নুরুল হক নুর। সবাই তাকে ভিপি নুর হিসেবেই চেনে, জানে। ২০১৮ সালের কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি সবার কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে নির্দলীয় প্ল্যাটফর্ম থেকে নির্বাচিত হন ভিপি। তার পর থেকে শুরু তার অগ্রযাত্রা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেপথ্যের কারিগর এই তরুণ নেতা একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়ে জেলে গেছেন। নির্যাতনের শিকার হয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের পুলিশের। তার উদ্যোগে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। একপর্যায়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পতন হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের। খবরের কাগজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারের সেই অভিজ্ঞতাই বর্ণনা করেছেন নুরুল হক নুর। তিনি বলেছেন, ১৮ জুলাই সব রাজনৈতিক দল মিলে সর্বদলীয় মিছিল কর্মসূচি দেওয়া হয়েছিল ছাত্রদের ওপর হামলার প্রতিবাদে এবং সেই দিন থেকে সে আন্দোলন আর ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এটা একটা গণ-আন্দোলন এবং জাতীয় আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খবরের কাগজের সিটি এডিটর আবদুল্লাহ আল মামুন।
খবরের কাগজ: বাংলাদেশের মানুষ সবাই আপনাকে চেনে, জানে এবং পজিটিভ ধারণা রাখে। এই যে আপনি একজন ভিপি নুর হয়ে উঠলেন, কীভাবে?
নুরুল হক নুর: আমাকে যারা দেখেছেন, তারা তো বলতে পারবেন কীভাবে ভিপি নুর হয়ে উঠলাম। আমি দক্ষিণাঞ্চলের প্রত্যন্ত একটা গ্রামে বড় হয়েছি, গ্রামের স্কুলে লেখাপড়া করেছি। ২০০৮ সালে গাজীপুর থেকে এসএসসি পাস করেছি। ২০১২ সালে উত্তরা হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। ২০১৪ সালে দ্বিতীয় দফায় ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হই। পরিবার স্থানীয় রাজনীতিতে যুক্ত ছিল। আমার বাবা ’৯০-এর দশকে বিএনপির প্রথম সরকারের সময় ইউপি সদস্য ছিলেন। পরিবারের অন্য সদস্যরাও স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে টুকটাক যুক্ত ছিলেন। সেখান থেকে রাজনীতি বিষয়ে আগ্রহ তৈরি হয়। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো রাজনীতির জন্য একটা তীর্থভূমি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর কাছ থেকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দেখেছি। কিছুটা অংশগ্রহণও করেছি। কিন্তু লক্ষ্য রাজনীতি ছিল না। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের একটা সন্তানের যে রকম লক্ষ্য থাকে একটা ভালো চাকরি করে ফ্যামিলিকে সাপোর্ট দেওয়া। সেই চাকরির অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন করি।
সে আন্দোলন থেকেই উদ্বুদ্ধ হয়ে পরে ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি এবং জয়লাভ করি। ডাকসু নির্বাচনের পর থেকেই লোকজন ভিপি নুর ডাকা শুরু করে। তখন থেকেই পরিচিতি পেতে থাকি। এর পর শুধু সামনে এগিয়েছি। ২০২১ সালে গণ অধিকার পরিষদ নামে আমরা একটি রাজনৈতিক দল গঠন করি। ২০২৪-এ নিবন্ধন পাই। জার্নিটা পর্যায়ক্রমে হয়েছে। একটা সময়ের মধ্য দিয়ে আস্তে আস্তে এই জায়গায় এসেছি।
খবরের কাগজ: কী চাকরি করার ইচ্ছে ছিল?
নুরুল হক নুর: ইন্টারমিডিয়েটের পর আগ্রহ ছিল মেডিকেলে পড়ার। হাইস্কুল লাইফে রচনা পড়ানো হতো ‘এইম ইন লাইফ’। না বুঝে মুখস্থ বিদ্যা পড়ে কেউ ফার্মার, কেউ টিচার, কেউ ডাক্তার হওয়ার কথা বলত।
এই রচনা পড়ার সময় মনে হয়েছে আমি আসলে কী হতে চাই? আমার তো একটা লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থাকা দরকার। সেখান থেকেই আগ্রহ তৈরি হয়। এই দেশের চিকিৎসার দুরবস্থা, গ্রামের মানুষ চিকিৎসা পেতে কী ধরনের ভোগান্তির শিকার হয়, সেটা আমরা কাছ থেকে দেখেছি। ধরেন, রংপুর কিংবা বরিশালের মানুষ হঠাৎ করে একটা জটিল রোগে আক্রান্ত হলো। তার চিকিৎসা রংপুর কিংবা বরিশালে সম্ভব নয়। প্রথমে সে উপজেলা থেকে আসবে জেলা হাসপাতালে। সেখান থেকে আসবে বিভাগীয় শহরে। শেষ পর্যন্ত তাকে ঢাকায় আসতে হচ্ছে। একমুখী চিকিৎসা বা ঢাকামুখী চিকিৎসাব্যবস্থা। তখন মনে হয়েছিল আমার চিকিৎসক হওয়া দরকার। সেখান থেকেই চিকিৎসক হওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ তৈরি হয়। বলতে গেলে প্রচণ্ড রকমের ‘প্যাশন’ ছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত চিকিৎসক হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি।
খবরের কাগজ: মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলেন?
নুরুল হক নুর: পরীক্ষা দিয়েছিলাম, হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর ইচ্ছে হয় বিসিএস ক্যাডার হওয়ার। চিন্তাভাবনা করে দেখেছিলাম অ্যাডমিন ক্যাডার হলে একটা বৈচিত্র্যময় কাজের অভিজ্ঞতা তৈরি হবে, যেটা পরবর্তী লাইফেও কাজে লাগবে। রাজনীতি করার একটা টুকটাক আগ্রহ ছিল। কিন্তু ফ্যামিলির অবস্থা এবং নানান কারণেই মনে হয়েছিল যে শুরুর দিকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়া ঠিক হবে না। কারণ বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট তো ভিন্ন। ৫ আগস্টের আগেও যে প্রেক্ষাপট দেখেছি তাতে রাজনীতি করার জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার দরকার ছিল। একটা ইউপি নির্বাচনেও মানুষ ২ থেকে ৩ কোটি টাকা খরচ করে। এমপি নির্বাচনে ১০ কোটি টাকা খরচ করে। আমার তো সেই টাকা নেই। তার জন্য টার্গেট ছিল অন্তত একটা চাকরি বা ব্যবসা-বাণিজ্য করে আর্থিক নিশ্চয়তা তৈরি করা, এরপর রাজনীতির দিকে যাওয়া।
কোটা ছাত্রদের একটা সমস্যা, ছাত্রদের একটা বঞ্চনার জায়গা ছিল। এই দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সমাজের বিভিন্ন সেক্টরে, শত-সহস্র অনিয়ম এবং বৈষম্য আছে। সেগুলো বিলোপ করা দরকার। রাষ্ট্রের বৈষম্য কীভাবে সমাধান হবে? সেই জন্যই রাজনীতিতে আসা এবং আলহামদুলিল্লাহ মানুষের ব্যাপক সমর্থন এবং সহযোগিতায় খুব অল্প সময়ে সারা বাংলাদেশ তথা বহির্বিশ্বে যেখানে বাংলাদেশিরা আছে তাদের কাছে গণ ধিকার পরিষদ পরিচিতি পেয়েছে। গণ অধিকার পরিষদ একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল। খুব অল্প সময়ের মধ্যে একটা বড় অবস্থান তৈরি হয়েছে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এই গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী বিকল্প রাজনীতি, বিকল্প নেতৃত্বের প্রতি মানুষের যে আগ্রহ তৈরি হয়েছে, সেখানে গণ অধিকার পরিষদ একটা ভালো অবস্থানে থাকবে এবং বাংলাদেশে নতুন নেতৃত্ব তৈরিতে গণ অধিকার পরিষদ একটা আদর্শ প্ল্যাটফর্ম হবে।
খবরের কাগজ: ছাত্রজীবন থেকেই আপনার রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল। আপনি চেয়েছিলেন মানুষের সেবা করতে- এই তো?
নুরুল হক নুর: মানুষ দুনিয়ায় বাঁচবে কতদিন, কত বছর? একটা সময় পর তাকে চলে যেতেই হবে। আর সব মানুষই চলে যাবে। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ- ওই যে আমরা ভাব সম্প্রসারণ পড়েছিলাম- মানুষ বাঁচে তার কর্মের মধ্যে, বয়সের মধ্যে নয় বা জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভালো। সেই জায়গা থেকে মনে হয়েছে, একটা ভালো কর্মের মধ্য দিয়ে, মরার পরও মানুষ বেঁচে থাকতে পারে এবং মানুষের দোয়া পেতে পারে। সে জায়গা থেকে মনে হয়েছে পরিবারের পাশাপাশি সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য কিছু কাজ করা এবং নিদর্শন রেখে যেতে হবে। যাতে আমি না থাকলেও মানুষ আমাকে মনে রাখে। সে জন্যই মনে হয়েছে মানুষের সেবা করার জন্য রাজনৈতিক দল একটা উপযুক্ত প্ল্যাটফর্ম হতে পারে। রাজনীতি তো আলটিমেটলি মানুষের জন্য কাজ করা। জনগণের উন্নয়ন, সুবিধা-অসুবিধা দেখা। সে জায়গা থেকেই রাজনীতিতে আসা।
খবরের কাগজ: কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন শুরু করেন, তখন কি মনে হয়নি যে আন্দোলনে আপনি সফল হবেন কি না? আপনার নিজের মধ্যে কোনো সংশয় ছিল?
নুরুল হক নুর: না, শুরুর দিকে কিছুটা কনফিউশন ছিল, আসলে ছাত্ররা শেষ পর্যন্ত আন্দোলনে থাকবে কি না। ছাত্রলীগ হামলা করলে আমাদের আন্দোলন চলবে কি না। কারণ, ১৫ বছরে এটি একটি কমন চিত্র ছিল সরকারি দলের বাইরে কোনো ছাত্রসংগঠন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ক্যাম্পাসে দাঁড়াতে পারেনি। সেখানে দাবিদাওয়া তোলা তো পরের কথা। আমরা এই আন্দোলন করতে গিয়েও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছি। ধাক্কাধাক্কি, কিল, ঘুসি, হামলা- এগুলো ফেস করেছি এবং দেখেছি শুরুর দিকে কিংবা যখন বাধাহীনভাবে আন্দোলন চলছিল তখন হাজার হাজার শিক্ষার্থী আন্দোলনে এল এবং হামলা হয়েছে। হেলমেট বাহিনীর তাণ্ডব চলেছে। তখন আবার অনেকে মিছিল-মিটিং থেকে চলে যায়।
কিন্তু মনে হয়েছিল আমরা নেমেছি, রক্ত ঝরেছে, হামলা হয়েছে, এর শেষ দেখে ছাড়ব। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে ৯ মাস। আমরা কোটা সংস্কার আন্দোলন করেছি সোয়া ৮ মাস। ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ৪ অক্টোবর পর্যন্ত আমরা আন্দোলন করেছি। এর মধ্যে প্রজ্ঞাপন, দাবিদাওয়া মেনে নেওয়া নিয়ে সরকারের নানা রকম টালবাহানা ছিল। আমরাও নাছোড়বান্দা ছিলাম। প্রজ্ঞাপন জারির পর আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছিলাম।
আবার যখন ২০২৪ সালের জুনে আদালতের রায়কে কেন্দ্র করে, আমাদের যে পলিটিক্যাল লিগ্যাসির অবস্থানটা, এই কোটা সংস্কার আন্দোলনকে তৈরি করেছে। কোটা সংস্কারের আন্দোলনের সারা দেশে তারুণ্যের যে বিপ্লব এবং বিদ্রোহের মনোভাব, সেটা আমরা সমাজের মানুষকে দেখিয়েছি। সরকার সেটা মুছে দিতে চেয়েছিল। কারণ তাদের জন্য থ্রেট হচ্ছে এই তরুণ ফোর্স গণ অধিকার পরিষদ। কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বের হয়ে আসা ফোর্স।
সরকার আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে কোটা আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছিল। তখন আমরা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছি এবং কৌশলগতভাবে আমরা তখন নেতৃত্বে না থেকে, নতুন নেতৃত্বের সুযোগ দিয়েছি। কারণ আমরা যদি নেতৃত্বে থাকতাম তাহলে ছাত্রলীগ, যুবলীগ শুরুতেই হামলা করে এটা বানচাল করে দিত। আমরা সেই কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্বকে গাইড করার পাশাপাশি কোটা সংস্কার আন্দোলনকে রাষ্ট্র সংস্কার, ফ্যাসিবাদ নিরসনের এক দফা আন্দোলনে নিয়ে যাই। সে বিষয়ে রূপরেখা, প্ল্যান, প্রোগ্রাম করেছি। বিএনপির মতো একটা বড় রাজনৈতিক দল, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছি। ১৭ জুলাই ২০২৪ সব রাজনৈতিক দল মিলে গায়েবি জানাজার কর্মসূচি দিয়েছিলাম। ১৮ জুলাই সব রাজনৈতিক দল মিলে সর্বদলীয় মিছিল কর্মসূচি দেওয়া হয়েছিল ছাত্রদের ওপর হামলার প্রতিবাদে এবং সেই দিন থেকে সে আন্দোলন আর ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এটা একটা গণ-আন্দোলন এবং জাতীয় আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। রাজনৈতিক দলগুলো এই আন্দোলনে কতটুকু অবদান রেখেছে, সেটা সবাই জানে এবং সেখানে আমাদের কতটুকু নেতৃত্ব ছিল সেটাও সবাই জানে। এই আন্দোলনের সঙ্গে আমি সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলাম। ১৮ জুলাই রাত ১২টার পর মানে ১৯ তারিখ (জুলাই) আমি আবার অ্যারেস্ট হই।
খবরের কাগজ: কোটা সংস্কার আন্দোলনে দাবি আদায়ের পর আপনার কি মনে হয়েছিল যে, আওয়ামী লীগের পতন ঘটাতে হবে?
নুরুল হক নুর: ২০১৪ সালে বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগের একদলীয় শাসন, কর্তৃত্ববাদী শাসনের যাত্রা শুরু হয়। নির্বাচনের আগে তারা বলতে বাধ্য হয়েছিল এটা নিয়ম রক্ষার নির্বাচন, পরে আবার দ্রুতই নির্বাচন হবে। কিন্তু তারা ক্ষমতায় গিয়ে সে কথা রাখেনি। তখনই মানুষ পরিষ্কারভাবে বুঝতে পেরেছিল আওয়ামী লীগের জেনেটিক্যাল গুণ বাকশালী চেতনা থেকে তারা বের হতে পারেনি। এখনো বাকশাল কায়েম করবে।
খবরের কাগজ: আপনার কী মনে হয়েছিল?
নুরুল হক নুর: তখন আমরা ধারণা করেছিলাম, এই ব্যবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার। সে জন্য রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলন করেছে। কিন্তু পারেনি। আমরা সুযোগ পেয়েছি ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময়। আমাদের কাজ ছিল প্রাথমিকভাবে এই মৃতপ্রায় প্রজন্ম এবং জাতিকে জাগিয়ে তোলা। তাদের মধ্যে জাগরণ তৈরি করা। দেশে যেটা হচ্ছে এভাবে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চলতে পারে না।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে আমরা নাড়া দিয়েছিলাম। একই বছর আবার নিরাপদ সড়ক আন্দোলন গ্রো করেছিল। একটা আন্দোলনের মধ্যে আর একটা আন্দোলন তৈরি হয় না। যখন কোটা সংস্কার আন্দোলনে আমরা হামলা-মামলায় কোণঠাসা, তখন শিক্ষার্থীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন হয়েছিল। আমরা চেষ্টা করেছিলাম শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করা যায়, সারা দেশে শিক্ষার্থীদের কীভাবে রিলেট করা যায়। শিক্ষার্থীরা সে সময় বলেছে- আমরা দেখেছি কোটা সংস্কার আন্দোলনে কীভাবে ভাইদের পেটানো হয়েছে। হেলমেট বাহিনীর তাণ্ডব চলেছে। সেটা তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছাত্র আন্দোলন ছিল এবং ছাত্রদের একটা বড় জাগরণ ছিল। সে সময় অনেক পত্রপত্রিকা একে কিশোর বিদ্রোহ বলেছিল। তখনই আমরা পরিষ্কার হয়েছি, এই প্রজন্মের তরুণরা দূরদর্শী চিন্তা নিয়ে এগোচ্ছে। তারা রাষ্ট্রের সবকিছু দেখছে, বুঝছে। কিন্তু বলতে পারছে না। রাস্তার মাঝে প্ল্যাকার্ড তুলে বলছে যে, রাষ্ট্র সংস্কার চলছে সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত। তারা রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে ভাবছে। তার ফলে এই কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ২০২৪ সালের ঘটনা ঘটানো সম্ভব হয়েছে। ওই যে ১৮ সালের কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, আন্দোলনে হেলমেট বাহিনীর হামলা ও তাণ্ডব ছাত্ররা দেখেছে। তখনকার স্কুলের ছাত্ররা এখন বিশ্ববিদ্যালয় এসেছে। তাদের মধ্যে বিপ্লবের, প্রতিবাদের বা দ্রোহের আগুন ছিল। সময়মতো তারা সেটা এক্সপোজ করেছে। ফলে ফ্যাসিবাদী সরকারের অবসান হয়েছে।
খবরের কাগজ: কোটা সংস্কার এবং নিরাপদ সড়ক আন্দোলন একই সময়ে হয়েছিল। তাহলে সেই আন্দোলনের সুপ্ত বাসনা ছিল ফ্যাসিবাদ দূর করা এবং আওয়ামী লীগের পতন দরকার। এটা সুপ্ত বাসনা ছিল?
নুরুল হক নুর: জি। এবং সেই পতনে একমাত্র ভূমিকা রাখতে পারবে তরুণ প্রজন্ম, নিউ জেনারেশন। কারণ, রাজনৈতিক দলগুলো তখন ব্যর্থ হচ্ছিল। তারা বলছিল, বাধ্য হয়ে ইলেকশনে যাচ্ছে। একদিকে বলছে ইলেকশন অবৈধ। আবার তারা নির্বাচনে যাচ্ছে। আবার বলছে, ফেয়ার নির্বাচন হচ্ছে না। তারা স্থানীয় নির্বাচনেও গেছে। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে গেছে। কিন্তু আমরা বুঝতে পারছিলাম তরুণ প্রজন্মের জাগরণ ছাড়া একটা বিপ্লব কিংবা গণ-অভ্যুত্থান সম্ভব নয়। যে কারণে আমরা দায়িত্ব নিয়েছিলাম তরুণদের কানেক্ট করা এবং তাদের মধ্যে একটা জাগরণ ঘটানো।
খবরের কাগজ: এরপর আপনি ডাকসু নির্বাচন করলেন। তার মানে আপনি কি মনে করেছিলেন যে এই ধরনের আন্দোলনের জন্য আপনার পরিচিতির দরকার আছে, সে জন্য ডাকসু নির্বাচন করেছিলেন?
নুরুল হক নুর: আমাকে অনেকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছিল যে, নুরা কি ভিপি-জিএস হবে! ওর থেকে আমাদের সঙ্গে আসুক। একটা সম্পাদক পদে নির্বাচন করুক। এজিএস পদে নির্বাচন করুন। এ রকম আমাকে বলেছিল। এই অবহেলায় আমার মধ্যে আরও জেদ তৈরি হয়েছিল। দেখুন, এ রকম একটা সময়ে এত বড় একটা ছাত্র আন্দোলন করলাম, আমাদের নিয়ে তাদের অবজারভেশন এই। তারপর আমরা দেখিয়ে দিই আমাদের অবস্থান বা শিক্ষার্থীরা কী চায়। তরুণ প্রজন্মের যে একটা চিন্তার নতুন জগৎ তৈরি হয়েছে, তাদের ভাবনা যে অ্যানালগ বা ওল্ড জেনারেশন পলিটিক্স থেকে ভিন্ন- সেটা দেখানো দরকার। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৪ জেলার ছেলেমেয়েরা পড়ে। একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে শহরের ছেলেমেয়েরা আসে। তাদের নানা রকমের চিন্তাভাবনা রয়েছে। তারা দেখিয়ে দিয়েছে।
আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে ২০১৮ সালের নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে, মধ্যরাতে নির্বাচন হয়েছে। বিএনপির সাতজন সংসদ সদস্য শপথ নিয়েছিলেন। আমি তখন ভিপি হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছি। দায়িত্ব নেওয়ার পরে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ করার আরও বড় সুযোগ হয়েছিল। যদিও আমাকে খুব বেশি মুভ করতে দেওয়া হয়নি। যেখানে গেছি সেখানেই হামলা হয়েছে। হামলার পরও থামিনি। এ পর্যন্ত ২৫ বার হামলা হয়েছে। কিন্তু কখনো থামাতে পারেনি। দেশবাসীর প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে গেছি।
খবরের কাগজ: আপনার কাছে ছাত্র আন্দোলন ও কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্ব এবং ভিপি হওয়ার আগে ও পরের অনুভূতিটা কেমন ছিল?
নুরুল হক নুর: আমি নেতা হয়েছি- এই অনুভূতিটা কখনো কাজ করেনি। ২৮ বছর পরে ডাকসু নির্বাচন হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে চরিত্র সব সময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, প্রতিবাদ করা গণমানুষের পক্ষে থাকা, স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম- আমরা সেটাকে আমলে নিয়েই কিছু করার চেষ্টা করেছিলাম। ফলে গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট তৈরি করা সম্ভব হয়েছে।
আজকে যারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে উপদেষ্টা আছেন, যারা নেতা রয়েছেন- তাদের অনেকে ওই থেকে কাজ করেই একটা রাজনৈতিক অবস্থা তৈরি করেছেন। আমার একটা সন্তুষ্টির জায়গা যে, আমি অল্প সময়ের মধ্যে আমার চেয়ে বড় নেতা তৈরি করতে পেরেছি। আমার সঙ্গে যারা রাজনীতি করেছেন তারা এখন সরকারের মন্ত্রী। কেউ কেউ এখন ন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল বিভিন্ন জায়গায় আছেন। আমি এটা মনে করি যে, কোনো রাজনৈতিক নেতা বা প্রফেশনাল ব্যক্তি হিসেবে, সাংবাদিক হোক, শিক্ষক হোক তার সফলতা তার সঙ্গে যারা কাজ করেছে, তাদের বড় অবস্থানে পৌঁছে দেওয়া।
খবরের কাগজ: ছাত্র নেতৃত্ব গড়ে ওঠার পেছনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা নিয়ে আপনি নিশ্চয়ই গর্ববোধ করেন?
নুরুল হক নুর: শুধু ছাত্র অন্দোলন না। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আরও এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিসের মাধ্যমে তার মধ্যে থাকা সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের জায়গা। নানাভাবে এক্সপ্লোর করা নিজেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভালো ভালো একাডেমিশিয়ান তৈরি করেছে। সোশ্যাল ওয়ার্কার, এনজিও কর্মী, বিজ্ঞানী, গবেষক, শিক্ষক সাংবাদিক এবং রাজনীতিবিদ তৈরি করে যাচ্ছে।
আমি ডাকসুর ভিপি ছিলাম এখন একটা রাজনৈতিক দলের প্রধান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা যেকোনো প্রতিষ্ঠান আলোকিত হয় বা পরিচিত হয় তার ছাত্রদের দ্বারা। তার প্রতিনিধিদের দ্বারা। প্রতিনিধিরা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে পরিচিত হয় সেটা নয় বরং ওই প্রতিনিধিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ করেছে। ছাত্রদের কন্ট্রিবিউশন, প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন গর্বের তেমনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়েন তাদের জন্য গর্বের।
দ্বিতীয় পর্ব আগামীকাল...