ঢাকা ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪

বিশেষ সাক্ষাৎকার: নুরুল হক নুর ১৮ জুলাইয়ের পর আন্দোলন  ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৫০ এএম
১৮ জুলাইয়ের পর আন্দোলন 
ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না

নুরুল হক নুর। সবাই তাকে ভিপি নুর হিসেবেই চেনে, জানে। ২০১৮ সালের কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি সবার কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে নির্দলীয় প্ল্যাটফর্ম থেকে নির্বাচিত হন ভিপি। তার পর থেকে শুরু তার অগ্রযাত্রা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেপথ্যের কারিগর এই তরুণ নেতা একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়ে জেলে গেছেন। নির্যাতনের শিকার হয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের পুলিশের। তার উদ্যোগে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। একপর্যায়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পতন হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের। খবরের কাগজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারের সেই অভিজ্ঞতাই বর্ণনা করেছেন নুরুল হক নুর। তিনি বলেছেন, ১৮ জুলাই সব রাজনৈতিক দল মিলে সর্বদলীয় মিছিল কর্মসূচি দেওয়া হয়েছিল ছাত্রদের ওপর হামলার প্রতিবাদে এবং সেই দিন থেকে সে আন্দোলন আর ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এটা একটা গণ-আন্দোলন এবং জাতীয় আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খবরের কাগজের সিটি এডিটর আবদুল্লাহ আল মামুন।

খবরের কাগজ: বাংলাদেশের মানুষ সবাই আপনাকে চেনে, জানে এবং পজিটিভ ধারণা রাখে। এই যে আপনি একজন ভিপি নুর হয়ে উঠলেন, কীভাবে?
নুরুল হক নুর: আমাকে যারা দেখেছেন, তারা তো বলতে পারবেন কীভাবে ভিপি নুর হয়ে উঠলাম। আমি দক্ষিণাঞ্চলের প্রত্যন্ত একটা গ্রামে বড় হয়েছি, গ্রামের স্কুলে লেখাপড়া করেছি। ২০০৮ সালে গাজীপুর থেকে এসএসসি পাস করেছি। ২০১২ সালে উত্তরা হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। ২০১৪ সালে দ্বিতীয় দফায় ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হই। পরিবার স্থানীয় রাজনীতিতে যুক্ত ছিল। আমার বাবা ’৯০-এর দশকে বিএনপির প্রথম সরকারের সময় ইউপি সদস্য ছিলেন। পরিবারের অন্য সদস্যরাও স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে টুকটাক যুক্ত ছিলেন। সেখান থেকে রাজনীতি বিষয়ে আগ্রহ তৈরি হয়। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো রাজনীতির জন্য একটা তীর্থভূমি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর কাছ থেকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দেখেছি। কিছুটা অংশগ্রহণও করেছি। কিন্তু লক্ষ্য রাজনীতি ছিল না। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের একটা সন্তানের যে রকম লক্ষ্য থাকে একটা ভালো চাকরি করে ফ্যামিলিকে সাপোর্ট দেওয়া। সেই চাকরির অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন করি।
সে আন্দোলন থেকেই উদ্বুদ্ধ হয়ে পরে ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি এবং জয়লাভ করি। ডাকসু নির্বাচনের পর থেকেই লোকজন ভিপি নুর ডাকা শুরু করে। তখন থেকেই পরিচিতি পেতে থাকি। এর পর শুধু সামনে এগিয়েছি। ২০২১ সালে গণ অধিকার পরিষদ নামে আমরা একটি রাজনৈতিক দল গঠন করি। ২০২৪-এ নিবন্ধন পাই। জার্নিটা পর্যায়ক্রমে হয়েছে। একটা সময়ের মধ্য দিয়ে আস্তে আস্তে এই জায়গায় এসেছি।

খবরের কাগজ: কী চাকরি করার ইচ্ছে ছিল? 
নুরুল হক নুর: ইন্টারমিডিয়েটের পর আগ্রহ ছিল মেডিকেলে পড়ার। হাইস্কুল লাইফে রচনা পড়ানো হতো ‘এইম ইন লাইফ’। না বুঝে মুখস্থ বিদ্যা পড়ে কেউ ফার্মার, কেউ টিচার, কেউ ডাক্তার হওয়ার কথা বলত। 
এই রচনা পড়ার সময় মনে হয়েছে আমি আসলে কী হতে চাই? আমার তো একটা লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থাকা দরকার। সেখান থেকেই আগ্রহ তৈরি হয়। এই দেশের চিকিৎসার দুরবস্থা, গ্রামের মানুষ চিকিৎসা পেতে কী ধরনের ভোগান্তির শিকার হয়, সেটা আমরা কাছ থেকে দেখেছি। ধরেন, রংপুর কিংবা বরিশালের মানুষ হঠাৎ করে একটা জটিল রোগে আক্রান্ত হলো। তার চিকিৎসা রংপুর কিংবা বরিশালে সম্ভব নয়। প্রথমে সে উপজেলা থেকে আসবে জেলা হাসপাতালে। সেখান থেকে আসবে বিভাগীয় শহরে। শেষ পর্যন্ত তাকে ঢাকায় আসতে হচ্ছে। একমুখী চিকিৎসা বা ঢাকামুখী চিকিৎসাব্যবস্থা। তখন মনে হয়েছিল আমার চিকিৎসক হওয়া দরকার। সেখান থেকেই চিকিৎসক হওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ তৈরি হয়। বলতে গেলে প্রচণ্ড রকমের ‘প্যাশন’ ছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত চিকিৎসক হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি।


খবরের কাগজ: মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলেন? 
নুরুল হক নুর: পরীক্ষা দিয়েছিলাম, হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর ইচ্ছে হয় বিসিএস ক্যাডার হওয়ার। চিন্তাভাবনা করে দেখেছিলাম অ্যাডমিন ক্যাডার হলে একটা বৈচিত্র্যময় কাজের অভিজ্ঞতা তৈরি হবে, যেটা পরবর্তী লাইফেও কাজে লাগবে। রাজনীতি করার একটা টুকটাক আগ্রহ ছিল। কিন্তু ফ্যামিলির অবস্থা এবং নানান কারণেই মনে হয়েছিল যে শুরুর দিকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়া ঠিক হবে না। কারণ বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট তো ভিন্ন। ৫ আগস্টের আগেও যে প্রেক্ষাপট দেখেছি তাতে রাজনীতি করার জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার দরকার ছিল। একটা ইউপি নির্বাচনেও মানুষ ২ থেকে ৩ কোটি টাকা খরচ করে। এমপি নির্বাচনে ১০ কোটি টাকা খরচ করে। আমার তো সেই টাকা নেই। তার জন্য টার্গেট ছিল অন্তত একটা চাকরি বা ব্যবসা-বাণিজ্য করে আর্থিক নিশ্চয়তা তৈরি করা, এরপর রাজনীতির দিকে যাওয়া। 
কোটা ছাত্রদের একটা সমস্যা, ছাত্রদের একটা বঞ্চনার জায়গা ছিল। এই দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সমাজের বিভিন্ন সেক্টরে, শত-সহস্র অনিয়ম এবং বৈষম্য আছে। সেগুলো বিলোপ করা দরকার। রাষ্ট্রের বৈষম্য কীভাবে সমাধান হবে? সেই জন্যই রাজনীতিতে আসা এবং আলহামদুলিল্লাহ মানুষের ব্যাপক সমর্থন এবং সহযোগিতায় খুব অল্প সময়ে সারা বাংলাদেশ তথা বহির্বিশ্বে যেখানে বাংলাদেশিরা আছে তাদের কাছে গণ ধিকার পরিষদ পরিচিতি পেয়েছে। গণ অধিকার পরিষদ একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল। খুব অল্প সময়ের মধ্যে একটা বড় অবস্থান তৈরি হয়েছে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এই গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী বিকল্প রাজনীতি, বিকল্প নেতৃত্বের প্রতি মানুষের যে আগ্রহ তৈরি হয়েছে, সেখানে গণ অধিকার পরিষদ একটা ভালো অবস্থানে থাকবে এবং বাংলাদেশে নতুন নেতৃত্ব তৈরিতে গণ অধিকার পরিষদ একটা আদর্শ প্ল্যাটফর্ম হবে। 
খবরের কাগজ: ছাত্রজীবন থেকেই আপনার রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল। আপনি চেয়েছিলেন মানুষের সেবা করতে- এই তো?
নুরুল হক নুর: মানুষ দুনিয়ায় বাঁচবে কতদিন, কত বছর? একটা সময় পর তাকে চলে যেতেই হবে। আর সব মানুষই চলে যাবে। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ- ওই যে আমরা ভাব সম্প্রসারণ পড়েছিলাম- মানুষ বাঁচে তার কর্মের মধ্যে, বয়সের মধ্যে নয় বা জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভালো। সেই জায়গা থেকে মনে হয়েছে, একটা ভালো কর্মের মধ্য দিয়ে, মরার পরও মানুষ বেঁচে থাকতে পারে এবং মানুষের দোয়া পেতে পারে। সে জায়গা থেকে মনে হয়েছে পরিবারের পাশাপাশি সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য কিছু কাজ করা এবং নিদর্শন রেখে যেতে হবে। যাতে আমি না থাকলেও মানুষ আমাকে মনে রাখে। সে জন্যই মনে হয়েছে মানুষের সেবা করার জন্য রাজনৈতিক দল একটা উপযুক্ত প্ল্যাটফর্ম হতে পারে। রাজনীতি তো আলটিমেটলি মানুষের জন্য কাজ করা। জনগণের উন্নয়ন, সুবিধা-অসুবিধা দেখা। সে জায়গা থেকেই রাজনীতিতে আসা।
খবরের কাগজ: কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন শুরু করেন, তখন কি মনে হয়নি যে আন্দোলনে আপনি সফল হবেন কি না? আপনার নিজের মধ্যে কোনো সংশয় ছিল?
নুরুল হক নুর: না, শুরুর দিকে কিছুটা কনফিউশন ছিল, আসলে ছাত্ররা শেষ পর্যন্ত আন্দোলনে থাকবে কি না। ছাত্রলীগ হামলা করলে আমাদের আন্দোলন চলবে কি না। কারণ, ১৫ বছরে এটি একটি কমন চিত্র ছিল সরকারি দলের বাইরে কোনো ছাত্রসংগঠন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ক্যাম্পাসে দাঁড়াতে পারেনি। সেখানে দাবিদাওয়া তোলা তো পরের কথা। আমরা এই আন্দোলন করতে গিয়েও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছি। ধাক্কাধাক্কি, কিল, ঘুসি, হামলা- এগুলো ফেস করেছি এবং দেখেছি শুরুর দিকে কিংবা যখন বাধাহীনভাবে আন্দোলন চলছিল তখন হাজার হাজার শিক্ষার্থী আন্দোলনে এল এবং হামলা হয়েছে। হেলমেট বাহিনীর তাণ্ডব চলেছে। তখন আবার অনেকে মিছিল-মিটিং থেকে চলে যায়। 
কিন্তু মনে হয়েছিল আমরা নেমেছি, রক্ত ঝরেছে, হামলা হয়েছে, এর শেষ দেখে ছাড়ব। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে ৯ মাস। আমরা কোটা সংস্কার আন্দোলন করেছি সোয়া ৮ মাস। ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ৪ অক্টোবর পর্যন্ত আমরা আন্দোলন করেছি। এর মধ্যে প্রজ্ঞাপন, দাবিদাওয়া মেনে নেওয়া নিয়ে সরকারের নানা রকম টালবাহানা ছিল। আমরাও নাছোড়বান্দা ছিলাম। প্রজ্ঞাপন জারির পর আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছিলাম।
আবার যখন ২০২৪ সালের জুনে আদালতের রায়কে কেন্দ্র করে, আমাদের যে পলিটিক্যাল লিগ্যাসির অবস্থানটা, এই কোটা সংস্কার আন্দোলনকে তৈরি করেছে। কোটা সংস্কারের আন্দোলনের সারা দেশে তারুণ্যের যে বিপ্লব এবং বিদ্রোহের মনোভাব, সেটা আমরা সমাজের মানুষকে দেখিয়েছি। সরকার সেটা মুছে দিতে চেয়েছিল। কারণ তাদের জন্য থ্রেট হচ্ছে এই তরুণ ফোর্স গণ অধিকার পরিষদ। কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বের হয়ে আসা ফোর্স।

সরকার আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে কোটা আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছিল। তখন আমরা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছি এবং কৌশলগতভাবে আমরা তখন নেতৃত্বে না থেকে, নতুন নেতৃত্বের সুযোগ দিয়েছি। কারণ আমরা যদি নেতৃত্বে থাকতাম তাহলে ছাত্রলীগ, যুবলীগ শুরুতেই হামলা করে এটা বানচাল করে দিত। আমরা সেই কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্বকে গাইড করার পাশাপাশি কোটা সংস্কার আন্দোলনকে রাষ্ট্র সংস্কার, ফ্যাসিবাদ নিরসনের এক দফা আন্দোলনে নিয়ে যাই। সে বিষয়ে রূপরেখা, প্ল্যান, প্রোগ্রাম করেছি। বিএনপির মতো একটা বড় রাজনৈতিক দল, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছি। ১৭ জুলাই ২০২৪ সব রাজনৈতিক দল মিলে গায়েবি জানাজার কর্মসূচি দিয়েছিলাম। ১৮ জুলাই সব রাজনৈতিক দল মিলে সর্বদলীয় মিছিল কর্মসূচি দেওয়া হয়েছিল ছাত্রদের ওপর হামলার প্রতিবাদে এবং সেই দিন থেকে সে আন্দোলন আর ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এটা একটা গণ-আন্দোলন এবং জাতীয় আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। রাজনৈতিক দলগুলো এই আন্দোলনে কতটুকু অবদান রেখেছে, সেটা সবাই জানে এবং সেখানে আমাদের কতটুকু নেতৃত্ব ছিল সেটাও সবাই জানে। এই আন্দোলনের সঙ্গে আমি সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলাম। ১৮ জুলাই রাত ১২টার পর মানে ১৯ তারিখ (জুলাই) আমি আবার অ্যারেস্ট হই। 
খবরের কাগজ: কোটা সংস্কার আন্দোলনে দাবি আদায়ের পর আপনার কি মনে হয়েছিল যে, আওয়ামী লীগের পতন ঘটাতে হবে?
নুরুল হক নুর: ২০১৪ সালে বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগের একদলীয় শাসন, কর্তৃত্ববাদী শাসনের যাত্রা শুরু হয়। নির্বাচনের আগে তারা বলতে বাধ্য হয়েছিল এটা নিয়ম রক্ষার নির্বাচন, পরে আবার দ্রুতই নির্বাচন হবে। কিন্তু তারা ক্ষমতায় গিয়ে সে কথা রাখেনি। তখনই মানুষ পরিষ্কারভাবে বুঝতে পেরেছিল আওয়ামী লীগের জেনেটিক্যাল গুণ বাকশালী চেতনা থেকে তারা বের হতে পারেনি। এখনো বাকশাল কায়েম করবে। 


খবরের কাগজ: আপনার কী মনে হয়েছিল? 
নুরুল হক নুর: তখন আমরা ধারণা করেছিলাম, এই ব্যবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার। সে জন্য রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলন করেছে। কিন্তু পারেনি। আমরা সুযোগ পেয়েছি ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময়। আমাদের কাজ ছিল প্রাথমিকভাবে এই মৃতপ্রায় প্রজন্ম এবং জাতিকে জাগিয়ে তোলা। তাদের মধ্যে জাগরণ তৈরি করা। দেশে যেটা হচ্ছে এভাবে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চলতে পারে না। 
কোটা সংস্কার আন্দোলনে আমরা নাড়া দিয়েছিলাম। একই বছর আবার নিরাপদ সড়ক আন্দোলন গ্রো করেছিল। একটা আন্দোলনের মধ্যে আর একটা আন্দোলন তৈরি হয় না। যখন কোটা সংস্কার আন্দোলনে আমরা হামলা-মামলায় কোণঠাসা, তখন শিক্ষার্থীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন হয়েছিল। আমরা চেষ্টা করেছিলাম শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করা যায়, সারা দেশে শিক্ষার্থীদের কীভাবে রিলেট করা যায়। শিক্ষার্থীরা সে সময় বলেছে- আমরা দেখেছি কোটা সংস্কার আন্দোলনে কীভাবে ভাইদের পেটানো হয়েছে। হেলমেট বাহিনীর তাণ্ডব চলেছে। সেটা তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছাত্র আন্দোলন ছিল এবং ছাত্রদের একটা বড় জাগরণ ছিল। সে সময় অনেক পত্রপত্রিকা একে কিশোর বিদ্রোহ বলেছিল। তখনই আমরা পরিষ্কার হয়েছি, এই প্রজন্মের তরুণরা দূরদর্শী চিন্তা নিয়ে এগোচ্ছে। তারা রাষ্ট্রের সবকিছু দেখছে, বুঝছে। কিন্তু বলতে পারছে না। রাস্তার মাঝে প্ল্যাকার্ড তুলে বলছে যে, রাষ্ট্র সংস্কার চলছে সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত। তারা রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে ভাবছে। তার ফলে এই কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ২০২৪ সালের ঘটনা ঘটানো সম্ভব হয়েছে। ওই যে ১৮ সালের কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, আন্দোলনে হেলমেট বাহিনীর হামলা ও তাণ্ডব ছাত্ররা দেখেছে। তখনকার স্কুলের ছাত্ররা এখন বিশ্ববিদ্যালয় এসেছে। তাদের মধ্যে বিপ্লবের, প্রতিবাদের বা দ্রোহের আগুন ছিল। সময়মতো তারা সেটা এক্সপোজ করেছে। ফলে ফ্যাসিবাদী সরকারের অবসান হয়েছে।
খবরের কাগজ: কোটা সংস্কার এবং নিরাপদ সড়ক আন্দোলন একই সময়ে হয়েছিল। তাহলে সেই আন্দোলনের সুপ্ত বাসনা ছিল ফ্যাসিবাদ দূর করা এবং আওয়ামী লীগের পতন দরকার। এটা সুপ্ত বাসনা ছিল?
নুরুল হক নুর: জি। এবং সেই পতনে একমাত্র ভূমিকা রাখতে পারবে তরুণ প্রজন্ম, নিউ জেনারেশন।  কারণ, রাজনৈতিক দলগুলো তখন ব্যর্থ হচ্ছিল। তারা বলছিল, বাধ্য হয়ে ইলেকশনে যাচ্ছে। একদিকে বলছে ইলেকশন অবৈধ। আবার তারা নির্বাচনে যাচ্ছে। আবার বলছে, ফেয়ার নির্বাচন হচ্ছে না। তারা স্থানীয় নির্বাচনেও গেছে। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে গেছে। কিন্তু আমরা বুঝতে পারছিলাম তরুণ প্রজন্মের জাগরণ ছাড়া একটা বিপ্লব কিংবা গণ-অভ্যুত্থান সম্ভব নয়। যে কারণে আমরা দায়িত্ব নিয়েছিলাম তরুণদের কানেক্ট করা এবং তাদের মধ্যে একটা জাগরণ ঘটানো।


খবরের কাগজ: এরপর আপনি ডাকসু নির্বাচন করলেন। তার মানে আপনি কি মনে করেছিলেন যে এই ধরনের আন্দোলনের জন্য আপনার পরিচিতির দরকার আছে, সে জন্য ডাকসু নির্বাচন করেছিলেন?
নুরুল হক নুর: আমাকে অনেকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছিল যে, নুরা কি ভিপি-জিএস হবে! ওর থেকে আমাদের সঙ্গে আসুক। একটা সম্পাদক পদে নির্বাচন করুক। এজিএস পদে নির্বাচন করুন। এ রকম আমাকে বলেছিল। এই অবহেলায় আমার মধ্যে আরও জেদ তৈরি হয়েছিল। দেখুন, এ রকম একটা সময়ে এত বড় একটা ছাত্র আন্দোলন করলাম, আমাদের নিয়ে তাদের অবজারভেশন এই। তারপর আমরা দেখিয়ে দিই আমাদের অবস্থান বা শিক্ষার্থীরা কী চায়। তরুণ প্রজন্মের যে একটা চিন্তার নতুন জগৎ তৈরি হয়েছে, তাদের ভাবনা যে অ্যানালগ বা ওল্ড জেনারেশন পলিটিক্স থেকে ভিন্ন- সেটা দেখানো দরকার। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৪ জেলার ছেলেমেয়েরা পড়ে। একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে শহরের ছেলেমেয়েরা আসে। তাদের নানা রকমের চিন্তাভাবনা রয়েছে। তারা দেখিয়ে দিয়েছে।
আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে ২০১৮ সালের নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে, মধ্যরাতে নির্বাচন হয়েছে। বিএনপির সাতজন সংসদ সদস্য শপথ নিয়েছিলেন। আমি তখন ভিপি হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছি। দায়িত্ব নেওয়ার পরে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ করার আরও বড় সুযোগ হয়েছিল। যদিও আমাকে খুব বেশি মুভ করতে দেওয়া হয়নি। যেখানে গেছি সেখানেই হামলা হয়েছে। হামলার পরও থামিনি। এ পর্যন্ত ২৫ বার হামলা হয়েছে। কিন্তু কখনো থামাতে পারেনি। দেশবাসীর প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে গেছি। 


খবরের কাগজ: আপনার কাছে ছাত্র আন্দোলন ও কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্ব এবং ভিপি হওয়ার আগে ও পরের অনুভূতিটা কেমন ছিল? 
নুরুল হক নুর: আমি নেতা হয়েছি- এই অনুভূতিটা কখনো কাজ করেনি। ২৮ বছর পরে ডাকসু নির্বাচন হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে চরিত্র সব সময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, প্রতিবাদ করা গণমানুষের পক্ষে থাকা, স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম- আমরা সেটাকে আমলে নিয়েই কিছু করার চেষ্টা করেছিলাম। ফলে গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট তৈরি করা সম্ভব হয়েছে।
আজকে যারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে উপদেষ্টা আছেন, যারা নেতা রয়েছেন- তাদের অনেকে ওই থেকে কাজ করেই একটা রাজনৈতিক অবস্থা তৈরি করেছেন। আমার একটা সন্তুষ্টির জায়গা যে, আমি অল্প সময়ের মধ্যে আমার চেয়ে বড় নেতা তৈরি করতে পেরেছি। আমার সঙ্গে যারা রাজনীতি করেছেন তারা এখন সরকারের মন্ত্রী। কেউ কেউ এখন ন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল বিভিন্ন জায়গায় আছেন। আমি এটা মনে করি যে, কোনো রাজনৈতিক নেতা বা প্রফেশনাল ব্যক্তি হিসেবে, সাংবাদিক হোক, শিক্ষক হোক তার সফলতা তার সঙ্গে যারা কাজ করেছে, তাদের বড় অবস্থানে পৌঁছে দেওয়া। 


খবরের কাগজ: ছাত্র নেতৃত্ব গড়ে ওঠার পেছনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা নিয়ে আপনি নিশ্চয়ই গর্ববোধ করেন?
নুরুল হক নুর: শুধু ছাত্র অন্দোলন না। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আরও এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিসের মাধ্যমে তার মধ্যে থাকা সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের জায়গা। নানাভাবে এক্সপ্লোর করা নিজেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভালো ভালো একাডেমিশিয়ান তৈরি করেছে। সোশ্যাল ওয়ার্কার, এনজিও কর্মী, বিজ্ঞানী, গবেষক, শিক্ষক সাংবাদিক এবং রাজনীতিবিদ তৈরি করে যাচ্ছে। 
আমি ডাকসুর ভিপি ছিলাম এখন একটা রাজনৈতিক দলের প্রধান।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা যেকোনো প্রতিষ্ঠান আলোকিত হয় বা পরিচিত হয় তার ছাত্রদের দ্বারা। তার প্রতিনিধিদের দ্বারা। প্রতিনিধিরা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে পরিচিত হয় সেটা নয় বরং ওই প্রতিনিধিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ করেছে। ছাত্রদের কন্ট্রিবিউশন, প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন গর্বের তেমনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়েন তাদের জন্য গর্বের। 

দ্বিতীয় পর্ব আগামীকাল...

অনেকেই চলে গেলেন আলবদর বাহিনীর নৃশংসতায়

প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১২ পিএম
অনেকেই চলে গেলেন আলবদর বাহিনীর নৃশংসতায়
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ও রাশীদুল হাসানের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান ছিল। বয়সে, অভ্যাসে, রুচিতে যতটা না মিল ছিল গরমিল ছিল তার তার চেয়েও বেশি। অন্তত বাহ্যত তো তাই মনে হতো। যদিও তারা দুজনেই ছাত্র ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের, সহকর্মী ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগে। কিন্তু তারা কাছাকাছি, খুব কাছাকাছি ছিলেন বিনয়ে; আরও কাছে ছিলেন একে অপরের দেশের প্রতি ভালোবাসায়। সামান্যতার সাধারণ পরিবেশে তারা অসামান্য হয়ে উঠেছিলেন ওই দুই আপাত-সাধারণ, কিন্তু বস্তুত দুর্লভ গুণে।

জ্যোতির্ময় বাবুর নাম লেখা ছিল মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের সেই খাতায়, যেখানে নাম থাকবার কথা অত্যন্ত বিপজ্জনক ব্যক্তিদের। এটা তিনি প্রথম টের পেলেন যখন দরখাস্ত করলেন কলকাতা যাওয়ার পাসপোর্টের জন্য। তার বৃদ্ধা মাতা দিন দিন দৃষ্টিশক্তি হারাচ্ছিলেন; সেই মায়ের ইচ্ছা ছিল বড় ছেলেকে দেখবেন। এ জন্য ভেতরে ভেতরে ভারী চঞ্চল ছিলেন জ্যোতির্ময় স্যার, যদিও বাইরে প্রকাশ করতেন না। খুবই প্রকাশবিমুখ ছিলেন তিনি এসব বিষয়ে সব সময়েই। অনেক চেষ্টা করেছেন তিনি নিজে, তার হয়ে অন্যরাও চেষ্টা করেছেন কেউ কেউ; কিন্তু কারোরই সাধ্য ছিল না মিলিটারির খাতায় যার নাম লেখা রয়েছে ‘কমিউনিস্ট’ বলে তাকে পাসপোর্ট দেয়। প্রভোস্ট ছিলেন তিনি জগন্নাথ হলের। সেই হলের ছেলেরা রাষ্ট্রবিরোধী সামরিক প্রস্তুতি নিচ্ছে- এমন একটা বানানো সংবাদে মিলিটারি নাকি খুব তপ্ত হয়েছিল এবং শোনা গেছে প্রভোস্টকে তারা হয়তো গ্রেপ্তার করত ২৫ মার্চের আগেই, যদি না তুলনামূলকভাবে কিছুটা ভদ্রগোছের একজন লোক থাকতেন প্রাদেশিক গভর্নরের পদে। ২৫ মার্চের রাতেই তাকে গুলি করেছিল হানাদাররা, সময়মতো চিকিৎসা হলে হয়তো তিনি বাঁচতেও পারতেন। কিন্তু মার্চে বাঁচলেও ডিসেম্বরে বাঁচতেন কি না খুবই সন্দেহ, যেমন বাঁচেননি সন্তোষ ভট্টাচার্য, বাঁচেননি জ্যোতির্ময় বাবুরই ছাত্র রাশীদুল হাসান।

রাশীদুল হাসানেরও নাম ছিল মিলিটারির গুপ্ত খাতায়। সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে তার খোঁজে সশস্ত্র লোকেরা হানা দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, হানা দিয়ে ধরে নিয়ে গেল তাকে কলা ভবনের তার কামরা থেকে। তার খোঁজে সশস্ত্র সেনারা আসবে- এমন গুরুত্বপূর্ণ নিজেকে তিনি ভাবেননি কখনো, তাই প্রস্তুত ছিলেন না, মিলিটারির লোকেরা এসে অনায়াসে তার খোঁজ পেয়েছিল। পরে ডিসেম্বরে আবার যখন আলবদররা এল, তখনো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেই ছিলেন তিনি। যাওয়ার তেমন জায়গাও ছিল না তার, এই শহরে। উদ্বাস্তু হয়ে এসেছিলেন তিনি কলকাতা থেকে।

জাত শিক্ষক ছিলেন তারা উভয়েই। জ্যোতির্ময় বাবু শিক্ষক ছিলেন আমার, যেমন তারও কিছু আগে শিক্ষক ছিলেন তিনি রাশীদুল হাসানের। জীবন ও সাহিত্য সম্পর্কে আমার অনেক ধারণাই তার কাছ থেকে পাওয়া। আমি যতটা জানি তারও চেয়ে বেশি আমার ঋণ। জ্যোতির্ময় বাবু অসংশোধনীয়রূপে যুক্তিবাদী ছিলেন, বিষয়কে তিনি বিশ্লেষণ করে দেখতে চাইতেন তার মূল্য নির্ধারণের আগে। সেই জন্য তার সঙ্গে তর্ক ছিল আমার। আসলে তিনি তর্ক ভালোবাসতেন, মনেপ্রাণে ছিলেন গণতান্ত্রিক। সাম্যবাদী নন, বুর্জোয়া গণতন্ত্রী। সেই জন্য তিনি আহ্বান করতেন বিতর্কে, উৎসাহ দিতেন তর্কে, সর্বোপরি মর্যাদা দিতেন ভিন্নমতের- এমনভাবে দিতেন, অতটা কম লোককেই দেখছি আমি দিতে, আমাদের অগণতান্ত্রিক সমাজে। এ সমাজ আজও অগণতান্ত্রিক, সেকালে আরও বেশি ছিল এর জিজ্ঞাসাহীনতা। তিনি নিজে জানতেন কিনা জানি না, তবে আমরা বিলক্ষণ জানতাম যে, ভেতরে ভেতরে তিনি কোমল ছিলেন, ছিলেন স্পর্শকাতর ও অনুভূতিপ্রবণ। একবার ছুটির সময়ে সেই গেন্ডারিয়া থেকে নীলক্ষেতে এসেছিলেন তিনি আমাদের বাসায় একটা বইয়ের খোঁজে। আমি বাসায় ছিলাম না, ফিরে এসে শুনি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে গেছেন। না পেয়ে চলে গেছেন শেষ পর্যন্ত। আমার স্ত্রী গিয়েছিলেন রান্নাঘরে, তার জন্য চায়ের ব্যবস্থা করে ফিরে দেখেন স্যার বারান্দাজুড়ে পায়চারি করছেন আর গুনগুনিয়ে গাইছেন গান। ধরা পড়ে স্যার পাছে অপ্রস্তুত হন, সেই জন্য আমার স্ত্রী আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। এ ঘটনা নিয়ে আমরা হেসেছি ঠিকই কিন্তু অনেক দিন, অনেক সময় আমার স্মৃতির ভেতর তার সেই না শোনা গুনগুনিয়ে গাওয়া গান শুনেছি আমি, আমার চেতনার অজানা স্তরে সেই গান বেজে উঠেছে, আজও ওঠে, যখনই তার কথা মনে করি। তার স্নেহ ওই তার গানের মতোই গুনগুন করে ওঠে। শুধু স্নেহ নয়, জীবন্ত তার উপস্থিতিও।

জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে আমি জানি তার সরাসরি ছাত্র হওয়ার অনেক আগে থেকেই। সেই যখন আমি স্কুল ছেড়েছি কী ছাড়িনি সেই বয়সেই তার লেখা পড়েছিলাম আমি, একটি গ্রন্থ-সমালোচনা; ‘মুকতি’ নামে তখনকার দিনের একটি মাসিক পত্রিকায়। সেই লেখায় তার বক্তব্য কী কী ছিল আজ আর মনে নেই, কিন্তু এটা ঠিকই মনে আছে বক্তব্যের মধ্যে যুক্তি ছিল স্পষ্ট, পারম্পর্য ছিল দৃঢ়। সেই যে কৈশোরে ছায়া ফেলেছিলেন তিনি মনের ওপর, সেই ছায়া কালে কালে লোপ পায়নি, বরঞ্চ আরও গভীর হয়েছে; বিশেষ করে সেই আঠারো-উনিশ বছরে যখন সুযোগ হয়েছিল থাকবার তার আশপাশে। এই ছায়া স্তব্ধ নয়, এবং  সত্তাজুড়ে আছে অনুচ্চ সেই গান, অনুচ্চই। কেননা যে জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা নাটক পড়াতেন, নাটক পরিচালনা করতেন, তার পছন্দ ছিল নাটকীয় দ্বন্দ্ব, যদিও ব্যক্তিগত জীবনে তিনি নাটুকেপনা তো নয়ই, নাটকীয়তাও পছন্দ করতেন না।

এম এন রায়ের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে খুব ছোট একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছিলেন জ্যোতির্ময় স্যার অনেক আগে, আমরা যখন ছাত্র ছিলাম সেই সময়ে। আমাকে বলেছিলেন, তুমি এসো, আর কেউ যদি আসতে চায় এনো। যখন গিয়ে পৌঁছেছি ফ্রেন্ডস সেন্টারের বাড়ির কাছে, আমি ও আমার বন্ধু, দেখি দোরগোড়ায় একা দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। হেসে বললেন, এসো, তোমাদের জন্যই দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের জন্যই দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি, যেমন সেদিন তেমনি পরেও যেন আমরা আসি, এসে মতামত দিই একটা কিছু এবং তর্ক করি তার সঙ্গে। সব ছাত্রের প্রতিই এ ছিল তার আমন্ত্রণ- উদার এবং উষ্ণ। সেই দরজা আছে, তিনি নেই। কিন্তু আছে কি সেই দরজাও? মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়।

রাশীদুল হাসানকেও আমি শিক্ষকতা ভিন্ন অন্য কোনো পেশায় চিন্তা করতে পারি না। আমি যে তাকে অনেক দিন ধরে চিনতাম তা অবশ্য নয়। ছাত্রাবস্থায় আমরা আসার আগেই তিনি বের হয়ে গেছেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং শিক্ষক হয়ে ফিরে এসেছেন বেশ কিছুদিন পরে। মধ্যবর্তী সময়েও শিক্ষকতাই করেছেন তিনি, কিছু সময় পাবনায়, তার পর জন্মভূমি বীরভূমে। তিনি লিখতেন। প্রবন্ধ লিখতেন, কবিতা লিখতেন সময় সময়। তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা জীবনেই, সেই ঊনসত্তর সালে, যখন প্রবল গণ-আন্দোলনের আদিগন্ত ঝড় বইছে দেশব্যাপী। তার আগে পরিচয় হয়নি। কেননা তিনি যখন যোগ দেন ইংরেজি বিভাগে তখন আমি শিক্ষাছুটিতে বাইরে ছিলাম, কিছুদিনের জন্য।

 পরিচয় হলো কখন সেটা মনে আছে, কিন্তু ঠিক কখন অন্তরঙ্গতা ঘটল তার দিন-তারিখ মনে নেই। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, তিনি তার লেখা কবিতা পড়ে শোনাচ্ছেন আমাকে। তার কবিতা শুনে মনে মনে আমি ড্রাইডেনের মন্তব্য স্মরণ করেছি সুইফট সম্বন্ধে; স্মরণ করে বলেছি, রাশীদুল হাসান সাহেব, আপনি কোনো দিন কবি হবেন না। কবি হবেন না এই কারণে নয় যে, আপনার মধ্যে আবেগের অভাব; না হওয়ার কারণটা অন্য, সেটা এই যে, আপনি কবিতা লিখছেন মনের কথা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় নেমে গিয়ে বলতে পারছেন না বলে। আপনার ছিল প্রতিবাদ, কিন্তু সুযোগ ছিল না প্রকাশের। কবিতাকে তাই মাধ্যম করলেন। কিন্তু কবিতা তো জীবনের বিকল্প হতে পারে কেবল তার জন্যই কবিতাকে যিনি জীবনের ঊর্ধ্বে স্থান দেন। আপনি দেননি। আপনি জীবনকে অনেক বেশি ভালোবাসেন, যে জন্য কবিতার কোনো স্বায়ত্তশাসিত সত্তা ছিল না, আজ্ঞাবহ ছিল তারা আপনার মনের কথার। নিজের গরজ বলে কোনো বালাই ছিল না তাদের। ছিল তারা আপনার ইচ্ছাবন্দি। আপনাকে নিরাসক্ত বলবে কে? আপনি জীবনকে সুন্দর করতে চাইতেন, জানতেন একার জীবন মহৎ হবে না অন্যের জীবনকে স্পর্শ না করলে এবং অন্যের সাহায্য না পেলে, তাই তো আপনি চলে গেলেন অত দ্রুত। মৃত্যুর সঙ্গে আপস করলে আধমরা হয়ে হয়তো আরও অনেক দিন বেঁচে থাকতে পারতেন, যেমন অন্যরা আছে, যেমন আমরা আছি।

জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ও রাশীদুল হাসান কখনো, কোনো অবস্থাতেই গোপন কোনো সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। বোমাবারুদ তৈরি করেননি। কিন্তু তাদের ছিল হৃদয়। জীবন্ত হৃদয়। বোমাবারুদের চেয়েও যা বিপজ্জনক- শাসকশ্রেণির পক্ষে। বাংলাদেশকে ভালোবাসতেন তারা। এই ভালোবাসা দেশের সব বুদ্ধিজীবীর মধ্যে ছিল কি? ছিল না। অবশ্যই ছিল না। মুতসুদ্দি চরিত্রের অধিকারী ছিলেন তারা অনেকেই। যারা দেশপ্রেমিক ছিলেন তাদেরও অনেকেই ততটা অগ্রসর ছিলেন না, যতটা ছিলেন জ্যোতির্ময় স্যার ও রাশীদুল হাসান। অথচ অদৃষ্টের সেই পুরোনো ও প্রসিদ্ধ পরিহাস, তারা উভয়েই ছিলেন বলতে গেলে নিরাশ্রয়। জ্যোতির্ময় বাবু আমাদের বলতেন, পাকিস্তানে তোমরা হলে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক, আমরা, হিন্দুরা, হিন্দু বলেই তৃতীয় শ্রেণির। পরিহাস করে বলতেন বটে, কিন্তু ব্যাপারটা তো পরিহাসের ছিল না, ছিল মর্মান্তিকরূপে বাস্তবিক। তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের আত্মীয়স্বজন বলতে জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাদের প্রায় কেউ ছিলেন না। 

চমৎকার সুযোগ ছিল ইংল্যান্ড থেকে সরাসরি কলকাতা চলে যাওয়ার; ১৯৬৫-এর যুদ্ধের পর পূর্ব পাকিস্তান যে তাদের পক্ষে পূর্বের তুলনায় অধিক অনাত্মীয় হয়ে উঠেছিল, সে খবর তো বিলেতে বসে না জানার কোনো কারণ ছিল না। ঘটনাটি অস্বাভাবিক। কিন্তু না, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডাকছিল; বাসন্তী গুহঠাকুরতাকে ডাকছিল গেন্ডারিয়ার মেয়েদের স্কুল (তার একটা লেখা পড়েই আমি ধোলাই খালকে চিনেছিলাম, খালটাকে দেখার আগেই)। তারা চলে এলেন, উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য জ্যোতির্ময় স্যারের পক্ষে যতটা সময় থাকার বাধ্যবাধকতা ছিল সেটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টিকিট কাটলেন, প্লেনের।

রাশীদুল হাসান পশ্চিমবঙ্গের লোক, ঢাকায় এসেছিলেন উদ্বাস্তু হয়ে; পরে এখান থেকে ছাত্রজীবন শেষ করে কর্মজীবনে একবার চলে গিয়েছিলেন স্বদেশে, কিন্তু আবার চলে আসতে হয়েছে তাকে, ১৯৬৫-এর যুদ্ধের পর। আত্মীয়স্বজন বলতে প্রায় কেউ ছিলেন না তার ঢাকায়, অথবা পূর্ব পাকিস্তানে। সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন মনে হয় আনোয়ার পাশা, যাকে তার সঙ্গেই নিয়ে গিয়েছিল ঘাতকরা হত্যা করবে বলে। একই সময়ে, একই বাসা থেকে। পাকিস্তানিরা চেয়েছিল প্রতিরোধের সব সম্ভাব্য ঘাঁটিগুলোকে দেবে নিশ্চিহ্ন করে। সেই জন্যই জ্যোতির্ময় বাবু ও রাশীদুল হাসান চলে গেলেন, আরও অনেকের সঙ্গে আলবদর বাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডে।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এয়ারপোর্টে ক্লান্ত হলে

প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৪ পিএম
আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৬ পিএম
এয়ারপোর্টে ক্লান্ত হলে
ড. পবিত্র সরকার

আমার চেয়ে ঢের ঢের বেশিবার বিমান ভ্রমণ করেন এমন লোক তো অজস্র আছেন, কাজেই এটা আমি বিমান ভ্রমণ করি কখনো সখনো, অন্যমনস্কতার ছলে তার বিজ্ঞাপন নয়। সে বিজ্ঞাপন দিয়ে এ বয়সে আর কী প্রমাণ করতে চাইব? বিমান ভ্রমণের মধ্যে কোনো আভিজাত্য টিকে আছে বলে আমি আর মনে করি না। আগে বিমানে চড়লে লোকে গলায় একটা বিরাট মালা পরে বিমানের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ছবি তুলত, এখন সেসব উঠে গেছে। প্রচুর লোক সঙ্গে আসত বিমানে চড়ছে এমন লোককে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। তবে এখন মোবাইলে ছবি তোলা সহজ হয়ে গেছে বলে এখনো লোকে বিমানের পাশে দাঁড়িয়ে প্রচুর ছবি তোলে, সেলফি তোলে। 

কিন্তু সেসব আর ঘরে বাঁধিয়ে রাখার চল নেই। আগে দেখতাম, যারা বিমানে করে এসেছেন, তারা কাঁধের ঝোলানো ব্যাগে অজস্র ‘ট্যাগ’ লাগিয়ে রাখতেন, যাতে লোকে এক লহমায় বুঝতে পারে যে তিনি বিমান থেকে নেমেছেন। আমার এক প্রতিষ্ঠিত বন্ধু বৈঠকখানা ঘরে আগেকার বিমানের রঙিন পাতাওয়ালা টিকিটের স্তূপ সাজিয়ে রাখতেন লোকেদের দেখার জন্য যে, তিনি কতবার বিমান ভ্রমণ করেছেন। এখন সে টিকিটও নেই, সাইডব্যাগে সে ‘ট্যাগ’ও লাগানো হয় না। আজকেই দিল্লি থেকে আসার সময় দেখলাম যে, আমার পাশের মধ্যবর্তী সিটের যাত্রী একটা প্লাস্টিকের পুঁটলি কোলে নিয়ে সেখান থেকে পাসপোর্ট েবর করলেন। অর্থাৎ তিনি বিদেশে যাচ্ছেন। বিমানযাত্রার এখন গণতন্ত্রীকরণ হয়েছে, কাজেই বিমানে চড়েছি এই নিয়ে কোনো মক্কেল আর বাহাদুরি করতে যায় না।

এই কথা বলার জন্য এবারকার ‘ছলছুতো’ শুরু করিনি। এর আগে এয়ারপোর্টে সময় কাটানোর নানা উপায় নিয়ে আমি লিখেছি, এখানেই। একটা হলো কোনো বাচ্চা, এজনাস থেকে বছর বারোর মধ্যে যেকোনো বয়সের, চোখে পড়লে তাকে নজরবন্দি করে রাখা। অর্থাৎ সর্বক্ষণ সে কী করছে, কে দেখছে, কীভাবে মা-বাবার সঙ্গে চলতে চলতে নেচে এক চক্কর ঘুরে যাচ্ছে বা বাবার হাত ধরে চলেছে, প্রায় কাত হয়ে, কিন্তু মুখটা সামনের দিকে নয় পেছনের দিকে- এ রকম অজস্র ছবি আপনাকে বিপুল বিনোদন দেবে। এবারে, অর্থাৎ গতকাল (২০ সেপ্টেম্বর) যখন দিল্লি যাই তখন কলকাতা বিমানবন্দরে জুতসই শিশু বা বালক-বালিকা দেখা গেল না। ‘দেশের কী অবনতি হচ্ছে’ অর্থাৎ এয়ারপোর্টে বাচ্চা ‘কম পড়িতেছে’ ভাবলাম একটু। অথচ কালই আমার ফ্লাইট দফায় দফায় পিছিয়ে সাড়ে তিন ঘণ্টা পরে ছাড়ল। বই পড়তে ক্লান্ত লাগে বলে এখন আর বই সঙ্গে নিই না, শুনে আমার বন্ধুরা আমার সম্বন্ধে যত খারাপ ধারণাই করুন। অন্য সময় হাতে প্রুফও থাকে, এবারে তাও নেই। এবার কাগজ-কলমও সঙ্গে নিইনি, নিজের ওপর রাগ করে- কিছুদিন থেকে ছড়া, কবিতা এসব কিছু আসছে না কলমে। 

তাই খুব বিপদে পড়ে গেলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ নয়। প্রথমে আমাকে যা উজ্জীবিত করল তা হলো একজন ভয়ংকর মোটা যাত্রী, প্রায় চলন্ত চর্বির পিণ্ড বললেই চলে। তার ভুঁড়িটি প্যান্টের কোমরের বাঁধন ডিঙিয়ে অনেকখানি সামনে উপচে পড়েছে, কিন্তু তিনি দিব্যি সপ্রতিভভাবে তা সামলে নিয়ে গটগট করে আমার সামনে দিয়ে চলাফেরা করতে লাগলেন। তাকে দেখলাম, একটু পরে আর-একজনকে ওই রকম দেখলাম। তখন আমার মাথায় একটা দুশ্চিন্তা এল। আমি জানি আমার ভারত অভাবীদের দেশ, প্রচুর লোক দুবেলা পেট ভরে খেতে পায় না। সেখানে কি এই ধরনের নমুনা বেড়ে যাচ্ছে? গত বছর মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে শুনেছিলাম যে, সেখানে ‘মোটাত্ব’ অর্থাৎ ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ওবিজিটি, তার শতকরা হিসাব নাকি ৬৫। মানে আমেরিকার ৬৫ শতাংশ লোক মোটা হওয়ার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। আমাদের দেশে এরা কি কোনো বিপৎসংকেত? হ্যাঁ, আমি কলকাতার পথেঘাটেও দেখি এবং দেখে ভয় পাই যে, বেশ কিছু ছেলেমেয়ে, বিশেষ করে ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা ওজনের মেশিনকে কলা দেখিয়ে আয়তনে বেড়ে চলেছেন। সেটা দেখে ভয় পাব, না ভাবব যে, এরাই মোদিজির ‘অচ্ছে দিন’ যে এসে গেছে তার প্রমাণ। আমাদের মতো অবিশ্বাসীদের চোখে আঙুল দিয়ে মুখ ভেঙচিয়ে বলছে, ‘‘ওরে অলপ্পেয়েরা, তবে যে বলছিস ‘অচ্ছে দিন’ আসেনি? এই দ্যাখ, কত মোটাসোটা 
সুখী লোক আমরা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর পথেঘাটে ছেড়ে দিয়েছি।’’

এই রকম ভাবতে ভাবতে বেশ সময় কেটে গেল। হ্যাঁ, ভারতে মধ্যবিত্তের মাইনে বেড়েছে, পথে গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে, কলকাতায় খাবারের দোকানের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, বৈচিত্র্যও তেমনি বেড়েছে, পুজোর ছুটিতে ট্রেনের দামি টিকিট সব নাকি বিক্রি হয়ে গেছে। কাজেই লোকে গাড়িতে চড়বে, ছুটিতে বেড়াবে, হোটেলে-রেস্তোরাঁয় ভালো খাবেদাবে আর মোটা হবে না- একি মামাবাড়ির আবদার নাকি?
 
যাই হোক, মোটামুটি বেশ কিছু পৃথুলাকার নর-নারী এবং দুজন অতিকায় মোটা লোক, যাদের ভুঁড়ি শরীর থেকে খসে মাটিতে না পড়ে যায়, আমার মনে এই আশঙ্কা জাগাচ্ছিল, আমার ওই সাড়ে তিন ঘণ্টার বিনোদনের রসদ এবং কোটা হিসেবে খারাপ ছিল না। কিন্তু তা ছাড়াও অনেক কিছু ছিল। যেমন একটি অত্যন্ত আধুনিক ছেলের ডান হাতে লাল সুতলি বাঁধা দেখেও আমি খানিকক্ষণ ভাবলাম। আমাদের গ্রামে মায়েরা মঙ্গলচণ্ডীর ব্রত করলে ছেলেমেয়েদের হাতে এই রকম লাল সুতলি বেঁধে দিতেন। কিন্তু এর পোশাক দেখে মনে হলো না যে, ওই মা মঙ্গলচণ্ডীর ব্রত করতে পারেন? তা হলে ওই লাল সুতলি কিসের জন্য? এ নিয়ে খানিকক্ষণ গবেষণা করলাম কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত বা তত্ত্বে পৌঁছতে পারলাম না। 

লাল সুতা থেকে মনটা ফিরিয়ে দেখি, আর একটি ছেলে মানে যুবক, ভারী স্মার্ট পোশাক-আশাক পরা, কিন্তু তার মাথাটি সম্পূর্ণ কামানো। তা মাথা কামানো হতেই পারে। হয়তো পারিবারিক শোকের ব্যাপার ঘটেছে কিছু, না হয় সে আমাদের সময়কার অভিনেতা ইয়ুল ব্রাইনারের মতো মাথা কামানোকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছে, কাজেই চারপাশের চুল আর টাকওয়ালা লোকেদের তুলনায় ব্যতিক্রম হলেও সে অস্বাভাবিক নয়- এই রকম ভাবতে গিয়ে, সে একটু ঘুরে দাঁড়াতে দেখি যে, তার মাথার পেছনে, মেরুদণ্ড ও ‘ভার্টিব্রা’গুলোরে ওপরেই একটা ঘন চুলের ফিতেমতো উঠে গিয়ে একটি চমৎকার টিকিতে শেষ হয়েছে। এতেই আমি একটু চমকে গেলাম, কারণ ওই স্মার্ট পোশাকে এটি আমি আশা করিনি।

আরও ছোটখাটো অনেক বিনোদন তো ছিলই, সেগুলোর তালিকা দিয়ে আর পাঠককে ভারাক্রান্ত করব না। দু-একটি শিশুও এসে গেল এর মধ্যে, দৌড়াদৌড়ি করে, তারা আসায় স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।
তাই বলছিলাম, জীবন খুব নিষ্করুণ নয়। ভোগান্তি দেয়, আবার তা থেকে উদ্ধারও সরবরাহ করে। 

লেখক: ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়

বাশারের পতন: তুরস্ক, ইসরায়েল ও পশ্চিমাদের বিজয়!

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:১৬ পিএম
বাশারের পতন: তুরস্ক, ইসরায়েল ও পশ্চিমাদের বিজয়!
শ্লোমো বেন-অমি

সিরিয়ার আল-আসাদ রাজবংশের ৫৪ বছর পর পতন মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে বদলে দিয়েছে। ইসলামপন্থি হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) মিলিশিয়ার অতর্কিত আক্রমণ সিরিয়ার প্রতিবেশী দেশ ও অন্য সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ রাশিয়ায় পালিয়ে যাওয়ার খবর আরেকটি যুদ্ধের জন্ম দিতে পারে। সেই যুদ্ধ অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। 

৭ অক্টোবর ২০২৩, গাজা সীমান্তবর্তী এলাকায় ইসরায়েলের বেসামরিক নাগরিকের ওপর হামাস যে হামলা চালিয়েছিল, তা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ভূমিকম্পের মতো ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। গাজায় হামাসকে নির্মূল করতে ইসরায়েল নির্মমভাবে আক্রমণ করে। ইসরায়েল লেবাননে হিজবুল্লাহর ওপর আক্রমণ করে মূলত ইরানের ‘প্রতিরোধের অক্ষ’কে ধ্বংস করেছে, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য আন্তর্জাতিক শিপিংয়ে হুতি হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইয়েমেনে ইরান-সমর্থিত হুতিদের ওপর আক্রমণ করে। 

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ২০১১ সালে, যখন আসাদ সরকার শান্তিপূর্ণ ‘আরব বসন্ত’ বিক্ষোভকে চূর্ণ করেছিল। কিন্তু ২০১৫ সালের পর যুদ্ধটি অনেকাংশে কমে যায়, যখন রাশিয়া হস্তক্ষেপ করে। ইরান এবং হিজবুল্লাহর সহায়তায় সেই যুদ্ধটি আসাদের পক্ষে চলে যায়। ইরানের প্রক্সি ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় এবং ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার যুদ্ধের ক্ষমতা কিছুটা হ্রাস পাওয়ায় বিদ্রোহীরা সুযোগ নিয়েছে। তুরস্কের সহায়তায় বিদ্রোহীরা সহজেই বাশার সরকারের দুর্বল প্রতিরক্ষাকে পরাস্ত্র করে ফেলে। বাশার আল-আসাদের সেনাবাহিনী যুদ্ধ ছাড়াই আত্মসমর্পণ করে। ইরান ও রাশিয়ার পৃষ্ঠপোষকরা দ্রুত তাদের বাহিনী সরিয়ে নেয় এবং তাকে তার ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। 

সিরিয়ার সঙ্গে ইরানের জোট আরব বিশ্বে প্রধান শক্ত ঘাঁটি ছিল এবং এর অবসান আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যকে নতুন রূপ দেবে। মোহাম্মদ আলী আবতাহি, যিনি ছিলেন ইরানের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট। তিনি বাশার পালানোর দুই দিন আগে বলেছিলেন, সিরিয়া সরকারের পতন মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি হবে। 

ইসরায়েল প্রভাবশালী শক্তি হয়ে উঠবে। হায়াত তাহরির আল-শাম নামটি আরবের দেশগুলোর দ্বীপ অঞ্চলসহ ভূমধ্যসাগরের পূর্ব অংশের মুক্তির জন্য দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এইচটিএস নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি নতুন ধরনের ইসলামপন্থি ভাবমূর্তি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তিনি আল-কায়েদা এবং ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর ব্যর্থতা থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করেছেন বলে মনে হয়। এখন তিনি নিজেকে একজন বাস্তববাদী হিসেবে দেখেন, যিনি শুধু সিরিয়ার নিপীড়নমূলক শাসন থেকে মুক্তি আনতে চান।
 
তার এই নতুন বাস্তববাদের লক্ষণ হলো সিরিয়ার প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ গাজী আল-জালালিকে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর না করা পর্যন্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অনুমতি দেওয়ার জন্য জোলানিকে তার লোকদের নির্দেশ করতে হবে। আইএস সৈন্য ও কর্মকর্তাদের ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালাত। তার পরও আল-জোলানি একটি কট্টর ইসলামপন্থি সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তুরস্ক এইচটিএস-এর চরমপন্থাকে প্ররোচিত করতে পারে। অনেকে ধারণা করছেন, জোলানি তুরস্কের একজন অনুগত সৈনিক হতে পারেন। যাই হোক না কেন, আল-জোলানি শক্তিশালী রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হচ্ছেন। 

তাকে অবশ্যই প্রতিদ্বন্দ্বী মিলিশিয়াদের সঙ্গে তুলনা করতে হবে, যারা বাশারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য একত্রিত হয়েছিল। উত্তরে তুর্কি বাহিনীর আক্রমণের সময় পূর্ব সিরিয়ার আরও কিছু অংশের নিয়ন্ত্রণ নিতে ছুটে আসা কুর্দি বাহিনীকেও প্রতিরোধ করেছিল। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের কাছে সিরিয়ার কুর্দিরা তুরস্কের কুর্দিদের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহকে উৎসাহিত করার হুমকি দেয়।
২০১৯ সালে এরদোয়ান উত্তর সিরিয়ায় ৩০ কিলোমিটারজুড়ে একটি ‘নিরাপত্তা অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কুর্দি যোদ্ধাদের তুর্কি সীমান্ত থেকে দূরে ঠেলে দেওয়ার জন্য তিনি সেনাবাহিনী নিযুক্ত করেছিলেন। এমন এলাকা যেখানে কুর্দিরা একটি স্বায়ত্তশাসিত ছিটমহলকে নিজের দখলে নিয়ে গৃহযুদ্ধের জন্য সুযোগ খুঁজছিলেন। 

কুর্দিদের স্বায়ত্তশাসন টিকে রাখার আকাঙ্ক্ষা এবং সীমান্ত এলাকা থেকে তাদের দূরে রাখার জন্য তুরস্কের মধ্যে সমঝোতা খুঁজে পেতে জোলানিকে এখন কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। এরদোয়ান কি কুর্দি আঞ্চলিক ক্ষমতা সহ্য করবেন, যা তিনি তুরস্কের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করেন? জোলানি কি তুরস্ককে কুর্দিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অনুমতি দেবেন? যখন তিনি তাদের সঙ্গে শাসক জোট গঠন করার চেষ্টা করছেন এবং সিরিয়ার আঞ্চলিক সার্বভৌমত্বকে সমর্থন করতে যাচ্ছেন। সিরিয়ার কুর্দিদের সঙ্গে তার দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত সত্ত্বেও এরদোয়ান বাশারের পতনকে দুর্দান্ত অর্জন হিসেবে দেখেন। বিদ্রোহী বাহিনীর অগ্রযাত্রা অনুসরণ করে তিনি আনন্দিত হয়েছিলেন। সিরিয়ার এই অগ্রযাত্রা কোনো ঘটনা ছাড়াই চলতে থাকে। 

বছরের পর বছর এরদোয়ান এবং তার কাতার মিত্ররা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইসলামপন্থি দলগুলোকে সমর্থন করে আসছে। তিনি নিজেকে ইরানিদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় দেখেছিলেন যে, মুসলিম ভূমিতে ইসলামি গণতন্ত্রের কোন মডেলটি প্রাধান্য পাবে: শিয়া মৌলবাদী বা তুরস্কের মধ্যপন্থি কোনো রূপ। এখন তিনি বিশ্বাস করেন, তিনি দেশের সন্নিকটেই এমন একটি মডেলকে রূপ দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। 

যদিও সিরিয়ার বিদ্রোহীদের এমন সাফল্যের পেছনে ইসরায়েলের হাত রয়েছে। সে জন্য ইসরায়েলকে ধন্যবাদ দেওয়ার অনেক কিছু রয়েছে। ইসরায়েল তার নতুন প্রতিবেশীদের সম্পর্কে কোনো ভুল ধারণা পোষণ করে না। আল-জোলানি সিরিয়ার গোলান মালভূমিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন (তাই নাম জোলানি), ইসরায়েল ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ওই অঞ্চল দখল করেছিল। যার সংযুক্তি ও সার্বভৌমত্ব ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। 

দামেস্কে বিদ্রোহী অগ্রযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে ইসরায়েল সিরিয়ার সীমান্তে যুদ্ধ ইউনিট মোতায়েন করে। গোলান মালভূমিতে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর ছড়িয়ে পড়া এবং সীমান্তে সিরিয়ার পাশের দ্রুজ এলাকায় আক্রমণ করা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল ইসরায়েল। ৭ অক্টোবরের রোমহর্ষক ঘটনা এখনো ইসরায়েলের মনে গেঁথে আছে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ক্ষোভকে অবমূল্যায়ন করা উচিত নয়। সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের অত্যাচারের পতন যদি ঘটতে পারে, কেন ইরানকেও পতনের চেষ্টা করা হবে না? নেতানিয়াহু প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপের বাইরে চলে যাওয়ার প্রলোভন রয়েছে। তিনি যুক্তি দিয়েছেন, ১৯৭৪ সালের চুক্তি অনুযায়ী ইসরায়েল ও সিরিয়ার মধ্যে যে বাহিনী বিচ্ছিন্নকরণ নিয়ন্ত্রিত ছিল তা ভেঙে গেছে। তিনি ইসরায়েলি সৈন্যদের হারমন পর্বতের সিরিয়ার অংশের নিয়ন্ত্রণ দখল করতে নির্দেশ দেন। সিরিয়ার সার্বভৌম ভূখণ্ডের বাফার জোন এবং এর আশপাশে প্রভাবশালী অবস্থান নেয়। 

এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্ররাও একইভাবে উদ্বিগ্ন। তারাও বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতায় থাকাটা পছন্দ করত, এই ভয়ে যে ইসলামপন্থি নিয়ন্ত্রিত সিরিয়া সন্ত্রাসবাদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠতে পারে। তাদের দৃষ্টিতে বাশার আল-আসাদ ইসলামপন্থি বিদ্রোহী নেতৃত্বাধীন সরকারের চেয়ে ভালো, যদিও এটি মধ্যপন্থি বলে দাবি করে।

বাশার আল-আসাদের পতন ঘটেছে। মধ্যপ্রাচ্য আবার নাটকীয়ভাবে পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যর পুনরুদ্ধারে সবার এগিয়ে আসা উচিত।

লেখক: ইসরায়েলের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল

খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:০৭ পিএম
খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি
সৈয়দ ফারুক হোসেন

দেশের ২ কোটি ৩৬ লাখ বা ২৬ শতাংশ মানুষ উচ্চমাত্রার খাদ্যসংকটে ভুগছেন। সম্প্রতি একটি সমীক্ষায় দেশের খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে আশঙ্কাজনক এ চিত্র উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত খাদ্যসংকটে থাকা মানুষগুলো তীব্র খাদ্য নিরাপত্তহীনতায় ভুগতে পারেন। তাদের মধ্যে মায়ানমার থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ৩ লাখ রোহিঙ্গাও রয়েছে। এ অবস্থায় তীব্র খাদ্যসংকটে থাকা ১৬ লাখ মানুষের জন্য জরুরি খাদ্যসহায়তা প্রয়োজন।

 জাতিসংঘসহ বাংলাদেশে কাজ করা আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলোর যৌথভাবে পরিচালিত ‘সমন্বিত খাদ্যনিরাপত্তার পর্যায় চিহ্নিতকরণ’ শীর্ষক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ৭ নভেম্বর প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে। ২০ বছর ধরে এই জরিপ করা হচ্ছে। বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশে দুই বছর ধরে প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে। প্রতিবেদনে দেশের খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভোগা মানুষের ভৌগোলিক অবস্থানও চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব মানুষের বেশির ভাগ বাস করেন চট্টগ্রাম, রংপুর, খুলনা ও সিলেট বিভাগে। দেশের ৪০টি এলাকায় খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে জরিপ চালিয়ে দেখা যায়, ৩৩টি এলাকার মানুষ সংকটজনক অবস্থায় রয়েছেন। জরিপে দেখা গেছে, ১৬ লাখ ৪৭ হাজার মানুষের জরুরি খাদ্যসহায়তা দরকার। খাদ্য নিয়ে সংকটময় অবস্থায় আছেন ২ কোটি ১৯ লাখ ৩৩ হাজার মানুষ। আর ৩ কোটি ৩৪ লাখ ১১ হাজার মানুষ চাপে আছেন। শুধু ৩ কোটি ৩৯ লাখ মানুষ পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছেন।

দেশে খাদ্যপণ্যের দাম ও কৃষি-উপকরণের বিষয়টিকে বর্তমান সরকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে। সরকার পণ্য সরবরাহ ও খাদ্য বণ্টনব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে না পারলে সামনের দিনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। বন্যা ও অন্যান্য দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার কৃষকদের জন্য খাদ্যসহায়তার পাশাপাশি আসন্ন বোরো-রবি মৌসুমে বিনামূল্যে কৃষি-উপকরণ সহায়তা দেওয়া দরকার। শুধু রিজার্ভের উন্নতি হলেই অর্থনীতির গতি ফিরে আসবে না। দেশের খাদ্যপণ্য সরবরাহব্যবস্থায় দ্রুত পরিবর্তনের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের দিয়ে ওই ঘাটতি পূরণের উদ্যোগ নিতে হবে।

 বাংলাদেশে গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় সব ধরনের সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হয়। বিশেষ করে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দরিদ্র জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়ে। ওই অভ্যুত্থানের পর নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নিয়েছে। অর্থনৈতিক কাঠামো পরিবর্তনের লক্ষ্যে বর্তমান সরকার কাজ করে যাচ্ছে। নানা কারণে খাদ্যপণ্যের দাম তুলনামূলক বেশি বেড়েছে। ফলে সরকারকে সারা দেশে ন্যায্যমূল্যে খাদ্য সরবরাহ বাড়াতে হবে এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এদিকে ২০২৪ সালের শুরুতে দেশের মানুষের আয় কমে গেছে এবং ব্যয় বেড়ে গেছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট ও সংঘাতের কারণে ওই সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং প্রবাসী আয় কমে যাওয়ায় সমস্যা আরও তীব্র হয়েছে। আমদানি-রপ্তানি ও বাণিজ্য ব্যাহত হয়েছে। ফলে খাদ্যনিরাপত্তা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হয়েছে।

চলতি বছরের বন্যা ও খরার মতো দুর্যোগে দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যাদের বড় অংশই কৃষিজীবী। এদের আবার এক-চতুর্থাংশ কৃষি-মজুর। বন্যা, দুর্যোগ ও তাপপ্রবাহের কারণে তারা ঠিকমতো কাজ পাননি। কাজ পেলেও মজুরি পেয়েছেন কম। এই জনগোষ্ঠীর বড় অংশ শুধু কৃষি মজুরি দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাদের দৈনিক আয়ের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ খাদ্যের পেছনে ব্যয় হয়। ফলে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাদের খাদ্য গ্রহণ কমাতে হচ্ছে। এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড়ের কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বন্যার কারণে ফসল, গবাদিপশু, মৎস্যসম্পদ এবং মজুত খাদ্যের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে।

 এতে খাদ্য উৎপাদন কমতে পারে এবং গৃহস্থের আয় কমে আসতে পারে। মহামারির প্রায় তিনটি বছর অতিবাহিত হলো! এরপর যুক্ত হলো ইউক্রেন-রাশিয়ার সংঘাত। এ সংঘাতের কারণে এবং জলবায়ু পরিবর্তন ও ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিশ্বজুড়ে ৩ বিলিয়ন মানুষ এখনো স্বাস্থ্যকর খাবারের সামর্থ্য রাখে না। তাদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ জীবিকা নির্বাহের জন্য কৃষির ওপর নির্ভর করে। এমতাবস্থায় একটি টেকসই বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য আমাদের সংহতি এবং সম্মিলিত পদক্ষেপের শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে, এমনটি মনে করছেন বিশ্লেষকরা। যেখানে প্রত্যেকেরই পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবারের নিয়মিত নিশ্চয়তা থাকবে। বাংলাদেশে ক্ষুধার ঝুঁকিতে থাকা মানুষের জন্য সবচেয়ে কার্যকর ও অন্যতম বড় উদ্যোগ বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে কাজ করছে বর্তমান সরকার। কৃষি ও খাদ্যপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং সরকারের কার্যকর উদ্যোগের মাধ্যমেই এই খাদ্যসংকট মোকাবিলা করা সম্ভব। ২০৩০ সালে বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি ১৩ লাখ মানুষ ক্ষুধার ঝুঁকিতে থাকবে। 

বিশ্ব খাদ্যনিরাপত্তার মূল উদ্দেশ্য হলো ক্ষুধা, অপুষ্টি ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলা, কৃষির উন্নতিতে মনোযোগ দেওয়া, কৃষিভিত্তিক উৎপাদনে উৎসাহ দেওয়া, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তা গ্রহণে উৎসাহ দান, গ্রামীণ জনগণ বিশেষ করে নারী ও পিছিয়ে পড়া মানুষের অবদানে উৎসাহ এবং প্রযুক্তির সমৃদ্ধিকে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। কৃষিকে কেন্দ্র করে বিশ্বের মানুষের প্রয়োজনীয় খাদ্যের জোগান, দরিদ্র ও পুষ্টিহীনতা দূর করে ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়ার অঙ্গীকার নিতে হবে সবাইকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক সংকটে বেশি নিপতিত হয় পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী। একটি ভালো ভবিষ্যতের আশায় সবার জন্য খাদ্যনিরাপত্তা, শান্তি ও সমতাকে অগ্রাধিকার দিতে সরকার, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি খাত, একাডেমিয়া এবং সুশীল সমাজকে একত্রে কাজ করা দরকার।

খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় কাউকে পিছিয়ে না রাখার হাতিয়ার হিসেবে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষক জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করে এগোতে হবে। তাদের আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে ফসলের উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির দিকে বিশেষ মনোনিবেশ দরকার। কৃষিপ্রযুক্তি গ্রহণে কোন শ্রেণির কৃষক পেছনে আছে তা চিহ্নিত করে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ দরকার। এ ছাড়া সুবিধাভোগী শ্রেণি ব্যবধান কমাতে নীতিগুলো ডিজাইন করা, আসন্ন বৈশ্বিকসংকট ও খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকি বিষয়ে প্রান্তিক কৃষকসহ সব সম্প্রদায়কে সতর্ক করা, প্রতিষ্ঠানগুলোকে অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিমূলক করা খুবই প্রয়োজন।

 অপরদিকে বিনিয়োগনীতিগুলোকে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে উপযোগী করে গড়ে তোলার পাশাপাশি বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করা, কৃষি-খাদ্যব্যবস্থায় সবার সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা; প্রান্তিক কৃষকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান অত্যাবশ্যকীয়। টেকসইভাবে উৎপাদিত খাবার সরবরাহ করতে খাদ্যশৃঙ্খল ঠিক রাখা; খাদ্যের ক্ষয়ক্ষতি ও অপচয় রোধ করতে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও টেকসই প্যাকেজিং-ব্যবস্থাও গড়ে তুলতে হবে। দরিদ্র এবং দুর্বল কৃষি পরিবারকে ফসল উৎপাদন করতে উন্নত বীজ, রোপণের উপকরণ, সার, বাগান করার সরঞ্জামসহ প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ চলমান রাখা; টেকসই কৃষি ব্যবস্থাপনার আলোকে কৃষক এবং পরিবেশের জন্য সবচেয়ে স্মার্ট সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন।

 পিছিয়ে পড়া কৃষক পরিবার যাতে ফসল ফলিয়ে আয় বাড়িয়ে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতে পারে এবং কৃষক ব্যয়বহুল রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার না করে অর্থ সাশ্রয় করতে পারে, সে জন্য উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি গ্রহণ করা দরকার। পিছিয়ে পড়া কৃষকদের বসতবাড়ির আঙিনায় বা তাদের ক্ষুদ্র জমিতে প্রদর্শনী প্লট স্থাপনে সহযোগিতা করা দরকার। বিভিন্ন শাকসবজি ও ফলের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার চালানো; চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুফল হিসেবে জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহারের সুফল পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে পারলে জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে। জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময় এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে উদ্ভাবনী ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে দেশে একটি সহনশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই কৃষি-খাদ্যব্যবস্থার রূপান্তর ঘটাতে পারলে আগামীতে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত হতে পারে।

লেখক: সাবেক রেজিস্ট্রার, বিএসএফএমএসটিইউ
[email protected]

জবাবদিহির ব্যবস্থা করতে হবে

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:২২ পিএম
জবাবদিহির ব্যবস্থা করতে হবে
এ বি এম নাজমুস সাকিব

আয়নাঘর বা গোপন বন্দিশালার অস্তিত্ব থাকার বিষয়ে প্রথমবারের মতো কোনো বাহিনীপ্রধানের (র‌্যাব মহাপরিচালক) স্বীকার করার বিষয়টি প্রশংসা (‘অ্যাপ্রিশিয়েট’) করার মতো। আগে তো বাহিনীগুলোর দায়মুক্তি ও ভিন্ন যুক্তিগুলো ছিল খুবই অগ্রহণযোগ্য। যেমন- ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা বা ক্রসফায়ার নিয়ে র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বক্তব্য ছিল একই ধরনের। সেদিক থেকে গোপন বন্দিশালার অস্তিত্ব স্বীকার করার মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার বিষয়গুলো ইতিবাচকভাবে মনে হচ্ছে।

কথিত আয়নাঘর বা গোপন বন্দিশালায় কাউকে আটকে রাখা বা গুম করার মতো বিষয়গুলো কোনো বাহিনীর কাঠামোতে থাকতে পারে না। এটা ছিলও না। রাজনৈতিক কারণে বা বাহিনীর কারও ব্যক্তিস্বার্থে এজাতীয় কাজ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে একটি কঠোর বার্তা থাকা প্রয়োজন, সেটা হলো কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। অপরাধ করলে সে যেই হোক, তার শাস্তি হবেই। এই বার্তা যদি সমাজে বা রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা পায়, তাহলে এজাতীয় বেআইনি কাজ অনেকটাই কমে যাবে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আইনের রক্ষক, তারা আইন লঙ্ঘন করলে কঠোর শাস্তির বিধান থাকতে হবে। জবাবদিহি ও স্বচ্ছতাই নির্ধারণ করবে আগামী দিনের আইনশৃঙ্খলার সামগ্রিক বিষয়টি।

সহকারী অধ্যাপক, অপরাধবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাবি

'), descriptionParas[2].nextSibling); } if (descriptionParas.length > 6 && bannerData[arrayKeyTwo] != null) { if (bannerData[arrayKeyTwo].type == 'image') { descriptionParas[0].parentNode.insertBefore(insertImageAd(bannerData[arrayKeyTwo].url, ('./uploads/ad/' + bannerData[arrayKeyTwo].file)), descriptionParas[5].nextSibling); } else { descriptionParas[0].parentNode.insertBefore(insertDfpCodeAd(bannerData[arrayKeyTwo].custom_code), descriptionParas[5].nextSibling); } } if (descriptionParas.length > 9 && bannerData[arrayKeyThree] != null) { if (bannerData[arrayKeyThree].type == 'image') { descriptionParas[0].parentNode.insertBefore(insertImageAd(bannerData[arrayKeyThree].url, ('./uploads/ad/' + bannerData[arrayKeyThree].file)), descriptionParas[8].nextSibling); } else { descriptionParas[0].parentNode.insertBefore(insertDfpCodeAd(bannerData[arrayKeyThree].custom_code), descriptionParas[8].nextSibling); } } });