সিরিয়ার আল-আসাদ রাজবংশের ৫৪ বছর পর পতন মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে বদলে দিয়েছে। ইসলামপন্থি হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) মিলিশিয়ার অতর্কিত আক্রমণ সিরিয়ার প্রতিবেশী দেশ ও অন্য সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ রাশিয়ায় পালিয়ে যাওয়ার খবর আরেকটি যুদ্ধের জন্ম দিতে পারে। সেই যুদ্ধ অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
৭ অক্টোবর ২০২৩, গাজা সীমান্তবর্তী এলাকায় ইসরায়েলের বেসামরিক নাগরিকের ওপর হামাস যে হামলা চালিয়েছিল, তা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ভূমিকম্পের মতো ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। গাজায় হামাসকে নির্মূল করতে ইসরায়েল নির্মমভাবে আক্রমণ করে। ইসরায়েল লেবাননে হিজবুল্লাহর ওপর আক্রমণ করে মূলত ইরানের ‘প্রতিরোধের অক্ষ’কে ধ্বংস করেছে, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য আন্তর্জাতিক শিপিংয়ে হুতি হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইয়েমেনে ইরান-সমর্থিত হুতিদের ওপর আক্রমণ করে।
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ২০১১ সালে, যখন আসাদ সরকার শান্তিপূর্ণ ‘আরব বসন্ত’ বিক্ষোভকে চূর্ণ করেছিল। কিন্তু ২০১৫ সালের পর যুদ্ধটি অনেকাংশে কমে যায়, যখন রাশিয়া হস্তক্ষেপ করে। ইরান এবং হিজবুল্লাহর সহায়তায় সেই যুদ্ধটি আসাদের পক্ষে চলে যায়। ইরানের প্রক্সি ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় এবং ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার যুদ্ধের ক্ষমতা কিছুটা হ্রাস পাওয়ায় বিদ্রোহীরা সুযোগ নিয়েছে। তুরস্কের সহায়তায় বিদ্রোহীরা সহজেই বাশার সরকারের দুর্বল প্রতিরক্ষাকে পরাস্ত্র করে ফেলে। বাশার আল-আসাদের সেনাবাহিনী যুদ্ধ ছাড়াই আত্মসমর্পণ করে। ইরান ও রাশিয়ার পৃষ্ঠপোষকরা দ্রুত তাদের বাহিনী সরিয়ে নেয় এবং তাকে তার ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়।
সিরিয়ার সঙ্গে ইরানের জোট আরব বিশ্বে প্রধান শক্ত ঘাঁটি ছিল এবং এর অবসান আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যকে নতুন রূপ দেবে। মোহাম্মদ আলী আবতাহি, যিনি ছিলেন ইরানের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট। তিনি বাশার পালানোর দুই দিন আগে বলেছিলেন, সিরিয়া সরকারের পতন মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি হবে।
ইসরায়েল প্রভাবশালী শক্তি হয়ে উঠবে। হায়াত তাহরির আল-শাম নামটি আরবের দেশগুলোর দ্বীপ অঞ্চলসহ ভূমধ্যসাগরের পূর্ব অংশের মুক্তির জন্য দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এইচটিএস নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি নতুন ধরনের ইসলামপন্থি ভাবমূর্তি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তিনি আল-কায়েদা এবং ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর ব্যর্থতা থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করেছেন বলে মনে হয়। এখন তিনি নিজেকে একজন বাস্তববাদী হিসেবে দেখেন, যিনি শুধু সিরিয়ার নিপীড়নমূলক শাসন থেকে মুক্তি আনতে চান।
তার এই নতুন বাস্তববাদের লক্ষণ হলো সিরিয়ার প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ গাজী আল-জালালিকে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর না করা পর্যন্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অনুমতি দেওয়ার জন্য জোলানিকে তার লোকদের নির্দেশ করতে হবে। আইএস সৈন্য ও কর্মকর্তাদের ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালাত। তার পরও আল-জোলানি একটি কট্টর ইসলামপন্থি সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তুরস্ক এইচটিএস-এর চরমপন্থাকে প্ররোচিত করতে পারে। অনেকে ধারণা করছেন, জোলানি তুরস্কের একজন অনুগত সৈনিক হতে পারেন। যাই হোক না কেন, আল-জোলানি শক্তিশালী রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হচ্ছেন।
তাকে অবশ্যই প্রতিদ্বন্দ্বী মিলিশিয়াদের সঙ্গে তুলনা করতে হবে, যারা বাশারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য একত্রিত হয়েছিল। উত্তরে তুর্কি বাহিনীর আক্রমণের সময় পূর্ব সিরিয়ার আরও কিছু অংশের নিয়ন্ত্রণ নিতে ছুটে আসা কুর্দি বাহিনীকেও প্রতিরোধ করেছিল। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের কাছে সিরিয়ার কুর্দিরা তুরস্কের কুর্দিদের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহকে উৎসাহিত করার হুমকি দেয়।
২০১৯ সালে এরদোয়ান উত্তর সিরিয়ায় ৩০ কিলোমিটারজুড়ে একটি ‘নিরাপত্তা অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কুর্দি যোদ্ধাদের তুর্কি সীমান্ত থেকে দূরে ঠেলে দেওয়ার জন্য তিনি সেনাবাহিনী নিযুক্ত করেছিলেন। এমন এলাকা যেখানে কুর্দিরা একটি স্বায়ত্তশাসিত ছিটমহলকে নিজের দখলে নিয়ে গৃহযুদ্ধের জন্য সুযোগ খুঁজছিলেন।
কুর্দিদের স্বায়ত্তশাসন টিকে রাখার আকাঙ্ক্ষা এবং সীমান্ত এলাকা থেকে তাদের দূরে রাখার জন্য তুরস্কের মধ্যে সমঝোতা খুঁজে পেতে জোলানিকে এখন কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। এরদোয়ান কি কুর্দি আঞ্চলিক ক্ষমতা সহ্য করবেন, যা তিনি তুরস্কের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করেন? জোলানি কি তুরস্ককে কুর্দিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অনুমতি দেবেন? যখন তিনি তাদের সঙ্গে শাসক জোট গঠন করার চেষ্টা করছেন এবং সিরিয়ার আঞ্চলিক সার্বভৌমত্বকে সমর্থন করতে যাচ্ছেন। সিরিয়ার কুর্দিদের সঙ্গে তার দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত সত্ত্বেও এরদোয়ান বাশারের পতনকে দুর্দান্ত অর্জন হিসেবে দেখেন। বিদ্রোহী বাহিনীর অগ্রযাত্রা অনুসরণ করে তিনি আনন্দিত হয়েছিলেন। সিরিয়ার এই অগ্রযাত্রা কোনো ঘটনা ছাড়াই চলতে থাকে।
বছরের পর বছর এরদোয়ান এবং তার কাতার মিত্ররা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইসলামপন্থি দলগুলোকে সমর্থন করে আসছে। তিনি নিজেকে ইরানিদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় দেখেছিলেন যে, মুসলিম ভূমিতে ইসলামি গণতন্ত্রের কোন মডেলটি প্রাধান্য পাবে: শিয়া মৌলবাদী বা তুরস্কের মধ্যপন্থি কোনো রূপ। এখন তিনি বিশ্বাস করেন, তিনি দেশের সন্নিকটেই এমন একটি মডেলকে রূপ দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন।
যদিও সিরিয়ার বিদ্রোহীদের এমন সাফল্যের পেছনে ইসরায়েলের হাত রয়েছে। সে জন্য ইসরায়েলকে ধন্যবাদ দেওয়ার অনেক কিছু রয়েছে। ইসরায়েল তার নতুন প্রতিবেশীদের সম্পর্কে কোনো ভুল ধারণা পোষণ করে না। আল-জোলানি সিরিয়ার গোলান মালভূমিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন (তাই নাম জোলানি), ইসরায়েল ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ওই অঞ্চল দখল করেছিল। যার সংযুক্তি ও সার্বভৌমত্ব ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
দামেস্কে বিদ্রোহী অগ্রযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে ইসরায়েল সিরিয়ার সীমান্তে যুদ্ধ ইউনিট মোতায়েন করে। গোলান মালভূমিতে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর ছড়িয়ে পড়া এবং সীমান্তে সিরিয়ার পাশের দ্রুজ এলাকায় আক্রমণ করা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল ইসরায়েল। ৭ অক্টোবরের রোমহর্ষক ঘটনা এখনো ইসরায়েলের মনে গেঁথে আছে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ক্ষোভকে অবমূল্যায়ন করা উচিত নয়। সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের অত্যাচারের পতন যদি ঘটতে পারে, কেন ইরানকেও পতনের চেষ্টা করা হবে না? নেতানিয়াহু প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপের বাইরে চলে যাওয়ার প্রলোভন রয়েছে। তিনি যুক্তি দিয়েছেন, ১৯৭৪ সালের চুক্তি অনুযায়ী ইসরায়েল ও সিরিয়ার মধ্যে যে বাহিনী বিচ্ছিন্নকরণ নিয়ন্ত্রিত ছিল তা ভেঙে গেছে। তিনি ইসরায়েলি সৈন্যদের হারমন পর্বতের সিরিয়ার অংশের নিয়ন্ত্রণ দখল করতে নির্দেশ দেন। সিরিয়ার সার্বভৌম ভূখণ্ডের বাফার জোন এবং এর আশপাশে প্রভাবশালী অবস্থান নেয়।
এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্ররাও একইভাবে উদ্বিগ্ন। তারাও বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতায় থাকাটা পছন্দ করত, এই ভয়ে যে ইসলামপন্থি নিয়ন্ত্রিত সিরিয়া সন্ত্রাসবাদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠতে পারে। তাদের দৃষ্টিতে বাশার আল-আসাদ ইসলামপন্থি বিদ্রোহী নেতৃত্বাধীন সরকারের চেয়ে ভালো, যদিও এটি মধ্যপন্থি বলে দাবি করে।
বাশার আল-আসাদের পতন ঘটেছে। মধ্যপ্রাচ্য আবার নাটকীয়ভাবে পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যর পুনরুদ্ধারে সবার এগিয়ে আসা উচিত।
লেখক: ইসরায়েলের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল