কমলা হ্যারিস আগস্টে ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কনভেনশনে তার গ্রহণযোগ্যতা বক্তৃতায় এবং কয়েক সপ্তাহ পর ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে টেলিভিশন বিতর্কে তার চিন্তাচেতনা স্পষ্ট করেছিলেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তাহলে পূর্বসূরিদের মতো বিশেষ করে তার বর্তমান নেতা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ডানপন্থি নীতি অব্যাহত রাখবেন।
কমলা হ্যারিস আয়ের সমতা ও দারিদ্র্য মোকাবিলার চেষ্টা করবেন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সহিংসতা সৃষ্টি করে, এমন নীতিগুলো তিনি পরিত্যাগ করবেন। তিনি আমেরিকানদের মধ্যে বর্ণবৈষম্য দূর করার চেষ্টা করবেন।
হ্যারিস যদি এই নির্বাচনে জয়ী হন, তাহলে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অফিসে একজন কৃষ্ণাঙ্গ এবং দক্ষিণ এশীয় নারী অবস্থান করবেন। তবে প্রান্তিক জনগণের খুব বেশি উপকার হবে না। কারণ, তিনি সেই ক্ষমতাকে পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্টদের মতো একই বর্ণবাদী, যৌনতাবাদী ও ইসলামবিদ্বেষী উপায়ে ব্যবহার করবেন।
বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন যখন তাকে কালো বর্ণের আমেরিকানদের জন্য কিছু করার বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তখন বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নই। আমি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।’ প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে কমলা হ্যারিস মূলত একই কাজ করবেন। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ক্ষেত্রে যেমনটি হয়েছিল, তেমনি কমলা হ্যারিস হলেও তা কালো বর্ণের আমেরিকান বা অন্য কোনো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সুসংবাদ বয়ে আনবে না।
আমেরিকানদের প্রথমবারের মতো বাড়ি কিনতে সাহায্য করার জন্য হ্যারিস প্রস্তাব করেছেন ২৫ হাজার ডলার অনুদান, যা শ্বেতবর্ণের আমেরিকানরাই এই সুবিধা বেশি পাবেন। এতে কালো ও অন্যান্য বর্ণের মানুষ বৈষম্যের শিকার হবেন। হ্যারিস নির্বাচনি প্রচারাভিযানে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তাতে প্রথমবারের মতো বাড়ি কেনার ক্ষেত্রে যাদের বাবা-মায়ের ইতোমধ্যে বাড়ি আছে, তাদের ব্যাপারে নির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি।
মনে হচ্ছে, কমলা হ্যারিস সব আমেরিকানকে সাহায্য করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে চান। যদিও তার নীতিগুলো প্রাথমিকভাবে (বেশির ভাগ শ্বেতাঙ্গ) আমেরিকানদের সাহায্য করবে, যারা মধ্যবিত্ত জীবনযাপন করছেন। হ্যারিসের প্রতিশ্রুতি দেওয়া ৩০ লাখ বাড়ির সুবিধা শ্রমজীবী ও দরিদ্ররা নাও পেতে পারেন। প্রজনন অধিকার-সম্পর্কিত হ্যারিসের অঙ্গীকারগুলো নির্দিষ্ট নয়। যারা ইতোমধ্যে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন, হ্যারিসের কথায় তারা আশ্বস্ত হতে পারেননি।
তিনি বলেছেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তিনি ‘রো বনাম ওয়েডকে’ আইনে পরিণত করবেন। জিমি কার্টারের পর থেকে প্রত্যেক ডেমোক্র্যাটিক প্রেসিডেন্ট এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং এখনো তা পালন করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। এমনকি যদি মার্কিন কংগ্রেস এই ধরনের আইন পাস করে, তাহলে অতি ডানপন্থিরা এই আইনকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করবেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেক রাজ্য গর্ভপাতকে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করেছে এবং এটিকে আরও সীমাবদ্ধ করেছে। রো-এর আইন যদি বাস্তবে রূপ নেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৭৩ সাল থেকে যে প্রজনন অধিকার আইন ছিল, সেটাই আবার ফিরে আসবে।
কমলা হ্যারিস যদি নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসেন এবং তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে সক্ষম হন, তাহলে আমেরিকান কালো বর্ণ ও দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাসকারী নারীরা গর্ভনিরোধক, প্রসবপূর্ব গর্ভপাত এবং নবজাতকের যত্ন থেকে বঞ্চিত হবেন। কারণ রো-এর আইন সবকিছুই জাতীয় সেবার অধীন থাকবে। আইনটি কখনোই সবার জন্য সাশ্রয়ী নয়। প্রতিটি রাজ্যে সব নারীর পরিষেবায় সমান সুযোগ থাকবে না।
তিনি আমেরিকার প্রথম নারী ও কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য প্রস্তুত। হ্যারিসের প্রজনন অধিকারের বিষয়টি অস্পষ্ট, এতে নারীদের উপকার কম হবে। বিশেষ করে প্রান্তিক যারা, তাদের ক্ষতি বেশি হবে। কমলা হ্যারিস প্রয়াত অ্যাম্বার নিকোল থারম্যানের মতো কালো মেয়েদের কথা বলেছেন, যারা জর্জিয়ার মতো রাজ্যে প্রজনন অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। কিন্তু তার কথার কোনো অর্থ নেই, শুধু কর্মপরিকল্পনা ছাড়া কিছুই নয়।
সেপ্টেম্বরে এক বিলিয়নিয়র অপরাহ উইনফ্রের সঙ্গে টেলিভিশন সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। তখন তিনি বলেন, ট্রাম্পের সঙ্গে হ্যারিসের আগের বিতর্কের সময় তার কাছে অস্ত্র ছিল। কমলা হ্যারিস হাসতে হাসতে বললেন, ‘যদি কেউ আমার বাড়িতে ঢুকে পড়ে, তাদের গুলি করা হবে।’ ‘যদিও আমার এটি বলা উচিত হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার কর্মীরা পরে এটি মোকাবিলা করবে।’
ভাইস প্রেসিডেন্টকে আত্মবিশ্বাসী বলে মনে হয়েছিল যে, তার এই মন্তব্যটিতে শেষ পর্যন্ত বন্দুক নিয়ন্ত্রণ সমর্থক, বন্দুকের মালিক, ডানপন্থি ভোটারদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করা হচ্ছে। কারণ তারা ট্রাম্পের পক্ষে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকতে পারে। প্রাণঘাতী শক্তির ব্যবহার সম্পর্কে তার বিবৃতিটি ভোট পাওয়ার জন্য বুদ্ধিদীপ্ত ছিল। হ্যারিস একটি সহিংস জাতি ও সংস্কৃতি হিসেবে মার্কিন ইস্যুটিকে তুলে ধরতে চেয়েছেন।
এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে, হ্যারিস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে এমন পদক্ষেপগুলোর কথা বলবেন। যখন তিনি লোকেদের গুলি করার বিষয়ে কথা বললেন, তখন তিনি আক্রমণাত্মক অস্ত্র, ব্যক্তিগত তথ্য অনুসন্ধান ও লাল পতাকা আইনের কথা শোনালেন।
এদিকে ট্রাম্প বলেছেন, কমলা হ্যারিস একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারী। অনেক আমেরিকান মনে করেন, তিনি অন্যান্য প্রেসিডেন্টের তুলনায় কালো বর্ণের আমেরিকানদের সুরক্ষার জন্য আরও বেশি কিছু করবেন। বন্দুক সহিংসতার প্রতি হ্যারিসের মনোভাব দেখে মনে হয়, প্রেসিডেন্ট হ্যারিস তার পূর্বসূরিদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গ নারীসহ প্রান্তিক সম্প্রদায়ের জন্য বেশি নিরাপত্তা ও সুরক্ষা দেবেন। ধারণা করা হচ্ছে, কৃষ্ণাঙ্গ নারী এবং দক্ষিণ এশীয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে কমলা হ্যারিস আমেরিকানদের সহিংসতা হ্রাস করবেন। তবে সারা বিশ্বে কৃষ্ণাঙ্গ, বাদামি এবং এশীয় বর্ণের মানুষদের পঙ্গু করে দিতে পারেন।
তিনি বারবার বলেছেন, ‘আমেরিকায় সর্বদা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ও প্রাণঘাতী যোদ্ধা রয়েছে’- যা নিশ্চিত করবেন। কমলা হ্যারিস স্পষ্ট করেছেন, তার ডেমোক্র্যাটিক এবং রিপাবলিকান উত্তরসূরিদের প্রাণঘাতী, বর্ণবাদী, সাম্রাজ্যবাদী নীতিগুলোর প্রতি সমর্থন দিতে পারেন।
তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে গাজার হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি দেখবেন বলেছেন। একাধিকবার বলা সত্ত্বেও তিনি এবং জো বাইডেন গাজায় যুদ্ধবিরতির বিষয়টি গড়িমসি করে যাচ্ছেন। সত্য কথা হলো, জো বাইডেন ও হ্যারিস গাজার যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করেননি- কারণ তারা চান না। প্রেসিডেন্ট হিসেবে হ্যারিস তার ভবিষ্যৎ প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে কৃষ্ণাঙ্গ, বাদামি এবং এশিয়ানদের জীবনযাপনের ক্ষেত্রে ঠিক ততটাই ভালো থাকবেন, যেমন তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট ও মার্কিন সিনেটর হিসেবে ছিলেন।
এই নির্বাচনে যারা হ্যারিসকে ভোট দিচ্ছেন, তারা সত্যিকার অর্থে কেন তাকে ভোট দেবেন? সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা উচিত। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হিসেবে একজন নারী, দ্বিজাতিক, কৃষ্ণাঙ্গ এবং দক্ষিণ এশীয় নারীকে ঘিরে সারা বিশ্বে উত্তেজনা বিরাজ করছে।
ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সির সময়ে আমরা ফিরে যাচ্ছি না। মার্কিন গণতন্ত্রে যতটুকু অবশিষ্ট রয়েছে তা রক্ষা করার জন্য অনেক আমেরিকান হ্যারিস-ওয়ালজকে সমর্থন করে যাচ্ছেন। কেউ কেউ কমলা হ্যারিসকে মনে করেন যে, একজন কৃষ্ণাঙ্গ ও দক্ষিণ এশীয় নারী হিসেবে তিনি তার মতো দেখতে এমন লোকদের বেশি মূল্যায়ন করবেন। তিনি একবার নির্বাচিত হলে তার পূর্বসূরিদের চেয়ে প্রান্তিক লোকদের অনেক বেশি সমর্থন করবেন বলে অনেকে মনে করেন।
বারাক ওবামা যেমন একবার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন, তেমনিভাবে কমলা হ্যারিস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে চান। তবে কমলা হ্যারিসের ‘ব্ল্যাক আমেরিকা’ বা প্রান্তিকদের প্রেসিডেন্ট হওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। তিনি তার নির্বাচনি প্রচারে এ কথা বারবার স্পস্ট করে বলেছেন। জো বাইডেনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার কাজের মাধ্যমে এটি বারবার স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছেন।
এবারের মার্কিন নির্বাচনে কমলা হ্যারিসকে ভোট দেওয়ার অনেক কারণ নিহিত রয়েছে। তবে অনুমান করা যাচ্ছে, তার প্রেসিডেন্সি প্রান্তিকদের অধিকার এবং সংগ্রামকে সমর্থন করবে।
লেখক: অধ্যাপক, আমেরিকান ইউনিভার্সিটি, ওয়াশিংটন, ডিসি
আল-জাজিরা থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল