ঢাকা ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, শনিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন ও কপ-২৯

প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪৮ এএম
বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন ও কপ-২৯

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ বৈশ্বিকভাবে সৃষ্টি হলেও বাংলাদেশ বিশ্বের জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় যথাক্রমে সপ্তম ও পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে, যা বাংলাদেশের ব-দ্বীপ অঞ্চলের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। সব কিছু সরকার ও ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কোনোমতেই তা ভালো হবে না। বাস্তবে দেখা যায়, জীবাশ্ম জ্বালানির ভবিষ্যৎ নিয়ে এ বিশ্ব এখন দ্বিধাবিভক্ত। একদিকে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর বাণিজ্যিক স্বার্থ আর অন্যদিকে ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর জোট অ্যালায়েন্স অব স্মল আইল্যান্ডের (এওএসআইএস) জলবায়ুর ঝুঁকি থেকে বেঁচে থাকার লড়াই।...

আজারবাইজানের বাকুতে শুরু হয়েছে কপ-২৯ জলবায়ু সম্মেলন (১১-২২ নভেম্বর)। জলবায়ু অর্থায়ন, অভিযোজন ও প্রশমন কৌশলগুলো ন্যায়সঙ্গত হতে হবে এবং সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে প্রাধান্য দিতে হবে। আন্তর্জাতিক অর্থায়নসংকট মোকাবিলায় যে ১০০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল তা বাড়াতে হবে। উন্নত দেশগুলোর অর্থ সাহায্য কিছু আর্থিক সমস্যার সমাধান করলেও এর দ্বারা প্রকৃত জলবায়ু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে না। বাংলাদেশ বৈশ্বিক উষ্ণতা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখার বিষয়ে দৃঢ় অবস্থানে থাকবে সব সময়। অভিযোজন পদক্ষেপের ওপর গুরুত্বারোপ এবং তরুণদেরও এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে হবে। 

এ ছাড়া, আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জগুলো স্পষ্টভাবে তুলে ধরা এবং উচ্চাভিলাষী প্রশমন উদ্যোগ নিয়ে কথা বলতে হবে। কপ-২৯ সম্মেলনে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। কপ-২৯ সম্মেলনে জোরালো অ্যাডভোকেসির প্রয়োজন রয়েছে, যাতে বৈশ্বিক জলবায়ু আলোচনায় বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর কণ্ঠস্বর শোনা যায়। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং সহনশীলতা গঠনে বাংলাদেশ উদাহরণ সৃষ্টি করবে। 
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ বৈশ্বিকভাবে সৃষ্টি হলেও বাংলাদেশ বিশ্বের জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় যথাক্রমে সপ্তম ও পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে, যা বাংলাদেশের ব-দ্বীপ অঞ্চলের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। 

পৃথিবীর উষ্ণতম বছর ছিল ২০২৩ সাল। বছরটি উষ্ণতার দিক থেকে আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। এতে বিজ্ঞানীদের পূর্বাভাস সত্য প্রমাণ করে নিশ্চিত হওয়া গেল ২০২৩ ছিল এ গ্রহের এ যাবৎকালের উষ্ণতম বছর। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিয়ে আরও বলেছেন, পৃথিবীর এ অবস্থা মানুষেরই সৃষ্টি। এ গ্রহ গরম হয়ে ওঠার পেছনে জীবাশ্ম জ্বালানির বহুল ব্যবহারই দায়ী। তাই আর সময়ক্ষেপণ নয়, দ্রুত নবায়নযোগ্য জ্বালানির পথে আমাদের হাঁটতে হবে। তা না হলে বর্তমান পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে বলে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

এর ফলে ইতোমধ্যেই বন্যা, ঘূর্ণিঝড় এবং ভূমিক্ষয়জনিত ঝুঁকির মাধ্যমে বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগর বরাবর উপকূলীয় তটরেখার ৭১০ বর্গকিলোমিটারের বেশি এলাকাজুড়ে বসবাসরত প্রায় ১ কোটি পরিবারের রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো ও পরিষেবায় প্রবেশ ও অন্তর্ভুক্তি পরস্থিতি খুব সংকটে রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের ৬৯ শতাংশ উপকূলীয় উপজেলায় সবচেয়ে দরিদ্র পরিবারগুলো গুরুতর ঝুঁকিতে পড়েছে, যা বাংলাদেশের এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ৩, ৪, ৭, ৮ ও ১৩ নম্বর সূচক অর্জনকে বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে ফেলছে। 

বাংলাদেশের কৃষিতথ্য সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী, তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় দেশে ধানের উৎপাদন দিন দিন কমে যাচ্ছে। ধান চাষের ক্ষেত্রে ১৮-৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা প্রয়োজন হয়। শীতের সময় তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রির অনেক নিচে নেমে যায় এবং গরমের সময় ৩৫ ডিগ্রির ওপরে উঠে যায়। এতে ধানের পরাগায়নে অনেক সমস্যা হয় এবং উৎপাদন ব্যাহত হয়। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মেরু অঞ্চলে বরফ গলার কারণে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি হচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে কৃষিজমির মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। লবণাক্ততার তীব্রতায় আবাদি জমি হয়ে পড়ছে অনাবাদি, ফলন কমছে ক্রমাগত। এতে করে উপকূলীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে দিন দিন। মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (এসআরডিআই) এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, শুধু লবণাক্ততার কারণেই প্রতিবছর উপকূলীয় জেলাগুলো ৩০ লাখ টনেরও বেশি খাদ্যশস্য উৎপাদন থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে।

কৃষিজমির লবণাক্ততা বাড়তে থাকলে কৃষি থেকে আয় বছরে ২১ শতাংশ কমে যাবে এবং উপকূলীয় অঞ্চলের অর্ধেকের বেশি কৃষিজমি উৎপাদনবঞ্চিত হবে। ফলে, বিপুলসংখ্যক অধিবাসী বাস্তুচ্যুত হবে। প্রধান খাদ্যশস্য ধান ছাড়াও বাংলাদেশের অন্য শস্য যেমন- পাট, গম, ভুট্টা, মটর, ছোলা উৎপাদনও ক্রমশই হ্রাস পাচ্ছে; যার প্রধান কারণ শিলাবৃষ্টি, ঝড়, আকস্মিক বন্যা, খরা পরিস্থিতি প্রভৃতি। ফলে, উপকূলীয় মানুষের মাথাপিছু আয় হ্রাস পাচ্ছে, স্বাস্থ্য-শিক্ষা-পুষ্টির ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন শুধু কৃষিই নয়, বাংলাদেশের অর্থনীতির সব খাত সংকটে পড়েছে। যেমন- দেশে প্রায় ১ লাখ ৪৭ হাজার হেক্টর পুকুর, ৫ হাজার ৪৮৮ হেক্টর বাঁওড় এবং ১১ কোটি  হেক্টর চিংড়ি ঘেরে মাছ চাষ হয়। এ ছাড়া ৪৪ লাখ ৭০ হাজার হেক্টর মুক্ত জলাশয়, যেমন- নদী, হাওর, বিল, খালে প্রায় ২৫০ প্রজাতির মাছ বাস করে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ুর বিভিন্ন পরিবর্তনের প্রভাবে এই মৎস্য উৎপাদনও হুমকির মুখে পড়েছে। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে পানি গরম হয়ে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। এতে মাছের পোনা উৎপাদন অনেকাংশে হ্রাস পায়। এ কারণে মৎস্য খাত থেকে আয় কমে যাচ্ছে, যা প্রভাব পড়ছে মৎস্যজীবীদের ওপর, যাদের জীবিকা মূলত মাছ ধরার ওপর নির্ভরশীল। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বর্তমান সময়ে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেওয়ায় মানুষ তাদের সব হারিয়ে সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়ছে, যাদের পুনর্বাসন করতে সরকারকে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। ফলে, বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পাশাপাশি অনেক মানুষ কাজের সন্ধানে নিজ এলাকা ছেড়ে বড় শহরে বিশেষ করে ঢাকায় পাড়ি জমাচ্ছে এবং বাধ্য হয়ে অপরিকল্পিতভাবে বিকাশমান শিল্পকারখানা ও শ্রম ব্যবস্থায় জড়িত হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) হিসাব মতে, বাংলাদেশের উৎপাদন খাত তাপমাত্রাজনিত অস্বস্তি বা হিট স্ট্রেসের কারণে বর্তমানে ২ দশমিক ৫৯ শতাংশ কর্মঘণ্টা হারাচ্ছে, যা ২০৩০ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ৪ দশমিক ৯৬ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। যদি পোশাক কারখানাগুলো তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য ভবিষ্যতে এয়ার কন্ডিশনের ওপর বেশি নির্ভর করে, তাহলে তা বাংলাদেশের গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন আরও বাড়িয়ে দেবে, যেখানে আবার আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত প্রায় পুরোপুরি জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর। 

ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ক্লাইমেট সার্ভিসের তথ্যমতে, জীবাশ্ম জ্বালানির বহুল ব্যবহার শুরুর দীর্ঘ সময়ের গড় উষ্ণতা বাড়ার তুলনায় গত বছর পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়ে দাঁড়ায় ১ দশমিক ৪৮ ডিগ্রি। গেল বছরের জুলাই মাস থেকে প্রতিদিনই বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ার রেকর্ড সৃষ্টি হয়। অথচ বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এখন সত্যিই ব্যর্থতার দ্বারপ্রান্তে গিয়ে পৌঁছেছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধে তাই দরকার গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন ও জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের রাশ শক্ত হাতে টেনে ধরা। কিন্তু কাজটি করা সম্ভব হয়নি বলে গত বছরটি বিশ্বের উষ্ণতম বছরে পরিণত হয়।

 এটি বিশ্ববাসীর জন্য আসলেই দুশ্চিন্তার কারণ। ইউরোপভিত্তিক জলবায়ুবিষয়ক পর্যবেক্ষক সংস্থা কোপারনিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সারভিসের (সিথ্রিএস) এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। সেখানে আরও বলা হয়, শিল্পপূর্ব অক্টোবর মাসের গড় তাপমাত্রার চেয়ে ২০২৩ সালের অক্টোবর মাস ছিল অনেক বেশি উষ্ণ। এর তাপমাত্রা ছিল ১ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কোপারনিকাস সারভিসের উপপ্রধান সামান্তা বারগেসের মতে, ২০২৩ সালের ছয়টি মাস এবং দুটি মৌসুম উষ্ণতার বেলায় নতুন রেকর্ড গড়ে। তাই ২০২৩ সাল হলো স্মরণকালের উষ্ণতম বছর। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জোরদার হয় বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রেখে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার পর্যায়ক্রমে বন্ধ করার দাবি।

সব কিছু সরকার ও ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কোনোমতেই তা ভালো হবে না। ব্যক্তিপর্যায়ে বেশি করে শাকসবজি, ফলমূল, শস্য, লেবু, বাদাম ও বীজ এবং কম মাংস এবং দুগ্ধজাত খাবার খেলেও পরিবেশগত প্রভাব কমিয়ে আনতে উল্লেখযোগ্যভাবে ভূমিকা রাখা যায়; উদ্ভিদভিত্তিক খাদ্য উৎপাদনের মাধ্যমে কম গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন করা যায় এবং কম শক্তি, জমি এবং জলের প্রয়োজন হয়। এমনকি ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে যদি বিদেশে অনুষ্ঠিত সভা সেমিনারগুলো সম্পন্ন করা যায়, তাহলে বিপুল জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো উড়োজাহাজে ওড়া এড়ানো যায়। এ রকম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হাজারো ব্যক্তিপ্রচেষ্টা মানবসভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে পারে।

বাস্তবে দেখা যায়, জীবাশ্ম জ্বালানির ভবিষ্যৎ নিয়ে এ বিশ্ব এখন দ্বিধাবিভক্ত। একদিকে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর বাণিজ্যিক স্বার্থ আর অন্যদিকে ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর জোট অ্যালায়েন্স অব স্মল আইল্যান্ডের (এওএসআইএস) জলবায়ুর ঝুঁকি থেকে বেঁচে থাকার লড়াই। কপ-২৮ সম্মেলনের শেষ দিকেও তার লক্ষণ পরিষ্কার হয়ে ওঠে। ঘড়ির কাঁটা ধরে ঝুলতে থাকা এ বিভেদ রীতিমতো বড় হয়ে উঠেছিল। নানামুখী চাপ ছিল ঠিকই, তার পরও জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনের শেষ দিকে বিষয়টি অমীমাংসিত থেকে যায়। 

কপ-২৮ সম্মেলন চলাকালীন আরও একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। ‘জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার পর্যায়ক্রমে বন্ধের দাবির কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।’ এ মন্তব্যের পর তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। শেষে পিছু হটে এসে তিনি বলতে বাধ্য হন, ‘জলবায়ুবিষয়ক বিজ্ঞানের প্রতি তার শ্রদ্ধা আছে। এমন একটা বিরূপ অবস্থা জিইয়ে থাকার পরও ২৮ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম জলবায়ুবিষয়ক সম্মেলন কপের (কনফারেন্স অব পার্টিস) ২৮-এর সদস্য দেশগুলো (১৯৮ দেশ) একমত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার থেকে তারা পর্যায়ক্রমে সরে আসবে। ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ুর চুক্তির পর শেষ অবধি দুবাই জলবায়ু চুক্তিও সফল হয়।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ

২০২৫ সালে ইউক্রেনে কি শান্তি ফিরে আসবে?

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০২ পিএম
২০২৫ সালে ইউক্রেনে কি শান্তি ফিরে আসবে?
ড. ডায়ানা গালিভা

২০২৪ সালজুড়েই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলমান ছিল। রাশিয়া ভেলিকা নোভোসিল্কা এবং ভুহলেদার অঞ্চলকে তার সুবিধাজনক যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে রেখে দিয়েছে। দোনেৎস্ক ওব্লাস্টের সামনের লাইনটি আরও উত্তাল হয়ে উঠছে। কারণ, এখানে যুদ্ধের প্রস্তুতি এমনভাবে করা হয়েছে, যা ২০২৩ সালের তুলনায় অনেক বড় পরিসরে। ২০২৪-এর আরেকটি স্বতন্ত্র দিক ছিল গত আগস্টে কুরস্ক আক্রমণ। 

যেখানে ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনী রাশিয়ায় আক্রমণ করেছিল। অন্যদিকে অক্টোবরের মধ্যে রাশিয়ান বাহিনী ইউক্রেনের দখলকৃত প্রায় অর্ধেক অঞ্চল পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়। এই অঞ্চলটিই ছিল ২০২৪ সালের রণাঙ্গনের বড় ক্ষেত্র। আশা করা হচ্ছে, নতুন কূটনৈতিক কৌশল এবং গতিশীলতা দেখা দেবে আগামী বছর। ২০২৫ সালে কি ইউক্রেনে শান্তির দেখা মিলবে? 

ইউক্রেনে যত দ্রুত সম্ভব শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায়, তা নিয়ে ভাবছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। নভেম্বরে জি-২০ নেতারা রিওডি জেনেরিও শীর্ষ সম্মেলনে তাদের চূড়ান্ত ঘোষণা দেন। সেখানে তারা ‘হুমকি বা শক্তি প্রয়োগের নিন্দা করে ব্যাপক, ন্যায়সংগত এবং টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতি সমর্থন করে সব প্রাসঙ্গিক এবং গঠনমূলক উদ্যোগ’ নিতে চেষ্টা করেন। ২০২৪ সালে নিজ নিজ মিত্র এবং অংশীদারদের মাধ্যমে উভয় পক্ষে সামরিক, আর্থিক এবং রাজনৈতিক সমর্থন অব্যাহত রাখার বিষয়টি লক্ষ করা গেছে। 

ইউক্রেনকে অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতা করছে। জার্মানিভিত্তিক কিয়েল ইনস্টিটিউটের মতে, ইউরোপ ২০২২ সালে যুদ্ধ শুরু হওয়া থেকে ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ইউক্রেনকে সমর্থন করার জন্য ১২৫ বিলিয়ন ডলার এবং যুক্তরাষ্ট্র ৯০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। যুক্তরাজ্য এই দুই বছরে ইউক্রেনের জন্য অন্যতম প্রধান সাহায্যদাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। যুক্তরাজ্য আশ্বাস দিয়ে বলেছে, ‘যতদিন লাগে’ তারা ইউক্রেনকে প্রতিবছর ৩ বিলিয়ন ডলার সামরিক সহায়তা দেবে।
 
রাশিয়াও তার নিজ মিত্রদের মাধ্যমে রাজনৈতিক ও সামরিক সমর্থন পেয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো উত্তর কোরিয়ার ভূমিকা। গত সপ্তাহে জি-৭ এর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকের সময় গ্রুপটি রাশিয়াকে ‘দায়িত্বহীন ও হুমকিমূলক পারমাণবিক বক্তব্য’ দেওয়ার জন্য নিন্দা করেছে। মস্কোর প্রতি উত্তর কোরিয়ার সমর্থনকে বিপজ্জনক বলে মনে করছে বিশ্ববাসী। এর আগেও উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়া তাদের সমন্বিত কৌশলগত অংশীদারি চুক্তিতে অনুমোদন করেছে। দক্ষিণ কোরিয়া কুরস্ক অঞ্চলে ১০ হাজার সৈন্য পাঠানো এবং মহাকাশে প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করার জন্য উত্তর কোরিয়াকে অভিযুক্ত করেছে। 
অন্যান্য দেশ, যেমন- ইউনাইটেড আরব আমিরাত তাদের নিরপেক্ষ রাজনৈতিক অবস্থান বজায় রেখেছে। ইউনাইটেড আরব আমিরাত মধ্যস্থতা করে যাচ্ছে। এর ইতিবাচক দিক হলো সেপ্টেম্বরে দুই পক্ষ থেকে ১০৩ জন যুদ্ধবন্দির বিনিময়। 

আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় হলো- দুই পক্ষের মধ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। রাশিয়া ডিনিপ্রোর ওপর আক্রমণে ওরেশনিক হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছে। মস্কো ব্যাখ্যা করেছে, রাশিয়ার ভূখণ্ডকে লক্ষ্যবস্তু করে কিয়েভ মার্কিন এবং যুক্তরাজ্যের তৈরি বা সরবরাহ করা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের প্রতিক্রিয়া ছিল এই আক্রমণ। মস্কো কখনোই তার পারমাণবিক সক্ষমতা দেখায়নি। তবে তারা ‘ভয়ংকর’ অস্ত্র তৈরি করে যাচ্ছে। যেহেতু উভয় পক্ষই  তাদের গতি, দূরত্ব এবং প্রভাব বিস্তারের জন্য সুবিধা খোঁজে, তাই আগামী দিনে ভারী এবং উন্নত অস্ত্রের বৃদ্ধি অব্যাহত থাকার আশঙ্কা রয়েছে। 

এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৫ সালে দুই পক্ষের মধ্যে কোনো শান্তিচুক্তির আশা কি দেখা দেবে? ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি একটি ‘শান্তি সূত্র’ প্রস্তাব করার চেষ্টা করেছিলেন। ইউক্রেনের সমগ্র অঞ্চল থেকে রাশিয়ার প্রত্যাহারের দাবিগুলো নিয়ে গত জুনে সুইজারল্যান্ড শীর্ষ সম্মেলনের সময় একটি রূপরেখা দেওয়া হয়েছিল। যদিও প্রচেষ্টাগুলো সফল হয়নি। কারণ গ্লোবাল সাউথের দেশগুলো আলোচনায় রাশিয়া বা ইসরায়েলের উপস্থিতি ও অনুপস্থিতিকে সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে তারা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। 

পূর্ববর্তী পরামর্শগুলোও সেই সম্মেলনে আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছিল। যেমন, গত মে মাসে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান শান্তি আলোচনা আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। যখন চীনের প্রধানমন্ত্রী ওয়াং ই ‘শান্তিই শক্তি’র মাধ্যমে দুই বছরের ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করতে চেয়েছিলেন। 

এই ব্যর্থতার পর জেলেনস্কি অক্টোবরে আবার যুদ্ধ শেষ করার জন্য তার ‘বিজয় পরিকল্পনা’ উপস্থাপন করেন। এর মধ্যে রয়েছে নির্দিষ্ট অস্ত্র ব্যবহারের অনুরোধ এবং অবিলম্বে ন্যাটোতে যোগদানের ‘নিঃশর্ত’ আমন্ত্রণ। তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমার এবং ন্যাটোর নতুন মহাসচিব মার্ক রুটের সঙ্গে সাক্ষাতের মাধ্যমে তার দেশের জন্য সশস্ত্র ও আর্থিক সহায়তা জোরদার করতে ইউরোপ সফর শুরু করেন। নভেম্বরে জি-৭ বৈঠকে নেতারা ইউক্রেনের প্রতি তাদের ‘যতদিন সময় লাগে’ বলে সমর্থন পুনঃপ্রকাশ করেন। কারণ, জেলেনস্কি ‘কূটনৈতিক উপায়ে’ ২০২৫ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করার আশা করেছিলেন। ক্রেমলিন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল যে, জেলেনস্কির পরিকল্পনা ন্যাটো এবং রাশিয়ার মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষের দিকে নিয়ে যেতে পারে। 

অনেক পর্যবেক্ষক জানুয়ারিতে ওভাল অফিসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আনুষ্ঠানিক প্রত্যাবর্তনের জন্য উদ্বিগ্নভাবে অপেক্ষা করছেন। কারণ তিনি ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যে’ যুদ্ধ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যদিও এখন পর্যন্ত কোনো বিশদ বা স্পষ্ট পরিকল্পনা দেওয়া হয়নি। গত মাসে রিপোর্ট করা হয়েছিল যে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ট্রাম্পের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিয়ে আলোচনা করার জন্য উন্মুখ ছিলেন। কিন্তু তিনি আঞ্চলিক মূল বিষয়গুলো ছাড় দেওয়ার ব্যাপারে অস্বীকার করেছিলেন। 

আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, ২০২৪ সালে ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতের কোনো সমাধান হয়নি। এমনকি অস্ত্রশস্ত্র এবং নতুন দেশ এই যুদ্ধে সম্পৃক্ততার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। উভয় পক্ষের বক্তৃতার মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ রয়েছে, যেখানে ‘বিজয়’ ও  ‘শান্তি’র পরিবর্তে অন্য কোনো অর্থ বহন করছে। এমনকি ট্রাম্প ইউক্রেনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন কিছুটা দুর্বল করলেও ইউরোপীয় নেতাদের দৃঢ় অবস্থান বজায় রাখার সম্ভাবনা বেশি। রাশিয়া সম্ভবত তার বর্তমান মিত্রদের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তুলবে, বিশেষ করে যতদূর সামরিক প্রতিরোধ বজায় রাখা যায়।

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের দ্রুত সমাধান হওয়াটা কঠিন। অন্তত যতক্ষণ না প্রধান অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে নেতৃত্ব ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে। ২০২৫ হতে পারে শান্তি নির্মাণের বছর। এটি অর্জনের জন্য অনেক প্রচেষ্টা করা হবে। মনে হচ্ছে, কোনো ধরনের ব্রেকিং পয়েন্ট বা সিদ্ধান্তে না পৌঁছানো পর্যন্ত রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট কাটবে না। 

লেখক: একাডেমিক ভিজিটর, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় 
আরব নিউজ থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল  

রাজধানীর বায়ুদূষণ রোধ করা জরুরি

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৫৮ এএম
রাজধানীর বায়ুদূষণ রোধ করা জরুরি
সৈয়দ ফারুক হোসেন

আইকিউএয়ারের ২০২৩ সালের বছরভিত্তিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বায়ুদূষণ বেশি বাংলাদেশে। এ তালিকায় ১ নম্বরে বাংলাদেশ। এর পর রয়েছে পাকিস্তান, ভারত, তাজিকিস্তান ও বুরকিনা ফাসো। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় ১ নম্বরে ছিল ভারতের নয়াদিল্লি। এর পর রয়েছে ঢাকা, বুরকিনা ফাসোর ওয়াগাডুগু, তাজিকিস্তানের দুশানবে ও ইরাকের বাগদাদ। শীত এলে বায়ুদূষণ আরও বাড়ে। বাংলাদেশ ও রাজধানী শহর ঢাকায় বায়ুদূষণের সমস্যাটি নতুন নয়। শুষ্ক মৌসুমে বিশ্বের দূষিত শহরগুলোর তালিকায় ঢাকা প্রায়ই ১ নম্বরে থাকে।

 সম্প্রতি গত শুক্রবার ছুটির দিনে রাত পৌনে ৯টায় বিশ্বের ১২৫টি শহরের মধ্যে দূষণের দিক দিয়ে ঢাকা ছিল তৃতীয়। শীর্ষে ছিল পাকিস্তানের লাহোর, দ্বিতীয় ভারতের নয়াদিল্লি। সাধারণত একিউআই স্কোর ৫০ থেকে ১০০-এর মধ্যে থাকলে ‘স্বাভাবিক অবস্থা’ বলা হয়। স্কোর ১০১ থেকে ২০০-এর মধ্যে থাকলে ‘অস্বাস্থ্যকর’, স্কোর ২০১ থেকে ৩০০-এর মধ্যে থাকলে ‘খারাপ’ এবং ৩০১ থেকে ৪০০ স্কোর হলে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে বিবেচিত হয়। বছর বছর বায়ুর মানের অবনতি হচ্ছে। 

ঢাকার রাস্তায় বের হলেই দেখা যায়, খোঁড়াখুঁড়ি অথবা নির্মাণকাজ চলছে; সেখানে ধুলোবালি যথেচ্ছভাবে ছড়াচ্ছে। রাস্তায় বের হলেই দেখা যায়, বহু পুরোনো লক্কড়ঝক্কড় বাস, লেগুনার মতো যানবাহন কালো ধোঁয়া ছেড়ে চলাচল করছে, বর্জ্য পোড়ানো হচ্ছে। মূলত ঢাকায় বায়ুদূষণের বড় উৎস নির্মাণকাজ। এর পর রয়েছে ইটভাটা ও কারখানা, আন্তর্দেশীয় দূষিত বায়ু এবং রান্নার চুলা। ঢাকার বাতাসে অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদানের সঙ্গে চারটি উপাদানের আশঙ্কাজনক উপস্থিতি রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা, সালফার ডাই-অক্সাইড ও ব্ল্যাক কার্বন।

 শীতের শুরু থেকেই ঢাকার বায়ুমান কখনো চরম অস্বাস্থ্যকর এবং কখনো বিপজ্জনক পর্যায়ে চলে যায়। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যান্য শহরে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখা, বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের বাইরে যাওয়া নিষেধ করা হয়। এ ছাড়া বায়ুদূষণ দূর করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়। একটি সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর নগরের জন্য আয়তন অনুযায়ী জনসংখ্যা সীমিত রাখা, গাছপালা ও জলাভূমি রক্ষা করা আর বায়ু-মাটিদূষণ নিয়ন্ত্রণে রাখাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন বিশেষজ্ঞরা। এসব কারণে ঢাকার অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছে। এক যুগ ধরে ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান উৎস হিসেবে ইটভাটাকে মনে করা হতো। কিন্তু এই জরিপ বলছে, ঢাকার বাতাসে দূষিত বস্তুর উৎস হিসেবে ইটভাটার স্থান দখল করেছে যানবাহন ও শিল্পকারখানার ধোঁয়া। দূষিত বাতাসে কঠিন ও তরল পদার্থ উড়ে বেড়ায়, যার মধ্যে রয়েছে কাচ, ধোঁয়া বা ধুলা, যেগুলোকে ‘বস্তুকণা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এসব বস্তুকণার মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী বলা হয় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ‘বস্তুকণা ২.৫’। যেটি মানুষের চুলের ব্যাসের মাত্র ৩ শতাংশ, যেটি মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ঢুকে যায়। 

এই দূষণ সবচেয়ে বেশি হয় জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে; যা মূলত গাড়ির ইঞ্জিন বা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপন্ন হয়। ঢাকার বাতাসে ভেসে বেড়ানো অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা পাওয়া গেছে প্রতি ঘনমিটারে ৮৬ মাইক্রোগ্রাম, যা ২০০৩ সালে ছিল ৭২ মাইক্রোগ্রাম। ডব্লিউএইচও বলছে, বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার সহনীয় মাত্রা ৫ মাইক্রোগ্রাম। ঢাকার বাতাসে সালফার ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ পাওয়া গেছে ৮ দশমিক ৯ মাইক্রোগ্রাম, যা ২০০৩ সালে ছিল ৫ মাইক্রোগ্রাম। ডব্লিউএইচওর মানদণ্ড অনুযায়ী, বাতাসে সালফার ডাই-অক্সাইডের সহনীয় মাত্রা ৪০। অর্থাৎ সালফার ডাই-অক্সাইড সহনীয় মাত্রার চেয়ে কম রয়েছে ঢাকার বাতাসে। কিন্তু এটা বাড়ছে। গত বছর যা ছিল মাত্র ৬ মাইক্রোগ্রাম। ঢাকায় বর্ষায় ডেঙ্গুর ভয়, শীতে বায়ুদূষণের ভয়, সারা বছর থাকে শব্দদূষণ- মানুষ এসব সমস্যায় এখন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। 

বায়ু দূষিত হলে মানুষের শ্বাসতন্ত্রের রোগ বেড়ে যায়। ঘরে ঘরে যেমন সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত মানুষ বাড়ে, তেমনি হাসপাতালে বাড়ে শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত মানুষের ভিড়। বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি হয় শ্বাসতন্ত্রের রোগ। এর মধ্যে হাঁপানি, ফুসফুসের কাশি ছাড়াও লাং ক্যানসার, স্ট্রোক ও কিডনির সমস্যা হয়। এদিকে বায়ুমানের সূচক ২০০ অতিক্রম করলে একে ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ বলে ধরা হয়। বায়ুদূষণের কারণে সারা দেশে মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় ৫ বছর ৪ মাস।

 ঢাকায় কমেছে প্রায় ৭ বছর ৭ মাস। অর্থাৎ ঢাকায় বায়ুদূষণ না থাকলে আমরা আরও প্রায় ৭ বছর ৭ মাস বেশি বাঁচতে পারতাম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭২ বছর ৬ মাস। লাইফ ইনডেক্সের গবেষণা মতে, ১৯৯৮ সালে বায়ুদূষণের কারণে গড় আয়ু কমেছিল প্রায় ২ বছর ৮ মাস, ২০১৯ সালে সেটি ৫ বছর ৪ মাসে দাঁড়িয়েছিল। গবেষণা বলছে, সারা দেশের ৬৪টি জেলার প্রতিটিতেই বায়ুদূষণের হার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী অন্তত ৩ গুণ বেশি। বায়ুদূষণের সঙ্গে মানুষের গড় আয়ুর বিষয়টি জড়িত। 

গত কয়েক যুগে এই শহরের সবুজ এলাকা ও জলাভূমি হারিয়েছে, আর বাতাস-মাটি মারাত্মকভাবে দূষিত হয়েছে। গত এক বছরে বিশ্বের প্রধান শহরগুলোর বসবাসযোগ্যতা নিয়ে যে কয়টি জরিপ হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ঢাকার অবস্থান ছিল তলানিতে। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার ভারতের রাজধানী দিল্লিবাসী। বায়ুদূষণ লাইফ ইনডেক্সের তথ্যমতে, বায়ুদূষণের কারণে সারা বিশ্বে মানুষের গড় আয়ু কমেছে ২ দশমিক ২ বছর। স্থায়ীভাবে দূষণ বন্ধ করা গেলে বিশ্বের মানুষের গড় আয়ু ৭২ থেকে ৭৪ বছর হতো, যা সার্বিক হিসাবে ১৭ বিলিয়ন জীবন-বর্ষ। রাজধানী ঢাকায় গত ১০ বছরে বায়ুদূষণ বেড়েছে ৮৬ শতাংশ। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বায়ুদূষণের কারণে মানুষের গড় আয়ু ২ থেকে ৯ বছর পর্যন্ত কমছে। এর ফলে নানা ধরনের কঠিন অসুখের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্করাই বায়ুদূষণের সবচেয়ে বড় শিকার।

 পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্মল বায়ু ও টেকসই উন্নয়ন প্রকল্পের বাতাসের মান পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রাজধানীর বায়ু ২০১৪ সালে ১৬৫ দিন বিপজ্জনক ছিল। ২০১৫ সালে দূষণের মাত্রা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭৮ দিন। পর্যায়ক্রমে ২০১৬ সালে ১৯২ দিন, ২০১৭ সালে ২১২ দিন, ২০১৮ সালে ২৩৬ দিন, ২০১৯ সালে ২৮৩ দিন ঢাকার বায়ু দূষিত ছিল, যার ধারাবাহিকতায় ২০২০ ও ২০২১ সালে বায়ুদূষণের তালিকায় প্রথম হয় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। মৃত জীবদেহের পচনের ফলে অনেক ধরনের দুর্গন্ধযুক্ত গ্যাস যেমন মিথেন, হাইড্রোজেন সালফাইড ইত্যাদি বাতাসের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে বায়ুর দূষণ ঘটায়। মহাকাশ থেকে ভূপৃষ্ঠে আগত উল্কাপিণ্ড, মহাজাগতিক ধূলিকণা প্রভৃতি বাতাসের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে বায়ুর দূষণ ঘটায়।

মানুষের দৈনন্দিন কার্যকলাপের ফলে প্রতিনিয়ত অবাঞ্ছিত বস্তু বাতাসে মিশ্রিত হচ্ছে, এগুলোকেই মনুষ্যসৃষ্ট কারণ বলে। শিল্পাঞ্চলের কারখানা থেকে নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, হাইড্রো কার্বন, ধাতব কণা, ধোঁয়া প্রভৃতি প্রচুর পরিমাণে বাতাসে মিশ্রিত হয়ে বাতাসকে দূষিত করে। বিভিন্ন যানবাহনে জীবাশ্ম জ্বালানির (পেট্রোল ও ডিজেল) দহনের ফলে বিভিন্ন ক্ষতিকর গ্যাস নির্গত হয়। এগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান বায়ুদূষক কার্বন মনো-অক্সাইডের প্রায় ৭০ শতাংশ এই যানবাহন থেকে নির্গত হয়। এ ছাড়া যানবাহনের ধোঁয়ায় প্রচুর নাইট্রোজেনের অক্সাইড থাকে, যা বায়ুকে দূষিত করে তোলে।

 যানবাহনের আধিক্যের জন্য শহরাঞ্চলের বাতাস বেশি দূষিত হয়। বায়ুমণ্ডলকে দূষণমুক্ত রাখতে নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করা প্রয়োজন। গাছ অক্সিজেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইডের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে, তাই প্রচুর পরিমাণে বৃক্ষ রোপণ করলে বায়ুমণ্ডলে বিভিন্ন গ্যাসের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা হয়। জীবাশ্ম জ্বালানি দহনে বাতাস বেশি দূষিত হয়। তাই এগুলোর পরিবর্তে দূষণমুক্ত সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, জোয়ার-ভাটার শক্তি প্রভৃতি ব্যবহার করা প্রয়োজন। সালফারবিহীন কয়লা ও সিসাবিহীন পেট্রোল ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাসের সাহায্যে যানবাহন চালানোর মাধ্যমে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। 

বায়ুদূষণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ আইন প্রয়োগ করে দূষণকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করলে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বায়ুদূষণের উৎস বা কারণ এবং কুফল সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বোধ জাগিয়ে তুললে বায়ুদূষণ রোধ করা সম্ভব। দুই কারণে ঢাকার বায়ু বেশি দূষিত হচ্ছে। প্রথমটি বাতাসের দূষিত উপাদান বাতাসেই রয়ে যাচ্ছে। এর বাইরেও রয়েছে শহরে বড় প্রকল্পের কাজ, নির্মাণাধীন ভবনের কাজ, যানবাহনের ধোঁয়ায় ঢাকার বায়ুর চাপ বেশি। এই দূষিত অংশ বায়ুর নিম্নস্তরে ২০০৩০০ ফুট ওপরে অবস্থান করছে। বর্তমানে বায়ুদূষণে ধুলার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গাড়ি ও শিল্পকারখানার ধোঁয়া। বর্তমানে বাতাসে ধুলা আগের চেয়ে পরিমাণে বেড়েছে। আগে এত মেগা প্রজেক্ট (বৃহৎ প্রকল্প) ও গাড়ি ছিল না। 

পাশাপাশি ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার জলাশয় ভরাট হওয়ায় ধুলার নতুন উৎস জন্মেছে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশে ধুলা এমনিতে বেশি। এরপর কয়েক বছর ধরে অনিয়ন্ত্রিতভাবে উন্মুক্ত পরিবেশে নতুন নতুন নির্মাণযজ্ঞ বাড়িয়েছে ধুলাদূষণ। মেট্রোরেলের মতো বড় প্রকল্প, পূর্বাচল সিটি ও বছিলার মতো কিছু অঞ্চল এবং অজস্র ছোট আবাসন প্রকল্প এর মধ্যে রয়েছে। যোগ হয়েছে মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধের মতো খানাখন্দে ভরা কিছু রাস্তা। এসব স্থান ছাড়াও রাজধানীর প্রবেশমুখ গাবতলী, যাত্রাবাড়ী, পূর্বাচল, কেরানীগঞ্জ, টঙ্গীসহ আরও কিছু এলাকায় ধুলার আধিক্য দেখা যায়। ঢাকা শহর ক্ষমতার চেয়ে তিন থেকে চার গুণ স্থাপনা ধারণ করে আছে। এরপরও শিল্পায়ন, কংক্রিটের ভবন, আবাসন প্রকল্প হচ্ছে। 

বাফার এলাকাগুলো মাটি ও বালু দিয়ে ভরাট করে নির্মাণযজ্ঞ চলছে। ফলে দূষণ রোধের এলাকাগুলো উল্টো দূষণ বাড়াচ্ছে। শুধু পানি ছিটিয়ে উষ্ণ আবহাওয়ায় ধুলা বেশিক্ষণ ভিজিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এই অবস্থার মধ্যেও গত বছর পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বায়ুদূষণ রোধে নির্দেশিকার বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। নির্দেশিকায় রাস্তা নির্মাণের সময় নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা, বিটুমিনের ওপর বালু না ছিটিয়ে মিনি অ্যাসফল্ট প্যান্টের মতো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার, রাস্তার পাশের মাটি কংক্রিট বা ঘাসে ঢেকে দেওয়া, রাস্তা পরিষ্কারের ঝাড়ুর পরিবর্তে ভ্যাকুয়াম সুইপিং ট্রাক ব্যবহার, বড় সড়কে কমপক্ষে দুবার পানি ছিটানোর ব্যবস্থা নেওয়া কোনোটি কার্যকর করার উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে এখনই জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়।

লেখক: সাবেক রেজিস্ট্রার, বিএসএফএমএসটিইউ
[email protected]

জাতীয় ঐক্য সব সময় ভালো উদ্যোগ: ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৫০ পিএম
আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৫৪ পিএম
জাতীয় ঐক্য সব সময় ভালো উদ্যোগ: ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম
ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

জাতীয় ঐক্য সব সময় ভালো, দেখা যাক এটার ফলাফল কী দাঁড়ায়। তবে ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের কিছুটা অবনতি হয়েছে। মূলত পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে, প্রাদেশিক সরকারের সঙ্গে।

কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে খুব একটা বড় রকমের মতবিরোধ হয় নাই। ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক খুবই গভীর। আমরা অনেক কিছুই আমদানি করি। রপ্তানির দিক থেকে যদিও কম। দুটিই প্রতিবেশী দেশ। তাই চেষ্টা করা হচ্ছে সম্পর্কটা ঠিক রাখার; সম্পর্ক যাতে অবনতি না হয়।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

সংকটে সবাইকে একত্রিত করা ভালো অগ্রগতি: ড. দিলারা চৌধুরী

প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৪২ পিএম
আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৫০ পিএম
সংকটে সবাইকে একত্রিত করা ভালো অগ্রগতি: ড. দিলারা চৌধুরী
ড. দিলারা চৌধুরী

আমি মনে করি, এটা একটা ইতিবাচক বিষয়। একটা ভূমিকা প্রধান উপদেষ্টা নিয়েছেন। ছাত্রদের সঙ্গে বসেছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসেছেন। এই সংকটে সবাইকে একত্রিত করা হয়েছে। এটা অত্যন্ত ভালো অগ্রগতি।

ভারতের বিষয়ে আমাদের এখন কথা বলতে হবে। আমরা আমাদের নাগরিককে গ্রেপ্তার করতে পারব না? চিন্ময় তো বাংলাদেশের নাগরিক। তার জন্য এ রকম করবে? তাহলে আমাদের স্বাধীনতা আছে নাকি। আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। ঐকমত্যে সবাইকে নিয়ে আসছেন, আমি খুবই খুশি। জনগণও খুশি হবে। আমাদের দেশের ওপর হুমকি এসেছে, আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে ড. ইউনূসকে সমর্থন দেব। এর বাইরে যে কথা বলবে সে দেশদ্রোহী।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সাবেক অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

লেবাননের যুদ্ধবিরতি এবং বিশ্ব পরিস্থিতি

প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৩৯ এএম
লেবাননের যুদ্ধবিরতি এবং বিশ্ব পরিস্থিতি
হর্ষ কাকর

যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের দীর্ঘ আলোচনার পর ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহ যুদ্ধবিরতি মেনে নিয়েছে। এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধের পর এই যুদ্ধবিরতি হয়। এই যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে, যাদের বেশির ভাগই নির্দোষ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‌এই চুক্তিটি লেবাননে যুদ্ধ বন্ধ করবে এবং লেবানন থেকে পরিচালিত হিজবুল্লাহ ও অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হুমকি থেকে ইসরায়েলকে নিরাপদ করবে।’ তারা আরও বলেন, ‘‌এই যুদ্ধবিরতি স্থায়ী শান্তি পুনরুদ্ধারের পরিস্থিতি তৈরি করবে। উভয় দেশের বাসিন্দাদের নিরাপদে তাদের বাড়িতে ফিরে যেতে দিন।’ 

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘আমরা চুক্তি কার্যকর করব এবং যেকোনো লঙ্ঘনের জন্য আমরা জবাব দেব।’ চুক্তি অনুযায়ী প্রাথমিকভাবে এই যুদ্ধবিরতি ৬০ দিনের জন্য হবে। পশ্চিম এশিয়ায় সংঘাতের একটি অংশের অবসান হওয়ায় বিশ্ব এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে। লেবাননে সংঘাতে এখন পর্যন্ত ১ দশমিক ২ মিলিয়ন লেবানিজ এবং ৬০ হাজার ইসরায়েলিকে বাস্তুচ্যুত করেছে। লেবাননের মতে, তাদের প্রায় ৩ হাজার ৭০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটে, যেখানে ইসরায়েলের ৭৫ জন সৈন্য ও ৪৫ জন বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে। ইউনাইটেড নেশন সিকিউরিটি কাউন্সিল রেজল্যুশন-১৭০১ চুক্তি অনুসারে ২০০৬ সালের ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ বিরোধের অবসান ঘটেছিল। ২০০৬-এর মতো, শুধু লেবাননের সশস্ত্র বাহিনী এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীরা লেবাননের লিতানি নদীর দক্ষিণে কাজ করবে। তার মানে হচ্ছে, হিজবুল্লাহ বাহিনী সীমান্ত থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার পিছু হটবে যখন ইসরায়েলি বাহিনী লেবানন ছেড়ে দেবে।

২০০৬ সালের যুদ্ধবিরতি চুক্তি উভয় পক্ষই লঙ্ঘন করেছে। হিজবুল্লাহ ভূগর্ভস্থ কাঠামো নির্মাণ করছে এবং ইসরায়েলি বিমান নিয়মিতভাবে লেবাননের ওপর দিয়ে উড়ছে। গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে আক্রমণ শুরু না করা পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি বহাল ছিল। এটি উল্লেখ করা উচিত যে, উভয় যুদ্ধবিরতি (২০০৬ এবং বর্তমান) ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে, লেবাননের মধ্যে নয়। বিশ্ব হিজবুল্লাহকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে মনোনীত করা সত্ত্বেও তাদের বৈশ্বিক অস্তিত্ব রয়েছে বলে স্বীকার করেছে। বর্তমান যুদ্ধবিরতিতে সংঘাতে জড়িত সব পক্ষের জন্য জয়জয়কার বজায় থাকবে বলে আশা করা যায়। 

জো বাইডেনের এটা বিশেষ অর্জন, যদিও তার প্রেসিডেন্সির শেষ পর্যায়ে এসে এটি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের আগে যদি এই যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হতো, তাহলে কমলা হ্যারিসের উপকার হতে পারত। যুক্তরাষ্ট্রকে তার সীমা প্রসারিত করতে হচ্ছে। ইসরায়েল ও ইউক্রেনকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করার পাশাপাশি ভবিষ্যতের যেকোনো অপারেশনের জন্য নিজস্ব মজুতও বজায় রাখা হচ্ছে। নেতানিয়াহু আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধবিরতি মেনে নেওয়ার তিনটি কারণ ঘোষণা করেছেন।

প্রথমত, ইসরায়েলকে তার প্রধান প্রতিপক্ষ ইরানের দিকে মনোযোগ দিতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, যুদ্ধবিরতি একটি ‘নিশ্বাস’ হিসেবে আভির্ভূত হয়েছে, কারণ ইসরায়েলি বাহিনী তাদের মজুত পুনরায় পূরণ করার সুযোগ পাচ্ছে। অবশেষে হামাস ও হিজবুল্লাহর অপারেশন আলাদা হয়ে যায়। আরও একাধিক কারণ রয়েছে। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী কিছুটা ক্লান্ত। সিএনএন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ইসরায়েলি বাহিনী অতি ধার্মিকদের বিরুদ্ধে ১১২৬টি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। 

ইসরায়েল সুপ্রিম কোর্ট স্থির করেছিলেন যে, গোঁড়া ধার্মিক ইহুদিদের সামরিক চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া যাবে না। একজন ইসরায়েলি সামরিক মুখপাত্র অতি-অর্থোডক্স ইহুদিদের আদেশের খসড়া তৈরির বিষয়ে মন্তব্য করার সময় এমনভাবেই উল্লেখ করেছেন। ‘আইডিএফে (ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী) অনেক সৈন্যের প্রয়োজন। আমাদের ১০ হাজারের মতো সৈন্য রয়েছে কিন্তু এটি স্থিতিশীল পরিসংখ্যান নয়। কারণ দুর্ভাগ্যবশত আমাদের হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশি।’ হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধবিরতি হলে সৈন্য নিয়োগের চাহিদা কমে যাবে। অন্যদিকে ইসরায়েল সরকারের মধ্যে সংঘাতের আচরণ ও নেতানিয়াহুর কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র নিয়েও মতানৈক্য রয়েছে। 

ইসরায়েল হিজবুল্লাহকে কখনোই পরাজিত করতে পারেনি। ২০০৬ সালে যুদ্ধবিরতির আগে উভয় পক্ষই হতাহত হয়েছিল। তখন তারা সেই যুদ্ধবিরতিকে স্বাগত জানিয়েছিল। কারণ তারা পরে সংগ্রাম করার সুযোগ খুঁজেছিল। ইসরায়েল শিক্ষা নিয়েছিল এবং এই অভিযানে তারা তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছিল। হিজবুল্লাহও পরিবর্তন এনেছিল এবং ধারাবাহিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও আরেকটি যুদ্ধবিরতি জোরদার করতে সক্ষম হয়েছিল। এবারের যুদ্ধে ইসরায়েল লক্ষ্যবস্তুতে বোমা হামলার মাধ্যমে হিজবুল্লাহর সিনিয়র নেতাদের নির্মূল করেছে। পেজার বোমার আঘাতে মাধ্যম স্তরের নেতাদের মেরে ফেলেছে। তা ছাড়া বিমানবাহিনী হিজবুল্লাহর রকেট স্টোরেজ ডিপো এবং উৎপাদন কেন্দ্রে বোমা হামলা করে। 

যা-ই হোক, এগুলো রকেট উৎক্ষেপণ বন্ধ করতে তেমন কিছু করেনি। হিজবুল্লাহও ২০০৬ সাল থেকে অনেক কিছুই শিখেছিল। যুদ্ধবিরতির কয়েক দিন আগে হিজবুল্লাহ ২৫০টিরও বেশি রকেট নিক্ষেপ করেছিল। লেবাননে অনুপ্রবেশ করা ইসরায়েলি বাহিনী ২০০৬ সালে বা এখন পর্যন্ত খুব বেশি সফল হতে পারেনি। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও হিজবুল্লাহ সব সময় ফিরে এসেছে। ইসরায়েলের জন্য বিশেষ কঠিন হবে। কারণ তারা গাজায় হামাসের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। লক্ষ্যবস্তুতে বিমান হামলায় লেবাননের বেসামরিক লোকের হতাহতের ঘটনায় শুধু হিজবুল্লাহ লাভবান হয়েছে। কারণ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো নির্দোষ মানুষের মৃত্যুর মাধ্যমে সমর্থন লাভ করে যাচ্ছে। একই সঙ্গে এটি ইসরায়েলের বৈশ্বিক অবস্থানকে শক্ত করে যাচ্ছে। ইসরায়েল এখন সিরিয়ার পাশাপাশি ইয়েমেনেও হামাস, ইসরায়েলবিরোধী গোষ্ঠীর দিকে মনোনিবেশ করতে পারে।

ইসরায়েল সচেতন রয়েছে যে, এই যুদ্ধবিরতি হিজবুল্লাহকে তার কাঠামো ও সামরিক শক্তি পুনর্নির্মাণ করতে সক্ষম করবে। ভবিষ্যতে কোনো একসময় আবার যুদ্ধ শুরু হবে। অবিলম্বে সেই যুদ্ধ না-ও হতে পারে, তবে ঘটবে। এটা সময়ের ব্যাপার কিন্তু উভয় দেশের নাগরিকদের জন্য কিছুটা স্বস্তি এনে দিয়েছে। হামাস ও হিজবুল্লাহর প্রধান সমর্থক ইরানের ভবিষ্যতের জন্য তাদের অন্তত প্রক্সি সুরক্ষিত থাকা অপরিহার্য। হিজবুল্লাহকে বাঁচাতে গিয়ে হামাসকে আত্মত্যাগ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ইরানের জন্য হামাস, হুতি এবং হিজবুল্লাহ শপথকারী এক মিত্র এবং তাদের একমাত্র শত্রু ইসরায়েল। তাদের সবাই একসঙ্গে ধ্বংস হতে দেওয়া যাবে না। ইরান নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। 

এই যুদ্ধবিরতি প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এ কারণেই হিজবুল্লাহ প্রধান নাইম কাসিমকে যুদ্ধবিরতির অনুমোদন দিয়েছে। হিজবুল্লাহকেও পুনরুদ্ধার করতে হবে। ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের শত্রুতা অব্যাহত রয়েছে। যুদ্ধবিরতির অন্যতম কারণ এটি দুই পক্ষের সক্ষমতা, জনশক্তি, কাঠামো এবং অস্ত্রশস্ত্রের মজুত পুনর্নির্মাণ করে। যদিও এতে অনেক হতাহত হয়েছে। তবে তারা সচেতন যে, তারা যুদ্ধে হারেনি। তারা যুদ্ধ এবং পরবর্তী পর্যায়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে চূড়ান্ত বিশ্লেষণে, ইসরায়েল এবং হিজবুল্লাহ উভয়ই জানে এটি স্থায়ী শান্তিচুক্তি নয়। এটা কতদিন চলবে তা কেউ জানে না। বর্তমানে উভয় পক্ষের বাহিনী এবং জনগণও যুদ্ধে ক্লান্ত। এই ক্লান্তিই উভয় পক্ষকে অন্তত অল্প সময়ের জন্য শান্তিতে থাকতে বাধ্য করতে পারে। 

লেখক: ভারতীয় সেনাবাহিনীর 
অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল
দ্য স্টেটসম্যান থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল