ড. হোসেন জিল্লুর রহমান একজন শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ ও সমাজচিন্তাবিদ। তিনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকের চেয়ারম্যান। একই সঙ্গে তিনি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ২০০৭-০৮ সালের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় উপদেষ্টা হিসেবে বাণিজ্য ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার পরামর্শদাতা ছিলেন। খবরের কাগজের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি দারিদ্র্যবিমোচন, ভূমি সংস্কার, সুশিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী, অর্থনীতির পুনর্জাগরণ, সুশাসন, রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নয়ন অর্থাৎ গণতান্ত্রিক উৎকর্ষের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক শেহনাজ পূর্ণা
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বের মাত্রা অনেক- এর একটি হচ্ছে রুটিন ওয়ার্ক। আর একটি হচ্ছে, রোডম্যাপগুলো তৈরি করা অর্থাৎ রাজনৈতিক রোডম্যাপ, সংস্কারের রোডম্যাপ, নির্বাচনের রোডম্যাপ- এগুলো তৈরি করা জরুরি। তৃতীয় আরেকটি বিষয় হচ্ছে, সবার মধ্যে ঐক্যের আবহ তৈরি করতে হবে। একই সঙ্গে এই ঐক্যের বিষয়টিকে সংহত করতে হবে। সেখানেও ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। যা বলছি- এগুলো সবই চ্যালেঞ্জের বিষয়। নির্মোহভাবে এগুলোর সমাধান করতে হবে। জনগণ অন্তর্বর্তী সরকারকে বড় ধরনের দায়িত্ব দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করতে। এগুলো নির্মোহভাবে করে যেতে হবে। যাদের ক্ষমতায় বসানো হয়েছে, তারাও জবাবদিহির ঊর্ধ্বে নন। তারা যেসব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন, সেখানে কতটুকু সক্ষমতা দেখাচ্ছেন- এ বিষয়টি দেখা দরকার। যারা দায়িত্বে আছেন তাদের সক্ষমতার পরীক্ষা এখন চলছে। ২০২৫-এ সেই সক্ষমতার পরীক্ষার ফল আমাদের দেখতে হবে।…
খবরের কাগজ: অন্তর্বর্তী সরকার ছয় মাস ধরে রাষ্ট্রক্ষমতায় রয়েছে। এই সময়ে সরকারের সফলতা-ব্যর্থতা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: সরকারের সফলতা- ব্যর্থতার চেয়েও এই সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশার মাত্রাটা খুব বেশি। ২০২৩-কে কেন্দ্র করে সবারই একটা প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল; যা ছিল রাজনৈতিক প্রত্যাশা। ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে একটা সরকার ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় বসেছিল। প্রতিযোগিতামূলক এবং সুষ্ঠু ভোটাধিকার প্রয়োগ করে একটা সরকার যেন হয়, সেই আকাঙ্ক্ষা ছিল ২০২৩-এ। ২০২৪-এ জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে সেই আকাঙ্ক্ষা যেমন ছিল, তার সঙ্গে বাড়তি আশা ছিল দেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন হবে। এই যে আমাদের অবকাঠামোগত সমস্যা, মানবাধিকারের যে দুর্বল অবস্থা, রাষ্ট্রক্ষমতার সামনে নাগরিকের অসহায়ত্ব, যে নাগরিকরা সার্বিকভাবে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীগুলোর সামনে অসহায় এবং অপমানিত, এগুলোর পরিবর্তন দরকার। সুতরাং আমাদের আকাঙ্ক্ষার মাত্রাটা অনেক বড়। একই সঙ্গে এটাও সত্য যে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একটা বিশাল ভঙ্গুর অবস্থা আমরা দেখেছি। সাধারণ মানুষের অনেক বড় কষ্ট ছিল অর্থনৈতিক বিষয়। সেখানে ২০২৪-এর শেষ ৪-৫ মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে রাতারাতি অনেক কিছু করা সম্ভব নয়। কিন্তু মানুষের চাওয়া- অন্তত সঠিক চেষ্টাটুকু যেন হয়। যে ত্রুটিগুলো সামনে আনা সম্ভব, সেগুলো যেন আসে- সে ধরনের একটা সদিচ্ছা থাকতে হবে। মানুষ যে ধরনের স্বৈরশাসন থেকে বেরিয়ে এসেছে, অর্থাৎ তখন যে নেতৃত্ব ছিল, তাদের যে চেহারা ছিল, তারা যে অর্থনৈতিক বাস্তবতা তৈরি করেছিল, মানুষ সে জায়গায় আর ফিরে যেতে চায় না, সেই আকাঙ্ক্ষার জায়গা থেকেই এই নতুন অন্তর্বর্তী সরকার করা হলো, কাজেই প্রত্যাশা অবশ্যই বেশি। তারা ইতোমধ্যে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। সে লক্ষ্যে তারা সংস্কার কমিশন গঠন করেছে।
তারা সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলো ঠিক করার চেষ্টা করছে। তার পরও সঠিক চেষ্টাটা হচ্ছে কি না, এটা নিয়ে কিছু অস্বস্তিও তৈরি হয়েছে। মানুষের ভেতরে এক ধরনের উপলব্ধি জন্মেছে যে, সঠিক চেষ্টার ঘাটতিগুলো আসলে কোথায়? সেখানে আমি বলব যে, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের বিষয়ে একটা চেষ্টা চলছে। সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক কষ্টের যে পর্যায়, সেখানে তেমন কোনো পরিবর্তন করা সম্ভব হয়নি। অন্তত আমরা তা দেখছি না। টিসিবির লাইনগুলো দেখলেই বোঝা যায়, মানুষ কেমন কষ্টের মধ্যে আছে। এটাও সত্য যে, এখানে যেটা প্রয়োজন ছিল, অর্থাৎ অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থনীতি যারা চালান, অর্থনীতির যারা অংশীদার বা অর্থনীতির চাকা যারা ঘোরান, সে কৃষক হোক, শ্রমিক হোক, ছোট উদ্যোক্তা বা বড় উদ্যোক্তা কিংবা মাঝারি উদ্যোক্তা হোক; যে পর্যায়েরই হোক না কেন, সবার সঙ্গে আরও একটা জোরালো সংযোগের দরকার ছিল।
অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ের পাঁচ মাসে একটা বিষয় দেখা গেছে, অর্থনীতি যারা চালান তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার সংযোগটা কম দৃশ্যমান হয়েছে। সে ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক কষ্টের জায়গাগুলো আরও কীভাবে দ্রুত সমাধান করা যায়, সেই পরামর্শগুলো আসতে হবে। যারা সরকারি আমলা, তারা ঠিক করবেন। এটা করবেন যারা অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ করেন তারা। তাদের সঙ্গে যোগাযোগের একটা স্পষ্ট ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। আমি বলব, এটা চিন্তার বিষয়। সরকার একটা উদ্যোগ নিয়েছে, তারা সংস্কার কমিশন করেছে। সংস্কার একটা ভালো উদ্যোগ ছিল। সংস্কার কমিশনের কাজের পদ্ধতির ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, এখানেও খোলামেলা আলোচনার চেয়ে একটা আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু হয়েছে। নির্বাচন, জনপ্রশাসন, বিচারব্যবস্থা- এগুলোর জন্য রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের সঙ্গে আরও বেশি খোলামেলা আলোচনার প্রয়োজন ছিল।
এরই মধ্যে আমরা দেখতে পেলাম যে, সংস্কার কমিশন সময় বাড়িয়েছে। তাদের পদ্ধতিগত কৌশল সেই খোলামেলা আলোচনার দিকে যায় কি না দেখা যাক।
আরেকটি বিষয় হলো, একটা বা দুটো পরিসংখ্যান যদি দেখেন; প্রশাসনে যারা জড়িত তারা অনেকে বলছেন, তারা ১৫ বছর বঞ্চিত ছিলেন। বঞ্চিত কর্মকর্তার তালিকাটা দ্রুত হয়ে গেল। কিন্তু এই পরিবর্তনটা যারা নিয়ে এসেছেন, অর্থাৎ ছাত্র-জনতা, তাদের আহতদের তালিকাটা এখনো সম্পূর্ণ তৈরি হয়নি। এই পরিবর্তনটা একটা বেদনার সংকট তৈরি করেছে। তাহলে অগ্রাধিকার আসলে কোথায়? অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে কারা বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে? এই যে পদবঞ্চিত বলে কর্মকর্তারা সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু ছাত্র-জনতা যারা আহত হয়েছেন, তাদের এখনো আমলাতান্ত্রিকভাবে সত্যটা যাচাই করতে হচ্ছে। কাগজে যাচাই-বাছাই শব্দগুলো শুনতে পাচ্ছি। এটা অত্যন্ত আমলাতান্ত্রিক শব্দ। এখানে আমার মনে হচ্ছে, একটা ঘাটতির সমস্যা আছে। অন্তর্বর্তী সরকার আকাঙ্ক্ষাগুলো ঠিকই উচ্চারণ করছে। কিন্তু কার্যপ্রণালি যেভাবে করছে, সেটা একটা স্ববিরোধিতার সমস্যা তৈরি করছে। বিশেষ করে, আমলাতান্ত্রিক নির্ভরশীলতা অনেক বেশি বেড়ে গেছে। আগস্টে এক ধরনের ঐক্যের একটা শক্তিশালী আবহ তৈরি হয়েছিল। সবাই একত্রিতভাবে কিছু করতে চায়। সবাই চায় বাংলাদেশে পরিবর্তন যেন হয়। তারা অংশগ্রহণও করতে চায়। সেখানেও ঐক্যের ক্ষেত্রে অনেকটা ফাটল দেখা যাচ্ছে। ভিন্ন মত থাকতে পারে, সেটা কোনো সমস্যা নয়।
কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বের মাত্রা অনেক- এর একটি হচ্ছে রুটিন ওয়ার্ক। মন্ত্রণালয়গুলো চলতে হবে প্রতিদিন- সেই রুটিন ওয়ার্কের মাধ্যমে। আর একটা হচ্ছে, রোডম্যাপগুলো তৈরি করা, রাজনৈতিক রোডম্যাপ, সংস্কারের রোডম্যাপ, নির্বাচনের রোডম্যাপ- এগুলো তৈরি করা জরুরি। তৃতীয় আরেকটা বিষয় হচ্ছে, সবার মধ্যে ঐক্যের আবহ তৈরি করতে হবে এবং এই ঐক্যের বিষয়টাকে সংহত করতে হবে। কিন্তু সেখানেও ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। যা বলছি- এগুলো সবই চ্যালেঞ্জের বিষয়। নির্মোহভাবে এগুলোর সমাধান করতে হবে। জনগণ অন্তর্বর্তী সরকারকে বড় ধরনের দায়িত্ব দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করতে। এগুলো নির্মোহভাবে করে যেতে হবে। যাদের ক্ষমতায় বসানো হয়েছে, তারাও জবাবদিহির ঊর্ধ্বে নন। তারা যেসব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন, সেখানে কতটুকু সক্ষমতা দেখাচ্ছেন- এ বিষয়টা দেখা দরকার। যারা দায়িত্বে আছেন তাদের সক্ষমতার একটা পরীক্ষাও এখন চলছে। ২০২৫-এ সেই সক্ষমতার পরীক্ষার ফল আমাদের দেখতে হবে।
খবরের কাগজ: দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ও স্থিতিশীলতার জন্য সরকারের কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন, সেটাও প্রথমে জানা দরকার। কোথায় ঘাটতিগুলো হচ্ছে সেটা দেখা দরকার। আমরা দেখতে পাচ্ছি গ্রামাঞ্চলে এবং শহরেও বেশ কিছু অঞ্চলে ছিনতাই, রাহাজানির সংখ্যা বেড়েছে। অনেক জায়গায় দেখছি- ব্যবসায়ী মহল সেই অর্থে আস্থার জায়গাটা সেভাবে পাচ্ছে না। আস্থা না পেলে তারা অনেক বেশি বিনিয়োগ করবেন কীভাবে? আইনশৃঙ্খলার অবস্থা যে পর্যায়ে থাকা উচিত, সে পর্যায়ে নেই- এটা উপলব্ধির বিষয়। সেখানে কী করা উচিত, অবশ্যই তা নিয়ে রাজনৈতিকভাবে একই সঙ্গে প্রশাসনিকভাবে ভাবতে হবে। যেমন- পুলিশকে এখনো সার্বিকভাবে চালু করা যায়নি। পুলিশ অন্যতম একটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এখন কীভাবে তাদের চালু করা যেতে পারে, সে ক্ষেত্রে খুব জোরালো বা দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। সেখানে অনেক কিছু করার আছে। এটা একটা অন্যতম কাজ। পুলিশ প্রশাসনের যারা দোষী তাদের এক ধরনের শাস্তির প্রক্রিয়ায় নিয়ে এসে সার্বিকভাবে বাহিনীকে সচল করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এখানে তা হয়নি। সে জন্য স্বভাবতই আইনশৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্নগুলো উঠছে। দ্বিতীয়ত; একটি জোরালো রাজনৈতিক ম্যাসেজ দরকার।
এখানে রাজনৈতিক দলগুলোরও ভূমিকা আছে। ক্ষমতা, দখলবাজি, চাঁদাবাজি ইত্যাদির বিরুদ্ধে তাদের যে তৃণমূল পর্যায়ে কর্মী বাহিনী আছে, তারা যেন এ ধরনের কর্মকাণ্ডে লিপ্ত না হয়, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। সে জন্যই রাজনৈতিক দলগুলোর একটা জোরালো ম্যাসেজ দেওয়ার বিষয় আছে। আমি একটি বিষয়ে জোর দিয়ে আবারও বলছি, মানুষকে আস্থার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। কমিউনিটি পর্যায়ে স্থানীয় সরকার একেবারেই সচল নেই। পুলিশকে যেমন সচল করা দরকার, স্থানীয় সরকারকেও তেমনি সচল করা দরকার। এই দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ- যদি আইনশৃঙ্খলাকে ঠিক করতে হয়। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি অন্য সামাজিক শক্তিগুলোকেও বড় ম্যাসেজ দেওয়া দরকার। কমিউনিটি পর্যায়ে সামাজিক দায়িত্ব নিশ্চিত করা দরকার। সেখানে করণীয়গুলোও সুস্পষ্ট। পুলিশ, স্থানীয় সরকার- দুটিকেই সচল করতে হবে। যেটি বর্তমানে একেবারেই সচল নেই।
খবরের কাগজ: সরকার ইতোমধ্যেই বেশ কিছু সংস্কার কমিশন গঠন করেছে, কাজে হাত দিয়েছে। আপনি কি মনে করেন কমিশনগুলোর কাজ শেষ হওয়ার পরই নির্বাচন হওয়া উচিত?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: সংস্কার কাজে হাত দিয়েছে বলতে সরকার কিছু সংস্কার কমিশন করেছে। এটা একটা কাজ। কিন্তু সংস্কারের কাজে হাত দেওয়া- এটা আলাদা কাজ। শিক্ষায় অনেক সংস্কার দরকার। আমরা যখন বলি সংস্কারের কাজ, তখন বলতে হবে আমাদের এখানে প্রতিষ্ঠানগুলো জোরালোভাবে সচল হলো কি না। সার্বিকভাবে যে আমলাতান্ত্রিক একটা বোঝা শিক্ষা অঙ্গনের ওপর আছে, সেটা কতটুকু মুক্ত হলো, সেটি দেখা দরকার। শিক্ষার বিষয়গুলো, যেমন- কারিকুলাম কেমন হবে ইত্যাদি নানা বিষয়ে বিভিন্ন মহল থেকে চাপ তৈরি হয়, শিক্ষার অঙ্গনগুলোয় পরিস্থিতি ফেরত আসবে কি না, সেখানে এখনো দেখা যাচ্ছে- কে দোষ করেছিল, কে দোষ করেনি সেই আবহাওয়া এখনো চলছে। আপনি যখন প্রশ্ন করছেন যে, সংস্কার কাজে হাত দিয়েছে- এখন ওই প্রশ্নটি তুলতে হচ্ছে যে, সংস্কারের কোন কাজে হাত দিয়েছে? সেগুলো এখন দৃশ্যমান হওয়া দরকার।
সংস্কারের লক্ষ্যে সরকার একটা কাজ করেছে যে, তারা সংস্কার কমিশন বানিয়েছে। সংস্কার শব্দটা এমনভাবে বলা হচ্ছে যে, এটা দিয়েই অবধারিতভাবে বোঝা যাচ্ছে, সংস্কার বলতে আমরা কী বুঝছি। সংস্কারের মধ্যে তিনটি স্তর দেখা যাচ্ছে। একটি স্তর হচ্ছে- কাঠামোগত, কিছু আইনগত পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে। স্থানীয় সরকারের নির্বাচন ২০১৪-এ দলীয় প্রতীকে করার ফলে সাংঘাতিক ক্ষতি হয়েছে। এই সংস্কারটা করা হয়েছে কি না। এটা এখনো করা হয়নি। এ জন্য কোনো সংস্কার কমিশনের জন্য অপেক্ষা করার দরকার নেই। এখনই করে ফেলা যায়। সংস্কার হচ্ছে কাঠামোগত ও আইনগত পরিবর্তনের বিষয়। কিছু সংস্কার দরকার মানুষের মাইনসেট বা মানসিকতার পরিবর্তনের জন্য। আমাদের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সেখানে কিছু অনৈতিক চাপের জায়গা তৈরি হয়। সেই জায়গায় পরিবর্তনগুলো কিছুটা কাঠামোগত ও আইনগত সংস্কারের মাধ্যমে করতে হবে। কিছু সংস্কার আছে যেটা চলমান। প্রশাসনিক এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সঠিকভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে এখনই সে সংস্কারগুলো করা যায়। ব্যাংকিং সেক্টরে কিছু পরিবর্তন এসেছে।
মূলত পরিবর্তনটা হলো কিছু লোককে সরানো হয়েছে। কিছু নতুন লোককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সংস্কার নিয়ে আপনি যখন বললেন, তখন ২০২৫-এ এসে কোন সংস্কার নিয়ে আমরা কথা বলব, সেটাও জানা দরকার। সংস্কার শব্দটার মধ্যে অটোমেটিক কেউ বুঝছে না যে, কী হচ্ছে এর পেছনে অথবা কোন কথাটা আমরা বলছি। একই সঙ্গে খোলাসা করার বিষয়টা- আমরা সবসময় বলছি। এটার জন্য কি সংস্কার কমিশনের রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করতে হবে, নাকি যে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক ক্ষমতা আছে, সেটা সঠিকভাবে ব্যবহার করে এখনই পরিবর্তন করা দরকার সেটা বুঝতে হবে। আর একটা হচ্ছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এক অর্থে সমাজের যে মতগুলো একটা ঐকমত্য তৈরি করে, সে জায়গায় রাজনৈতিক সংস্কৃতির বেশ কিছু পরিবর্তন হতে পারে। আইনগত সংস্কারের বিষয় আছে, দ্বিকক্ষ পার্লামেন্ট হবে কি না ইত্যাদি ব্যাপার আলোচনার বিষয়। এসবের জন্য সময় লাগবে। সে জন্য আমি বলব, সরকার কোন ধরনের সংস্কারে হাত দিয়েছে, সেটা খোলাসা করা অত্যন্ত জরুরি।
খবরের কাগজ: অন্তর্বর্তী সরকার শিক্ষা কারিকুলাম পরিবর্তনে কাজ করছে। কারিকুলামে বেশ কিছু সংযোজন-বিয়োজনের কথা শোনা যায়। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: শিক্ষা কারিকুলাম বিষয়ে একটা কমিটি করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এই কমিটি বাতিল হয়ে গেল। আবার যতদূর শুনেছি, আপনি যেটা বললেন, যোজন-বিয়োজনের ব্যাপারটি ঘটেছে। টেক্সবই কিছু বদলাচ্ছে। এটা দেখার বিষয় আছে। এটা নিয়ে অনেক বিতর্কও হচ্ছে। এই বিষয়গুলো সার্বিকভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে আমি একটা বাস্তবতায় দেখেছি যে, শিক্ষাঙ্গনে আমাদের স্বাভাবিকতা ফিরে আসছে কি না, সেটা দেখা দরকার। শিক্ষার বিষয়টাকে প্রাধান্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো চালাতে পারছেন কি না, এই বিষয়গুলো দেখাটা বেশ জরুরি। কারিকুলাম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে চলে, এটা চলমান প্রক্রিয়া। এটাও দৃশ্যমান করা দরকার। আলোচনার ভিত্তিতে এটা করা যায়। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা আস্থার জায়গা তৈরি হচ্ছে কি না, এটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় বিষয়। সর্বোপরি জাতিগতভাবে শিক্ষার ভীত সুগঠিত করতে সুষ্ঠু কর্মপরিকল্পনা দরকার।
খবরের কাগজ: আপনি কি মনে করেন শিক্ষা খাতকে ঢেলে সাজানো উচিত? শিক্ষা খাতের কর্মপরিকল্পনা কেমন হওয়া উচিত?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: আসলে ঢেলে সাজানো শব্দগুলো এক ধরনের পপুলার শব্দ। বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকার বলি বা নতুন সময়কাল বলি- ঢালাওভাবে কথাবার্তাগুলো সমস্যা তৈরি করছে। কী সংস্কার, এটার ব্যাখ্যা না দিয়ে আমরা সংস্কারের কথা বলছি। আমি মাধ্যমিক শিক্ষাকে ঠিক করছি, প্রাথমিককে, নাকি উচ্চশিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষা- কোনগুলোকে কীভাবে ঠিক করব এবং আমি শিক্ষককে চালকের আসনে বসাতে পারব কি না, তাদের দক্ষতা বাড়াতে পারব কি না ইত্যাদি। শিক্ষা পরিচালনায় স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটি- ওগুলো ছিল একেবারে রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট এবং অকার্যকর। কাজেই শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানো বলতে আমাদের এখন সুনির্দিষ্টভাবে কর্মপরিকল্পনাগুলো সাজানো খুবই প্রয়োজন।
খবরের কাগজ: উত্তরাধিকার সূত্রে অন্তর্বর্তী সরকার একটি খারাপ অর্থনীতি পেয়েছে। এর থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে কী পদক্ষেপ নিতে পারে?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: এটা সত্য, আমাদের অর্থনীতির অবস্থা খারাপ ছিল। কিন্তু সেখানেও আমাদের প্রবাসীরা ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে রেমিট্যান্স পাঠানোর বিষয়ে। স্বৈরশাসনের শেষ দিকে তারা রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ রেখেছিল। বর্তমানে রেমিট্যান্সের গতি বেড়েছে। রপ্তানিও মোটামুটি সন্তোষজনক অবস্থায় আছে। এখানে আমি আবারও যেটা বলব, আমাদের অন্তর্বর্তী সরকার সার্বিকভাবে অর্থনীতি নিয়ে ব্যস্ত আছে। ব্যক্তি খাতের সঙ্গে যদি বড় ধরনের সংযুক্তি না হয়, মাঠ বাস্তবতা না জানি, নিবিড় তথ্য না জানি, কোথায় কোন সমস্যা হচ্ছে সেই পরামর্শগুলোকে সঙ্গে নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে পদক্ষেপ নিতে না পারি, তাহলে সমস্যা প্রকট হবে।
এখানে অনেক বিষয় আছে- তার মধ্যে সমন্বয় একটা বড় ব্যাপার। এটা শুধু অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। এখানে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাজ আছে, শিল্প মন্ত্রণালয়ের কাজ আছে, সার্বিকভাবে পুরো উপদেষ্টা পরিষদের কাজ আছে। কারণ আইনশৃঙ্খলা উন্নত না হলে লোকজন বিনিয়োগ করতে সাহস পাবে না। কর্মসংস্থান তৈরি করা যাবে না। এভাবে অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ বাড়বে। মূলত অর্থনীতিতে যারা ক্রিয়াশীল আছেন, সেটা বিশেষ করে ব্যক্তি খাতের সঙ্গে সংযোগ ও সমন্বয় অন্তর্বর্তী সরকারের অনেক বেশি বাড়ানো দরকার। এখানে মানসিকতার এক ধরনের অনীহা অথবা অনুপস্থিতি দেখতে পাচ্ছি। তাদের সঙ্গে আরও বেশি কথা বলা দরকার। শুধু এফবিসিসিআই প্রেসিডেন্টকে ডেকে একটা কিছু করলাম অথবা আমি হঠাৎ করে কাউকে ধরলাম, যা এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি করে। এই জায়গায় অন্তর্বর্তী সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন।
দ্বিতীয় কিস্তি আগামী দিন। চোখ রাখুন…