ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা। তিনি ২০২৪ সালের ৯ আগস্ট অর্থ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হন। পরবর্তী সময়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পান। ১৯৭০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। এ ছাড়া তিনি এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কেন্দ্র (সিরডাপ)-এর গবেষণাপ্রধান হিসেবে কাজ করেন। তিনি বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (বার্ড) মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন। জাতীয় অর্থনীতির বিভিন্ন সমস্যা ও সম্ভাবনা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, রাজস্বনীতি, মানবসম্পদ উন্নয়ন, তুলনামূলক উন্নয়ন অভিজ্ঞতাসহ অর্থনীতির নানা বিষয়ে কথা বলেছেন খবরের কাগজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খবরের কাগজ-এর সম্পাদক মোস্তফা কামাল
রমজানে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি ঠেকাতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সরবরাহব্যবস্থায় জোর দেওয়া হয়েছে। টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড ও ঢাকা-চট্টগ্রাম বিভাগে ট্রাকসেল আবার চালু করা হয়েছে। এই সেবা সাময়িক বন্ধ করে দিয়েছিলাম। তখন দরকার ছিল না। কৃষি মন্ত্রণালয়কে বললাম, অর্থ দিয়ে তোমরা এটা চালু করো। তারা আবার শুরু করেছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় ভর্তুকি মূল্যে চাল বিক্রয় করবে। সব জায়গায় নয়। যেমন- আমরা চিন্তা করছি, কিছু কিছু জায়গায় বিশেষ করে যেসব জায়গায় জেলেরা আছে, চট্টগ্রামে ওদের কার্ড আছে, ওদের চাল কিছুটা বাড়ানোর জন্য চিন্তাভাবনা করছি। সরকারের পক্ষ থেকে যত পণ্য আমদানি করা হচ্ছে যেমন- চাল, গম, মসুর ডাল, খেজুর- এগুলো থেকে শুল্ক তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে কিছু কিছু পণ্যের দাম কমে গেছে। এতে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এটা আরেকটা চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। নিত্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ভারত আমাদের বড় উৎস। বেনাপোল আবার বন্ধ করে দিল, ওটা ছিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এখন পাকিস্তান থেকেও চাল আসছে। আবার আমরা ভিয়েতনাম থেকেও আনছি। গম এখন রাশিয়া, ইউক্রেন থেকে আনছি। অতএব, আমরা আশা করছি, রোজার সময় তেমন কোনো সমস্যা হবে না।…
খবরের কাগজ: অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ৬ মাস পূর্ণ করেছে। অর্থ উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর আপনাকে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আপনি কতটা সফল হয়েছেন বলে মনে করছেন?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: অর্থনীতির দিকটা চ্যালেঞ্জিং। বিশেষ করে ব্যাংকিং সেক্টর, এনবিআরসহ পুরো আর্থিক খাত অর্থাৎ যাকে আমরা বলি পুঁজিবাজার- এগুলোর অবস্থা একদমই নাজুক। প্রথমত, গত সরকারের দুর্নীতি ও দুঃশাসনই এর জন্য দায়ী। এরপর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও প্রাইভেট ব্যাংকে বড় ধরনের ডিফল্ট লোন, অর্থ পাচার, দুর্নীতি এগুলোও ঘটেছে। পুঁজিবাজারেও একই অবস্থা। পুঁজিবাজারে বড় বড় সংস্থাগুলো শেয়ার কারসাজি করে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান সরকারি বিনিয়োগ সংস্থা ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) ফান্ড থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। অন্যদিকে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার এলসি খোলার পর তা পরিশোধ করেননি। অর্থাৎ সবমিলে বিশাল অঙ্কের টাকা তিনি ব্যাংকগুলোকে ফেরত দেননি। একটা ব্যাংক থেকে ৮০ শতাংশ টাকা একটি লোক একদিনে তুলে নিয়ে গেছে। এগুলো সাধারণ মানুষের আমানতের টাকা।
আমরা যখন অন্তর্বর্তী সরকারে আসি তখন দেশের আর্থিক অবস্থা একেবারেই খারাপ ছিল। আমাদের একটা বড় রকমের চ্যালেঞ্জ ছিল অর্থনীতির এই ভঙ্গুর অবস্থাকে স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে কতকগুলো অ্যাকশন নিয়ে কিছু ব্যাংকের হিসাব বন্ধ করে দিই। আর্থিক খাতে মোটামুটি একটা শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। এখনো কিছু সমস্যা রয়ে গেছে, তবে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। সরকারি ব্যাংকগুলোর সব ব্যবস্থাপনা পরিবর্তন করে দিয়েছি। পণ্য খালাসের ক্ষেত্রে শুল্কবিষয়ক ও পোর্টের সমস্যাগুলো সহজ করে দিয়েছি। সবমিলে আর্থিকভাবে আমাদের অনেক খারাপ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। গত ২৭-২৮ বছরে এমন আর্থিক দুরাবস্থা দেখা যায়নি। বিগত সরকারের আমলে বলা হয়েছে- বাংলাদেশে উন্নতি হচ্ছে, প্রবৃদ্ধি বেশি- এগুলো সত্য ছিল না। ব্যাংকে ডিপোজিট নেই, খেলাপি ঋণ আড়াই লাখ কোটি টাকা। আমি যখন বাংলাদেশ ব্যাংক ছেড়ে আসি তখন খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ৩৮ হাজার কোটি টাকা, এখন আড়াই লাখ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। এখন ব্যাংকে ১ লাখ টাকার চেক দিলে বলে ১০ হাজার টাকা নিয়ে যেতে। ব্যাংকে টাকা নেই। অতএব, আমাদের এখন প্রধান লক্ষ ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট সমাধান করা। আশার আলো হলো, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরে আসছে। পুরোটা ফিরে আসছে, সেটা বলব না। মোটামুটি চলে আসছে। অন্যদিকে বাইরের যারা দাতা অর্থাৎ বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, ইসলামী ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক- ওদের সঙ্গে আমাদের কথাবার্তা হচ্ছে। এডিবি ডিসেম্বর মাসে ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দিয়েছে। জুনে আরও ৫০০ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার কথা। আমাদের প্রথম কাজ ছিল ঋণের ব্যবস্থা করা, আমরা সে ব্যবস্থা করেছি।
বিগত সরকার মেগা প্রকল্পের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এসব প্রকল্পে বড় ধরনের দুর্নীতিও হয়েছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে এত টাকা কেন খরচ হলো, পদ্মা রেল লিংক প্রকল্পে এত টাকা কেন খরচ হলো- সেগুলো পরের প্রশ্ন। প্রথম কাজ হচ্ছে এই ঋণগুলো এখন আমাদের পরিশোধ করতে হবে। ঋণদাতা সংস্থাগুলোকে আমরা আশ্বস্ত করেছি। আমরা বলেছি, সব ঋণ পরিশোধ করব। বাংলাদেশ কখনো ঋণখেলাপি হয়নি। সবচেয়ে বড় যে সমস্যা সেটা হলো- এগুলো ডিজিটালাইজেশন করা হয়নি। ওরা বহুদিন ধরে বলে আসছে জনবলের অভাব। আগের চেয়ারম্যানকে আমি বলেছিলাম, জনবল নেওয়া যাবে না, ডিজিটালাইজড করতে হবে। কাস্টমস কিছুটা করেছে। ইনকাম ট্যাক্সও করেছে। অনলাইনে ১২ লাখের বেশি রিটার্ন জমা হয়েছে। করদাতারা এবার থেকে অনলাইনে ট্যাক্স রিটার্ন দিতে পারছে। কোম্পানি করদাতাকে অনলাইনে রিটার্নে আনা যায়নি, কারণ প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল। সেদিক দিয়ে আমরা বলতে পারি, অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আসছে। চ্যালেঞ্জগুলো যে আমরা সবটা নিতে পেরেছি, তা নয়।
প্রথম চ্যালেঞ্জটা ছিল মূল্যস্ফীতি কমানো, সেটা এখনো আছে। তবে কিছুটা কমেছে। প্রধান সমস্যা সরবরাহজনিত। সরবরাহ যদি আমরা স্বাভাবিক করতে পারি, সে ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি আরও কমে আসবে। আমরা একটি বিষয় নিশ্চিত করেছি- সেটা হলো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, যেমন- চাল, ডালের শুল্ককর কমিয়ে দিয়েছি। আর রোজার সময় অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্য যেমন- খেজুর, মসুর ডাল আমদানির জন্য এসব পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক কমানো হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো- বাজার এখনো স্থিতিশীল হয়নি। যেমন দেখবেন- বাজারে আছে, কিন্তু আপনি পাচ্ছেন না। তারা বলছে এক বছরেও তারা আর পাবে না।
খবরের কাগজ: সিন্ডিকেট নিয়ে অনেক কথাবার্তা, লেখালেখি হয়েছে। আপনি নিজেও বলেছেন, সিন্ডিকেট ভাঙা যাচ্ছে না...
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: আমি কথা বলেছি, অনেকে বলছে সিন্ডিকেট ভাঙছে কি না? সিন্ডিকেটের তো কোনো অফিস নেই। সিন্ডিকেট হচ্ছে চেইন অব পিপলস। হয়তো একজন বেশি নিয়ন্ত্রণ করে, একজন আমদানি করে কারওয়ান বাজারে নিয়ে আসে, তারাও সিন্ডিকেটের অংশ। এমনকি খুচরা দোকানদাররাও সিন্ডিকেটের অংশ। আপনি জানবেন না তারা কোন দোকানে পণ্য লুকিয়ে রেখেছে। অতএব, ভোক্তাধিকার আইনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। একটা টাস্কফোর্স করা হয়েছে। ভোক্তা অধিকারের লোকজন বাজারে যায়, জরিমানা করে।
এতে যে বাজারে দ্রব্যমূল্য পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে, তা নয়। আপনি দেখবেন বাজারে এখন লোকজন সবজির ক্ষেত্রে দামে কিছুটা সাশ্রয় পাচ্ছে, আবার এপ্রিলের দিকে দাম বেড়ে যাবে। আমরা চেষ্টা করছি কীভাবে এগুলো একটা নিয়মের মধ্যে আনা যায়। সবাই খারাপ নয়, কিছু ভালো লোক আছে বাজারে। ট্রাকে পণ্য আনার ক্ষেত্রে মাঝ পথে চাঁদাবাজরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। ব্রিজের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে চাঁদা তুলছে। এদের আমরা চাঁদাবাজ বলি। পণ্য লোড-আনলোডের ক্ষেত্রেও একটা সিন্ডিকেট আছে। এ ছাড়া আছে পাইকারি ব্যবসায়ীদের কারসাজি। সেখানেও অনেক চ্যালেঞ্জ আছে মূল্যস্ফীতিটা নিয়ন্ত্রণে আনার ক্ষেত্রে। কাজেই সিন্ডিকেট ভাঙা অত সহজ ব্যাপার নয়।
খবরের কাগজ: রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি রোধে কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: রমজানে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি ঠেকাতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সরবরাহ ব্যবস্থায় জোর দেওয়া হয়েছে। টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড ও ঢাকা-চট্টগ্রাম বিভাগে ট্রাকসেল আবার চালু করা হয়েছে। এই সেবা সাময়িক বন্ধ করে দিয়েছিলাম। তখন দরকার ছিল না। কৃষি মন্ত্রণালয়কে বললাম, অর্থ দিয়ে তোমরা এটা চালু করো। তারা আবার শুরু করেছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় ভর্তুকিমূল্যে চাল বিক্রয় করবে। সব জায়গায় নয়। যেমন- আমরা চিন্তা করছি, কিছু কিছু জায়গায় বিশেষ করে যেসব জায়গায় জেলেরা আছে, চট্টগ্রামে ওদের কার্ড আছে, ওদের চাল কিছুটা বাড়ানোর জন্য চিন্তাভাবনা করছি। সরকারের পক্ষ থেকে যত পণ্য আমদানি করা হচ্ছে যেমন- চাল, গম, মসুর ডাল, খেজুর, এগুলো থেকে শুল্ক তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে কিছু কিছু পণ্যের দাম কমে গেছে। এতে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এটা আরেকটা চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে।
নিত্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ভারত আমাদের বড় উৎস। বেনাপোল আবার বন্ধ করে দিল, ওটা ছিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এখন পাকিস্তান থেকেও চাল আসছে। আবার আমরা ভিয়েতনাম থেকেও আনছি। গম এখন রাশিয়া, ইউক্রেন থেকে আনছি। অতএব, আমরা আশা করছি, রোজার সময় তেমন কোনো সমস্যা হবে না। বাজার মনিটরিং করতে হবে। জেলা প্রশাসকদের ইতোমধ্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসকদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা আছে। ভোক্তা অধিকারের যারা ম্যাজিস্ট্রেট আছেন, তাদের এ ক্ষমতা দেওয়া আছে। আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ হলো ফরেন এক্সচেঞ্জ। আপনি জানেন রিজার্ভটা আগে কমে গিয়েছিল, এখন বেড়ে রিজার্ভটা ২৫ বিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। এটা ঠিক আছে। আর আমদানির ক্ষেত্রে বকেয়া (আউটস্টান্ডিং) ছিল ৪.৫ বিলিয়ন ডলার। এটা এখন ৪ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। এর জন্য রিজার্ভ থেকে এক টাকাও নেওয়া হয়নি।
খবরের কাগজ: রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে কি না...
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের একটা মূল্য নির্ধারণ করেছে। ব্যাংকারদের বলা হয়েছে- আমরা দেব না, তোমরা বাজার থেকে ডলার সংগ্রহ করো। যেহেতু রেমিট্যান্সের প্রবাহ একটু ভালো। তবে তাদের চাপ বেড়েছে। গতবার খাদ্যদ্রব্য আমদানি করা হয়নি। এবার ৯ মিলিয়ন ডলারের চাল আনতে হবে। ইতোমধ্যে রিজার্ভ কিছুটা বেড়েছে। আমি প্রাইভেট ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলেছি কয়েকদিন আগে। প্রাইভেট ব্যাংকাররা রাজি হয়েছে। মোটামুটি ৬ থেকে ৭টা প্রাইভেট ব্যাংক আছে ভালো। ইসলামী ব্যাংক সবচেয়ে ভালো ছিল। এখন তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে অল্প দিন হলো। প্রাইভেট ব্যাংগুলোর মধ্যে তারা সবচেয়ে বড় ব্যাংক ছিল। বাকি ব্যাংকগুলোর সঙ্গেও কথা বলেছি। ওরা প্রোভাইড করবে, সেখানে আমার গ্যারান্টি দিতে হবে, সেটা আমি দেব। শর্ত হলো- ওরা শুধু ফাইন্যান্স করবে এলসিতে। এস্টেট অপারেশন প্রাইভেটদের জন্য নয়। এলসি কিছুটা সহজ হয়েছে, একেবারে যে সহজ হয়েছে, তা নয়।
রাশিয়ানরা একদিক দিয়ে ভালো- এরা হইচই করে না, টাকা না পেলেও। ওরা মাঝে মাঝে অনুরোধ করে টাকা দেওয়ার ক্ষেত্রে। রাশিয়া স্টেট অন এন্টার প্রাইজ, এরা প্রাইভেট। এরা সরকারের কথা শোনে না। ফরেন এক্সেঞ্জের রিজার্ভ কিছু ভালো হয়েছে, আর রেমিট্যান্সও ভালো অবস্থানে আছে। গত মাসে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। এখন এ খাতে ২ বিলিয়ন ডলারের চেয়ে বেশি আসে। মোটামুটি যে রেটটা আছে, এটা থাকবে। আমাদের লোকজনের মধ্যে আস্থা আসছে।
খবরের কাগজ: হুন্ডির পরিবর্তে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে টাকা পাঠানো কি বেড়েছে?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: এখন হুন্ডি কমে গেছে। এখানে ম্যানিপুলেটরা আছে। তবে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে টাকা পাঠানো বেড়েছে।
খবরের কাগজ: ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন শিল্পকারখানা চালু করা যাচ্ছে না, এ সম্পর্কে কিছু বলুন।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ হলো- এনার্জি প্রাইজটা। গ্যাসের স্বল্পতা, শিল্পগুলো সব চালু করা যাচ্ছে না। গ্যাসের ঘাটতি আছে। এজন্য পাচ্ছে না। এলপিজি আনতে হয়, আবার পেট্রল, ফার্নেস অয়েল আনতে হয়- এগুলোর ক্ষেত্রে বিরাট চাপ পড়ছে আমাদের। এপ্রিল-মের দিকে বেশি চাপ পড়বে। কারণ, গরম এলে এসি চলবে, ইলেকট্রিক সরঞ্জাম বেশি চলবে। আসলে গরমের সময় কনজামশনটা একটু বেশি আসে। শীতের সময় একটু কম। আমরা চেষ্টা করছি কী করা যায়। আবার হুট করে দাম বাড়ানোও যাচ্ছে না। বাড়ালে শিল্পে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। বিরাট সাবসিডি দিতে হয় সরকারকে। এ খাতে ৬২ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। ওদের সঙ্গে বহু মিটিং আমি করেছি যখন বাণিজ্য উপদেষ্টার দায়িত্বে ছিলাম। বড় বড় ইম্পোর্টার আছে কেডিএস, সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ- এরাই বড় শিল্পগোষ্ঠী। ব্যবসায়ীরা তাদের শুধু মুনাফা বোঝে। আমাদের দেশে ব্যবসাটা অন্য দেশের মতো এত কমপিটেটিভ না। আপনি দেখবেন একজন ব্যবসায়ী ১০ বছর আগে এক সময় আপনার সঙ্গে রিকশায় চড়ত, এখন সে মার্সিটিজ গাড়িতে চড়ে।
অপর দিকে লেভেল প্লেইং ফিল্ড থাকে না, তখন ভালো ব্যাবসায়ীরাও মার খেয়ে যাচ্ছে। এখানে রাজনৈতিক ব্যাপার। আমরা এখনো এত কঠোর হতে পারিনি। পুলিশ দিয়ে রিটেইলারদের ধরে নিয়ে আসো। আগের পলিটিক্যাল গভর্নমেন্ট এগুলো করত। অনেক সময় কাকে কোন শাস্তি দিতে হয়, বাইরের লোক কিছুই জানত না। এগুলো আমরা ব্যবহার করছি না। তারা এখনো সক্রিয়। বিভিন্নভাবে তারা এখনো মেনুপুলেট করে। অতএব, এদের ধরার জন্য আমরা মনিটর করছি। আর সিন্ডিকেট একেবারে নিশ্চিহ্ন করা যাবে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ৬ থেকে ৭টা মেজর ইমপোর্টার বাংলাদেশে। আপনি যদি সয়াবিন আনতে চান, ব্রাজিল থেকে একটা বিরাট জাহাজ আসবে। এলসি করতে হবে ৫০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকা। এখন যদি মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ীদের বলেন সয়াবিন আনতে, তারা ১০টা কনটেইনারও আনতে পারবে না। কারণ ওদের দেবেও না। তাদের একটি মাত্র কনটেইনার আনার সক্ষমতা রয়েছে।
এখানে ন্যাচারাল মনোপলি হয়ে যায় কমোডিটি ব্যবসায়। চাল যেমন ৫০ হাজার টনের কমে কেউ দেবে না। ১৫০ টনের ডিও লেটার নেবে, পরে সে আরেকজনের কাছে তা বিক্রি করে দেবে। এটা একটা বিষয়। এটাকে রোধ করা যাচ্ছে না। এটা ডিফিকাল্ট। পলিটিক্যাল গভর্নমেন্ট থাকলে সুবিধা হয়, তাদের অনেক কর্মী আছে। নেতারা যখন বলে এটা কর, ওটা দেখ- ওরা ঘোরাঘুরি করলে বাজারে কিছুটা সুবিধা পাওয়া যায়। বিনা পয়সায় করে না কেউ, করলেও তারা কন্ট্রোল করে। আগে যারা চাঁদা নিত, তারা তো আছেই। নতুন যারা আছে তারাও মনে করছে আমরা ক্ষমতায় আসব- তারাও চাঁদা নিচ্ছে। আবার যারা লোকাল, যারা আশপাশে থাকে, তাদের একটা পাওয়ার আছে। যা তাদের বাদ দিতে পারে না। কারওয়ান বাজারে থাকে, বিভিন্ন বাজারে থাকে।
দোকানদাররাও কন্ট্রোল করে। চাঁদাবাজরা নিজেরা মিলেমিশে থাকে। এদের ভাঙা খুবই জটিল। পলিটিক্যাল ইস্যু ছাড়া, লোকাল লিডারশিপ ছাড়া পারবে না। আমাদের সে লোকাল রিপ্রেজেনটেটিভ নেই। এখন ওয়ার্ড কমিশনাররাও নেই। সিটি করপোরেশনও নেই। ওরা হয়তো নিজের স্বার্থে করে। কারণ ওরা ভাবে, এই এলাকা আমি কন্ট্রোল করব। এই কন্ট্রোলের মধ্য দিয়ে ইনকামও করব। বিষয়গুলো বড়ই জটিল। আরেকটা হয় কী- যখন কোনো দ্রব্যের মূল্য ওপরে উঠে যায়, তখন তা নামানো খুব কঠিন হয়। অনেক ফ্যাক্টর থাকে। সময় লাগবে। আমি আশা করি, রোজার পর হয়তো কিছুটা নেমে আসবে।
দ্বিতীয় কিস্তি আগামী দিন। চোখ রাখুন…