২৩ আমেরিকান নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ কমলা হ্যারিসকে সমর্থন করে একটি খোলা চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন। শুধু দুজন অর্থনীতিবিদ অনেক কিছুতেই একমত হতে পারেননি। তবে আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি, সার্বিকভাবে কমলা হ্যারিসের অর্থনৈতিক কর্মসূচিগুলো যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য, বিনিয়োগ, স্থায়িত্ব, স্থিতিস্থাপকতা, কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং ন্যায্যতাকে উন্নত করবে। তিনি প্রতি উৎপাদনশীল অর্থনীতির তুলনায় দেশকে ব্যাপকভাবে উন্নত করতে পারবেন। নোবেল অর্থনীতিবিদরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, কোনো প্রশ্ন ছাড়াই কমলা হ্যারিস যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির জন্য উত্তম হবেন।...
ডোনাল্ড ট্রাম্প পুঁজিবাদের এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়েছেন, যা শিল্পপতি ও অর্থশালীদের প্রলুব্ধ করেছে। ট্রাম্প কর কমিয়ে এবং অনেকটা শিথিল করে তাদের পুঁজিবাদীদের ইচ্ছা পূরণ করতে চায়। এতে তিনি বেশির ভাগ আমেরিকানের জীবন আরও দরিদ্র, কঠিন এবং খাটো করে তুলবেন।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যতটা কাছাকাছি আসছে, প্রচারণা ততটা তীব্রতর হচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসলে দেশের কী আমূল পরিবর্তন আনবেন সেই প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এ ধরনের প্রতিশ্রুতি দেশের রাজস্বনীতি একদম ভেঙে পড়বে। করপোরেশন এবং বিলিয়নেয়ারদের গাণিতিকভাবে কর কমালে দেশের প্রতিরক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষার মতো মৌলিক কর্মসূচিগুলো টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
ট্রাম্পের প্রচারণার আরও কিছু অযৌক্তিক প্রতিশ্রুতি ইলন মাস্কের কাছ থেকে এসেছে, যিনি ফেডারেল বাজেট থেকে ২ ট্রিলিয়ন ডলার কমানোর কথা বলেছেন। ইলন মাস্ক যার কোম্পানিগুলো সরকারি চুক্তি ও বেলআউটের ওপর অনেক বেশি নির্ভর করে (ওবামা প্রশাসনের কাছ থেকে ৪৬৫ মিলিয়ন ডলার লোন না পেলে ইলন মাস্কের কোম্পানি টেসলা হয়তো ট্রাম্পের অধীনে চলে যেতে পারে)।
ইলন মাস্কের দাবি, ট্রাম্প মার্কিন অর্থনীতি এবং রাজনীতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। ট্রাম্পের প্রস্তাবগুলো সব সরকারি ব্যয়ের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমানোর চিন্তা করছে, যা সাধারণ হিসাব অফিসের চেয়ে আটগুণ বেশি। এতে সরকারের অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষা বিভাগ রাষ্ট্রীয় অপচয় বা জালিয়াতির বিষয় অনুধাবন করছে। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিরক্ষা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ট্রেজারি ও বাণিজ্য বিভাগসহ সব বিবেচনামূলক ব্যয় কমাতে হবে। সেই সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য সুপ্রতিষ্ঠিত এবং ব্যয়বহুল কর্মসূচি হ্রাস করতে হবে।
এ ধরনের কর্তন থেকে বোঝা যায়, ট্রাম্প বিভিন্ন কর্মসূচিতে বড় পরিবর্তন করতে কংগ্রেসকে রাজি করানোর চেষ্টা করবেন। কিন্তু আপনার নিশ্বাস আটকে রাখবেন না। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন ‘প্রশাসনিক রাষ্ট্র’ ভেঙে দেওয়ার জন্য মতো অবস্থায় ছিল। তিনি মার্কিন প্রশাসন চার বছর চালিয়েছেন। এখন তিনি জনগণের কাছে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যাতে তার আগের ঘাটতি পূরণ করতে পারেন।
এ ধরনের ক্ষতিকর কর্তনগুলো মার্কিন অর্থনীতি ও সমাজের ওপর ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলবে। পরিবর্তনশীল চাষাবাদ নীতি নিশ্চিতভাবে ব্যর্থ হবে। হার্বার্ট হুভারের অধীনে ইউএস সেক্রেটারি অব ট্রেজারি অ্যান্ড্রু মেলনের রাজস্ব কমানোর কৌশল যেমন দেশকে বড় বিপর্যয়ের মুখে ফেলেছিল, তেমনি মার্কিন কংগ্রেসে ১৪ বছরের কনজারভেটিভ সরকারের অধীনে কঠোর নীতিগুলো প্রায় দেড় দশকের স্থবিরতায় নিয়ে গেছে।
ট্রাম্প এবং কমলা হ্যারিসের অর্থনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকবে। কমলা হ্যারিসের কর্মসূচিতে জীবনযাত্রার ব্যয় কমিয়ে দেবে। ওষুধ ও শক্তির খরচ কমাতে মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস আইন (আইআরএ) সংশোধন করবে। হ্যারিস আবাসনকে আরও সাশ্রয়ী করে তুলবে, যেখানে ট্রাম্পের শুল্ক (আমদানি পণ্যের ওপর কর) আরও ব্যয়বহুল করে তুলবে। আমেরিকানদের বিশেষ করে মধ্যম ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য এ বিষয়টি কঠিন হয়ে উঠবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিটি বিষয়ই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। ট্রাম্পের নীতি সেই বিষয়গুলোকে আরও জটিল করে তুলবে। এমনকি করোনা মহামারির আগেও মার্কিন জনগণের আয়ুষ্কাল উন্নত দেশের তুলনায় অনেক কম ছিল। ট্রাম্পের সময়ে আরও হ্রাস পেয়েছিল। সাশ্রয়ী মূল্যের সেবা আইন এবং আইআরএ বিধান রয়েছে, যা ওষুধের দাম হ্রাস করে। সেই আইন বাতিল করার লক্ষ্যে ট্রাম্পের প্রচেষ্টা দেশকে আরও শোচনীয় করে তুলবে।
আমেরিকা বৈষম্যের দিক দিয়ে উন্নত অর্থনীতির তালিকায় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। ধনীদের জন্য ট্রাম্পের ট্যাক্স কমানো নীতি অর্থনীতির শীর্ষ অবস্থান থেকে দূরে ঠেলে দেবে। অন্যদিকে, কমলা হ্যারিসের নীতি মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রার মান অনেক উন্নত করবে।
স্বাস্থ্য ও বৈষম্যের সংকট ছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তন আমেরিকানদের জীবন এবং তাদের সম্পত্তির জন্য ব্যপক ক্ষতিকর। তবু ট্রাম্প তার নির্বাচনি প্রচারাভিযানে জীবাশ্ম-জ্বালানি বাড়ানোদের প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি পরিবেশ দূষণের আইনগুলো শিথিল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। পরিচ্ছন্ন শক্তির অর্থনীতিতে উত্তরণের জন্য তিনি শুধু আমেরিকাকে অন্য অনেক দেশের পেছনেই ফেলে দেবেন না; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বড় বিপদের মুখে ফেলে দেবেন।
২৩ আমেরিকান নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ কমলা হ্যারিসকে সমর্থন করে একটি খোলা চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন। শুধু দুজন অর্থনীতিবিদ অনেক কিছুতেই একমত হতে পারেননি। তবে আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি, সার্বিকভাবে কমলা হ্যারিসের অর্থনৈতিক কর্মসূচিগুলো যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য, বিনিয়োগ, স্থায়িত্ব, স্থিতিস্থাপকতা, কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং ন্যায্যতাকে উন্নত করবে। তিনি প্রতি উৎপাদনশীল অর্থনীতির তুলনায় দেশকে ব্যাপকভাবে উন্নত করতে পারবেন। নোবেল অর্থনীতিবিদরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, কোনো প্রশ্ন ছাড়াই কমলা হ্যারিস যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির জন্য উত্তম হবেন।
অনেক আমেরিকান ট্রাম্পের প্রেসিডেন্টের সময় সব ঘটনা ভুলে যেতে বসেছে। কিন্তু আমরা অবশ্যই তা ভুলিনি। ট্রাম্প যাকে তার শত্রু বলে মনে করেছেন, তার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছেন। রিপাবলিকান পার্টির সঙ্গে এখন ব্যক্তিত্বের সম্পর্ক ছাড়া আর কিছুই নেই। এতে কোনো সন্দেহ নেই, ট্রাম্প দ্বিতীয়বার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হলে প্রথম মেয়াদের চেয়ে আরও খারাপ হবে।
যদিও আমেরিকার অর্থনৈতিক শক্তি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে। ট্রাম্প বারবার রাজস্ব থেকে গবেষণা ব্যয় কমানোর প্রস্তাব করেছেন, যা মৌলিক বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য ক্ষতিকর হবে। ট্রাম্প যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন অনেক রিপাবলিকানরাও ট্রাম্পের প্রস্তাবগুলো বেপরোয়া তা বুঝতে পেরেছিলেন। ফলে গত নির্বাচনে তিন ভোট কম পেয়েছিলেন।
অন্য একটি খোলা চিঠিতে যেখানে প্রায় ৮০ জন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ এবং বিজ্ঞানীরা যোগ দিয়েছিলেন। আমরা উল্লেখ করি যে, ‘গত দুই শতাব্দীতে জীবনযাত্রার মান এবং আয়ুষ্কালের
ব্যাপক বৃদ্ধি মূলত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির কারণেই।’ কমলা হ্যারিস এটি স্বীকার করেছেন ও বিষয়গুলো বোঝেন, এই ক্ষেত্রগুলোয় আমেরিকার নেতৃত্ব বজায় রাখার জন্য ফেডারেল সরকার, স্বাধীন বিশ্ববিদ্যালয় এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার বিশেষ প্রয়োজন। কমলা হ্যারিস বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে অভিবাসীরা সবসময় যে ভূমিকা পালন করেছে তাও স্বীকার করেছেন।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, শুধু ইলন মাস্কের কোম্পানিগুলো মৌলিক বিজ্ঞানের ওপর নির্ভর করে। তারপরও ডোনাল্ট ট্রাম্প তার কোম্পানিগুলোকে সহযোগিতা করে নিজের স্বার্থে কাজে লাগিয়েছে। স্বার্থ, কর কমানো এবং আইন শিথিলকরণের জন্য শিল্পপতি ও ধনাঢ্যরা ট্রাম্পের দলে যোগ দিয়েছে। ট্রাম্প পুঁজিবাদীদের জন্য আশ্বাস দিয়েছেন। পুঁজিবাদ মাস্ক ও অন্য বিলিয়নেয়ারদের জন্য ভালো হলেও বাকি আমেরিকানদের জন্য ভালো হবে না। কিন্তু কমলা হ্যারিস যুক্তি দিয়ে বা সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন যাতে আমেরিকানরা আরও স্থিতিস্থাপক, অন্তর্ভুক্তিমূলক, দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিতে পরিণত হতে পারে। তিনি এমন এক অর্থনীতি গড়তে চান, যা পুঁজিবাদকেও ছাড়িয়ে যাবে এবং আমেরিকানরা ন্যায়সংগতভাবে সবাই সুবিধা ভোগ করতে পারে।
লেখক: অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী এবং অধ্যাপক, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও মার্কিন প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কাউন্সিলের সভাপতি।
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল