একজন তরুণের বিপথগামী হওয়ার পেছনে নানাবিধ কারণ রয়েছে। কিছু কারণের জন্য রাষ্ট্র দায়ী, আবার কিছু কারণের জন্য সমাজ দায়ী এবং কিছু কারণ পরিবার থেকে সৃষ্ট। বিপথগামী হওয়ার কারণগুলোকে চিহ্নিত করে সমাধানকল্পে তরুণদের জন্য আগামীর সম্ভাবনার বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয়ে সর্বসম্মতভাবে ঐক্যবদ্ধ উপায়ে কাজ করে যেতে হবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে, সে জায়গায় কীভাবে ব্যবস্থা নিয়ে তরুণদের সামনের পথকে সুগম করে তোলা যায়, তার জন্য চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। সামগ্রিক উপায়ে স্থিতিশীল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে, যা টেকসই ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
সাম্য, মানবিকতা ও ন্যায়ের সমাজ গড়ে তুলতে হবে এবং সে লক্ষ্যে কাজ চালিয়ে যেতে হবে। কাজ সম্পাদনে প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়, সৃষ্ট প্রতিকূলতাকে মাড়িয়েই সামনের দিকে পথ চলতে হবে। যেখানে প্রত্যেকেই সমান সুযোগ লাভ করতে পারবে- এমন একটি সমাজব্যবস্থা বিনির্মাণ করতে হবে। মানুষের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা থাকবে, স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের সুযোগ থাকবে এবং সংগঠন করার অধিকার নিশ্চিত হবে। বিশেষ করে উঠতি বয়সী তরুণদের ক্ষেত্র তৈরি করে দিতে হবে; যেখানে দৃঢ় প্রত্যয়ে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণে একটি উন্মুক্ত পৃথিবীর পরিবেশ তারা পেতে পারে।
তরুণদের মধ্যে হতাশা, বিচ্ছিন্নতা ইত্যাদির কারণে তারা পথচ্যুত হয়ে যাচ্ছে। কিশোর অপরাধের হার ও মাত্রা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পথচ্যুত হওয়া এবং কিশোর অপরাধে জড়িত হওয়ার পেছনের কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে। পরিবার ও শিক্ষকদের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। সমাজকাঠামো ও সমাজ ব্যবস্থাপনাকে আরও জোরদার ও অগ্রগামী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। প্রয়োজনে যাদের মধ্যে কিছু বিচ্যুত আচরণ পরিলক্ষিত হয়, তাদের জন্য বিশেষ যত্নের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। সংশোধন সেন্টারের উদ্যোগগুলোকে আধুনিক ও প্রায়োগিক হিসেবে গড়ে তোলা। অন্যের প্ররোচনায় প্ররোচিত হয়ে সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে তরুণদের মধ্যে।
এ প্রবণতা থেকে তরুণদের বের করে নিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে। দেখা যায়, তরুণদের একটি অংশ যাচাই-বাছাই ছাড়া অপতথ্যের ওপর নির্ভর করে ধ্বংসাত্মক কর্মে লিপ্ত হচ্ছে। আবার অনেকেই তরুণদের কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করছে। এ দুষ্টচক্র থেকে তরুণদের মুক্ত রাখতে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। অন্যথায় তরুণদের মধ্যে অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা কোনোভাবেই রোধ করা সম্ভব হবে না। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আন্তরিকতা, হৃদ্যতা ও পারস্পরিক মেলবন্ধনের মাধ্যমে পরস্পর পরস্পরের খোঁজখবর নেওয়ার মাধ্যমে তরুণদের পরিবারের প্রতি ভরসা ও আস্থার জায়গা তৈরি হয়। এ প্রেক্ষাপটে তরুণদের মধ্যে অন্যায়-অনিয়ম থেকে দূরে থাকার পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
তরুণদের মধ্যে মেধা আছে, দেশপ্রেম আছে, আছে আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত। আমাদের কাজ হবে তরুণদের সঠিক পথে পরিচালনা করা। যেসব তরুণ বিপথগামী হচ্ছে কিংবা অপকর্মে জড়িয়ে যাচ্ছে, তাদের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, সঠিক গাইডলাইন ও যত্নের অভাবে তরুণদের পথচ্যুত হওয়ার অসংখ্য উদাহরণ বিদ্যমান। আবার এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে, যেখানে দেখা যায় জেলফেরত অনেকেই সঠিক পথের দেখা পাওয়ায় নতুন জীবনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পেয়েছে। কাজেই তরুণদের নতুন পথের সন্ধান দিতে হবে, যেখানে তারা নিজেদের ভাগ্যান্বেষণে নতুনত্বের স্বাদ গ্রহণ করতে পারে। সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ভূমিকা রাখার মানসে ব্রতী হয়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পায়, প্রত্যেকেই মেধাবী এবং প্রত্যেকের জীবনে সফল হওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা থাকে।
কিন্তু দেখা যায়, দেশের সেরা বিদ্যাপীঠে অধ্যয়ন করেও অনেকে হারিয়ে যায় জীবনের গতিপথ থেকে। কেন তারা হারিয়ে যায়, কেন রাষ্ট্রের জন্য সুফল বয়ে আনতে পারছে না, এর পেছনের কারণ চিহ্নিত করে সব শিক্ষার্থীর জন্য নিরাপদ পরিবেশ ও সুনিশ্চিত ভবিষ্যতের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুদায়িত্ব। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলোয় কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের চাপমুক্ত রাখার পাশাপাশি সুশৃঙ্খল পরিবেশের আবহ সৃষ্টি করতে হবে।
জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার একটি প্রবণতা রয়েছে অধিকাংশের মধ্যে। এ থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে। সবাইকে প্রকৌশল বিদ্যায় পড়তে হবে, বিষয়টা এমন নয়। যার যে বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে তাকে সে বিষয়ে অধ্যয়নের সুযোগ দেওয়া উচিত। আবার রাষ্ট্রের উচিত প্রত্যেক নাগরিকের জন্য কর্মের জোগান নিশ্চিত করা। কর্মের নিশ্চয়তাই পারে শিক্ষার্থীদের সঠিক জ্ঞানার্জন ও জ্ঞানার্জনের আগ্রহকে শাণিত করতে। আবার সব সময় যে সরকারের ওপর নির্ভর করতে হবে, ব্যাপারটি আদতে তেমন নয়।
বেসরকারি পর্যায়ে যারা দায়িত্বশীল ও যাদের সামর্থ্য রয়েছে, তাদের উচিত হচ্ছে তরুণদের সামনের পথচলাকে সুগম করা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেখা যায়, কৃতী গ্র্যাজুয়েট নির্মাণে বেসরকারি পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠান নির্মিত হয়েছে। যেখান থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও দেশের প্রতিনিধিত্ব করছে এবং দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও অবকাঠামো বিনির্মাণে বেসরকারি সেক্টরের যে ভূমিকা অন্য দেশে পরিলক্ষিত হয়, বাংলাদেশে তেমন উল্লেখযোগ্য উদাহরণ লক্ষ করা যায় না। এ ক্ষেত্রে যারা দায়িত্বশীল তাদের মধ্যে এক ধরনের অনীহা দেখা যায়। যোগ্য শিক্ষার্থী গড়ে তুলতে ব্যর্থ হলে আধুনিক শিল্পবিপ্লব ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না। কাজেই বেসরকারি উদ্যোক্তাদের এ বিষয়ে নজর দেওয়া উচিত।
পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে এবং পৃথিবীর এই অগ্রসরমাণতা চলমান থাকবে। বিশ্ব বাজার ব্যবস্থাপনায় প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে যোগ্য নাগরিক ও দক্ষ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে, এ ঘাটতি পূরণের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উভয় সেক্টরে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সরকারের সীমাবদ্ধতা ও সামর্থ্য নিয়ে আমাদের জানা রয়েছে, সরকারের ওপর সব দায় অর্পণ করা সমীচীন নয়। আবার বেসরকারি পর্যায়ে যারা রয়েছেন, তাদেরও সামাজিক দায়বদ্ধতার ব্যাপারে কিছুটা হলেও সচেতন হওয়া উচিত, উদ্যমী হওয়া উচিত। নিজস্ব উদ্যোগে কর্মহীন যুবকদের জন্য কর্মের সংস্থান নিশ্চিত করাও দায়িত্বশীলদের দায়িত্বের মধ্যে বর্তায়।
আবার বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোক্তা হয়ে যারা ক্যারিয়ার গড়তে চান, তাদের জন্য সরকারের বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করে নতুনদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নতুন বার্তা দিতে পারে। দেখা যায়, উদ্যোক্তাদের ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে নানা ধরনের ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয়।
সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিতে গুরুত্বারোপ করতে হবে। প্রতিবছর দেখা যায় অসংখ্য হেক্টর জমি পতিত অবস্থায় থাকে। কোনো জমি পতিত রাখা যাবে না- এই মর্মে সবাইকে অবহিত করতে হবে। পতিত জমিতে যদি সঠিকভাবে চাষাবাদ হয়, তাহলে দেখা যাবে দ্রব্যমূল্য অনেকাংশে কমে আসবে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ক্ষেত্রে বিদেশ নির্ভরতাও কমে আসবে। আবার বিদেশ থেকে যে সাহায্য কিংবা অনুদান আসে তার সঠিক ব্যবস্থাপনা জনগণের সামনে সরকারের তরফ থেকে উপস্থাপন করতে হবে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে এবং যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ উদ্ধারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। মূল্যস্ফীতি কমাতে সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমাতে সরকারের বিশেষ টিমের টহল বাড়ানোর পাশাপাশি দোষীদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে অন্যদের জন্য উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে।
দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার তাগিদে রাষ্ট্রের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। যেখানে অন্যায়-অনিয়মের ঘটনা ঘটবে, সেখানেই প্রতিবাদ করতে হবে। কেননা দেখা যায় অন্যায়-অনিয়মের পর্যায় পার হয়েই অপকর্ম ও অপরাধের ঘটনা ঘটে থাকে। শুরুতেই অনিয়মকে পদদলিত করা সম্ভব হলে অপরাধকর্ম সংঘটিত হওয়ার সুযোগ থাকে না। তাই দৃঢ় প্রত্যয়ে বাংলাদেশের শান্তি ও সুরক্ষা রক্ষার স্বার্থে অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে শূন্যসহিষ্ণু নীতি প্রয়োগ করা উচিত।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]