ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সর্বশেষ ভিপি নুরুল হক নুর। মানুষের কাছে তিনি ভিপি নুর নামে পরিচিত। পটুয়াখালীর প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে উঠে আসা নুর ধাপে ধাপে নিজেকে তৈরি করে এখন রাজনীতির আলোচিত মুখ। আন্দোলন করতে গিয়ে বারবার হামলা-মামলা, জেল-জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। প্রতিবাদ-আন্দোলন থেকে নিবৃত্ত করতে না পেরে ভিপি নুরকে একাধিকবার অর্থবিত্তের প্রলোভন দেখিয়েছিলেন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালীরা। তার পরেও তাকে লক্ষ্য থেকে টলানো যায়নি। ভিপি নুরের দৃঢ় মনোবল এবং চেষ্টার ফলে দানা বাঁধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সেই আন্দোলন থেকেই পতন হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের। এসেছে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার।
এই সরকারের কাছে প্রত্যাশা কী? আন্দোলনের সময় দিনগুলো কেমন ছিল, সেসব নিয়ে কথা বলেছেন গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর। তিনি বলেন, এই সরকারের কোনো পলিটিক্যাল বেজ নেই। পলিটিক্যাল পার্টিগুলো যদি সরকারের বিপক্ষে চলে যায় তাহলে সরকার এক মাসও টিকতে পারবে না। এ জন্য আমরা বলেছিলাম সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তাদের প্রতিনিধি নিয়ে জাতীয় সরকার করতে পারে। তাহলে সবার প্রতিনিধিত্ব থাকবে। সবাই সরকারকে সাপোর্ট দিতে বাধ্য। তাহলে হয়তো সরকার সুন্দরভাবে সফলভাবে কাজগুলো এগিয়ে নিতে পারবে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খবরের কাগজের সিটি এডিটর আবদুল্লাহ আল মামুন
শেখ হাসিনা যেভাবে বিভিন্নজনকে পয়সা ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কিনে নিয়েছে, আমাদেরও বিভিন্ন সময় সে অফার করেছিল। আমরা বিক্রি হইনি। আমরা এ জন্য এখনো পরিষ্কারভাবে বলি, শেখ হাসিনার মতো এত শক্তিশালী দানবীয় সরকারের কাছে মাথা নত করিনি। কাজেই কারও কাছে মাথা বিক্রি করে রাজনীতি করব না। কারও কাছে নত হয়ে এমপি-মন্ত্রী হওয়ার জন্য রাজনীতি করব না। স্ট্রেট-ফরোয়ার্ড রাজনীতি করে যাব। দেশ ও জাতির পক্ষে আমাদের অবস্থান থাকবে। কে পছন্দ করল না করল, কে খুশি হলো, অখুশি হলো- বিন্দুমাত্র আমরা তা চিন্তাভাবনা করি না।...
খবরের কাগজ: আপনি কি মনে করেন আওয়ামী লীগের পতনের জন্য আপনার ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য?
নুরুল হক নুর: আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না যে, এটা আমার একক কৃতিত্ব বা একক কন্ট্রিবিউশন ছিল। আমরা একটা টিমওয়ার্ক করেছিলাম। বড় টিম ছিল। এ টিমের অনেকে হয়তো আমার মতো পরিচিতি পাননি বা মিডিয়ায় পরিচিত মুখ নন। তাদের অনেক কন্ট্রিবিউশন আছে। আমাদের একজন ছাত্রনেতা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্বদ্যিালয়ের ছাত্র। কোটা সংস্কারের আন্দোলন থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছিলেন এবং গুম হয়েছেন। আমাদের সঙ্গে অনেক ছাত্রনেতা, ছাত্র অধিকার পরিষদের প্রোগ্রাম করতে গিয়ে পা ভেঙেছে, চোখ হারিয়েছে। তারা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছে। তাদের পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ রকম বড় একটা কমিউনিটি আমার সঙ্গে ছিল এবং এখনো আছে। তাদের মুখপাত্র হিসেবে আমি সামনে ছিলাম।
ফলে আমাকে আপনারা দেখছেন। কিন্তু আমরা যে সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছি, যে কাজগুলো করেছি, সেখানে সবার কন্ট্রিবিউশন ছিল। তরুণদের এই প্ল্যাটফর্ম ছাত্র অধিকার পরিষদ ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ থেকে তৈরি হয়েছে এবং ছাত্র অধিকার পরিষদ থেকে রাজনৈতিক দল গণ অধিকার পরিষদের জন্ম হয়েছে। গণ অধিকার পরিষদ ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যাদের দেখেন, তারা ছাত্র অধিকার পরিষদ থেকেই তৈরি হয়েছে। ছাত্র অধিকার পরিষদ তৈরি না হলে এই বিপ্লবী চেতনা এবং এভাবে এই সময়ে তারা বিদ্রোহ করত না। হয়তো অন্য কেউ করত আগে বা পরে। আমরা ২০১৮ সালের পর সারা বাংলাদেশের তরুণদের সম্পৃক্ত করেছি। তাদের সাহস, প্রতিক্রিয়া, প্রতিবাদ, দেশের প্রশ্নে আপসহীন ভাবনা আর ট্রিগার করেছে ছাত্র অধিকার পরিষদের সঙ্গে গণ অধিকার পরিষদ। এখানে রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তির অবদান ছিল, কন্ট্রিবিউশন ছিল। তবে এটা সবাইকে স্বীকার করতে হবে কো-অর্ডিনেশনের ক্ষেত্রে গণ অধিকার পরিষদের অগ্রণী ভূমিকা ছিল।
খবরের কাগজ: জেলখানায় নিয়ে যাওয়া বা কোর্টে হাজিরার সময় আপনাকে মুমূর্ষু অবস্থায় দেখেছি। আন্দোলন করতে গিয়ে আপনাকে কি পুলিশের নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে?
নুরুল হক নুর: মাঝে মাঝে ভাবি, আমি তো একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছি। জেলহাজত পর্যন্ত যেতে হয়েছে। একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়ে থানা বা ডিবি কার্যালয় থেকে ছাড়া পেয়েছি। আবার একবার দুই দফায় ১২ দিন রিমান্ডে ছিলাম। সেখানে গরু-ছাগল জবাই করার মতো ঝুলিয়ে পিটিয়েছে পুলিশ,
টর্চার করেছে।
খবরের কাগজ: এ বিষয়ে আরও বিস্তারিতভাবে আপনার অভিজ্ঞতা বলুন।
নুরুল হক নুর: অভিজ্ঞতা বলতে দেখা যায়, নাশতা খেলাম, তারপর দুপুরে টর্চার শুরু হলো। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের গল্প শুনেছিলাম- অল্প বয়সী মেয়েদের পাকিস্তানি আর্মি অফিসাররা পালাক্রমে ধর্ষণ করত। একজন যেত বা একটা টিম যেত, পরে আর একটা টিম যেত বা আরেকজন যেত। কোনো একজন মা নাকি বলেছিলেন যে, ‘বাবারা তোমরা আসো একটু আস্তে আস্তে বা একটু সময় নিয়ে আসো। আমার মেয়েটা অনেক ছোট।’ আমার ক্ষেত্রে সে রকমই অভিজ্ঞতা যে, বিকেলে এক টিম এসেই জিজ্ঞাসাবাদ। জিজ্ঞাসাবাদ মানে চোখ বাঁধা, হাত বাঁধা। গরু যে হাল চাষ করে, ধরেন পেছনে একটা লাঠি থাকে, লাঠির মাথায় লোহার একটা সুচ থাকে। হাঁপিয়ে গেলে গুঁতা দিলে গরু আবার হাঁটা শুরু করে। কথা নেই, দেখা যায় পেছন থেকে একটা বাড়ি (আঘাত) পড়ে গেছে। কিংবা দেখা যায়, বসতে দিয়েছে একটা চেয়ারে- সেখানে আবার ইলেকট্রিক সেটআপ কারেন্টের শক দেওয়ার। মানে এ ধরনের নির্যাতন ছিল। এটা সব সময়ই হয়েছে। এক বেলা ডাকলে এক বেলা, দুই বেলা ডাকলে দুই বেলা, তিন বেলা ডাকলে তিন বেলা নির্যাতন করেছে। এ ধরনের নির্যাতন তাদের পৈশাচিক আনন্দের একটা জায়গা ছিল। আমার ক্ষেত্রে বিশেষ করে ছাত্রলীগ থেকে যারা ইয়াং পুলিশ অফিসার ছিল, ওদের বড় ধরনের ক্ষোভ ছিল। তাদের একজন আরেকজনকে বলছে- স্যার ও কত বড় বেয়াদব, ও প্রধানমন্ত্রীর নামের আগে ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’ বলে না। কেন আমি শেখ হাসিনার নামের আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলি না, সে জন্য পুলিশ অফিসার ক্ষুব্ধ। কেন শেখ মুজিবুর রহমানের নামের আগে আমি জাতির পিতা বলি না, তা নিয়ে ক্ষুব্ধ।
শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল কায়েম করেছিলেন, সেটা নিয়ে কেন আমি সমালোচনা করেছি? শেখ মুজিবুর রহমানের কি অবদান কম- এগুলো আমি কেন বলি? মানে পারসোনাল ক্ষোভ। যারা একেবারে আদর্শিকভাবে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, এটা তাদের একটা ক্ষোভের জায়গা ছিল। নির্যাতন-নিপীড়নের সব কথা বলাও যায় না। আমি মাঝে মাঝে ভেবেছি আসলে বাস্তবতাটা কত কঠিন। মাঝে মাঝে আমি দেখেছি- অন্য দলের সিনিয়র নেতাদের মেরে রক্তাক্ত করে ফেলেছে। কিন্তু রিমান্ডে যাওয়ার সময় সাদা পাঞ্জাবি, নতুন জামা-কাপড় পরে যাচ্ছে। যাওয়ার সময় কর্মীদের হাত নেড়ে আশ্বস্ত করতে চেয়েছে যে, এভরিথিং ইজ ওকে। বাট, দেখা যাচ্ছে, তার হাতটা ওঠাতেও কষ্ট হচ্ছে। কারণ মেরে বা পিটিয়ে ফুলিয়ে ফেলেছে। কিন্তু সে যেহেতু লিডার, তার কর্মীরা যাতে মনোবল
না হারায়, আতঙ্কিত না হয়, এ জন্য নির্যাতনের
কথা বলেননি।
আমার সঙ্গে যারাই ছিলেন- এই যে বিএনপির উত্তরের আহ্বায়ক ছিলেন সাইফুল ইসলাম নীরব ভাই। ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ভাই। দক্ষিণের মজনু ভাই। বিএনপির আরও সিনিয়র লিডার, এমপিরা। একটা লোককেও বাদ রাখেনি ঝোলানো থেকে, নির্যাতন থেকে, নিপীড়ন থেকে। তারা বয়স, সিনিয়রিটি নানা কারণে হয়তোবা মুখ খোলেননি। আমার ক্ষেত্রে মনে হয়েছে, আমি যদি এটা সহ্য করে যাই চুপ চুপ। তাহলে এটা চলতেই থাকবে। এটা বন্ধ করা দরকার। আমি পুলিশের প্রিজন ভ্যান থেকে বলেছিলাম, ডিবি কার্যালয়- আই ওয়াজ ট্রিটেড লাইক আ ফুটবল। সো এটা হচ্ছে অত্যাচার-নির্যাতন। দেখেছেন মনে হয়, আঘাতের চিহ্ন কোর্টে আমি টি-শার্ট খুলে দেখিয়েছিলাম। কারণ এখানে আমার হিরোগিরির কিছু নেই। আমার ওপর যে অত্যাচার-নির্যাতন হয়েছে, এটা দেশবাসী জানুক। দেশের
মানুষ জানুক।
খবরের কাগজ: মানুষ জানতে চায় আসলে নির্যাতনটা কীভাবে হয়েছে এবং পুলিশ কীভাবে নির্যাতন করে?
নুরুল হক নুর: শেখ হাসিনার আমলেই পুলিশের রিমান্ডে যে রাজনীতিবিদরা টর্চারের শিকার হয়েছেন, অত্যাচারের শিকার হয়েছেন এমনটা নয়। এর আগেও যারা ছিলেন, এমন ঘটনা ঘটেছে হয়তো। তবে এতটা প্রকট আকারে হয়নি। রাজনীতিবিদদের প্রতি একটা সম্মান ছিল। শেখ হাসিনা তো সব রীতিনীতি ভেঙে তছনছ করে দিয়েছেন। শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ইনস্ট্রাকশন ছিল বিরোধীদলীয় নেতাদের ‘ঝুলাইয়া, পিটাইয়া, মাইরা’ ভিডিও তাদের পাঠাতে। পুলিশ বলেছে, ভাই আমাদের কিছু করার নেই, এই ভিডিও পাঠাতে হবে হোম মিনিস্টারের কাছে। বোঝেন তাহলে কতটা বর্বর, পৈশাচিক নির্যাতনের চিত্র।
খবরের কাগজ: সুনির্দিষ্টভাবে জানতে চাই ঝোলানোটা কেমন ছিল? আপনার হাত ধরে, পা ধরে কীভাবে ঝুলিয়েছিল?
নুরুল হক নুর: হাতে তো হ্যান্ডকাফ পরা। হ্যান্ডকাফের ওপরে আই থিঙ্ক রিঙের মতো সিস্টেম। হ্যান্ডকাফ খুলে দুটি আঙুল দুটি রিঙের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেয়। পা-টা ফাঁসির আসামির মতো একটা নির্দিষ্ট দূরত্বে মাটি থেকে ওপরে ঝুলিয়ে দেয়। মাটি থেকে তক্তা বা কাঠের একটা কাঠামো থাকে। যখন পেটানো শুরু করে, পা থেকে ওপর পর্যন্ত ওটা একটু সরিয়ে দেয়। অটোমেটিক্যালি আপনি মুভ করতে থাকবেন। ওদের তো একটা ট্রেনিং আছে, আসলে কোথায় কীভাবে মারতে হয়।
এমন হয়েছে, অনেক মানুষ তো বলতেও পারে না, দেখাতেও পারে না। তার পরই দেখা যায়, চেয়ারে বসতে দিয়েছে- নিচে ইলেকট্রিক শকের ব্যবস্থা রাখা আছে, বসলেই শক করে। ইভেন আমরা তো কিছুটা পরিচিত ফেস ছিলাম ন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনালে, ফলে আমাদের সঙ্গে অসভ্যতা অতটা করতে পারেনি।
এমনও হয়েছে ছাত্রদল, যুবদল বা শিবিরের ছেলেদের উলঙ্গ করে নির্যাতন করেছে। বালতির মধ্যে পানি রেখে ইলেকট্রিক লাইন দিয়ে সেখানে প্রসাব করতে বাধ্য করেছে। এ কারণে তারা কারেন্টের শক খেয়েছে। পুলিশ ওই চিত্র তাদের সিনিয়দের দেখায়, যাতে তারা ভয়ে-আতঙ্কে যা বলাতে চায় তা যেন বলে দেয়।
আমার কাছে স্বীকারোক্তি চেয়েছিল যে, বিটিভিতে আপনারা আগুন দিয়েছেন। মিরপুরের মেট্রোরেলে আগুন দিয়েছেন। তারেক রহমান নির্দেশ এবং টাকা-পয়সা দিয়েছে। এটা বললে তাহলে আর অন্য মামলায় জড়াবে না। আমি স্বীকারোক্তি দিইনি। বলেছি, তোমাদের এত সংস্থা- ডিজিএফআই, এনএসআই, এসবি আছে। তাদের কাছে খবর নাও এগুলো (আগুন)-কে দিয়েছে। এগুলো (আগুন) সরকার দিয়েছে। সাবোট্যাজ করেছে আন্দোলনে। আমি কেন স্বীকারোক্তি দেব? ফলে আরও টর্চার করেছে, হুমকি দিয়েছে সব মামলায় জড়াবে। দেখেছেন তো, গত ১৫ বছর মামলার তো একটা উৎসব ছিল। প্রতিযোগিতা ছিল কোন পুলিশ সদস্য বিএনপি, জামায়াত, গণ অধিকার পরিষদের নেতা-কর্মীদের নামে কত মামলা দিতে পারে। কত মিথ্যা মামলা সাজাতে পারে? মরা মানুষ হতো মামলার আসামি। যার হাত নেই, সেও বোমা ছুড়ে মারার মামলার আসামি হয়েছে- এ ধরনের চিত্র তো দেখেছি।
খবরের কাগজ: আপনাকে কখনো প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল সরকারের সঙ্গে মিলে যান?
নুরুল হক নুর: এটা তো শুরু থেকেই ছিল। শেখ হাসিনার গত দেড় দশকে ধারাবাহিকভাবে লড়াই, সংগ্রাম চালিয়ে গেছে কে? একমাত্র ২০১৮ সালের আন্দোলনের পর থেকে আমার টিমের সহযোগিতা, আমার সহযোদ্ধা ও সহকর্মীদের সমর্থনে সাহস নিয়ে লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে গেছি। শেখ হাসিনার জন্য আমরা বড় একটা থ্রেট ছিলাম। শেখ হাসিনা যেভাবে বিভিন্নজনকে পয়সা ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কিনে নিয়েছে, আমাদেরও বিভিন্ন সময় সে অফার করেছিল। আমরা বিক্রি হইনি। আমরা এ জন্য এখনো পরিষ্কারভাবে বলি, শেখ হাসিনার মতো এত শক্তিশালী দানবীয় সরকারের কাছে মাথা নত করিনি। কাজেই কারও কাছে মাথা বিক্রি করে রাজনীতি করব না। কারও কাছে নত হয়ে এমপি-মন্ত্রী হওয়ার জন্য রাজনীতি করব না। স্ট্রেট-ফরোয়ার্ড রাজনীতি করে যাব। দেশ ও জাতির পক্ষে আমাদের অবস্থান থাকবে। কে পছন্দ করল না করল, কে খুশি হলো, অখুশি হলো- বিন্দুমাত্র আমরা তা চিন্তাভাবনা করি না। আমাদের পরিষ্কার কথা হলো- রাজনীতিগতভাবে ৫০ বছর দেশে যা চলেছে, যেভাবে চলেছে সেই পথে আগামীর বাংলাদেশ চলবে না। সেখান থেকে বের হয়ে আসতে হলে নিউ লিডারশিপ প্রয়োজন এবং জেন জি (নিউ জেনারেশন) সেটা প্রমাণ করেছে। একজিস্ট লিডারশিপের বাইরে তারা নিজ নিজ জায়গা থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে। যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, উত্তরা, রামপুরা- কী ধরনের এই প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ ছিল? এখানে কে লিড দিয়েছে, কে লিডার ছিল? কেউ ছিল না। সম্মিলিতভাবে তারা নেতৃত্ব দিয়েছিল। আমার বিশ্বাস, ‘দিস ইস আই টাইম পলিটিক্স’-এ একটু চেঞ্জ আনা এবং সেই লক্ষ্যেই গণ অধিকার পরিষদ কাজ করছে। আমরা আশাবাদী এবং দেশের মানুষকে বলব, আপনারা সচেতন হন। সঠিক মানুষকে রাজনীতিতে সাপোর্ট দিন। সঠিক মানুষের নেতৃত্বে থাকুন। একটা পরিবর্তন করতে হবে। একটা জাতির ভাগ্যে এ রকম সুযোগ বারবার আসে না। ৫৩ বছরে আমরা একবার পেয়েছি, একটা গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়েছি। এখন আমাদের দরকার একটা জাতীয় ঐক্যের সরকার। এই সরকারের মাধ্যমে আমরা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র কাঠামোর পরিবর্তন বা বিলোপের চিন্তাভাবনা করছি। জাতীয় ঐক্যের সরকারের মাধ্যমে পরিবর্তন করে একটা
নতুন কাঠামো প্রণয়ন করতে হবে। যে কারণে
নতুন সংবিধানের একটা দাবি উঠছে। আমরা সেই দাবির পক্ষে।
খবরের কাগজ: আপনি কি মনে করেন গণ-আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে যে সরকার এসেছে, তারা আপনাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূরণের জন্য ঠিকঠাক কাজ করছে?
নুরুল হক নুর: একটা সরকারকে মূল্যায়ন করার জন্য দু-তিন মাস পর্যাপ্ত সময় না। শেখ হাসিনা গত ১৫ বছরে রাষ্ট্রকে একটা ব্যক্তির ওপরে ডিপেন্ডেবল করেছিলেন। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো একটা ব্যক্তির আঙুলের হ্যালনে চলত। এ রকম একটা ভঙ্গুর রাষ্ট্রব্যবস্থায় হঠাৎ করে সরকার পরিবর্তন হলো। নতুন এসেই তারা এই সেটআপ পরিবর্তন করতে পারবে না। এই সরকারের আন্তরিকতা আছে। সরকারের ভালো লোক আছে। তারা ভালো কিছু করতে চায়। তবে রাজনৈতিক সহযোগিতা ছাড়া তারা ভালো কিছু করতে পারবে না, সফল হবে না। সে জন্য আমরা শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে তাদের বারবার পরামর্শ দিয়েছি- যে আন্দোলনকারী স্টেক হোল্ডারদের নিয়ে এই সরকারকে একটা জাতীয় সরকারের রূপ দেওয়া, একটা নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত তারা থাকবে এবং একটা রোডম্যাপ প্রকাশ করা। তাদের কাজের ধরন মানুষের সামনে উপস্থাপন করা। মানুষ রাষ্ট্র সংস্কার চাচ্ছে। প্রশাসনের সংস্কার চাচ্ছে। গভর্মেন্ট সার্ভিসের সংস্কার চাচ্ছে। রাজনীতি সংস্কার চাচ্ছে। এ জন্য একটু সময় লাগবে। সে জন্য আমরা বলছি, বছর দুয়েক সময় প্রয়োজন হবে। এখন রাজনৈতিক দলগুলো যদি সরকারকে সেই সময়টা না দেয় তাহলে সরকার থাকতে পারবে না। কারণ এই সরকারের কোনো পলিটিক্যাল বেজ নেই। পলিটিক্যাল পার্টিগুলো যদি সরকারের অ্যাগেইনেস্টে চলে যায়। তাহলে সরকার এক মাসও টিকতে পারবে না। এ জন্য আমরা বলেছিলাম, সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তাদের প্রতিনিধি নিয়ে যদি জাতীয় সরকার করতে পারে। তাহলে সবার প্রতিনিধিত্ব থাকবে। সবাই সরকারকে সাপোর্ট দিতে বাধ্য। তাহলে হয়তো সরকার সুন্দরভাবে, সফলভাবে কাজগুলো এগিয়ে নিতে পারবে।
খবরের কাগজ: সংসদ নির্বাচনের আগে জাতীয় সরকার হওয়ার কোনো সুযোগ আছে বলে আপনি মনে করেন?
নুরুল হক নুর: আমি মনে করি অবশ্যই নতুন নতুন ক্রাইসিস তৈরি হচ্ছে। মাঝখানে দেখেছেন না রাষ্ট্রপতি নিয়ে রাজনৈতিক দল ও ছাত্র-জনতার মধ্যে কী ধরনের একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে? এখন কেউ বলছে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন। কেউ বলছে ডাবল চেম্বার বা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট নির্বাচন। কেউ বলছে বিদ্যমান সিস্টেমে। এই যে জটিলতাগুলো বা নানা ধরনের মতামত তৈরি হচ্ছে- দিন শেষে এর তো একটা কালেক্টিভ ওপেনিয়ন প্রয়োজন। একটা সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন। সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি ইউনিটি বা আলাপ-আলোচনা না থাকে, সরকারের সঙ্গে যদি রাজনৈতিক দলগুলোর বোঝাপড়া না থাকে তাহলে এটা সম্ভব নয়। এ জন্য আমরা বলছি, এখনো সুযোগ আছে। ২১ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদের কাঠামো দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব নয়। এটাকে আরও বাড়ানো দরকার। একুশের জায়গায় যদি ৩১ হয় সরকারের লস আছে? আপনার লস আছে, আমার লস আছে? নেই তো। তাহলে এখানে আট-দশটা রাজনৈতিক দল থেকে আট-দশজন রাজনৈতিক নেতা নেওয়া যেতেই পারে। তাহলে তাদের সাপোর্টটা সরকারের প্রতি থাকবে। তখন সরকার স্মুথলি কাজ করতে পারবে।
খবরের কাগজ: বিএনপি কি আপনার এই প্রস্তাবের সঙ্গে একমত?
নুরুল হক নুর: আমি জানি না বিএনপির অবস্থানটা কী? কারণ বিএনপিকে আমরা এ বিষয়ে কখনো জিজ্ঞেস করিনি। বিএনপির সঙ্গে আমাদের অত্যন্ত ভালো বোঝাপড়া আছে। আমরা বিএনপিকে কখনো বলিনি। সরকারে যারা আছে তাদের বলেছি। পাবলিকলি অনেকবার বলেছি। বিএনপি তো বলছে, তারেক রহমান জাতীয় সরকার করবেন।
খবরের কাগজ: বিএনপি আপনাকে নির্বাচনি এলাকায় নির্বিঘ্নে কাজ করার জন্য সহযোগিতা করছে। নির্বাচনের সময় রিলেশনটা কেমন থাকবে? একসঙ্গে নির্বাচন করবেন?
নুরুল হক নুর: আওয়ামী ফ্যাসিবাদ পতনের এক দফা দাবিতে একসঙ্গে যে আন্দোলন করেছিলাম, সেই ইউনিটি ধরে রাখা বিএনপির জন্য জরুরি। বিএনপি একটা বড় রাজনৈতিক দল। সরকার গঠন করলে তারাই বেনিফিটেড হবে। ছোট দলগুলোকে নিয়ে যদি বিএনপি একটা জাতীয় সরকার গঠন করতে পারে সেটা দেশ-বিদেশে পরিচিতি পাবে।
আমাদের পরিষ্কার কথা যে, হাসিনা সরকারের কাছে মাথা বিক্রি করে আমরা রাজনীতি করিনি। আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে কিংবা নতজানু হয়ে গণ অধিকার পরিষদ কিংবা পরিষদের নেতারা রাজনীতি করবে না। যেখানে আমাদের মূল্যায়ন হবে, আমাদের মর্যাদা থাকবে চিন্তাভাবনা করে সেখানে আমরা এগোব।
খবরের কাগজ: ধন্যবাদ।
নুরুল হক নুর: আপনাকেও ধন্যবাদ।