কয়েক বছর আগে আমার এক ছাত্র বিসিএস পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফলে সরকারি পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) কর্তৃক সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে আমার বাসায় আসে। ওই সময়ে তার আনন্দের সীমা ছিল না। ওই মুহূর্তটি ছিল তার জীবনের সর্বোচ্চ আনন্দের। একজন ছাত্রের পিএসসি কর্তৃক সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার আনন্দ যে কত বেশি, সেটি প্রতিবছর ফলাফল প্রকাশ হলে নিজের ছাত্রদের দেখলেই বুঝতে পারি। অনেক শিক্ষার্থীই বিসিএস পরীক্ষায় পিএসসির সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়াকেই চূড়ান্ত ফল হিসেবে ধরে নেয়। এমনকি তার পরিবার, আত্মীয়স্বজন সবাই সেটিই মনে করেন।
আমার ওই ছাত্রের বেলাতেও তেমনটিই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় কয়েক মাস পরে প্রজ্ঞাপন প্রকাশ হওয়ার পর আমাকে ফোন করে জানায় যে, প্রজ্ঞাপনে তার রোল নেই। আমি ওই ছাত্রের আনন্দের মুহূর্তটি পিএসসি কর্তৃক সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার পর যেভাবে অনুভব করতে পেরেছিলাম আবার দুঃখের মুহূর্তটিও সেভাবেই অনুভব করলাম প্রজ্ঞাপন প্রকাশের পর। প্রজ্ঞাপন থেকে তার নাম বাদ যাওয়ার মূল কারণ কী- তা আজও আমরা কেউ জানতে পারিনি। হয়তো বিষয়টি রাজনৈতিক হতে পারে। আমি ওই ছাত্রকে খুব ভালোভাবে জানি যে, সে কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না।
তাহলে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, তার পরিবারের কেউ কি তাহলে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিল? সেটা হলেও কি একজন সাধারণ শিক্ষার্থী তার মেধা প্রমাণ করার পর প্রজ্ঞাপন থেকে তার নাম বাদ দেওয়া যায়? বিষয়টির যুক্তিতর্ক অনেক দূরে নিয়ে যাওয়া যাবে। কিন্তু আমি সেই যুক্তিতর্কে যেতে চাই না।
একজন মেধাবী ছাত্র দীর্ঘদিন থেকে স্বপ্ন আঁকে, প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মকর্তা বা কর্মচারী হিসেবে সে দেশের সেবা করবে। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন যদি সফলতার চূড়ান্ত শিখরে যাওয়া সত্ত্বেও পূরণ না হয়, তাহলে এর চেয়ে বেদনাদায়ক আর কী হতে পারে!
গত কয়েক দিন থেকে শুনতে পাচ্ছি বিগত কয়েকটি বিসিএস পরীক্ষার ফলাফলে যাদের নাম পিএসসি কর্তৃক সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে এবং যারা চাকরিতে যোগদান করেছেন, তাদের পুনরায় ভেরিফিকেশন করা হবে। বিষয়টি আমার কাছে আশঙ্কাজনক মনে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমার যুক্তি হচ্ছে, কেউ যদি চাকরিবিধি ভঙ্গ করে তাহলে তার শাস্তি অবশ্যই হওয়া উচিত।
বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারীদের জন্য একটি আচরণ বিধিমালা রয়েছে ১৯৭৯ সালের। এটির নাম সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা-১৯৭৯। এটি ২০০২ সালে এবং ২০১১ সালে দুই দফায় সংশোধিত হয়েছে। এই আচরণ বিধিমালায় মোট ৩৪টি নির্দেশনা আছে। দেশে বা বিদেশে কারও কাছ থেকে উপহার বা পুরস্কার নেওয়া, যৌতুক দেওয়া-নেওয়া, ব্যক্তিগত ব্যবসা, রাজনীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, নারী সহকর্মীর সঙ্গে অনৈতিক আচরণসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকারি কর্মচারীদের কার্যক্রম কেমন হবে তার নির্দেশনা রয়েছে। শুধু নাগরিকদের সঙ্গে আচরণ বিষয়ে আলাদা কোনো বিধি নেই।
নাগরিকদের সঙ্গে যেকোনো অসদাচরণ শাস্তিযোগ্য হবে, এমন একটি বিধি আছে ২০১৮ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালায়। সেখানে অসদাচরণের সংজ্ঞাও দেওয়া আছে। যেখানে অসদাচরণ বলতে বোঝানো হয়েছে- অসঙ্গত আচরণ, চাকরি-শৃঙ্খলাহানিকর আচরণ কিংবা শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণকে। উল্লিখিত বিধানাবলি অনুযায়ী কোনো সরকারি কর্মচারী বা কর্মকর্তা অপরাধ করলে অবশ্যই তার শাস্তি অনিবার্য হওয়া উচিত।
কিন্তু মেধা প্রমাণ করার পরও যদি রাজনৈতিক কারণে কোনো শিক্ষার্থী চূড়ান্ত প্রজ্ঞাপন তালিকা থেকে নাম বাদ পড়ে সেটির চেয়ে ভয়াবহ কিংবা দুঃখজনক ওই শিক্ষার্থীর জন্য আর কিছু হতে পারে না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দল থাকবে- এমনটি স্বাভাবিক। কিন্তু বিগত সময়ে শুধু রাজনৈতিক কারণে যাদের নাম প্রজ্ঞাপনে তোলা হয়নি, সে বিষয়ে সবারই আপত্তি থাকার কথা। কিংবা ভবিষ্যতেও যদি এমন প্রক্রিয়া চলমান থাকে তবে সেটির প্রভাবও নেতিবাচক হিসেবে ধরা যায়।
আমাদের সমাজে এমন অনেকেই রয়েছেন, যারা বিগত জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে বৈষম্যবিরোধীদের পক্ষে সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকেই পারিবারিকভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের মৌন সমর্থক। হয়তো এ বিষয়টি নতুন করে প্রমাণ করার সুযোগ তারা পাবে না। কিন্তু পরিস্থিতি যদি এমন হয় আন্দোলনে অংশ নিয়েছে কিন্তু পিএসসির কোনো পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও যদি প্রজ্ঞাপন থেকে তার নাম বাদ যায়, তাহলে তার সেই দুঃখ কীভাবে মিটবে?
কয়েকদিন আগে আমার একজন ছাত্র আমার অফিসে এসে তার এমন অসহাত্বের আশঙ্কা নিয়ে আলাপ করছিল। এমনকি সে চাকরির জন্য চেষ্টা না করে কীভাবে বিদেশে পাড়ি জমানো যায়, সেই রাস্তাও খুঁজছে। সে মনে করে, একটি চাকরির পরীক্ষায় যে পরিশ্রম করতে হয়, তার পর যদি চূড়ান্তভাবে কোনো কারণে প্রজ্ঞাপন থেকে নাম বাদ যায় তাহলে তখন যে ধরনের হতাশা তাকে আঁকড়ে ধরবে সেখান থেকে সহজে বের হওয়া সম্ভব হবে না।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে দেশের মেধাবী তরুণরা, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আবার বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারেও তরুণদের অংশগ্রহণ রয়েছে। অন্যদিকে দেশের অসংখ্য মেধাবী তরুণ বেকার রয়েছে। এর আগে আমরা তরুণদের নিয়ে বিভিন্ন লেখালেখি, সেমিনার এবং আলোচনায় অনেক প্রত্যাশার কথা ব্যক্ত করেছি। এখন তরুণদের হাতেই রাষ্ট্রের চালিকা-চাবি।
দেশের মেধাবীরা বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এ বিষয়ে নানা ধরনের বিশ্লেষণ, হিসাব-নিকাশ, আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। তরুণদের নেতৃত্বে পরিচালিত দেশের যে সংস্কার কাঠামো আমরা পেতে যাচ্ছি সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণদের কাছে কর্মসংস্থান এবং তৎসংশ্লিষ্ট নিরপেক্ষতার প্রসঙ্গটি অত্যন্ত আলোচিত। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কর্মসংস্থান সংকটে বেকারত্বের হার বেড়েছে।
অতিমাত্রায় হতাশ হয়েছে উচ্চশিক্ষিতরা। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণদের অনেকের জীবন বিষাদময় হয়ে উঠেছে। ফলে এই সরকারের পক্ষ থেকে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র কী এবং কেমন থাকছে, সেটি খুঁজে বেড়াচ্ছে তরুণরা। বেকারদের অনেকে পরিশ্রম করে একটি চাকরির জন্য পিএসসি কর্তৃক সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার পরও যদি তার পরিবারের রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড কিংবা কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততার কারণে প্রজ্ঞাপন থেকে নাম বাদ যায়, তাতে শঙ্কা প্রকাশ করার যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়