‘আমেরিকায় এই সময় একজন প্রেসিডেন্ট আছেন।’ মার্কিন নির্বাচনে ক্ষমতার উত্তরণসংক্রান্ত এই মন্ত্রটি আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ডেমোক্র্যাটরা সতর্ক করছে যে, সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হলে তিনি ২০১৬ সালের মতো প্রেসিডেন্টের রূপান্তরের সময় নিয়ম ও প্রোটোকল মেনে চলবেন না।
যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি নীতি আছে, তা হলো, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ক্ষমতা গ্রহণের আগে নীতিনির্ধারণে হস্তক্ষেপ করে বিদায়ী প্রেসিডেন্টকে কখনো নিচু করেন না। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। অতীতের প্রেসিডেন্টরা ঐতিহ্যগতভাবে তা মেনে চলেন। আমেরিকায় একদা এক প্রেসিডেন্ট ছিলেন। যেমন- বিল ক্লিনটন, ১৯৯২ সালে এই বিষয়টিকে বেশি জোর দিয়েছিলেন। তিনি নির্বাচনে জয়ের পরে ‘আমেরিকার বন্ধু ও শত্রুদের’ সঙ্গে ভালো আচরণ ও স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন।
প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ এবং বারাক ওবামাও এটি করেছিলেন। কিন্তু ২০১৬ সালে যখন নবনির্বাচিত ট্রাম্প কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তখন সারা বিশ্বে গুঞ্জন শোনা গিয়েছিল। কারণ তিনি আইন ও ঐতিহ্যের লঙ্ঘন করেছিলেন। বিশেষ করে ১৭৯৯ সালের লোগান আইন অনুসারে, আমেরিকান নাগরিকদের অননুমোদিত কর্মকাণ্ড বা বহির্বিশ্বের কোনো সরকারের সঙ্গে অযাচিত আলোচনা মার্কিন সরকারের অবস্থানকে আরও দুর্বল করে দেয়। ইতিহাসবিদদের মতে, এই আইনটি সংবিধানের অধীনে প্রেসিডেন্টের অবস্থান ও ক্ষমতা রক্ষা করে বিশেষ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আচরণ করার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
২০১৬ সালে ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক জ্যারেড হাফম্যান লোগান অ্যাক্ট সংশোধন করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি শুধু চলতি প্রেসিডেন্টের মাধ্যমে পরিচালিত হবে।
এই আইনটি নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের জন্য প্রযোজ্য। বোঝা যায় যে, লোগান আইনটি আমেরিকান নাগরিকদের ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য, তেমনি নির্বাচিত প্রেসিডেন্টদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ২০১৬ সালে নির্বাচনের পরে তিনি দুটি পদক্ষেপের জন্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সমালোচনা করার সময় অনেকেই লোগান আইনের আহ্বান জানিয়েছিলেন।
প্রথমটি ছিল ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েনের সঙ্গে তার ফোনকল। ১৯৭৯ সালের পর থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বা নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের এটি প্রথম ছিল। সেই ফোনকলটি চীনকে ক্ষুব্ধ করেছিল। আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সেই ফোনকলে চীন তাদের নীতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। দ্বিতীয়টি ছিল ইসরায়েলি বসতি বন্ধের দাবিতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে ওবামা প্রশাসনের বিরোধিতা করা। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ এল-সিসি এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে তার প্রেস সচিবের ফোনকলের মাধ্যমে ব্যক্তিগতভাবে হস্তক্ষেপ করেছিলেন, যেখানে তিনি রেজল্যুশন সম্পর্কে কথা বলেছিলেন।
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের রাজনীতির অন্যতম নীতি লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়েছিল। সেন্টার ফর প্রেসিডেন্সিয়াল ট্রানজিশন অনুসারে ক্রান্তিকালীন একজন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ঐতিহ্যগতভাবে বিদেশি নেতাদের সঙ্গে খুবই কম নিযুক্ত হন। আমেরিকার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সব সময় এক নীতিতে চলবে, বিশেষ করে জাতীয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতির বিষয়ে নিশ্চিত করবেন।
প্রেসিডেন্সিয়াল ট্রানজিশন বিশেষজ্ঞ এবং ডেমোক্র্যাটরা বলছেন, ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ট্রাম্প স্টেট ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে সমন্বয় না করেই বিভিন্ন দেশের নেতাদের কাছ থেকে ফোনকলে কথা বলেছিলেন। আমেরিকা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে অনেক গুরুত্ব বহন করে, তাই তাদের নীতিগুলোর ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করে।
২০১৬ সালে আমেরিকার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার আগে যখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন, তখন যুক্তরাষ্ট্রের অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। ট্রাম্পের সমালোচকরা উদ্বিগ্ন যে, এবারে তিনি নির্বাচিত হলে তিনি একই কাজ করবেন। জো বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় না করেই তিনি পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।
এই মাসে রিপাবলিকান প্রার্থী তার সমর্থকদের বলেছেন, তিনি নেতানিয়াহুর সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন। ইসরায়েলে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রতিক্রিয়া কীভাবে করবে তা জানতে চাইলে তিনি নেতানিয়াহুকে বলেন, ‘আপনার যা করতে হবে তা করুন। লোগান আইনে উল্লেখ আছে, কূটনৈতিকভাবে বেপরোয়া কাজ করা ঠিক নয়, বরং এটা বড় ধরনের অপরাধ।’
ডেমোক্র্যাটিক দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের সঙ্গে বিতর্কে ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগেই ইউক্রেন যুদ্ধের নিষ্পত্তি করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। যদিও ট্রাম্প নিঃসন্দেহে ইউক্রেনের পরিস্থিতির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু এই কথা বলাতে বিরোধীরা তার মধ্যে গোঁড়ামির লক্ষণ দেখেছিলেন যে তিনি নিয়ম লঙ্ঘন করবেন।
কার্নেগি এনডাউমেন্টের সিনিয়র ফেলো অ্যারন মিলার বলেন, ট্রাম্পের কারও কাছে পৌঁছানোর দরকার নেই। কারণ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিসহ সবাই তার সঙ্গে যোগাযোগ করছে। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, ট্রাম্প তাদের অবশ্যই প্রতিশ্রুতি দেবেন, কিন্তু তিনি আইনের মাধ্যমে তা প্রয়োগ করবেন না। মিলার ট্রাম্পকে আইন লঙ্ঘনকারী হিসেবে দেখেন। এখানে লোগান আইন বা অন্য কোনো আইনের প্রশ্ন নয়। এটি ঘটতে যাচ্ছে। ট্রাম্প ছাড়া আর কেউ এই বিষয়গুলো থামাতে পারবে না। তার নিজেকেই সংশোধন করতে হবে।
তবে মনে হচ্ছে, নিয়ম লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে ট্রাম্প শুধু একা নন, জেফরি মাইকেলস ও অ্যান্ড্রু পেইনসহ অনেকেই। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও পররাষ্ট্রনীতি ঐতিহ্যগতভাবে সাংবিধানিকভাবেই বাস্তবতা মেনে হওয়া উচিত।
মিলার স্বীকার করেছেন, নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট প্রায়ই পররাষ্ট্রনীতিতে হস্তক্ষেপ করেন। তবে বিদায়ী প্রেসিডেন্টের অনুমোদনের দরকার আছে। ১৯৮৮ সালের সেক্রেটারি অব স্টেট জর্জ শুটজ থেকে জেমস বেকারের ট্রানজিশনের সময় নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে (প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন)-এর সংলাপ সাজাতে সাহায্য করেছি, যা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল।
নির্বাচন এবং ট্রাম্পের বর্তমান অবস্থান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বিভক্ত হয়ে পড়েছে। ট্রাম্প জিতলে যে খুব বেশি পরিবর্তন হবে তেমন নয়। আমেরিকা তাদের নিঃশ্বাস ধরে রেখেছে এবং আশা করছে যেন ২০২১ সালের পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
লেখক: জাতিসংঘে লেবাননের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও ভিজিটিং রিসার্চ স্কলার, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি
আরব নিউজ থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল