ঢাকা ৭ ফাল্গুন ১৪৩১, বৃহস্পতিবার, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
English
বৃহস্পতিবার, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৭ ফাল্গুন ১৪৩১

সংকটে সবাইকে একত্রিত করা ভালো অগ্রগতি: ড. দিলারা চৌধুরী

প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৪২ পিএম
আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৫০ পিএম
সংকটে সবাইকে একত্রিত করা ভালো অগ্রগতি: ড. দিলারা চৌধুরী
ড. দিলারা চৌধুরী

আমি মনে করি, এটা একটা ইতিবাচক বিষয়। একটা ভূমিকা প্রধান উপদেষ্টা নিয়েছেন। ছাত্রদের সঙ্গে বসেছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসেছেন। এই সংকটে সবাইকে একত্রিত করা হয়েছে। এটা অত্যন্ত ভালো অগ্রগতি।

ভারতের বিষয়ে আমাদের এখন কথা বলতে হবে। আমরা আমাদের নাগরিককে গ্রেপ্তার করতে পারব না? চিন্ময় তো বাংলাদেশের নাগরিক। তার জন্য এ রকম করবে? তাহলে আমাদের স্বাধীনতা আছে নাকি। আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। ঐকমত্যে সবাইকে নিয়ে আসছেন, আমি খুবই খুশি। জনগণও খুশি হবে। আমাদের দেশের ওপর হুমকি এসেছে, আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে ড. ইউনূসকে সমর্থন দেব। এর বাইরে যে কথা বলবে সে দেশদ্রোহী।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সাবেক অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

বিশেষ সাক্ষাৎকার: ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এবারের বাজেট আকারে ছোট হবে

প্রকাশ: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:৪০ এএম
আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:৪২ এএম
এবারের বাজেট আকারে ছোট হবে
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা। তিনি ২০২৪ সালের ৯ আগস্ট অর্থ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হন। পরবর্তীতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পান। ১৯৭০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। এ ছাড়া তিনি এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কেন্দ্র (সিরডাপ)-এর গবেষণাপ্রধান হিসেবে কাজ করেন। তিনি বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড)-এর মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন। জাতীয় অর্থনীতির বিভিন্ন সমস্যা ও সম্ভাবনা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, রাজস্বনীতি, মানবসম্পদ উন্নয়ন, তুলনামূলক উন্নয়ন অভিজ্ঞতাসহ অর্থনীতির নানা বিষয়ে কথা বলেছেন খবরের কাগজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খবরের কাগজ-এর সম্পাদক মোস্তফা কামাল

খবরের কাগজ: অনুকূল পরিবেশ না থাকায় দেশের ব্যবসায়ীরা বেশ হতাশা প্রকাশ করেছেন। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে একটা বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, বড় বড় ব্যবসায়ীরা টাকা-পয়সা ব্যাংক থেকে নিয়েছেন। ব্যাংকে পর্যাপ্ত তারল্য সংকট। যে কারণে ব্যাংক আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। ব্যবসায়ীদের মধ্যে ৬ থেকে ৭ শতাংশ ঋণখেলাপি। গরপরতা যদি ১৬ শতাংশ বলি, কিছু কিছু ব্যাংক বলে ৪০-৫০ শতাংশ। ৪ থেকে ৫ শতাংশের বেশি ভালো ব্যাংক নেই। ব্যবসায়ীরা ঋণ সুবিধা  পাচ্ছে না। এটা একটা সমস্যা। যদিও আমরা ২২ হাজার কোটি টাকা আগে দিয়েছি কয়েকটা ব্যাংককে। মানুষের ডিপোজিটের টাকা পরিশোধের জন্য এটি দেওয়া হয়েছে। এখানে চেকের প্রক্রিয়াটি বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে যায়। আমরা যা দিয়েছি তা পর্যাপ্ত নয়। ২২ হাজার কোটি টাকা বেশি নয়। আমাদের দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। ব্যবসায়ীরা সময়মতো ঋণ পাচ্ছে না। সবেচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানগুলো। এমনিতে তারা ঋণ কম পায়। আগে তাও সম্ভব ছিল না। দ্বিতীয়ত, দেশে ব্যবসায়ীরা ভয়ে কিছু করতে চাচ্ছে না। তারা দেখছে চোখের সামনে ব্যবসায়ীরা পালিয়ে গেছে। ওরা ভাবছে, এখন ব্যবসায় ঢুকলে আমাকে মনিটর করবে ব্যাংক। এরকমও হয়েছে- নরসিংদীর এক লোক আড়াই হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে। তাকে কেউ চেনেও না। এখন এগুলো করা সম্ভব নয়। ব্যবসায়ীরাও জানে আমাদের ঋণ দেবে ব্যাংক, তাহলে এজেন্সিরা আমাদের তদারকি করবে। এনবিআর টাকা আদায়ে পদক্ষেপ নেবে। আগে আর্থিক লেনদেনগুলো ছিল অনেকটাই অস্বচ্ছ। এজন্য বন্ধ থাকত অনেক কিছু। তবু আমরা বলছি, এসব বিষয়ে চিন্তা করার দরকার নেই।

ভালো ব্যবসায়ীরা সব সময় ভালো ব্যবসা করে। একটু সময় লাগবে। ওরাও এক সময় এলসি প্রক্রিয়ার মধ্যে আসবে। অনেক শিল্পকারখানা নষ্ট হয়ে গেছে জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময়। এরপরও বলব, ব্যবসায় কিছুটা উন্নতি হয়েছে। আমদানি কিছুটা বেড়েছে। মেশিনারি আমদানি তেমন হয়নি। তবে সর্বপরি আমদানি কিছুটা ভালো হয়েছে। এ ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করতে হবে।

খবরের কাগজ: বর্তমানে দেশে আমদানি-রপ্তানি পরিস্থিতি কেমন?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: যদিও অনেকে বলেছে, রপ্তানি খারাপ। আসলে তা নয়। এটি অনেক ভালো অবস্থানে আছে। ছোট ছোট জায়গায় তারা সাব-কনট্রাক্ট করে। বাংলাদেশে শুধু আরএমজিতে গ্রিন ফ্যাক্টরি অনেক। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ বড় চ্যালেঞ্জ। প্রধান ইস্যু হলো ব্যবসায়ের পরিবেশ, দেশের রাজনৈতিক অবস্থা কেমন, নিয়ন্ত্রণ সংস্থার পলিসিগুলো কেমন। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের আগে এসব পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে। মাঝখানে এয়ারলাইন্সের কিছু ঝামেলা হলো। টাকা-পয়সা নিতে পারেনি। এয়ারলাইন্স যদি লাভ করে তবে বাংলাদেশ ব্যাংক অডিট বোর্ড দেখে রিলিজ করে। গ্রামীণ ফোনের টাকা অনেকদিন ধরে পাঠাতে পারে না। সেভরনের টাকারও একই অবস্থা। তার পর মেটলাইফ আছে। তারাও বলছে একই কথা। তবে নিয়ম আছে, অ্যালাউ বা গ্রহণ করতে হবে। নিষেধ করা যাবে না। বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা যাতে বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ পায়, কোনো ধরনের ঝক্কি-ঝামেলায় না পড়ে, সে জন্য সরকার কাজ করে যাচ্ছে। নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলো যেন আরও বন্ধুসুলভ হয়। আবার কাস্টমসের ব্যাপার আছে। আয়কর ও শুল্কে তথ্য দিতে ভুল হলে সময়ক্ষেপণ হয়। যা ব্যবসায়ীরা পছন্দ করেন না। পোর্টে আগে ছিল এ ধরনের সমস্যা। এখন এটা ঠিক হয়েছে। এখন একদিন বা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কাস্টমসে চালান জমা দেওয়া হয়ে যাচ্ছে। আমরা একটা ন্যাশনাল উইনডো চালু করেছি। অর্থাৎ, সব তথ্য অনলাইনে দেওয়ার পর এনবিআর তা যাচাই-বাছাই করবে। চালান জমা, কপি দেওয়া, এগুলোতে  দীর্ঘ সময় লাগে। এটা করলে কিছুটা সময় লাঘব হবে। এটা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ। প্রাইভেট সেক্টরের জন্য বাইরে থেকেও চেষ্টা করছি। ওপেক ফান্ডে আমি কথা বলেছি, তারা ১০০ মিলিয়ন দেবে। কোন কোন শিল্পকারখানায় অর্থ দেওয়া হবে তা তারা নির্ধারণ করবে। প্রাইভেট সেক্টরে কোন কোন ব্যাংককে দেবে সেটিও তারা নির্ধারণ করে থাকে। তাদের কয়েকটা ব্যাংক নির্ধারণ করা আছে। এর বাইরে তারা যাবে না। এ ক্ষেত্রে তাদের বেশকিছু বিষয় রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কথা বলেছি- একটা গ্যারান্টি দেবে ১ বিলিয়ন ডলার। সেটাও আবার প্রাইভেট ব্যাংক। ব্যাংক এলসি করবে এবং গ্যারান্টি দেবে। এতে বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান লাভবান হবে।

খবরের কাগজ: তরুণ সমাজের একটা বড় অংশ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছে। আপনি জানেন, বেকারদের একটা বড় অংশ এখানে ব্যবসা করছে। শেয়ারবাজারে বিদ্যমান অস্থিরতা দূর করার উপায় কী?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো শেয়ারবাজার এখন নাজুক পরিস্থিতিতে আছে। এখানে বেশির ভাগ যারা বিনিয়োগ করেছে, তারা প্রতিদিন সেক্রেটারি কমিশনের চেয়ারম্যানের পদত্যাগ চায়। সমস্যা এখানে সেক্রেটারি কমিশনের চেয়ারম্যানের নয়। সমস্যা হলো পুঁজি মার্কেটে ফ্লোর কাস্ট দিয়েছে। ফ্লোর প্রাইজ আছে। নামলে হয়তো অর্ধেক চলে যাবে। আর জেড ক্যাটাগরির শেয়ারগুলোর এজিএমও হয় না। আগে খুব বিক্রয় হতো, এখন ফ্যাক্টরিই নেই। এখন চেয়ারম্যান আসার পর জেড ক্যাটাগরির শেয়ার কেউ কেনেও না, রিটার্নও দেয় না। সবাই শেয়ার কেনে না। প্রফিটেবল কোম্পানির শেয়ার সবাই কেনে না। এটা ব্লশিপ শেয়ার। আমরা চেষ্টা করছি, শেয়ার মার্কেটের উন্নতির জন্য। সাকিবের মতো লোক, তাকে ৪০ লাখ টাকা জরিমানা করল। তিনি কি জানতেন শেয়ার মার্কেটে ঝামেলা হয়। নিয়াজ মোরশেদেরও কোটি কোটি টাকা। তাকেও তো ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। 

খবরের কাগজ: এবারের বাজেট কেমন হবে?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: এবার আমরা একটা রিভাইজ বাজেট করছি। বৈদেশিক বিনিময় বাড়াতে এক্সপোর্ট ডাইভারসিটি করতে চেষ্টা করব। এখন তৈরি পোশাক রপ্তানি হচ্ছে। এটির ওপর নির্ভর করা ঠিক না। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো জ্বালানি প্রণোদনা। এ ক্ষেত্রে অনেক ভর্তুকি দিতে হবে। এবার ৪০ হাজার কোটি টাকা দিতে হয়েছে। পেট্রোল, কৃষিতে সার- এর জন্য ভর্তুকি দিতে হয়। সার যে দামে কেনা হয়, সে দামে কৃষক পায় না। তার থেকে অনেক কমে পায়। বাজেট খুব বড় হবে তা নয়। সেখানে কিছুটা কৃচ্ছ্রসাধন হবে। তবে পরিচালন ব্যয় কমানো যাবে না। আমরা বেতন-ভাতা দিই, ঋণের সুদহার আছে। এগুলো কমানো যাবে না। সে কারণে বাজেট কিছুটা ছোট করব। বড় বড় মেগা প্রকল্প হবে না। এ ক্ষেত্রে দেশি ও আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠীর অর্থ প্রয়োজন হয়। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো আমাদের বাজেটে সম্পদ নেই। জিডিপি ট্যাক্সে ৭ দশমিক ৭ শতাংশ আছে। ভুটানে ১২%, জাপানে ২১ থেকে ২২%। আবার ফিনল্যান্ডে ৫০% ট্যাক্স হিসেবে দিয়ে দেয়। এর সুবিধা স্যোশাল বেনিফিট। উন্নত দেশগুলোতে ট্যাক্সের টাকায় তাদের প্রচুর সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। যেমন বৃদ্ধ বয়সে ওষুধ-হাসপাতাল অর্থাৎ ফ্রি স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়। যদিও তাদের দেশে ট্যাক্সের  পরিমাণ বেশি। আমাদের দেশে এ পর্যায়ে আসতে সময় লাগবে। কারণ আমাদের দেশে রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রগুলো এখনো বিস্তৃত নয়। কী পরিমাণ ট্যাক্স আদায় হলো তার সঠিক পরিসংখ্যানও উঠে আসে না।   

অনলাইন করাতে ট্যাক্সের বিষয়গুলো বুঝতে অনেকের অসুবিধা হচ্ছে। এ কারণে সময় বাড়াতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক স্টেটমেন্ট সময়ের পরে হলেও মেনে নিতে হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, পুরো প্রক্রিয়াটি শেষ করতে সময় বৃদ্ধি প্রয়োজন। ট্যাক্স আইনজীবীদের মতে, এখনো তারা অনেককিছু করতে পারেনি। ইতোমধ্যে ১২ লাখ লোক অনলাইনে রিটার্ন জমা দিয়েছে। গতবারের চেয়ে এবার অনেক বেশি। এটি আরেকটু বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ১২ লাখ খারাপ নয়। কোম্পানির জন্য অনলাইনে রিটার্ন জমা এখনো  বাধ্যতামূলক করিনি। কোম্পানিগুলোকে অনেক তথ্য দিতে হয়। তাদের বিভিন্ন লাইসেন্স দিতে হয়, না হলে ট্যাক্সের নাম নির্ধারণ করা যায় না। অতএব, এটা একটা বড় মোবিলাইজেশন। অতিদ্রুত খরচ কমাতে পারব না। এছাড়া বড় প্রকল্পগুলো অব্যাহত রাখার ব্যাপারে এডিবি, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক রাজি হয়েছে। এখন আমাদের বাজেটের ব্যাপারে নেটটা বাড়ানোর চেষ্টা করছি। আরেকটা বিষয়, বাজেট যেন বাস্তবধর্মী হয়। কিছু বড় প্রকল্পের প্রয়োজন রয়েছে। অবকাঠামো উন্নয়ন, বিদ্যুৎ খাত এগুলোতে খরচ করতেই হবে। আবার বৈদ্যুতিক লাইন, কিছু পাইপ লাইন পুরাতন হয়ে গেছে, সেগুলো রিপ্লেস করতে হবে। সবচেয়ে বড় সমস্যা কর্মসংস্থান। কর্মসংস্থানে যদি আয় না থাকে তাহলে মূল্যস্ফীতি  আরও বেশি হবে। গত এক বছরে মালয়েশিয়া, দুবাই, আবুধাবি, কাতার, ওমানে লোক নিচ্ছে না। শুধু সৌদি আরব নিচ্ছে। আর ইতালিতে যাচ্ছে। সেটিও বৈধভাবে হচ্ছে না। জাহাজ দিয়ে, সাঁতার কেটে অবৈধভাবে যাচ্ছে বেশি। ইতালিতে বড় সংখ্যক কর্মী রয়েছে। আমাদের রাজস্ব চাপ বাড়ছে। সে কারণে কৃচ্ছ্রসাধন করতে হবে। কিন্তু সোশ্যাল সেক্টরে এগুলো সম্ভব নয়। এটা অবশ্য দাতারা বলছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক বিষয়গুলো কমাতে পারবে না। আমি যদি স্বাস্থ্য খাতে ২৫ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে দিই তাহলে বাজেটে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু কমালে অনেক হাসপাতাল, অনেক মেডিকেল সেন্টার বন্ধ হয়ে যাবে। একইভাবে শিক্ষায়ও সমস্যা আছে। এরপর আইটিতে সমস্যা রয়েছে।  আগে সরকারের যত টাকা খরচ হয়েছে, এসব টাকা মুষ্টিমেয় কয়েকজনের কাছে চলে গেছে। 

খবরের কাগজ: কর্মসংস্থান বৃদ্ধির লক্ষ্যে আপনার পরিকল্পনা কী?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: আমাদের দেশে তরুণরা স্বউদ্যোগে কাজ করছে। তারা অনেক কষ্ট করছে। আইটি এমন একটি বিষয় যাতে তরুণরা সহজেই আকৃষ্ট হয়। প্রযুক্তির ব্যবসা অন্য ব্যবসার মতো মাটি কাটা বা দোকানদারের মতো না। আসলে এটার জন্য আউট সোর্স করতে হয়। ভারতে অধিক পরিমাণে আউট সোর্সিংয়ের কাজ চলছে। আমি যখন দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য টিকিট কিনি তখন ভারতীয় লোকজন রেসপন্স করে। বাইরের দেশগুলোতে তরুণরা আউট সোর্সিংয়ে যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। তারা বিমান, রেলওয়ের টিকিট অনলাইনে বিক্রি করছে। ভারতীয় তরুণরা এদিক  থেকে অনেক এগিয়ে। কিন্তু আমাদের দেশে এমন সুবিধা খুবই কম। পল্লি এলাকায় এ সেবা পাওয়া খুবই দুরূহ। তবে শহর এলাকায় ছেলেমেয়েরা এ কাজ সহজে করতে পারে ব্রডব্যান্ড, ইন্টারনেট, ওয়াইফাই ব্যবহারের মাধ্যমে। গ্রামে তেমন কোনো শক্তিশালী অবস্থা তৈরি হয়নি। তবুও সরকার গ্রাম এলাকায় বহু টাকা খরচ করছে ব্যান্ডউইথে। তবে খুব একটা সক্ষমতা এখনো অর্জন করতে পারেনি। এটা আমাদের সমস্যা। বাইরে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে আমরা দক্ষ কর্মী পাঠাতে পারি। শ্রীলংকা, পাকিস্তান, ভারত এবং ইন্দোনেশিয়ায়ও দক্ষ লোকবল আছে। কর্মসংস্থানের জন্য সবচেয়ে ভালো হলো ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো। আপনি ছোট একটা টেক্সটাইল মিল করবেন। খরচ হবে ২০০ কোটি টাকা। এখানে ১০০ জনের বেশি জনবল কাজে লাগাতে পারবেন না। কারণ সবাই অটোমেটিকভাবে চলে। কিন্তু এই ২০০ কোটি টাকা যদি ২ কোটি টাকা করে ১০০ জনকে দেন তাহলে ১০ জন করে হলে ১ হাজার হবে। অতএব, তারা মোটামুটি টেকনিকও ব্যবহার করে। ক্ষুদ্র শিল্পপ্রতিষ্ঠানও টেকনিক ব্যবহার করে। এখানে তাদের বৃহৎ কোনো মেশিন নেই। তাদের সুবিধা দিতে পারলে ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো করবে। সেই সঙ্গে কর্মসংস্থানও বাড়বে। আমরা চীন থেকে বিস্কুট আমদানি করি। এখন অনেকটা কমে গেছে। এখানে উৎপাদন হলে বৈদেশিক বিনিময় বাড়বে। এতে অনেকটা সাশ্রয় হবে। কর্মসংস্থানের আরেকটা ব্যাপার আছে, সেটা হলো- যে বড় বড় প্রকল্পগুলো আগে নেওয়া হয়েছিল, সেগুলোতে কর্মসংস্থান ছিল না। এখানে ছিল উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন জনশক্তি। এলিভেটরে যারা কাজ করছে তাদের ক্ষেত্রে জনবল খুবই কম। আমরা শ্রমঘন স্থানীয় কিছু প্রকল্প নিতে চাই। যেমন- স্থানীয় অবকাঠামো উন্নয়ন, স্থানীয় শিল্পকারখানা স্থাপন ইত্যাদি। এজন্য দরকার এডিপিতে ছোট ছোট প্রকল্প যুক্ত করা। এতে স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। ছোট মানে ১ থেকে ২ কোটি টাকা নয়। ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকার প্রকল্প। ৪০ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা এত না। এ ক্ষেত্রে আমাদের এখানে জমি কিনতে যাবেন দেখবেন যে, আরও ৫ জনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। পারবেন না কিনতে। জমির ক্ষেত্রে কোর্টে চলে যায় বছরের পর বছর। এই বিষয়গুলো উন্নতি না করলে হবে না। রাজনৈতিক সরকার থাকলে আরও বেশি। কোন মন্ত্রী এসে কী বলবে, এসে কী পরিবর্তন করবে। এখানে আবার প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছেমতো কাজ হবে। এগুলো বিদেশিরা পছন্দ করে না। তারা সব বিষয় পর্যবেক্ষণ করে। এসব ব্যাপারে আমাদের অনেক দুর্বলতা আছে। 

সবচেয়ে বাইরে ইনফ্লো ফরেন ইস্যু। ওরা যদি টের পেত দুর্নীতি হচ্ছে, ৫ বছরের প্রজেক্ট ১০ বছরে যাচ্ছে, তাহলে সবকিছু বন্ধ হয়ে যেত। এখনো ওরা টাকা-পয়সা দিচ্ছে। বিশ্বব্যাংক এসেছিল, তারা বলে আমরাও টাকা দেব। অতএব, আমরা এটাকে এক জায়গায় নিয়ে আসছি। এখন মোটামুটি একপর্যায়ে আছে। আজকে ডলার ১২০, পরশু ১১৭; এমন ওঠানামা করে। আমাদের অবস্থা এখনো খারাপ। এটা অনেক কারণে হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি আস্থা ফিরিয়ে  আনতে। এ অবস্থা না হলে গ্রাহক ১ লাখ টাকার চেক ওঠাতে পারতেন না। কারণ, অনেক ব্যাংকে টাকা নেই। আমরা মাঝখানে কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে ঠিক করেছি। আমরা যতদিন দায়িত্বে থাকি ততদিন দেশের অর্থনীতির জন্য কিছু কাজ করে যাব। আইন পরিবর্তন করতে পারব না। ব্যাংকিং আইন পরিবর্তন করতে সময় লাগে। পুঁজিবাজারে সময় লাগবে। আমরা কিছু কিছু সংস্কার করব। যেটা- ব্যাংক ঠিক করা, বোর্ডগুলো পরিবর্তন করা, কাস্টমস ডিউটিটা আরও উন্নত করা। এগুলো চলমান থাকবে। এর জন্য ছোট ছোট আইন লাগবে। এটা আমরা করব। নির্বাচন হবে। এই নির্বাচনের আগে আমরা এমন একটা পদচিহৃ রেখে যেতে চাই যাতে আগামীতে যারা ক্ষমতায় আসবেন তারা যেন এভাবে চালিয়ে বা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

খবরের কাগজ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।

সাক্ষাৎকারের প্রথম অংশ পড়ুন:
>> রোজায় পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকবে

রোজায় পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকবে

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:০৭ পিএম
রোজায় পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকবে

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা। তিনি ২০২৪ সালের ৯ আগস্ট অর্থ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হন। পরবর্তী সময়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পান। ১৯৭০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। এ ছাড়া তিনি এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কেন্দ্র (সিরডাপ)-এর গবেষণাপ্রধান হিসেবে কাজ করেন। তিনি বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (বার্ড) মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন। জাতীয় অর্থনীতির বিভিন্ন সমস্যা ও সম্ভাবনা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, রাজস্বনীতি, মানবসম্পদ উন্নয়ন, তুলনামূলক উন্নয়ন অভিজ্ঞতাসহ অর্থনীতির নানা বিষয়ে কথা বলেছেন খবরের কাগজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খবরের কাগজ-এর সম্পাদক মোস্তফা কামাল


রমজানে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি ঠেকাতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সরবরাহব্যবস্থায় জোর দেওয়া হয়েছে। টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড ও ঢাকা-চট্টগ্রাম বিভাগে ট্রাকসেল আবার চালু করা হয়েছে। এই সেবা সাময়িক বন্ধ করে দিয়েছিলাম। তখন দরকার ছিল না। কৃষি মন্ত্রণালয়কে বললাম, অর্থ দিয়ে তোমরা এটা চালু করো। তারা আবার শুরু করেছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় ভর্তুকি মূল্যে চাল বিক্রয় করবে। সব জায়গায় নয়। যেমন- আমরা চিন্তা করছি, কিছু কিছু জায়গায় বিশেষ করে যেসব জায়গায় জেলেরা আছে, চট্টগ্রামে ওদের কার্ড আছে, ওদের চাল কিছুটা বাড়ানোর জন্য চিন্তাভাবনা করছি। সরকারের পক্ষ থেকে যত পণ্য আমদানি করা হচ্ছে যেমন- চাল, গম, মসুর ডাল, খেজুর- এগুলো থেকে শুল্ক তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে কিছু কিছু পণ্যের দাম কমে গেছে। এতে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এটা আরেকটা চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। নিত্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ভারত আমাদের বড় উৎস। বেনাপোল আবার বন্ধ করে দিল, ওটা ছিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এখন পাকিস্তান থেকেও চাল আসছে। আবার আমরা ভিয়েতনাম থেকেও আনছি। গম এখন রাশিয়া, ইউক্রেন থেকে আনছি। অতএব, আমরা আশা করছি, রোজার সময় তেমন কোনো সমস্যা হবে না।…


খবরের কাগজ: অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ৬ মাস পূর্ণ করেছে। অর্থ উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর আপনাকে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আপনি কতটা সফল হয়েছেন বলে মনে করছেন?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: অর্থনীতির দিকটা চ্যালেঞ্জিং। বিশেষ করে ব্যাংকিং সেক্টর, এনবিআরসহ পুরো আর্থিক খাত অর্থাৎ যাকে আমরা বলি পুঁজিবাজার- এগুলোর অবস্থা একদমই নাজুক। প্রথমত, গত সরকারের দুর্নীতি ও দুঃশাসনই এর জন্য দায়ী। এরপর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও প্রাইভেট ব্যাংকে বড় ধরনের ডিফল্ট লোন, অর্থ পাচার, দুর্নীতি এগুলোও ঘটেছে। পুঁজিবাজারেও একই অবস্থা। পুঁজিবাজারে বড় বড় সংস্থাগুলো শেয়ার কারসাজি করে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান সরকারি বিনিয়োগ সংস্থা ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) ফান্ড থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। অন্যদিকে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার এলসি খোলার পর তা পরিশোধ করেননি। অর্থাৎ সবমিলে বিশাল অঙ্কের টাকা তিনি ব্যাংকগুলোকে ফেরত দেননি। একটা ব্যাংক থেকে ৮০ শতাংশ টাকা একটি লোক একদিনে তুলে নিয়ে গেছে। এগুলো সাধারণ মানুষের আমানতের টাকা। 

আমরা যখন অন্তর্বর্তী সরকারে আসি তখন দেশের আর্থিক অবস্থা একেবারেই খারাপ ছিল। আমাদের একটা বড় রকমের চ্যালেঞ্জ ছিল অর্থনীতির এই ভঙ্গুর অবস্থাকে স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে কতকগুলো অ্যাকশন নিয়ে কিছু ব্যাংকের হিসাব বন্ধ করে দিই। আর্থিক খাতে মোটামুটি একটা শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। এখনো কিছু সমস্যা রয়ে গেছে, তবে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। সরকারি ব্যাংকগুলোর সব ব্যবস্থাপনা পরিবর্তন করে দিয়েছি। পণ্য খালাসের ক্ষেত্রে শুল্কবিষয়ক ও পোর্টের সমস্যাগুলো সহজ করে দিয়েছি। সবমিলে আর্থিকভাবে আমাদের অনেক খারাপ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। গত ২৭-২৮ বছরে এমন আর্থিক দুরাবস্থা দেখা যায়নি। বিগত সরকারের আমলে বলা হয়েছে- বাংলাদেশে উন্নতি হচ্ছে, প্রবৃদ্ধি বেশি- এগুলো সত্য ছিল না। ব্যাংকে ডিপোজিট নেই, খেলাপি ঋণ আড়াই লাখ কোটি টাকা। আমি যখন বাংলাদেশ ব্যাংক ছেড়ে আসি তখন খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ৩৮ হাজার কোটি টাকা, এখন আড়াই লাখ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। এখন ব্যাংকে ১ লাখ টাকার চেক দিলে বলে ১০ হাজার টাকা নিয়ে যেতে। ব্যাংকে টাকা নেই। অতএব, আমাদের এখন প্রধান লক্ষ ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট সমাধান করা। আশার আলো হলো, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরে আসছে। পুরোটা ফিরে আসছে, সেটা বলব না। মোটামুটি চলে আসছে। অন্যদিকে বাইরের যারা দাতা অর্থাৎ বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, ইসলামী ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক- ওদের সঙ্গে আমাদের কথাবার্তা হচ্ছে। এডিবি ডিসেম্বর মাসে ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দিয়েছে। জুনে আরও ৫০০ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার কথা। আমাদের প্রথম কাজ ছিল ঋণের ব্যবস্থা করা, আমরা সে ব্যবস্থা করেছি। 

বিগত সরকার মেগা প্রকল্পের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এসব প্রকল্পে বড় ধরনের দুর্নীতিও হয়েছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে এত টাকা কেন খরচ হলো, পদ্মা রেল লিংক প্রকল্পে এত টাকা কেন খরচ হলো- সেগুলো পরের প্রশ্ন। প্রথম কাজ হচ্ছে এই ঋণগুলো এখন আমাদের পরিশোধ করতে হবে। ঋণদাতা সংস্থাগুলোকে আমরা আশ্বস্ত করেছি। আমরা বলেছি, সব ঋণ পরিশোধ করব। বাংলাদেশ কখনো ঋণখেলাপি হয়নি। সবচেয়ে বড় যে সমস্যা সেটা হলো- এগুলো ডিজিটালাইজেশন করা হয়নি। ওরা বহুদিন ধরে বলে আসছে জনবলের অভাব। আগের চেয়ারম্যানকে আমি বলেছিলাম, জনবল নেওয়া যাবে না, ডিজিটালাইজড করতে হবে। কাস্টমস কিছুটা করেছে। ইনকাম ট্যাক্সও করেছে। অনলাইনে ১২ লাখের বেশি রিটার্ন জমা হয়েছে। করদাতারা এবার থেকে অনলাইনে ট্যাক্স রিটার্ন দিতে পারছে। কোম্পানি করদাতাকে অনলাইনে রিটার্নে আনা যায়নি, কারণ প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল। সেদিক দিয়ে আমরা বলতে পারি, অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আসছে। চ্যালেঞ্জগুলো যে আমরা সবটা নিতে পেরেছি, তা নয়।

 প্রথম চ্যালেঞ্জটা ছিল মূল্যস্ফীতি কমানো, সেটা এখনো আছে। তবে কিছুটা কমেছে। প্রধান সমস্যা সরবরাহজনিত। সরবরাহ যদি আমরা স্বাভাবিক করতে পারি, সে ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি আরও কমে আসবে। আমরা একটি বিষয় নিশ্চিত করেছি- সেটা হলো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, যেমন- চাল, ডালের শুল্ককর কমিয়ে দিয়েছি। আর রোজার সময় অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্য যেমন- খেজুর, মসুর ডাল আমদানির জন্য এসব পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক কমানো হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো- বাজার এখনো স্থিতিশীল হয়নি। যেমন দেখবেন- বাজারে আছে, কিন্তু আপনি পাচ্ছেন না। তারা বলছে এক বছরেও তারা আর পাবে না। 

খবরের কাগজ: সিন্ডিকেট নিয়ে অনেক কথাবার্তা, লেখালেখি হয়েছে। আপনি নিজেও বলেছেন, সিন্ডিকেট ভাঙা যাচ্ছে না...

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: আমি কথা বলেছি, অনেকে বলছে সিন্ডিকেট ভাঙছে কি না? সিন্ডিকেটের তো কোনো অফিস নেই। সিন্ডিকেট হচ্ছে চেইন অব পিপলস। হয়তো একজন বেশি নিয়ন্ত্রণ করে, একজন আমদানি করে কারওয়ান বাজারে নিয়ে আসে, তারাও সিন্ডিকেটের অংশ। এমনকি খুচরা দোকানদাররাও সিন্ডিকেটের অংশ। আপনি জানবেন না তারা কোন দোকানে পণ্য লুকিয়ে রেখেছে। অতএব, ভোক্তাধিকার আইনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। একটা টাস্কফোর্স করা হয়েছে। ভোক্তা অধিকারের লোকজন বাজারে যায়, জরিমানা করে। 

এতে যে বাজারে দ্রব্যমূল্য পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে, তা নয়। আপনি দেখবেন বাজারে এখন লোকজন সবজির ক্ষেত্রে দামে কিছুটা সাশ্রয় পাচ্ছে, আবার এপ্রিলের দিকে দাম বেড়ে যাবে। আমরা চেষ্টা করছি কীভাবে এগুলো একটা নিয়মের মধ্যে আনা যায়। সবাই খারাপ নয়, কিছু ভালো লোক আছে বাজারে। ট্রাকে পণ্য আনার ক্ষেত্রে মাঝ পথে চাঁদাবাজরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। ব্রিজের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে চাঁদা তুলছে। এদের আমরা চাঁদাবাজ বলি। পণ্য লোড-আনলোডের ক্ষেত্রেও একটা সিন্ডিকেট আছে। এ ছাড়া আছে পাইকারি ব্যবসায়ীদের কারসাজি। সেখানেও অনেক চ্যালেঞ্জ আছে মূল্যস্ফীতিটা নিয়ন্ত্রণে আনার ক্ষেত্রে। কাজেই সিন্ডিকেট ভাঙা অত সহজ ব্যাপার নয়।

খবরের কাগজ: রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি রোধে কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: রমজানে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি ঠেকাতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সরবরাহ ব্যবস্থায় জোর দেওয়া হয়েছে। টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড ও ঢাকা-চট্টগ্রাম বিভাগে ট্রাকসেল আবার চালু করা হয়েছে। এই সেবা সাময়িক বন্ধ করে দিয়েছিলাম। তখন দরকার ছিল না। কৃষি মন্ত্রণালয়কে বললাম, অর্থ দিয়ে তোমরা এটা চালু করো। তারা আবার শুরু করেছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় ভর্তুকিমূল্যে চাল বিক্রয় করবে। সব জায়গায় নয়। যেমন- আমরা চিন্তা করছি, কিছু কিছু জায়গায় বিশেষ করে যেসব জায়গায় জেলেরা আছে, চট্টগ্রামে ওদের কার্ড আছে, ওদের চাল কিছুটা বাড়ানোর জন্য চিন্তাভাবনা করছি। সরকারের পক্ষ থেকে যত পণ্য আমদানি করা হচ্ছে যেমন- চাল, গম, মসুর ডাল, খেজুর, এগুলো থেকে শুল্ক তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে কিছু কিছু পণ্যের দাম কমে গেছে। এতে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এটা আরেকটা চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। 

নিত্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ভারত আমাদের বড় উৎস। বেনাপোল আবার বন্ধ করে দিল, ওটা ছিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এখন পাকিস্তান থেকেও চাল আসছে। আবার আমরা ভিয়েতনাম থেকেও আনছি। গম এখন রাশিয়া, ইউক্রেন থেকে আনছি। অতএব, আমরা আশা করছি, রোজার সময় তেমন কোনো সমস্যা হবে না। বাজার মনিটরিং করতে হবে। জেলা প্রশাসকদের ইতোমধ্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসকদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা আছে। ভোক্তা অধিকারের যারা ম্যাজিস্ট্রেট আছেন, তাদের এ ক্ষমতা দেওয়া আছে। আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ হলো ফরেন এক্সচেঞ্জ। আপনি জানেন রিজার্ভটা আগে কমে গিয়েছিল, এখন বেড়ে রিজার্ভটা ২৫ বিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। এটা ঠিক আছে। আর আমদানির ক্ষেত্রে বকেয়া (আউটস্টান্ডিং) ছিল ৪.৫ বিলিয়ন ডলার। এটা এখন ৪ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। এর জন্য রিজার্ভ থেকে এক টাকাও নেওয়া হয়নি।

খবরের কাগজ: রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে কি না...
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের একটা মূল্য নির্ধারণ করেছে। ব্যাংকারদের বলা হয়েছে- আমরা দেব না, তোমরা বাজার থেকে ডলার সংগ্রহ করো। যেহেতু রেমিট্যান্সের প্রবাহ একটু ভালো। তবে তাদের চাপ বেড়েছে। গতবার খাদ্যদ্রব্য আমদানি করা হয়নি। এবার ৯ মিলিয়ন ডলারের চাল আনতে হবে। ইতোমধ্যে রিজার্ভ কিছুটা বেড়েছে। আমি প্রাইভেট ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলেছি কয়েকদিন আগে। প্রাইভেট ব্যাংকাররা রাজি হয়েছে। মোটামুটি ৬ থেকে ৭টা প্রাইভেট ব্যাংক আছে ভালো। ইসলামী ব্যাংক সবচেয়ে ভালো ছিল। এখন তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে অল্প দিন হলো। প্রাইভেট ব্যাংগুলোর মধ্যে তারা সবচেয়ে বড় ব্যাংক ছিল। বাকি ব্যাংকগুলোর সঙ্গেও কথা বলেছি। ওরা প্রোভাইড করবে, সেখানে আমার গ্যারান্টি দিতে হবে, সেটা আমি দেব। শর্ত হলো- ওরা শুধু ফাইন্যান্স করবে এলসিতে। এস্টেট অপারেশন প্রাইভেটদের জন্য নয়। এলসি কিছুটা সহজ হয়েছে, একেবারে যে সহজ হয়েছে, তা নয়। 

রাশিয়ানরা একদিক দিয়ে ভালো- এরা হইচই করে না, টাকা না পেলেও। ওরা মাঝে মাঝে অনুরোধ করে টাকা দেওয়ার ক্ষেত্রে। রাশিয়া স্টেট অন এন্টার প্রাইজ, এরা প্রাইভেট। এরা সরকারের কথা শোনে না। ফরেন এক্সেঞ্জের রিজার্ভ কিছু ভালো হয়েছে, আর রেমিট্যান্সও ভালো অবস্থানে আছে। গত মাসে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। এখন এ খাতে ২ বিলিয়ন ডলারের চেয়ে বেশি আসে। মোটামুটি যে রেটটা আছে, এটা থাকবে। আমাদের লোকজনের মধ্যে আস্থা আসছে। 

খবরের কাগজ: হুন্ডির পরিবর্তে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে টাকা পাঠানো কি বেড়েছে?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: এখন হুন্ডি কমে গেছে। এখানে ম্যানিপুলেটরা আছে। তবে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে টাকা পাঠানো বেড়েছে। 

খবরের কাগজ: ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন শিল্পকারখানা চালু করা যাচ্ছে না, এ সম্পর্কে কিছু বলুন।

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ হলো- এনার্জি প্রাইজটা। গ্যাসের স্বল্পতা, শিল্পগুলো সব চালু করা যাচ্ছে না। গ্যাসের ঘাটতি আছে। এজন্য পাচ্ছে না। এলপিজি আনতে হয়, আবার পেট্রল, ফার্নেস অয়েল আনতে হয়- এগুলোর ক্ষেত্রে বিরাট চাপ পড়ছে আমাদের। এপ্রিল-মের দিকে বেশি চাপ পড়বে। কারণ, গরম এলে এসি চলবে, ইলেকট্রিক সরঞ্জাম বেশি চলবে। আসলে গরমের সময় কনজামশনটা একটু বেশি আসে। শীতের সময় একটু কম। আমরা চেষ্টা করছি কী করা যায়। আবার হুট করে দাম বাড়ানোও যাচ্ছে না। বাড়ালে শিল্পে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। বিরাট সাবসিডি দিতে হয় সরকারকে। এ খাতে ৬২ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। ওদের সঙ্গে বহু মিটিং আমি করেছি যখন বাণিজ্য উপদেষ্টার দায়িত্বে ছিলাম। বড় বড় ইম্পোর্টার আছে কেডিএস, সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ- এরাই বড় শিল্পগোষ্ঠী। ব্যবসায়ীরা তাদের শুধু মুনাফা বোঝে। আমাদের দেশে ব্যবসাটা অন্য দেশের মতো এত কমপিটেটিভ না। আপনি দেখবেন একজন ব্যবসায়ী ১০ বছর আগে এক সময় আপনার সঙ্গে রিকশায় চড়ত, এখন সে মার্সিটিজ গাড়িতে চড়ে।

অপর দিকে লেভেল প্লেইং ফিল্ড থাকে না, তখন ভালো ব্যাবসায়ীরাও মার খেয়ে যাচ্ছে। এখানে রাজনৈতিক ব্যাপার। আমরা এখনো এত কঠোর হতে পারিনি। পুলিশ দিয়ে রিটেইলারদের ধরে নিয়ে আসো। আগের পলিটিক্যাল গভর্নমেন্ট এগুলো করত। অনেক সময় কাকে কোন শাস্তি দিতে হয়, বাইরের লোক কিছুই জানত না। এগুলো আমরা ব্যবহার করছি না। তারা এখনো সক্রিয়। বিভিন্নভাবে তারা এখনো মেনুপুলেট করে। অতএব, এদের ধরার জন্য আমরা মনিটর করছি। আর সিন্ডিকেট একেবারে নিশ্চিহ্ন করা যাবে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ৬ থেকে ৭টা মেজর ইমপোর্টার বাংলাদেশে। আপনি যদি সয়াবিন আনতে চান, ব্রাজিল থেকে একটা বিরাট জাহাজ আসবে। এলসি করতে হবে ৫০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকা। এখন যদি মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ীদের বলেন সয়াবিন আনতে, তারা ১০টা কনটেইনারও আনতে পারবে না। কারণ ওদের দেবেও না। তাদের একটি মাত্র কনটেইনার আনার সক্ষমতা রয়েছে।

 এখানে ন্যাচারাল মনোপলি হয়ে যায় কমোডিটি ব্যবসায়। চাল যেমন ৫০ হাজার টনের কমে কেউ দেবে না। ১৫০ টনের ডিও লেটার নেবে, পরে সে আরেকজনের কাছে তা বিক্রি করে দেবে। এটা একটা বিষয়। এটাকে রোধ করা যাচ্ছে না। এটা ডিফিকাল্ট। পলিটিক্যাল গভর্নমেন্ট থাকলে সুবিধা হয়, তাদের  অনেক কর্মী আছে। নেতারা যখন বলে এটা কর, ওটা দেখ- ওরা ঘোরাঘুরি করলে বাজারে কিছুটা সুবিধা পাওয়া যায়। বিনা পয়সায় করে না কেউ, করলেও তারা কন্ট্রোল করে। আগে যারা চাঁদা নিত, তারা তো আছেই। নতুন যারা আছে তারাও মনে করছে আমরা ক্ষমতায় আসব- তারাও চাঁদা নিচ্ছে। আবার যারা লোকাল, যারা আশপাশে থাকে, তাদের একটা পাওয়ার আছে। যা তাদের বাদ দিতে পারে না। কারওয়ান বাজারে থাকে, বিভিন্ন বাজারে থাকে।

 দোকানদাররাও কন্ট্রোল করে। চাঁদাবাজরা নিজেরা মিলেমিশে থাকে। এদের ভাঙা খুবই জটিল। পলিটিক্যাল ইস্যু ছাড়া, লোকাল লিডারশিপ ছাড়া পারবে না। আমাদের সে লোকাল রিপ্রেজেনটেটিভ নেই। এখন ওয়ার্ড কমিশনাররাও নেই। সিটি করপোরেশনও নেই। ওরা হয়তো নিজের স্বার্থে করে। কারণ ওরা ভাবে, এই এলাকা আমি কন্ট্রোল করব। এই কন্ট্রোলের মধ্য দিয়ে ইনকামও করব। বিষয়গুলো বড়ই জটিল। আরেকটা হয় কী- যখন কোনো দ্রব্যের মূল্য ওপরে উঠে যায়, তখন তা নামানো খুব কঠিন হয়। অনেক ফ্যাক্টর থাকে। সময় লাগবে। আমি আশা করি, রোজার পর হয়তো কিছুটা নেমে আসবে। 

দ্বিতীয় কিস্তি আগামী দিন। চোখ রাখুন…

ঐক্য, স্থিতিশীলতাই সিরিয়ার বাথবাদীর উত্তরণের লক্ষ্য

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০১:৪৭ পিএম
ঐক্য, স্থিতিশীলতাই সিরিয়ার বাথবাদীর উত্তরণের লক্ষ্য
ড. জিওরজি বুজটিন

নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও শান্তিপূর্ণ উত্তরণকে উৎসাহিত করতে প্রতিবেশী দেশ এবং বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের কূটনৈতিক নেতৃত্ব, সংলাপ এবং মানবিক উদ্যোগের ওপর জোর দিলে সিরিয়ার পুনরুদ্ধারতা প্রক্রিয়ায় গঠনমূলক প্রভাব ফেলবে।...

বাথ পার্টি একসময় আরব বিশ্বের প্রভাবশালী শক্তি ছিল। বাশার আল-আসাদ সরকারের পতনের মুখে সিরিয়ায় তার উত্তরাধিকার দুর্বল হয়ে পড়ে। তার শাসনের অবসান ঘটে। কয়েক দশকের দমন-পীড়ন এবং আর্থরাজনৈতিক উত্থান-পতনের পর এমন একটি মতাদর্শের মেয়াদ শেষ হয়, যা এই অঞ্চলকে আলাদা একটি রূপ দিয়েছে। কিন্তু বিভাজন এবং কর্তৃত্ববাদের উত্তরাধিকার রেখে গেছে।

সিরিয়া যখন বাথিস্ট-পরবর্তী স্থানান্তর করতে শুরু করেছে, তখন ইরাকের ডি-বাথিফিকেশন থেকে সতর্কতামূলক শিক্ষা নেয়। ২০০৩ সালে সাদ্দাম হোসেনের বাথ পার্টির বিলুপ্তি প্রাতিষ্ঠানিক পতন, ব্যাপক অস্থিতিশীলতা, সাম্প্রদায়িক সহিংসতাসহ গুরুতর পরিণতির দিকে পরিচালিত করে। সিরিয়া যদি এই ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তি এড়াতে চায়, তবে তাদের অবশ্যই একটি ভিন্ন পথ বেছে নিতে হবে। তাদের ঐক্য, ন্যায়বিচার এবং তার জাতীয় রাষ্ট্রের অখণ্ডতার ওপর জোর দিতে হবে। 

ইরাকে ডি-বাথিফিকেশন প্রক্রিয়াটি ছিল দ্রুত এবং নির্বিচারমূলক। ৩৫ হাজারেরও বেশি সরকারি কর্মচারী রাতারাতি তাদের চাকরি হারিয়েছেন। ইরাকি সেনাবাহিনী বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় হাজার হাজার সামরিক সৈন্যকে বরখাস্ত করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের এই বিলুপ্তি একটি ক্ষমতার শূন্যতা তৈরি করেছে, যা নৈরাজ্য এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজনে ইন্ধন জোগায়। দায়েশের মতো চরমপন্থি গোষ্ঠীর উত্থানের সুযোগ তৈরি করেছে। 

অতীতের অভিযোগের সমাধান না করে ইরাকের ডি-বাথিফিকেশন প্রকৃতপক্ষে সামাজিক ফাটলকে আরও গভীর করে তুলেছে। প্রচারাভিযানটি অসমভাবে সুন্নি সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে সহিংসতা এবং অবিশ্বাসের চক্রকে স্থায়ী করে তোলে। এই অভিজ্ঞতা এমনভাবে জবাবদিহি অনুসরণ করার গুরুত্বকে বোঝায়, যা প্রতিশোধের পরিবর্তে পুনর্মিলনকে উৎসাহিত করে।

সিরিয়ার অগ্রগতির পথ অবশ্যই অন্তর্ভুক্তি, ন্যায়বিচার এবং সমৃদ্ধির দৃষ্টিভঙ্গিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এই দৃষ্টিভঙ্গির কেন্দ্রবিন্দু হবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার নিশ্চিত করা যে তারা সম্প্রদায় বা জাতি নির্বিশেষে সব নাগরিককে ন্যায়সংগতভাবে সেবা করে। এর জন্য প্রয়োজন মেধা ও ন্যায্যতার নীতির ভিত্তিতে শাসনকাঠামো পুনর্গঠন করা। এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যাতে আগে কয়েক দশকের কর্তৃত্ববাদী শাসনের মাধ্যমে যেসব কণ্ঠস্বর প্রান্তিক হয়ে গিয়েছিল তাদের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। 

চ্যালেঞ্জের মাত্রা বিশাল। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের মতে, ২০২৩ সালের শেষের দিকে সিরিয়ায় ১৬ দশমিক ৭ মিলিয়ন মানুষের মানবিক সহায়তার প্রয়োজন ছিল, যা সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যা। ফোর্সড ডিসপ্লেসমেন্টের জয়েন্ট ডেটা সেন্টার অনুসারে ৭ দশমিক ২ মিলিয়ন অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত লোক রয়েছে, যা জনসংখ্যার ওপর সংঘাত প্রতিফলিত করে। এই পরিসংখ্যানগুলো সর্বাধিক দুর্বলদের চাহিদা মোকাবিলায় ব্যাপক শাসন সংস্কার এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনার ওপর জোর দেয়।

জবাবদিহি সামাজিক ক্ষত নিরাময়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সম্মিলিত শাস্তির আশ্রয় না নিয়ে অতীতের অভিযোগের সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক নিয়মে একটি অন্তর্বর্তী বিচারকাঠামো প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। যুদ্ধাপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধীদের জবাবদিহির আওতায় এনে সিরিয়া তার জনগণের মধ্যে আস্থা পুনর্গঠন শুরু করতে পারে।
অর্থনৈতিক পুনর্গঠনও সমান জরুরি অগ্রাধিকার হিসেবে দাঁড়িয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য কাউন্সিল অন গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স অনুসারে, গত এক দশকে সিরিয়ার অর্থনীতি বিপর্যয়মূলক পতনের সম্মুখীন হয়েছে। ২০১০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে প্রকৃত মোট দেশীয় পণ্য প্রায় ৮৪ শতাংশ কমেছে। আরব উপসাগরীয় ব্যবসার অন্তর্দৃষ্টি অনুসারে, পুনরুদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় স্মারক আর্থিক সংস্থানগুলোকে হাইলাইট করে ৪০০ থেকে ৬০০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে দেশের অবকাঠামো পুনর্নির্মাণের ব্যয় প্রয়োজন। 

এ কাজটি করতে শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সমর্থন দরকার। বিশেষ করে উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে যারা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অংশীদারি ও লক্ষ্যবস্তু বিনিয়োগের মাধ্যমে সিরিয়া টেকসই উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং বাস্তুচ্যুত সম্প্রদায়ের পুনঃএকত্রীকরণের পথ প্রশস্ত করতে পারে। 

উপরন্তু, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অত্যাবশ্যক। সিরিয়ার স্থিতিশীলতা (বা এর অভাব) বড় প্রভাব ফেলবে, যা তার সীমানা ছাড়িয়ে বিস্তৃত মধ্যপ্রাচ্যকে প্রভাবিত করবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও শান্তিপূর্ণ উত্তরণকে উৎসাহিত করতে প্রতিবেশী দেশ এবং বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের কূটনৈতিক নেতৃত্ব, সংলাপ এবং মানবিক উদ্যোগের ওপর জোর 
দিলে সিরিয়ার পুনরুদ্ধারতা প্রক্রিয়ায় গঠনমূলক প্রভাব ফেলবে। 

ভবিষ্যতের এই দৃষ্টিভঙ্গির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ঐক্যের নীতি। সিরিয়ার আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষা করা আলোচনার অযোগ্য। সাম্প্রদায়িক বা জাতিগত কারণে খণ্ডিত হওয়া আরও অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি বহন করে এবং সহিংসতার চক্রকে স্থায়ী করে তোলে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই সিরিয়ার সার্বভৌমত্ব রক্ষার গুরুত্ব স্বীকার করতে হবে এবং পুনর্মিলন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রচার করতে হবে।

সিরিয়ায় বাথবাদী শাসনের অবসান দেশটির ভবিষ্যৎকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার একটি ঐতিহাসিক সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। এই অঞ্চলের অন্যদের সঙ্গে নিজের অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এবং অন্তর্ভুক্তি, ন্যায়বিচার ও ঐক্যকে অগ্রাধিকার দিয়ে সিরিয়া একটি স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। বৈশ্বিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে মূল আঞ্চলিক অভিনেতাদের অবশ্যই এই দৃষ্টিভঙ্গি ঘিরে সমাবেশ করতে হবে। সহযোগিতা এবং ভাগ করা প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে সিরিয়া তাদের ভগ্ন অতীত থেকে সমন্বিত ভবিষ্যতে রূপান্তর করতে পারে, যা এই অঞ্চলের জন্য আশার আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করবে। 

লেখক: জাতিসংঘে নিযুক্ত ইরাকের সাবেক কূটনীতিক এবং আনোয়ার গার্গাশ ডিপ্লোম্যাটিক একাডেমিতে কূটনীতিক-ইন-রেসিডেন্স ছিলেন।
আরব নিউজ থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল

প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনি রোডম্যাপের প্রত্যাশা

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০১:৪৩ পিএম
প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনি রোডম্যাপের প্রত্যাশা

সাধারণ জনগণ চায় দেশে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন। নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হলে জনগণের আস্থা বাড়বে। এবারের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় একটি বিষয় পরিষ্কার যে, প্রার্থীর জনপ্রিয়তা না থাকলে নির্বাচনে কোনোভাবেই বিজয়ী হতে পারবে না। কোনো প্রতীক বা দলের মনোনয়ন নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার মূল কার্ড হওয়ার সুযোগ নেই।…

ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে সাধারণ জনগণের আগ্রহ বেড়েছে। এরই মধ্যে বিএনপি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নির্বাচন নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলাপ করেছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে মতামত দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। নির্বাচন কমিশনও নিজেদের নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করে তুলছে। ইতোমধ্যে সংসদ নির্বাচন ও স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন (ইসি) মোট ৫ হাজার ৯২১ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা জাতীয় নির্বাচনের জন্য চাওয়া হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলেরও প্রস্তুতি লক্ষ করা যাচ্ছে। নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান কেমন হবে এবং নতুন রাজনৈতিক দল গঠিত হলে তারা কীভাবে নির্বাচনে যাবে, সে বিষয়ে কোনো পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়নি। ছাত্রদের নেতৃত্বে একটি রাজনৈতিক দল খুব শিগগিরই আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। গণমাধ্যমসূত্রে জানা গেছে, ছাত্রদের নেতৃত্বে গঠিত দল ৩০০ আসনেই প্রার্থী দিতে পারে। আর বিএনপি এবং জামায়াত আলাদাভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছে বলে প্রাথমিক ধারণা করতে পারছি। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং অন্য বাম রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান এখনো পরিষ্কার নয়। 

বাংলাদেশের রাজনীতি কোন দিকে যাচ্ছে। কীভাবে সাধারণ জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। তাছাড়া দেশের মানুষ বিভিন্ন অনলাইন জরিপ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত জনগণের মন্তব্যের মধ্য দিয়ে মতামত যাচাই করতে পারে। এখন মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিকর বক্তব্যে কিংবা তথ্যে রাজনীতিতে লাভবান হওয়া কঠিন। এক কথায় বলা যায়, ধোঁকাবাজির রাজনীতি এখন আর নেই। একথা আমরা সবাই জানি, রাজনীতিতে আস্থা-অনাস্থা এবং বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্নটি অনেক বেশি। পাশাপাশি সন্দেহ-সংশয় তো আছেই। সাম্প্রতিককালে রাজনীতিবিদদের বক্তব্য শুনলে মনে হয় রাজনীতিতে আস্থা এবং বিশ্বাস বলতে কিছু নেই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক ধরনের প্রতিযোগিতা রয়েছে। দীর্ঘ সময়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পরও তারাই বর্তমান রাজনীতির মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। 

ভবিষ্যতে নির্বাচনি রাজনীতিতে তাদের আপেক্ষিক শক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, আওয়ামী লীগ নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে মনোনিবেশ করেছে। কিন্তু বাস্তবে রাজনীতি কোন দিকে যাচ্ছে সেটি প্রকৃতভাবে অনুমান করা কঠিন। কারণ রাজনীতিতে এক ধরনের গেম চলতে থাকে। গেমগুলো কোনো সময় খালি চোখে দেখা যায়, আবার কোনো সময় দেখা যায় না। আমরা জানি, একসময় আওয়ামী লীগ একপ্রকার গেমের মধ্য দিয়ে নিজেদের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছিল। বিএনপি ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিলেও ২০২৪ এবং তার আগে ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নিয়ে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সুযোগ করে দিয়েছিল। বিএনপি ওই সময়ে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। আওয়ামী লীগের যে একক আধিপত্য তৈরি হয়েছে, তার পেছনে বিএনপির কিছুটা দুর্বল সাংগঠনিক শক্তি দায়ী ছিল বলে অনুমান করা যায়। 

বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রত্যাবর্তনের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, বিএনপি আওয়ামী লীগের তুলনায় অপেক্ষাকৃত নবীন রাজনৈতিক দল হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেছে দীর্ঘ সময়। বিশেষ করে  ’৯০-পরবর্তী একটি দীর্ঘ সময় বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে প্রধানত দুটি দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যেই। এ প্রেক্ষাপট থেকেই বিএনপি বিগত দশম সংসদ (২০১৪) নির্বাচনের প্রাক্কালে নিশ্চিতভাবেই ধরে নিয়েছিল যে, তারা সরকার গঠন করবে। কে কোন পদ পেতে যাচ্ছেন কিংবা কে কোন পদ নিতে চান এমন হিসাব-নিকাশও বিএনপি-দলীয় কতিপয় নেতৃবৃন্দ ও সমর্থকরা শুরু করেছিলেন। এর অন্যতম কারণ ছিল, নির্বাচনের কয়েক মাস আগেই পাঁচ সিটি করপোরেশনে বিএনপির একচেটিয়া বিজয়। তারা ধরেই নিয়েছিল দেশের আপামর জনসাধারণ তাদের ‘নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের’ দাবিতে একমত হয়ে রাস্তায় নেমে আসবে এবং দাবি মেনে নিতে বাধ্য হবে সরকার। 

এ ছাড়া বিগত সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপির অনেকের ধারণা ছিল বিদেশিরাই তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে। পরিবেশটা এমন মনে হচ্ছিল যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিএনপিকে ক্ষমতায় আনবেই। এ ছাড়া বিএনপিরও অতি মাত্রায় আস্থা ছিল জামায়াত এবং হেফাজতের ওপর। কিন্তু আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক গেমে তাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। 

এখনো রাজনীতিতে গেম রয়েছে। কিছুদিন আগে লন্ডন থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেছিলেন, আগামী নির্বাচন বিএনপির জন্য যে খুব সহজ হবে তেমনটি তিনি মনে করেন না। এমনকি এ বিষয়ে তিনি বারবার ইঙ্গিত দিয়েছেন। নির্বাচন কেমন হবে, কোন প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলো অংশ নেবে। পক্ষপাতিত্ব থাকবে কি না- সবকিছু নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার পেছনে কাজ করে। আর এ কারণে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য বর্তমান সরকারের সচেতনতা আরও বাড়াতে হবে। বিশেষ করে তৃণমূল পর্যায়ে নির্বাচনি পরিবেশ নিয়ে রাজনৈতিক সংঘাত মোকাবিলার বিষয়টি অধিকভাবে ভাবতে হবে।
সাধারণত গণতান্ত্রিক সমাজে ক্ষমতা পরিবর্তনের মূল মাধ্যম নির্বাচন।

 রাজনীতিতে পেশিশক্তি, ভোটশক্তির পাশাপাশি দরকার কৌশলী হওয়া। রাজনীতির লড়াইয়ে বিগত সময়ে সংসদ নির্বাচন-পূর্ব আওয়ামী লীগ কিছুটা কৌশলের আশ্রয় নিয়ে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে মোকাবিলা করেছিল। আমার মনে হয়, বিগত সময়ে বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখা ছিল আওয়ামী লীগের অন্যতম রাজনৈতিক কৌশল। ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না’- এমন ফাঁদটি আওয়ামী লীগের ক্ষমতার লড়াইয়ের খেলায় বিজয়ী হতে সহজ করে দিয়েছিল। কাজেই রাজনীতিতে বিজয়ী হতে হলে যেকোনো রাজনৈতিক দল কিংবা শক্তিকেই কৌশলী হতে হবে এবং প্রতিপক্ষের কৌশল বুঝতে হবে। তাহলেই রাজনীতির খেলায় চূড়ান্ত বিজয় সহজ হবে। 

সাধারণ জনগণ চায় দেশে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন। নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হলে জনগণের আস্থা অনেকাংশে বাড়বে। এবারের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় একটি বিষয় পরিষ্কার যে, প্রার্থীর জনপ্রিয়তা না থাকলে নির্বাচনে কোনোভাবেই বিজয়ী হতে পারবে না। কোনো প্রতীক বা দলের মনোনয়ন কোনোভাবেই নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার মূল কার্ড হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ দেশে একটি বিরাট জনগোষ্ঠী তরুণ এবং সচেতন। তাদের বেশির ভাগ অংশ এবারই প্রথম ভোট দিতে যাবে। 

নির্বাচনের আগেই কোনো রাজনৈতিক দলকে হারিয়ে দিয়ে নির্বাচনের আয়োজন কতটা অংশগ্রহণমূলক হবে- সে বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার। এই ফেব্রুয়ারি মাসেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি শুরু হয়েছে। বিএনপি নির্বাচনমুখী জনসংযোগের লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে আর আওয়ামী লীগ নিজেদের ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে শামিল হচ্ছে। কাজেই নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণের রোডম্যাপ এমন হওয়া উচিত, যাতে দেশে একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরির মধ্য দিয়ে সব সংকটের সুষ্ঠু সমাধান হয়।

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

বিশেষ সাক্ষাৎকার: ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ রোজায় পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকবে

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১:০৪ এএম
রোজায় পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকবে
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। অলংকরণ : নিয়াজ চৌধুরী তুলি

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা। তিনি ২০২৪ সালের ৯ আগস্ট অর্থ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হন। পরবর্তী সময়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পান। ১৯৭০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। এ ছাড়া তিনি এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কেন্দ্র (সিরডাপ)-এর গবেষণাপ্রধান হিসেবে কাজ করেন। তিনি বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (বার্ড) মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন। জাতীয় অর্থনীতির বিভিন্ন সমস্যা ও সম্ভাবনা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, রাজস্বনীতি, মানবসম্পদ উন্নয়ন, তুলনামূলক উন্নয়ন অভিজ্ঞতাসহ অর্থনীতির নানা বিষয়ে কথা বলেছেন খবরের কাগজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খবরের কাগজ-এর সম্পাদক মোস্তফা কামাল

খবরের কাগজ: অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ৬ মাস পূর্ণ করেছে। অর্থ উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর আপনাকে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আপনি কতটা সফল হয়েছেন বলে মনে করছেন? 

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: অর্থনীতির দিকটা চ্যালেঞ্জিং। বিশেষ করে ব্যাংকিং সেক্টর, এনবিআরসহ পুরো আর্থিক খাত অর্থাৎ যাকে আমরা বলি পুঁজিবাজার- এগুলোর অবস্থা একদমই নাজুক। প্রথমত, গত সরকারের দুর্নীতি ও দুঃশাসনই এর জন্য দায়ী। এরপর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও প্রাইভেট ব্যাংকে বড় ধরনের ডিফল্ট লোন, অর্থ পাচার, দুর্নীতি এগুলোও ঘটেছে। পুঁজিবাজারেও একই অবস্থা। পুঁজিবাজারে বড় বড় সংস্থাগুলো শেয়ার কারসাজি করে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান সরকারি বিনিয়োগ সংস্থা ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) ফান্ড থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। অন্যদিকে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার এলসি খোলার পর তা পরিশোধ করেননি। অর্থাৎ সবমিলে বিশাল অঙ্কের টাকা তিনি ব্যাংকগুলোকে ফেরত দেননি। একটা ব্যাংক থেকে ৮০ শতাংশ টাকা একটি লোক একদিনে তুলে নিয়ে গেছে। এগুলো সাধারণ মানুষের আমানতের টাকা। 

আমরা যখন অন্তর্বর্তী সরকারে আসি তখন দেশের আর্থিক অবস্থা একেবারেই খারাপ ছিল। আমাদের একটা বড় রকমের চ্যালেঞ্জ ছিল অর্থনীতির এই ভঙ্গুর অবস্থাকে স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে কতকগুলো অ্যাকশন নিয়ে কিছু ব্যাংকের হিসাব বন্ধ করে দিই। আর্থিক খাতে মোটামুটি একটা শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। এখনো কিছু সমস্যা রয়ে গেছে, তবে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। সরকারি ব্যাংকগুলোর সব ব্যবস্থাপনা পরিবর্তন করে দিয়েছি। পণ্য খালাসের ক্ষেত্রে শুল্কবিষয়ক ও পোর্টের সমস্যাগুলো সহজ করে দিয়েছি। সবমিলে আর্থিকভাবে আমাদের অনেক খারাপ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। গত ২৭-২৮ বছরে এমন আর্থিক দুরাবস্থা দেখা যায়নি। বিগত সরকারের আমলে বলা হয়েছে- বাংলাদেশে উন্নতি হচ্ছে, প্রবৃদ্ধি বেশি- এগুলো সত্য ছিল না। ব্যাংকে ডিপোজিট নেই, খেলাপি ঋণ আড়াই লাখ কোটি টাকা। আমি যখন বাংলাদেশ ব্যাংক ছেড়ে আসি তখন খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ৩৮ হাজার কোটি টাকা, এখন আড়াই লাখ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। এখন ব্যাংকে ১ লাখ টাকার চেক দিলে বলে ১০ হাজার টাকা নিয়ে যেতে। ব্যাংকে টাকা নেই। অতএব, আমাদের এখন প্রধান লক্ষ ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট সমাধান করা। আশার আলো হলো, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরে আসছে। পুরোটা ফিরে আসছে, সেটা বলব না। মোটামুটি চলে আসছে। অন্যদিকে বাইরের যারা দাতা অর্থাৎ বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, ইসলামী ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক- ওদের সঙ্গে আমাদের কথাবার্তা হচ্ছে। এডিবি ডিসেম্বর মাসে ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দিয়েছে। জুনে আরও ৫০০ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার কথা। আমাদের প্রথম কাজ ছিল ঋণের ব্যবস্থা করা, আমরা সে ব্যবস্থা করেছি। 

বিগত সরকার মেগা প্রকল্পের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এসব প্রকল্পে বড় ধরনের দুর্নীতিও হয়েছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে এত টাকা কেন খরচ হলো, পদ্মা রেল লিংক প্রকল্পে এত টাকা কেন খরচ হলো- সেগুলো পরের প্রশ্ন। প্রথম কাজ হচ্ছে এই ঋণগুলো এখন আমাদের পরিশোধ করতে হবে। ঋণদাতা সংস্থাগুলোকে আমরা আশ্বস্ত করেছি। আমরা বলেছি, সব ঋণ পরিশোধ করব। বাংলাদেশ কখনো ঋণখেলাপি হয়নি। সবচেয়ে বড় যে সমস্যা সেটা হলো- এগুলো ডিজিটালাইজেশন করা হয়নি। ওরা বহুদিন ধরে বলে আসছে জনবলের অভাব। আগের চেয়ারম্যানকে আমি বলেছিলাম, জনবল নেওয়া যাবে না, ডিজিটালাইজড করতে হবে। কাস্টমস কিছুটা করেছে। ইনকাম ট্যাক্সও করেছে। অনলাইনে ১২ লাখের বেশি রিটার্ন জমা হয়েছে। করদাতারা এবার থেকে অনলাইনে ট্যাক্স রিটার্ন দিতে পারছে। কোম্পানি করদাতাকে অনলাইনে রিটার্নে আনা যায়নি, কারণ প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল। সেদিক দিয়ে আমরা বলতে পারি, অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আসছে। চ্যালেঞ্জগুলো যে আমরা সবটা নিতে পেরেছি, তা নয়। প্রথম চ্যালেঞ্জটা ছিল মূল্যস্ফীতি কমানো, সেটা এখনো আছে। তবে কিছুটা কমেছে। প্রধান সমস্যা সরবরাহজনিত। সরবরাহ যদি আমরা স্বাভাবিক করতে পারি, সে ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি আরও কমে আসবে। আমরা একটি বিষয় নিশ্চিত করেছি- সেটা হলো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, যেমন- চাল, ডালের শুল্ককর কমিয়ে দিয়েছি। আর রোজার সময় অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্য যেমন- খেজুর, মসুর ডাল আমদানির জন্য এসব পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক কমানো হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো- বাজার এখনো স্থিতিশীল হয়নি। যেমন দেখবেন- বাজারে আছে, কিন্তু আপনি পাচ্ছেন না। তারা বলছে এক বছরেও তারা আর পাবে না। 

খবরের কাগজ: সিন্ডিকেট নিয়ে অনেক কথাবার্তা, লেখালেখি হয়েছে। আপনি নিজেও বলেছেন, সিন্ডিকেট ভাঙা যাচ্ছে না...
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: আমি কথা বলেছি, অনেকে বলছে সিন্ডিকেট ভাঙছে কি না? সিন্ডিকেটের তো কোনো অফিস নেই। সিন্ডিকেট হচ্ছে চেইন অব পিপলস। হয়তো একজন বেশি নিয়ন্ত্রণ করে, একজন আমদানি করে কারওয়ান বাজারে নিয়ে আসে, তারাও সিন্ডিকেটের অংশ। এমনকি খুচরা দোকানদাররাও সিন্ডিকেটের অংশ। আপনি জানবেন না তারা কোন দোকানে পণ্য লুকিয়ে রেখেছে। অতএব, ভোক্তাধিকার আইনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। একটা টাস্কফোর্স করা হয়েছে। ভোক্তা অধিকারের লোকজন বাজারে যায়, জরিমানা করে। এতে যে বাজারে দ্রব্যমূল্য পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে, তা নয়। আপনি দেখবেন বাজারে এখন লোকজন সবজির ক্ষেত্রে দামে কিছুটা সাশ্রয় পাচ্ছে, আবার এপ্রিলের দিকে দাম বেড়ে যাবে। আমরা চেষ্টা করছি কীভাবে এগুলো একটা নিয়মের মধ্যে আনা যায়। সবাই খারাপ নয়, কিছু ভালো লোক আছে বাজারে। ট্রাকে পণ্য আনার ক্ষেত্রে মাঝ পথে চাঁদাবাজরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। ব্রিজের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে চাঁদা তুলছে। এদের আমরা চাঁদাবাজ বলি। পণ্য লোড-আনলোডের ক্ষেত্রেও একটা সিন্ডিকেট আছে। এ ছাড়া আছে পাইকারি ব্যবসায়ীদের কারসাজি। সেখানেও অনেক চ্যালেঞ্জ আছে মূল্যস্ফীতিটা নিয়ন্ত্রণে আনার ক্ষেত্রে। কাজেই সিন্ডিকেট ভাঙা অত সহজ ব্যাপার নয়।

খবরের কাগজ: রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি রোধে কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে? 
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: রমজানে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি ঠেকাতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সরবরাহ ব্যবস্থায় জোর দেওয়া হয়েছে। টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড ও ঢাকা-চট্টগ্রাম বিভাগে ট্রাকসেল আবার চালু করা হয়েছে। এই সেবা সাময়িক বন্ধ করে দিয়েছিলাম। তখন দরকার ছিল না। কৃষি মন্ত্রণালয়কে বললাম, অর্থ দিয়ে তোমরা এটা চালু করো। তারা আবার শুরু করেছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় ভর্তুকিমূল্যে চাল বিক্রয় করবে। সব জায়গায় নয়। যেমন- আমরা চিন্তা করছি, কিছু কিছু জায়গায় বিশেষ করে যেসব জায়গায় জেলেরা আছে, চট্টগ্রামে ওদের কার্ড আছে, ওদের চাল কিছুটা বাড়ানোর জন্য চিন্তাভাবনা করছি। সরকারের পক্ষ থেকে যত পণ্য আমদানি করা হচ্ছে যেমন- চাল, গম, মসুর ডাল, খেজুর, এগুলো থেকে শুল্ক তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে কিছু কিছু পণ্যের দাম কমে গেছে। এতে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এটা আরেকটা চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। 

নিত্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ভারত আমাদের বড় উৎস। বেনাপোল আবার বন্ধ করে দিল, ওটা ছিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এখন পাকিস্তান থেকেও চাল আসছে। আবার আমরা ভিয়েতনাম থেকেও আনছি। গম এখন রাশিয়া, ইউক্রেন থেকে আনছি। অতএব, আমরা আশা করছি, রোজার সময় তেমন কোনো সমস্যা হবে না। বাজার মনিটরিং করতে হবে। জেলা প্রশাসকদের ইতোমধ্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসকদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা আছে। ভোক্তা অধিকারের যারা ম্যাজিস্ট্রেট আছেন, তাদের এ ক্ষমতা দেওয়া আছে। আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ হলো ফরেন এক্সচেঞ্জ। আপনি জানেন রিজার্ভটা আগে কমে গিয়েছিল, এখন বেড়ে রিজার্ভটা ২৫ বিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। এটা ঠিক আছে। আর আমদানির ক্ষেত্রে বকেয়া (আউটস্টান্ডিং) ছিল ৪.৫ বিলিয়ন ডলার। এটা এখন ৪ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। এর জন্য রিজার্ভ থেকে এক টাকাও নেওয়া হয়নি।

খবরের কাগজ: রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে কি না...
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের একটা মূল্য নির্ধারণ করেছে। ব্যাংকারদের বলা হয়েছে- আমরা দেব না, তোমরা বাজার থেকে ডলার সংগ্রহ করো। যেহেতু রেমিট্যান্সের প্রবাহ একটু ভালো। তবে তাদের চাপ বেড়েছে। গতবার খাদ্যদ্রব্য আমদানি করা হয়নি। এবার ৯ মিলিয়ন ডলারের চাল আনতে হবে। ইতোমধ্যে রিজার্ভ কিছুটা বেড়েছে। আমি প্রাইভেট ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলেছি কয়েকদিন আগে। প্রাইভেট ব্যাংকাররা রাজি হয়েছে। মোটামুটি ৬ থেকে ৭টা প্রাইভেট ব্যাংক আছে ভালো। ইসলামী ব্যাংক সবচেয়ে ভালো ছিল। এখন তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে অল্প দিন হলো। প্রাইভেট ব্যাংগুলোর মধ্যে তারা সবচেয়ে বড় ব্যাংক ছিল। বাকি ব্যাংকগুলোর সঙ্গেও কথা বলেছি। ওরা প্রোভাইড করবে, সেখানে আমার গ্যারান্টি দিতে হবে, সেটা আমি দেব। শর্ত হলো- ওরা শুধু ফাইন্যান্স করবে এলসিতে। এস্টেট অপারেশন প্রাইভেটদের জন্য নয়। এলসি কিছুটা সহজ হয়েছে, একেবারে যে সহজ হয়েছে, তা নয়। 

রাশিয়ানরা একদিক দিয়ে ভালো- এরা হইচই করে না, টাকা না পেলেও। ওরা মাঝে মাঝে অনুরোধ করে টাকা দেওয়ার ক্ষেত্রে। রাশিয়া স্টেট অন এন্টার প্রাইজ, এরা প্রাইভেট। এরা সরকারের কথা শোনে না। ফরেন এক্সেঞ্জের রিজার্ভ কিছু ভালো হয়েছে, আর রেমিট্যান্সও ভালো অবস্থানে আছে। গত মাসে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। এখন এ খাতে ২ বিলিয়ন ডলারের চেয়ে বেশি আসে। মোটামুটি যে রেটটা আছে, এটা থাকবে। আমাদের লোকজনের মধ্যে আস্থা আসছে। 

খবরের কাগজ: হুন্ডির পরিবর্তে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে টাকা পাঠানো কি বেড়েছে?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: এখন হুন্ডি কমে গেছে। এখানে ম্যানিপুলেটরা আছে। তবে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে টাকা পাঠানো বেড়েছে। 

খবরের কাগজ: ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন শিল্পকারখানা চালু করা যাচ্ছে না, এ সম্পর্কে কিছু বলুন।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ হলো- এনার্জি প্রাইজটা। গ্যাসের স্বল্পতা, শিল্পগুলো সব চালু করা যাচ্ছে না। গ্যাসের ঘাটতি আছে। এজন্য পাচ্ছে না। এলপিজি আনতে হয়, আবার পেট্রল, ফার্নেস অয়েল আনতে হয়- এগুলোর ক্ষেত্রে বিরাট চাপ পড়ছে আমাদের। এপ্রিল-মের দিকে বেশি চাপ পড়বে। কারণ, গরম এলে এসি চলবে, ইলেকট্রিক সরঞ্জাম বেশি চলবে। আসলে গরমের সময় কনজামশনটা একটু বেশি আসে। শীতের সময় একটু কম। আমরা চেষ্টা করছি কী করা যায়। আবার হুট করে দাম বাড়ানোও যাচ্ছে না। বাড়ালে শিল্পে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। বিরাট সাবসিডি দিতে হয় সরকারকে। এ খাতে ৬২ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। ওদের সঙ্গে বহু মিটিং আমি করেছি যখন বাণিজ্য উপদেষ্টার দায়িত্বে ছিলাম। বড় বড় ইম্পোর্টার আছে কেডিএস, সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ- এরাই বড় শিল্পগোষ্ঠী। ব্যবসায়ীরা তাদের শুধু মুনাফা বোঝে। আমাদের দেশে ব্যবসাটা অন্য দেশের মতো এত কমপিটেটিভ না। আপনি দেখবেন একজন ব্যবসায়ী ১০ বছর আগে এক সময় আপনার সঙ্গে রিকশায় চড়ত, এখন সে মার্সিটিজ গাড়িতে চড়ে।

অপর দিকে লেভেল প্লেইং ফিল্ড থাকে না, তখন ভালো ব্যাবসায়ীরাও মার খেয়ে যাচ্ছে। এখানে রাজনৈতিক ব্যাপার। আমরা এখনো এত কঠোর হতে পারিনি। পুলিশ দিয়ে রিটেইলারদের ধরে নিয়ে আসো। আগের পলিটিক্যাল গভর্নমেন্ট এগুলো করত। অনেক সময় কাকে কোন শাস্তি দিতে হয়, বাইরের লোক কিছুই জানত না। এগুলো আমরা ব্যবহার করছি না। তারা এখনো সক্রিয়। বিভিন্নভাবে তারা এখনো মেনুপুলেট করে। অতএব, এদের ধরার জন্য আমরা মনিটর করছি। আর সিন্ডিকেট একেবারে নিশ্চিহ্ন করা যাবে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ৬ থেকে ৭টা মেজর ইমপোর্টার বাংলাদেশে। আপনি যদি সয়াবিন আনতে চান, ব্রাজিল থেকে একটা বিরাট জাহাজ আসবে। এলসি করতে হবে ৫০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকা। এখন যদি মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ীদের বলেন সয়াবিন আনতে, তারা ১০টা কনটেইনারও আনতে পারবে না। কারণ ওদের দেবেও না। তাদের একটি মাত্র কনটেইনার আনার সক্ষমতা রয়েছে। এখানে ন্যাচারাল মনোপলি হয়ে যায় কমোডিটি ব্যবসায়। চাল যেমন ৫০ হাজার টনের কমে কেউ দেবে না। ১৫০ টনের ডিও লেটার নেবে, পরে সে আরেকজনের কাছে তা বিক্রি করে দেবে। এটা একটা বিষয়। এটাকে রোধ করা যাচ্ছে না। এটা ডিফিকাল্ট। পলিটিক্যাল গভর্নমেন্ট থাকলে সুবিধা হয়, তাদের  অনেক কর্মী আছে। নেতারা যখন বলে এটা কর, ওটা দেখ- ওরা ঘোরাঘুরি করলে বাজারে কিছুটা সুবিধা পাওয়া যায়। বিনা পয়সায় করে না কেউ, করলেও তারা কন্ট্রোল করে। আগে যারা চাঁদা নিত, তারা তো আছেই। নতুন যারা আছে তারাও মনে করছে আমরা ক্ষমতায় আসব- তারাও চাঁদা নিচ্ছে। আবার যারা লোকাল, যারা আশপাশে থাকে, তাদের একটা পাওয়ার আছে। যা তাদের বাদ দিতে পারে না। কারওয়ান বাজারে থাকে, বিভিন্ন বাজারে থাকে। দোকানদাররাও কন্ট্রোল করে। চাঁদাবাজরা নিজেরা মিলেমিশে থাকে। এদের ভাঙা খুবই জটিল। পলিটিক্যাল ইস্যু ছাড়া, লোকাল লিডারশিপ ছাড়া পারবে না। আমাদের সে লোকাল রিপ্রেজেনটেটিভ নেই। এখন ওয়ার্ড কমিশনাররাও নেই। সিটি করপোরেশনও নেই। ওরা হয়তো নিজের স্বার্থে করে। কারণ ওরা ভাবে, এই এলাকা আমি কন্ট্রোল করব। এই কন্ট্রোলের মধ্য দিয়ে ইনকামও করব। বিষয়গুলো বড়ই জটিল। আরেকটা হয় কী- যখন কোনো দ্রব্যের মূল্য ওপরে উঠে যায়, তখন তা নামানো খুব কঠিন হয়। অনেক ফ্যাক্টর থাকে। সময় লাগবে। আমি আশা করি, রোজার পর হয়তো কিছুটা নেমে আসবে। 

দ্বিতীয় কিস্তি আগামী দিন। চোখ রাখুন…