ঢাকা ৩ মাঘ ১৪৩১, শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি ২০২৫

বাশারের পতন: তুরস্ক, ইসরায়েল ও পশ্চিমাদের বিজয়!

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:১৬ পিএম
বাশারের পতন: তুরস্ক, ইসরায়েল ও পশ্চিমাদের বিজয়!
শ্লোমো বেন-অমি

সিরিয়ার আল-আসাদ রাজবংশের ৫৪ বছর পর পতন মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে বদলে দিয়েছে। ইসলামপন্থি হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) মিলিশিয়ার অতর্কিত আক্রমণ সিরিয়ার প্রতিবেশী দেশ ও অন্য সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ রাশিয়ায় পালিয়ে যাওয়ার খবর আরেকটি যুদ্ধের জন্ম দিতে পারে। সেই যুদ্ধ অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। 

৭ অক্টোবর ২০২৩, গাজা সীমান্তবর্তী এলাকায় ইসরায়েলের বেসামরিক নাগরিকের ওপর হামাস যে হামলা চালিয়েছিল, তা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ভূমিকম্পের মতো ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। গাজায় হামাসকে নির্মূল করতে ইসরায়েল নির্মমভাবে আক্রমণ করে। ইসরায়েল লেবাননে হিজবুল্লাহর ওপর আক্রমণ করে মূলত ইরানের ‘প্রতিরোধের অক্ষ’কে ধ্বংস করেছে, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য আন্তর্জাতিক শিপিংয়ে হুতি হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইয়েমেনে ইরান-সমর্থিত হুতিদের ওপর আক্রমণ করে। 

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ২০১১ সালে, যখন আসাদ সরকার শান্তিপূর্ণ ‘আরব বসন্ত’ বিক্ষোভকে চূর্ণ করেছিল। কিন্তু ২০১৫ সালের পর যুদ্ধটি অনেকাংশে কমে যায়, যখন রাশিয়া হস্তক্ষেপ করে। ইরান এবং হিজবুল্লাহর সহায়তায় সেই যুদ্ধটি আসাদের পক্ষে চলে যায়। ইরানের প্রক্সি ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় এবং ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার যুদ্ধের ক্ষমতা কিছুটা হ্রাস পাওয়ায় বিদ্রোহীরা সুযোগ নিয়েছে। তুরস্কের সহায়তায় বিদ্রোহীরা সহজেই বাশার সরকারের দুর্বল প্রতিরক্ষাকে পরাস্ত্র করে ফেলে। বাশার আল-আসাদের সেনাবাহিনী যুদ্ধ ছাড়াই আত্মসমর্পণ করে। ইরান ও রাশিয়ার পৃষ্ঠপোষকরা দ্রুত তাদের বাহিনী সরিয়ে নেয় এবং তাকে তার ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। 

সিরিয়ার সঙ্গে ইরানের জোট আরব বিশ্বে প্রধান শক্ত ঘাঁটি ছিল এবং এর অবসান আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যকে নতুন রূপ দেবে। মোহাম্মদ আলী আবতাহি, যিনি ছিলেন ইরানের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট। তিনি বাশার পালানোর দুই দিন আগে বলেছিলেন, সিরিয়া সরকারের পতন মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি হবে। 

ইসরায়েল প্রভাবশালী শক্তি হয়ে উঠবে। হায়াত তাহরির আল-শাম নামটি আরবের দেশগুলোর দ্বীপ অঞ্চলসহ ভূমধ্যসাগরের পূর্ব অংশের মুক্তির জন্য দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এইচটিএস নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি নতুন ধরনের ইসলামপন্থি ভাবমূর্তি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তিনি আল-কায়েদা এবং ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর ব্যর্থতা থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করেছেন বলে মনে হয়। এখন তিনি নিজেকে একজন বাস্তববাদী হিসেবে দেখেন, যিনি শুধু সিরিয়ার নিপীড়নমূলক শাসন থেকে মুক্তি আনতে চান।
 
তার এই নতুন বাস্তববাদের লক্ষণ হলো সিরিয়ার প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ গাজী আল-জালালিকে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর না করা পর্যন্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অনুমতি দেওয়ার জন্য জোলানিকে তার লোকদের নির্দেশ করতে হবে। আইএস সৈন্য ও কর্মকর্তাদের ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালাত। তার পরও আল-জোলানি একটি কট্টর ইসলামপন্থি সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তুরস্ক এইচটিএস-এর চরমপন্থাকে প্ররোচিত করতে পারে। অনেকে ধারণা করছেন, জোলানি তুরস্কের একজন অনুগত সৈনিক হতে পারেন। যাই হোক না কেন, আল-জোলানি শক্তিশালী রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হচ্ছেন। 

তাকে অবশ্যই প্রতিদ্বন্দ্বী মিলিশিয়াদের সঙ্গে তুলনা করতে হবে, যারা বাশারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য একত্রিত হয়েছিল। উত্তরে তুর্কি বাহিনীর আক্রমণের সময় পূর্ব সিরিয়ার আরও কিছু অংশের নিয়ন্ত্রণ নিতে ছুটে আসা কুর্দি বাহিনীকেও প্রতিরোধ করেছিল। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের কাছে সিরিয়ার কুর্দিরা তুরস্কের কুর্দিদের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহকে উৎসাহিত করার হুমকি দেয়।
২০১৯ সালে এরদোয়ান উত্তর সিরিয়ায় ৩০ কিলোমিটারজুড়ে একটি ‘নিরাপত্তা অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কুর্দি যোদ্ধাদের তুর্কি সীমান্ত থেকে দূরে ঠেলে দেওয়ার জন্য তিনি সেনাবাহিনী নিযুক্ত করেছিলেন। এমন এলাকা যেখানে কুর্দিরা একটি স্বায়ত্তশাসিত ছিটমহলকে নিজের দখলে নিয়ে গৃহযুদ্ধের জন্য সুযোগ খুঁজছিলেন। 

কুর্দিদের স্বায়ত্তশাসন টিকে রাখার আকাঙ্ক্ষা এবং সীমান্ত এলাকা থেকে তাদের দূরে রাখার জন্য তুরস্কের মধ্যে সমঝোতা খুঁজে পেতে জোলানিকে এখন কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। এরদোয়ান কি কুর্দি আঞ্চলিক ক্ষমতা সহ্য করবেন, যা তিনি তুরস্কের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করেন? জোলানি কি তুরস্ককে কুর্দিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অনুমতি দেবেন? যখন তিনি তাদের সঙ্গে শাসক জোট গঠন করার চেষ্টা করছেন এবং সিরিয়ার আঞ্চলিক সার্বভৌমত্বকে সমর্থন করতে যাচ্ছেন। সিরিয়ার কুর্দিদের সঙ্গে তার দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত সত্ত্বেও এরদোয়ান বাশারের পতনকে দুর্দান্ত অর্জন হিসেবে দেখেন। বিদ্রোহী বাহিনীর অগ্রযাত্রা অনুসরণ করে তিনি আনন্দিত হয়েছিলেন। সিরিয়ার এই অগ্রযাত্রা কোনো ঘটনা ছাড়াই চলতে থাকে। 

বছরের পর বছর এরদোয়ান এবং তার কাতার মিত্ররা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইসলামপন্থি দলগুলোকে সমর্থন করে আসছে। তিনি নিজেকে ইরানিদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় দেখেছিলেন যে, মুসলিম ভূমিতে ইসলামি গণতন্ত্রের কোন মডেলটি প্রাধান্য পাবে: শিয়া মৌলবাদী বা তুরস্কের মধ্যপন্থি কোনো রূপ। এখন তিনি বিশ্বাস করেন, তিনি দেশের সন্নিকটেই এমন একটি মডেলকে রূপ দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। 

যদিও সিরিয়ার বিদ্রোহীদের এমন সাফল্যের পেছনে ইসরায়েলের হাত রয়েছে। সে জন্য ইসরায়েলকে ধন্যবাদ দেওয়ার অনেক কিছু রয়েছে। ইসরায়েল তার নতুন প্রতিবেশীদের সম্পর্কে কোনো ভুল ধারণা পোষণ করে না। আল-জোলানি সিরিয়ার গোলান মালভূমিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন (তাই নাম জোলানি), ইসরায়েল ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ওই অঞ্চল দখল করেছিল। যার সংযুক্তি ও সার্বভৌমত্ব ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। 

দামেস্কে বিদ্রোহী অগ্রযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে ইসরায়েল সিরিয়ার সীমান্তে যুদ্ধ ইউনিট মোতায়েন করে। গোলান মালভূমিতে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর ছড়িয়ে পড়া এবং সীমান্তে সিরিয়ার পাশের দ্রুজ এলাকায় আক্রমণ করা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল ইসরায়েল। ৭ অক্টোবরের রোমহর্ষক ঘটনা এখনো ইসরায়েলের মনে গেঁথে আছে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ক্ষোভকে অবমূল্যায়ন করা উচিত নয়। সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের অত্যাচারের পতন যদি ঘটতে পারে, কেন ইরানকেও পতনের চেষ্টা করা হবে না? নেতানিয়াহু প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপের বাইরে চলে যাওয়ার প্রলোভন রয়েছে। তিনি যুক্তি দিয়েছেন, ১৯৭৪ সালের চুক্তি অনুযায়ী ইসরায়েল ও সিরিয়ার মধ্যে যে বাহিনী বিচ্ছিন্নকরণ নিয়ন্ত্রিত ছিল তা ভেঙে গেছে। তিনি ইসরায়েলি সৈন্যদের হারমন পর্বতের সিরিয়ার অংশের নিয়ন্ত্রণ দখল করতে নির্দেশ দেন। সিরিয়ার সার্বভৌম ভূখণ্ডের বাফার জোন এবং এর আশপাশে প্রভাবশালী অবস্থান নেয়। 

এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্ররাও একইভাবে উদ্বিগ্ন। তারাও বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতায় থাকাটা পছন্দ করত, এই ভয়ে যে ইসলামপন্থি নিয়ন্ত্রিত সিরিয়া সন্ত্রাসবাদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠতে পারে। তাদের দৃষ্টিতে বাশার আল-আসাদ ইসলামপন্থি বিদ্রোহী নেতৃত্বাধীন সরকারের চেয়ে ভালো, যদিও এটি মধ্যপন্থি বলে দাবি করে।

বাশার আল-আসাদের পতন ঘটেছে। মধ্যপ্রাচ্য আবার নাটকীয়ভাবে পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যর পুনরুদ্ধারে সবার এগিয়ে আসা উচিত।

লেখক: ইসরায়েলের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল

বিপ্লব-পরবর্তী যে রোডম্যাপ ঘোষিত হয়নি

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:৫৩ এএম
বিপ্লব-পরবর্তী যে রোডম্যাপ ঘোষিত হয়নি
এ এফ এম আবদুর রহমান

বিপ্লবী ছাত্র-জনতা কর্তৃক আমাদিগকে প্রদত্ত কর্তৃত্বের মর্যাদা রক্ষার্থে নিজেদের সমন্বয়ে বাংলাদেশের জন্য একটি অন্তর্বর্তী বিপ্লবী সরকার গঠন করিলাম এবং পারস্পরিক আলোচনা করিয়া বাংলাদেশের জনগণের জন্য গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থায় সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারসম্পন্ন রাষ্ট্র পরিচালনায় অঙ্গীকারবদ্ধ হইলাম।...


অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সব রাজনৈতিক দলসহ জনগণের একটি প্রত্যাশা ছিল রাষ্ট্র সংস্কারের রোডম্যাপ ঘোষণার। কিন্তু সেটি ঘোষিত হয়নি। যে রোডম্যাপটি ঘোষিত হওয়া অত্যাবশ্যক ছিল সেটি আমার প্রস্তাবনায় নিম্নরূপ হতে পারত:
জুলাই-আগস্ট বিপ্লব ও অন্তর্বর্তী সরকারকে সাংবিধানিক ভিত্তি প্রদান ও ক্ষমতা হস্তান্তরের রোডম্যাপের রূপরেখা:
১. ‘প্রোক্লামেশন অব রেভ্যুলিউশন’ বা ‘বিপ্লবের ফরমান’ জারি করে অন্তর্বর্তী বিপ্লবী সরকারের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা।
২. প্রোক্লামেশন অব রেভ্যুলিউশনে হাসিনা সরকারের পতন, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনকে ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান’ তথা ‘বিপ্লব’-এ রূপান্তরিত হওয়ার ঘোষণা দেওয়া।
৩. ‘সফল বিপ্লব’-এর ফলে বিদ্যমান সংবিধান স্বয়ংক্রিয়ভাবে অবলুপ্তি হওয়া বিবেচনা করা।
৪. প্রোক্লামেশন অব রেভ্যুলিউশনের ক্ষমতায় একজন নতুন রাষ্ট্রপতি মনোনয়ন করা।
৫. স্বৈরাচার সরকার কর্তৃক সৃষ্ট রাষ্ট্রীয়, বিচারিক ও আর্থিক সব প্রতিষ্ঠানের বিশৃঙ্খলার সংস্কার সাধন করা।
৬. প্রোক্লামেশন অব রেভ্যুলিউশনের অধীনে সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে একটি গণপরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করা।
৭. নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্যদের দ্বারা নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা।
৮. নতুন সংবিধানের অধীনে সংসদের নির্বাচন করা।
৯. রাষ্ট্রপতির আহ্বানে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের দ্বারা সরকার গঠন করা।
১০. নতুন সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা ও অন্তর্বর্তী বিপ্লবী সরকার বিলুপ্ত করা।

এই রোডম্যাপের ভিত্তিতে যে ‘প্রোক্লামেশন অব রেভ্যুলিউশন’ ঘোষিত হতে পারত সেটি নিম্নরূপ-

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
যেহেতু ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে শুরু হওয়া একটি ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জনগণ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করিয়াছে এবং উহার গণপরিষদ গঠন করিয়া ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাসের ৪ তারিখে রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়নপূর্বক উহা ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর হইতে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে গ্রহণ করিয়াছে;
যেহেতু সংবিধানের প্রস্তাবনা এবং ১১ অনুচ্ছেদের বিধানে এই মর্মে অঙ্গীকার ও নিশ্চয়তা বিধান করা হইয়াছিল যে, রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে;

যেহেতু রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সভাপতিরূপে শেখ হাসিনা নবম সংসদে নির্বাচিত হইয়া সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সরকার গঠন করেন এবং প্রধানমন্ত্রীরূপে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার মানসিকতায় রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সহায়তায় নির্বাচনব্যবস্থা কলুষিত করিয়া ভোটারবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দশম, একাদশ ও দ্বাদশ সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করেন এবং সরকারের সর্বময় ক্ষমতা নিজ হস্তে কুক্ষিগত করেন;

যেহেতু শেখ হাসিনা ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ৬ জানুয়ারি হইতে ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময়কালে সরকার পরিচালনাকালীন সর্বগ্রাসী দুর্নীতির মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক অবকাঠামোয় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করিয়া গণতন্ত্রহীনতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বিচারব্যবস্থা অকার্যকরক্রমে নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রকে অকার্যকর করিয়া এক অমানবিক ও নীতি-নৈতিকতাবিহীন স্বৈরাচারী প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন; যেহেতু সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সংবিধানে ত্রয়োদশ, চতুর্দশ, পঞ্চদশ ও ষষ্ঠদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের এক-তৃতীয়াংশ অসংশোধনযোগ্য রূপে কঠোর বিধান করিয়া ভবিষ্যতের সকল সংসদকে অকার্যকর করিয়া রাখিয়াছিলেন; যেহেতু বাংলাদেশের সকল কার্যকরী বিরোধী দলের সদস্যরা চরম অমানবিক নিষ্পেষণের শিকার হইয়া শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিতে অস্বীকৃত হওয়ায় জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট প্রদানে বিরত থাকে, যাহার ফলে নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সরকার পরিবর্তন অসম্ভব হইয়া পরে;

যেহেতু বিগত পনেরো বছর এক অমানবিক, অনৈতিক, বিচারহীন অগণতান্ত্রিক সমাজে জনগণ মতপ্রকাশে বিপদাপন্ন ছিলেন ও শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় বসবাস করিতেছিলেন; যেহেতু জুলাই-আগস্ট ২০২৪ মাসে ছাত্র-জনতা এক ঐতিহাসিক আন্দোলনের মাধ্যমে যে সফল বিপ্লব ও জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থান সংঘটন করেন এবং যাহার দমনে শেখ হাসিনার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্বিচারে প্রাণঘাতী গুলিবর্ষণে সহস্রাধিক ছাত্র-জনতার জীবনহানি করিয়াছে; যেহেতু এই সফল বিপ্লবের ফলে ৫ আগস্ট ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতি বরাবরে পদত্যাগ করিয়া পলায়ন-প্রক্রিয়ায় দেশত্যাগ করিলে দেশ সরকারবিহীনতায় পতিত হয় এবং সংসদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিলুপ্ত হয় এবং যেহেতু বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের সর্বময় ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং সেই সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী জনগণের পক্ষে বিপ্লবী ছাত্র-জনতার অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে বিপ্লবী ছাত্র-জনতার দ্বারা আমরা মনোনীত হইয়া বিপ্লবী পরিষদ গঠন করিয়াছি; সেহেতু বিপ্লবী ছাত্র-জনতা কর্তৃক আমাদিগকে প্রদত্ত কর্তৃত্বের মর্যাদা রক্ষার্থে নিজেদের সমন্বয়ে বাংলাদেশের জন্য একটি অন্তর্বর্তী বিপ্লবী সরকার গঠন করিলাম এবং পারস্পরিক আলোচনা করিয়া বাংলাদেশের জনগণের জন্য গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থায় সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারসম্পন্ন রাষ্ট্র পরিচালনায় অঙ্গীকারবদ্ধ হইলাম। আমরা আরও ঘোষণা করিতেছি যে, জুলাই-আগস্ট ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান আন্দোলনটি একটি সফল বিপ্লব হিসেবে পরিসমাপ্ত হইয়াছে।

আমরা আরও ঘোষণা করিতেছি যে, ঘোষিত সফল বিপ্লবের ফলে ১৯৭১ সালে গঠিত গণপরিষদ কর্তৃক ৪ নভেম্বর ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে প্রবর্তিত ও ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে গৃহীত বাংলাদেশের সংবিধান, উহার ষোলোটি সংশোধনীসহ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হইয়া যাওয়ায় বর্তমানে উক্ত সংবিধানের কোনো আইনগত কার্যকারিতা ও অস্তিত্ব নাই। আমরা ঘোষণা করিতেছি যে, আমরা বাংলাদেশের জন্য একজন রাষ্ট্রপতি মনোনীত করিব এবং ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতাসহ প্রজাতন্ত্রের সকল নির্বাহী ও আইন প্রণয়ন ক্ষমতা রাষ্ট্রপতি প্রয়োগ করিবেন এবং তিনি প্রজাতন্ত্রের সকল সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হইবেন।

আমরা আরও ঘোষণা করিতেছি যে, স্বৈরাচার সরকার কর্তৃক রাষ্ট্রীয়, বিচারিক ও আর্থিক সকল প্রতিষ্ঠানে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হইয়াছে আমরা তাহার সংস্কার সাধন করিব। আমরা আরও ঘোষণা করিতেছি যে, বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের জন্য আমরা সুবিধাজনক সময়ে গণপরিষদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করিব এবং উক্ত গণপরিষদ দ্বারা প্রণীত সংবিধানের বিধান অনুযায়ী সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করিব। আমরা দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করিতেছি যে, নির্বাচিত সংসদ দ্বারা গঠিত সরকারের নিকট আমরা ক্ষমতা হস্তান্তর করিব ও তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের বিপ্লবী পরিষদের অবলুপ্তি ঘটিবে।
আমরা আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে, এই ঘোষণাপত্র ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৫ আগস্ট দুপুর ২টা ৩১ মিনিট হইতে কার্যকর হইয়াছে মর্মে বিবেচিত হইবে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস
(উপদেষ্টা পরিষদের অনন্য সদস্য)
বিপ্লবী ছাত্র-জনতার মনোনয়নে ক্ষমতাপ্রাপ্ত বিপ্লবী পরিষদ।
বঙ্গভবন, ৮ আগস্ট ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ।
ইতোমধ্যে অনেকটা সময় চলে গেলেও সময় একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। বর্তমান সরকারের বৈধতাসংক্রান্ত বিষয় হওয়ায় ভবিষ্যতের সব জটিলতা এড়ানোর জন্য এখনই এই ‘বিপ্লবের ফরমান’ জারি করা আবশ্যক। নতুবা সমগ্র জাতিকে পস্তাতে হতে পারে।

লেখক: বিচারপতি
(বি. দ্র.: ভাষারীতি ও মতামত লেখকের নিজস্ব।)

গাজা যুদ্ধবিরতি: দীর্ঘ বর্বরতার পর ব্যর্থ ইসরায়েল

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:২৬ এএম
গাজা যুদ্ধবিরতি: দীর্ঘ বর্বরতার পর ব্যর্থ ইসরায়েল

গাজা সব ফিলিস্তিনির এবং বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে যে তারা সম্পূর্ণ যুদ্ধ সহ্য করতে পারে। ফিলিস্তিনিরা যে ভূমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তা থেকে তারা নড়বে না। এটি বিশ্বকে জানান দেয় যে দখলদাররা তাদের যা কিছু ছিল তাই আমাদের দিকে ছুড়ে ফেলেছে। এটি কোনো নাকবা ছিল না। গাজা ইসরায়েলকে জানান দিয়েছে যে ফিলিস্তিনিরা বিদ্যমান রয়েছে। যতক্ষণ না ইসরায়েলিরা তাদের সঙ্গে সমান অধিকারের বিষয়ে সমান শর্তে কথা না বলে, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা শান্ত হবে না।...

কয়েক মাস ধরে নেতানিয়াহু গাজা যুদ্ধবিরতির প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, যার ফলে তার নিজস্ব আলোচকদের মধ্যেও হতাশার সৃষ্টি হয়েছিল। দুই মাসেরও বেশি সময় আগে তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়াভ গ্যালান্টের বিদায়ের মাধ্যমে এ বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৫ মাসব্যাপী যুদ্ধের প্রধান স্থপতি গ্যালান্ট স্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে গাজায় সেনাবাহিনীর করার মতো আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।
তবুও নেতানিয়াহু জেদ ধরে রেখেছিলেন। গত বসন্তে তিনি সিআইএ পরিচালক উইলিয়াম বার্নসের উপস্থিতিতে রাফাহর ওপর আক্রমণের পক্ষে হামাসের স্বাক্ষরিত চুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। শরৎকালে নেতানিয়াহু জেনারেলদের পরিকল্পনার দিকে মনোনিবেশ করেন, যার লক্ষ্য ছিল ইসরায়েলিদের পুনর্বাসনের প্রস্তুতির জন্য উত্তর গাজা খালি করা। পরিকল্পনাটি ছিল উত্তর গাজার জনগণকে অনাহারে মারা এবং বোমা হামলা চালিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া। কেউ স্বেচ্ছায় চলে না গেলে তাকে সন্ত্রাসী হিসেবে গণ্য করা হবে। এটি এতটাই চরম ও আন্তর্জাতিক যুদ্ধের নিয়মের পরিপন্থি ছিল যে সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোশে ইয়ালন এটিকে যুদ্ধাপরাধ এবং জাতিগত নির্মূল বলে নিন্দা করেছিলেন। এই পরিকল্পনার মূল চাবিকাঠি ছিল গাজা উপত্যকার কেন্দ্রস্থলে ইসরায়েল সীমান্ত থেকে সমুদ্র পর্যন্ত একটি সামরিক রাস্তা ও ফাঁড়ি দিয়ে একটা করিডর করা। নেটজারিম করিডর কার্যকরভাবে অঞ্চলটির স্থলভাগ প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনে এবং নতুন উত্তর সীমান্তে পরিণত হয়। উত্তর গাজা থেকে বিতাড়িত কোনো ফিলিস্তিনিকে ফিরে আসতে দেওয়া হতো না।

বাইডেন প্রশাসনের কেউ নেতানিয়াহুকে এই পরিকল্পনা পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করেনি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নিজেও নন। তিনি একজন সহজাত ইহুদিবাদী, যিনি তার সব বক্তৃতার মাধ্যমে গাজায় গণহত্যা চালানোর জন্য ইসরায়েলকে সহযোগিতা করেছেন। তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনও এই অঞ্চলের সবচেয়ে কম বিশ্বস্ত কূটনীতিক হিসেবে পরিগণিত হয়েছিলেন। 
যুদ্ধবিরতি চুক্তির চূড়ান্ত সময়ে ব্লিঙ্কেন এক সংবাদ সম্মেলনে হামাসকে পূর্ববর্তী প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার জন্য দোষারোপ করেন। নীতিগতভাবে সত্যটি ছিল বিপরীত। আলোচনা কভার করা প্রত্যেক ইসরায়েলি সাংবাদিক রিপোর্ট করেছেন যে নেতানিয়াহু পূর্ববর্তী সব চুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং এই চুক্তিতে বিলম্বের জন্য তিনিই দায়ী।

নেতানিয়াহুর ১৫ মাসের যুদ্ধের বিষয়ে সময় নির্ধারণের জন্য নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষ মধ্যপ্রাচ্য দূত স্টিভ উইটকফের সঙ্গে একটি সংক্ষিপ্ত বৈঠকে এটি শেষ হয়েছিল। এক বৈঠকের পর নেতানিয়াহু ১৫ মাস ধরে যে রেড লাইনগুলো এঁকেছিলেন, সেগুলো মুছে ফেলা হয়েছে। ইসরায়েলি পণ্ডিত এরেল সেগাল যেমন বলেছিলেন, ‘ট্রাম্পের নির্বাচনের জন্য আমরাই প্রথম মূল্য দিতে যাচ্ছি। (চুক্তিটি) আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে... আমরা ভেবেছিলাম আমরা উত্তর গাজার নিয়ন্ত্রণ নেব, যাতে মানবিক সাহায্যে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।’

কলামিস্ট ইয়োসি ইয়েহোশুয়া ওয়াইনেটে লিখেছেন, ‘এটি একটি ঐকমত্য হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। ইসরায়েলের বিজয়ের মনোভাব নিয়ে পুরোপুরি সন্দেহ রয়েছে। বাস্তবতাকে আড়াল করার কোনো প্রয়োজন নেই। যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মি মুক্তি চুক্তি ইসরায়েলের জন্য খারাপ হবে। তবে এটি মেনে নেওয়া ছাড়া এর আর কোনো উপায় নেই।’

যুদ্ধবিরতি চুক্তির খসড়ায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই ফিলাডেলফি ও নেটজারিম করিডর উভয় থেকে ইসরায়েল সরে আসবে। নেতানিয়াহু আগেও এ রকম অনেক শর্ত প্রত্যাখ্যান করেছেন। 
এমনকি এটি ছাড়াও খসড়া চুক্তিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে ফিলিস্তিনিরা যাতে তাদের বাড়িতে ফিরে যেতে পারে। এর মধ্যে উত্তর গাজাও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখান থেকে গাজা বাসিন্দাদের উচ্ছেদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এটি ইসরায়েলের স্থল আক্রমণের সবচেয়ে বড় একক ব্যর্থতা।
ইসরায়েল কেবল গ্লোবাল সাউথকেই হারাচ্ছে না, তারা আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায় এই ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়েছিল এবং জনমত হারিয়েছে। বরং পশ্চিমাদের এমন একটি প্রজন্মের সমর্থনও হারিয়েছে। 

কথাটা আমার নয়। জ্যাক লিউ খুব ভালোভাবেই তুলে ধরেছেন। হামাসের হামলার এক মাস আগে বাইডেন যাকে ইসরায়েলে রাষ্ট্রদূত হিসেবে মনোনীত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি মানুষকে যা বলেছি, এই যুদ্ধ শেষ হলে তাদের চিন্তা করতে হবে। প্রজন্ম তাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, ছয় দিনের যুদ্ধ, ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধ, এমনকি ইন্তিফাদার সঙ্গে যুদ্ধও স্মৃতি থেকে ভুলে যাবে।’ তার বিদায়ী সাক্ষাৎকারে একজন অর্থোডক্স ইহুদি হিসেবে লিউ টাইমস অব ইসরায়েলকে বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে জনমত এখনো মূলত ইসরায়েলপন্থি, কিন্তু তা পরিবর্তন হচ্ছে। 

আমি এখানকার লোকদের যা বলেছি যে এই যুদ্ধ শেষ হলে তাদের চিন্তা করতে হবে তা হলো প্রজন্মের স্মৃতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, ছয় দিনের যুদ্ধ, ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধ, এমনকি ইন্তিফাদার সঙ্গেও ফিরে যায় না। এটি এই যুদ্ধ দিয়ে শুরু হয় এবং আপনি ভবিষ্যতের নীতিনির্ধারকদের ওপর এই যুদ্ধের প্রভাব উপেক্ষা করতে পারবেন না। আজ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ব্যক্তিদের ওপর নয়, বরং আজ ২৫, ৩৫, ৪৫ বছর বয়সী এবং যারা পরবর্তী ৩০, ৪০ বছরের জন্য নেতা হবেন।’
নেতানিয়াহুর প্রতি লিউর আক্রমণ সাম্প্রতিক জরিপে ব্যাপকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি আমেরিকান ইহুদি কিশোর হামাসের প্রতি সহানুভূতিশীল দেখিয়েছে। ৪২ শতাংশ আমেরিকান বিশ্বাস করে যে ইসরায়েল গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে এবং ৬৬ শতাংশ গোটা ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি সহানুভূতিশীল।

এটি কোনো নতুন ঘটনা নয়। যুদ্ধের দুই বছর আগে করা জরিপে দেখা গেছে , আমেরিকান ইহুদিদের এক-চতুর্থাংশ একমত যে ইসরায়েল একটি বর্ণবাদী রাষ্ট্র। জরিপে উত্তরদাতাদের একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এই বক্তব্যকে ইহুদিবিরোধী বলে মনে করেননি।

গাজার যুদ্ধ ভবিষ্যতের নতুন প্রজন্মের নেতাদের জন্য ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত দেখার বিষয় হয়ে উঠেছে। ২০২৩ সালের ৬ অক্টোবর ভেবেছিল যে তারা ফিলিস্তিনের বিষয়টি বন্ধ করে দিয়েছে এবং বিশ্ব জনমত তাদের নিয়ন্ত্রণে।
যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ, যা পশ্চিমা সরকারগুলো প্রথমে ইহুদিবিদ্বেষী এবং পরে সন্ত্রাসবাদ হিসেবে আইন প্রণয়ন করে ফিলিস্তিনের মুক্তির জন্য বিশ্বব্যাপী ফ্রন্ট তৈরি করেছে। ইসরায়েলকে বয়কট করার আন্দোলন এখন আগের চেয়েও অনেক শক্তিশালী।

ইসরায়েল এখন আন্তর্জাতিক বিচারের কাঠগড়ায়, যা আগে কখনো হয়নি। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে নেতানিয়াহু ও গ্যালান্টের বিরুদ্ধে কেবল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়নি, আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার মামলাও অব্যাহত রয়েছে। 

এ ছাড়া ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সম্প্রতি গাজা অভিযানে অংশগ্রহণকারী সব সৈন্যের পরিচয় গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ তাদের ভয় ছিল, বিদেশ ভ্রমণের সময় তাদের অনুসরণ করা হতে পারে।

২০২৪ সালের জানুয়ারিতে গাজায় ইসরায়েলি সেনাদের হাতে নিহত ছয় বছর বয়সী শিশু হিন্দ রজব নামে একটি ক্ষুদ্র কর্মী গোষ্ঠী এই বড় পদক্ষেপ নেয়। বেলজিয়ামভিত্তিক এই গোষ্ঠীটি ভিডিও, অডিও, ফরেনসিক রিপোর্ট এবং অন্যান্য নথিসহ ১ হাজার ইসরায়েলি ব্যক্তির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ দাখিল করেছে।

গাজায় যুদ্ধবিরতি মানেই ফিলিস্তিনের দুঃস্বপ্নের শেষ হওয়া নয়। বরং ইসরায়েলের শুরু। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর গাজায় যা ঘটেছিল তার সত্যতা উন্মোচিত এবং নথিভুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আইনি পদক্ষেপগুলো গতি ফিরে পাবে। 

নেতানিয়াহু যুদ্ধ থেকে এমন একটি দেশে ফিরে আসবেন, যেখানে অভ্যন্তরীণভাবে আগের চেয়েও বেশি বিভক্ত হবে। সেনাবাহিনী এবং সেবা করতে অস্বীকৃতি জানানো হারেদিমদের মধ্যে সংগ্রাম চলছে। ধর্মনিরপেক্ষ এবং জাতীয় ধর্মীয় ইহুদিবাদীদের মধ্যে সংগ্রাম চলছে। গাজায় নেতানিয়াহুর পশ্চাদপসরণের সঙ্গে বসতি স্থাপনকারী অতি-ডানপন্থিরা বুঝতে পারছেন যে বৃহত্তর ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার সুযোগ খুবই কম। এই সময়ে ইসরায়েল থেকে ইহুদিদের অভূতপূর্ব যাত্রা শুরু হয়েছে। আঞ্চলিকভাবে লেবানন ও সিরিয়ায় এখনো ইসরায়েলের সৈন্য রয়েছে। চলমান অভিযানগুলোকে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণে ইসরায়েলের হারানো প্রতিরোধক্ষমতা পুনরুদ্ধার হিসেবে ভাবা বোকামি হবে।

হিজবুল্লাহর নেতৃত্ব নিশ্চিহ্ন হওয়ার পর এবং সিরিয়ায় নিজেদের ব্যাপকভাবে বিস্তৃত দেখতে পাওয়ার পর ইরানের প্রতিরোধ অক্ষটি হয়তো কিছুটা আঘাতের সম্মুখীন হয়েছিল। কিন্তু হামাসের মতো হিজবুল্লাহও যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত হয়নি। সুন্নি ও আরববিশ্ব গাজা এবং অধিকৃত পশ্চিম তীরে চলমান দমন-পীড়নের কারণে আগের মতো ক্ষুব্ধ হয়েছে।

সিরিয়াকে ক্যানটনে বিভক্ত করার ইসরায়েলের স্পষ্ট প্রচেষ্টা সব সম্প্রদায় এবং জাতিগত সিরীয়দের জন্য ততটাই উসকানিমূলক, যতটা পশ্চিম তীরের এলাকা ‘বি’ ও ‘সি’ জর্ডানের সঙ্গে সংযুক্ত করার পরিকল্পনা জর্ডানের জন্য অস্তিত্বগত হুমকি। আম্মানে সংযুক্তি যুদ্ধের জন্য একটি পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে। সংঘাত নিরসন হবে কয়েক দশক ধরে পুনর্গঠনের ধৈর্যশীল কাজ। ট্রাম্প ধৈর্যশীল মানুষ নন। হামাস ও গাজা এখন পিছিয়ে পড়বে। বিপুল প্রাণহানির কারণে প্রতিটি পরিবার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু গত ১৫ মাসে গাজা যা অর্জন করেছে তা সংঘাতকে বদলে দিতে পারে।

গাজা সব ফিলিস্তিনির এবং বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে যে তারা সম্পূর্ণ যুদ্ধ সহ্য করতে পারে। ফিলিস্তিনিরা যে ভূমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তা থেকে তারা নড়বে না। এটি বিশ্বকে জানান দেয় যে দখলদাররা তাদের যা কিছু ছিল তাই আমাদের দিকে ছুড়ে ফেলেছে। এটি কোনো নাকবা ছিল না। গাজা ইসরায়েলকে জানান দিয়েছে যে ফিলিস্তিনিরা বিদ্যমান রয়েছে। যতক্ষণ না ইসরায়েলিরা তাদের সঙ্গে সমান অধিকারের বিষয়ে সমান শর্তে কথা না বলে, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা শান্ত হবে না।

এই উপলব্ধি বুঝতে আরও অনেক বছর লাগতে পারে। কিন্তু কেউ কেউ তা উপলব্ধি করতে পেরেছে। কলামিস্ট ইয়ার আসুলিন হারেৎজে লিখেছেন, ‘যদিও আমরা পুরো মধ্যপ্রাচ্য জয় করি এবং সবাই যদি আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে, তবু আমরা এই যুদ্ধে জিততে পারব না।’ কিন্তু গাজায় যারা বসবাস করছেন, তারা যা অর্জন করেছেন, তা ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।

লেখক: মিডল ইস্ট আইয়ের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান সম্পাদক। 
মিডল ইস্ট আই থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদুল ইসলাম সকাল

সমাজব্যবস্থার কারণে মূল্যবোধের ক্ষয়

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:১১ এএম
সমাজব্যবস্থার কারণে মূল্যবোধের ক্ষয়
ড. মাহবুব উল্লাহ

সমাজব্যবস্থা যে রকম হবে সেই অনুযায়ী শাসক, আমলা, রাজনীতিবিদ, বিচারকদের চরিত্র হবে। এটা সমাজকাঠামোর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। এটা সিস্টেমের অংশ। সমাজব্যবস্থা খারাপের কারণে মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়েছে। সমাজে দুটি জিনিস থাকে। একটা ইনফ্রাস্ট্রাকচার বা অবকাঠামো। আরেকটা হলো সুপারস্ট্রাকচার বা পরিকাঠামো। পরিকাঠামো হলো একটা সমাজের মধ্যে বিচারব্যবস্থা থাকে, ধর্ম থাকে, মূল্যবোধ থাকে এবং ন্যায়-অন্যায়ের বিষয়গুলো থাকে। শিল্প, সাহিত্য-সংস্কৃতি সব হচ্ছে সমাজের সুপারস্ট্রাকচার। আর ইনফ্রাস্ট্রাকচার বা অবকাঠামোর মধ্যে থাকে উৎপাদন সম্পর্ক এবং উৎপাদন শক্তি। 

পৃথিবীর সমাজব্যবস্থা আদিম সাম্যবাদ থেকে শুরু করে দাসব্যবস্থা, সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তারপর আবার সাম্যবাদী ব্যবস্থা এভাবে বিবর্তনগুলো হয়। সমাজের উৎপাদন সম্পর্কের সঙ্গে যদি উৎপাদনের শক্তির বিরোধ হয়ে যায়, তাহলে সমাজ বদলায় বা পরিবর্তিত হয়। একটা সমাজের দিকে যখন আমরা তাকাই তখন দেখি, উৎপাদিকা শক্তিতে বিভিন্ন সময় পরিবর্তন হচ্ছে। প্রযুক্তির পরিবর্তনের ফলে সমাজেও পরিবর্তন হয়। উৎপাদিকা শক্তির পরিবর্তনের কারণে আবার উৎপাদন সম্পর্কেরও পরিবর্তন হয়। প্রযুক্তির পরিবর্তনের ফলে মানুষে মানুষের সম্পর্কের পরিবর্তন হয়। কাজেই এদিক থেকে চিন্তাভাবনা বদলাবে, মূল্যবোধ বদলাবে। কিন্তু কথা হলো, এই চিন্তাভাবনা আর মূল্যবোধ ভালো না মন্দ, সেটা দেখতে হবে। কিন্তু এই ভালো মন্দের বিচারটাও আপেক্ষিক। আমাদের সময়ে আমরা যেভাবে পিতা-মাতা, শিক্ষকদের শ্রদ্ধা করতাম, সম্মান করতাম, মান্য করতাম, সেভাবে আমাদের প্রজন্ম করছে না। এর কারণ হচ্ছে যুগের পরিবর্তন। এই পরিবর্তনে আমাদের পশ্চিমা দেশের প্রভাব আছে। কারণ এসব দেশ বস্তুগতভাবে উন্নত।

মূল্যবোধের পরিবর্তন হবে, সেটা অবশ্যম্ভাবী। সেই মূল্যবোধ একটা পর্যায় পর্যন্ত সমাজের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। যেগুলো অসামঞ্জস্যপূর্ণ, সেটাতে আমাদের সমস্যা হয়। অন্য দেশের প্রযুক্তি, সামাজিক চিন্তাভাবনা যখন আমাদের দেশে আসে, তখন ভালো দিকের সঙ্গে খারাপ দিকও আসে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ

বুদ্ধিজীবীরাও বিচার করেননি

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:৫৯ এএম
বুদ্ধিজীবীরাও বিচার করেননি
আবুল কাসেম ফজলুল হক

মানুষ ভালোমন্দ বিবেচনা করেই জীবনযাপন করছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকদের একটা উক্তি, অপরিচ্ছন্ন জীবন যাপনযোগ্য নয়। জীবন কী, জগৎ কী, অতীত কী ছিল, ভবিষ্যৎ কী... এর মধ্যে ভালোমন্দ বিচার করে জীবনযাপন করা উচিত। সেই ব্যাপারটা বলা যায়, বাংলাদেশের বেলায় স্বাধীনতার অল্প সময়ের মধ্যে উঠে গেছে। অধিকাংশের সময় কেটেছে, এমন একটা অবস্থায় যাকে বলা যায় ‘জোর যার মুল্লুক তার’ অবস্থা। আইনের শাসন কোনো সরকারই প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। শুধু ক্ষমতাসীন, সরকার সমর্থকদের দুর্নীতি নিয়ে আলোচনা ছিল। বুদ্ধিজীবী যারা ছিলেন তাদের মধ্যেও এসব ব্যাপারে বিচার বিবেচনা করে মানুষের নৈতিকতাকে উন্নত করে সমাধানের দিকে যাওয়া দেখতে পাইনি। কেবল দমননীতি নিয়ে দুর্নীতি দমন করা যাবে না। মানুষের অস্তিত্বের মধ্যে দুর্নীতির প্রবণতা আছে। এই প্রবণতা দূর করার কোনো প্রেসক্রিপশন বিজ্ঞানীরা দিতে পারেননি। দার্শনিক বা নীতিবিদ্যার সঙ্গে যুক্তরা সমাধান দিয়েছেন। সমাজজীবনে, রাষ্ট্রীয় জীবনে ন্যায়ের সঙ্গে অন্যায়ের, সত্যের সঙ্গে মিথ্যা থাকবে। দুর্নীতির প্রবণতা যে আছে সেটা একেবারেই নির্মূল করা যাবে না। এটা লক্ষ্য করলে মনে হয়, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দুর্নীতি দূর করার উপযোগী নয়। আমাদের দরকার উন্নত রাজনৈতিক দল ও সরকার। উন্নত রাজনৈতিক দল ও সরকারের মাধ্যমে ধাপে ধাপে পরিস্থিতি ভালোর দিকে যাবে। বাংলাদেশের যে অবস্থা সেখানে সম্মিলিত চেষ্টা দরকার। 

বাংলা একাডেমির সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক

সমস্যা ব্যক্তিগত নয়, সমষ্টিগত

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:৪৯ এএম
আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:৫০ এএম
সমস্যা ব্যক্তিগত নয়, সমষ্টিগত
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

এটি ব্যক্তিগত সমস্যা নয়। এটা সমষ্টিগত সমস্যা। ব্যক্তি ইচ্ছা করলেই সৎ থাকতে পারবেন- এই সমাজে এ রকম নিশ্চয়তা নেই। ধরা যাক, পুলিশের একজন সদস্য যদি সৎ থাকতে চান, তিনি যদি ঘুষ না নেন, তা হলে কিন্তু তিনি তারই প্রতিষ্ঠানে অন্যদের বিরাগভাজন হবেন। সে জন্য এটা সমষ্টিগত সমস্যা। এটার সঙ্গে রাষ্ট্র এবং সমাজ জড়িত। এখন নৈতিকতার অবক্ষয় আমরা দেখছি, এটা সত্য। এটা শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা বিশ্বে ঘটছে। এর বড় একটা দৃষ্টান্ত হলো, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো একজন লোক যে অপরাধী বলে অভিযুক্ত হয়েছেন। তার জন্য শাস্তিও বরাদ্দ হয়েছে। তিনি যে আমেরিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট হলেন, এটাতেই প্রমাণ হয় নৈতিকতা এখন বিশ্বব্যাপী অবনতির দিকে গেছে। আগেকার দিনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো লোক মনোনয়নের জন্য বিবেচিত হতেন না, অথচ সেখানে তিনি নির্বাচিত হয়ে গেছেন। তাকে যারা ভোট দিয়েছেন তারাও জানেন তার নৈতিকতার অবস্থানটা কী। 

সারা পৃথিবীতে চলছে ব্যক্তির উন্নতি। যেটিকে আমরা বলছি পুঁজিবাদী উন্নতি। সহিংসতা, নিপীড়ন, মুনাফা লিপ্সার কারণে নৈতিকতার গুরুত্ব কমে গেছে। একটা সামাজিক বিপ্লব দরকার। সেই বিপ্লবের লক্ষ হবে ব্যক্তিমালিকানার জায়গায় সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক