ঢাকা ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, শনিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪

বিশেষ সাক্ষাৎকার: নুরুল হক নুর সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি নিয়ে  জাতীয় সরকার হতে পারে

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:১৮ পিএম
সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি নিয়ে 
জাতীয় সরকার হতে পারে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সর্বশেষ ভিপি নুরুল হক নুর। মানুষের কাছে তিনি ভিপি নুর নামে পরিচিত। পটুয়াখালীর প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে উঠে আসা নুর ধাপে ধাপে নিজেকে তৈরি করে এখন রাজনীতির আলোচিত মুখ। আন্দোলন করতে গিয়ে বারবার হামলা-মামলা, জেল-জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। প্রতিবাদ-আন্দোলন থেকে নিবৃত্ত করতে না পেরে ভিপি নুরকে একাধিকবার অর্থবিত্তের প্রলোভন দেখিয়েছিলেন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালীরা। তার পরেও তাকে লক্ষ্য থেকে টলানো যায়নি। ভিপি নুরের দৃঢ় মনোবল এবং চেষ্টার ফলে দানা বাঁধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সেই আন্দোলন থেকেই পতন হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের। এসেছে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। 

এই সরকারের কাছে প্রত্যাশা কী? আন্দোলনের সময় দিনগুলো কেমন ছিল, সেসব নিয়ে কথা বলেছেন গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর। তিনি বলেন, এই সরকারের কোনো পলিটিক্যাল বেজ নেই। পলিটিক্যাল পার্টিগুলো যদি সরকারের বিপক্ষে চলে যায় তাহলে সরকার এক মাসও টিকতে পারবে না। এ জন্য আমরা বলেছিলাম সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তাদের প্রতিনিধি নিয়ে জাতীয় সরকার করতে পারে। তাহলে সবার প্রতিনিধিত্ব থাকবে। সবাই সরকারকে সাপোর্ট দিতে বাধ্য। তাহলে হয়তো সরকার সুন্দরভাবে সফলভাবে কাজগুলো এগিয়ে নিতে পারবে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খবরের কাগজের সিটি এডিটর আবদুল্লাহ আল মামুন


শেখ হাসিনা যেভাবে বিভিন্নজনকে পয়সা ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কিনে নিয়েছে, আমাদেরও বিভিন্ন সময় সে অফার করেছিল। আমরা বিক্রি হইনি। আমরা এ জন্য এখনো পরিষ্কারভাবে বলি, শেখ হাসিনার মতো এত শক্তিশালী দানবীয় সরকারের কাছে মাথা নত করিনি। কাজেই কারও কাছে মাথা বিক্রি করে রাজনীতি করব না। কারও কাছে নত হয়ে এমপি-মন্ত্রী হওয়ার জন্য রাজনীতি করব না। স্ট্রেট-ফরোয়ার্ড রাজনীতি করে যাব। দেশ ও জাতির পক্ষে আমাদের অবস্থান থাকবে। কে পছন্দ করল না করল, কে খুশি হলো, অখুশি হলো- বিন্দুমাত্র আমরা তা চিন্তাভাবনা করি না।...

খবরের কাগজ: আপনি কি মনে করেন আওয়ামী লীগের পতনের জন্য আপনার ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য? 
নুরুল হক নুর: আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না যে, এটা আমার একক কৃতিত্ব বা একক  কন্ট্রিবিউশন ছিল। আমরা একটা টিমওয়ার্ক করেছিলাম। বড় টিম ছিল। এ টিমের অনেকে হয়তো আমার মতো পরিচিতি পাননি বা মিডিয়ায় পরিচিত মুখ নন। তাদের অনেক কন্ট্রিবিউশন আছে। আমাদের একজন ছাত্রনেতা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্বদ্যিালয়ের ছাত্র। কোটা সংস্কারের আন্দোলন থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছিলেন এবং গুম হয়েছেন। আমাদের সঙ্গে অনেক ছাত্রনেতা, ছাত্র অধিকার পরিষদের প্রোগ্রাম করতে গিয়ে পা ভেঙেছে, চোখ হারিয়েছে। তারা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছে। তাদের পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ রকম বড় একটা কমিউনিটি আমার সঙ্গে ছিল এবং এখনো আছে। তাদের মুখপাত্র হিসেবে আমি সামনে ছিলাম।

 ফলে আমাকে আপনারা দেখছেন। কিন্তু আমরা যে সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছি, যে কাজগুলো করেছি, সেখানে সবার কন্ট্রিবিউশন ছিল। তরুণদের এই প্ল্যাটফর্ম ছাত্র অধিকার পরিষদ ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ থেকে তৈরি হয়েছে এবং ছাত্র অধিকার পরিষদ থেকে রাজনৈতিক দল গণ অধিকার পরিষদের জন্ম হয়েছে। গণ অধিকার পরিষদ ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। 

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যাদের দেখেন, তারা ছাত্র অধিকার পরিষদ থেকেই তৈরি হয়েছে। ছাত্র অধিকার পরিষদ তৈরি না হলে এই বিপ্লবী চেতনা এবং এভাবে এই সময়ে তারা বিদ্রোহ করত না। হয়তো অন্য কেউ করত আগে বা পরে। আমরা ২০১৮ সালের পর সারা বাংলাদেশের তরুণদের সম্পৃক্ত করেছি। তাদের সাহস, প্রতিক্রিয়া, প্রতিবাদ, দেশের প্রশ্নে আপসহীন ভাবনা আর ট্রিগার করেছে ছাত্র অধিকার পরিষদের সঙ্গে গণ অধিকার পরিষদ। এখানে রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তির অবদান ছিল, কন্ট্রিবিউশন ছিল। তবে এটা সবাইকে স্বীকার করতে হবে কো-অর্ডিনেশনের ক্ষেত্রে গণ অধিকার পরিষদের অগ্রণী ভূমিকা ছিল।
খবরের কাগজ: জেলখানায় নিয়ে যাওয়া বা কোর্টে হাজিরার সময় আপনাকে মুমূর্ষু অবস্থায় দেখেছি। আন্দোলন করতে গিয়ে আপনাকে কি পুলিশের নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে?

নুরুল হক নুর: মাঝে মাঝে ভাবি, আমি তো একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছি। জেলহাজত পর্যন্ত যেতে হয়েছে। একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়ে থানা বা ডিবি কার্যালয় থেকে ছাড়া পেয়েছি। আবার একবার দুই দফায় ১২ দিন রিমান্ডে ছিলাম। সেখানে গরু-ছাগল জবাই করার মতো ঝুলিয়ে পিটিয়েছে পুলিশ, 
টর্চার করেছে। 

খবরের কাগজ: এ বিষয়ে আরও বিস্তারিতভাবে আপনার অভিজ্ঞতা বলুন। 
নুরুল হক নুর: অভিজ্ঞতা বলতে দেখা যায়, নাশতা খেলাম, তারপর দুপুরে টর্চার শুরু হলো। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের গল্প শুনেছিলাম- অল্প বয়সী মেয়েদের পাকিস্তানি আর্মি অফিসাররা পালাক্রমে ধর্ষণ করত। একজন যেত বা একটা টিম যেত, পরে আর একটা টিম যেত বা আরেকজন যেত। কোনো একজন মা নাকি বলেছিলেন যে, ‘বাবারা তোমরা আসো একটু আস্তে আস্তে বা একটু সময় নিয়ে আসো। আমার মেয়েটা অনেক ছোট।’ আমার ক্ষেত্রে সে রকমই অভিজ্ঞতা যে, বিকেলে এক টিম এসেই জিজ্ঞাসাবাদ। জিজ্ঞাসাবাদ মানে চোখ বাঁধা, হাত বাঁধা। গরু যে হাল চাষ করে, ধরেন পেছনে একটা লাঠি থাকে, লাঠির মাথায় লোহার একটা সুচ থাকে। হাঁপিয়ে গেলে গুঁতা দিলে গরু আবার হাঁটা শুরু করে। কথা নেই, দেখা যায় পেছন থেকে একটা বাড়ি (আঘাত) পড়ে গেছে। কিংবা দেখা যায়, বসতে দিয়েছে একটা চেয়ারে- সেখানে আবার ইলেকট্রিক সেটআপ কারেন্টের শক দেওয়ার। মানে এ ধরনের নির্যাতন ছিল। এটা সব সময়ই হয়েছে। এক বেলা ডাকলে এক বেলা, দুই বেলা ডাকলে দুই বেলা, তিন বেলা ডাকলে তিন বেলা নির্যাতন করেছে। এ ধরনের নির্যাতন তাদের পৈশাচিক আনন্দের একটা জায়গা ছিল। আমার ক্ষেত্রে বিশেষ করে ছাত্রলীগ থেকে যারা ইয়াং পুলিশ অফিসার ছিল, ওদের বড় ধরনের ক্ষোভ ছিল। তাদের একজন আরেকজনকে বলছে- স্যার ও কত বড় বেয়াদব, ও প্রধানমন্ত্রীর নামের আগে ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’ বলে না। কেন আমি শেখ হাসিনার নামের আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলি না, সে জন্য পুলিশ অফিসার ক্ষুব্ধ। কেন শেখ মুজিবুর রহমানের নামের আগে আমি জাতির পিতা বলি না, তা নিয়ে ক্ষুব্ধ।
শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল কায়েম করেছিলেন, সেটা নিয়ে কেন আমি সমালোচনা করেছি? শেখ মুজিবুর রহমানের কি অবদান কম- এগুলো আমি কেন বলি? মানে পারসোনাল ক্ষোভ। যারা একেবারে আদর্শিকভাবে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, এটা তাদের একটা ক্ষোভের জায়গা ছিল। নির্যাতন-নিপীড়নের সব কথা বলাও যায় না। আমি মাঝে মাঝে ভেবেছি আসলে বাস্তবতাটা কত কঠিন। মাঝে মাঝে আমি দেখেছি- অন্য দলের সিনিয়র নেতাদের মেরে রক্তাক্ত করে ফেলেছে। কিন্তু রিমান্ডে যাওয়ার সময় সাদা পাঞ্জাবি, নতুন জামা-কাপড় পরে যাচ্ছে। যাওয়ার সময় কর্মীদের হাত নেড়ে আশ্বস্ত করতে চেয়েছে যে, এভরিথিং ইজ ওকে। বাট, দেখা যাচ্ছে, তার হাতটা ওঠাতেও কষ্ট হচ্ছে। কারণ মেরে বা পিটিয়ে ফুলিয়ে ফেলেছে। কিন্তু সে যেহেতু লিডার, তার কর্মীরা যাতে মনোবল 
না হারায়, আতঙ্কিত না হয়, এ জন্য নির্যাতনের 
কথা বলেননি।

আমার সঙ্গে যারাই ছিলেন- এই যে বিএনপির উত্তরের আহ্বায়ক ছিলেন সাইফুল ইসলাম নীরব ভাই। ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ভাই। দক্ষিণের মজনু ভাই। বিএনপির আরও সিনিয়র লিডার, এমপিরা। একটা লোককেও বাদ রাখেনি ঝোলানো থেকে, নির্যাতন থেকে, নিপীড়ন থেকে। তারা বয়স, সিনিয়রিটি নানা কারণে হয়তোবা মুখ খোলেননি। আমার ক্ষেত্রে মনে হয়েছে, আমি যদি এটা সহ্য করে যাই চুপ চুপ। তাহলে এটা চলতেই থাকবে। এটা বন্ধ করা দরকার। আমি পুলিশের প্রিজন ভ্যান থেকে বলেছিলাম, ডিবি কার্যালয়- আই ওয়াজ ট্রিটেড লাইক আ ফুটবল। সো এটা হচ্ছে অত্যাচার-নির্যাতন। দেখেছেন মনে হয়, আঘাতের চিহ্ন কোর্টে আমি টি-শার্ট খুলে দেখিয়েছিলাম। কারণ এখানে আমার হিরোগিরির কিছু নেই। আমার ওপর যে অত্যাচার-নির্যাতন হয়েছে, এটা দেশবাসী জানুক। দেশের 
মানুষ জানুক। 

খবরের কাগজ: মানুষ জানতে চায় আসলে নির্যাতনটা কীভাবে হয়েছে এবং পুলিশ কীভাবে নির্যাতন করে? 
নুরুল হক নুর: শেখ হাসিনার আমলেই পুলিশের রিমান্ডে যে রাজনীতিবিদরা টর্চারের শিকার হয়েছেন, অত্যাচারের শিকার হয়েছেন এমনটা নয়। এর আগেও যারা ছিলেন, এমন ঘটনা ঘটেছে হয়তো। তবে এতটা প্রকট আকারে হয়নি। রাজনীতিবিদদের প্রতি একটা সম্মান ছিল। শেখ হাসিনা তো সব রীতিনীতি ভেঙে তছনছ করে দিয়েছেন। শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ইনস্ট্রাকশন ছিল বিরোধীদলীয় নেতাদের ‘ঝুলাইয়া, পিটাইয়া, মাইরা’ ভিডিও তাদের পাঠাতে। পুলিশ বলেছে, ভাই আমাদের কিছু করার নেই, এই ভিডিও পাঠাতে হবে হোম মিনিস্টারের কাছে। বোঝেন তাহলে কতটা বর্বর, পৈশাচিক নির্যাতনের চিত্র। 

খবরের কাগজ: সুনির্দিষ্টভাবে জানতে চাই ঝোলানোটা কেমন ছিল? আপনার হাত ধরে, পা ধরে কীভাবে ঝুলিয়েছিল?
নুরুল হক নুর: হাতে তো হ্যান্ডকাফ পরা। হ্যান্ডকাফের ওপরে আই থিঙ্ক রিঙের মতো সিস্টেম। হ্যান্ডকাফ খুলে দুটি আঙুল দুটি রিঙের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেয়। পা-টা ফাঁসির আসামির মতো একটা নির্দিষ্ট দূরত্বে মাটি থেকে ওপরে ঝুলিয়ে দেয়। মাটি থেকে তক্তা বা কাঠের একটা কাঠামো থাকে। যখন পেটানো শুরু করে, পা থেকে ওপর পর্যন্ত ওটা একটু সরিয়ে দেয়। অটোমেটিক্যালি আপনি মুভ করতে থাকবেন। ওদের তো একটা ট্রেনিং আছে, আসলে কোথায় কীভাবে মারতে হয়। 
এমন হয়েছে, অনেক মানুষ তো বলতেও পারে না, দেখাতেও পারে না। তার পরই দেখা যায়, চেয়ারে বসতে দিয়েছে- নিচে ইলেকট্রিক শকের ব্যবস্থা রাখা আছে, বসলেই শক করে। ইভেন আমরা তো কিছুটা পরিচিত ফেস ছিলাম ন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনালে, ফলে আমাদের সঙ্গে অসভ্যতা অতটা করতে পারেনি।

এমনও হয়েছে ছাত্রদল, যুবদল বা শিবিরের ছেলেদের উলঙ্গ করে নির্যাতন করেছে। বালতির মধ্যে পানি রেখে ইলেকট্রিক লাইন দিয়ে সেখানে প্রসাব করতে বাধ্য করেছে। এ কারণে তারা কারেন্টের শক খেয়েছে। পুলিশ ওই চিত্র তাদের সিনিয়দের দেখায়, যাতে তারা ভয়ে-আতঙ্কে যা বলাতে চায় তা যেন বলে দেয়।
আমার কাছে স্বীকারোক্তি চেয়েছিল যে, বিটিভিতে আপনারা আগুন দিয়েছেন। মিরপুরের মেট্রোরেলে আগুন দিয়েছেন। তারেক রহমান নির্দেশ এবং টাকা-পয়সা দিয়েছে। এটা বললে তাহলে আর অন্য মামলায় জড়াবে না। আমি স্বীকারোক্তি দিইনি। বলেছি, তোমাদের এত সংস্থা- ডিজিএফআই, এনএসআই, এসবি আছে। তাদের কাছে খবর নাও এগুলো (আগুন)-কে দিয়েছে। এগুলো (আগুন) সরকার দিয়েছে। সাবোট্যাজ করেছে আন্দোলনে। আমি কেন স্বীকারোক্তি দেব? ফলে আরও টর্চার করেছে, হুমকি দিয়েছে সব মামলায় জড়াবে। দেখেছেন তো, গত ১৫ বছর মামলার তো একটা উৎসব ছিল। প্রতিযোগিতা ছিল কোন পুলিশ সদস্য বিএনপি, জামায়াত, গণ অধিকার পরিষদের নেতা-কর্মীদের নামে কত মামলা দিতে পারে। কত মিথ্যা মামলা সাজাতে পারে? মরা মানুষ হতো মামলার আসামি। যার হাত নেই, সেও বোমা ছুড়ে মারার মামলার আসামি হয়েছে- এ ধরনের চিত্র তো দেখেছি।

খবরের কাগজ: আপনাকে কখনো প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল সরকারের সঙ্গে মিলে যান?
নুরুল হক নুর: এটা তো শুরু থেকেই ছিল। শেখ হাসিনার গত দেড় দশকে ধারাবাহিকভাবে লড়াই, সংগ্রাম চালিয়ে গেছে কে? একমাত্র ২০১৮ সালের আন্দোলনের পর থেকে আমার টিমের সহযোগিতা, আমার সহযোদ্ধা ও সহকর্মীদের সমর্থনে সাহস নিয়ে লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে গেছি। শেখ হাসিনার জন্য আমরা বড় একটা থ্রেট ছিলাম। শেখ হাসিনা যেভাবে বিভিন্নজনকে পয়সা ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কিনে নিয়েছে, আমাদেরও বিভিন্ন সময় সে অফার করেছিল। আমরা বিক্রি হইনি। আমরা এ জন্য এখনো পরিষ্কারভাবে বলি, শেখ হাসিনার মতো এত শক্তিশালী দানবীয় সরকারের কাছে মাথা নত করিনি। কাজেই কারও কাছে মাথা বিক্রি করে রাজনীতি করব না। কারও কাছে নত হয়ে এমপি-মন্ত্রী হওয়ার জন্য রাজনীতি করব না। স্ট্রেট-ফরোয়ার্ড রাজনীতি করে যাব। দেশ ও জাতির পক্ষে আমাদের অবস্থান থাকবে। কে পছন্দ করল না করল, কে খুশি হলো, অখুশি হলো- বিন্দুমাত্র আমরা তা চিন্তাভাবনা করি না। আমাদের পরিষ্কার কথা হলো- রাজনীতিগতভাবে ৫০ বছর দেশে যা চলেছে, যেভাবে চলেছে সেই পথে আগামীর বাংলাদেশ চলবে না। সেখান থেকে বের হয়ে আসতে হলে নিউ লিডারশিপ প্রয়োজন এবং জেন জি (নিউ জেনারেশন) সেটা প্রমাণ করেছে। একজিস্ট লিডারশিপের বাইরে তারা নিজ নিজ জায়গা থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে। যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, উত্তরা, রামপুরা- কী ধরনের এই প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ ছিল? এখানে কে লিড দিয়েছে, কে লিডার ছিল? কেউ ছিল না। সম্মিলিতভাবে তারা নেতৃত্ব দিয়েছিল। আমার বিশ্বাস, ‘দিস ইস আই টাইম পলিটিক্স’-এ একটু চেঞ্জ আনা এবং সেই লক্ষ্যেই গণ অধিকার পরিষদ কাজ করছে। আমরা আশাবাদী এবং দেশের মানুষকে বলব, আপনারা সচেতন হন। সঠিক মানুষকে রাজনীতিতে সাপোর্ট দিন। সঠিক মানুষের নেতৃত্বে থাকুন। একটা পরিবর্তন করতে হবে। একটা জাতির ভাগ্যে এ রকম সুযোগ বারবার আসে না। ৫৩ বছরে আমরা একবার পেয়েছি, একটা গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়েছি। এখন আমাদের দরকার একটা জাতীয় ঐক্যের সরকার। এই সরকারের মাধ্যমে আমরা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র কাঠামোর পরিবর্তন বা বিলোপের চিন্তাভাবনা করছি। জাতীয় ঐক্যের সরকারের মাধ্যমে পরিবর্তন করে একটা 
নতুন কাঠামো প্রণয়ন করতে হবে। যে কারণে 
নতুন সংবিধানের একটা দাবি উঠছে। আমরা সেই দাবির পক্ষে। 

খবরের কাগজ: আপনি কি মনে করেন গণ-আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে যে সরকার এসেছে, তারা আপনাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূরণের জন্য ঠিকঠাক কাজ করছে?
নুরুল হক নুর: একটা সরকারকে মূল্যায়ন করার জন্য দু-তিন মাস পর্যাপ্ত সময় না। শেখ হাসিনা গত ১৫ বছরে রাষ্ট্রকে একটা ব্যক্তির ওপরে ডিপেন্ডেবল করেছিলেন। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো একটা ব্যক্তির আঙুলের হ্যালনে চলত। এ রকম একটা ভঙ্গুর রাষ্ট্রব্যবস্থায় হঠাৎ করে সরকার পরিবর্তন হলো। নতুন এসেই তারা এই সেটআপ পরিবর্তন করতে পারবে না। এই সরকারের আন্তরিকতা আছে। সরকারের ভালো লোক আছে। তারা ভালো কিছু করতে চায়। তবে রাজনৈতিক সহযোগিতা ছাড়া তারা ভালো কিছু করতে পারবে না, সফল হবে না। সে জন্য আমরা শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে তাদের বারবার পরামর্শ দিয়েছি- যে আন্দোলনকারী স্টেক হোল্ডারদের নিয়ে এই সরকারকে একটা জাতীয় সরকারের রূপ দেওয়া, একটা নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত তারা থাকবে এবং একটা রোডম্যাপ প্রকাশ করা। তাদের কাজের ধরন মানুষের সামনে উপস্থাপন করা। মানুষ রাষ্ট্র সংস্কার চাচ্ছে। প্রশাসনের সংস্কার চাচ্ছে। গভর্মেন্ট সার্ভিসের সংস্কার চাচ্ছে। রাজনীতি সংস্কার চাচ্ছে। এ জন্য একটু সময় লাগবে। সে জন্য আমরা বলছি, বছর দুয়েক সময় প্রয়োজন হবে। এখন রাজনৈতিক দলগুলো যদি সরকারকে সেই সময়টা না দেয় তাহলে সরকার থাকতে পারবে না। কারণ এই সরকারের কোনো পলিটিক্যাল বেজ নেই। পলিটিক্যাল পার্টিগুলো যদি সরকারের অ্যাগেইনেস্টে চলে যায়। তাহলে সরকার এক মাসও টিকতে পারবে না। এ জন্য আমরা বলেছিলাম, সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তাদের প্রতিনিধি নিয়ে যদি জাতীয় সরকার করতে পারে। তাহলে সবার প্রতিনিধিত্ব থাকবে। সবাই সরকারকে সাপোর্ট দিতে বাধ্য। তাহলে হয়তো সরকার সুন্দরভাবে, সফলভাবে কাজগুলো এগিয়ে নিতে পারবে।

খবরের কাগজ: সংসদ নির্বাচনের আগে জাতীয় সরকার হওয়ার কোনো সুযোগ আছে বলে আপনি মনে করেন?
নুরুল হক নুর: আমি মনে করি অবশ্যই নতুন নতুন ক্রাইসিস তৈরি হচ্ছে। মাঝখানে দেখেছেন না রাষ্ট্রপতি নিয়ে রাজনৈতিক দল ও ছাত্র-জনতার মধ্যে কী ধরনের একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে? এখন কেউ বলছে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন। কেউ বলছে ডাবল চেম্বার বা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট নির্বাচন। কেউ বলছে বিদ্যমান সিস্টেমে। এই যে জটিলতাগুলো বা নানা ধরনের মতামত তৈরি হচ্ছে- দিন শেষে এর তো একটা কালেক্টিভ ওপেনিয়ন প্রয়োজন। একটা সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন। সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি ইউনিটি বা আলাপ-আলোচনা না থাকে, সরকারের সঙ্গে যদি রাজনৈতিক দলগুলোর বোঝাপড়া না থাকে তাহলে এটা সম্ভব নয়। এ জন্য আমরা বলছি, এখনো সুযোগ আছে। ২১ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদের কাঠামো দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব নয়। এটাকে আরও বাড়ানো দরকার। একুশের জায়গায় যদি ৩১ হয় সরকারের লস আছে? আপনার লস আছে, আমার লস আছে? নেই তো। তাহলে এখানে আট-দশটা রাজনৈতিক দল থেকে আট-দশজন রাজনৈতিক নেতা নেওয়া যেতেই পারে। তাহলে তাদের সাপোর্টটা সরকারের প্রতি থাকবে। তখন সরকার স্মুথলি কাজ করতে পারবে।
 
খবরের কাগজ: বিএনপি কি আপনার এই প্রস্তাবের সঙ্গে একমত?
নুরুল হক নুর: আমি জানি না বিএনপির অবস্থানটা কী? কারণ বিএনপিকে আমরা এ বিষয়ে কখনো জিজ্ঞেস করিনি। বিএনপির সঙ্গে আমাদের অত্যন্ত ভালো বোঝাপড়া আছে। আমরা বিএনপিকে কখনো বলিনি। সরকারে যারা আছে তাদের বলেছি। পাবলিকলি অনেকবার বলেছি। বিএনপি তো বলছে, তারেক রহমান জাতীয় সরকার করবেন। 
খবরের কাগজ: বিএনপি আপনাকে নির্বাচনি এলাকায় নির্বিঘ্নে কাজ করার জন্য সহযোগিতা করছে। নির্বাচনের সময় রিলেশনটা কেমন থাকবে? একসঙ্গে নির্বাচন করবেন? 

নুরুল হক নুর: আওয়ামী ফ্যাসিবাদ পতনের এক দফা দাবিতে একসঙ্গে যে আন্দোলন করেছিলাম, সেই ইউনিটি ধরে রাখা বিএনপির জন্য জরুরি। বিএনপি একটা বড় রাজনৈতিক দল। সরকার গঠন করলে তারাই বেনিফিটেড হবে। ছোট দলগুলোকে নিয়ে যদি বিএনপি একটা জাতীয় সরকার গঠন করতে পারে সেটা দেশ-বিদেশে পরিচিতি পাবে। 
আমাদের পরিষ্কার কথা যে, হাসিনা সরকারের কাছে মাথা বিক্রি করে আমরা রাজনীতি করিনি। আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে কিংবা নতজানু হয়ে গণ অধিকার পরিষদ কিংবা পরিষদের নেতারা রাজনীতি করবে না। যেখানে আমাদের মূল্যায়ন হবে, আমাদের মর্যাদা থাকবে চিন্তাভাবনা করে সেখানে আমরা এগোব।
খবরের কাগজ: ধন্যবাদ।
নুরুল হক নুর: আপনাকেও ধন্যবাদ।

২০২৫ সালে ইউক্রেনে কি শান্তি ফিরে আসবে?

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০২ পিএম
২০২৫ সালে ইউক্রেনে কি শান্তি ফিরে আসবে?
ড. ডায়ানা গালিভা

২০২৪ সালজুড়েই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলমান ছিল। রাশিয়া ভেলিকা নোভোসিল্কা এবং ভুহলেদার অঞ্চলকে তার সুবিধাজনক যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে রেখে দিয়েছে। দোনেৎস্ক ওব্লাস্টের সামনের লাইনটি আরও উত্তাল হয়ে উঠছে। কারণ, এখানে যুদ্ধের প্রস্তুতি এমনভাবে করা হয়েছে, যা ২০২৩ সালের তুলনায় অনেক বড় পরিসরে। ২০২৪-এর আরেকটি স্বতন্ত্র দিক ছিল গত আগস্টে কুরস্ক আক্রমণ। 

যেখানে ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনী রাশিয়ায় আক্রমণ করেছিল। অন্যদিকে অক্টোবরের মধ্যে রাশিয়ান বাহিনী ইউক্রেনের দখলকৃত প্রায় অর্ধেক অঞ্চল পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়। এই অঞ্চলটিই ছিল ২০২৪ সালের রণাঙ্গনের বড় ক্ষেত্র। আশা করা হচ্ছে, নতুন কূটনৈতিক কৌশল এবং গতিশীলতা দেখা দেবে আগামী বছর। ২০২৫ সালে কি ইউক্রেনে শান্তির দেখা মিলবে? 

ইউক্রেনে যত দ্রুত সম্ভব শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায়, তা নিয়ে ভাবছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। নভেম্বরে জি-২০ নেতারা রিওডি জেনেরিও শীর্ষ সম্মেলনে তাদের চূড়ান্ত ঘোষণা দেন। সেখানে তারা ‘হুমকি বা শক্তি প্রয়োগের নিন্দা করে ব্যাপক, ন্যায়সংগত এবং টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতি সমর্থন করে সব প্রাসঙ্গিক এবং গঠনমূলক উদ্যোগ’ নিতে চেষ্টা করেন। ২০২৪ সালে নিজ নিজ মিত্র এবং অংশীদারদের মাধ্যমে উভয় পক্ষে সামরিক, আর্থিক এবং রাজনৈতিক সমর্থন অব্যাহত রাখার বিষয়টি লক্ষ করা গেছে। 

ইউক্রেনকে অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতা করছে। জার্মানিভিত্তিক কিয়েল ইনস্টিটিউটের মতে, ইউরোপ ২০২২ সালে যুদ্ধ শুরু হওয়া থেকে ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ইউক্রেনকে সমর্থন করার জন্য ১২৫ বিলিয়ন ডলার এবং যুক্তরাষ্ট্র ৯০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। যুক্তরাজ্য এই দুই বছরে ইউক্রেনের জন্য অন্যতম প্রধান সাহায্যদাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। যুক্তরাজ্য আশ্বাস দিয়ে বলেছে, ‘যতদিন লাগে’ তারা ইউক্রেনকে প্রতিবছর ৩ বিলিয়ন ডলার সামরিক সহায়তা দেবে।
 
রাশিয়াও তার নিজ মিত্রদের মাধ্যমে রাজনৈতিক ও সামরিক সমর্থন পেয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো উত্তর কোরিয়ার ভূমিকা। গত সপ্তাহে জি-৭ এর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকের সময় গ্রুপটি রাশিয়াকে ‘দায়িত্বহীন ও হুমকিমূলক পারমাণবিক বক্তব্য’ দেওয়ার জন্য নিন্দা করেছে। মস্কোর প্রতি উত্তর কোরিয়ার সমর্থনকে বিপজ্জনক বলে মনে করছে বিশ্ববাসী। এর আগেও উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়া তাদের সমন্বিত কৌশলগত অংশীদারি চুক্তিতে অনুমোদন করেছে। দক্ষিণ কোরিয়া কুরস্ক অঞ্চলে ১০ হাজার সৈন্য পাঠানো এবং মহাকাশে প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করার জন্য উত্তর কোরিয়াকে অভিযুক্ত করেছে। 
অন্যান্য দেশ, যেমন- ইউনাইটেড আরব আমিরাত তাদের নিরপেক্ষ রাজনৈতিক অবস্থান বজায় রেখেছে। ইউনাইটেড আরব আমিরাত মধ্যস্থতা করে যাচ্ছে। এর ইতিবাচক দিক হলো সেপ্টেম্বরে দুই পক্ষ থেকে ১০৩ জন যুদ্ধবন্দির বিনিময়। 

আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় হলো- দুই পক্ষের মধ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। রাশিয়া ডিনিপ্রোর ওপর আক্রমণে ওরেশনিক হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছে। মস্কো ব্যাখ্যা করেছে, রাশিয়ার ভূখণ্ডকে লক্ষ্যবস্তু করে কিয়েভ মার্কিন এবং যুক্তরাজ্যের তৈরি বা সরবরাহ করা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের প্রতিক্রিয়া ছিল এই আক্রমণ। মস্কো কখনোই তার পারমাণবিক সক্ষমতা দেখায়নি। তবে তারা ‘ভয়ংকর’ অস্ত্র তৈরি করে যাচ্ছে। যেহেতু উভয় পক্ষই  তাদের গতি, দূরত্ব এবং প্রভাব বিস্তারের জন্য সুবিধা খোঁজে, তাই আগামী দিনে ভারী এবং উন্নত অস্ত্রের বৃদ্ধি অব্যাহত থাকার আশঙ্কা রয়েছে। 

এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৫ সালে দুই পক্ষের মধ্যে কোনো শান্তিচুক্তির আশা কি দেখা দেবে? ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি একটি ‘শান্তি সূত্র’ প্রস্তাব করার চেষ্টা করেছিলেন। ইউক্রেনের সমগ্র অঞ্চল থেকে রাশিয়ার প্রত্যাহারের দাবিগুলো নিয়ে গত জুনে সুইজারল্যান্ড শীর্ষ সম্মেলনের সময় একটি রূপরেখা দেওয়া হয়েছিল। যদিও প্রচেষ্টাগুলো সফল হয়নি। কারণ গ্লোবাল সাউথের দেশগুলো আলোচনায় রাশিয়া বা ইসরায়েলের উপস্থিতি ও অনুপস্থিতিকে সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে তারা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। 

পূর্ববর্তী পরামর্শগুলোও সেই সম্মেলনে আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছিল। যেমন, গত মে মাসে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান শান্তি আলোচনা আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। যখন চীনের প্রধানমন্ত্রী ওয়াং ই ‘শান্তিই শক্তি’র মাধ্যমে দুই বছরের ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করতে চেয়েছিলেন। 

এই ব্যর্থতার পর জেলেনস্কি অক্টোবরে আবার যুদ্ধ শেষ করার জন্য তার ‘বিজয় পরিকল্পনা’ উপস্থাপন করেন। এর মধ্যে রয়েছে নির্দিষ্ট অস্ত্র ব্যবহারের অনুরোধ এবং অবিলম্বে ন্যাটোতে যোগদানের ‘নিঃশর্ত’ আমন্ত্রণ। তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমার এবং ন্যাটোর নতুন মহাসচিব মার্ক রুটের সঙ্গে সাক্ষাতের মাধ্যমে তার দেশের জন্য সশস্ত্র ও আর্থিক সহায়তা জোরদার করতে ইউরোপ সফর শুরু করেন। নভেম্বরে জি-৭ বৈঠকে নেতারা ইউক্রেনের প্রতি তাদের ‘যতদিন সময় লাগে’ বলে সমর্থন পুনঃপ্রকাশ করেন। কারণ, জেলেনস্কি ‘কূটনৈতিক উপায়ে’ ২০২৫ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করার আশা করেছিলেন। ক্রেমলিন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল যে, জেলেনস্কির পরিকল্পনা ন্যাটো এবং রাশিয়ার মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষের দিকে নিয়ে যেতে পারে। 

অনেক পর্যবেক্ষক জানুয়ারিতে ওভাল অফিসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আনুষ্ঠানিক প্রত্যাবর্তনের জন্য উদ্বিগ্নভাবে অপেক্ষা করছেন। কারণ তিনি ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যে’ যুদ্ধ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যদিও এখন পর্যন্ত কোনো বিশদ বা স্পষ্ট পরিকল্পনা দেওয়া হয়নি। গত মাসে রিপোর্ট করা হয়েছিল যে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ট্রাম্পের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিয়ে আলোচনা করার জন্য উন্মুখ ছিলেন। কিন্তু তিনি আঞ্চলিক মূল বিষয়গুলো ছাড় দেওয়ার ব্যাপারে অস্বীকার করেছিলেন। 

আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, ২০২৪ সালে ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতের কোনো সমাধান হয়নি। এমনকি অস্ত্রশস্ত্র এবং নতুন দেশ এই যুদ্ধে সম্পৃক্ততার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। উভয় পক্ষের বক্তৃতার মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ রয়েছে, যেখানে ‘বিজয়’ ও  ‘শান্তি’র পরিবর্তে অন্য কোনো অর্থ বহন করছে। এমনকি ট্রাম্প ইউক্রেনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন কিছুটা দুর্বল করলেও ইউরোপীয় নেতাদের দৃঢ় অবস্থান বজায় রাখার সম্ভাবনা বেশি। রাশিয়া সম্ভবত তার বর্তমান মিত্রদের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তুলবে, বিশেষ করে যতদূর সামরিক প্রতিরোধ বজায় রাখা যায়।

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের দ্রুত সমাধান হওয়াটা কঠিন। অন্তত যতক্ষণ না প্রধান অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে নেতৃত্ব ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে। ২০২৫ হতে পারে শান্তি নির্মাণের বছর। এটি অর্জনের জন্য অনেক প্রচেষ্টা করা হবে। মনে হচ্ছে, কোনো ধরনের ব্রেকিং পয়েন্ট বা সিদ্ধান্তে না পৌঁছানো পর্যন্ত রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট কাটবে না। 

লেখক: একাডেমিক ভিজিটর, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় 
আরব নিউজ থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল  

রাজধানীর বায়ুদূষণ রোধ করা জরুরি

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৫৮ এএম
রাজধানীর বায়ুদূষণ রোধ করা জরুরি
সৈয়দ ফারুক হোসেন

আইকিউএয়ারের ২০২৩ সালের বছরভিত্তিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বায়ুদূষণ বেশি বাংলাদেশে। এ তালিকায় ১ নম্বরে বাংলাদেশ। এর পর রয়েছে পাকিস্তান, ভারত, তাজিকিস্তান ও বুরকিনা ফাসো। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় ১ নম্বরে ছিল ভারতের নয়াদিল্লি। এর পর রয়েছে ঢাকা, বুরকিনা ফাসোর ওয়াগাডুগু, তাজিকিস্তানের দুশানবে ও ইরাকের বাগদাদ। শীত এলে বায়ুদূষণ আরও বাড়ে। বাংলাদেশ ও রাজধানী শহর ঢাকায় বায়ুদূষণের সমস্যাটি নতুন নয়। শুষ্ক মৌসুমে বিশ্বের দূষিত শহরগুলোর তালিকায় ঢাকা প্রায়ই ১ নম্বরে থাকে।

 সম্প্রতি গত শুক্রবার ছুটির দিনে রাত পৌনে ৯টায় বিশ্বের ১২৫টি শহরের মধ্যে দূষণের দিক দিয়ে ঢাকা ছিল তৃতীয়। শীর্ষে ছিল পাকিস্তানের লাহোর, দ্বিতীয় ভারতের নয়াদিল্লি। সাধারণত একিউআই স্কোর ৫০ থেকে ১০০-এর মধ্যে থাকলে ‘স্বাভাবিক অবস্থা’ বলা হয়। স্কোর ১০১ থেকে ২০০-এর মধ্যে থাকলে ‘অস্বাস্থ্যকর’, স্কোর ২০১ থেকে ৩০০-এর মধ্যে থাকলে ‘খারাপ’ এবং ৩০১ থেকে ৪০০ স্কোর হলে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে বিবেচিত হয়। বছর বছর বায়ুর মানের অবনতি হচ্ছে। 

ঢাকার রাস্তায় বের হলেই দেখা যায়, খোঁড়াখুঁড়ি অথবা নির্মাণকাজ চলছে; সেখানে ধুলোবালি যথেচ্ছভাবে ছড়াচ্ছে। রাস্তায় বের হলেই দেখা যায়, বহু পুরোনো লক্কড়ঝক্কড় বাস, লেগুনার মতো যানবাহন কালো ধোঁয়া ছেড়ে চলাচল করছে, বর্জ্য পোড়ানো হচ্ছে। মূলত ঢাকায় বায়ুদূষণের বড় উৎস নির্মাণকাজ। এর পর রয়েছে ইটভাটা ও কারখানা, আন্তর্দেশীয় দূষিত বায়ু এবং রান্নার চুলা। ঢাকার বাতাসে অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদানের সঙ্গে চারটি উপাদানের আশঙ্কাজনক উপস্থিতি রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা, সালফার ডাই-অক্সাইড ও ব্ল্যাক কার্বন।

 শীতের শুরু থেকেই ঢাকার বায়ুমান কখনো চরম অস্বাস্থ্যকর এবং কখনো বিপজ্জনক পর্যায়ে চলে যায়। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যান্য শহরে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখা, বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের বাইরে যাওয়া নিষেধ করা হয়। এ ছাড়া বায়ুদূষণ দূর করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়। একটি সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর নগরের জন্য আয়তন অনুযায়ী জনসংখ্যা সীমিত রাখা, গাছপালা ও জলাভূমি রক্ষা করা আর বায়ু-মাটিদূষণ নিয়ন্ত্রণে রাখাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন বিশেষজ্ঞরা। এসব কারণে ঢাকার অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছে। এক যুগ ধরে ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান উৎস হিসেবে ইটভাটাকে মনে করা হতো। কিন্তু এই জরিপ বলছে, ঢাকার বাতাসে দূষিত বস্তুর উৎস হিসেবে ইটভাটার স্থান দখল করেছে যানবাহন ও শিল্পকারখানার ধোঁয়া। দূষিত বাতাসে কঠিন ও তরল পদার্থ উড়ে বেড়ায়, যার মধ্যে রয়েছে কাচ, ধোঁয়া বা ধুলা, যেগুলোকে ‘বস্তুকণা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এসব বস্তুকণার মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী বলা হয় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ‘বস্তুকণা ২.৫’। যেটি মানুষের চুলের ব্যাসের মাত্র ৩ শতাংশ, যেটি মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ঢুকে যায়। 

এই দূষণ সবচেয়ে বেশি হয় জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে; যা মূলত গাড়ির ইঞ্জিন বা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপন্ন হয়। ঢাকার বাতাসে ভেসে বেড়ানো অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা পাওয়া গেছে প্রতি ঘনমিটারে ৮৬ মাইক্রোগ্রাম, যা ২০০৩ সালে ছিল ৭২ মাইক্রোগ্রাম। ডব্লিউএইচও বলছে, বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার সহনীয় মাত্রা ৫ মাইক্রোগ্রাম। ঢাকার বাতাসে সালফার ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ পাওয়া গেছে ৮ দশমিক ৯ মাইক্রোগ্রাম, যা ২০০৩ সালে ছিল ৫ মাইক্রোগ্রাম। ডব্লিউএইচওর মানদণ্ড অনুযায়ী, বাতাসে সালফার ডাই-অক্সাইডের সহনীয় মাত্রা ৪০। অর্থাৎ সালফার ডাই-অক্সাইড সহনীয় মাত্রার চেয়ে কম রয়েছে ঢাকার বাতাসে। কিন্তু এটা বাড়ছে। গত বছর যা ছিল মাত্র ৬ মাইক্রোগ্রাম। ঢাকায় বর্ষায় ডেঙ্গুর ভয়, শীতে বায়ুদূষণের ভয়, সারা বছর থাকে শব্দদূষণ- মানুষ এসব সমস্যায় এখন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। 

বায়ু দূষিত হলে মানুষের শ্বাসতন্ত্রের রোগ বেড়ে যায়। ঘরে ঘরে যেমন সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত মানুষ বাড়ে, তেমনি হাসপাতালে বাড়ে শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত মানুষের ভিড়। বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি হয় শ্বাসতন্ত্রের রোগ। এর মধ্যে হাঁপানি, ফুসফুসের কাশি ছাড়াও লাং ক্যানসার, স্ট্রোক ও কিডনির সমস্যা হয়। এদিকে বায়ুমানের সূচক ২০০ অতিক্রম করলে একে ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ বলে ধরা হয়। বায়ুদূষণের কারণে সারা দেশে মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় ৫ বছর ৪ মাস।

 ঢাকায় কমেছে প্রায় ৭ বছর ৭ মাস। অর্থাৎ ঢাকায় বায়ুদূষণ না থাকলে আমরা আরও প্রায় ৭ বছর ৭ মাস বেশি বাঁচতে পারতাম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭২ বছর ৬ মাস। লাইফ ইনডেক্সের গবেষণা মতে, ১৯৯৮ সালে বায়ুদূষণের কারণে গড় আয়ু কমেছিল প্রায় ২ বছর ৮ মাস, ২০১৯ সালে সেটি ৫ বছর ৪ মাসে দাঁড়িয়েছিল। গবেষণা বলছে, সারা দেশের ৬৪টি জেলার প্রতিটিতেই বায়ুদূষণের হার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী অন্তত ৩ গুণ বেশি। বায়ুদূষণের সঙ্গে মানুষের গড় আয়ুর বিষয়টি জড়িত। 

গত কয়েক যুগে এই শহরের সবুজ এলাকা ও জলাভূমি হারিয়েছে, আর বাতাস-মাটি মারাত্মকভাবে দূষিত হয়েছে। গত এক বছরে বিশ্বের প্রধান শহরগুলোর বসবাসযোগ্যতা নিয়ে যে কয়টি জরিপ হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ঢাকার অবস্থান ছিল তলানিতে। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার ভারতের রাজধানী দিল্লিবাসী। বায়ুদূষণ লাইফ ইনডেক্সের তথ্যমতে, বায়ুদূষণের কারণে সারা বিশ্বে মানুষের গড় আয়ু কমেছে ২ দশমিক ২ বছর। স্থায়ীভাবে দূষণ বন্ধ করা গেলে বিশ্বের মানুষের গড় আয়ু ৭২ থেকে ৭৪ বছর হতো, যা সার্বিক হিসাবে ১৭ বিলিয়ন জীবন-বর্ষ। রাজধানী ঢাকায় গত ১০ বছরে বায়ুদূষণ বেড়েছে ৮৬ শতাংশ। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বায়ুদূষণের কারণে মানুষের গড় আয়ু ২ থেকে ৯ বছর পর্যন্ত কমছে। এর ফলে নানা ধরনের কঠিন অসুখের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্করাই বায়ুদূষণের সবচেয়ে বড় শিকার।

 পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্মল বায়ু ও টেকসই উন্নয়ন প্রকল্পের বাতাসের মান পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রাজধানীর বায়ু ২০১৪ সালে ১৬৫ দিন বিপজ্জনক ছিল। ২০১৫ সালে দূষণের মাত্রা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭৮ দিন। পর্যায়ক্রমে ২০১৬ সালে ১৯২ দিন, ২০১৭ সালে ২১২ দিন, ২০১৮ সালে ২৩৬ দিন, ২০১৯ সালে ২৮৩ দিন ঢাকার বায়ু দূষিত ছিল, যার ধারাবাহিকতায় ২০২০ ও ২০২১ সালে বায়ুদূষণের তালিকায় প্রথম হয় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। মৃত জীবদেহের পচনের ফলে অনেক ধরনের দুর্গন্ধযুক্ত গ্যাস যেমন মিথেন, হাইড্রোজেন সালফাইড ইত্যাদি বাতাসের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে বায়ুর দূষণ ঘটায়। মহাকাশ থেকে ভূপৃষ্ঠে আগত উল্কাপিণ্ড, মহাজাগতিক ধূলিকণা প্রভৃতি বাতাসের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে বায়ুর দূষণ ঘটায়।

মানুষের দৈনন্দিন কার্যকলাপের ফলে প্রতিনিয়ত অবাঞ্ছিত বস্তু বাতাসে মিশ্রিত হচ্ছে, এগুলোকেই মনুষ্যসৃষ্ট কারণ বলে। শিল্পাঞ্চলের কারখানা থেকে নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, হাইড্রো কার্বন, ধাতব কণা, ধোঁয়া প্রভৃতি প্রচুর পরিমাণে বাতাসে মিশ্রিত হয়ে বাতাসকে দূষিত করে। বিভিন্ন যানবাহনে জীবাশ্ম জ্বালানির (পেট্রোল ও ডিজেল) দহনের ফলে বিভিন্ন ক্ষতিকর গ্যাস নির্গত হয়। এগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান বায়ুদূষক কার্বন মনো-অক্সাইডের প্রায় ৭০ শতাংশ এই যানবাহন থেকে নির্গত হয়। এ ছাড়া যানবাহনের ধোঁয়ায় প্রচুর নাইট্রোজেনের অক্সাইড থাকে, যা বায়ুকে দূষিত করে তোলে।

 যানবাহনের আধিক্যের জন্য শহরাঞ্চলের বাতাস বেশি দূষিত হয়। বায়ুমণ্ডলকে দূষণমুক্ত রাখতে নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করা প্রয়োজন। গাছ অক্সিজেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইডের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে, তাই প্রচুর পরিমাণে বৃক্ষ রোপণ করলে বায়ুমণ্ডলে বিভিন্ন গ্যাসের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা হয়। জীবাশ্ম জ্বালানি দহনে বাতাস বেশি দূষিত হয়। তাই এগুলোর পরিবর্তে দূষণমুক্ত সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, জোয়ার-ভাটার শক্তি প্রভৃতি ব্যবহার করা প্রয়োজন। সালফারবিহীন কয়লা ও সিসাবিহীন পেট্রোল ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাসের সাহায্যে যানবাহন চালানোর মাধ্যমে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। 

বায়ুদূষণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ আইন প্রয়োগ করে দূষণকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করলে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বায়ুদূষণের উৎস বা কারণ এবং কুফল সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বোধ জাগিয়ে তুললে বায়ুদূষণ রোধ করা সম্ভব। দুই কারণে ঢাকার বায়ু বেশি দূষিত হচ্ছে। প্রথমটি বাতাসের দূষিত উপাদান বাতাসেই রয়ে যাচ্ছে। এর বাইরেও রয়েছে শহরে বড় প্রকল্পের কাজ, নির্মাণাধীন ভবনের কাজ, যানবাহনের ধোঁয়ায় ঢাকার বায়ুর চাপ বেশি। এই দূষিত অংশ বায়ুর নিম্নস্তরে ২০০৩০০ ফুট ওপরে অবস্থান করছে। বর্তমানে বায়ুদূষণে ধুলার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গাড়ি ও শিল্পকারখানার ধোঁয়া। বর্তমানে বাতাসে ধুলা আগের চেয়ে পরিমাণে বেড়েছে। আগে এত মেগা প্রজেক্ট (বৃহৎ প্রকল্প) ও গাড়ি ছিল না। 

পাশাপাশি ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার জলাশয় ভরাট হওয়ায় ধুলার নতুন উৎস জন্মেছে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশে ধুলা এমনিতে বেশি। এরপর কয়েক বছর ধরে অনিয়ন্ত্রিতভাবে উন্মুক্ত পরিবেশে নতুন নতুন নির্মাণযজ্ঞ বাড়িয়েছে ধুলাদূষণ। মেট্রোরেলের মতো বড় প্রকল্প, পূর্বাচল সিটি ও বছিলার মতো কিছু অঞ্চল এবং অজস্র ছোট আবাসন প্রকল্প এর মধ্যে রয়েছে। যোগ হয়েছে মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধের মতো খানাখন্দে ভরা কিছু রাস্তা। এসব স্থান ছাড়াও রাজধানীর প্রবেশমুখ গাবতলী, যাত্রাবাড়ী, পূর্বাচল, কেরানীগঞ্জ, টঙ্গীসহ আরও কিছু এলাকায় ধুলার আধিক্য দেখা যায়। ঢাকা শহর ক্ষমতার চেয়ে তিন থেকে চার গুণ স্থাপনা ধারণ করে আছে। এরপরও শিল্পায়ন, কংক্রিটের ভবন, আবাসন প্রকল্প হচ্ছে। 

বাফার এলাকাগুলো মাটি ও বালু দিয়ে ভরাট করে নির্মাণযজ্ঞ চলছে। ফলে দূষণ রোধের এলাকাগুলো উল্টো দূষণ বাড়াচ্ছে। শুধু পানি ছিটিয়ে উষ্ণ আবহাওয়ায় ধুলা বেশিক্ষণ ভিজিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এই অবস্থার মধ্যেও গত বছর পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বায়ুদূষণ রোধে নির্দেশিকার বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। নির্দেশিকায় রাস্তা নির্মাণের সময় নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা, বিটুমিনের ওপর বালু না ছিটিয়ে মিনি অ্যাসফল্ট প্যান্টের মতো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার, রাস্তার পাশের মাটি কংক্রিট বা ঘাসে ঢেকে দেওয়া, রাস্তা পরিষ্কারের ঝাড়ুর পরিবর্তে ভ্যাকুয়াম সুইপিং ট্রাক ব্যবহার, বড় সড়কে কমপক্ষে দুবার পানি ছিটানোর ব্যবস্থা নেওয়া কোনোটি কার্যকর করার উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে এখনই জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়।

লেখক: সাবেক রেজিস্ট্রার, বিএসএফএমএসটিইউ
[email protected]

জাতীয় ঐক্য সব সময় ভালো উদ্যোগ: ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৫০ পিএম
আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৫৪ পিএম
জাতীয় ঐক্য সব সময় ভালো উদ্যোগ: ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম
ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

জাতীয় ঐক্য সব সময় ভালো, দেখা যাক এটার ফলাফল কী দাঁড়ায়। তবে ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের কিছুটা অবনতি হয়েছে। মূলত পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে, প্রাদেশিক সরকারের সঙ্গে।

কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে খুব একটা বড় রকমের মতবিরোধ হয় নাই। ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক খুবই গভীর। আমরা অনেক কিছুই আমদানি করি। রপ্তানির দিক থেকে যদিও কম। দুটিই প্রতিবেশী দেশ। তাই চেষ্টা করা হচ্ছে সম্পর্কটা ঠিক রাখার; সম্পর্ক যাতে অবনতি না হয়।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

সংকটে সবাইকে একত্রিত করা ভালো অগ্রগতি: ড. দিলারা চৌধুরী

প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৪২ পিএম
আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৫০ পিএম
সংকটে সবাইকে একত্রিত করা ভালো অগ্রগতি: ড. দিলারা চৌধুরী
ড. দিলারা চৌধুরী

আমি মনে করি, এটা একটা ইতিবাচক বিষয়। একটা ভূমিকা প্রধান উপদেষ্টা নিয়েছেন। ছাত্রদের সঙ্গে বসেছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসেছেন। এই সংকটে সবাইকে একত্রিত করা হয়েছে। এটা অত্যন্ত ভালো অগ্রগতি।

ভারতের বিষয়ে আমাদের এখন কথা বলতে হবে। আমরা আমাদের নাগরিককে গ্রেপ্তার করতে পারব না? চিন্ময় তো বাংলাদেশের নাগরিক। তার জন্য এ রকম করবে? তাহলে আমাদের স্বাধীনতা আছে নাকি। আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। ঐকমত্যে সবাইকে নিয়ে আসছেন, আমি খুবই খুশি। জনগণও খুশি হবে। আমাদের দেশের ওপর হুমকি এসেছে, আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে ড. ইউনূসকে সমর্থন দেব। এর বাইরে যে কথা বলবে সে দেশদ্রোহী।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সাবেক অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

লেবাননের যুদ্ধবিরতি এবং বিশ্ব পরিস্থিতি

প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৩৯ এএম
লেবাননের যুদ্ধবিরতি এবং বিশ্ব পরিস্থিতি
হর্ষ কাকর

যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের দীর্ঘ আলোচনার পর ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহ যুদ্ধবিরতি মেনে নিয়েছে। এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধের পর এই যুদ্ধবিরতি হয়। এই যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে, যাদের বেশির ভাগই নির্দোষ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‌এই চুক্তিটি লেবাননে যুদ্ধ বন্ধ করবে এবং লেবানন থেকে পরিচালিত হিজবুল্লাহ ও অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হুমকি থেকে ইসরায়েলকে নিরাপদ করবে।’ তারা আরও বলেন, ‘‌এই যুদ্ধবিরতি স্থায়ী শান্তি পুনরুদ্ধারের পরিস্থিতি তৈরি করবে। উভয় দেশের বাসিন্দাদের নিরাপদে তাদের বাড়িতে ফিরে যেতে দিন।’ 

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘আমরা চুক্তি কার্যকর করব এবং যেকোনো লঙ্ঘনের জন্য আমরা জবাব দেব।’ চুক্তি অনুযায়ী প্রাথমিকভাবে এই যুদ্ধবিরতি ৬০ দিনের জন্য হবে। পশ্চিম এশিয়ায় সংঘাতের একটি অংশের অবসান হওয়ায় বিশ্ব এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে। লেবাননে সংঘাতে এখন পর্যন্ত ১ দশমিক ২ মিলিয়ন লেবানিজ এবং ৬০ হাজার ইসরায়েলিকে বাস্তুচ্যুত করেছে। লেবাননের মতে, তাদের প্রায় ৩ হাজার ৭০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটে, যেখানে ইসরায়েলের ৭৫ জন সৈন্য ও ৪৫ জন বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে। ইউনাইটেড নেশন সিকিউরিটি কাউন্সিল রেজল্যুশন-১৭০১ চুক্তি অনুসারে ২০০৬ সালের ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ বিরোধের অবসান ঘটেছিল। ২০০৬-এর মতো, শুধু লেবাননের সশস্ত্র বাহিনী এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীরা লেবাননের লিতানি নদীর দক্ষিণে কাজ করবে। তার মানে হচ্ছে, হিজবুল্লাহ বাহিনী সীমান্ত থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার পিছু হটবে যখন ইসরায়েলি বাহিনী লেবানন ছেড়ে দেবে।

২০০৬ সালের যুদ্ধবিরতি চুক্তি উভয় পক্ষই লঙ্ঘন করেছে। হিজবুল্লাহ ভূগর্ভস্থ কাঠামো নির্মাণ করছে এবং ইসরায়েলি বিমান নিয়মিতভাবে লেবাননের ওপর দিয়ে উড়ছে। গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে আক্রমণ শুরু না করা পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি বহাল ছিল। এটি উল্লেখ করা উচিত যে, উভয় যুদ্ধবিরতি (২০০৬ এবং বর্তমান) ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে, লেবাননের মধ্যে নয়। বিশ্ব হিজবুল্লাহকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে মনোনীত করা সত্ত্বেও তাদের বৈশ্বিক অস্তিত্ব রয়েছে বলে স্বীকার করেছে। বর্তমান যুদ্ধবিরতিতে সংঘাতে জড়িত সব পক্ষের জন্য জয়জয়কার বজায় থাকবে বলে আশা করা যায়। 

জো বাইডেনের এটা বিশেষ অর্জন, যদিও তার প্রেসিডেন্সির শেষ পর্যায়ে এসে এটি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের আগে যদি এই যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হতো, তাহলে কমলা হ্যারিসের উপকার হতে পারত। যুক্তরাষ্ট্রকে তার সীমা প্রসারিত করতে হচ্ছে। ইসরায়েল ও ইউক্রেনকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করার পাশাপাশি ভবিষ্যতের যেকোনো অপারেশনের জন্য নিজস্ব মজুতও বজায় রাখা হচ্ছে। নেতানিয়াহু আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধবিরতি মেনে নেওয়ার তিনটি কারণ ঘোষণা করেছেন।

প্রথমত, ইসরায়েলকে তার প্রধান প্রতিপক্ষ ইরানের দিকে মনোযোগ দিতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, যুদ্ধবিরতি একটি ‘নিশ্বাস’ হিসেবে আভির্ভূত হয়েছে, কারণ ইসরায়েলি বাহিনী তাদের মজুত পুনরায় পূরণ করার সুযোগ পাচ্ছে। অবশেষে হামাস ও হিজবুল্লাহর অপারেশন আলাদা হয়ে যায়। আরও একাধিক কারণ রয়েছে। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী কিছুটা ক্লান্ত। সিএনএন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ইসরায়েলি বাহিনী অতি ধার্মিকদের বিরুদ্ধে ১১২৬টি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। 

ইসরায়েল সুপ্রিম কোর্ট স্থির করেছিলেন যে, গোঁড়া ধার্মিক ইহুদিদের সামরিক চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া যাবে না। একজন ইসরায়েলি সামরিক মুখপাত্র অতি-অর্থোডক্স ইহুদিদের আদেশের খসড়া তৈরির বিষয়ে মন্তব্য করার সময় এমনভাবেই উল্লেখ করেছেন। ‘আইডিএফে (ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী) অনেক সৈন্যের প্রয়োজন। আমাদের ১০ হাজারের মতো সৈন্য রয়েছে কিন্তু এটি স্থিতিশীল পরিসংখ্যান নয়। কারণ দুর্ভাগ্যবশত আমাদের হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশি।’ হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধবিরতি হলে সৈন্য নিয়োগের চাহিদা কমে যাবে। অন্যদিকে ইসরায়েল সরকারের মধ্যে সংঘাতের আচরণ ও নেতানিয়াহুর কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র নিয়েও মতানৈক্য রয়েছে। 

ইসরায়েল হিজবুল্লাহকে কখনোই পরাজিত করতে পারেনি। ২০০৬ সালে যুদ্ধবিরতির আগে উভয় পক্ষই হতাহত হয়েছিল। তখন তারা সেই যুদ্ধবিরতিকে স্বাগত জানিয়েছিল। কারণ তারা পরে সংগ্রাম করার সুযোগ খুঁজেছিল। ইসরায়েল শিক্ষা নিয়েছিল এবং এই অভিযানে তারা তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছিল। হিজবুল্লাহও পরিবর্তন এনেছিল এবং ধারাবাহিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও আরেকটি যুদ্ধবিরতি জোরদার করতে সক্ষম হয়েছিল। এবারের যুদ্ধে ইসরায়েল লক্ষ্যবস্তুতে বোমা হামলার মাধ্যমে হিজবুল্লাহর সিনিয়র নেতাদের নির্মূল করেছে। পেজার বোমার আঘাতে মাধ্যম স্তরের নেতাদের মেরে ফেলেছে। তা ছাড়া বিমানবাহিনী হিজবুল্লাহর রকেট স্টোরেজ ডিপো এবং উৎপাদন কেন্দ্রে বোমা হামলা করে। 

যা-ই হোক, এগুলো রকেট উৎক্ষেপণ বন্ধ করতে তেমন কিছু করেনি। হিজবুল্লাহও ২০০৬ সাল থেকে অনেক কিছুই শিখেছিল। যুদ্ধবিরতির কয়েক দিন আগে হিজবুল্লাহ ২৫০টিরও বেশি রকেট নিক্ষেপ করেছিল। লেবাননে অনুপ্রবেশ করা ইসরায়েলি বাহিনী ২০০৬ সালে বা এখন পর্যন্ত খুব বেশি সফল হতে পারেনি। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও হিজবুল্লাহ সব সময় ফিরে এসেছে। ইসরায়েলের জন্য বিশেষ কঠিন হবে। কারণ তারা গাজায় হামাসের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। লক্ষ্যবস্তুতে বিমান হামলায় লেবাননের বেসামরিক লোকের হতাহতের ঘটনায় শুধু হিজবুল্লাহ লাভবান হয়েছে। কারণ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো নির্দোষ মানুষের মৃত্যুর মাধ্যমে সমর্থন লাভ করে যাচ্ছে। একই সঙ্গে এটি ইসরায়েলের বৈশ্বিক অবস্থানকে শক্ত করে যাচ্ছে। ইসরায়েল এখন সিরিয়ার পাশাপাশি ইয়েমেনেও হামাস, ইসরায়েলবিরোধী গোষ্ঠীর দিকে মনোনিবেশ করতে পারে।

ইসরায়েল সচেতন রয়েছে যে, এই যুদ্ধবিরতি হিজবুল্লাহকে তার কাঠামো ও সামরিক শক্তি পুনর্নির্মাণ করতে সক্ষম করবে। ভবিষ্যতে কোনো একসময় আবার যুদ্ধ শুরু হবে। অবিলম্বে সেই যুদ্ধ না-ও হতে পারে, তবে ঘটবে। এটা সময়ের ব্যাপার কিন্তু উভয় দেশের নাগরিকদের জন্য কিছুটা স্বস্তি এনে দিয়েছে। হামাস ও হিজবুল্লাহর প্রধান সমর্থক ইরানের ভবিষ্যতের জন্য তাদের অন্তত প্রক্সি সুরক্ষিত থাকা অপরিহার্য। হিজবুল্লাহকে বাঁচাতে গিয়ে হামাসকে আত্মত্যাগ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ইরানের জন্য হামাস, হুতি এবং হিজবুল্লাহ শপথকারী এক মিত্র এবং তাদের একমাত্র শত্রু ইসরায়েল। তাদের সবাই একসঙ্গে ধ্বংস হতে দেওয়া যাবে না। ইরান নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। 

এই যুদ্ধবিরতি প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এ কারণেই হিজবুল্লাহ প্রধান নাইম কাসিমকে যুদ্ধবিরতির অনুমোদন দিয়েছে। হিজবুল্লাহকেও পুনরুদ্ধার করতে হবে। ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের শত্রুতা অব্যাহত রয়েছে। যুদ্ধবিরতির অন্যতম কারণ এটি দুই পক্ষের সক্ষমতা, জনশক্তি, কাঠামো এবং অস্ত্রশস্ত্রের মজুত পুনর্নির্মাণ করে। যদিও এতে অনেক হতাহত হয়েছে। তবে তারা সচেতন যে, তারা যুদ্ধে হারেনি। তারা যুদ্ধ এবং পরবর্তী পর্যায়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে চূড়ান্ত বিশ্লেষণে, ইসরায়েল এবং হিজবুল্লাহ উভয়ই জানে এটি স্থায়ী শান্তিচুক্তি নয়। এটা কতদিন চলবে তা কেউ জানে না। বর্তমানে উভয় পক্ষের বাহিনী এবং জনগণও যুদ্ধে ক্লান্ত। এই ক্লান্তিই উভয় পক্ষকে অন্তত অল্প সময়ের জন্য শান্তিতে থাকতে বাধ্য করতে পারে। 

লেখক: ভারতীয় সেনাবাহিনীর 
অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল
দ্য স্টেটসম্যান থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল