কিছু কৌশল অবলম্বন করে তাদের জবাবদিহি ও বিচারের আওতায় আনতে হবে। মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনায় নিজেদের ঢেলে সাজানো দরকার, যাতে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা পুনরুদ্ধার করা যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনা ও মূল্যবোধ সমুন্নত রাখা অপরিহার্য। গণমাধ্যমকে ভয় দেখানো ইতোমধ্যে বিদ্যমান পরিবেশকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। বিপিএসএ যে বিবৃতি প্রদান করেছে, তাতে সংবিধান প্রদত্ত গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে স্থূলভাবে সংকুচিত করার প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই দেখানো হয়নি।...
মহাত্মা গান্ধী উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন যে, প্রত্যেকের চাহিদা মেটানোর জন্য এই পৃথিবীতে সবই আছে। কিন্তু লোভের কোনো শেষ নেই। বাংলাদেশের গণমাধ্যমে দুর্নীতির প্রমাণসহ চিত্র ফুটে উঠেছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে বড় ধরনের দুর্নীতির চিত্র প্রতিদিনই গণমাধ্যমে দেখা যায়। এসব দুর্নীতির খবরে জাতি হতবাক ও বিস্মিত। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান উচ্চমাত্রায় দুর্নীতিগ্রস্ত। এসব অপরাধের জন্য সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে ঝুঁকির সম্মুখীন। এর মধ্যে রয়েছে পুলিশ, র্যাব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের রাজনীতিবিদরা।
যারা দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত, তাদের বহির্গমনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অপরাধ কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা, নিয়মবহির্ভূত সুযোগ এবং ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ এসেছে। সাবেক সেনাপ্রধানের কার্যকলাপ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রক্রিয়ার প্রতি মানুষের বিশ্বাসকে ভেঙে দিয়েছে। বেনজীর আহমেদ চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর দুর্নীতির শীর্ষে তার নাম দুঃখজনক। র্যাবে থাকাকালীন মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। সাবেক পুলিশপ্রধানের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি দুর্নীতি, জালিয়াতি এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। বর্তমানে তিনি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অধীনে রয়েছেন।
এই ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে তিনি তার পেশাজীবনের বহু বছরের অভিজ্ঞতা প্রয়োগ করেছেন। অথচ আইনের রক্ষক হয়ে নিজেই আইন ভঙ্গের রোল মডেলে রূপান্তরিত হয়েছেন। তিনিই শুধু পুলিশ বাহিনীতে এই ধরনের নির্লজ্জ দুর্নীতির একমাত্র উদাহরণ নন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক কমিশনারও ছিলেন এবং সেই সময়েই এমন অনেক অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। এনবিআরের একজন সদস্য এবং কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কর্মকর্তার দুর্নীতির বিষয়টি সবার সামনে চলে আসে। তার ছেলের ছাগল কেলেঙ্কারি এবং পরবর্তীকালে তার পরিবারের আয় ও সম্পত্তির বিশদ বিবরণ তুলে ধরা হয়। তিনি দেশের রাজস্ব আহরণে তার তত্ত্বাবধানে ভূমিকার অপব্যবহার করেছেন। তিনি আয়ের অবৈধ উৎস হিসেবে কর ফাঁকিতে ‘গুরু’র ভূমিকায় রূপান্তরিত হয়েছিলেন। এটা স্পষ্ট যে, তিনি এনবিআরের একমাত্র ব্যক্তি নন, তিনি অন্য অনেকের যোগসাজশে ও সুরক্ষা ছাড়াই বিচ্ছিন্নভাবে দুর্নীতি কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন।
স্বর্ণ চোরাচালানের জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারকারীদের অন্তর্দ্বন্দ্বের বিষয়টিও উঠে এসেছে। একজন এমপির নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও কম উদ্বেগজনক নয়। এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে বছরের পর বছর অবৈধ ব্যবসার সুবিধা দেওয়া হয়েছে। রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মানি লন্ডারিং এবং মানব পাচারসহ আন্তর্জাতিক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য কুয়েতে কারাগারে দণ্ডিত এমপির মামলাও দুর্নীতির একটি বড় উদাহরণ। এটি মোটেও আশ্চর্যের বিষয় নয়। কারণ তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানগুলোকে পক্ষপাতমূলক দখল নিশ্চিত করে রাষ্ট্রকে এই স্তরে নিয়ে গেছে। এ ধরনের বড় দুর্নীতির প্রভাব রাষ্ট্রে অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি করে। এসবের আর্থিক মূল্য কেবল সরকার এবং ওই সম্পর্কিত সংস্থাগুলো দৃঢ়ভাবে পরিমাপ করতে পারবে। সে ক্ষেত্রে সততার সঙ্গে কাজ করতে হবে এবং স্বার্থমুক্ত থাকতে হবে।
অন্যদিকে এনবিআরের এক কর্মকর্তার দুর্নীতির স্তর নিয়ে বিস্তর বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, বাংলাদেশের কর জিডিপির অনুপাত বিশ্বের সর্বনিম্নদের মধ্যে অন্যতম। উচ্চ কর আহরণের জন্য সাধারণ মানুষের ওপর পরোক্ষ করের চাপ প্রয়োগ করা হয়। প্রকৃত করদাতারা প্রায়ই এনবিআরের অসাধু কর্মকর্তাদের কাছে শত্রুতে পরিণত হচ্ছেন। অন্যদিকে কর ফাঁকিবাজরা নিয়মিতভাবে কর এড়িয়ে যাচ্ছেন। কর কর্মকর্তাদের ঘুষ গ্রহণের জন্য সরকারের অন্যান্য বিভাগের চেয়ে সরাসরি ক্ষতি হয়েছে এই কর বিভাগের। কর কর্মকর্তারা অবৈধভাবে কর ফাঁকিদের সহযোগিতা করতে দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। কৌশলে কর ফাঁকির পরিমাণও অনেক বেড়েছে, যা সরাসরি রাজস্ব খাতকে নষ্ট করছে। এনবিআর কর্মকর্তাদের সঙ্গে গোপন চুক্তি করে ব্যবসার মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্নভাবে অবৈধ অর্থ পাচার ও অর্থ পাচারে সহযোগিতা করা হয়েছে।
সব ক্ষেত্রেই শক্তির অপব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু অপরাধীদের কিছুই করা হচ্ছে না। এনবিআরের সাবেক সদস্য বছরের পর বছর এমন দুর্নীতি করে মানুষকে বোকা বানিয়েছে। এনবিআর এ ব্যাপারে তার বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। এটা এখন আর গোপনীয় বিষয় নয় যে, তিনি ব্যবসায়ী, আমলা ও রাজনৈতিক শক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় বহাল তবিয়তে খুব আনন্দের সঙ্গে জীবনযাপন করছেন। দেশের অনার্থিক প্রতিষ্ঠানও দুর্নীতিতে জর্জরিত। সেই সব প্রতিষ্ঠানের অনেক কর্মকর্তাও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত। তাদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
অথচ তারা সেই সব প্রতিষ্ঠানের সুনাম নষ্ট করেছেন। মনে হয় এসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না। এখন এটি সবার সামনে উন্মোচন করা দরকার। কিছু কৌশল অবলম্বন করে তাদের জবাবদিহি ও বিচারের আওতায় আনতে হবে। মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনায় নিজেদের ঢেলে সাজানো দরকার, যাতে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা পুনরুদ্ধার করা যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনা ও মূল্যবোধ সমুন্নত রাখা অপরিহার্য। গণমাধ্যমকে ভয় দেখানো ইতোমধ্যে বিদ্যমান পরিবেশকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। বিপিএসএ যে বিবৃতি প্রদান করেছে, তাতে সংবিধান প্রদত্ত গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে স্থূলভাবে সংকুচিত করার প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই দেখানো হয়নি।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ (টিআইবি)