ঢাকা ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি এবং আমাদের জাতীয় স্বার্থ

প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৪৬ এএম
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি এবং আমাদের জাতীয় স্বার্থ
মুন্সী ফয়েজ আহমদ

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে আমরা অনেক কিছুই নতুন করে ভাবার চেষ্টা করছি। এ জন্য অনেকেই বলার চেষ্টা করছেন, পররাষ্ট্রনীতিতেও নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতির আমূল পরিবর্তন করতে হবে, এমনটা ভাবা সমীচীন নয়। জাতীয় প্রয়োজনে, জাতীয় স্বার্থের সাধারণত পরিবর্তন হয়। প্রায়ই দেখা যায়, রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কূটনীতিতেও বড় রকমের পরিবর্তন হয়। এটা সঠিক নয়। আমাদের রাজনৈতিক একটা পরিবর্তন হয়েছে। তাই বলে পররাষ্ট্রনীতিতেও পরিবর্তন আনতে হবে, এমনটি নয়। অনেকেই মনে করেন, আগে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি ভারতের ওপর বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল ছিল।

 আমরা চেষ্টা করব তা কমাতে এবং সে ধরনের চিন্তাভাবনা হচ্ছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত আমাদের চারপাশ বেষ্টিত করে আছে। আমাদের পরস্পর নির্ভরশীলতা, তা পরস্পরের নিরাপত্তার জন্য। অন্যান্য ক্ষেত্র, যেমন- সামাজিক উন্নয়নে নির্ভরতা, সেটা কখনো কমে যাবে না। এ অবস্থার মধ্যেও চীনের সঙ্গে আমাদের গভীর সম্পর্ক। তার কারণ হলো আর্থসামাজিক উন্নয়ন অর্থাৎ আমাদের যে প্রয়োজনগুলো আছে, তা পূরণে চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমরা ভূমিকা রাখছি। যদিও আমাদের মতামত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মেলে না। তার পরও তারা আমাদের বিভিন্ন জায়গায়, যেমন- মানবাধিকার অথবা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, উন্নয়ন, এসডিজি- সব ক্ষেত্রেই আমাদের অবস্থানগুলো প্রায়ই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে যায়। তার পরও তারা আমাদের গুরুত্ব দেয় বা তারা আমাদের কাজ করতে বাধা দেয় না। ফলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমরা বড় ধরনের সক্রিয়তা দেখাতে, একই সঙ্গে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হই। যেটা আমাদের জন্য মঙ্গলজনক।

 পৃথিবীতে বড় ধরনের যেসব সংলাপ চলছে, সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সম্ভব হয়। আমাদের নিরাপত্তা, আর্থসামাজিক উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক মহলে আমাদের ভূমিকা- এই তিনটি বিষয়ে ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এ ছাড়া জাপান, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া- সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এখন আপেক্ষিক গুরুত্বের কথা যদি বলি- কোন দেশ কোন বিষয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেটা মাথায় রাখতে হবে।

 ভারতের সঙ্গে আমাদের যে সম্পর্কটা ছিল, এখন সেখানে কিছুটা টানাপোড়েন চলছে। আমাদের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা বা ভারসাম্য বজায় রাখার ইঙ্গিত দিয়ে আসছেন। ভারতের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আমাদের ক্ষোভ আছে। তার পরও ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অতি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং বিশেষ করে আমাদের প্রধান উপদেষ্টা দুজনের মতামত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি মনে করি, তারা দুজনই সঠিক জায়গায় আছেন। ভারতের সঙ্গে আমাদের ভালো সম্পর্ক থাকতে হবে এবং সেটার জন্য কাজ করতে হবে। অন্যদিকে ভারতকেও আমাদের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। ভারতের যারা পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করেন, তারা দুই দেশের সম্পর্ককে ভালোভাবে রক্ষা করায় আগ্রহী। সুতরাং মূল বিষয়টিতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। 

আমাদের অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। ডলারসংকট চলছে। বাজেট বাস্তবায়ন করতে অসুবিধা হচ্ছে। আমাদের আর্থিক সাহায্যের প্রয়োজন আছে। সেখানে  যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তারা নিজেরা সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারে এবং গুরুত্বপূর্ণ যে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো আছে, যেমন- বিশ্বব্যাংক, আইএসএফ, এদেরও অনুপ্রাণিত করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আগে যা প্রত্যাশা করিনি, এখন আমরা তা করতে পারি। এটা ইতিবাচক দিক।

 যুক্তরাষ্ট্র আমাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিন ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে; ভারতীয়রাও ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু সেটা সম্ভব নয় নানান কারণে। তাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের যে স্তর তা আমাদের স্তরের চেয়ে অনেক আলাদা। আমাদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য তারা যা দিতে পারে, সেটা গ্রহণ করা অনেক ক্ষেত্রেই ঠিক হবে না। কারণ তারা যা দিতে চায় তার বিনিময় হিসাব অনেক বেশি, যা আমাদের পক্ষে বহন করা কঠিন। আমরা আর্থিক সাহায্য চাইতে পারি। তবে তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু নিয়ে ব্যবহার করা আমাদের জন্য খুব সহজ নয়। সেখানে আমাদের বড় রকমের পরিবর্তন আসবে না। সে জন্য চীনের সঙ্গে আমাদের যে অবস্থানটা ছিল, অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনেও সেখানে তেমন কোনো টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়নি। 

আমরা যে ভূরাজনীতির কথা বলি, সেই কারণে কিছুটা দায় সৃষ্টি হতে পারে বা টানাপোড়েনও হতে পারে। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থটাই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চীনের থেকে যে জিনিসপত্র কিনি, তার বদলে চীন আমাদের কাছ থেকে ভূরাজনৈতিক স্বার্থ আদায় করে না। তারা কোনো চাপ দেয় না। কোনো অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সারা পৃথিবীতে তারা এভাবেই কাজ করে থাকে। একসময় তারা বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করত, তখন তারা কমিউনিজমকে বাইরে রপ্তানি করার চেষ্টা করত। এখন তারা এসব করে না। তারা কোনো দেশেরই অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা থেকে সাধারণত বিরত থাকে। ফলে বিভিন্ন সহযোগিতায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। আমাদের দেশের সঙ্গেও তাই করে। এ জন্য তাদের সঙ্গে আমাদের তেমন টানাপোড়েন সৃষ্টি হবে না। 

আমাদের যদি বেশি মূল্য দিতে হয়, তাহলে আমাদের সরে আসা উচিত। কারণ স্বাভাবিকভাবে আমাদের অর্থসংকট আছে। ইচ্ছা করলেই যেকোনো জিনিস কিনতে পারি না। সে জন্য আমাদের সতর্কতার মধ্যে থাকতে হবে। আমাদের তিন দেশের সঙ্গে যে সম্পর্ক, ঘুরেফিরে সেখানেই থাকবে। এখন সাময়িকভাবে কিছুটা সমস্যা সৃষ্টি হলেও হতে পারে- যা স্বাভাবিক। আমরা যদি জাতীয় স্বার্থের কথা চিন্তা করি, এখানে কয়েকটি কথা খেয়াল করার দরকার আছে- আমাদের জাতিস্বার্থের প্রথম কথা ‘নিরাপত্তা’। নিরাপত্তার বিষয়ে যদিও ভারতের সঙ্গে কিছুটা টানাপোড়েন চলছে, তবু এমন কোনো লক্ষণ দেখা যায় না যে, আমাদের ভৌগোলিক নিরাপত্তা হুমকির মুখে। আন্তর্জাতিক আইনকানুন যে রকম আছে, আমরা অনেক নিরাপদ বোধ করি। বিভিন্ন রকম সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু টানাপোড়েন সৃষ্টি হতে পারে। তার পরও আমরা শঙ্কাগ্রস্ত নই। আগে থেকেই আমরা আর্থসামাজিক উন্নয়নের ওপর জোর দিতে পারি। সে ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন হবে না।

বর্তমানে আমাদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। প্রথম কাজ হলো অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তারা বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা। আমরা যদি দীর্ঘমেয়াদি অবস্থায় এগিয়ে যেতে পারি, তাহলে আমাদের সমস্যা তেমন থাকবে না। এখন আমরা আগের মতোই আর্থসামাজিক উন্নয়নের যে লক্ষ্যটি আছে তার ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে পারব। সেই কারণে চীনের সঙ্গে সম্পর্কটা গুরুত্ব বেশি পায়। তার মানে এই নয় যে, ভারতের সঙ্গে গুরুত্ব কমে যাবে। তবে ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা বৃদ্ধি করা জরুরি। ভারতের সঙ্গে আমাদের যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আছে, যেমন- টেকনোলজি ও খাদ্যপণ্য, সেগুলোও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। চীনের পরই ভারতের অবস্থান। যদিও চীন অনেক বেশি এগিয়ে গেছে। আবার যুক্তরাষ্ট্রও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের সহায়ক শক্তি। তারাও আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তারাই আমাদের রপ্তানির প্রধান গন্তব্য। আমরা যা কিছু উৎপাদন করি, বিশেষ করে মূল রপ্তানি দ্রব্য তৈরি পোশাক, যার বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে ইউরোপের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। 

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, যাদের সক্ষমতা আছে, বিশেষ করে যে দেশগুলো থেকে সাহায্যের প্রয়োজন, সেখানেও যুক্তরাষ্ট্রের বিরাট ভূমিকা আছে। মনে রাখতে হবে, একেক দেশ একেক বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের বর্তমান নেতা যারা আছেন, যারা দেশ চালাচ্ছেন, তারা অনেক বোঝেন। আবার তাদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন যারা পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে অনভিজ্ঞ। বাংলাদেশ অনেক দেশের তুলনায় কম শক্তিধর দেশ। সে জন্য সম্ভাবনার পাশাপাশি বিপদের আশঙ্কাও বেশি। ফলে ভুল করলে মাশুল দিতে হতে পারে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। সে জন্য আমরা যেন অতীতের ভুলগুলো এড়িয়ে চলতে পারি, সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। 

লেখক: সাবেক রাষ্ট্রদূত

বাশারের পতনে আরব অঞ্চলে কী বার্তা দেয়?

প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:২৩ পিএম
বাশারের পতনে আরব অঞ্চলে কী বার্তা দেয়?
রামি জি খৌরি

গত ৮ ডিসেম্বর দুই সপ্তাহেরও কম সময় ধরে চলমান অভ্যুত্থানের পর সিরিয়ায় বিরোধী বাহিনী দামেস্কে প্রবেশ করে এবং বাশার আল-আসাদ শাসনের অবসান ঘোষণা করে। বিদ্রোহীরা রাজধানীতে প্রবেশের ঠিক আগমুহূর্তেই সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট ও তার পরিবার বিমানে দেশ ছেড়ে চলে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল সৃষ্টির পর বাশার আল-আসাদ পরিবারের শাসনের অর্ধশতাব্দীর অবসান ঘটিয়ে সিরিয়ান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকে আধুনিক আরব অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক মোড় হিসেবে দেখা উচিত। ১৯৫০-এর দশক থেকে সামরিক শাসনের মাধ্যমে আরবের স্বৈরশাসকদের মতো দেশ পরিচালনা করে যাচ্ছিল বাশার আল-আসাদের পরিবার। দীর্ঘদিন ধরে আরব সমাজে আধিপত্য বিস্তার করে দেশকে ধ্বংসের পথে নিয়ে গেছেন তারা। 

অনেকেই বাশার আল-আসাদের উৎখাতকে উদযাপন করছেন। আবার অনেকেই ভাবছেন সিরিয়ায় বিভিন্ন স্থানীয় এবং বহিরাগত শক্তির প্রভাব থাকার কারণে পরবর্তী সময়ে দেশে কী হতে পারে। সিরিয়ার জনগণ শালীন জীবনযাপন করতে চায়, যেখানে সম্মানের সঙ্গে বসবাস করবে এবং তাদের কথা শোনা হবে। আমরা আশা করব, অচিরেই সিরিয়ায় নতুন ও স্থিতিশীলতা এবং শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। লম্বা দাড়ির মানে কী, পশ্চিমাদের তা বিশ্লেষণ করার মূর্খতা বন্ধ করা উচিত।
 
সিরিয়ার শাসন ও গৃহযুদ্ধের ধ্বংসাত্মক গল্পের অর্থ কী হতে পারে, তা এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বাশার আল-আসাদের অধীনে সিরিয়া কখনোই অনন্য ছিল না। বরং এটি ছিল দাম্ভিকতায় ভরা এবং ধ্বংসাত্মক। আরব রাষ্ট্রীয় শক্তির বড় উদাহরণ যা আঞ্চলিক শক্তি ও বিভিন্ন গোষ্ঠীর সহায়তায় অর্ধশতাব্দী ধরে এই অঞ্চলকে ধ্বংস করেছে। চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে সিরিয়াবাসীকে। 

বাশার আল-আসাদের সরকার আরব অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারে দীর্ঘস্থায়ী সামরিক শাসন ও বিদেশিদের দ্বারা সমর্থিত ছিল। তারা ছিল পারিবারিকভাবে স্বৈরাচারী; যা সিরিয়ার জনগণ, অর্থনীতি এবং জাতীয় অখণ্ডতাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। 

সিরিয়ার বর্তমান যে পরিস্থিতি তা আরব দেশে স্বৈরাচারের সব দুর্বলতা প্রকাশ করে। এ ধরনের স্বৈরাশাসন যেভাবে যেখানেই টিকে থাকুক, সেটা অবশ্যই আমাদের সমাজ থেকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে মূলোৎপাটন করতে হবে। এর পেছনে রয়েছে প্রকৃত বহুত্ববাদের অভাব, বিশ্বাসযোগ্য অংশগ্রহণমূলক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জবাবদিহির অভাব, সামরিক ও পুলিশি বর্বরতা, ব্যাপক কারাদণ্ড, নির্যাতন ও মৃত্যু। এতে দেশের ভেতরে অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় উচ্চবিত্তদের মধ্যে দুর্নীতির জন্ম দেয়। দেশে জীবনমানের মধ্যে গভীর বৈষম্য দেখা দেয়। নাগরিক ও রাষ্ট্রের মধ্যে কোনো কাঠামোগত সংযোগ নেই, ফলে এমন নীতি তৈরি হতে পারে, যেখানে শাসিতদের নিজের অভিপ্রায় ও ইচ্ছা প্রতিফলিত হয়। 

গামাল আবদেল নাসেরের ১৯৫২ সালের মিসরীয় বিপ্লব সামরিক শাসনের মাধ্যমে আরবে ধ্বংসাত্মক উত্তরাধিকারের সূচনা করেছিল। ফলে ১৯৬৭ সালে আরব সেনাবাহিনীর কাছে ইসরায়েলের পরাজয়ের পর তা আরও দ্রুত প্রসারিত হয়েছিল। বাশার আল-আসাদের বাবা হাফেজ আরব অফিসারদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন; যিনি পরবর্তী দুই দশকে বিভিন্ন আরব দেশে ক্ষমতা দখল করেন এবং তাদের মাটিতে পুঁতে ফেলার চেষ্টা করেন। 

এই স্ব-আরোপিত অফিসাররা তাদের কয়েক দশকের শাসনামলে যুদ্ধ চালাতে বা কার্যকরভাবে শাসন করতে পারেননি। ফলে ১৯৯০-এর দশক থেকে কিছু ধনী তেল উৎপাদনকারী দেশের বাইরে বেশির ভাগ আরব তাদের উপযুক্ত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, চাকরি, পর্যাপ্ত খাদ্য, পানি, বিদ্যুৎ এবং অন্যান্য মৌলিক প্রয়োজনীয়তার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। 

আঞ্চলিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, আরবদের ছোট অংশ (বেশির ভাগই তেল উৎপাদনকারী রাজ্যে) আরামদায়ক জীবনযাপন করে। অন্যদিকে আরবের সংখ্যাগরিষ্ঠরা রাজনৈতিক অধিকার বা সম্মানজনক জীবনযাপন উপভোগ করেন না। আরব সমাজে বৈষম্য ও দারিদ্র্য ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

দমন-পীড়নের মাধ্যমে আরব সরকারগুলো তাদের নাগরিকদের নিষ্ক্রিয়, বাকস্বাধীনতাহীন ও নপুংশক ভোক্তায় রূপান্তরিত করেছে। এদের মধ্যে অনেকেই দেশত্যাগ করতে চান। এসব দমন-পীড়ন আরব নাগরিকদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ, ভয় এবং হতাশার জন্ম দিয়েছে। তারা রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করছেন এবং দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। তারা ইসরায়েল বা বিদেশি শক্তির হুমকির মুখে নিজেদের রক্ষা করতে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। বেঁচে থাকার জন্য তারা ছোট উপজাতীয়, ধর্মীয় বা মতাদর্শিক গোষ্ঠী থেকে পিছু হটছেন। 

সামরিকীকরণ ক্ষমতার মডেলকে চ্যালেঞ্জকারী সবচেয়ে শক্তিশালী আরব আন্দোলনগুলো ছিল ইসলামপন্থি- উভয়ই সশস্ত্র এবং শান্তিপূর্ণ। সিরিয়ায় যখন একটি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ আন্দোলন নৃশংস সামরিক শক্তির সঙ্গে মুখোমুখি হলো, তখন বিদ্রোহ দ্রুতই একটি গৃহযুদ্ধে রূপান্তরিত হয়। এতে জাতীয় সংহতিকে ক্ষুণ্ন করে, সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর আরও বেশি বিস্তার ঘটে এবং বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপের সূচনা করে।

সিরিয়ায় যা ঘটেছে তা সব আরব স্বৈরশাসকদের জেগে ওঠার আহ্বান হওয়া উচিত। যে আরব রাষ্ট্র সাংবিধানিক বা নির্বাচনি উপায়ে তার জনগণের বিশ্বাসযোগ্যতা ও বৈধতা পায়নি, সেই অঞ্চল দীর্ঘকাল এমন স্বৈরশাসনের বাস্তবতা সহ্য করতে পারে না।

আমি অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে আরব সমাজ এবং নাগরিকদের অবস্থা পর্যালোচনা করেছি। অবশেষে এই উপসংহারে পৌঁছেছি, একটি আরব দেশও স্থিতিশীল রাষ্ট্র, প্রকৃত সার্বভৌমত্ব, নাগরিকত্ব এবং টেকসই ও ন্যায়সংগত মানব উন্নয়নের চারটি মূল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। 
সিরিয়ায় প্রত্যেক সাধারণ নাগরিকের স্বাধীনতা ও মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার যে অদম্য ইচ্ছা তা বিশ্বকে এক ধরনের সংকেত দিয়ে যায়। আরবদের বিদ্যমান রাষ্ট্র ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে বহির্বিশ্বের যে ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে তা বেশির ভাগই আরব জনগণের জন্য ব্যর্থতা বয়ে আনবে। 

লেখক: বিশিষ্ট ফেলো, আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুত। 
আল-জাজিরা থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল

তরুণসমাজের দিকে নজর দিন

প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:১৭ পিএম
তরুণসমাজের দিকে নজর দিন
মো. সাখাওয়াত হোসেন

একজন তরুণের বিপথগামী হওয়ার পেছনে নানাবিধ কারণ রয়েছে। কিছু কারণের জন্য রাষ্ট্র দায়ী, আবার কিছু কারণের জন্য সমাজ দায়ী এবং কিছু কারণ পরিবার থেকে সৃষ্ট। বিপথগামী হওয়ার কারণগুলোকে চিহ্নিত করে সমাধানকল্পে তরুণদের জন্য আগামীর সম্ভাবনার বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয়ে সর্বসম্মতভাবে ঐক্যবদ্ধ উপায়ে কাজ করে যেতে হবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে, সে জায়গায় কীভাবে ব্যবস্থা নিয়ে তরুণদের সামনের পথকে সুগম করে তোলা যায়, তার জন্য চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। সামগ্রিক উপায়ে স্থিতিশীল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে, যা টেকসই ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। 

সাম্য, মানবিকতা ও ন্যায়ের সমাজ গড়ে তুলতে হবে এবং সে লক্ষ্যে কাজ চালিয়ে যেতে হবে। কাজ সম্পাদনে প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়, সৃষ্ট প্রতিকূলতাকে মাড়িয়েই সামনের দিকে পথ চলতে হবে। যেখানে প্রত্যেকেই সমান সুযোগ লাভ করতে পারবে- এমন একটি সমাজব্যবস্থা বিনির্মাণ করতে হবে। মানুষের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা থাকবে, স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের সুযোগ থাকবে এবং সংগঠন করার অধিকার নিশ্চিত হবে। বিশেষ করে উঠতি বয়সী তরুণদের ক্ষেত্র তৈরি করে দিতে হবে; যেখানে দৃঢ় প্রত্যয়ে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণে একটি উন্মুক্ত পৃথিবীর পরিবেশ তারা পেতে পারে।

তরুণদের মধ্যে হতাশা, বিচ্ছিন্নতা ইত্যাদির কারণে তারা পথচ্যুত হয়ে যাচ্ছে। কিশোর অপরাধের হার ও মাত্রা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পথচ্যুত হওয়া এবং কিশোর অপরাধে জড়িত হওয়ার পেছনের কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে। পরিবার ও শিক্ষকদের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। সমাজকাঠামো ও সমাজ ব্যবস্থাপনাকে আরও জোরদার ও অগ্রগামী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। প্রয়োজনে যাদের মধ্যে কিছু বিচ্যুত আচরণ পরিলক্ষিত হয়, তাদের জন্য বিশেষ যত্নের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। সংশোধন সেন্টারের উদ্যোগগুলোকে আধুনিক ও প্রায়োগিক হিসেবে গড়ে তোলা। অন্যের প্ররোচনায় প্ররোচিত হয়ে সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে তরুণদের মধ্যে।

 এ প্রবণতা থেকে তরুণদের বের করে নিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে। দেখা যায়, তরুণদের একটি অংশ যাচাই-বাছাই ছাড়া অপতথ্যের ওপর নির্ভর করে ধ্বংসাত্মক কর্মে লিপ্ত হচ্ছে। আবার অনেকেই তরুণদের কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করছে। এ দুষ্টচক্র থেকে তরুণদের মুক্ত রাখতে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। অন্যথায় তরুণদের মধ্যে অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা কোনোভাবেই রোধ করা সম্ভব হবে না। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আন্তরিকতা, হৃদ্যতা ও পারস্পরিক মেলবন্ধনের মাধ্যমে পরস্পর পরস্পরের খোঁজখবর নেওয়ার মাধ্যমে তরুণদের পরিবারের প্রতি ভরসা ও আস্থার জায়গা তৈরি হয়। এ প্রেক্ষাপটে তরুণদের মধ্যে অন্যায়-অনিয়ম থেকে দূরে থাকার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। 

তরুণদের মধ্যে মেধা আছে, দেশপ্রেম আছে, আছে আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত। আমাদের কাজ হবে তরুণদের সঠিক পথে পরিচালনা করা। যেসব তরুণ বিপথগামী হচ্ছে কিংবা অপকর্মে জড়িয়ে যাচ্ছে, তাদের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, সঠিক গাইডলাইন ও যত্নের অভাবে তরুণদের পথচ্যুত হওয়ার অসংখ্য উদাহরণ বিদ্যমান। আবার এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে, যেখানে দেখা যায় জেলফেরত অনেকেই সঠিক পথের দেখা পাওয়ায় নতুন জীবনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পেয়েছে। কাজেই তরুণদের নতুন পথের সন্ধান দিতে হবে, যেখানে তারা নিজেদের ভাগ্যান্বেষণে নতুনত্বের স্বাদ গ্রহণ করতে পারে। সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ভূমিকা রাখার মানসে ব্রতী হয়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পায়, প্রত্যেকেই মেধাবী এবং প্রত্যেকের জীবনে সফল হওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা থাকে।

 কিন্তু দেখা যায়, দেশের সেরা বিদ্যাপীঠে অধ্যয়ন করেও অনেকে হারিয়ে যায় জীবনের গতিপথ থেকে। কেন তারা হারিয়ে যায়, কেন রাষ্ট্রের জন্য সুফল বয়ে আনতে পারছে না, এর পেছনের কারণ চিহ্নিত করে সব শিক্ষার্থীর জন্য নিরাপদ পরিবেশ ও সুনিশ্চিত ভবিষ্যতের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুদায়িত্ব। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলোয় কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের চাপমুক্ত রাখার পাশাপাশি সুশৃঙ্খল পরিবেশের আবহ সৃষ্টি করতে হবে। 

জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার একটি প্রবণতা রয়েছে অধিকাংশের মধ্যে। এ থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে। সবাইকে প্রকৌশল বিদ্যায় পড়তে হবে, বিষয়টা এমন নয়। যার যে বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে তাকে সে বিষয়ে অধ্যয়নের সুযোগ দেওয়া উচিত। আবার রাষ্ট্রের উচিত প্রত্যেক নাগরিকের জন্য কর্মের জোগান নিশ্চিত করা। কর্মের নিশ্চয়তাই পারে শিক্ষার্থীদের সঠিক জ্ঞানার্জন ও জ্ঞানার্জনের আগ্রহকে শাণিত করতে। আবার সব সময় যে সরকারের ওপর নির্ভর করতে হবে, ব্যাপারটি আদতে তেমন নয়। 

বেসরকারি পর্যায়ে যারা দায়িত্বশীল ও যাদের সামর্থ্য রয়েছে, তাদের উচিত হচ্ছে তরুণদের সামনের পথচলাকে সুগম করা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেখা যায়, কৃতী গ্র্যাজুয়েট নির্মাণে বেসরকারি পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠান নির্মিত হয়েছে। যেখান থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও দেশের প্রতিনিধিত্ব করছে এবং দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও অবকাঠামো বিনির্মাণে বেসরকারি সেক্টরের যে ভূমিকা অন্য দেশে পরিলক্ষিত হয়, বাংলাদেশে তেমন উল্লেখযোগ্য উদাহরণ লক্ষ করা যায় না। এ ক্ষেত্রে যারা দায়িত্বশীল তাদের মধ্যে এক ধরনের অনীহা দেখা যায়। যোগ্য শিক্ষার্থী গড়ে তুলতে ব্যর্থ হলে আধুনিক শিল্পবিপ্লব ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না। কাজেই বেসরকারি উদ্যোক্তাদের এ বিষয়ে নজর দেওয়া উচিত। 

পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে এবং পৃথিবীর এই অগ্রসরমাণতা চলমান থাকবে। বিশ্ব বাজার ব্যবস্থাপনায় প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে যোগ্য নাগরিক ও দক্ষ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে, এ ঘাটতি পূরণের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উভয় সেক্টরে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সরকারের সীমাবদ্ধতা ও সামর্থ্য নিয়ে আমাদের জানা রয়েছে, সরকারের ওপর সব দায় অর্পণ করা সমীচীন নয়। আবার বেসরকারি পর্যায়ে যারা রয়েছেন, তাদেরও সামাজিক দায়বদ্ধতার ব্যাপারে কিছুটা হলেও সচেতন হওয়া উচিত, উদ্যমী হওয়া উচিত। নিজস্ব উদ্যোগে কর্মহীন যুবকদের জন্য কর্মের সংস্থান নিশ্চিত করাও দায়িত্বশীলদের দায়িত্বের মধ্যে বর্তায়।

 আবার বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোক্তা হয়ে যারা ক্যারিয়ার গড়তে চান, তাদের জন্য সরকারের বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করে নতুনদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নতুন বার্তা দিতে পারে। দেখা যায়, উদ্যোক্তাদের ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে নানা ধরনের ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয়।   

সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিতে গুরুত্বারোপ করতে হবে। প্রতিবছর দেখা যায় অসংখ্য হেক্টর জমি পতিত অবস্থায় থাকে। কোনো জমি পতিত রাখা যাবে না- এই মর্মে সবাইকে অবহিত করতে হবে। পতিত জমিতে যদি সঠিকভাবে চাষাবাদ হয়, তাহলে দেখা যাবে দ্রব্যমূল্য অনেকাংশে কমে আসবে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ক্ষেত্রে বিদেশ নির্ভরতাও কমে আসবে। আবার বিদেশ থেকে যে সাহায্য কিংবা অনুদান আসে তার সঠিক ব্যবস্থাপনা জনগণের সামনে সরকারের তরফ থেকে উপস্থাপন করতে হবে। 

দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে এবং যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ উদ্ধারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। মূল্যস্ফীতি কমাতে সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমাতে সরকারের বিশেষ টিমের টহল বাড়ানোর পাশাপাশি দোষীদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে অন্যদের জন্য উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে।  

দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার তাগিদে রাষ্ট্রের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। যেখানে অন্যায়-অনিয়মের ঘটনা ঘটবে, সেখানেই প্রতিবাদ করতে হবে। কেননা দেখা যায় অন্যায়-অনিয়মের পর্যায় পার হয়েই অপকর্ম ও অপরাধের ঘটনা ঘটে থাকে। শুরুতেই অনিয়মকে পদদলিত করা সম্ভব হলে অপরাধকর্ম সংঘটিত হওয়ার সুযোগ থাকে না। তাই দৃঢ় প্রত্যয়ে বাংলাদেশের শান্তি ও সুরক্ষা রক্ষার স্বার্থে অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে শূন্যসহিষ্ণু নীতি প্রয়োগ করা উচিত। 

লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected] 

ডেঙ্গু: চিকিৎসা ও জনসচেতনতা বাড়াতে হবে

প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৫১ এএম
ডেঙ্গু: চিকিৎসা ও জনসচেতনতা বাড়াতে হবে
ডা. মুশতাক হোসেন

দেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বিস্তৃত নয়। আমাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা অবশ্যই বিস্তৃত করতে হবে। একই সঙ্গে মাধ্যমিক স্বাস্থ্যসেবা বাড়ানো দরকার। জনবান্ধব পরিকল্পনা করতে গেলে আমাদের জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। সেটা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একার কাজ নয়। এর সঙ্গে স্থানীয় সরকার এবং জনগণ একসঙ্গে কাজ করবে। জনসচেতনতার পাশাপাশি ডেঙ্গু রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। শুধু মশা মারার জন্য সচেতনতা নয় বরং রোগপ্রতিরোধে শহর ও গ্রামাঞ্চলে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। যেমন- লিফলেট, পোস্টার, ক্লিপিং, ব্যানার, র্যালি, প্রাক 
মিছিল- এটা একটা অংশ। সে ক্ষেত্রে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে।...

দেশে ডেঙ্গু মোকাবিলায় রোগীকেন্দ্রিক চিকিৎসার যে আয়োজন, তা যথেষ্ট নয়। রোগ নিরাময়ে আমাদের রোগীকেন্দ্রিক চিকিৎসা দিতে হবে। ডেঙ্গু এডিস মশাবাহিত একটি রোগ। এই সমস্যা যথাযথভাবে দূর করতে হলে কিছু প্রাথমিক বিষয় সম্পর্কে সবাইকে জানতে হবে। বর্তমানে ডেঙ্গুতে হাজার হাজার লোক আক্রান্ত হচ্ছে। ডেঙ্গু কোনো জটিল রোগ নয়। অসাবধানতার কারণে ডেঙ্গু একটা সাধারণ রোগ থেকে জটিল অবস্থায় চলে গেছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে দ্রুত তা শনাক্ত করতে হবে। একই সঙ্গে প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা দিয়ে তাকে ভালো করতে হবে। মনে রাখতে হবে, শুধু চিকিৎসা দিয়ে সব মানুষকে ডেঙ্গু থেকে মুক্ত রাখা সম্ভব নয়। কাজেই ডেঙ্গু সমস্যা দূরীকরণে জনগণভিত্তিক বা কমিউনিটিভিত্তিক পরিকল্পনা দরকার।

বলাবাহুল্য, দেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বিস্তৃত নয়। আমাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা অবশ্যই বিস্তৃত করতে হবে। একই সঙ্গে মাধ্যমিক স্বাস্থ্যসেবা বাড়ানো দরকার। জনবান্ধব পরিকল্পনা করতে গেলে আমাদের জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। সেটা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একার কাজ নয়। এর সঙ্গে স্থানীয় সরকার এবং জনগণ একসঙ্গে কাজ করবে। জনসচেতনতার পাশাপাশি ডেঙ্গু রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। শুধু মশা মারার জন্য সচেতনতা নয় বরং রোগপ্রতিরোধে শহর ও গ্রামাঞ্চলে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। যেমন- লিফলেট, পোস্টার, ক্লিপিং, ব্যানার, র্যালি, প্রাক মিছিল- এটা একটা অংশ। সে ক্ষেত্রে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে।

 সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্যকর্মীসহ ছাত্রছাত্রী ও সাধারণ মানুষ নিজের হাতে কাজ করলে যেটা শিখবে, সেটা কখনো ভুলবে না। জনগণকে সংগটিত করা ছাড়া এ কাজ  হবে না। ঘরবাড়ি পরিষ্কার না রাখলে, সেখানে মশা উৎপন্ন হয়ে বাড়িতে ডেঙ্গু ছড়াবে। এডিস মশা অন্য যেকোনো সুস্থ মানুষকে কামড়ালে তা অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে। কাজেই আপনার একার বাড়ি পরিষ্কার রাখলে হবে না। পাশের বাড়িতে এডিস মশা উৎপন্ন হচ্ছে কিনা, তা দেখতে হবে। সবাইকে একসঙ্গে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী, ইচ্ছুক জনগণ, তারা নিজেরা হাত লাগিয়ে পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করবে অর্থাৎ ভলান্টিয়ার হিসেবে তারা কাজ করবে। পড়াশোনার পাশাপাশি ভলান্টিয়ার হিসেবে তাদের কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। এতে তারা উৎসাহ নিয়ে কাজ করবে। শুধু চিকিৎসা নয়, ডেঙ্গু মোকাবিলায় জনসচেতনতা বাড়ানো ও জনগণকে সম্পৃক্ত হতে হবে। 

ডেঙ্গু মহামারি রোগ না হলেও এর প্রাদুর্ভাব মহামারির চেয়ে কমও নয়। এবার ডেঙ্গুতে প্রচুর মানুষ মারা গেছে। একই সঙ্গে এর স্থায়িত্বকালও অন্যান্য বছরের তুলনায় ব্যাপক। এখনো বহু রোগী আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু সে তুলনায় প্রয়োজনীয় তারা স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে না। হাসপাতালমুখী চিকিৎসার চেয়ে নিজেরা সচেতন হয়ে এই রোগ মোকাবিলা করার মনোভাব তৈরি করতে হবে। রোগ হলেই লোকজন ভয় পেয়ে হাসপাতালে ভর্তির জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। হাসপাতালে সব রোগীর সঠিক চিকিৎসা দেওয়া কঠিন। এতে তাদের সুচিকিৎসা পাওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। কতগুলো হাসপাতাল আছে, হাসপাতালে কত ব্যাগ স্যালাইন আছে, কতজন ডাক্তার আছে- সেটা তো শেষ কথা। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী আগে প্রাথমিক চিকিৎসা কীভাবে পেতে পারে সেটা দেখতে হবে। রোগ হলেই হাসপাতাল, আইসিইউ, ক্রিটিক্যাল 
কেয়ার- সেখানে ভিড় বাড়ানো হয়। মনে রাখতে হবে, সেগুলো সবশেষে উচ্চমাত্রার জটিল চিকিৎসাসেবা। ডেঙ্গু প্রতিকারে জনসচেতনতার পাশাপাশি জনপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

যখন কোনো লোক অসুস্থ বোধ করবে তাকে অবশ্যই ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে হবে। সেই পরীক্ষা যেন নিজের পয়সায় সবাই করতে পারে, সে ব্যবস্থা থাকা দরকার। যারা গরিব মানুষ অর্থাৎ যারা দিন আনে দিন খায়, তাদের জন্য হাসপাতালের ব্যয়ভার বহন করা কঠিন। ডেঙ্গু হলে প্রথম চিকিৎসা হচ্ছে বিশ্রামে থাকা- যার বাসায় বিশ্রাম করার সংগতি নেই, তাকে সেকেন্ডারি কেয়ার হাসপাতালে রাখতে হবে। 

সবচেয়ে বড় কথা, এই রোগ একেবারে নিরসনে গুরুত্ব দিতে হবে। বছরের পর বছর ডেঙ্গু চলতে দেওয়া- এই মানসিকতা পরিবর্তন করা খুবই জরুরি। প্রতি বছর ডেঙ্গুতে মানুষ মারা যাচ্ছে। অথচ ডেঙ্গু কোভিডের মতো অজানা রোগ নয়। এটাকে প্রতিরোধ করা যায়, চিকিৎসা দিয়ে সারিয়ে তোলা যায়। কাজেই এই রোগ খুব বেশি ক্ষতিকর কোনোভাবেই বলা যায় না। সঠিক জ্ঞান ও সুচিকিৎসা দিয়ে এই রোগ সহজেই সারিয়ে তোলা সম্ভব। ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ বহু বছর কাজ করেছে। এখন ডায়রিয়ায় কেউ মারা যায় না। আগে কলেরা, ধনুষ্টংকার ইত্যাদি রোগেও লোকজন মারা যেত। এখন সেসব সমস্যা নেই। একইভাবে ডেঙ্গু  প্রতিরোধ করতে পারলে আমরা বড় ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা থেকে মুক্তি পাব। 

দেশে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বাস্তবায়ন করতে হবে। সে ক্ষেত্রে কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিট, স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোয় চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য পেশাজীবী, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মী প্রভৃতি জনবল নিযুক্ত করে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে। শুধু রোগনির্ণয় ও রোগীর চিকিৎসা নয়, এখানে রোগ প্রতিরোধমূলক সেবা, স্বাস্থ্য উন্নয়নমূলক সেবা কার্যক্রমও থাকবে। গ্রামে কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা হাসপাতাল থাকলেও সরাসরি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে ভিড় করেন রোগীরা। 

শহরে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য আউটডোর (বহির্বিভাগ) ব্যবস্থা আছে বড় বড় মেডিকেল কলেজে। মাধ্যমিক পর্যায়ের সেবাও দেওয়া হয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেগুলো খুবই দুর্বল এবং মানুষের কাছে অজানা- ফলে এগুলো প্রায় অব্যবহৃত হয়েই পড়ে থাকে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও জরুরি স্বাস্থ্যসেবা যদি আমরা তৃণমূল পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি তাহলে আকস্মিক জরুরি রোগী ছাড়া অন্য রোগীদের জন্য সুপারিশ পদ্ধতি বাধ্যতামূলক করা যাবে। সুপারিশ করা রোগীর সুবিধা হলো তারা কোনো পদ্ধতিগত ঝামেলা ছাড়াই সুপারিশমতো উচ্চপর্যায়ের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা, দরকার হলে হাসপাতালে ভর্তি হতে পারবেন। মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বিশেষায়িত হাসপাতালে সব সময় ভিড় লেগে থাকবে না। 

প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে শক্তিশালী ও সার্বক্ষণিক সচল রাখতে হলে স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। অর্থের সংস্থান, জনবল নিয়োগ, প্রয়োজনীয় কেনাকাটা প্রভৃতি বিষয়ে পরিসর আরও অনেক বাড়াতে হবে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অর্থ ব্যবস্থাপনা, আইটি ব্যবস্থাপনা, তথ্য ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষ জনবল নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। রোগীর স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য তথ্য ডিজিটাল মাধ্যমে সংরক্ষণ, বিশ্লেষণ ও ব্যবহার উপযোগী করতে হবে। 

ই-স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কার্যকর হলে তৃণমূলে মানুষের স্বাস্থ্যসেবার দক্ষতা অনেক গুণ বাড়বে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও তৃতীয় স্তরের স্বাস্থ্যসেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য আদান-প্রদান সঙ্গে সঙ্গেই ঘটবে। এজন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ও পর্যাপ্ত সম্পদ বরাদ্দ করতে হবে। তৃণমূল পর্যায় থেকে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়াতে হবে। এতে স্বাস্থ্য খরচ অনেকটা কমে আসবে। স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়ালে একটা  সুস্বাস্থ্যকর  প্রজন্ম গড়ে উঠবে। দেশের বিশৃঙ্খলা কমে যাবে, অসন্তোষ কমে যাবে। একটা সুখী প্রজন্ম তৈরি হবে। কাজেই, সুস্বাস্থ্যকর একটি সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। 

লেখক: সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে  গণপ্রতিরোধ এবং বহির্বিশ্বের হাত

প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৪৮ এএম
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে 
গণপ্রতিরোধ এবং বহির্বিশ্বের হাত
অ্যালেক্স ব্রোঞ্জিনি ভেন্ডার

জো বাইডেন এবং ট্রাম্প উভয়েই পররাষ্ট্রনীতিতে সংশোধনবাদ যুক্তি দিয়েছেন। বিশ্বের একটা অংশ চীন বলয়ের দিকে চলে যাওয়ার কারণে এমনটা হয়েছে। আমেরিকার পতনকে ঠেকানোর জন্য বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থাকে উল্টে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। ট্রাম্পের চীনবিরোধী নীতির জন্য একটু চিন্তা করা প্রয়োজন।...  

১৯৮৬ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের সময় জ্যঁ বদ্রিলার্দ ভ্রমণ ডায়েরি ‘পৃথিবীতে একমাত্র অবশিষ্ট আদিম সমাজ’ লিখেছিলেন। তিনি তার ভ্রমণ ডায়েরিতে শতাব্দীর শেষে আমেরিকান আধিপত্যের প্রকৃতি সম্পর্কে একটি প্যারাডক্স বর্ণনা করেছেন। বদ্রিলার্দ লিখেছেন, ‘আমেরিকান শক্তি তার নিজস্ব কোনো চেতনা বা প্রতিভা দ্বারা অনুপ্রাণিত বলে মনে হয় না’। কিন্তু এটি এক অর্থে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও তর্কাতীত। আমেরিকার ‘সাফল্য’ আগে তাদের বিরোধিতাকারী সব শক্তির দুর্বলতা থেকে ভুগছে। বদ্রিলার্দের কাছে আমেরিকান কৌশলগত চিন্তাধারায় অসঙ্গতি ছিল। 

এখন ইন্দো-প্যাসিফিক যাকে বলা হয়, শুধু সে অঞ্চলই নয়, আজ আমেরিকার প্রতিপক্ষ বিশ্বের সর্বত্রই বিরাজ করছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় গত মঙ্গলবারের অভ্যুত্থানে জো বাইডেন প্রশাসনের কোনো হাত আছে বলে মনে হয় না। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইওন সুক ইওলের গণতান্ত্রিক শাসন উৎখাতের প্রচেষ্টা অনেক কম। এ ব্যাপারে বাইডেন প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে। ভ্রমণ ডায়েরি লেখার সময় স্টেট ডিপার্টমেন্ট আশ্বাসের বাইরে সামান্য কিছু বলেছে যে, দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে আমেরিকার জোট কিছুটা শক্ত লোহার মতো। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ার বিপদের সময় পাশে থাকবে।

ইওন নিজেও কোনো ধরনের কৌশলগত যুক্তি প্রদর্শন করেন না। এই অভ্যুত্থানে দক্ষিণ কোরিয়ায় রাষ্ট্র ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে দেশের ভেতরে অভিজাত শ্রেণি সংঘর্ষে জড়ায়নি। এমনকি ইওনের নিজের দলও এই অভ্যুত্থানকে সমর্থন করেনি। সমর্থন শুধু সামরিক বাহিনীতে সীমাবদ্ধ ছিল। 

এই অভ্যুত্থানটি বিশৃঙ্খল এবং জুয়া খেলার মতো নির্ভরশীল ছিল। দক্ষিণ কোরিয়ায় রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করে ইওনের অঘোষিত সংবাদ সম্মেলনের পর মধ্য রাতে সুশীল সমাজ একত্রিত হতে ব্যর্থ হয়। সামরিক আইনের পক্ষে একক সংসদীয় ভোট নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়ে ইওন ভোর ৫টার মধ্যে তার ঘোষণাটি ফিরিয়ে নেন। তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ প্রায় নিশ্চিতভাবেই অভিশংসনের দিকে এবং অতি শিগগিরই আনুষ্ঠানিকভাবে পদ থেকে অব্যাহতি নিতে বাধ্য হবেন। 

দক্ষিণ কোরিয়ার এই অভ্যুত্থান ছিল স্বল্পস্থায়ী। মঙ্গলবারে যেসব ঘটনা ঘটেছে তা কেবল ডানপন্থি-জনতাবাদী দলের কাজ বলে ধারণা করা হচ্ছে। তিন ঘণ্টার এই জাতীয় সংকট নিশ্চিতভাবে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনীতিকে বদলে দেবে। তবুও ধারণা করা হচ্ছে, জো বাইডেনের ইন্দো-প্যাসিফিক নীতির চূড়ান্ত কৌশলেই দক্ষিণ কোরিয়ায় এমন অভ্যুত্থান ঘটেছে। চীনকে কিছুটা অবদমিত করতেই এমনটা করা হয়েছে। ইওনকে আলিঙ্গন করাসহ উদার-গণতান্ত্রিক মিত্র এবং এশিয়ায় মার্কিন নীতির প্রভাবের কারণেই এমনটা হয়েছে। 
ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাইডেন প্রশাসনের কৃতিত্ব হলো আমেরিকান-জাপানি-কোরিয়ান ত্রিপক্ষীয় চুক্তি (জারোকাস)।

 এটি মার্কিন নেতৃত্বাধীন যৌথ নিরাপত্তা চুক্তি; যা চীনকে মোকাবিলার উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে। ২০২৩ সালের আগস্টে মার্কিন প্রেসিডেন্ট দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইওন এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ক্যাম্প ডেভিড শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। এটি ত্রিপক্ষীয় অংশীদারির একটি নতুন যুগ বলে ঘোষণা করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ক্ষতিপূরণের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার অনুরোধের অবসান ঘটাতে ইওনের ইচ্ছার কারণে একটি শীর্ষ সম্মেলন সম্ভব হয়েছিল।

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনবিরোধী ব্লককে একত্রিত করার জন্য ইওনের অংশগ্রহণ জো বাইডেন প্রশাসন আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করেছে। গত ফেব্রুয়ারিতে ডেপুটি সেক্রেটারি অব স্টেট কার্ট ক্যাম্পবেল পরামর্শ দিয়েছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইওন নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য। গত এপ্রিলে রাষ্ট্রীয় নৈশভোজে ইওন তার অতিথিদের আমেরিকান পিঠা পরিবেশন করেছিলেন। তার পর ডন ম্যাকলিনের স্বাক্ষরিত একটি গিটার উপহার দেওয়া হয়েছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হোয়াইট হাউসের এই আকর্ষণীয় বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচার হয়েছিল।
 
দক্ষিণ কোরিয়ার গণতন্ত্রের প্রতি ইওনের স্পষ্ট অবজ্ঞা ছিল। উত্তর কোরিয়ার আক্রমণের অভিযোগ এনে গত মঙ্গলবার সামরিক আইন ঘোষণা করা হয়। এর প্রতিবাদে ইওনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী স্লোগান দেন কোরিয়ার জনগণ। আমেরিকা মনে করে ইওনের ইচ্ছাগুলো বন্ধ করা শুধু ক্ষমাযোগ্য পাপই নয়, বরং এটি কৌশলগত দিক থেকে বিশেষ প্রয়োজন।  

ঐতিহাসিক অ্যাডাম টুজ বলেন, জো বাইডেন এবং ট্রাম্প উভয়েই পররাষ্ট্রনীতিতে সংশোধনবাদ যুক্তি দিয়েছেন। বিশ্বের একটা অংশ চীন বলয়ের দিকে চলে যাওয়ার কারণে এমনটা হয়েছে। আমেরিকার পতনকে ঠেকানোর জন্য বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থাকে উল্টে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। ট্রাম্পের চীনবিরোধী নীতির জন্য একটু চিন্তা করা প্রয়োজন।  

বাইডেন, যিনি ট্রাম্পের আক্রমণাত্মক কথাগুলো ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রচারণা চালিয়েছিলেন। বাইডেন ইস্পাত শুল্ক নিয়ে ডব্লিউটিওর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছেন। আমেরিকান মিত্রদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাইডেন প্রশাসন চীনা বৈদ্যুতিক যানবাহনকে বিদেশি বাজারে ছড়িয়ে পড়া রোধে বিশ্বব্যাপী চাপ সষ্টি করে। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি রবার্ট লাইটিজারকে প্রশাসন বিশ্বয়কর ব্যক্তি বলে মনে করে। বাইডেন প্রশাসনের ভূ-অর্থনীতি ট্রাম্পের মতোই উগ্র।

ট্রাম্প এবং বাইডেন প্রেসিডেন্সির অধীনে আমেরিকান মিত্রদের নতুন আদর্শ আরও দৃঢ় হয়েছে। আমেরিকান সংশোধনবাদের সঙ্গে নিয়মভিত্তিক আদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। কেউ নিয়মভিত্তিক আদেশ মেনে চলে কিনা তা দেখা পরের বিষয়। ইসরায়েলের মতো ইরানের প্রভাবের নেটওয়ার্ককে উপড়ে ফেলার প্রচেষ্টা নিঃশব্দে স্টেট ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে সমর্থন করা হয়েছে (যদিও এটি ইসরায়েলি যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত)। ইওনের গণতন্ত্রবিরোধী প্রবণতা সবসময় বাইডেন প্রশাসনের কাছে অনুমোদিত ছিল। এমনকি রাশিয়া নিজেই সংক্ষিপ্তভাবে এই মান পূরণ করেছে।

মধ্যপ্রাচ্যে, ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল এবং অন্যত্র এই সংশোধনবাদ দ্বিদলীয় পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তিতেই হওয়া উচিত। অর্থনীতির এক সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক দেশে এই শতাব্দীর প্রথম অভ্যুত্থান বাইডেন প্রশাসনের জন্য দুঃখজনক। 

লেখক: নিউইয়র্কে বসবাসকারী একজন লেখক
দ্য গার্ডিয়ান থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল

ঢাকার খেলার মাঠ এবং পার্ক সংস্কার

প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৩১ পিএম
ঢাকার খেলার মাঠ এবং পার্ক সংস্কার
ইকবাল হাবিব

নগরকে শিশুবান্ধব, জনবান্ধব, সর্বোপরি পরিবেশবান্ধব করে গড়ে তোলার জন্য পার্ক ও খেলার মাঠ সংস্কার এবং নির্মাণের পাশাপাশি শিশুদের জন্য আরও স্থান তৈরি (Place Making) করতে হবে। এই স্থানগুলো কানাগলি, রাস্তার পার্শ্বস্থ অংশ, যেকোনো জমির অংশ অথবা খাল বা নদীর পাশে উন্মুক্ত জায়গা হতে পারে। সঠিক এবং ন্যূনতম উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে একটি স্থানকে শিশুদের খেলার জায়গায় রূপান্তরিত করা সম্ভব।...


সূচনালগ্ন থেকেই একটি নগর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিকশিত হয়, নগরব্যবস্থা পরিপক্ব হয়ে ওঠে। নগরের সড়ক, স্থাপনা, উন্মুক্ত স্থানসহ বিভিন্ন উপাদান সময়ের সাক্ষ্য বহন করে চলে। নগরের এই বৈশিষ্ট্যগুলোকেই তরুণ প্রজন্ম বর্তমান হিসেবে আলিঙ্গন করে আর প্রবীণ প্রজন্ম এর মাঝে লালন করে অতীতের স্মৃতি। পরিবর্তনশীল এই নগর এবং সমাজ একটি চক্রের মতো চিরন্তন ছন্দে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে হস্তান্তরিত হয়। রাজধানী ঢাকাও এর ব্যতিক্রম নয়। 
মোগল আমলে গণপরিসর ছিল মূলত বাজার, যা চক নামে পরিচিত ছিল। এ ছাড়া গণপরিসর হিসেবে উদ্যান বা বাগানের পাশাপাশি স্বতঃস্ফূর্তভাবেও এ ধরনের স্থান গড়ে উঠেছিল। 

মহল্লাগুলোয় প্রায়ই সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান বা সমাবেশ আয়োজিত হতো। কিংবদন্তি স্থপতি মাজহারুল ইসলামের বর্ণনা অনুসারে, এসব মহল্লার নোড বা সংযোগস্থল বিভিন্ন অনুষ্ঠান এবং ধর্মীয় সভা আয়োজনের জন্য জনপ্রিয় ছিল, যা দৈনন্দিন প্রয়োজনীয়তা পূরণের পাশাপাশি পারস্পরিক যোগাযোগ ও মানবমিথস্ক্রিয়ার চাহিদাও পূরণ করত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই চর্চাগুলো হারিয়ে গেছে, নতুন আঙ্গিক প্রতিস্থাপিত হয়েছে। বিগত দিনগুলোতে মূলত বাগান, চক, মহল্লা বা সড়কের বিভিন্ন সংযোগস্থলই এ ধরনের কার্যকলাপের আয়োজনস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হলেও বর্তমানে ক্যাফে, রেস্টুরেন্ট এবং কফি শপগুলো ক্রমপরিবর্তনশীল এই নগরের পুরোনো রীতি এবং স্থানগুলোর পরিপূরক হয়ে উঠেছে।

পরিবর্তিত আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক আবহের মধ্য দিয়ে ঢাকার গণপরিসর বিভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। একসময় অসংখ্য ঐতিহ্যের আবাসস্থল ঢাকা, বর্তমানে নতুন সংস্কৃতি এবং পরিবর্তিত সামাজিক প্রেক্ষাপট ও কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে, নতুন রূপ ধারণ করেছে।

বর্তমান প্রেক্ষাপট

একটি নগরের ইতিহাস ও সংস্কৃতি এবং তার সংরক্ষণ, শুধু নগরদর্শনের জন্যই নয়, বরং আগামী প্রজন্মের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক প্রজন্মেরই তার নিজস্ব কিছু স্থান থাকে, কিছু নিদর্শন থাকে, যা সদাপ্রবাহমান সময়ে অমোঘ পদচিহ্ন রেখে যায়। কিন্তু আজকের এই ঢাকায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য স্মৃতিকাতর বা স্মৃতিবিধুর কোনো স্থান কি তৈরি করা সম্ভব? উল্লেখ্য, ঢাকায় খোলা জায়গা ও প্রবেশযোগ্য পার্কের অভাব রয়েছে এবং একটি সমীক্ষা মতে, নগরের ৪০ শতাংশ বাসিন্দা কখনো পার্কে যান না।

জাতিসংঘ প্রণীত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি)-এর ১১ নম্বর অভীষ্ট হলো ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক, নিরাপদ, অভিঘাতসহনশীল এবং টেকসই নগর ও জনবসতি গড়ে তোলা।’ যার অন্যতম লক্ষ্যমাত্রা হলো ‘২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য বিশেষ করে নারী, শিশু, প্রবীণ ও প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য নিরাপদ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অবারিত (প্রবেশাধিকারযুক্ত) সবুজ ও অন্য উন্মুক্ত স্থানে সর্বজনীন প্রবেশাধিকার প্রদান।’ এ ছাড়া একটি নগরে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় সবুজের পরিমাণ কমপক্ষে ২৫ শতাংশ থাকার কথা থাকলেও ঢাকায় বর্তমানে এই সবুজের পরিমাণ মাত্র ৮ শতাংশ। ঢাকা শহর ২০০২ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে গড়ে ৬.৫ শতাংশ সবুজ হারিয়েছে। ফলে অত্যধিক কংক্রিটকরণের কারণে শহরটি ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা বৃদ্ধি অর্থাৎ তাপীয় দ্বীপ প্রভাব অনুভব করছে। 

নগর গণ-আন্দোলন
সময়ের সঙ্গে ঢাকার অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি আরও একটি লক্ষণীয় রূপান্তর হচ্ছে কংক্রিটের অত্যধিক ব্যবহার এবং নগরের সবুজ স্থানগুলোর হ্রাস। শিশুদের সুষ্ঠু বিকাশ এবং তাদের চাহিদার প্রতি কোনোরূপ নজর ব্যতিরেকেই ঢাকায় শহুরে বৃদ্ধি ও নগরায়ণ ঘটছে। এভাবেই শিশুদের জন্য মাঠ রক্ষার চেষ্টার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল একটি আন্দোলন। পুরোনো ধানমন্ডি-৮ খেলার মাঠে (বর্তমানে শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব) শিশুদের প্রবেশাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, যার মধ্য দিয়েই সূচনা হয় এই প্রতিবাদের। জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত সরকারি মাঠে ক্লাবের ক্রীড়া সুবিধা বিকাশের মাধ্যমে জনগণের অধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সেই মুহূর্তে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) মতো পরিবেশকর্মীরা সমাবেশ করেছিলেন। পরে ক্লাবটি পরিবেশকর্মীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিলেও ২০০৪ সালে উচ্চ আদালত পরিবেশকর্মীদের পক্ষে রায় দেন এবং খেলার মাঠটিকে অবৈধ দখলমুক্ত করার নির্দেশনা দেন।

২০১১ সালে আদালত আবারও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি), গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং ক্লাব কর্তৃপক্ষকে সব অননুমোদিত কাঠামো অপসারণ করে মাঠটি জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করার আদেশ জারি করেন। কিন্তু আদালতের সেই নির্দেশনাকে অমান্য করে সিটি করপোরেশন সরকারি তহবিল ব্যবহার করে ওই মাঠে নানাবিধ অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে মূলত খেলার মাঠটিকে ক্লাবের জন্য একচেটিয়াভাবে দখল করে। অধিকন্তু হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ধানমন্ডি-৮ খেলার মাঠসংক্রান্ত একটি পিটিশনের শুনানিতে ‘বিব্রত’ হন। ফলে এ-সংক্রান্ত কার্যধারা বিলম্বিত হয়। সিটি মেয়র কর্তৃক তৎকালীন আসন্ন নির্বাচন উপলক্ষে আয়োজিত গণশুনানিতে আন্দোলনকারীরা মাঠ রক্ষার দাবি জানান। এভাবেই পরিবেশবাদীদের নিরন্তর প্রচেষ্টায় খেলার মাঠটি ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।

স্বপ্ন বাস্তবায়নে সমাধান যাত্রা
নগর দৃষ্টিকোণ থেকে নাগরিকদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন নিশ্চিতকরণ এবং উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে নগরায়ণের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পুনর্মূল্যায়ন করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। এরই মাঝে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নগরের পার্ক ও খেলার মাঠগুলোকে সংস্কারের জন্য সময়োপযোগী প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। সমস্যার গভীরতাকে অনুধাবন করে ভিত্তিস্থপতিরা ডিএনসিসির সঙ্গে পরামর্শক হিসেবে সহযোগিতা দেন। এভাবে ভিত্তিস্থপতিদের সহযোগিতায় ঢাকার চিহ্নিত ৫৪টির পার্কের মধ্যে ২৮টিকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শহরের স্মৃতি-আবহকে উন্নত করার প্রচেষ্টায় একটি ইতিবাচক পদক্ষেপের প্রতিফলন।

ঢাকার পার্ক এবং খেলার মাঠ পুনরুজ্জীবিত করার এ যাত্রায় ভিত্তিস্থপতিরা সূচনালগ্ন থেকেই জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশীজন সম্পৃক্তকরণ, সবার মতামত গ্রহণ এবং বিবেচনার গুরুত্ব অনুধাবন করে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে পরিচালিত জনমত সমীক্ষা, বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে ‘অংশগ্রহণমূলক দ্রুত মূল্যায়ন সভা (PRA)’ এবং মাইনক্রাফট গেমিং সফটওয়্যারের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে তাদের স্বপ্নের উদ্যানগুলোকে সরাসরি রূপদানের মতো তিনটি মৌলিক কৌশল গ্রহণ করা হয়েছিল। প্রথমেই জরিপের মাধ্যমে পার্কের অবস্থা, ব্যবহারের ধরনসহ পছন্দসই সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত এবং ব্যবহারকারী ও এলাকাবাসীর মতামত সংগ্রহ করা হয়। ‘স্পাইডার ম্যাপ’ প্রণয়নের মাধ্যমে পার্ক-সম্পর্কিত নির্দিষ্ট চাহিদাগুলো চিহ্নিত করে সম্ভাব্য সমাধানগুলো উন্মোচিত করা হয়। সবার অন্তর্ভুক্তিতা নিশ্চিতকরণে পিআরএ সভার মাধ্যমে বিভিন্ন অংশীজন তথা, বিভিন্ন সংস্থা, প্রবীণ নাগরিক, ব্যবসায়ী, শিশু-কিশোর, ক্রীড়া সংগঠক, স্থানীয় বাসিন্দা এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুসহ সবার অংশগ্রহণে একই টেবিলে আলোচনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। গুণগত মানসম্পন্ন আদর্শ পার্ক তৈরির উদ্দেশ্যে ওই সেশনের মাধ্যমে পার্কসংলগ্ন কমিউনিটিগুলোর চাহিদা এবং ধারণাগুলোকে গ্রহণ করে একটি ‘ড্রিম ম্যাপ বা স্বপ্নচিত্র’ প্রস্তুত করা হয়।

মাইনক্রাফট গেমিং সফটওয়্যারের মাধ্যমে স্কুলগামী ছেলেমেয়েদের সীমাহীন উদ্ভাবনী সম্ভাবনা ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে তাদেরই স্বপ্নের পার্ক ও খেলার মাঠের ডিজাইন সরাসরি অঙ্কনে উৎসাহিত করা হয়েছিল। একটি ভার্চুয়াল যাত্রার মধ্যদিয়ে শিশু-কিশোররা তাদের খেলার মাঠ, ফুলের বাগান এবং খেলার জন্য প্রয়োজনীয় জায়গাগুলো সুসজ্জিত করে। এভাবে এই ডিজিটাল নৈসর্গিক ডিজাইনগুলো মূলত শিশু-কিশোরদের সীমাহীন আনন্দ এবং কল্পনার রাজ্য হিসেবে পার্কগুলোর অবস্থান ব্যক্ত করেছে। 

প্রাপ্য স্থানের সীমাবদ্ধতাগুলোকে সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করে সব পার্ক ও খেলার মাঠে নানাবিধ ক্রিয়াকলাপের জন্য এর বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করে নকশায়ন করা হয়েছে। পার্ক ও খেলার মাঠগুলোয় জনগণের প্রবেশ এবং সক্রিয় অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করার জন্য পরিকল্পিতভাবে জোনিং করা হয়েছে। প্রতিটি স্বতন্ত্র জোন বিভিন্ন খেলাধুলা, ব্যবহারকারীর পছন্দ এবং তাদের কার্যকরী চাহিদাগুলোকে পূরণ করার পাশাপাশি বিদ্যমান নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা হ্রাস করে প্রত্যেকের জন্য একটি উপভোগ্য অভিজ্ঞতার নিশ্চয়তা প্রদান করে। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য একটি রূপান্তর হলো খেলার মাঠের প্রান্তগুলোকে ‘ট্রানজিশন স্পেসে’ পরিণত করা। পার্কের বেষ্টনীগুলো শুধু পার্কটিকে সীমাবদ্ধ করে না বরং একটি দৃষ্টিলব্ধ সংযোগও তৈরি করে। পার্কের মুক্তমঞ্চগুলো বিভিন্ন উৎসব বা উপলক্ষে অনায়াসে উদযাপন এবং সমাবেশের একটি আদর্শ কেন্দ্র।

ভবিষ্যতে করণীয়
নগরকে শিশুবান্ধব, জনবান্ধব, সর্বোপরি পরিবেশবান্ধব করে গড়ে তোলার জন্য পার্ক ও খেলার মাঠ সংস্কার এবং নির্মাণের পাশাপাশি শিশুদের জন্য আরও স্থান তৈরি (Place Making) করতে হবে। এই স্থানগুলো কানাগলি, রাস্তার পার্শ্বস্থ অংশ, যেকোনো জমির অংশ অথবা খাল বা নদীর পাশে উন্মুক্ত জায়গা হতে পারে। সঠিক এবং ন্যূনতম উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে একটি স্থানকে শিশুদের খেলার জায়গায় রূপান্তরিত করা সম্ভব। যেমন, একটি গাছ বা জলাধার/ নিম্নাঞ্চল (water depression area)-কে ঘিরেও শিশুদের বিভিন্ন রকম ক্রিয়াকলাপের আয়োজন বা ব্যবস্থা করা যেতে পারে। স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে অব্যবহৃত সরকারি বা ব্যক্তিগত জমি এবং স্কুল-কলেজের মাঠগুলোর বহুবিধ ব্যবহার নিশ্চিত করা যেতে পারে। অর্থাৎ অব্যবহৃত এসব জমির সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ বা কমিউনিটি পার্টনারশিপের মাধ্যমে শিশুদের জন্য সদ্ব্যবহার করা উচিত। এর পাশাপাশি নির্দিষ্ট সময়ে অব্যবহৃত থাকা স্থানগুলোয় তাদের প্রাপ্যতা অনুযায়ী সময়-নির্ধারিতভাবে (Time Stipulated) শিশুদের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। অর্থাৎ প্রাপ্যতা অনুযায়ী দিনের নির্দিষ্ট সময়ে ব্যবহার হতে পারে অথবা দীর্ঘ সময়ব্যাপীও (৫-১০ বছর) হতে পারে। অবশ্যই এ ধরনের প্রক্রিয়ায় কমিউনিটিভিত্তিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে করে ব্যক্তিগত অব্যবহৃত জমি বা স্থানগুলো শিশুদের ব্যবহারের জন্য প্রদানে জমির মালিকরা আগ্রহী হয়ে ওঠেন। 

এভাবে এসব জমি লাইব্রেরি, শরীরচর্চা কেন্দ্র, খেলাধুলার জায়গা বা অন্যান্য মিশ্র শিক্ষার স্থান হিসেবে ব্যবহারে মানুষকে প্রণোদিত করার সুযোগ তৈরি করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার অগ্রণী ভূমিকা পালন করে সরকারি, প্রাতিষ্ঠানিক বা সংগঠন মালিকানাধীন মিলনায়তন ও মাল্টিপারপাস হলগুলো কমিউনিটিভিত্তিক ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে পারে। এ ছাড়া যেসব সামাজিক অনুষ্ঠান কেন্দ্র বা কমিউনিটি সেন্টার বিভিন্ন সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা কর্তৃক দখলের শিকার হয়েছে, সেগুলোকে পুনরুদ্ধারে ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে কমিউনিটি সেন্টারভিত্তিক শিশুবান্ধব সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক বিনোদন কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটাতে সচেষ্ট হতে হবে। উল্লেখ্য, ঢাকা দক্ষিণ (৩৬টি) এবং উত্তর (১৩টি) সিটি করপোরেশনের অধীনে মোট ৪৯টি কমিউনিটি সেন্টার রয়েছে, যার মধ্যে বর্তমানে প্রায় ১৮টি সেন্টার মেরামত ও সরকারি কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব জমি বা স্থান সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের লক্ষ্যে যৌথ পরিচালন ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কর্তৃক গঠিত উন্মুক্ত স্থান, পার্ক ও খেলার মাঠসংক্রান্ত যৌথ ব্যবস্থাপনা বিধিমালা প্রণয়নের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। বর্তমান নগর কাঠামোয় শিশুদের সুন্দর শৈশব নিশ্চিতে এ ধরনের ব্যবহার সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখতে সক্ষম।

ঢাকার উন্মুক্ত স্থানগুলো বিশেষ করে পার্ক ও খেলার মাঠগুলো কেবল শিশু-কিশোর এবং নগরবাসীর বিনোদনের স্থানই নয় বরং এর পাশাপাশি নগরে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় রাখা নিশ্চিতে অন্যতম হাতিয়ার। পাশাপাশি এই হাতিয়ার ব্যবহারে, আন্দোলনের মাধ্যমে নগরের পার্ক ও খেলার মাঠগুলোকে সংস্কারের জন্য সময়োপযোগী প্রচেষ্টা এবং ঢাকার পার্ক এবং খেলার মাঠগুলোর সংস্কার নিশ্চিত করার কার্যক্রমটি একটি অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত। নগরের সংস্কারকৃত পার্ক এবং খেলার মাঠগুলো নগরবাসীর স্বপ্ন এবং আকাঙ্ক্ষার জীবন্ত প্রতিফলন হওয়ার পাশাপাশি তাদের অন্তর্ভুক্তিতা, যূথবদ্ধ আশা এবং স্থায়ী সম্প্রীতির বাস্তব মূর্ত প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।

লেখক: স্থপতি, সহসভাপতি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)

'), descriptionParas[2].nextSibling); } if (descriptionParas.length > 6 && bannerData[arrayKeyTwo] != null) { if (bannerData[arrayKeyTwo].type == 'image') { descriptionParas[0].parentNode.insertBefore(insertImageAd(bannerData[arrayKeyTwo].url, ('./uploads/ad/' + bannerData[arrayKeyTwo].file)), descriptionParas[5].nextSibling); } else { descriptionParas[0].parentNode.insertBefore(insertDfpCodeAd(bannerData[arrayKeyTwo].custom_code), descriptionParas[5].nextSibling); } } if (descriptionParas.length > 9 && bannerData[arrayKeyThree] != null) { if (bannerData[arrayKeyThree].type == 'image') { descriptionParas[0].parentNode.insertBefore(insertImageAd(bannerData[arrayKeyThree].url, ('./uploads/ad/' + bannerData[arrayKeyThree].file)), descriptionParas[8].nextSibling); } else { descriptionParas[0].parentNode.insertBefore(insertDfpCodeAd(bannerData[arrayKeyThree].custom_code), descriptionParas[8].nextSibling); } } });