জলবায়ুসংকটের কারণে কৃষি খাত ব্যাপক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয় এবং সেটা মোকাবিলা করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমি জাতিসংঘের মহাসচিব থাকাকালে জলবায়ু মোকাবিলায় আমার নেতৃত্বের ভূমিকা অনেক বড় ছিল। কপ-২৯ সম্মেলনে আমি বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করি। কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট অনুদান ও প্রতিশ্রুতি দেওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। জলবায়ুসহনশীল ফসল, টেকসই চাষাবাদ অনুশীলন, উন্নত পানি ও মাটি ব্যবস্থাপনার কৌশল বিকাশের জন্য কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ অপরিহার্য। কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নে সহায়তা শুধু উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং স্থিতিস্থাপকতা বাড়াবে না, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আরও স্থিতিশীল ও নিরাপদ বিশ্ব খাদ্যব্যবস্থায় অবদান রাখবে।...
এবারের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৯) হতে যাচ্ছে আজারবাইজানের বাকুতে। বিশ্ব নেতারা এবারের সম্মেলনে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় নতুন করে অর্থায়ন লক্ষ্য নির্ধারণ করতে যাচ্ছেন। বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোকে তাদের গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমাতে এবং জলবায়ুসংকটের প্রভাবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করার জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হবে। আবহাওয়ার বৈরী প্রভাব এবং কীভাবে তা মোকাবিলা করা যায়- সেটাই এবারের আলোচ্য বিষয় হবে। আমরা উত্তর আফ্রিকা, মেক্সিকো, ভারত
এবং সৌদি আরবজুড়ে মারাত্মক তাপপ্রবাহ
উপলব্ধি করেছি। দক্ষিণ আফ্রিকাজুড়েও অনেক খরা পড়েছে, যা ইতিহাসে রেকর্ড। ব্রাজিলের জলাভূমিতে ভয়ানক দাবানল দেখেছি। ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রেকর্ড ভঙ্গকারী হারিকেন ঝড় হয়েছে। জলবায়ু কোনো সীমানা জানে না এবং কাউকে রেহাই দেয় না।
এবারের সম্মেলন জলবায়ুসংকটের প্রথম সারিতে থাকা দুর্বল দেশগুলোকে রক্ষায় বিশ্ব নেতাদের কাছে বড় চাপ সৃষ্টি করবে। উন্নয়নশীল দেশের জন্য বিশেষ করে আফ্রিকায় জলবায়ু প্রভাবের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার খরচ অনেক বেশি। আফ্রিকান দেশগুলো জলবায়ুর চরম প্রভাবের কারণে তাদের জিডিপির ৫ শতাংশ হারাচ্ছে। কোনো কোনো দেশ তাদের জাতীয় বাজেটের ৯ শতাংশ পর্যন্ত বরাদ্দ করেছে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব কাটিয়ে উঠতে।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা অনুমান করছে, দক্ষিণ আফ্রিকার সাহারায় জলবায়ু বিপর্যয়ের মুখোমুখি যেসব সম্প্রদায় রয়েছে তাদের রক্ষা করতে আগামী দশকে বার্ষিক ৩০-৫০ বিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন হবে। জলবায়ুসংকট মোকাবিলা না করে আমরা দারিদ্র্য ও ক্ষুধা দূর করতে পারব না। জলবায়ু সংকটের সমাধান না করলে সমৃদ্ধ ও স্থিতিস্থাপক বিশ্ব সম্প্রদায় গড়ে তুলতে পারব না।
জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় আর্থিক ব্যয়ের মাত্রা দিন দিন অনেক বাড়ছে। অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অনুসারে ২০২১ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে প্রায় ৮৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার সহযোগিতা করা হয়েছিল। তবুও বৈশ্বিক জলবায়ু অর্থায়ন অনুপাতিকহারে দিন দিন কমে যাচ্ছে। জলবায়ু অর্থায়নের প্রায় ৯০ শতাংশ জলবায়ুসংকটের প্রভাবগুলো মেটানোর জন্য খরচ হয়। সংকট কাটিয়ে দেশগুলোর স্থিতিস্থাপকতা তৈরি করতে বহির্বিশ্বের সহযোগিতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ বিশ্বের সামনে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য যারা ইতোমধ্যেই ঋণের বোঝা বহন করে পঙ্গু হয়েছে। আমি বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে জলবায়ুর বৈরিতা প্রশমন এবং সংকট কাটিয়ে ওঠার আর্থিক সহযোগিতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য আহ্বান জানাই। জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় উভয়ই ক্ষত্রেই পর্যাপ্ত অর্থায়ন নিশ্চিত হোক।
আর্থিক ভারসাম্য মানে চ্যালেঞ্জের স্কেল ভেদে জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলার জন্য অনুদানভিত্তিক পাবলিক ফাইন্যান্স বাড়ানো। এটি অবশ্যই কপ-২৯-এ আলোচনা করা নতুন যৌথ পরিমাপকৃত লক্ষ্যের (NCQG) মূল উপাদান হতে হবে, যেখানে জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় সমন্বয় তহবিলের অর্থ পৃথক এবং সমান অগ্রাধিকার হিসেবে স্বীকৃত হতে হবে। সমন্বয় তহবিল সম্প্রসারণ ইতোমধ্যে জলবায়ুসংকটে বিধ্বংসী প্রভাবের সম্মুখীন হওয়া দেশগুলোকে রক্ষা করতে সম্পদের ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত করেছে।
কপ-২৯ সম্মেলনে সমন্বয় অর্থায়নের ওপর বেশি জোর দিতে অবশ্যই সাহসী ও রূপান্তরমূলক হতে হবে। কপ-২৯ সম্মেলনে সমন্বয় অর্থ তহবিলের আলোচনার জন্য আয়ারল্যান্ড এবং কোস্টারিকা থেকে দুজন মন্ত্রীকে প্রেসিডেন্সির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা এই সম্মেলন চলাকালীন পরামর্শ এবং দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় নেতৃত্ব দেবেন। এটি নিউ কালেক্টিভ কোয়ান্টিফাইড গোল (NCQG) আলোচনার মধ্যে সমন্বয় তহবিলের গুরুত্ব দেওয়াটা ইতিবাচক হবে।
কপ-২৯ সম্মেলনে বিশ্বনেতাদের অবশ্যই পাবলিক অ্যাডাপ্টেশন ফাইন্যান্স বাড়ানোর জন্য উচ্চাভিলাষী পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। এটিকে ক্ষয়ক্ষতি থেকে আলাদাভাবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করতে হবে। এই অঙ্গীকারগুলো অবশ্যই উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে করতে হবে। সবচেয়ে দুর্বলদের জন্য আবেদন প্রক্রিয়া সরল করাসহ আরও ভালো সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। শুধু এটি করার মাধ্যমে আমরা সমন্বয় তহবিলের ব্যবধানকে সংকুচিত করা এবং অর্থ সংগ্রহে বৈশ্বিক লক্ষ্য অর্জনের কাছাকাছি যাওয়ার আশা করতে পারি।
জলবায়ুসংকটের কারণে কৃষি খাত ব্যাপক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয় এবং সেটা মোকাবিলা করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমি জাতিসংঘের মহাসচিব থাকাকালে জলবায়ু মোকাবিলায় আমার নেতৃত্বের ভূমিকা অনেক বড় ছিল।
কপ-২৯ সম্মেলনে আমি বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করি। কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট অনুদান ও প্রতিশ্রুতি দেওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। জলবায়ুসহনশীল ফসল, টেকসই চাষাবাদ অনুশীলন, উন্নত পানি ও মাটি ব্যবস্থাপনার কৌশল বিকাশের জন্য কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ অপরিহার্য। কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নে সহায়তা শুধু উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং স্থিতিস্থাপকতা বাড়াবে না, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আরও স্থিতিশীল ও নিরাপদ বিশ্ব খাদ্যব্যবস্থায় অবদান রাখবে।
কপ-২৯ সম্মেলনে জলবায়ু নেতৃত্বের জন্য নতুন যুগের জন্য বড় সুযোগ রয়েছে। জলবায়ু সম্মেলনে যারা নেতা আছেন আমি তাদের সাহসী প্রতিশ্রুতি উপস্থাপন করার আহ্বান করছি, যা চ্যালেঞ্জের মাত্রাকে প্রতিফলিত করে। জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় অর্থ প্রক্রিয়াগুলোকে সরলীকরণ করা, দুর্বল দেশগুলোর জন্য অর্থায়নের সুবিধা বৃদ্ধি করা ও অর্থ সমন্বয় করা এবং ক্ষয়ক্ষতির সমান অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা নিশ্চিত করা।
এখন বিশ্ব নেতাদের বিশ্ব নেতৃত্ব দেখানোর সময়। প্রশ্ন থেকে যায়- আমরা কি এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে উঠতে পারব?
লেখক: জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব
দ্য গার্ডিয়ান থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল