দীর্ঘদিনের অপশাসন, দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ পাচার, স্বৈরতন্ত্র- এসব বিষয়ে মানুষ একেবারে ক্ষিপ্ত হয়ে ছাত্রদের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতা একটা বিজয় অর্জন করেছে। এখন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের দাবি- তারা অপশাসন, দুঃশাসন দূর করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে। বিচারব্যবস্থা ও নির্বাহী বিভাগসহ সব বিভাগ যেন রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকে। ব্যবসা-বাণিজ্যে যে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছিল বিগত সরকারের আমলে, তা ভেঙে যেন দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনে। একটা বৈষম্যহীন রাষ্ট্র তৈরির মাধ্যমে সব ক্ষেত্রে সংস্কার করে একটি কল্যাণকর রাষ্ট্রে পরিণত করে- এটাই সবার প্রত্যাশা।
সম্প্রতি দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে নাগরিকদের প্রত্যাশা শীর্ষক জরিপের ফলাফল চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রকাশিত হয়েছে। এতে দেশের ৯৭ শতাংশ ভোটার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আস্থাশীল। এই সরকারের মেয়াদ তিন বছর বা তার বেশি হওয়া উচিত বলে মনে করেন ৪৭ শতাংশ ভোটার। আর ৫৩ শতাংশ মনে করেন, এই সরকারের মেয়াদ দুই বছর বা তার কম হওয়া উচিত। বেসরকারি নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (এনএসইউ) সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (এসআইপিজি) পরিচালিত এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। গত ৯-১৯ সেপ্টেম্বর দেশের আটটি বিভাগের ১৭টি জেলায় মোট ১ হাজার ৮৬৯ জনের ওপর জরিপটি করা হয়। উত্তরদাতাদের বৃহত্তম অংশ মধ্যবয়সী। ২২ শতাংশ জেনারেশন জেড। ১৪ শতাংশের বয়স ৫০ বছরের ওপরে। এ ছাড়া জরিপের উত্তরদাতাদের ৫৪ শতাংশ শহরাঞ্চলের। ৪৬ শতাংশ গ্রামাঞ্চলের। ফলাফলে দেখা গেছে, জরিপে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের ৭২ শতাংশ ছাত্রদের নেতৃত্বে রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে।
উত্তরদাতাদের ৯৬ শতাংশ প্রধানমন্ত্রী পদে এক ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি থাকতে পারবেন না- এমন বিধান করাকে সমর্থন করেন। ৪৬ শতাংশ মনে করেন, উল্লেখযোগ্য সাংবিধানিক পরিবর্তন প্রয়োজন।
সংবিধানে ছোটখাটো সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন ৩৫ শতাংশ। আর ১৬ শতাংশ সম্পূর্ণ নতুন করে লেখা সংবিধানের পক্ষে মত দিয়েছেন। বাকি ৩ শতাংশ সংবিধানে পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই বলে মত দেন। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বর্তমান সরকারের প্রতি মানুষের ব্যাপক আস্থা ও আকাশচুম্বী প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে, যা এই জরিপেও উঠে এসেছে। এর বিপরীতে এই প্রত্যাশার ব্যবস্থাপনা করাটাই সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। আগেও দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু তার সুফল পাওয়া যায়নি। এর বড় কারণ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি।
এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তন না হলে রাজনৈতিক দলগুলো যেসব অঙ্গীকার করে ক্ষমতায় গিয়ে সেসব বাস্তবায়ন না করলে সবই হবে পণ্ডশ্রম। রাজনৈতিক দলগুলোকেও গণতান্ত্রিক হতে হবে। সংস্কার কমিশনগুলো সুপারিশ দেওয়ার পর সরকার হয়তো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করবে। এরপর হয়তো একটি রোডম্যাপ ও নির্বাচনের তারিখ ঠিক করা হবে। এই সরকারের দুই মাস হয়ে যাচ্ছে। আর এখনই ‘আগেই তো ভালো ছিলাম’ রব উঠেছে। উঠবেই না কেন? আগের সরকার যে প্রশাসন রেখে গেছে, তা দিয়ে গাড়িকে চালানো সম্ভব নয়। আর আমাদের অন্তর্বর্তী সরকার সম্ভবত সিস্টেমের ভেতর থেকে সিস্টেম ভালো করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু ভালোবাসা দিয়ে এই দেশে কেউ কি খুব ভালো হয়েছে? সরকারি বিভিন্ন অধিদপ্তরের আগের অভিজ্ঞতায় বলা যায়, এই সরকারের প্রথম সমস্যা হচ্ছে উপদেষ্টাদের মধ্যে বিশাল জেনারেশন গ্যাপ। এই দলে ৬০ বছর বয়সীদের ঊর্ধ্বে যেমন অনেক, আবার ২৫ বছরের নিচের উপদেষ্টাও আছেন।
আসলে কাজ করে ৩৫ থেকে ৫০ বছরের মানুষ, যারা অভিজ্ঞদের সঙ্গে তারুণ্যকে সংযুক্ত করে। বিভিন্ন গবেষণায়ও জীবনের সবচেয়ে দক্ষতার জন্য এই সময়ের কথাই বলা হয়। একমাত্র বিডার চেয়ারম্যান বাদে কোনো জায়গায় এই বয়সী মানুষকে নেওয়া হয়নি। ফলে উপদেষ্টাদের বিশাল অভিজ্ঞতা কর্মে পরিণত করা যাচ্ছে না। বর্তমান সরকার টেকনোক্র্যাট সরকার। তাত্ত্বিক মতে, এই সরকারের আসল শক্তি ঠিক পজিশনে ঠিক মানুষকে নিয়োগ দেওয়া। এই সরকারে নেই কোনো প্রকৌশলী। মেগা প্রজেক্টগুলোয় কাজ করার অভিজ্ঞতায় জানি, কীভাবে সরকারি প্রকৌশলীরা ফাঁকি দেন। এই জিনিস অন্য কেউ ধরতে পারবে না। তেমনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ডাক্তার ছাড়া অন্য উপদেষ্টা দেওয়ায় এই খাত এখন অনেক অরাজক অবস্থায় আছে।
দেশকে বাঁচিয়ে রাখে কৃষি। এই পরিষদে কোনো কৃষিবিদও নেই। ফলাফল ডিম, ইলিশ আমদানি-রপ্তানির জন্য আমরা আমলাদের তথ্যের ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। সরকার উপদেষ্টাদের অধীনে সর্বদলীয় কমিটি গঠন করতে পারে, যার কাজ হবে সংসদীয় কমিটির আদলে। তাহলে অনেক সিদ্ধান্ত মানুষের কাছে সহজে পৌঁছাবে। পরের বিষয়টি হচ্ছে অর্থনীতি। বিদেশি ঋণ আর সাহায্যে অর্থনীতিতে সুবাতাস দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এই ঋণকে কাজে লাগানোর মতো প্রশাসন কি সরকারের হাতে আছে? এই খাতে কাজ করা দেশে-বিদেশে কিছু চমৎকার মানুষ আছেন, যারা দেশের কর্মপরিকল্পনার স্ট্যান্ডার্ডই বদলে ফেলতে পারেন।
এখন একটি বড় সমস্যা বেকারত্ব। বেকারত্ব কোনোভাবেই সরকার দূর করতে পারবে না। এমনকি মোটামুটি পর্যায়েও কমাতে পারবে না। এ অবস্থায় বেসরকারি খাত ছাড়া কীভাবে তারা বেকারত্ব কমানোর কথা ভাববে? সরকারের প্রশাসনব্যবস্থা তাদের বিপদে ফেলতে পারে, কিন্তু ব্যবসায়ীরা সব সময়ে যে সরকারই আসুক সহায়ক পরিবেশ চান। তাই তাদের আস্থায় আনা অনেক বেশি সহজ।
অবৈধ বিদেশি বিতাড়নের মাধ্যমে বেকারদের জন্য সাময়িক কিছু চাকরির সুবিধা দেওয়া যায়। তাদের পরীক্ষা পদ্ধতি সহজ-ব্যাংক ড্রাফটের মাধ্যমে অতিরিক্ত অর্থ আদায় কাগজের স্তূপ দিয়ে আবেদনপত্রের ঝামেলা কমাতে হবে। তাদের জন্য চেষ্টা হচ্ছে- এটি তাদের বোঝানোটা খুব জরুরি। এ ছাড়া বিদেশি ডেটা সেন্টারগুলোকে দেশে নিয়ে এলে ৫০ মিলিয়ন ডলার রক্ষা করা সম্ভব এবং দেশেই অনেক হাই প্রোফাইল কাজের সুযোগ তৈরি করা সম্ভব। এদিকে তরুণদের আউটসোর্সকে সহজলভ্য করতে পেওনেয়ারকে সহজলভ্য করতে হবে। দুদককে এই দুই মাসে খুব বেশি দেখা যায়নি। এখন তো তাদের সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকার কথা। দুর্নীতিবাজ ধরতে হলে বেসরকারি কোম্পানিতে যারা কাজ করছে, তাদের কাছে গেলেই সহজে খুঁজে পাওয়া যাবে।
আবার আগের প্রশাসন, পুলিশ বা আর্মির অনেক লোক এখনো আগের অবস্থানে আছে। তাদের যদি তদন্তের আওতায় আনা না হয়, তাহলে কিছুই করতে পারবে না। সরকারের কোনো অনলাইন উপস্থিতি নেই বললেই চলে। ফলে আগের আমলের লুটেরারা এখন অনলাইনে অবস্থান নিয়ে সরকারের সব কাজকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে মানুষকে হতাশ করার চেষ্টা চলছে। আগের কালো আইনগুলো এখনো বর্তমান। সেগুলো বাতিল করে ভুক্তভোগীদের রক্ষা করা জরুরি। মানুষের প্রাণের দাবি ‘আন্তর্জাতিক নদী কনভেনশন’-এ এখনো স্বাক্ষর করা হয়নি। এভাবে চললে মানুষ কিছুদিনের মধ্যেই আশা হারাবে। তাদের এদিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এই আন্দোলনের শহিদ এবং আহতদের তালিকা করা। হতাহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া। তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। সেনাবাহিনী প্রধান ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন হওয়ার বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন।
এখানে দুটি চাওয়া, দেশের মানুষ চায় সংস্কার করে নির্বাচন। সরকার যেভাবে শম্বুক গতিতে এবং নরমভাবে চলছে, তাতে এখনই মানুষ চিন্তায় পড়ে গেছে- এই সরকার সংস্কার করতে পারবে কি না। এত এত দাবি মানা সম্ভব নয় এবং সব দাবি মানা তাদের কাজও নয়। ভুয়া সমন্বয়ক বা অযৌক্তিক দাবিদারদের বিরুদ্ধে মানুষ কঠোরতা দেখতে চাচ্ছে। তাই যারা কাজ করতে চাচ্ছে না, তাদের বাদ দিয়ে প্রশাসন ঢেলে সাজানো যেতেই পারে। আশার কথা, বিএনপিসহ প্রধান দলগুলো সমর্থন দিয়েছে। তাদের মূল নেতাদের কথায় কিছুটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। যদিও তাদের প্রান্তিক নেতাদের এই উপলব্ধি এখনো আসেনি। যদি এই সরকার ব্যর্থ হয়, তাহলে বাংলাদেশের মানুষের শেষ আশাও হারিয়ে যাবে। আমরা তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি হয়ে দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করতে চাই।
দেশ ও দশের কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে চাই। আমরা কখনো পরিচ্ছন্নতাকর্মী হয়ে রাস্তা, ড্রেন পরিষ্কার করতে এগিয়ে এসেছি, আবার কখনো ট্রাফিক পুলিশের রূপ নিয়ে রাস্তায় যানজট নিরসন করেছি। সুতরাং সমৃদ্ধ একটি দেশ গড়তে আমরা তরুণ প্রজন্ম অঙ্গীকারবদ্ধ। একজন দেশপ্রেমী সচেতন নাগরিক হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রত্যাশা, তিনি তার পরিষদ নিয়ে প্রথমে দেশকে একটি স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসবেন। এর পর সরকারি কার্যালয়সহ সব সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মপরিবেশ ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান সংস্কার করা, বিদেশের সব মিশনকে প্রবাসীদের আস্থা ও ভরসার জায়গায় নিয়ে আসা, বিমানবন্দরে ও বিমানকে রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য বিশেষ মর্যাদা দেওয়াসহ স্থানীয় সরকারের সব কার্যালয়, যেমন- সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন কার্যালয়কে গতিশীল করা।
এ জন্য এই সরকারকে যতদিন সময় প্রয়োজন তা তাদের দেওয়া এবং সব রাজনৈতিক দলকে এই সরকারকে সার্বিক সহযোগিতা করা উচিত। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও অন্যান্য উপদেষ্টার কাছে আমার প্রত্যাশা- চিকিৎসা খাতে এমনভাবে নজর দেওয়া হোক যেন দু-এক বছর পর বিদেশ থেকে মানুষ এই দেশে চিকিৎসা নিতে আসে। বাংলাদেশের চিকিৎসা খাতকে কেন্দ্র করে ভারত প্রতিবছর হাজার কোটি টাকা আয় করছে। এবার আমাদের দেশেই বিশ্বমানের চিকিৎসাব্যবস্থা চাই। সঙ্গে সঙ্গে এ সরকারের কাছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতিসহ সব জায়গায় নারীর সক্রিয় ও অবাধ অংশগ্রহণের জন্য সব প্রতিবন্ধকতা দূর করে নারীবান্ধব সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রত্যাশা করি। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান শহিদ শিক্ষার্থীরা যে পরিবর্তনের জন্য রক্ত দিয়েছেন সেটা যেন বৃথা না যায়। কেউ যেন ফ্যাসিস্ট হতে না পারে, ফ্যাসিস্ট হয়ে ক্ষমতায় থাকতে না পারে, তেমন ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে।
মানুষ পরিবর্তন চায়; ঘুষ-দুর্নীতির অভিশাপ থেকে মুক্তি চায়; সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও মাদকমুক্ত সমাজ চায়। আমরা দূষণমুক্ত পরিবেশ, ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন চাই। সর্বোপরি আমাদের তরুণ প্রজন্মের আত্মত্যাগ, রক্ত, চোখের জল যেন বৃথা না যায়, সেদিকে যেন সবার দৃষ্টি থাকে। মানুষের মধ্যে অনেক আস্থা ও আকাশচুম্বী প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। এই প্রত্যাশার অর্থ হলো সরকারের দায়িত্ব। মানুষ ভরসা করতে চায়। তাই অন্তর্বর্তী সরকার যেন দেশ ও
দেশের মানুষের স্বপ্ন পূরণ করতে সচেষ্ট হন, এটাই সবার প্রত্যাশা।
লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক
[email protected]