বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের যে জটিলতা এখন দেখা যাচ্ছে, সেটা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত। এটাও আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ভারতের এই আধিপত্যবাদী যে চেহারা, সেই চেহারার উন্মোচন ঘটানো দরকার। শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নয়, দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও তাদের আধিপত্যবাদী চরিত্র বিদ্যমান। এই সরকারের আগেও ছিল। মূলত এটা তৈরি হয়েছে ভারতে যে বৃহৎ পুঁজির বিকাশকেন্দ্রিক ভবন তার সম্প্রসারণের তাগিদ থেকে। বর্তমানে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সমস্যা, এটিকে হিন্দু-মুসলমান সমস্যা হিসেবে দেখা খুবই ভুল। কারণ নেপাল হিন্দু রাষ্ট্র, তার সঙ্গেও ভারতের অনেক সমস্যা আছে। এ ছাড়া মালদ্বীপ, ভুটান, শ্রীলঙ্কা- এসব দেশের সঙ্গে ভারতের একপেশে মনোভাব বিদ্যমান।
ফলে এসব দেশের মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ ভারতের শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে, তার প্রকাশ ঘটেছে সেসব দেশের সরকারের মধ্যেও। বর্তমানে বাংলাদেশ হচ্ছে সর্বশেষ তালিকায়। সেখানে ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের ক্ষোভ আগে থেকেই ছিল। সরকার পতনের পর ক্ষোভের প্রকাশটা এখন হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধেও পরিচালিত হয়েছে। হাসিনা সরকার ভারতের সঙ্গে নানা শর্তে এমন অনেক চুক্তি করেছে, এমনভাবে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ধারণ করেছে যে, এতে বাংলাদেশের মানুষের ক্ষোভ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের আপামর মানুষকে ভারতের বিরুদ্ধে জাগিয়ে তুলতে বাধ্য করেছে।
আমাদের অভিযোগ সুনির্দিষ্ট। এটা কোনো সাম্প্রদায়িক সমস্যার বিষয় নয়। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আমাদের সীমান্ত হত্যা চলছে বহুদিন ধরে। হাসিনা সরকারের সময় ছিল, এখনো সেটা অব্যাহত আছে। পানিবণ্টন সমস্যা ভারত কখনো সমাধান করতে চায়নি। অসম বাণিজ্য, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশে একচেটিয়া বাণিজ্য করে। কিন্তু ভারত বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের বাধা দিয়ে থাকে।
নেপাল, ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক সৃষ্টির একটা খুব ভালো সুযোগ ছিল। সেখানেও ভারত নানা রকমভাবে বাধা দেয়। তা ছাড়া তারা একচেটিয়াভাবে ট্রানজিটসহ অন্যান্য নানা ধরনের সুবিধা চায়। হাসিনা সরকার তার ক্ষমতার শেষ প্রান্তে এসে ট্রানজিটের এমন অনেক ধরনের সুবিধা ভারতকে দিয়েছে, সেগুলো খুবই অস্বচ্ছ এবং বাংলাদেশের জন্য বিভিন্নভাবে ক্ষতিকর। সেগুলো নিয়ে জনগণের মতামত নেওয়াও হয়নি। জনগণের সম্মতির বিরুদ্ধে গিয়ে এ ধরনের চুক্তিগুলো করা হয়েছে।
ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা। আমরা নিশ্চয়ই এটা স্বীকার করি যে, ভারত রাষ্ট্র বাংলাদেশের পাশেই ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় সহযোগিতা করেছে। তবে এখানে মনে রাখতে হবে যে, রাষ্ট্রের কোনো মায়ামমতা বা সহানুভূতি থাকে না। রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করে তার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কৌশলগত স্বার্থ বিবেচনা করে। সেই স্বার্থ বিবেচনা করে ভারত রাষ্ট্র তখন বাংলাদেশের জনগণকে সহায়তা করেছে। আমাদের এটা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করতে হবে যে, ভারতের জনগণ বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার মানুষ বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর বোঝা বহন করেছে, তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। তাদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করেছে।
ভারতের জনগণের সেই ভূমিকাকে আমরা কোনো দিন ভুলতে পারব না। সব সময় তা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করতে হবে। সেই সঙ্গে এটাও আমাদের মনে রাখতে হবে, ভারতের জনগণের এই ভূমিকার কারণে ভারতের বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী বা বিজেপি সরকারের যেকোনো দাবি মেনে নেওয়ার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। ১৯৭১ সালে বিজেপি বলে কোনো দলও ছিল না। নরেন্দ্র মোদির ভূমিকাও সে সময় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল না। ভারতের জনগণের সহায়তা আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করার অর্থ এই নয় যে, আদানিকে ব্যবসা দিতে হবে। কিংবা নরেন্দ্র মোদির যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কৌশলগত স্বার্থ সেগুলো পূরণ করতে হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কটা হতে হবে বন্ধুত্ব ও সমমর্যাদার।
যেখানে ভারতের শাসক শ্রেণি সব সময় চাইবে বাংলাদেশ অধস্তন রাষ্ট্র হিসেবে থাক। সে ক্ষেত্রে হাসিনা সরকার একটা চরম গ্রুপ তৈরি করেছিল এবং ভারত বাংলাদেশকে অধস্তন রাষ্ট্র হিসেবে অভ্যস্ত হয়ে যেতে বাধ্য করেছিল। হাসিনা সরকারের পতনের পর তাদের মধ্যে ভয় তৈরি হয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ অধস্তন অবস্থান থেকে সরে যাচ্ছে বা যেতে পারে। সেই আশঙ্কা থেকে বিজেপির সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন গোষ্ঠী ভারতে বাংলাদেশবিরোধী একটা ব্যাপক, খুবই অসম্মানজনক, বিতর্কিত, অপপ্রচারে লিপ্ত হচ্ছে এবং সেই অপপ্রচারের মূল বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু জনগণ, হিন্দু জনগোষ্ঠী নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছে। এর থেকে মনে হতে পারে যে, ভারতের সরকার হিন্দু জনগণের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল কিংবা তাদের স্বার্থ রক্ষায় খুবই আগ্রহী। এটা যদি সত্য হতো তাহলে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগণ অনেক ভালো অবস্থায় থাকত।
ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এবং তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হলো হিন্দু জনগোষ্ঠী, হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তারা যে ধরনের শাসন-নিপীড়নের মধ্যে বাস করে এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে বাস করে সেটার চিত্র আমরা বিভিন্ন সময় দেখেছি। বিজেপির সবচেয়ে বেশিসংখ্যক গরিব মানুষ ভারতেই বাস করে। এদের ভারতের সামরিক, বেসামরিক নিপীড়ন-নির্যাতনের বিভিন্ন রকম প্রক্রিয়া তৎপরতা ভারত রাষ্ট্রে আছে। সুতরাং বাংলাদেশের কথা যখন তারা বলে, হিন্দু জনগণের প্রতি মায়া-মহব্বতের ব্যাপার নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করে, তখন তারা আসলে এটাকে একটা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে।
সেই কারণে বিজয়ের মাসে আমাদের কয়েকটা জিনিস নিশ্চিত করতে হবে- ভারত সেটাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে, এই হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়ন, সেই ধরনের ঘটনা যেন কোনোভাবেই না ঘটে। সে ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। কারণ বাংলাদেশে কিছু উন্মাদ লোক থাকতে পারে। যারা সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন এবং সাম্প্রদায়িক তৎপরতা কিংবা জমি দখলের লোভে হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপরে আক্রমণ করতে পারে বা নিপীড়ন করতে পারে। সে রকম ঘটনা যেন না হয়। সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। পাশাপাশি এটা পরিষ্কার করতে হবে যে, যারাই বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা তৈরি করবে তারা আসলে বিজেপির স্বার্থ রক্ষা করছে।
দ্বিতীয়ত, আমাদের মনে রাখতে হবে যে, বর্তমান বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে ভারতের জনগণ ব্যাপক লড়াইয়ের মধ্যে আছে। শোষণ, নিপীড়ন এবং আধিপত্য, সাম্প্রদায়িকতার জন্য ভারতের জনগণও লড়াই করছে। সেখানে বামপন্থি, সংখ্যালগিষ্ঠ জনগণ একই সঙ্গে সংখ্যালঘিষ্ঠ জনগণের চেতনাসম্পন্ন যারা, তারা বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি, নিপীড়নমূলক ভূমিকা, শোষণ এবং আধিপত্য, বৃহৎ পুঁজির স্বার্থ রক্ষা করার জন্য জনগণকে উচ্ছেদ করা- এর জন্য তারাও লড়াই করছে।
সে জন্য বাংলাদেশের দিক থেকে আমাদের উচিত হবে, কীভাবে ভারতের সেই নিপীড়িত জনগণকে সঠিক তথ্য জানানো যায় এবং তাদের সঙ্গে একাত্ম সংহতি করা যায়। একই সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গেও এই সংহতিটা তৈরি করতে হবে। যাতে দক্ষিণ এশিয়া একটা গণতান্ত্রিক অঞ্চলে পরিণত হতে পারে। গণতান্ত্রিক দক্ষিণ এশিয়া প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ভারত একটা বাধা। সুতরাং সেই আধিপত্যবাদী ভূমিকার বিরুদ্ধে দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের সংহতি তৈরি করতে পারলে সেটা সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের জন্য গণতান্ত্রিক এবং বৈষম্যহীন যাত্রার পথ সুগম করবে।
বাংলাদেশে এই বিজয়ের মাসে আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ থেকে ২০২৪ গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যে বাংলাদেশের জনগণ শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সব সময় সজাগ-সচেতন ও সক্রিয় আছে। এই লড়াইয়ের ফলাফল হিসেবে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে হলে দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের সঙ্গে সমঝোতার মধ্যে যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই আরও বেশি সক্রিয় ভূমিকা রাখার পাশাপাশি দেশের প্রতি মনোযোগ বৃদ্ধি করতে হবে।
লেখক: শিক্ষাবিদ