ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ এশিয়ায় হয়তো তারা একটি বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে চেষ্টা করবে। এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় পরিষ্কার করে বলা যায়। প্রথমত, আমেরিকা চাইবে বাংলাদেশে যেন খুব তাড়াতাড়ি একটি নির্বাচন হয়। তার একটি রোডম্যাপ যেন সামনে নিয়ে আসা হয়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি তাগিদ থাকবে বাংলাদেশের নির্বাচনের ব্যাপারে। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাপারে কবে নির্বাচিত সরকার হতে যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র সে ব্যাপারে একটা রোডম্যাপ দ্রুতই দেখতে চাইবে।...
ডোনাল্ড ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি ইলেকটোরাল ভোটে বিশাল ব্যবধানে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কমলা হ্যারিসকে হারিয়ে আমেরিকার ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। অনেকে ভেবেছিলেন, এবারের নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। কিন্তু তা হয়নি। তিনি ইলেকটোরাল ভোটের পাশাপাশি জনগণের ভোটেই এগিয়ে গেছেন। সিনেটেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টি এগিয়ে ছিল। ‘হাউস অব রেড’ সেটিও রিপাবলিকানের দিকে গেছে। একই সঙ্গে বলা যায়, গাজার ঘটনায় জো বাইডেন ও তার টিম রীতিমতো জেনোসাইডের জটিলতার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন। সেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে তরুণ ভোটাররা যথেষ্ট ভোট দিয়েছে বোঝা গেছে।
সেটিও রিপাবলিকানদের দিকে চলে গেছে। এখানে বলে রাখা দরকার যে যুদ্ধ যদি কোনো পার্টি থামাতে পারে, সেটি ডোনাল্ড ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টিই পারবে। আমরা যদি আমেরিকার ইতিহাস দেখি, সেখানেও আমরা দেখেছি যে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় রিপাবলিকান পার্টি যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছিল। ডেমোক্র্যাটরা পারেনি। সে হিসাবে রিপাবলিকানদের ম্যান্ডেড ক্লিয়ার হয়ে গেছে। আর একটি বিষয় বলা দরকার, তা হলো দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি করতে চেষ্টা করবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর ব্যাপারে আমেরিকানরা বরাবরই বলে আসছিল- এই যুদ্ধ করে আমেরিকার কোনো লাভ হচ্ছে না। এখন ট্রাম্প প্রশাসন কী করবে, তা দেখার বিষয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিষয়ে তাদের নজর থাকবে।
নরেন্দ্র মোদির সঙ্গেও বড় ধরনের সম্পর্ক গড়তে চেষ্টা করবে তারা। তাদের বাড়তি একটা চেষ্টা থাকবে ভারতকে আমেরিকার দিকে টানার। কারণ বাইডেনের সময় ভারত, রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে যে বৈরী সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, তা আমেরিকার জন্য অস্বস্তিকর ছিল। তবে কী ধরনের পরিবর্তন হবে, সেটি বলা মুশকিল। সারা বিশ্বের মতো দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের দৃষ্টিও ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের দিকে। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফলাফল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং অভিবাসী নীতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ এশিয়ায় হয়তো তারা একটি বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে চেষ্টা করবে। এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় পরিষ্কার করে বলা যায়। প্রথমত, আমেরিকা চাইবে বাংলাদেশে যেন খুব তাড়াতাড়ি একটি নির্বাচন হয়। তার একটি রোডম্যাপ যেন সামনে নিয়ে আসা হয়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি তাগিদ থাকবে বাংলাদেশের নির্বাচনের ব্যাপারে। অন্তর্বর্তী সরকারের দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতায় ফিরিয়ে আনার। ট্রাম্প ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক করতে চেষ্টা করবেন। এ কারণে আমরা যে উৎসাহটা দেখতে পাচ্ছি বাংলাদেশের ব্যাপারে, সেটায় ভাটা পড়ার আশঙ্কা আছে। চীন, ভারত ও রাশিয়ার মতো বড় দেশগুলোর বিষয়ে ব্যস্ত থাকবে। সেই জায়গায় বাংলাদেশ যে মনোযোগ চেয়েছিল সেটা নাও পেতে পারে। তাই আমাদের ওপর কী প্রভাব পড়বে, সেটা এখনই বলা মুশকিল। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাপারে কবে নির্বাচিত সরকার হতে যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র সে ব্যাপারে একটা রোডম্যাপ দ্রুতই দেখতে চাইবে।
অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্ক অপেক্ষাকৃত জোরদার হবে। বিশেষ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির গণতান্ত্রিক চর্চা নিয়ে ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে যথেষ্ট সমালোচনা ছিল। ট্রাম্প সেই বিষয়টি সামনে আনবে না, বরং তাদের একটি চেষ্টা থাকবে অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি করতে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন হলে তার প্রভাব দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশের ওপর পড়বে কি না, সেটি দেখতে হলে আরও কিছুটা সময় লাগবে। বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে, বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে খুবই স্পষ্ট ছিলেন। সেই জায়গায় একটি বড় পরিবর্তন আসার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। ফিলিস্তিনের ব্যাপারে বলতে গেলে বলা যায়, সে ক্ষেত্রেও নতুন করে একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে।
ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক একই থাকবে বলেই মনে হয়। কারণ যুক্তরাষ্ট্র একটি প্রাতিষ্ঠানিক রাষ্ট্র। এটি ব্যক্তিনির্ভর কোনো রাষ্ট্র নয়। এখানে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। এটি নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই। যুক্তরাষ্ট্র একটি বৈশ্বিক শক্তি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তারা বড় রাষ্ট্রগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বিশেষ করে রাশিয়া, চীন ও ভারত এসব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন।
এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্কের কোনো পরিবর্তন হওয়ার মতো তেমন কিছু নেই বলেই মনে হয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর অভিবাসী নীতি নিয়ে ভিন্ন কোনো সিদ্ধান্ত নিলে বাংলাদেশ একটু চাপে পড়বে। কারণ বাংলাদেশের অনেকেই অবৈধভাবে সেখানে আছেন। আবার অনেকেই এখনো নাগরিকত্ব পাওয়ার পর্যায়ে রয়েছেন। সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় ডোনাল্ড ট্রাম্প যে মন্তব্য করেছেন, এটি হতে পারে আমেরিকার সংখ্যালঘুদের ভোট পাওয়ার জন্য তিনি এটি করেছেন। তবে সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় বড় রকম সজাগ থাকবেন। এটি নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই। ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক মূলত একই থাকবে।
তবে বিশ্বজুড়ে আমেরিকার মানবিক সহযোগিতার জায়গা কমে আসতে পারে। সেদিক বিবেচনায় দুই দেশের সম্পর্কে কিছু ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসতে পারে। বাংলাদেশের জন্য অনিশ্চয়তার জায়গা হিসেবে আছে রোহিঙ্গা ইস্যু। কারণ জাতিসংঘের মাধ্যমে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের জন্য যে সহায়তা আসে, তার একটি বড় অংশই আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। আমেরিকার ইতিহাসে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ঠিক প্রথাগত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখা যায়নি। তিনি যেভাবে বৈদেশিক নীতির জায়গাগুলো বিবেচনা করেন, সেটি ঘিরেও বেশ অনিশ্চয়তা থাকে। যেখানে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে উন্নয়ন, সংস্কার ও অন্যান্য সহায়তা বা সমর্থন করছে, সে ক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প বর্তমান সম্পর্কের কাঠামোকে সম্পূর্ণ সমর্থন করবেন বলে ঠিক মনে হয় না। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের বহমান সম্পর্ক বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে কোন পথে এগিয়ে যাবে, সেটি বুঝতে হলে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষক