ঢাকা ৯ মাঘ ১৪৩১, বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫

পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অত্যন্ত দুর্বল

প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:১৭ এএম
পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অত্যন্ত দুর্বল
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম

বায়ুদূষণে ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত শহরের একটি। শুধু ঢাকা নয়, বাংলাদেশের অন্যান্য শহরও দূষিত। ঢাকা তো শিল্পায়িত শহর, আবার বিশাল জনসংখ্যারও শহর। কিন্তু যেসব শহরে জনসংখ্যা বেশি না, সেখানেও বায়ুদূষণ বাড়ছে। বাতাসে দূষিত কণার পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। নির্মাণকাজ, ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া- এগুলোর কারণে দূষণ বাড়ছে। আবার গাছপালাও কমে যাচ্ছে, জলাশয় কমছে। ঢাকার নগর পরিকল্পনা খুবই দুর্বল। আবার যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়, সেগুলোর বাস্তবায়নও দুর্বল। তথাকথিত উন্নয়ন বা নির্মাণ চলছে। পরিকল্পনার দায়িত্বে রাজউক, তারা সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। পরিকল্পনাও ঠিকমতো নিতে পারছে না। আবার সিটি করপোরেশনও ভালোভাবে করতে পারছে না। সরকারি প্রতিষ্ঠানে তো সমস্যা আছেই। ব্যক্তিপর্যায়ে নির্মাণকাজেও কোনো নিয়ম মানা হয় না, নিয়ন্ত্রণ নেই। কর্তৃপক্ষ থেকে কোনো রকমের চাপ নেই। সার্বিক ব্যবস্থাপনা বা সুশাসনের অভাবকেই সবাই দায়ী করবে। উন্নয়ন যারা করবে, পরিকল্পনা করবে, তাদের দুর্বলতা রয়েছে অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা রয়েছে। জনসচেতনতারও অভাব রয়েছে। উন্নয়নকাজেও তদারকির অভাব প্রকট। 

নগর গবেষণা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, সাবেক চেয়ারম্যান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন

বিশেষ সাক্ষাৎকার: ড. মোস্তাফিজুর রহমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে

প্রকাশ: ২২ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:১৩ পিএম
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে

ড. মোস্তাফিজুর রহমান একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর সম্মানীয় ফেলো। তিনি সিপিডির নির্বাহী পরিচালক (২০০৭-১৭) এবং তারও আগে সিপিডির গবেষণা পরিচালক (১৯৯৮-০৭) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ড. মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে শিক্ষক হিসেবে ২৫ বছর অধ্যাপনার পর ২০১২ সালে সিপিডিতে পূর্ণকালীন দায়িত্ব পালনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। রাজস্ব, আর্থিক নীতি এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বাণিজ্যনীতি এবং বাণিজ্য সংস্কার, বহুপক্ষীয় বাণিজ্যব্যবস্থা এবং নিম্ন আয়ের দেশগুলোর স্বার্থ, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জসহ অর্থনীতির নানা বিষয়ে কথা বলেছেন খবরের কাগজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক শেহনাজ পূর্ণা

যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল অনুঘটক হলো বিনিয়োগ। বিনিয়োগ ছাড়া প্রবৃদ্ধি হয় না। আর দ্বিতীয় কথা হলো, আমি কত ইউনিট বিনিয়োগ করে ১ শতাংশ জিডিপি গ্রোথ করতে পারি। আমি যদি রেশিও কমাতে পারি, তার মানে হলো- আমার উৎপাদনশীলতা ভালো। আমি যদি ৪ ইউনিট দিয়ে ১ শতাংশ জিডিপি গ্রোথের পরিবর্তে ৩ ইউনিট বিনিয়োগ করে ১ শতাংশ জিডিপি গ্রোথ করতে পারি, এটাই উৎপাদনশীলতা। এই উৎপাদনশীলতাটুকু জরুরি। আমাদের দেশে যেটা দেখছি, ২৪-২৫ শতাংশের মধ্যে বিনিয়োগ থমকে আছে কয়েক বছর। ক্রেডিট যা নেওয়া হয় ব্যাংক থেকে বিনিয়োগের জন্য, এখানেও স্থবিরতা দেখছি। আমরা দেখছি যে, আমদানি ক্রেডিটের মেশিনারি করে আমদানির মাধ্যমে যন্ত্রপাতি এনে যে বিনিয়োগ করা হয়, সেই আমদানি নিয়েও একটা স্থবিরতা আছে। সবটা মিলিয়ে বিনিয়োগে একটা বড় ধরনের স্থবিরতা আছে। এর সঙ্গে কর্মসংস্থান, শোভন কর্মসংস্থান, আয় বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতির চাপকে সামাল দেওয়া- অনেক কিছু জড়িত। সুতরাং আমাদের অবশ্যই বিনিয়োগে চাঞ্চল্য আনতে হবে। সে ক্ষেত্রে এক ধরনের অনিশ্চয়তা ছিল গত কয়েক মাসে। বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিল- ঘটনা কোন দিকে যায়। এখন নিশ্চয়তা বা স্বস্তির একটা সময় এসেছে। কাজেই আশা করব যে, বিনিয়োগকারীরা সে সুযোগটা নেবেন। বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরাও আসবেন। দুটি ভালো 
পদক্ষেপ হয়েছে; সেটা হলো- আমাদের রিজার্ভের ওপর চাপ 
কিছুটা কমেছে। এলসি খোলার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা ছিল, এগুলো ক্রমান্বয়ে তুলে নেওয়া হচ্ছে।…


খবরের কাগজ: কর-জিডিপি অনুপাতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে নিচে। রাজস্ব আহরণ বাড়াতে কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার বলে মনে করেন?
ড. মোস্তাফিজুর রহমান: কর-জিডিপির অনুপাতে উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে কেবল শ্রীলঙ্কাই আমাদের কাছাকাছি আছে। অর্থাৎ প্রতিবেশী দেশগুলোর কর-জিডিপির অনুপাত আমাদের দ্বিগুণের মতো। এটার ফলে বাংলাদেশ একটা বিপজ্জনক এবং বাধ্যতামূলক ঋণনির্ভরতার মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। যেটা থেকে আবার ঋণ পরিষেবার একটা বড় চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। যা আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। সুতরাং অবশ্যই আমাদের কর-জিডিপির হার বাড়াতে হবে।

 সেখানে বর্তমান সরকার সংস্কার কমিটি করেছে। সেই সংস্কার কমিশন কাজ করেছে। তারা বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ দিচ্ছে। আমার মনে হয় যে, একটা হতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠন এবং দ্বিতীয়ত হতে হবে প্রযুক্তির বাস্তবায়ন। প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে এখন যে সিস্টেম আছে, এটাতে বড় ধরনের পরিবর্তন করতে হবে। এনবিআরের নিজস্ব যে জনশক্তি আছে, তা দিয়েই কাজ পরিচালনা করতে হবে। এনবিআরের নীতিমালা প্রণয়ন এবং নীতিমালা বাস্তবায়ন দুই ভাগে ভাগ করতে হবে। এনবিআরে যারা কাজ করেন তাদের ওপরের দিকে ওঠার রাস্তা যাতে রাখা হয়, এমন ধরনের সংস্কার করতে হবে। এটার একটা দিক আছে, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার। প্রযুক্তিকে যত বেশি কাজে লাগানো যাবে তত বেশি সুফল পাওয়া সম্ভব হবে। আমরা ইতিবাচক একটা দিক দেখলাম যে, এবার ই-সাবমিশন বা ইলেকট্রনিক সাবমিশন অনেক ভালো হয়েছে। করপোরেটের ক্ষেত্রে, ব্যক্তি খাতের ক্ষেত্রে এগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে। ডিজিটাল প্রস্তুতিটা রাখতে হবে। আমাদের কাস্টমস, ভ্যাট, ইনকাম ট্যাক্স- এগুলোর মধ্যে একটা সমন্বয় করতে হবে। যে সফটওয়্যারগুলো তারা ব্যবহার করেন সে ক্ষেত্রে ইন্টার অপারেবিলিটি থাকে। একটার সঙ্গে আরেকটার সংযোগ একই সঙ্গে সমন্বয় থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও  অন্যান্য ব্যাংকের সঙ্গে থাকে- যাতে ইন্টিগ্রেটেড সিস্টেম আমরা করতে পারি। আমাদের প্রত্যক্ষ কর মাত্র ৩২-৩৩ শতাংশ। এটাকে আরও কীভাবে বাড়ানো যায় তা ভাবতে হবে। সেটা করতে গেলে ইন্টার-অপারেবিলিটি অব দ্য সিস্টেমস অর্থাৎ কাস্টমস, ভ্যাট, ইনকাম ট্যাক্স- এগুলোর সমন্বয় করতে হবে। বেশি বেশি প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইনকাম ট্যাক্সের কাজকে কেন্দ্রীয়ভাবে করতে হবে। এটা বিভিন্ন দেশে আছে।

 ভারতে যে রকম আধার কার্ড প্রচলন করা হয়েছে, ইচ্ছা করলে আমরা সে রকম পারসোনাল অ্যাকাউন্ট নম্বর বা যেটা আমরা টিন বলি সেটার মাধ্যমে ইনফরমেশন দিতে পারবে। আধারের ইউনিক নম্বর দিয়ে তারা বড় ধরনের সব খরচের হিসাব করতে পারবে। তাহলে যিনি ইনকাম ট্যাক্সের বিষয়গুলো দেখেন, তিনি তখন সমন্বয় করতে পারবেন। একটা মানুষ কী রকম ব্যয় করছেন আর তিনি আয় করে কত দেখাচ্ছেন সেটা জানা যাবে। বিভিন্ন দেশে এগুলোর বেস্ট প্র্যাকটিস বা ব্যবহার আছে। এগুলো গ্রহণ করতে হবে। আমার মনে হয় যে, ট্যাক্স-জিডিপির অনুপাত বাড়ানোর বিশাল সুযোগ আমাদের আছে। সাধারণ জনগণের ওপর অপ্রত্যক্ষ কর বাড়িয়ে নয়, প্রত্যক্ষ কর কীভাবে আমরা বাড়াতে পারি সেই চিন্তা করতে হবে। যাদের কর দেওয়ার শক্তি আছে, কিন্তু দেন না, যাদের বিভিন্ন সময় শুল্ককর ১০ শতাংশ দিলেই সব সাদা করা যাবে, রিয়েল এস্টেট, বিনিয়োগ করলে সাদা করা যাবে- এ ধরনের যারা আছেন, তাদের প্রণোদনা দিয়ে চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু কাজ হয়নি। তা থেকে সরে এসে ডিজিটালাইজেশনে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং এনবিআরের মধ্যে জবাবদিহি এবং প্রণোদনা দুটির সমন্বয় করে আমাদের এগুলো মোকাবিলা করতে হবে। কারণ দেখা যাচ্ছে যে, রাজস্ব যা আহরণ করি, রাজস্ব ব্যয়ে তা চলে যায়। পুরো উন্নয়ন ব্যয়টা হয়ে গেছে ঋণনির্ভর। হয় অভ্যন্তরীণ, নয় বৈদেশিক। এটা টেকসই হবে না। যার ফলে বিনিয়োগ পরিষেবার ভার ক্রমান্বয়ে বাড়ছেই। আমরা যদি রাজস্ব আদায় বাড়াতে পারি, তাহলে উদ্বৃত্ত রাজস্ব দিয়েও উন্নয়ন ব্যয়ের একটা অংশ মেটাতে পারব। ঋণনির্ভরতা এবং সুদাসলের কারণে বড় ধরনের একটা অঙ্ক আমাদের বাজেটে রাখতে হচ্ছে; যা রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। এটা টেকসই হয় না এবং এটা থেকে আমাদের ফিরে আসতে হবে।

খবরের কাগজ: বেসরকারি বিনিয়োগ অনেক বছর ধরে একই জায়গায় স্থবির হয়ে আছে। বিনিয়োগ বাড়াতে সরকার কী পদক্ষেপ নিতে পারে?
ড. মোস্তাফিজুর রহমান: যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল অনুঘটক হলো বিনিয়োগ। বিনিয়োগ ছাড়া প্রবৃদ্ধি হয় না। আর দ্বিতীয় কথা হলো, আমি কত ইউনিট বিনিয়োগ করে ১ শতাংশ জিডিপি গ্রোথ করতে পারি। আমি যদি রেশিও কমাতে পারি, তার মানে হলো- আমার উৎপাদনশীলতা ভালো। আমি যদি ৪ ইউনিট দিয়ে ১ শতাংশ জিডিপি গ্রোথের পরিবর্তে ৩ ইউনিট বিনিয়োগ করে ১ শতাংশ জিডিপি গ্রোথ করতে পারি, এটাই উৎপাদনশীলতা। এই উৎপাদনশীলতাটুকু জরুরি। আমাদের দেশে যেটা দেখছি, ২৪-২৫ শতাংশের মধ্যে বিনিয়োগ থমকে আছে কয়েক বছর। ক্রেডিট নেওয়া হয় ব্যাংক থেকে বিনিয়োগের জন্য, এখানেও স্থবিরতা দেখছি। আমরা দেখছি যে, আমদানি ক্রেডিটের মেশিনারি আমদানির মাধ্যমে যন্ত্রপাতি এনে যে বিনিয়োগ করা হয়, সেই আমদানি নিয়েও একটা স্থবিরতা আছে। সবটা মিলিয়ে বিনিয়োগে একটা বড় ধরনের স্থবিরতা আছে। এর সঙ্গে কর্মসংস্থান, শোভন কর্মসংস্থান, আয় বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতির চাপকে সামাল দেওয়া- অনেক কিছু জড়িত। সুতরাং আমাদের অবশ্যই বিনিয়োগে চাঞ্চল্য আনতে হবে।

 এক ধরনের অনিশ্চয়তা ছিল গত কয়েক মাসে। বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিল- ঘটনা কোন দিকে যায়। এখন নিশ্চয়তা বা স্বস্তির একটা সময় এসেছে। কাজেই আশা করব যে, বিনিয়োগকারীরা সে সুযোগটা নেবেন। বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরাও আসবেন। দুটি ভালো পদক্ষেপ হয়েছে; সেটা হলো- আমাদের রিজার্ভের ওপর চাপ কিছুটা কমেছে। এলসি খোলার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা ছিল, এগুলো ক্রমান্বয়ে তুলে নেওয়া হচ্ছে। ক্যাপিট্যাল মেশিনারিজের আমদানি, বিভিন্ন ইন্টারমিডিয়েট ইনপুটের আমদানি- এগুলোর মধ্যে কিছুটা চাঞ্চল্য আমরা দেখছি। সেটার একটা প্রতিফলন ১৩ শতাংশ ইন্টারেস্ট রপ্তানি বৃদ্ধির মধ্যে আমরা দেখেছি। বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে অভ্যন্তরীণ বাজার। নতুন বিনিয়োগ করে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তার পর সেই টাকা খরচ করার ক্ষেত্রে এখনো প্রতিবন্ধকতা আছে। ১৫-১৬ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে একজন ব্যবসায়ী কত মুনাফা করতে পারবেন। যেটা দিয়ে তিনি বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন! সুতরাং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আসছে। দ্বিতীয় হচ্ছে, অনেক জায়গায় আমরা স্পেশালি ইকোনমিক জোন করেছিলাম। যেখানে বিনিয়োগকারীদের নিষ্কণ্টক জমি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটার সঙ্গে আমাদের অন্য সার্ভিসগুলো দিতে হবে।

 আমরা একটা ওয়ানস্টপ সার্ভিস করেছি ২০১৮ সালে। সেটা আমরা এখনো কার্যকর করতে পারিনি। এগুলোকে নিশ্চিত করতে হবে। ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালু করতে হলে আমাদের বিদ্যুৎ, গ্যাস দিতে হবে। যোগাযোগব্যবস্থা ভালো করতে হবে। এসব জায়গায় আমাদের বড় ধরনের একটা দুর্বলতা রয়েছে। এটাকে মোকাবিলা করতে হবে। বর্তমান সরকার ১০০টা প্ল্যানের জায়গা থেকে সরে এসে ১০টা স্পেশাল জোনকে ভালোভাবে চালু করতে চাচ্ছে। আমরা কিন্তু আগেই বলেছিলাম, ১০০টা স্পেশাল জোন করার জন্য জমি অধিগ্রহণ না করে ১০ থেকে ১২টা করে ভালোভাবে চালান। বর্তমান সরকার এ পদক্ষেপগুলোই এখন নিচ্ছে। আমার মনে হয় এটা খুব ভালো যে, তারা এটা করতে চাচ্ছে। এটা হলে বিনিয়োগে চাঙাভাব আসবে। আর যারা বৈদেশিক বিনিয়োকারী, যারা আমাদের দেশে ২ বিলিয়ন ডলারের মতো নেট এসডিআই নিয়ে আসে, ভিয়েতনামে যেখানে ১৮ থেকে ২০ বিলিয়ন ডলার, কম্বোডিয়া কত ছোট একটা দেশ- সেখানেও বৈদেশিক বিনিয়োগ অনেক বেশি। বৈদেশিক বিনিয়োগ যদি বাড়ানো যায় তাহলে রপ্তানি বাজারে একটা ভালো সংযোগ থাকে। আমাদের রপ্তানিও বাড়ে। আমরা ৫০ বিলিয়ন ডলারের মতো রপ্তানি করি। 

ভিয়েতনামের অর্থনীতি সাইজে আমাদের থেকে ছোট। তারা ৩৮০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করেছে গত বছর। সুতরাং যারা আমদানি করবে, রপ্তানি করবে এবং স্পেশাল জোনগুলো ব্যবহার করবে, তাদের জন্য ওয়ানস্টপ সার্ভিসের ক্ষেত্রে গ্যাস, বিদ্যুৎ, সেন্ট্রাল প্ল্যান, দক্ষ জনশক্তিসহ বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করতে হবে। শুধু জোন করলেই হবে না। আরও অনেক সমান্তরাল কাজ আমাদের করতে হবে। সেসব জায়গায় এখনো অনেক দুর্বলতা আছে। যা এখন উদ্যোগ-উদ্যম নিয়ে চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক একটা পুনর্গঠন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আবার বিভিন্ন ধরনের পলিসিগত পরিবর্তনও আনার চেষ্টা চলছে এবং তা বাস্তবায়নের চেষ্টাও চলছে। বিনিয়োগ ছাড়া প্রবৃদ্ধি হবে না, কর্মসংস্থান হবে না, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা, জীবনমান উন্নত হবে না। সেই বিনিয়োগ মূলত ব্যক্তি খাতেই করতে হবে। আমাদের দেশে ব্যক্তি খাত ৪ টাকা বিনিয়োগ করলে, সরকার বিনিয়োগ করে ১ টাকা। ব্যক্তি খাত সরকারি বিনিয়োগকে চাঙা করতে পারে। সুতরাং সরকারি খাতের বিনিয়োগ ও ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের মধ্যে এটা সমান্তরাল সমন্বয় দরকার আছে। যাতে করে ব্যক্তি খাত সরকারি বিনিয়োগের সুবিধা নিয়ে ব্যবসা করতে পারে। 

খবরের কাগজ: আমাদের দেশে তরুণ উদ্যোক্তা তৈরি করতে কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি?
ড. মোস্তাফিজুর রহমান: নতুন উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্রে আমি বলব যে, দেশের অর্থনীতিতে শতকরা প্রায় ৫৬ ভাগ হলো সার্ভিসেস সেক্টর। কৃষি ১২ শতাংশ, বাকি যেটুকু থাকে ওইটুকু হলো আমাদের শিল্প খাত, অর্থাৎ ৩২ শতাংশ। তার মধ্যে ম্যানুফ্যাকচারিং আরও কম। সার্ভিসেস সেক্টরে নতুন অনেক ধরনের কর্মকাণ্ডের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। আমি বলব- শুধু শিল্পোদ্যোক্তা নয়, সার্ভিসেস সেক্টর, ই-সার্ভিস, আইটি অ্যানাবল সার্ভিসেও নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে। যারা আসতে চাচ্ছেন তাদের জন্য দেশের শিল্প খাতের উন্নয়নের জন্য আমাদের ইনসেনটিভ আছে। সেবা খাতে যে উদ্যোক্তা ইয়াং জেনারেশন, তাদের জন্য স্পেশাল উইনডো সৃষ্টি করা দরকার। এগুলোতে আরও উদ্যোগ-উদ্যম নিয়ে কাজ করতে হবে। ইন্টারনেটের স্পিড বাড়ানো, তার খরচ কমানো- আইটি অ্যানাবল সার্ভিসে যারা আসে তাদের জন্য এ সুযোগগুলো অবারিত করতে হবে। নতুন নতুন খাতে সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের দেশে ই-কমার্স এখন সম্প্রসারিত হচ্ছে। বিশেষত কোভিডের পর থেকে এই জায়গাগুলোতে নতুন উদ্যোক্তারা আসছেন। শিল্পোদ্যোক্তা ও সেবা খাতের উদ্যোক্তা- দুটির দিকে নজর দিতে হবে। যাতে করে কর্মসংস্থান বাড়ে, আবার রপ্তানিও আমরা করতে পারি। সুতরাং একটা সমন্বিত পরিকল্পনা দরকার। বিশেষত, সেবা খাতে উদ্যোক্তাদের কীভাবে আমরা সহায়তা করতে পারি। আমরা জানি যে, ইন্ডিয়ায় আইটি অ্যানাবল সার্ভিসের এক্সপোর্টই হলো ১৬০ থেকে ১৭০ বিলিয়ন ডলার। আমার জানা মতে, ১৯৯৯-২০০০ সালে এটা ৫ বিলিয়ন ডলারও ছিল না। এটাকে সমন্বিত পরিকল্পনা নিতে হবে। উদ্যোক্তারা যাতে ওয়ানস্টপ সার্ভিসের সুবিধাটা পেতে পারেন, অবকাঠামোর সুবিধা পেতে পারেন, গ্যাস-বিদ্যুতের সুবিধা পেতে পারেন, আমদানি স্তরে যাতে হয়রানির সম্মুখীন না হন, পোর্টের টান অ্যারাউন্ড টাইম যাতে আমরা কমাতে পারি। আমাদের অনেক বাণিজ্যে, বিশেষ করে ভারত আমাদের বড় ট্রেড পার্টনার। আমরা যদি আমদানি খরচ কমাতে পারি তাহলে এটা ভোক্তা, উদ্যোক্তা, রপ্তানিমুখী শিল্প; যারা আমদানির ওপর নির্ভর করে, তাদের জন্য ইতিবাচক। সুতরাং সেসব জায়গায়ও আমাদের ট্রেড ফেইজ সিলেকশন, বাণিজ্য সহজীকরণের যেসব উদ্যোগ পেপারলেস ট্রেড, সিঙ্গেল উইনডো- এসব জায়গায় নজর দিতে হবে। কারণ ল্যান্ড পোর্টের মাধ্যমে আমাদের এই আঞ্চলিক বাজারে প্রবেশ এবং এটা আমাদের উদ্যোক্তাদের খরচ অনেক কমায়। এই পলিসি কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, সেটার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন রকম সহায়তা করতে হবে। কৃষি খাতে আমরা বাইরে যেতে পারছি না। অ্যাগ্রোবেস্ট ইন্ডাস্ট্রিজ সেখানেও দরকার। আমাদের এসপিএস, ইবিটি- এ ধরনের স্ট্রানভার যা আছে সেগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কুল চেইন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন আছে। এগুলো সামনের দিকে আরও বাড়বে। গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট প্রতিযোগিতার যে পরিবেশ, সেই পরিবেশও চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে। সুতরাং সেটার সঙ্গে তারা যাতে সামঞ্জস্য বিধান করেও উৎপাদন, রপ্তানি করতে পারেন, তাদের সেই সহযোগিতা করতে হবে। একবিংশ শতাব্দীর পরিবর্তিত বাণিজ্য পরিস্থিতি, বিশ্বায়ন পরিস্থিতি- এটাতে তারা শক্তিশালী অবস্থান থেকে যাতে সেখানে ঢুকতে পারেন, সে জন্য তাদের প্রয়োজনমাফিক সহায়তা দিতে হবে। আমাদের যে প্রণোদনা কাঠামো আছে, তার পরিবর্তন লাগবে। রেডিমেট গার্মেন্টসের ভেতরেও অনেক সম্ভাবনা আছে। মেইনমেইড ফাইবারের এখন গ্লোবাল মার্কেট ৭৫ শতাংশ আর আমাদের এখানে মেইনমেইড হলো ২৫ শতাংশ। কটন বেইজড ৭৫ শতাংশ। তার পর আছে আরএমজি বৈচিত্র্যকরণ। আরএমজির বাইরে যারা আসতে চাচ্ছেন, যেমন- সিনথেটিক, লেদার, ফুডওয়্যার, লাইটিং ইঞ্জিনিয়ারিং, আমাদের ফার্মাসিটিক্যালস, আসবাবপত্র ইত্যাদি।

 আমি মনে করি যে, শ্রমঘন যে প্লান্ট আছে- এসব জায়গায় আমাদের বড় ধরনের একটা সুযোগ আছে। এগুলোকে আইডেনটিফাই করে আমরা যদি বিশেষ করে ইকোনমি জোনগুলো, বিশেষ করে নিষ্কণ্টক জমির অভাব বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে। সেটার সঙ্গে সমন্বয় করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি, দক্ষ শ্রমিক তৈরি ভালোভাবে করতে পারলে স্থানীয় বিনিয়োগ এবং  বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে। আগামী ৫ থেকে ১০ বছরে বাংলাদেশও ভিয়েতনামের মতো বড় রপ্তানিকারক দেশ হতে পারবে। রপ্তানির ভেতরে টেকনোলজিক্যাল যে কম্পোনেন্ট, আমাদের দেশে উচ্চ টেকনোলজি কম্পোনেন্ট ১ শতাংশেরও কম আর ভিয়েতনামে ৪৩ শতাংশের বেশি। সেই রকম একটা টেকনোলজিক্যাল রেডিয়েশন করে আমাদের কিন্তু তুলনামূলক যে সুবিধাগুলো আছে, তাকে প্রতিযোগিতার সক্ষমতায় রূপান্তরিত করার একটা সুযোগ আছে। আগামীতে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন হচ্ছে, তখন অনেক রেফারেন্স সুবিধা, বাজারসুবিধা, শুল্কমুক্ত সুবিধা, কোটামুক্ত সুবিধা চলে যাবে। সেখানেও আমাদের উদ্যোক্তাদের সহায়তা করতে হবে। যাতে করে এই বাজার সুবিধানির্ভর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা থেকে তারা দক্ষতা এবং উৎপাদনশীলতানির্ভর প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় উত্তীর্ণ হতে পারে। যার মাধ্যমে আমরা আমাদের স্বল্পোন্নত দেশের গ্র্যাজুয়েশন, যেটা ২৪ নভেম্বর ২০২৬-এ হবে, তা টেকসইও মসৃণভাবে বাস্তবায়ন করতে পারি। 

খবরের কাগজ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। 
ড. মোস্তাফিজুর রহমান: আপনাকেও ধন্যবাদ।

বিশেষ সাক্ষাৎকার: ড. মোস্তাফিজুর রহমান সংস্কার ও নির্বাচনি প্রস্তুতি সমান্তরালভাবে চলুক

প্রকাশ: ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৩৯ পিএম
আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৪১ পিএম
সংস্কার ও নির্বাচনি প্রস্তুতি সমান্তরালভাবে চলুক
ড. মোস্তাফিজুর রহমান

ড. মোস্তাফিজুর রহমান একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর সম্মানীয় ফেলো। তিনি সিপিডির নির্বাহী পরিচালক (২০০৭-১৭) এবং তারও আগে সিপিডির গবেষণা পরিচালক (১৯৯৮-০৭) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ড. মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে শিক্ষক হিসেবে ২৫ বছর অধ্যাপনার পর ২০১২ সালে সিপিডিতে পূর্ণকালীন দায়িত্ব পালনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। রাজস্ব-আর্থিক নীতি এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বাণিজ্যনীতি এবং বাণিজ্য সংস্কার, বহুপক্ষীয় বাণিজ্যব্যবস্থা এবং নিম্ন আয়ের দেশগুলোর স্বার্থ, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জসহ অর্থনীতির নানা বিষয়ে কথা বলেছেন খবরের কাগজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক শেহনাজ পূর্ণা

খবরের কাগজ: অন্তর্বর্তী সরকার প্রায় ছয় মাস ধরে রাষ্ট্রক্ষমতায় রয়েছে। এই সরকারের সফলতা-ব্যর্থতা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী? 
ড. মোস্তাফিজুর রহমান: অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশে একটা রূপান্তরের সময়ে এসেছে এবং একটা শূন্যতার মধ্যে তাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসতে হয়েছে। সেটা ছিল এমন একটা সময়, যখন একটা রাজনৈতিক শূন্যতা ছিল, আইনশৃঙ্খলার শূন্যতা, আস্থার শূন্যতা, আবার একটা পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাও ছিল। জনমানুষের সামনে জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার যে আন্দোলন তার প্রেক্ষাপট, সেদিকটা আমাদের বিচার-বিবেচনায় রাখতে হবে। সাফল্য-ব্যর্থতার কথা যদি বলতে হয় বা মূল্যায়ন করতে হয়, তাদের একটা বড় সাফল্য যে, তারা শূন্যতাকে পূরণ করেছে। মানুষকে অনিশ্চয়তা এবং আস্থাহীনতার জায়গা থেকে স্বস্তির জায়গায় নিয়ে এসেছে। অন্যদিক থেকে এটাও বলতে হয় যে, তারা মাত্র পাঁচ মাস হলো রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। সুতরাং এখনই তাদের সাফল্য-ব্যর্থতা মূল্যায়নের উপযুক্ত সময় আসেনি। আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে, কীভাবে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের দিকে আমরা যেতে পারি। কীভাবে নির্বাচন করে তারা ক্ষমতা হস্তান্তর করতে সক্ষম হন। সবকিছুর ওপরেই তাদের সাফল্য-ব্যর্থতা মূল্যায়নের একটা সুযোগ তখন সৃষ্টি হবে। তার পরও আমি বলব যে, তারা জনগণকে একটা স্বস্তির জায়গায় নিয়ে এসেছেন। উদ্যোক্তা, ভোক্তা, সাধারণ জনগণ, উৎপাদক, রপ্তানিকারক- সবাই এখন একটা মোটামুটি ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ এবং আস্থার জায়গা থেকে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন। যদিও উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ অর্থনীতিতে অব্যাহত রয়েছে। ফলে জনগণের জীবনমানে তিন বছরে আমরা যা দেখেছি, সেটার বড় ধরনের পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু তারা চেষ্টা করছেন। সরবরাহ চেইনে যে প্রতিবন্ধকতা, তা সবটা দূর হয়নি। আমাদের তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি ছিল। আমদানি কখন করতে হবে, কতটুকু মজুত রাখতে হবে, কতটুকু মজুত থেকে পরে ছাড় দিতে হবে- এসব ব্যাপারে তথ্য-উপাত্তভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই আমরা কিছু দুর্বলতা লক্ষ করছি। তারা ক্রমান্বয়ে তা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে, আয়ত্তের মধ্যে নিয়ে আসবেন বলে মনে করছি। এ ক্ষেত্রে যা ইতিবাচক হয়েছে, তা হলো তারা রিজার্ভের অবনমন রোধ করতে পেরেছেন। টাকার যে বিনিময় হার, সেটার বড় ধরনের একটা ওঠানামা ছিল, তা তারা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছেন। আমাদের রপ্তানি খাতও ভালো করছে।

 প্রথম ছয় মাসে প্রায় ১৩ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আমাদের রেমিট্যান্স সর্বকালের মধ্যে বেশি এসেছে ২০২৪-এ। সেটার ইতিবাচক প্রভাবও রিজার্ভে পড়েছে। আশা করি, পরবর্তী সময়ে আমদানির লাইসেন্স খোলার ক্ষেত্রে, সরবরাহের ক্ষেত্রে সেটার একটা ইতিবাচক প্রভাব আমরা দেখতে পাব। আমি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে যেটা দেখি, তা হলো বিনিয়োগকারীরা এখনো চাঞ্চল্য দেখাচ্ছেন না। এর সঙ্গে কর্মসংস্থান হ্রাসও জড়িত। আয়বর্ধক শোভন কর্মসংস্থান সৃষ্টির যে আশু তাগিদ, সেটা আমরা এখনো দেখছি না। আমাদের সামনে বাজেট আসছে। সেখানে আমরা একটা দিকনির্দেশনা নিশ্চয়ই পাব। বড় ধরনের ইতিবাচক পদক্ষেপ হলো, শ্বেতপত্রের সদস্য হিসেবে শ্বেতপত্র প্রকাশ করে অর্থনীতির প্রকৃত অবস্থা জানার একটা সুযোগ হয়েছে আমাদের। সেখানে আমার নিজেরও অবদান রাখার সুযোগ হয়েছে। বিভিন্ন কমিশন করা হচ্ছে। তারা যেসব সংস্কার কর্মকাণ্ড নির্দিষ্ট করবেন বা সুপারিশ করবেন, আশা করি অন্তর্বর্তী সরকার সেগুলো নিয়ে কাজ শুরু করবে। সব মিলিয়ে আমি দেখি যে, তারা একটা ঐতিহাসিক ক্রান্তিলগ্নে বড় ধরনের ইতিবাচক ভূমিকা রাখছেন। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও তাদের কিছু কিছু সাফল্য আছে। অর্থনীতিতে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেমন- উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ, বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনা, বৈদেশিক বিনিয়োগ আহরণ করা, ব্যাংকিং খাতসহ অন্যান্য খাত থেকে যে টাকা চলে গেছে, তা ফেরত নিয়ে আসা ইত্যাদি। সে ক্ষেত্রে বিভিন্ন টাস্কফোর্স করা হয়েছে। আমাদের ব্যাংকিং খাতের সংস্কার কার্যক্রমকে বেগবান করতে হবে। এসব চ্যালেঞ্জ অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে আছে। সুতরাং আমাদের প্রত্যাশার একটা দিক আছে, আবার আকাঙ্ক্ষারও একটা দিক আছে। দুটোর মধ্যে আগামীতে একটা সামঞ্জস্য এবং সমন্বয় করে জনগণের স্বপ্ন পূরণ করতে হবে।

খবরের কাগজ: সরকার ইতোমধ্যেই বেশ কিছু সংস্কারকাজে হাত দিয়েছে। আপনি কি মনে করেন সব সংস্কারকাজ শেষ হওয়ার পরই নির্বাচন হওয়া উচিত?
ড. মোস্তাফিজুর রহমান: এখানে আমার মনে করার বিশেষ কিছু নেই। তার কারণ হলো, প্রধান উপদেষ্টা একটা সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন যে, জুন ২০২৬-এর মধ্যে নির্বাচন হবে। আমি মনে করি, এটা সঠিক সিদ্ধান্ত। সংস্কার কার্যক্রম অবশ্যই প্রয়োজন। সেগুলোর জন্য কমিশন হয়েছে। তারাও তাদের সুপারিশগুলো ইতোমধ্যে দিয়েছেন। সেগুলোর বাস্তবায়ন মূলত নির্বাচিত সরকারকে করতে হবে। এখানে অনেক ধরনের আইনি ব্যাপার আছে, রেগুলেটরি ব্যাপার আছে, আইন পরিবর্তনের ব্যাপার আছে, সাংবিধানিক বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয় আছে। এগুলো নির্বাচিত সরকারকে করতে হবে। রাজনৈতিক মাঠের খেলোয়াড় যারা আছেন, রাজনৈতিক শক্তি আছেন, তাদেরই সংস্কারগুলোকে গ্রহণ করতে হবে। তারা যদি গ্রহণ না করেন তাহলে নির্বাচিত হওয়ার পর তারা সেগুলো বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে অনেক শৈথিল্য দেখাবেন। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, নির্বাচনের প্রস্তুতি এবং সংস্কার কর্মসূচি সমান্তরালভাবে চলবে। 
সেটার বাস্তবায়ন কিন্তু বেশির ভাগ নির্ভর করবে নবনির্বাচিত যে সরকার আসবে তাদের ওপর। আমরা আশা করছি, সুষ্ঠু, স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক একটা নির্বাচন হবে। যার মাধ্যমে সরকার গঠিত হবে। সেই সরকারকেই সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে এসব সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণে অবদান রাখতে হবে এবং ক্রমিত হয়ে গেলে সেটার মালিকানা গ্রহণ করতে হবে এবং কর্মসূচি বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করতে হবে। সুতরাং সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের পর নির্বাচন- এটা আমার মনে হয় খুব যুক্তিসংগত নয়। কারণ, অনেক সংস্কার আছে, যেসব সংস্কার অনেক বছর লাগবে। যেমন- প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি। এত বছরের পুঞ্জীভূত সমস্যা, বিভিন্ন ধরনের রেগুলেটরি, আইনি সমস্যা- এগুলো দু-এক বছরে আমরা সমাধান করতে পারব না। এগুলো বাস্তবায়ন করতে গেলে যথেষ্ট সময় লাগবে। প্রশাসনিক সংস্কার, আইনি সংস্কার কিংবা নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার হয়তো আমরা করতে পারব। তারপর যেসব পরামর্শ থাকবে সেগুলো পরবর্তী সময়ে নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতাদের করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা যেটা বলেছেন, অর্থাৎ সংস্কারকাজ ও নির্বাচনি প্রস্তুতি- এ দুটি সমান্তরালভাবে চলবে এবং নির্বাচন জুন ২০২৬-এর মধ্যে সম্পন্ন করে ফেলতে হবে। আমি মনে করি যে, এটিই যুক্তিসংগত।

খবরের কাগজ: দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীলতার জন্য সরকারের কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
ড. মোস্তাফিজুর রহমান: আমাদের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিশ্চয়ই উন্নয়ন করতে হবে। কারণ, ইতোমধ্যে অনেক জায়গায় আমরা দেখেছি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বেশ অবনতি হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় সামরিক বাহিনীর সহায়তা নিতে হয়েছে। পুলিশে বড় ধরনের একটা বিপর্যয় হয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে অনেক জায়গায় পুলিশ বাহিনী তাদের কাজ করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। অবকাঠামোগুলো নষ্ট হয়েছে। তাদের নীতিগতভাবে বড় ধরনের বিপর্যয় হয়েছে। সব মিলিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর একটা বড় প্রভাব পড়েছে। তার পরও আমি বলব যে, সরকারের বড় ধরনের উদ্যোগ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। এটার সঙ্গে বিনিয়োগের নিরাপত্তাও আছে। এমনকি সামষ্টিক অর্থনীতি পরিচালনার জন্য ইতিবাচক পরিস্থিতির বিষয়ও আছে। সুতরাং আমি অবশ্যই মনে করি যে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও উন্নতির সুযোগ আছে। সেখানে আরও জনবল বৃদ্ধি করতে হবে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের মনোভঙ্গির পরিবর্তন দরকার। এসব দিকে এখন নজর দিতে হবে। আরও উদ্যোগ-উদ্যমের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতির জন্য কাজ করতে হবে বলে আমি মনে করি।

খবরের কাগজ: নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। কিছু পণ্যের আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারের পরও সেই সব পণ্যের দাম কমছে না। এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
ড. মোস্তাফিজুর রহমান: নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের যে অব্যাহত ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখছি, সেই প্রবণতা অবশ্যই জনগণের জীবনমানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এটা আমাদের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকেও অনেক দুর্বল করে দিচ্ছে। এগুলো থেকে উত্তরণে আমাদের ব্যাংকে যারা টাকা রাখবেন, তাদের উৎসাহিত করার জন্য ডিপোজিটের ওপর ইন্টারেস্ট বাড়াতে হচ্ছে। সেটার ওপর ভিত্তি করে আমাদের ঋণের সুদহার বাড়াতে হচ্ছে। সেটার একটা প্রতিফলন আমরা দেখছি, তা হলো বিনিয়োগে এক ধরনের স্থবিরতা। উচ্চ মূল্যস্ফীতি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও সামাজিক ব্যবস্থাপনাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। আমরা দেখছি যে, সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে। আমি মনে করি না যে, সংকুচিত মুদ্রানীতি দিয়েই কেবল এটার সমাধান করা যাবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি মুদ্রানীতির ওপর নির্ভর করে না। শুল্কনীতি কিছুটা সরাসরি কাজ দেয়। মুদ্রানীতির একটু প্রলম্বিত প্রভাব থাকে অর্থনীতির ওপর। শুল্কনীতি দ্রুত কাজ দেয়। সে ক্ষেত্রে তারা শুল্কনীতি কিছুটা প্রয়োগ করেছেন। নিত্যপণ্যের মূল্য কিছুটা কমিয়েছেন। তারা আবার কিছুদিন আগে শতাধিক পণ্যের ওপর ভ্যাট ও শুল্কহার বাড়িয়েছে। এতে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত যারা আছেন তারা সমস্যায় পড়বেন। সুতরাং বিনিয়োগে আস্থা এনে সরবরাহ চেইনকে সহজ করে সময়মতো আমদানির মাধ্যমে সরবরাহ এবং চাহিদার মধ্যে পার্থক্য কমিয়ে বাজারে নজরদারি-খবরদারি বাড়াতে হবে। নজরদারির ক্ষেত্রে যেসব প্রতিষ্ঠান আছে অর্থাৎ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়- এদের আরেকটু উদ্যোগ-উদ্যম নিয়ে সরবরাহ চেইনে যেন সমস্যা না হয়, সেটা নিশ্চিত করা দরকার। মধ্যম মেয়াদে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা যাতে নিশ্চিত হয়, সে জন্য সামনে আমাদের বড় যে ফসলের মৌসুম আছে, সেটার উৎপাদন নির্বিঘ্ন করতে সার, বীজ, বিদ্যুৎ এগুলোর সরবরাহ নিশ্চিতে নজর দিতে হবে। সরবরাহ চেইনের মধ্যে যেসব প্রতিবন্ধকতা আছে, তা দূর করতে হবে। যোগাযোগব্যবস্থাকে আরও কীভাবে আমরা সহজ করতে পারি, সেদিকে নজর দিতে হবে। ২ টাকার ফুলকপি ঢাকা শহরে এসে যেন ২০ টাকা না হয়, এগুলোর দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আমাদের যোগাযোগব্যবস্থা এখন তো অনেক ভালো। সেটাকে কাজে লাগিয়ে মূল্যের বড় ধরনের বিভাজন দূর করতে হবে। আর এটা করতে হলে প্রক্রিয়াজাতকরণ, কোল্ড স্টোরেজ- এসব বৃদ্ধির দিকে নজর দিতে হবে। 
ব্যক্তি খাতে যারা সামনে আসবেন তাদেরও উৎসাহিত করতে হবে।

খবরের কাগজ: সিন্ডিকেট নিয়ে অনেক লেখালেখি, আলোচনা, কথাবার্তা হয়েছে। কিন্তু সিন্ডিকেট ভাঙা যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে সরকারের করণীয় কী?
ড. মোস্তাফিজুর রহমান: সিন্ডিকেট কথাটা বহুল প্রচলিত। কোন জায়গায় সিন্ডিকেটের আশঙ্কা আছে, কোন জায়গায় সিন্ডিকেট করা সম্ভব নয়- এটাও আমাদের বের করতে হবে। অনেক সময় চাল-ডালের ব্যবসায়ীরা বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। চালের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করেন। এসব জায়গায় নজরদারি বাড়াতে হবে। আমাদের অনেক কিছু আমদানি করতে হয়। যারা আমদানি করছেন, তাদের ভেতরে এক ধরনের একচেটিয়াকরণের প্রবণতা দেখা যায়। তারা বাজারকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। এ ছাড়া অনেক নিত্যপণ্য আছে, সেখানেও যে সিন্ডিটে হয় না, তা নয়। সেখানে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা করা হয়। তার পর রাস্তায় চাঁদাবাজি, বাজারে ঢুকতে না দেওয়া, যারা নাকি ওই বাজার ইতোমধ্যে দখল করে আছেন। কারওয়ান বাজারে আসতে গেলে বাইরের ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। সুতরাং এসব জায়গায় কৃষকরা যাতে তাদের কৃষিপণ্য সরাসরি বাজারজাত করতে পারেন, সে ব্যবস্থা করতে হবে। এতে করে মধ্যস্বত্বভোগীরা অবৈধ সুযোগ নিতে পারবে না। এ রকম কিছু উদ্যোগ আমরা আগে দেখেছিলাম। এগুলোকে অব্যাহত রাখতে হবে। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ যেটা, সেটা হলো বাজার মনিটরিং করে উৎপাদক থেকে শুরু করে আমদানি পর্যায় থেকে কাস্টমস হয়ে ভোক্তা পর্যন্ত যারা আছে, তাদের ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে। যাতে করে কেউ মজুত করে রাখল, তার পর ডিলাররা যখন গেল তখন বলল যে, আমার কাছে তেল নেই। এই জিনিসগুলো যাতে করতে না পারে এবং এগুলোর ক্ষেত্রে যদি বড় ধরনের শাস্তির ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে অন্যরাও নিরুৎসাহিত হবে। আমরা দেখেছি, বেশ কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে এসব সিন্ডিকেশন চেষ্টা করা হয়। এগুলোতে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে। কিছু জায়গায় অন্য সমস্যা আছে। যেমন- যাতায়াত সমস্যা, চাঁদাবাজির সমস্যা, বাজারে ঢুকতে না দেওয়া- এসব আছে। এসব সমস্যা দূর করতে হবে; যাতে কৃষকও লাভবান হয়, আবার ভোক্তাও উপকৃত হয়।

খবরের কাগজ: বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে সরকারের করণীয় কী?
ড. মোস্তাফিজুর রহমান: বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে আমাদের কথা হলো, প্রথমেই হিসাবের ক্ষেত্রে একটা বড় পরিবর্তন এল। আইএমএফ বলল যে, আসলে প্রকৃত রিজার্ভ সেটা নয়। সুতরাং সেখানে একটা স্বচ্ছতা আসছে, এটা খুবই ইতিবাচক। আমরা এখন জানি যে, আমাদের প্রকৃত রিজার্ভ কত আছে, যেটা দিয়ে আমরা আমাদের ব্যয়গুলো মেটাতে পারি। যেমন- আমি আমদানি করতে পারি। আমি আমার বৈদেশিক ঋণ পরিষেবা মেটাতে পারি। সুতরাং ওটার জন্য কতটুকু রিজার্ভ আমার কাছে আছে। সেটার একটা স্পষ্ট হিসাব দরকার ছিল। আগেরটা স্ফীত ছিল। আমি ঋণ দিয়েছি, ঋণের ওই টাকা আমি এখন আর পাচ্ছি না। যে টাকা দিয়ে আমি আমদানি করতে পারব। তাহলে আমি যে টাকা ঋণ দিয়েছি ব্যবসায়ীদের, বিভিন্ন রপ্তানিমুখী শিল্পকে- সেটা তো আমি আমদানি বা ঋণ পরিষেবার জন্য ব্যবহার করতে পারব না। সুতরাং এ জন্য একটা গ্রস রিজার্ভ, একই সঙ্গে আমাদের নেট রিজার্ভ দরকার। আইএমএফ বিপিএমসি পদ্ধতিতে এটা করেছে। আমার মনে হয়, এটা স্বচ্ছ হয়েছে। আমরা জানি, রিজার্ভের পতন হচ্ছিল এবং সেটা অব্যাহত ছিল। আমরা দেখছি যে, ক্রমান্বয়ে রিজার্ভ বাড়ছে। এটা বাড়ানোর উপায় আছে। এর একটা বড় উপায় হলো আমাদের রেমিট্যান্স, যেটা সরাসরি রিজার্ভে এসে যোগ হয়। আমাদের উচিত ফরমাল পথে এটাকে উৎসাহিত করা।

 প্রবাসীদের যাতে কোনো প্রতিবন্ধকতায় পড়তে না হয়। পথে যাওয়া থেকে এয়ারপোর্টে ফেরা পর্যন্ত সেখানকার লেবার উইনিং যারা- সবাইকে তাদের সহযোগিতা করতে হবে। প্রবাসীদের বলতে হবে- তারা যাতে ইনফরমাল চ্যানেলে হুন্ডি-হাওলার মাধ্যমে রেমিট্যান্স না পাঠান। অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর এখানে কিছু ইতিবাচক প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি। ২০২৪-এ সবচেয়ে বেশি রিজার্ভ এসেছে। তার পরও রিজার্ভের পরিস্থিতি খুব ভালো, আমি তা বলব না। কিছু অবনমন ঠেকানো গেছে। অবনমন ঠেকানোর ফলে বিনিময় হারও স্থিতিশীলতার দিকে যাচ্ছে। এটা একটা ভালো দিক। রপ্তানিও বেশ ভালো, ১৩ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আমাদের দেশ থেকে যে টাকা চলে যায়- এর বড় দুটি রুট হলো- রপ্তানির ক্ষেত্রে যা পাঠানো হচ্ছে তার থেকে কম দেখিয়ে টাকা বাইরে রেখে দেওয়া। আর আমদানির ক্ষেত্রে যা মূল্য, তার থেকে বেশি দেখিয়ে টাকা বাইরে পাচার করা। এ ছাড়া হুন্ডি-হাওলা আছে, যা বিভিন্নভাবে আমাদের প্রবাসী ভাইদের প্রলুব্ধ করে। এসব জায়গায় আমাদের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক টাস্কফোর্স গঠন করেছে। এই টাস্কফোর্সগুলোর সুপারিশ সময়মতো এবং জরুরি প্রয়োজন- সেটা আমাদের বাস্তবায়ন করতে হবে। তাহলে রিজার্ভে যে ইতিবাচক প্রবণতা সম্প্রতি দেখেছি, তা আমরা অব্যাহত রাখতে পারব। ফলে রপ্তানি বহুমুখীকরণ, রপ্তানিবাজার বহুমুখীকরণ, বাইরে আরও বেশি দক্ষ শ্রমিক পাঠানো, ইনফরমাল চ্যানেলকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি যারা সিন্ডিকেট, হুন্ডি, হাওলার সঙ্গে জড়িত, যারা এগুলোতে টাকা পাচারে সহায়তা করে অর্থাৎ অনুঘটকের কাজ করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। বাইরে আমাদের যে দূতাবাস আছে, তাদের ইনটেলিজেন্স, সেখানে যারা কাজ করে দুই দিক থেকেই এটাকে আক্রমণ করতে হবে। উৎপাদন ও দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর মাধ্যমে আমরা রিজার্ভের আরও উন্নতি দেখব বলে আশা করছি।

দ্বিতীয় কিস্তি আগামী দিন। চোখ রাখুন…

বিস্মরণের প্ররোচনা

প্রকাশ: ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:০৮ এএম
বিস্মরণের প্ররোচনা
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

ভুলে যাই তো বটেই, আবার ভুলিয়ে দেওয়াও হয়। সমষ্টিগত লক্ষ্যটাকে মনে রাখা সহজ নয়, বিশেষ করে তখন যখন তার সঙ্গে বিরোধ বাধে ব্যক্তিগত লক্ষ্যের। মূল লক্ষ্য অবশ্য একই, অভিন্ন। সেটা হচ্ছে উন্নতি ও অগ্রগতির, উন্নতি করা এবং এগিয়ে যাওয়া। এই দুয়ের ভেতরও দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে বৈকি। কেননা, একটা হচ্ছে ওপরে ওঠা, অন্যটা সামনে যাওয়া; যদি বিরোধ না ঘটে, উন্নতি ও অগ্রগতি যদি হাত ধরাধরি করে চলতে পারে, তবে সেটা তো খুবই সুখবর।

সমষ্টির স্বার্থ এবং ব্যক্তির স্বার্থ দুটি আলাদা বস্তু, তাদের ভেতর পার্থক্য তো খুবই স্পষ্ট, কিন্তু দুয়ের ভেতর ঝগড়া-ফ্যাসাদ যে একেবারে অনিবার্য তা বলা যাবে না। কেননা, সমষ্টির স্বার্থের পক্ষে মোটেই অসম্ভব নয় ব্যক্তির স্বার্থকে পুষ্ট করা, নদী যেমন সমৃদ্ধ করে তার শাখা-প্রশাখাকে। তেমনি আবার ব্যক্তিও পারে সমষ্টির প্রবাহকে পূর্ণ ও বেগবান করতে এবং সেই পথে নিজেকে আরও ধনী করে তুলতে। কিন্তু ব্যক্তি ও সমষ্টিতে শত্রুতা বাঁধে বৈকি। সমষ্টির মধ্যে যে ব্যক্তি রয়েছে, ব্যক্তি যে মোটেই এগোবে না, সমষ্টি যদি পেছন থেকে তাকে টেনে ধরে, যদি আঁকড়ে রাখে পথ, এই সত্যটিকে অনেক সময়েই দূরবর্তী তত্ত্ব মনে হয়, বিশেষ করে তখন যখন নিজেকে বাঁচানোটা প্রয়োজন হয়ে পড়ে, অন্য সবকিছুর আগে। নিজে পানিতে পড়লে প্রতিবেশীর কথা কে ভাবে?

তা আমরা কি পানিতে পড়েছি? না, তা নয়; দুর্দশাটা ওই মাত্রার নয়। তবে পানিতে পড়েছিলাম বৈকি, পড়েছিলাম একাত্তরে। তখন আমরা সবাই বিপদে পড়েছিলাম। বিপদ মাত্রই মানুষকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন করে, আলাদা করে দেয়। প্রত্যেকে তখন নিজের কথা ভাবে। একাত্তরে আমরা নিজের কথা ভেবেছি; কিন্তু ভাবতে গিয়ে সবার কথাও ভেবেছি। কেননা প্রচণ্ড আতঙ্কের মধ্যেও সজাগ ছিল এই উপলব্ধি যে, সবাই বাঁচলে তবেই আমরা প্রত্যেকে বাঁচব, নইলে নয়। কেননা, যে শত্রু আমাদের আক্রমণ করেছিল, সে কারও ব্যক্তিগত শত্রু ছিল না; তার শত্রুতাটা ছিল আমাদের সবার সঙ্গে। তাই সবাই মিলে তাকে পরাভূত করা অত্যাবশ্যক মনে হয়েছিল, বাঁচার স্বার্থে। শত্রু টিকে থাকলে আমরা টিকব না, এটা বুঝেছিলাম। যারা নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে বাঁচার চেষ্টা করছে তারা কোনো না কোনো পরিমাণে রাজাকারে পরিণত হয়েছে। হয়তো বা না-জেনেই। হানাদারদের তোয়াজ করেছে। বাস্তবতা বলছে যে, এখনো আমরা বিপদেই আছি, তবে তখনকার মতো একেবারে পানিতে পড়েছি বলে মনে হচ্ছে না। বাস্তবতা এটা যে, একটি সাধারণ শত্রু আমাদের সবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বসে আছে। এ আমাদের বাঁচার মতো করে বাঁচতে দেবে না। যারা টিকবে তারা যতই বিলাস, কিংবা দম্ভ করুক, টিকে থাকবে আপস করে, একটি বিশ্বব্যবস্থার অংশ হয়ে গিয়ে। ওই রাজাকারই আসলে; নতুন নামে। এদের হইহই রইরইটা স্রোতে ভাসমান আত্মসমর্পণকারীদের আস্ফালন ছাড়া অন্য কিছু নয়।

স্রোতটা হচ্ছে বিশ্ব পুঁজিবাদের। রাষ্ট্র, সমাজ, ব্যক্তি পুঁজিবাদের অধীনে চলে গেছে। যেমন অর্থনৈতিকভাবে, তেমনি আদর্শগত রূপে। পুঁজিবাদ ব্যক্তিকে চেনে, সমষ্টিকে চেনে না; ব্যক্তির স্বার্থ ও লক্ষ্যকে সে দাঁড় করিয়ে দেয় সমষ্টির স্বার্থ ও লক্ষ্যের বিরুদ্ধে। একাত্তরে আমরা সমষ্টিগতভাবে লড়েছিলাম; সে-লড়াইয়ে আপাত বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের পরাজয়ের সূত্রপাত ঘটেছে। আমরা বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছি। সাধারণ শত্রুকে ভুলে পরস্পরকে একে অপরের শত্রুতে পরিণত করেছি। ফলে প্রকৃত অর্থে উন্নত হচ্ছি না, এগোতেও পারছি না। মুক্তির যে-লক্ষ্যটা সামনে ছিল সেটাকে ভুলে গেছি এবং পুঁজিবাদ তার নিজের স্বার্থ ও প্রবণতায় সেটা ভুলিয়েও দিয়েছে।

একাত্তরের যুদ্ধটা সশস্ত্র ছিল। অস্ত্র হাতে মানুষ লড়েছে। কিন্তু তার আসল চরিত্র ছিল আদর্শিক; দুটি আদর্শ পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিল। একটি আদর্শ লুণ্ঠনের, অপরটি লুণ্ঠনকে প্রতিহত করে সর্বজনীন মুক্তি অর্জনের। ওই যুদ্ধ হঠাৎ শুরু হয়নি, বিশেষ কোনো দিনে কিংবা ঘটনার মধ্য দিয়ে তার সূত্রপাত ঘটেনি। তার একটি নিজস্ব ইতিহাস রয়েছে, আছে ধারাবাহিকতা। পেছনে রয়েছে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, আছে তে-ভাগা আন্দোলন, তারও আগের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনও। ধারাবাহিকভাবে এগোতে এগোতে একটি পর্যায়ে এসে বিস্ফোরণ ঘটেছে একাত্তরে।

বিস্ফোরণটা অনেক বড় ছিল, নেতৃত্বের তুলনায়। নেতৃত্ব তাই সঠিক পরিচালনার দায়িত্ব নিতে পারেনি। পেছনের লোক এগিয়ে গেছে, সম্মুখবর্তীদের পেছনে ফেলে। একাত্তরের ঐক্যটা জনগণের ঐক্য, নেতৃত্বের ঐক্য নয়। রণাঙ্গনে সাধারণ মানুষ ছিল, যাদের কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছিল না যুদ্ধের। নেতৃত্বের ভেতর কোন্দল দেখা গেছে, ষড়যন্ত্র যে অনুপস্থিত ছিল তাও নয়। মুক্তিবাহিনীর পাশাপাশি মুজিববাহিনী গড়ে উঠেছে, মুক্তিবাহিনীতে বামপন্থিদের নেওয়া হয়নি; অনেক ক্ষেত্রে বামপন্থিরা নিজেরাও ছিল বিভ্রান্ত। তবুও, সব মিলিয়ে, মূল স্রোতটা ছিল আদর্শবাদী। 

ওই আদর্শবাদ পুরাতন আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ভেঙে তার জায়গায় ছোট কিন্তু অনুরূপ অন্য একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়নি, স্বপ্ন দেখেছে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের, যেখানে মানুষ মুক্তি পাবে এবং মুক্তির জন্য অত্যাবশ্যকীয় যে বৈষম্যহীন সমাজ তা গড়ে উঠবে। এ ছিল জনগণের আকাঙ্ক্ষা, নেতৃত্বের নয়। নেতৃত্ব চেয়েছে পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত আসনগুলোতে তারা আরাম করে বসে পড়বে, একদিন যেমন ব্রিটিশের পরিত্যক্ত গদিগুলোতে তাদের পূর্বসূরিরা বসেছিল। নেতৃত্বের আদর্শবাদ ব্যক্তিস্বার্থের; জনগণের আদর্শবাদ সমষ্টিস্বার্থের। দুটোই এগোচ্ছিল নিজস্ব ধারাবাহিকতায়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ব্যক্তিস্বার্থই জয়যুক্ত হয়েছে, সমষ্টিস্বার্থকে পদদলিত করে।

মস্তবড় জয়ের পর এটা একটা মস্তবড় পরাজয়। দুটোই ঐতিহাসিক। হানাদাররা পরাভূত হলো, তারা তাদের হাতের অস্ত্র সমর্পণ করল, কিন্তু তাদের আদর্শ অপরাজিতই রয়ে গেল। বিজয়ী বীরেরা ওই আদর্শকেই নিজেদের মধ্যে মহোৎসাহে ও প্রায় অবাধে বিকশিত করতে থাকল। সাধারণ মানুষ দেখল তারা দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হয়েছে; বিদেশি হানাদারদের তারা বিতাড়িত করেছে ঠিকই, কিন্তু স্বদেশি লুণ্ঠনকারীদের কবলে পড়ে গেছে। লুণ্ঠনই আদর্শ হয়ে দাঁড়াল।

ফলে মানুষ দ্বিতীয় দফায় নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ল। বিদেশি হানাদারদের বিরুদ্ধে যে সমষ্টিগত লড়াইটা ছিল, সেটি এখন আর নেই। এখনকার যুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যক্তিগত। পাকিস্তানি বাহিনী চলে গেছে, কিন্তু তাদের প্রেত্মারা বসে থাকেনি। তার পর অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটল, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনও প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের যিনি প্রধান তিনি সপরিবারে নিহত হলেন; এবং তার পর একের পর এক সামরিক বাহিনীর লোকদের অধীনে চলে গেল বাংলাদেশ। ক্রমাগত বৈষম্য বাড়তে থাকল, এবং কমতে থাকল দেশপ্রেম। নিঃশব্দে টাকার শাসন প্রতিষ্ঠিত হলো। আর টাকা চলে গেল লুণ্ঠনকারী ও ঋণখেলাপি, দুর্নীতিবাজ আমলা ও রাজনীতিক এবং বিদেশি কোম্পানি ও সংস্থার স্থানীয় এজেন্টদের হাতে। কমতে থাকল নিরাপত্তা। বিশেষভাবে বিপদ ঘটল সমাজের দুর্বল অংশের। যেমন- দরিদ্রের, নারীর, সংখ্যালঘুর এবং ক্ষুদ্র জাতিসত্তার।

যুদ্ধের সময়ে মানুষ ব্যস্ত ছিল কাজে। যুদ্ধ নিজেই একটা সার্বক্ষণিক কাজ। কাজ চলছিল রণাঙ্গনে, চলছিল কৃষিতে। আর আশা ছিল যে, স্বাধীন হলে কর্মের বিপুল সুযোগ তৈরি হবে। মানুষ বেকার থাকবে না। শিল্পায়ন ঘটবে। উৎপাদন বাড়বে। উৎপাদকরা মর্যাদাবান হবে। সেই আশা পূরণ হয়নি। ব্যাপক হারে বিনিয়োগ ঘটেনি। যারা উৎপাদন করে তারা দরিদ্র হয়েছে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়নি। সামরিক-বেসামরিক অনুৎপাদক খাতগুলোতে খরচ বেড়েছে। অপচয় মাত্রাহীন হয়ে পড়েছে। সর্বোপরি রাষ্ট্রক্ষমতা চলে গেছে তাদের হাতে, যারা উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত নয়। কর্মের ক্ষেত্রকে প্রসারিত না করে বরঞ্চ সংকুচিত করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ সমষ্টিগত মুক্তির যে-লক্ষ্যকে সামনে তুলে ধরেছিল, সেটা আলস্যের নয়, কাজের; সেটা ব্যক্তিগত লুণ্ঠনের নয়, সমষ্টিগত সৃষ্টির। সেই আদর্শ জয়যুক্ত হয়েছে এমনটা বলা যাচ্ছে না; যদিও আমরা বলি, ভালোবাসি বলতে, যে মুক্তিযুদ্ধে আমরা জয়ী হয়েছি।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এইচএমপি ভাইরাস: প্রয়োজন আগাম সতর্কতা

প্রকাশ: ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:০৬ এএম
এইচএমপি ভাইরাস: প্রয়োজন আগাম সতর্কতা
সৈয়দ ফারুক হোসেন

করোনাভাইরাস ও এমপক্সের পর এবার বিশ্বে নতুন এইচএমপি ভাইরাস (হিউম্যান মেটো নিউমো ভাইরাস) সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। ২০১৯ সালের শেষদিকে চীনে ব্যাপকহারে সংক্রমণ বাড়ে কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসের। একপর্যায়ে এটি মহামারিতে রূপ নেয়। থমকে যায় পুরো বিশ্ব। সেই সঙ্গে প্রাণ হারান লাখ লাখ মানুষ। সেই মহামারির ৫ বছর পর আবারও নতুন ব্যাধি আতঙ্কে পূর্ব এশিয়ার দেশ চীন। প্রাথমিক ধারণা, রাইনোভাইরাস ও দ্য হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাসের সংক্রমণে দেশটিতে রহস্যময় এই রোগের প্রাদুর্ভাব। শুধু চীনে নয়, এইচএমপিভির লক্ষণ শনাক্ত হয়েছে জাপান, মালয়েশিয়া, ভারত এবং বাংলাদেশেও। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশও। শঙ্কা রয়েছে মহামারিতে রূপ নেওয়ার। ভাইরাস হলো অতিক্ষুদ্র সংক্রামক, যা শুধু একটি জীবন্ত কোষের অভ্যন্তরে বংশবৃদ্ধি করতে পারে। ভাইরাস উদ্ভিদ, প্রাণী থেকে শুরু করে ব্যাকটেরিয়া, আর্কিয়াসহ সব জীবজগৎকে আক্রান্ত করে। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি বাস্তুতন্ত্রেই ভাইরাস পাওয়া যায়। এরা হলো সবচেয়ে বহুল সংখ্যক জৈবিক সত্তা। 

২০২০ সালের করোনা মহামারির পর এবার চীনে নতুন এক ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণে বিশ্বব্যাপী মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার ঠিক পাঁচ বছর পর এ ঘটনা ঘটল। কোভিড-১৯ মহামারিতে সারা পৃথিবীতে ৭০ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। ২০০১ সালে প্রথম দ্য হিউম্যান মেটানিউমো ভাইরাস (এইচএমপিভি) আবিষ্কার হয়। আবিষ্কারেরও ৬০ বছর আগে থেকে ভাইরাসটি মানবজগতে রয়েছে, ফলে কোভিডের মতো নভেল বা নতুন ধরনের ভাইরাস এইচএমপিভি নয়। মূলত ১৩-১৬ বছর বয়সের নিচের শিশু এবং বয়স্করা এতে আক্রান্ত হয়। সম্প্রতি এইচএমপিভি ভাইরাসের আক্রমণে হাসপাতালগুলোতে রোগীদের ভিড় বাড়ছে। বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে এই ভাইরাসের প্রভাব বেশি দেখা যাচ্ছে। ভাইরাসটিকে হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস বা এইচএমপিভি নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই ভাইরাসের কারণে সাধারণত ঠাণ্ডা জ্বরের মতো উপসর্গ দেখা দেয়। শীতের মৌসুমে ভাইরাসটি বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে।

 বর্তমানে চীনের বিভিন্ন প্রদেশে এর দ্রুত বিস্তার নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। চীনের পর এবার মালয়েশিয়ায় এবং আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও বাড়ছে হিউম্যান মেটানিউমো ভাইরাস বা এইচএমপিভি ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে জনসাধারণকে মাস্ক ব্যবহার এবং বারবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার পরামর্শ দিয়েছে মালয়েশিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের তথ্যানুসারে, এইচএমপিভি একটি শ্বাসযন্ত্রের ভাইরাস, যা ওপরের এবং নিচের শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ ঘটায়। এটি সব বয়সের ব্যক্তিদের প্রভাবিত করে। তবে শিশু, বয়স্ক এবং যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের জন্য ভাইরাসটি সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। 

এইচএমপিভি ২০০১ সালে প্রথম শনাক্ত করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হয়তো আরও অনেক যুগ আগে থেকেই এ ভাইরাসের অস্তিত্ব ছিল পৃথিবীতে। এইচএমপিভির উপসর্গগুলো ফ্লু এবং অন্যান্য শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের মতোই। সাধারণ উপসর্গের মধ্যে রয়েছে কাশি, জ্বর, নাক বন্ধ হওয়া এবং শ্বাসকষ্ট। গুরুতর ক্ষেত্রে, ভাইরাস ব্রঙ্কাইটিস বা নিউমোনিয়ার মতো জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। এইচএমপিভির ইনকিউবেশন পিরিয়ড বা উন্মেষপর্ব সাধারণত তিন থেকে ছয় দিনের মধ্যে হয়। সংক্রমণের তীব্রতার ওপর নির্ভর করে লক্ষণগুলো বিভিন্ন সময়কালের জন্য স্থায়ী হয়। এইচএমপিভি অন্যান্য শ্বাসযন্ত্রের ভাইরাসের মতোই ছড়ায়। যেমন- কাশি এবং হাঁচি থেকে নিঃসরণের মাধ্যমে, হাত মেলানো বা স্পর্শ দ্বারা, সংক্রমিত স্থান স্পর্শ করা এবং তার পর মুখ, নাক বা চোখ হাত দিয়ে স্পর্শ করার মাধ্যমেও বিস্তার লাভ করে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে আগেও এইচএমপিভি ভাইরাসের অস্তিত্ব ছিল। এখনো শিশু আর প্রবীণদের শরীরে মিলবে এটির অস্তিত্ব। তবে আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। করোনার মতো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললেই, সংক্রমণ থেকে দূরে থাকা সম্ভব। হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস বা এইচএমপিভি বাংলাদেশে নতুন কোনো ভাইরাস নয়। দেশে এর উপস্থিতি আগেও ছিল, এখনো আছে। এই ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই বলে জানিয়েছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। অন্য যেকোনো জ্বর, সর্দি বা কাশির ক্ষেত্রে যে ধরনের সতর্কতা প্রয়োজন, এইচএমপিভিজনিত অসুস্থতার ক্ষেত্রে একই ধরনের সাবধানতা প্রয়োজন। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে এই ভাইরাসের উপস্থিতি প্রথম শনাক্ত হয়। সর্বশেষ ২০২৩ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে দুজনের শরীরে এটি শনাক্ত হয়।  

এইচএমপিভি আক্রান্ত হলে জ্বর, সর্দি ও কাশি হয়, নাক বন্ধ হয়ে যায়, শরীরে ব্যথা হয়। এটি অন্য জ্বরের মতো। শিশু, বয়স্ক ও বয়স্ক যেসব ব্যক্তি ক্যানসার বা দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভুগছেন, তাদের ক্ষেত্রে কিছুটা ঝুঁকি আছে। হাঁচি-কাশির মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়ায়। আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে অন্য ব্যক্তির ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। সংক্রমণ থেকে দূরে থাকার উপায় হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। অর্থাৎ মাস্ক পরতে হবে, নিয়মিত হাত ধুতে হবে। করোনা ভাইরাসের মতো এই ভাইরাসেও সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছে শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিরা। বিশেষ করে আগে যাদের শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা ছিল, তারা নতুন এই ভাইরাসের আক্রমণে নাজুক অবস্থায় আছেন। বিশেষ করে যাদের শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা আছে। 

সম্প্রতি নতুন করে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে হিউম্যান মেটানিউমো ভাইরাস (এইচএমপিভি)। এটি শ্বাসতন্ত্রবাহিত সংক্রামক ব্যাধির জন্য দায়ী ভাইরাস। এইচএমপিভি ভাইরাসের উদ্ভব নানা কারণে হয়ে থাকে। বিভিন্ন রকম ভাইরাসের সংমিশ্রণে নতুন ভাইরাসের উদ্ভব হয় বা ভাইরাস তার টিকে থাকার জন্য রূপ পরিবর্তন করে। ভাইরাসের পরিবর্তন যখন অনেক বেশি হয়ে যায়, তখন একটি পর্যায়ে সেই ভাইরাসের নতুন নামকরণ করা হয়। হিউম্যান মেটানিউমো ভাইরাস (এইচএমপিভি) ২০০১ সালে প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছিল নেদারল্যান্ডসে। বাংলাদেশেও ২০০১ সাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে। ২০০১ সালের আগে থেকেই এই ভাইরাসটি পৃথিবীতে ছিল। কিন্তু নতুন করে বিজ্ঞানীদের চোখে ধরা পড়ে ২০০১ সালে।

অন্যান্য শ্বাসতন্ত্রবাহিত যেসব ভাইরাস, যেমন: ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস, করোনা ভাইরাসের মতো কাছাকাছি বৈশিষ্ট্য বা মিল রয়েছে এইচএমপিভি ভাইরাসের। শ্বাসতন্ত্রবাহিত যেসব রোগ আছে, যেমন: ইনফ্লুয়েঞ্জা সেটার মতোই এইচএমপিভি ছড়িয়ে পড়ে। হাঁচি-কাশির মাধ্যমে এইচএমপিভি ছড়ায়। এইচএমপিভি আক্রান্ত হাঁচি-কাশি লেগে থাকা ব্যক্তির ব্যবহৃত কাপড় বা কোনো বস্তু এমনকি কোনো জায়গা অন্য কেউ স্পর্শ করে সেই হাত নিজের নাক-মুখে স্পর্শে করলে সেখান থেকে এইচএমপিভি হতে পারে। সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শ ও হাঁচি-কাশির মাধ্যমেই এইচএমপিভি ছড়ানোর ইতিহাস আছে। চীনে সম্প্রতি এটি শনাক্ত হয়। ভাইরাসের প্রকোপে চীনে প্রচুর মানুষ হাসপাতালমুখী হচ্ছেন। গত বছর চীনে ৩২৪ জন এইচএমপিভিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ২০২৩ সালে সেই সংখ্যাটি ছিল ২২৫। 

বাংলাদেশের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের মতে, এটা নতুন কোনো ভাইরাস নয়। এমনকি এ নিয়ে বাংলাদেশে উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। কোভিড-১৯ একেবারে ভিন্ন ও নতুন আবহের ভাইরাস হওয়ায় এর প্রাদুর্ভাব বা মহামারির রেশ এতটা বিস্তর হয়েছিল। এই ভাইরাসের যে রূপ সেটির বিভিন্ন রকম শ্রেণিবিন্যাস করছেন বিজ্ঞানীরা। এইচএমপিভি ভাইরাসের মিউটেশন হয়েছে কি না, তা জানা যায়নি। গুরুতর ফর্মে যাওয়া এবং মানুষের খুব বেশি ক্ষতি করতে সক্ষম, মৃত্যুহার খুব উঁচু এমন পর্যায়ে যায়নি এইচএমপিভি। মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় ভাইরাসটি, তাই পর্যবেক্ষণে থাকতে হবে। অনেকের ক্ষেত্রে এই রোগটি জটিলতা বাড়াতে পারে। যেমন: যাদের শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, যেমন: শিশু, বয়স্ক ব্যক্তি; যাদের বয়স ৬০ বছরের বেশি তাদের ঝুঁকি বেশি। যারা অন্যান্য রোগে ভুগছেন, যেমন: ডায়াবেটিস, রক্তচাপ, ক্যানসার, কিডনিজনিত জটিলতা, অ্যাজমা আছে। কোনো ওষুধ খাওয়ার কারণে যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে তাদের, অন্তঃসত্ত্বা নারী। 

এইচএমপিভি ভাইরাসের চিকিৎসায় সরাসরি কোনো অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নেই। অধিকাংশ ভাইরাসের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো ওষুধ নেই। এ ক্ষেত্রে লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা দেওয়া হয় এবং এর পাশাপাশি রোগীর যত্ন নিশ্চিত করতে হবে। এটি এমনিতে সেরে যায় নির্দিষ্ট সময় পর। তবে রোগ যাতে গুরুতর পর্যায়ে না যায়, সেজন্য সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। শরীরে যদি অন্য কোনো সংক্রমণ থেকে থাকে, সেটার জন্য ওষুধ দেওয়া হয় রোগীকে। যাতে ওই সংক্রমণ এবং এইচএমপিভি ভাইরাসের সংক্রমণ যুক্ত হয়ে জটিল অবস্থা তৈরি করতে না পারে। করোনার মতো মহামারি পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে এমন অবস্থায় এখনো যায়নি এইচএমপিভি ভাইরাস। রোগটি যত বেশি ছড়াবে, তত বেশি আশঙ্কা থাকে এই ভাইরাসটি তার ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটাতে পারে, খুব বৃদ্ধি হতে পারে, আবার কমেও যেতে পারে। 

নিয়মিত বিরতিতে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে, হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় নাক-মুখে রুমাল, টিস্যু বা কনুই দিয়ে ঢেকে নিতে হবে, সংক্রমিত ব্যক্তির কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে, এইচএমপিভি সংক্রমিত ব্যক্তিকে মাস্ক পরিধান করতে হবে এবং আক্রান্ত ব্যক্তির কাছাকাছি থাকা ব্যক্তিদেরও মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। জ্বর হলে রোগীকে বিশ্রাম নিতে হবে নিজ অবস্থানে, অন্যান্য ভাইরাল জ্বরের মতো তিন দিনের ভেতর জ্বর কমে যাবে। যদি জ্বর না কমে তাহলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে হবে। অনেক বেশি রোগী হাসপাতালে এলে সেটি জনস্বাস্থ্যের জন্য জরুরি পরিস্থিতি হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই এইচএমপিভি আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে কি না, সেটি লক্ষ্য রাখার পাশাপাশি জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় হাসপাতাল, চিকিৎসা গবেষণা প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট সবার সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা, ২০২৫ সালে আবার করোনার মতো নতুন কোনো মহামারির উদ্ভব হবে। যদিও কোন রোগটি মহামারি আকার ধারণ করবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো বার্তা এখনই দেওয়া সম্ভব নয়। তবে এইচএমভির প্রাদুর্ভাব ভাবাচ্ছে তাদের।

লেখক: সাবেক রেজিস্ট্রার, বিএসএফএমএসটিইউ

শুল্ক-ভ্যাট বৃদ্ধি ভ্যাট বাড়ানো দূরদর্শিতার অভাব: ড. জাহিদ হোসেন

প্রকাশ: ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:২১ পিএম
ভ্যাট বাড়ানো দূরদর্শিতার অভাব: ড. জাহিদ হোসেন
ড. জাহিদ হোসেন

সরকার তড়িঘড়ি করে বেশ কিছু পণ্য ও সেবায় ভ্যাট-শুল্ক বাড়িয়েছে, যা সরকারের দূরদর্শিতার অভাব বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।

গতকাল শনিবার খবরের কাগজকে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ কর্মসূচি চলমান রাখতেই সরকার তড়িঘড়ি করে বেশ কিছু পণ্য ও সেবায় ভ্যাট-শুল্ক বাড়িয়েছে। এতে সরকার উভয়সংকটে পড়েছে। কারণ এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে পরোক্ষ কর বাড়ানো তো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। যদিও সরকার যৌক্তিকভাবে বলেছে, একেবারে অত্যাবশ্যকীয় কিছু পণ্যে শুল্ক কমানো হয়েছে।

ড. জাহিদ বলেন, ‘সাধারণ মানুষ তো কেবল নিত্যপণ্যই কেনে না, তারা তো কাপড়ও কেনে, সাবানও কেনে, মোবাইলের সিমও কেনে, রেস্তোরাঁয় খায়ও। আমাদের দেশের নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ৯০ শতাংশ মানুষই এই কাজগুলো করে। তারা সবাই দরিদ্র না, আবার ধনীও না। এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে তাদের গায়ে আঁচড় মারলে তো রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না, সেটা বোঝার জন্য তো অর্থনীতিবিদ বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হতে হয় না। এটা যে সরকার বোঝেনি তাও না।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘আমার মনে হয়, আইএমএফের কাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে চলতি অর্থবছরেই বাড়তি ১২ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের যে চাপ রয়েছে, সে জন্যই সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু এখন ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের সমালোচনার মুখে সরকার তো পিছু হটল এবং কিছু পণ্যের শুল্কহার কমিয়ে দিয়েছে। একদিকে কর বাড়িয়ে ১২ হাজার কোটি টাকা আদায় বাড়ানোর কথা বলেছে, অন্যদিকে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা দিতে ৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এটা তো মানুষের চোখে লাগে। একদিকে জনগণের কাছ থেকে বাড়তি টাকা নিচ্ছেন, অন্যদিকে আমলাদের সুবিধা দিচ্ছেন, এটা কি আইএমএফের শর্ত ছিল? এটা তো আইএমএফ বলেনি। আমাদের তো সামনে বাজেট আসছে। কাঠামোগত সংস্কারের উদ্যোগটা কি আমরা বাজেটে নিতে পারতাম না? আইএমএফ কি এতই অবুঝ? আইএমএফর ঋণ কর্মসূচি তো অনেক দিন আগে থেকেই চলছে। এর আগে প্রতিটা কিস্তিতেই তাদের শর্তের ব্যত্যয় হয়েছে। তারপরও তো আমরা কিস্তিগুলো পেয়েছি। এবার কেন তারা এত শক্ত হয়ে গেল?’ 

বর্তমান সরকারকে জনগণের আস্থার সরকার আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘তাদের অনেক কিছু বিবেচনা করেই যেকোনো বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে আমার মনে হয়, আইএমএফসহ অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গেও সরকারকে সঠিকভাবে দর-কষাকষি করতে হবে। তড়িঘড়ি সিদ্ধান্তের ফলে উভয়সংকটে পড়েছে সরকার। একদিকে শুল্ক, কর বাড়ালেন, তারপর আবার পিছু হটলেন। তার মানে সরকারের সিদ্ধান্ত টেকসই নয়। আইএমএফও অসন্তুষ্ট হলো, সাধারণ মানুষও অসন্তুষ্ট হলো, সরকারের বাড়তি রাজস্ব আদায়ও হলো না। তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত দূরদর্শিতার অভাব, নেতৃত্বের দুর্বলতাই এখানে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।’