ভূরাজনীতির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গত এক দশক ধরে ভূরাজনীতির যে বিবর্তন হচ্ছে এবারের নির্বাচনের মধ্যদিয়ে সেই রাজনীতির চেহারাটা স্পষ্টভাবে বেরিয়ে আসবে বলে মনে হয়। এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ। যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বড় সামরিক শক্তির দেশও বটে। একই সঙ্গে দেশটির কূটনৈতিক প্রভাব মোটা দাগে বেশ উঁচু মাপের বলতে হবে। ২০০৩ সাল থেকে ইরাক-আফগানিস্তানের যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের বেশকিছুটা সক্ষমতার ঘাটতি লক্ষ্য করা গেছে। তাদের সফলতার দৃষ্টান্ত অনেক কমে এসেছে। সামগ্রিক অর্থে মধ্যপ্রাচ্য প্রেক্ষাপটে এবং চীনের সঙ্গে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ত্রিমুখী। সে ক্ষেত্রে বলা যায়, ভূরাজনৈতিক জটিলতার মধ্যদিয়েই এবারের নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
সেদিক বিবেচনায় নির্বাচনটিকে গভীরভাবে পর্যালোচনা করার প্রয়োজন আছে। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক খুব একটা ইতিবাচক নয়। যুক্তরাষ্ট্র চীনকে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করে। আগামী দিনেও এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা বলবৎ থাকবে বলেই মনে হয়। বলা বাহুল্য, চীন এই মুহূর্তে বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশ। সামরিক শক্তির দিক থেকেও দেশটি ধাপে ধাপে তার সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। কাজেই চীন সবদিক থেকেই বৈশ্বিকভাবে তার প্রভাব বাড়িয়ে চলছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আগের শাসনামলে তিনি চীনের বিরুদ্ধে প্রথম শুল্কারোপ করেন। বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সেই শুল্ক বজায় রাখে। পরে বাইডেন প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে আধা সামরিক বা কূটনৈতিক সামরিক একটি কাঠামো তৈরি করেন। এসব কিছুর উদ্দেশ্য হচ্ছে চীনকে একরকম কোণঠাসা করে রাখা। আসলে যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনে যিনি জয়ী হবেন তার ওপর নির্ভর করবে চীনের সঙ্গে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা কমবে নাকি বাড়বে, এটি মনে করার যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। বলা বাহুল্য, এর প্রতিক্রিয়া সারা পৃথিবীজুড়েই ছড়িয়ে পড়বে।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের এই প্রতিযোগিতায় ভারতের একটি অংশগ্রহণ আছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সঙ্গে নিয়ে চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী। অন্যদিকে ভারত ও চীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাঝামাঝি রয়েছে বাংলাদেশ। সে ক্ষেত্রে দুই স্তরের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে আমাদের আটকে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে। একটা হচ্ছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা। অন্যদিকে ভারত ও চীনের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা। উভয় স্তরের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে বাংলাদেশের আটকে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা বেশ ভালোভাবেই পরিলক্ষিত হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে আমরা আমাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে কীভাবে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে পারি সেটা ভেবে দেখার
দরকার আছে।
নির্বাচনে জয়ী হয়ে ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সম্পর্ক সংকুচিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে জলবায়ু সংকট সমাধানে প্রতিশ্রুত সহায়তা এবং রোহিঙ্গাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা অর্থায়ন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশি অভিবাসীদেরও সংকট হতে পারে। কাজেই ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বজায় রাখার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কীভাবে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পারি সেটিও ভেবে দেখা দরকার। বলা বাহুল্য, চীন ও ভারত আমাদের পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে থাকে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের রপ্তানির একটা বড় সম্পর্ক রয়েছে। কাজেই সবাইকে বাংলাদেশের প্রয়োজন আছে। বর্তমান সময় ও বাস্তবতার আলোকে এই সক্ষমতা আরও বাড়ানো জরুরি। নির্বাচন ইস্যুতে রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবও বেশ ভালোভাবেই বিদ্যমান থাকবে। রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কেমন হবে সেটাই বিবেচ্য। কমলা হ্যারিস জয়লাভ করলে সে ক্ষেত্রে রাশিয়াকে যতক্ষণ পর্যন্ত পরাজিত করা সম্ভব না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলবে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, এখনো এই রাষ্ট্রগুলোতে ধ্বংসযজ্ঞ চলছে। বহির্বিশ্বে তার নানারকম প্রতিক্রিয়া হচ্ছে এবং সেটা আরও বাড়তে থাকবে। ট্রাম্প জয়লাভ করলে তিনি যুদ্ধ থেকে বের হয়ে আসবেন। তবে ইউরোপের ভূরাজনীতির যে ইতিহাস, গত ১০০ বছরের ইতিহাস বিবেচনা করলে এই সংঘাত সমাধান খুব একটা সহজ হবে বলে মনে হয় না। ট্রাম্প বলছেন, শক্তি খাটিয়ে তিনি রাশিয়াকে পরাজিত করতে পারবেন। রাশিয়ার জন্য সমঝোতার পথও খোলা রয়েছে। তবে সমঝোতা হলেও তা নিয়ে যথেষ্ট অনিশ্চয়তা রয়েছে। ইউক্রেন তার নিজস্ব ভূমি ছেড়ে দিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে সামঝোতায় যাবে আপাতদৃষ্টিতে তা মনে করার কোনো কারণ নেই।
ট্রাম্প অযৌক্তিক কিছু করতে গেলে তার অন্যরকম একটি প্রতিক্রিয়া হবে। তবে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র তার প্রভাব হারাচ্ছে, এটা মোটামুটিভাবে বলা যায়। ইরাক যুদ্ধের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সক্ষমতার ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। ইরানের সঙ্গে ইসরায়েলের যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে ট্রাম্প জয়ী হলে এ সংঘাত আরও তীব্রতর হবে। তিনি ইসরায়েলকে ফ্রি হ্যান্ড দেবেন অর্থাৎ ইসরায়েল নিজের খেয়াল খুশিমতো যা খুশি তাই করবে। ট্রাম্প প্যালেস্টাইনের বিরুদ্ধে লেবাননের বিরুদ্ধে এবং ইরানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে। সে ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যে একটা নতুন ভূরাজনীতি তৈরি হবে।
যদি ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতায় আসে সেখানে প্রধান শক্তি থাকবে ইসরায়েল। অবশেষে, সেই শক্তির সঙ্গে সমঝোতা করে মধ্যপ্রাচ্য একটি কাঠামো তৈরি করার চেষ্টা করবে। কমলা হ্যারিস ক্ষমতায় এলে ইসরায়েলের এখন যে ভূরাজনৈতিক কাঠামো আছে সেটা বজায় থাকবে। তবে ইসরায়েল বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে অন্য দেশের ওপর অযাচিত প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অর্থনীতি এবং তার পর পরই চীনের অর্থনীতি। অর্থনীতিকে ক্রমাগত শক্তিশালী করতে হলে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে যে সনাতনী পদ্ধতি বিদ্যমান তা দিয়ে চীনের অর্থনীতির সঙ্গে সামাল দেওয়া কঠিন হবে বলেই মনে হচ্ছে। অন্যদিকে যদি কমলা হ্যারিস জিতে যান, সে ক্ষেত্রে পরিকল্পনা পরিবর্তিত হতে পারে। অর্থাৎ চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি একটি স্থিতিশীল পর্যায়ে নিতে সক্ষম হবে। কমলা হ্যারিস জয়ী হলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে নতুনভাবে সাজাতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে মনে হয়। তা সম্ভব হলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি নতুন দিকে মোড় নেবে এবং অর্থনীতিকে আধুনিকায়ন করতে সহায়তা করবে। যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক প্রভাব এখনো পৃথিবীতে বিদ্যমান আছে এবং তার প্রভাব ভূরাজনীতিতে পড়বে।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত