জলবায়ু বিপর্যয় এড়াতে বিশ্বের আরও জলবায়ু অর্থায়ন প্রয়োজন। আজারবাইজানের বাকুতে জাতিসংঘের জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলন কপ২৯ শুরু হয়েছে। এই সম্মেলনে জলবায়ুর নতুনভাবে অর্থায়নের লক্ষ্যে আজারবাইজানের কপ প্রেসিডেন্সির অগ্রাধিকার অনেক বেশি।
উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের কার্বন নির্গমন মোকাবিলা করতে এবং জলবায়ু হুমকির বিরুদ্ধে স্থিতিস্থাপকতা তৈরি করতে সহায়তা প্রয়োজন। ২০০৯ সালে ১০০ বিলিয়ন ডলার বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, যার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২০২০ সালের মধ্যে পূরণ করা। এটি ছিল অনেক আগের লক্ষ্যমাত্রা এবং জলবায়ু সংকটের প্রান্তে থাকা দেশগুলোর জন্য যা প্রয়োজন তার থেকে অনেক কম।
এবারের জলবায়ু সম্মেলনে আলোচনার আহ্বায়ক হিসেবে আমরা একটি সুষ্ঠু ও মানসম্মত অর্থায়নের ওপর জোর দিয়েছি। এই সম্মেলনে ১৯৮টি দেশ অংশগ্রহণ করছে। প্রতিটি দেশকেই কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনে ভেটো প্রদানকারীদের সঙ্গে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কোনো কিছুই নিষ্পত্তি হবে না। কিছু দেশ একক অঙ্কের ট্রিলিয়নের জন্য তর্ক করে, কেউ বলে ডাবল ডিজিটের ট্রিলিয়ন এবং অন্যরা শত শত বিলিয়নের জন্য তর্ক করে। জনগণের অর্থ দিয়ে জলবায়ু কতটা মোকাবিলা করা যাবে, তা একটি বড় প্রশ্ন। জলবায়ু মোকাবিলায় বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। অনেক দেশই আর্থিক চাপের সম্মুখীন হচ্ছে। এমন একপর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, আজ দেরি করা মানেই আগামীকাল বড় বিলের নিশ্চয়তা দিতে পারে।
চরম মানবিক, পরিবেশগত এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি রোধ করতে বেশি দেরি না করে আগে নির্গমন হ্রাস অত্যন্ত জরুরি। হারিকেন ও খরার মতো জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাবগুলো মোকাবিলায় দেশগুলোকে শক্তিশালী করে এমন কার্যকর ব্যবস্থাগুলোতে বিনিয়োগ না করলে পবর্তীতে ব্যাপক ক্ষতি হবে। জলবায়ু প্রভাবের কারণে প্রান্তিক দেশগুলোতে যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হবে, সেই দেশগুলোর পুনর্গঠনে তার চেয়ে বহুগুণ খরচ হবে। প্রতিকারের জন্য প্রতিরোধই শ্রেয়, কিন্তু
আমাদের এই গ্রহ দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়েছে।
এই গ্রহের পতন বন্ধ করতে অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
শুধু এ ধরনের তহবিল প্রয়োজনীয় নয়, আরও বেশি দরকার। এ ধরনের তহবিল আগেও করা হয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। কোভিড-১৯-এর সময় বিশ্ব যখন সংকটের সম্মুখীন হয়েছিল, তখন উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো মাত্র ৪৮ মাসের মধ্যে ৮ ট্রিলিয়ন তহবিলের ব্যবস্থা করেছিল। সেই সময়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তা পূরণ করা সম্ভব হয়েছিল। আমাদের অবশ্যই জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিও একইভাবে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা
করতে হবে।
তবে এর দায় সম্পূর্ণভাবে সরকারি তহবিলের ওপর পড়তে পারে না। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে উত্তরণের জন্য বেসরকারি অর্থায়ন চালু করা দীর্ঘদিনের দাবি। বিনিয়োগকারীদের ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, জনগণ প্রতি ১ ডলার থেকে সর্বোচ্চ ৫ বা ৭ ডলার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ১০ ডলার করে অর্থ জোগাড় করা যেতে পারে। কিন্তু জলবায়ু মোকাবিলায় তার বিপরীতটি ঘটে চলছে। ২০২২ সালে উন্নত দেশগুলো জলবায়ু সহায়তার জন্য ৯৪ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। অথচ বেসরকারি খাত থেকে মাত্র ২১.৯ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছিল।
জলবায়ু মোকাবিলায় কত খরচ হতে পারে তার সঠিক ধারণা বা প্রমাণ এখনো নেই। শুধু অনুদান বা রেয়াতি অর্থায়নের মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলোর পরিচ্ছন্ন শক্তির রূপান্তরে অর্থায়নের জন্য বিশ্বে পর্যাপ্ত অর্থ নেই। শুধু জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষয়ক্ষতি ও মোকাবিলার কথা বলা হয়ে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থেকে সুস্পষ্টভাবে বলা যায়, বেসরকারি খাত ছাড়া জলবায়ু সুষ্ঠু কোনো সমাধান নেই।
আন্তর্জাতিক শক্তি সংগঠনের মতে, বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশ বিশ্বব্যাপী পরিচ্ছন্ন শক্তি ব্যয়ের মাত্র ১৫ শতাংশ পায়। পার্থক্য শুধু বেসরকারি খাতে। উন্নত দেশগুলোতে সবুজানয়ন প্রকল্পের ৮০ শতাংশের বেশি অর্থায়ন করে। উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশে তার সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র ১৪ শতাংশ। বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় যখন উন্নত দেশগুলো প্রায় ৬০ শতাংশ কার্বন নির্গমন করে। যদিও উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো এখনো বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনের ৮০ শতাংশের বেশি দূষিত করে। জলবায়ু মোকাবিলায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগ ব্যতীত দেশগুলোর শক্তির চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে কার্বন নির্গমনের অনুপাত পরিবর্তিত হবে এবং আয়তনে আরও বৃদ্ধি পাবে।
পুনর্বীকরণযোগ্য মুনাফা উৎপন্ন করে এমন দেশগুলোতে ব্যক্তিগত অর্থায়ন প্রলুব্ধ করে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত ঝুঁকিগুলো প্রায়ই মূলধনের খরচকে অসহনীয় করে তোলে। যদিও আফ্রিকা বিশ্বের স্বল্প-উন্নত মহাদেশ, যেখানে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত মহাদেশ ইউরোপের চেয়ে বেশি খরচ হয়। তাহলে কেন একজন বিনিয়োগকারী আফিকা মহাদেশের মতো অনুন্নত দেশগুলোতে বিনিয়োগ করবেন? বিনিয়োগের ক্ষেত্রকে যথার্থ করে তোলার জন্য আমাদের তীক্ষ্ণ হাতিয়ার দরকার, যেমন- অর্থ প্রদান না করা, চুক্তি লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে গ্যারান্টি বা মুদ্রার অস্থিরতার মতো সামষ্টিক অর্থনৈতিক ঝুঁকি।
এই উপায়ে বেসরকারি খাতকে বিনিয়োগে উৎসাহী করতে আমাদের অবশ্যই আরও বেশি জনসাধারণের অর্থকে লক্ষ্য করতে হবে। এটি শুধু উন্নয়নশীল বিশ্বের পরিবর্তনে অর্থায়নের জন্য নয়, জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতি ও ক্ষয়পূরণের জন্য জনগণের তহবিল খালি করার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমরা কীভাবে ক্ষয়ক্ষতি এবং ক্ষতি পূরণে অর্থায়ন করি, সেই সঙ্গে জলবায়ু সংকটকে আরও ভালোভাবে মোকাবিলা করার জন্য আন্তর্জাতিক আর্থিক স্থাপত্যের সংস্কার সম্পর্কে কপ২৯-এ মানসম্মত আলোচনা হতে বাধ্য। তবে নিশ্চিত যে, জলবায়ু মোকাবিলায় বিশ্বের আরও তহবিল প্রয়োজন এবং দ্রুতই তা প্রয়োজন। ইতিহাস বলে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আমরা দরকারি তহবিল সংগ্রহ করি, এটা এখন অনেকটাই রাজনৈতিক ইচ্ছার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
লেখক: সভাপতি, জাতিসংঘের কপ২৯ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন
দ্য গার্ডিয়ান থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল