। এর সার্বিক প্রভাব জনস্বাস্থ্যের ওপর পড়বে। আর ওষুধের মূল্য নিয়ে বাজারে অব্যাহতভাবে চরম নৈরাজ্য চলছে। এ অবস্থায় কোম্পানিগুলোর অধিক মুনাফা ও দাম নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধ করা জরুরি। তা না হলে দেশের চিকিৎসা খাত নিম্নবিত্ত মানুষের আওতার বাইরে চলে যাবে। ওষুধের বাজার নিয়ন্ত্রণে জেলা পর্যায়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তদারকিব্যবস্থা একবারেই দুর্বল।

 জেলা পর্যায়ে একজন ওষুধ তত্ত্বাবধায়ক লোক দেখানো কোনো কোনো সময় ফার্মেসিগুলো পরিদর্শনে যান। এর বাইরে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর মাঝেমধ্যে ফার্মেসিগুলোয় অভিযান পরিচালনা ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও ওষুধের দাম নিয়ে তেমন একটা শাস্তির বিষয় দেখা যায় না। 

সরকার দেশে ১১৭টি ওষুধের দাম নির্ধারণ করে থাকে। অথচ দেশে প্রায় দেড় হাজারের বেশি ওষুধ কোম্পানি ২৭ হাজারেরও বেশি জীবনরক্ষাকারী ওষুধ বিভিন্ন নামে উৎপাদন করে থাকে। কোভিড মহামারি-পরবর্তী সময় থেকে দেশের ওষুধশিল্পের সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশ ওষুধশিল্প সমিতি ও বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির যুক্তি- বিশ্ববাজারে ওষুধের কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, ডলারসংকট, উৎপাদন ব্যয়, প্যাকেজিং মূল্য ও পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন সময়ে ওষুধের দাম বাড়ছে।

 বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম কমলেও আমাদের দেশে তার প্রতিফলন দেখা যায়নি। এমনকি হাইকোর্ট গত ২৯ এপ্রিল দেশে ওষুধের দাম খেয়ালখুশিমতো বৃদ্ধি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নীরব। অনেক সময় দেখা যায়, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থ দেখার চেয়েও ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সংরক্ষণে ব্যস্ত। সে কারণেই ওষুধশিল্পে জড়িত ব্যবসায়ীরা নিয়মিত দাম বাড়ালেও তারা সে বিষয়ে অধিকাংশ সময়ই নীরব থাকে। যেহেতু ওষুধের দাম বাড়ানোর বিষয়ে ঔষধ প্রশাসনের তেমন ওজর-আপত্তি নেই, সে কারণে ওষুধশিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা ওষুধের দাম বাড়তে প্রতিনিয়তই তৎপর থাকেন। 

সরেজমিনে নগরীর রাজধানীর মিটফোর্ড, বংশাল, নাজিরাবাজার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকা এবং শাহবাগসহ বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার একাধিক ফার্মেসিতে ওষুধের দাম বৃদ্ধির সত্যতা যাচাই করে দেখা গেছে, গত ১৫ দিন অস্ত্রোপচার-পরবর্তী মাঝারি থেকে তীব্র ব্যথায় ব্যবহার করা ট্যাবলেট টেরাক্স-১০ প্রতি পিস আগে বিক্রি হতো ১২ টাকায় আর এখন দাম বেড়ে হয়েছে ২০ টাকা। অর্থাৎ বেড়েছে ৬৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। একইভাবে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য ক্যামলোসার্ট ট্যাবলেট এক পাতা ১০টির দাম ১০০ টাকা থেকে ১২০ টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ দাম ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। একইভাবে একই কোম্পানির ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণের কমেট-মেটফরমিন হাইড্রোক্লোরাইড এক পাতা ১০টির দাম ৪০ টাকা থেকে বেড়ে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশ। এ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক সেফ-৩ ডিএস ৪০০ মিলিগ্রাম ক্যাপসুলের দাম প্রতিটি ৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৬০ টাকা হয়েছে। উচ্চ রক্তচাপের জন্য ৩০টির এক বক্স রসুভা (৫ এমজি) ট্যাবলেট ৫০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা করা হয়েছে। দুটিরই মূল্য বেড়েছে ২০ শতাংশ।

রোগীদের ইউরিক অ্যাসিডজনিত সমস্যায় ফেবুক্সোস্ট্যাট ৪০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট প্রতি পিস ১২ টাকা বেড়ে ১৫ টাকা হয়েছে। মূল্য বেড়েছে ২৫ শতাংশ। ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হিউমুলিন এন ইনজেকশন ৩ মিলি কুইকপেন ৫টির এক প্যাকের দাম ৩ হাজার ৫০০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ৬০০ টাকা। উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের জন্য বাইজোরান ৫/২০ ট্যাবলেট কয়েক দিন আগেও এক পাতার ১৫টির দাম ছিল ১৫০ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকায়। দাম বৃদ্ধির পরিমাণ ২০ শতাংশ।

প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় দেশের মানুষকে তাদের চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ নিজেদের বহন করতে হচ্ছে। ওষুধ কেনার পেছনেই সিংহভাগ খরচ করতে হচ্ছে। আমাদের দেশে চিকিৎসাব্যবস্থায় অনেক দিন থেকেই প্রচলিত আছে- চিকিৎসক যে কোম্পানির ওষুধ লিখবেন সেটাই নিতে হবে। তা না হলে অসুখ তো সারবে না বরং আরও স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়বে। ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিক্রয় প্রতিনিধিরা প্রতিদিন চিকিৎসকদের নানা উপঢৌকন দেওয়াসহ হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ভিড় জমান। এ কারণে চিকিৎসকরা যাদের কাছ থেকে বেশি সুবিধা পান তাদের ওষুধ বেশি লিখে থাকেন বলে অভিযোগ আছে। এ কারণে দাম বেড়ে দরিদ্র ও অসচ্ছল মানুষের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। 

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর একসময় ২ শতাধিক ওষুধের মূল্য নির্ধারণের দায়িত্বে ছিল। কিন্তু এখন ১১৭টি ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করছে। এর বাইরের ওষুধগুলোর মূল্য নির্ধারণ অনেকটাই নির্ভর করে ওষুধ কোম্পানিগুলোর মর্জির ওপর। এতে ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। মূল্য নির্ধারণ কমিটিতে ভোক্তাদের প্রতিনিধি হিসেবে ক্যাব থাকলেও ভোক্তাদের অধিকার ও যুক্তিকে বারবার উপেক্ষা করে অযৌক্তিক ও অন্যায়ভাবে ওষুধের দাম বাড়ানো হয়। বর্তমানে প্রচলিত ওষুধের মূল্য বৃদ্ধির যে প্রক্রিয়া, সেটি যুক্তি ও ন্যায়সংগত কি না সন্দেহ আছে। জেনেরিক নামের যে ২ শতাধিক ওষুধের মূল্য নির্ধারণের দায়িত্ব ঔষধ প্রশাসনের ছিল, তা পুনর্বহাল করা দরকার। স্বাধীনতার আগে দেশে মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশ ওষুধ তৈরি হতো। এখন ৯৮ শতাংশ ওষুধই দেশে উৎপাদন করা হয়। দেশে উৎপাদিত ১২৪টি ওষুধ রপ্তানিও হচ্ছে। ওষুধ কোম্পানিগুলোকে কোনো রকম জবাবদিহি ছাড়া মূল্যবৃদ্ধির যে সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে, তা অনতিবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে।

 একই সঙ্গে বর্তমানে ঔষধ প্রশাসনের দক্ষতা, যোগ্যতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে যেসব প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, সেগুলো সমাধান করতে হবে। দেশে ওষুধশিল্প বিস্তার লাভ করলেও ওষুধ তৈরির কাঁচামালের ৯৭ শতাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এগুলোর অধিকাংশই আসে ভারত ও চীন থেকে। উন্নত বিশ্বের কয়েকটি দেশ থেকেও কিছু কাঁচামাল আসছে। নিম্ন আয়ের দেশ (এলডিসি) হিসেবে বাংলাদেশ ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক সুবিধা পেয়ে আসছে, যা ২০৩২ সাল পর্যন্ত বহাল থাকবে। 

২০২৬ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হলে এই সুবিধা বহাল থাকবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। দেশের ওষুধশিল্প সম্প্রসারণ করলেও সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন থেমে নেই। শুরুতে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এটি নিয়ন্ত্রণ করত। এখন দেশীয় বড় করপোরেটগুলো তাদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। তাদের আগ্রাসী ভূমিকার কারণে ওষুধশিল্পে এ ধরনের অস্থিরতা বন্ধ করা যাচ্ছে না। বড় কোম্পানিগুলোর আগ্রাসী তৎপরতা বন্ধ করা ও এই ব্যবসায় অনৈতিক বিপণন পদ্ধতি বন্ধ করতে হবে সর্বাগ্রে। 

লেখক: ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)
[email protected]

প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় থেকে পদক্ষেপ নিতে হবে

প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৪৩ এএম
প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় থেকে পদক্ষেপ নিতে হবে
ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার

ঢাকায় বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়েই চলছে। বিগত আট বছরের তুলনায় নভেম্বরে দূষণের মাত্রা ১০ ভাগ বেড়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর ২০১৯ সালে হাইকোর্টের নির্দেশে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে নির্দেশিকা প্রকাশ করে। কোন কোন উৎস থেকে বায়ুদূষণ হয় এবং সেটিকে কোন কোন মন্ত্রণালয় কীভাবে  নিয়ন্ত্রণ করবে, সেটি দেওয়া আছে। এই নির্দেশনা অনুসরণ করলেই বায়ুদূষণ কমে আসবে। সবাই যদি আমরা কাজ না করি, তাহলে একা কোনো সংস্থা, অধিদপ্তরের পক্ষে এটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। সবাইকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে। অন্যথায় আমাদের এই দূষণের মধ্যে থাকতে হবে। বায়ুদূষণে নাগরিকদের অংশগ্রহণ কম থাকে। তারা হয়তো বর্জ্য পোড়ায়। তবে এটা উল্লেখযোগ্য না। যানবাহন, শিল্পকারখানা, নির্মাণকাজ, ইটভাটা- এসব থেকে দূষণের পরিমাণটা বেশি হয়। সেগুলো প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় থেকে পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা নাগরিক হিসেবে সচেতন থাকতে পারি। দূষিত এলাকায় কম যেতে পারি। মাস্ক পরতে পারি। 

স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা

বড় সিদ্ধান্ত ছাড়া নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব না

প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৩৮ এএম
বড় সিদ্ধান্ত ছাড়া নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব না
অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান

ঢাকা শহরে বায়ুদূষণে অনেকগুলো উপাদান কাজ করে। বর্তমানে এটা এমন একটা পর্যায়ে চলে গেছে, যেখানে আসলে উন্নতি করার খুব একটা সম্ভাবনা আছে কি না সন্দেহ। এখান থেকে ফিরে আসার লক্ষণ কম দেখা যাচ্ছে। বরং ড্যাপকে (বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা) ধ্বংস করে এই শহরে আরও ভবন বানানোর পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। যত্রতত্র শিল্পকারখানা স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। ব্যবসায়িক গোষ্ঠী এই শহরকে ভোগের পণ্য বানাতে চায়। এখানে কোনো প্ল্যানিং অর্ডার নেই, কোনো কন্ট্রোল নেই। তাই যা হওয়ার কথা, দূষণ বেড়েই চলছে। কোনো একটা সূচকে আমরা আগের চেয়ে ভালো আছি, সে রকম দেখা যাচ্ছে না। শহরটাকে ধ্বংস করা হয়েছে। চীনে বায়ুদূষণের মাত্রা খারাপ হলে অলিম্পিক বয়কটের ডাক আসে। তখন চীন প্রাইভেট কারের ব্যবহার অর্ধেক করে ফেলে। আমাদেরও এ রকম বড় চিন্তা করতে হবে। বড় প্রভাব ফেলতে হবে। ছোট ছোট কোনো কিছু দিয়ে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে বলে মনে হচ্ছে না। পরিকল্পনায় বড় চিন্তা করার মতো উদ্যোগ কোনো সরকারের মধ্যে দেখছি না। এই মুহূর্তে যদি সরকার সিদ্ধান্ত নেয় শহরে কংক্রিট বাড়াব না, ঢাকার আশপাশের ইটভাটা সব বন্ধ করা হবে। এ রকম বড় সিদ্ধান্ত যদি নেওয়া সম্ভব হতো, তাহলে এটা নিয়ন্ত্রণ করা যেত। 

সভাপতি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)

উন্মুক্তভাবে নির্মাণকাজ বন্ধ করতে হবে

প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৩০ এএম
উন্মুক্তভাবে নির্মাণকাজ বন্ধ করতে হবে
স্থপতি ইকবাল হাবিব

বায়ুদূষণের প্রধান কারণ হলো উন্মুক্তভাবে নির্মাণকাজ। ইটের ভাটা থেকে শুরু করে বালুসহ সব কাঁচামাল উন্মুক্তভাবে পরিবহন করা হয়। ভবন হোক, ড্রেন হোক বা অন্য কোনো কাঠামো হোক, সবকিছুই আমরা উন্মুক্তভাবে করছি। এটা বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। ময়লার ভাগাড় থেকে বিভিন্ন ধরনের গ্যাস নির্গমন, যানবাহনের ধোঁয়াও এই দূষণের জন্য দায়ী।

ইটের ভাটা নিয়ে সত্যিকার অর্থে পদক্ষেপ নিলে দূষণ কমে আসত। ইটের ভাটাকে আধুনিকায়নের নামে একটা কারসাজি চলছে। এগুলো আধুনিকায়ন হয়নি সরকারি উদ্যোগের অভাবে। কারণ বাংলাদেশে যত নির্মাণকাজ হয়, তার মধ্যে ৬০ ভাগের বেশি করে সরকার নিজেই। সেখানে তারা ইটের বিকল্প ব্যবহার করে না। সব নির্মাণে ইটের বিকল্প ব্যবহার করতে হবে। ইটের বিকল্প যারা বানাবে, তাদের প্রণোদনা দিতে হবে। সরকারকে তার নিজের নির্মাণকাজে ইটের বিকল্প ব্যবহারে উদ্যোগী হতে হবে। কিন্তু বলা যায়, সরকারের কারণে হচ্ছে না। একই সঙ্গে বড় বড় প্রকল্প উন্মুক্তভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে। সঠিক নিয়ম মেনে করা হচ্ছে না। বায়ুদূষণ সরকারি মদদে বেশি হচ্ছে। সিটি করপোরেশন ড্রেন থেকে ময়লা উঠিয়ে আবার উন্মুক্তভাবে রেখে দেয়। সেটা আবার বাতাসে মিশে যাচ্ছে। সব বিষয়ে কঠোর নজরদারি, দায়বদ্ধতা এবং সরকারিভাবে জরুরি বাস্তবায়ন প্রয়োজন।

সহসভাপতি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)

'), descriptionParas[2].nextSibling); } if (descriptionParas.length > 6 && bannerData[arrayKeyTwo] != null) { if (bannerData[arrayKeyTwo].type == 'image') { descriptionParas[0].parentNode.insertBefore(insertImageAd(bannerData[arrayKeyTwo].url, ('./uploads/ad/' + bannerData[arrayKeyTwo].file)), descriptionParas[5].nextSibling); } else { descriptionParas[0].parentNode.insertBefore(insertDfpCodeAd(bannerData[arrayKeyTwo].custom_code), descriptionParas[5].nextSibling); } } if (descriptionParas.length > 9 && bannerData[arrayKeyThree] != null) { if (bannerData[arrayKeyThree].type == 'image') { descriptionParas[0].parentNode.insertBefore(insertImageAd(bannerData[arrayKeyThree].url, ('./uploads/ad/' + bannerData[arrayKeyThree].file)), descriptionParas[8].nextSibling); } else { descriptionParas[0].parentNode.insertBefore(insertDfpCodeAd(bannerData[arrayKeyThree].custom_code), descriptionParas[8].nextSibling); } } });