নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের বাজার প্রতিনিয়তই অস্থিতিশীল হয়ে যাচ্ছে। কয়েক মাস পরেই মুসলিম সম্প্রদায়ের পবিত্র মাস মাহে রমজান। এ উপলক্ষে আবার রমজানে ব্যবহার্য সব নিত্যপণ্যের দাম আরেক দফা বাড়া শুরু হয়েছে। এর বাইরে মানুষের জীনরক্ষাকারী ওষুধের দামও মাস গেলেই বাড়ে। যারা প্রতিনিয়ত শাসকষ্ট, ডায়াবেটিস ও হার্টের রোগী তারা জানেন মাস পেরোলেই তাদের ওষুধের দাম বাড়ে।
এর বাইরে আবারও বাড়ানো হয়েছে কয়েকটি ওষুধের দাম। ফামের্সিগুলোয় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্যথানাশক ট্যাবলেট, অ্যান্টিবায়োটিক, ডায়াবেটিস, ভিটামিন, গ্যাস্ট্রিকসহ বিভিন্ন ধরনের ওষুধ, ইনজেকশনসহ কোনো কোনো কোম্পানির ওষুধ এক পাতার দাম ১২০ টাকা থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এই হিসাবটি যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলে ওষুধের দাম বেড়েছে ৬৭ শতাংশ পর্যন্ত। আর নিত্যপণ্যের দামের মতো লাগামহীনভাবে দাম বাড়ার ফলে জিম্মি হয়ে পড়ছেন রোগীরা। বিশেষ করে যারা দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত ওষুধ সেবন করেন, তাদের অবস্থা শোচনীয়। একদিকে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি, অন্যদিকে ওষুধের দাম বৃদ্ধি নিয়ে আছেন মহাযন্ত্রণায়।
সাধারণ ও সীমিত আয়ের মানুষের এমনিতেই যেখানে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে নাভিশ্বাস অবস্থা, সেখানে জীবনরক্ষাকারী ওষুধের দাম বৃদ্ধি তাদের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট, গ্যাস্টিক, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীর প্রতি মাসের ওষুধের খরচ দ্বিগুণ বেড়েছে। ফলে একদিক খাদ্যপণ্য, অন্যদিকে অনেক সময় কাঁটছাট করে ওষুধ কিনে জীবন বাঁচাতে বাধ্য হচ্ছেন। যেহেতু ওষুধ জীবনরক্ষাকারী পণ্য এবং অনেক সময় ইংরেজিতে দাম লেখা থাকে, সে কারণেই সাধারণ মানুষ ওষুধের দর-কষাকষি বা যাচাই-বাছাই করে ক্রয়ের সময় ও সুযোগ কোনোটিই পান না। সেখানে প্রতিনিয়তই নানা অজুহাতে দাম বৃদ্ধি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
স্বাস্থ্য ও ওষুধ বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষের চিকিৎসা বাবদ মোট খরচের একটি বড় অংশ ব্যয় হয় ওষুধ কিনতে। এতে ওষুধভেদে বড় ব্যবধানে ঘন ঘন দাম বাড়ায় বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। এর সার্বিক প্রভাব জনস্বাস্থ্যের ওপর পড়বে। আর ওষুধের মূল্য নিয়ে বাজারে অব্যাহতভাবে চরম নৈরাজ্য চলছে। এ অবস্থায় কোম্পানিগুলোর অধিক মুনাফা ও দাম নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধ করা জরুরি। তা না হলে দেশের চিকিৎসা খাত নিম্নবিত্ত মানুষের আওতার বাইরে চলে যাবে। ওষুধের বাজার নিয়ন্ত্রণে জেলা পর্যায়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তদারকিব্যবস্থা একবারেই দুর্বল।
জেলা পর্যায়ে একজন ওষুধ তত্ত্বাবধায়ক লোক দেখানো কোনো কোনো সময় ফার্মেসিগুলো পরিদর্শনে যান। এর বাইরে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর মাঝেমধ্যে ফার্মেসিগুলোয় অভিযান পরিচালনা ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও ওষুধের দাম নিয়ে তেমন একটা শাস্তির বিষয় দেখা যায় না।
সরকার দেশে ১১৭টি ওষুধের দাম নির্ধারণ করে থাকে। অথচ দেশে প্রায় দেড় হাজারের বেশি ওষুধ কোম্পানি ২৭ হাজারেরও বেশি জীবনরক্ষাকারী ওষুধ বিভিন্ন নামে উৎপাদন করে থাকে। কোভিড মহামারি-পরবর্তী সময় থেকে দেশের ওষুধশিল্পের সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশ ওষুধশিল্প সমিতি ও বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির যুক্তি- বিশ্ববাজারে ওষুধের কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, ডলারসংকট, উৎপাদন ব্যয়, প্যাকেজিং মূল্য ও পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন সময়ে ওষুধের দাম বাড়ছে।
বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম কমলেও আমাদের দেশে তার প্রতিফলন দেখা যায়নি। এমনকি হাইকোর্ট গত ২৯ এপ্রিল দেশে ওষুধের দাম খেয়ালখুশিমতো বৃদ্ধি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নীরব। অনেক সময় দেখা যায়, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থ দেখার চেয়েও ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সংরক্ষণে ব্যস্ত। সে কারণেই ওষুধশিল্পে জড়িত ব্যবসায়ীরা নিয়মিত দাম বাড়ালেও তারা সে বিষয়ে অধিকাংশ সময়ই নীরব থাকে। যেহেতু ওষুধের দাম বাড়ানোর বিষয়ে ঔষধ প্রশাসনের তেমন ওজর-আপত্তি নেই, সে কারণে ওষুধশিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা ওষুধের দাম বাড়তে প্রতিনিয়তই তৎপর থাকেন।
সরেজমিনে নগরীর রাজধানীর মিটফোর্ড, বংশাল, নাজিরাবাজার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকা এবং শাহবাগসহ বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার একাধিক ফার্মেসিতে ওষুধের দাম বৃদ্ধির সত্যতা যাচাই করে দেখা গেছে, গত ১৫ দিন অস্ত্রোপচার-পরবর্তী মাঝারি থেকে তীব্র ব্যথায় ব্যবহার করা ট্যাবলেট টেরাক্স-১০ প্রতি পিস আগে বিক্রি হতো ১২ টাকায় আর এখন দাম বেড়ে হয়েছে ২০ টাকা। অর্থাৎ বেড়েছে ৬৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। একইভাবে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য ক্যামলোসার্ট ট্যাবলেট এক পাতা ১০টির দাম ১০০ টাকা থেকে ১২০ টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ দাম ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। একইভাবে একই কোম্পানির ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণের কমেট-মেটফরমিন হাইড্রোক্লোরাইড এক পাতা ১০টির দাম ৪০ টাকা থেকে বেড়ে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশ। এ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক সেফ-৩ ডিএস ৪০০ মিলিগ্রাম ক্যাপসুলের দাম প্রতিটি ৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৬০ টাকা হয়েছে। উচ্চ রক্তচাপের জন্য ৩০টির এক বক্স রসুভা (৫ এমজি) ট্যাবলেট ৫০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা করা হয়েছে। দুটিরই মূল্য বেড়েছে ২০ শতাংশ।
রোগীদের ইউরিক অ্যাসিডজনিত সমস্যায় ফেবুক্সোস্ট্যাট ৪০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট প্রতি পিস ১২ টাকা বেড়ে ১৫ টাকা হয়েছে। মূল্য বেড়েছে ২৫ শতাংশ। ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হিউমুলিন এন ইনজেকশন ৩ মিলি কুইকপেন ৫টির এক প্যাকের দাম ৩ হাজার ৫০০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ৬০০ টাকা। উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের জন্য বাইজোরান ৫/২০ ট্যাবলেট কয়েক দিন আগেও এক পাতার ১৫টির দাম ছিল ১৫০ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকায়। দাম বৃদ্ধির পরিমাণ ২০ শতাংশ।
প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় দেশের মানুষকে তাদের চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ নিজেদের বহন করতে হচ্ছে। ওষুধ কেনার পেছনেই সিংহভাগ খরচ করতে হচ্ছে। আমাদের দেশে চিকিৎসাব্যবস্থায় অনেক দিন থেকেই প্রচলিত আছে- চিকিৎসক যে কোম্পানির ওষুধ লিখবেন সেটাই নিতে হবে। তা না হলে অসুখ তো সারবে না বরং আরও স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়বে। ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিক্রয় প্রতিনিধিরা প্রতিদিন চিকিৎসকদের নানা উপঢৌকন দেওয়াসহ হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ভিড় জমান। এ কারণে চিকিৎসকরা যাদের কাছ থেকে বেশি সুবিধা পান তাদের ওষুধ বেশি লিখে থাকেন বলে অভিযোগ আছে। এ কারণে দাম বেড়ে দরিদ্র ও অসচ্ছল মানুষের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর একসময় ২ শতাধিক ওষুধের মূল্য নির্ধারণের দায়িত্বে ছিল। কিন্তু এখন ১১৭টি ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করছে। এর বাইরের ওষুধগুলোর মূল্য নির্ধারণ অনেকটাই নির্ভর করে ওষুধ কোম্পানিগুলোর মর্জির ওপর। এতে ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। মূল্য নির্ধারণ কমিটিতে ভোক্তাদের প্রতিনিধি হিসেবে ক্যাব থাকলেও ভোক্তাদের অধিকার ও যুক্তিকে বারবার উপেক্ষা করে অযৌক্তিক ও অন্যায়ভাবে ওষুধের দাম বাড়ানো হয়। বর্তমানে প্রচলিত ওষুধের মূল্য বৃদ্ধির যে প্রক্রিয়া, সেটি যুক্তি ও ন্যায়সংগত কি না সন্দেহ আছে। জেনেরিক নামের যে ২ শতাধিক ওষুধের মূল্য নির্ধারণের দায়িত্ব ঔষধ প্রশাসনের ছিল, তা পুনর্বহাল করা দরকার। স্বাধীনতার আগে দেশে মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশ ওষুধ তৈরি হতো। এখন ৯৮ শতাংশ ওষুধই দেশে উৎপাদন করা হয়। দেশে উৎপাদিত ১২৪টি ওষুধ রপ্তানিও হচ্ছে। ওষুধ কোম্পানিগুলোকে কোনো রকম জবাবদিহি ছাড়া মূল্যবৃদ্ধির যে সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে, তা অনতিবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে।
একই সঙ্গে বর্তমানে ঔষধ প্রশাসনের দক্ষতা, যোগ্যতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে যেসব প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, সেগুলো সমাধান করতে হবে। দেশে ওষুধশিল্প বিস্তার লাভ করলেও ওষুধ তৈরির কাঁচামালের ৯৭ শতাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এগুলোর অধিকাংশই আসে ভারত ও চীন থেকে। উন্নত বিশ্বের কয়েকটি দেশ থেকেও কিছু কাঁচামাল আসছে। নিম্ন আয়ের দেশ (এলডিসি) হিসেবে বাংলাদেশ ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক সুবিধা পেয়ে আসছে, যা ২০৩২ সাল পর্যন্ত বহাল থাকবে।
২০২৬ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হলে এই সুবিধা বহাল থাকবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। দেশের ওষুধশিল্প সম্প্রসারণ করলেও সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন থেমে নেই। শুরুতে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এটি নিয়ন্ত্রণ করত। এখন দেশীয় বড় করপোরেটগুলো তাদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। তাদের আগ্রাসী ভূমিকার কারণে ওষুধশিল্পে এ ধরনের অস্থিরতা বন্ধ করা যাচ্ছে না। বড় কোম্পানিগুলোর আগ্রাসী তৎপরতা বন্ধ করা ও এই ব্যবসায় অনৈতিক বিপণন পদ্ধতি বন্ধ করতে হবে সর্বাগ্রে।
লেখক: ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)
[email protected]