বাংলাভাষা এখন মধ্যবিত্তের সেই অংশের মানসিক সম্পদ, যে অংশ রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে দূরে রয়েছে। আর এদের মধ্যেও যে সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা নেই ইংরেজি শেখার, তাও বলা যাবে না। পারলে শিখত। পারে না, তাই শেখে না। সেই ইংরেজ যুগের অবস্থা। সে যুগে বাঙালি মুসলমান ইংরেজি শেখেনি। প্রচার করা হয়েছিল যে, কারণটা মনস্তাত্ত্বিক। অভিমান করে শেখেনি। রাজ্য হারানোর গভীর অভিমানে বাঙালি মুসলমান নাকি ইংরেজি ভাষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, খুব দৃঢ়ভাবে। অথচ আসল খবর এই যে, রাজ্য হারানোর জন্য অভিমানের প্রশ্নটাই সম্পূর্ণ অবান্তর। কেননা রাজ্য না ছিল বাঙালির, না ছিল বাঙালি মুসলমানের।
রাজ্য ছিল অবাঙালিদের হাতেই। যার আমাত্য ও বড় আমলারাও অধিকাংশই ছিল অবাঙালি। বাঙালি মুসলমানের ইংরেজি না শেখার প্রকৃত কারণ অর্থনৈতিক। তারা বড়ই গরিব ছিল। এ যুগে সে যে বাংলা শিখতে পারছে না তার জন্যও ওই একই দুর্বলতা দায়ী। তারা এখনো বড়ই গরিব। আগে যেমন ছিল, এখনো তেমনি রয়েছে। আমলাতন্ত্রই ‘স্বাধীন’ হয়েছে, গরিব মানুষ স্বাধীন হয়নি। যারা সম্পত্তির মালিক হতে পেরেছে তারা তো আর দেরি করছে না। ভীষণ বেগে ইংরেজি শিখছে। যেন এতদিন না শেখার প্রায়শ্চিত্ত করছে। ধর্মীয় প্রায়শ্চিত্তের তুলনায় ইহজাগতিক প্রায়শ্চিত্ত যে প্রবল হয়, তা প্রমাণিত হচ্ছে বুঝি।
ইংরেজ আমলে রাষ্ট্র ছিল উপনিবেশিক ও আমলাতান্ত্রিক, এখন দু-দুবার স্বাধীন হওয়ার পর সে হয়েছে পুঁজিবাদী ও আমলাতান্ত্রিক। আমলাতন্ত্র ঠিকই রয়েছে। ইংরেজ যে এ দেশকে শাসন করত, সেজন্য সর্বস্তরে তাকে নিজের দেশ থেকে লোক এনে বসাতে হয়নি, স্থানীয়দের দিয়েই কাজ চলেছে। আমলাতন্ত্রের একটি অনড় বেষ্টনী ছিল খাড়া করা, যার অভ্যন্তরে দুর্নীতি খুবই চলত। লুণ্ঠন যে যেভাবে পারে করার ব্যাপারে গাফিলতি করত না, কিন্তু কাঠামোটা ঠিকই থাকত, আমলারাই টিকিয়ে রাখত, তাদের সমষ্টিগত স্বার্থে। সেই আমলাতন্ত্রের সদস্যরা কেউ কেউ রাজনীতি করেছেন, যেমন- সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুভাষ বসু, তবে আমলাতন্ত্রের সদস্য হিসেবে নয়, বাইরে বেরিয়ে এসে। কেউ কেউ সাহিত্যচর্চা করেছেন, যেমন বঙ্কিমচন্দ্র ও নবীন সেন। কেউ-বা অর্থনীতির বই লিখেছেন, যেমন- রমেশচন্দ্র দত্ত। হ্যাঁ, তাদের প্রধান পরিচয় আমলাতন্ত্রী হিসেবে নয়, ব্যতিক্রম হিসেবেই। তবু সত্য তো থেকেই যায় যে, এরা সবাই আমলা হয়েছিল, কিংবা হতে না পেরে খুবই ক্ষুব্ধ ছিল (যেমন- সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়)। আমলাতন্ত্রের সদস্য হওয়ার চেয়ে বড় কোনো লক্ষ্য সে যুগে ছিল না।
আজকেও নেই।
আজকেও লোক আমলাতন্ত্রের সদস্য হতে চায়। না হলেও তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। মন্ত্রীরাও আমলানির্ভর থাকেন, এবং তাদেরও আমলাই মনে হয়, এক ধাপ ওপরের। সংসদ সদস্যরা যখন নিজেদের মান-মর্যাদার হিসাব-নিকাশ করেন তখন আমলাদের কী প্রাপ্য, কী নয় তার সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েই করেন। অন্য মানদণ্ড দেশে এখন নেই। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করে আমলাদের সহযোগিতা নিয়েই, তা সে আমলা শুল্ক বিভাগের হোন, কিংবা আমদানি-রপ্তানি বিভাগেরই হোন।
বলা বাহুল্য, আমলাতন্ত্রের ভাষাও পুঁজিবাদের ভাষাই। ইংরেজি ভাষা। ফাইলে বাংলা লেখাটা সামান্য ব্যাপার, আনুষ্ঠানিকতা মাত্র, প্রাণ রয়েছে অন্যত্র। আমলাতন্ত্রের মান ভাষা ইংরেজি, মূল ভাষাও সেটাই, প্রাণের ভাষাও বটে।
নিজের দেশে পুঁজিবাদী ইংরেজ, পুঁজিবাদের অনুপ্রেরণা ও শক্তি নিয়েই দেশ-বিদেশে গেছে কিন্তু সেখানে গিয়ে, বিশেষ করে ভারতবর্ষে, স্থানীয় সামন্তবাদকে অত্যন্ত উৎসাহিত করল নতুন জীবন লাভ করার ব্যাপারে। ইতিহাস বলছে, ভারতবর্ষের কোনো কোনো অঞ্চলে যখন পুঁজিবাদী বিকাশের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল তখনই ঔপনিবেশিকরা এসে সেই বিকাশকে ওপর থেকে প্রতিহত করল এবং ভেতরের সামন্তবাদী উপাদানকে শক্তিশালী করতে চাইল, ভারতবর্ষ যেন পুঁজিবাদী পথে এগিয়ে ব্রিটেনেরই সঙ্গে প্রতিযোগী না হতে চায় সেটা নিশ্চিত করার অভিপ্রায়ে। ধর্মের প্রতি যে পক্ষপাত এই উপমহাদেশে বেশ প্রাচীন, তার ভূমিতে নতুন জলসিঞ্চন ঘটল। ব্রিটিশ যুগে এতদঞ্চলে তাই সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা যতটা দেখা গেছে সামন্তবাদবিরোধিতা ততটা দেখা যায়নি।
পাকিস্তানিরা একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রই প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা সেটিকে স্থাপন করেছিল ধর্মের ওপর। তাই নিজেরা ধর্মের ব্যাপারে কেবল উদাসীন নয়, ক্ষেত্রবিশেষে অধর্মচারী হলেও জনগণকে পশ্চাৎপদ ও নেশাগ্রস্ত করে রাখার জন্য ধর্মের কথা খুব বলত। উর্দুকে যখন তারা পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করতে চাইল তখন যুক্তিটা গণতান্ত্রিক ছিল না, কেননা উর্দু পাকিস্তানের অধিকাংশ নাগরিকের ভাষা তো ছিলই না, কোনো অঞ্চলের ভাষাও ছিল না।
উর্দুর পক্ষে যুক্তিটা ছিল সামন্তবাদী। সেটা হলো এই যে, উর্দু ধর্মীয় ভাষা, আরবির কাছাকাছি, আর বিপরীত দিকে তাদের মতে বাংলা ছিল পৌত্তলিক ভাষা। বাংলা যে পৌত্তলিক, এই কথাটা আগেও বলা হয়েছে। বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা যে বাংলা নয়, সেটা যে উর্দু এই প্রচার পাকিস্তান হওয়ার আগেও করা হয়েছে। অনেকটা যেন তারই সূত্র ধরে পাকিস্তান আমলে বলা শুরু হলো যে, বাংলা ভাষার বর্ণমালা যেহেতু দেবনাগরীর কাছাকাছি, তাই তাকে বদলে আরবি হরফে লেখা দরকার। রবীন্দ্রনাথকে বাদ দাও, নজরুলকে সংশোধিত করো, কিছু কিছু শব্দ বড় বেশি হিন্দুত্ব, তাদের মুসলমানি করো- এসব পরামর্শ দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। পূর্ববঙ্গ রুখে দাঁড়াল। ফলে অন্তত এই রণাঙ্গনে সামন্তবাদী শক্তি পরাভূত হলো।
তা এখানে সে আপাতত পরাভূত হয়েছে বৈকি। এখন আর রাষ্ট্রভাষা উর্দু চাই- এ দাবি ঘোরতর মৌলবাদীরাও করবে না। বরঞ্চ এখন দেখা যাচ্ছে মৌলবাদীরা বলার চেষ্টা করছে যে, ভাষা আন্দোলনে তারাও ছিল। আন্দোলনের সূত্রপাত নাকি তারাই ঘটিয়েছে। এখন নাকি ইতিহাসকে বিকৃত করে তাদের অস্বীকার করা হচ্ছে। বীজটি যখন বপন করা হচ্ছিল, তখন কাছে ছিল, হয়তো মাটিও দু-এক মুঠো ফেলেছে আশপাশে, তাই বৃক্ষটি তাদেরই সম্পত্তি- এই তাদের দাবি। দাবিটি যেমনই হোক, এ যে বৃক্ষটিকে মূল্যবান বলে স্বীকার করছে, তাকে যে কাটতে চাইছে না, অতীতে যেমন চেয়েছিল সেটাই অধিক তাৎপর্যপূর্ণ।
কিন্তু সেই সঙ্গে এও লক্ষ্য করার বিষয় যে, ফেব্রুয়ারি মাস এলেই মৌলবাদীদের অস্বস্তি শুরু হয়ে যায়। নিজেদের দৈনিকে এরা মাতৃভাষা আল্লার শ্রেষ্ঠ দান বলে স্তম্ভ তুলে প্রচার শুরু করে। এমনভাবে যাতে মনে হবে- এই আমাদের মাতৃভাষা মানুষে সৃষ্টি করেনি, আকাশ থেকে ঝরে পড়েছে। সেই সঙ্গে উরস, জলসা, মাহফিল ইত্যাদির ধূম ফেলে দেয়। যেমন একবার একুশে ফেব্রুয়ারি শেষ হতে না হতেই, ২৪ তারিখেই জামায়াতের দৈনিকটিতে একটি ক্রোড়পত্র বের হয়েছে, যার শিরোনাম হচ্ছে, ‘শাহানশাহে তরিকত খাজাবাবা শাহ সুফী এনায়েতপুরী (কুঃ ছেঃ আঃ) ছাহেবের রেছালত দিবস উপলক্ষে পবিত্র উরস শরীফ, বিশ্ব জাকের মঞ্জিল পাক দরবার শরীফ, আটরশি, ফরিদপুর।’ সেই সামন্তবাদের দিকেই টানাটানি বটে, যদিও এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে নয়।
রাষ্ট্রীয়ভাবেও কি টানা হচ্ছে না জনগণকে সামন্তবাদের দিকে? এরশাদ সরকার শাসনতন্ত্রে সংশোধনী এনে রাষ্ট্রীয় ধর্ম প্রবর্তন করেছিল। বাহাত্তরে এ ছিল অকল্পনীয়, কিন্তু অষ্টাশিতে এটা সম্ভব হয়েছে। অন্য কোনো জোরে নয়, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার জোরে। এরশাদ হয়তো আরও এগোতে চাইতেন, যদিও নিজে তিনি ধর্মকর্মের জন্য বিখ্যাত ছিলেন না। লোকে বরঞ্চ উল্টোটাই জানত। তার পতনের পর তার বাসগৃহে জমজমের পবিত্র পানি পাওয়া যায়নি, পাওয়া গেছে ইসলাম-নিষিদ্ধ মূল্যবান সব পানীয় এবং তার বান্ধবীদের সংখ্যা নিয়ে তার উকিল স্বয়ং বড়াই করেছেন, আদালতে। কিন্তু ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে উৎসাহিত করার ব্যাপারে তার আগ্রহ ছিল অধিক।
ইচ্ছে ছিল ক্ষমতায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত রাখার স্বার্থে জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করা, এবং একটি আধ্যাত্মিক আবরণে নিজের সব অপকর্মকে আচ্ছাদিত রাখা। তার আমলে উরস, মাহফিল, হুজুর কেবলাদের অলৌকিক তৎপরতা মাদক ব্যবসায়ের মতোই গ্রাস করে ফেলতে চাইছিল বাংলাদেশকে। এখনো তা যে শেষ হয়ে গেছে তেমন নয়। সেই সঙ্গে যে জামায়াতে ইসলামী মুক্তিযুদ্ধে পরাভূত হয়ে গিয়েছিল সেও আবার ফেরত এসেছে। বন্ধ জলাশয়ের দুষ্ট মশা-মাছির মতো জাতির স্বাস্থ্যকে সে আবার দংশন করছে, ঘ্যান ঘ্যান করে। যেন আমরা আবার সেই পাকিস্তানে ফিরে গেছি।
অনেকটা যেন সেরকমই। কেননা আসল ঘটনা তো হচ্ছে সেই প্রত্যাখাত আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রত্যাবর্তন। এরই ফলে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হয়েও রাষ্ট্রভাষা হচ্ছে না। এবং সামন্তবাদ বিলীন হয়েও বিলীন হতে চাইছে না। বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের ওপর যেদিন ক্রোড়পত্র বের হয়েছে, সেদিনই তো আমাদের অন্য সবগুলো জাতীয় দৈনিকে বিশ্ব ক্রিকেটের ওপর ক্রোড়পত্র বের হলো। একদিকে সামন্তবাদী বিশ্ব, অন্যদিকে পুঁজিবাদী বিশ্ব। একদিকে জাকের, অপরদিকে ক্রিকেট।
কোনোটাই আমাদের নয়, মাঝখানে আমরা সত্যি সত্যি তৃতীয় বিশ্বে রয়েছি। আমরা যাব কোথায়? আমাদের বুর্জোয়ারা আত্মসমর্পণ করেছে সাম্রাজ্যবাদের কাছে, সেই আত্মসমর্পণ প্রমাণ করেছে যে, তারা মুখে যাই প্রচার করুক আসলে জাতীয়তাবাদী নয়। একাত্তরে যারা পাকিস্তানি ঘাতকদের মেনে নিয়েছে, তারা যেমন জাতীয়তাবাদী ছিল না এবং যতই তারা জাতীয়তাবাদী বলে দাবি করত, ততই যেমন প্রমাণ হতো যে আসলে তারা জাতীয় বেঈমান, এখনো সেই ঘটনাই চলছে, প্রায় হুবহু। পাকিস্তানিরা নেই, কিন্তু তাদের প্রভু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তো রয়েছে, আগের চেয়ে আরও দাম্ভিক রূপেই।
ভাষা আন্দোলন বলছে যেতে হবে সামনে, পুঁজিবাদী ও সামন্তবাদী উভয় বিশ্বকে ঠেলে দূরে সরিয়ে। যেতে হবে ইহজাগতিকতার পথ ধরে প্রকৃত গণতন্ত্রের অভিমুখে, যে গণতন্ত্রের মূল কথাটা হচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের সুযোগ ও অধিকারের সাম্য। এই পথে আমলাতন্ত্র একটি বড় প্রতিবন্ধক। কেননা আসল ক্ষমতা তার হাতেই, এবং সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত মিত্র সে, যেমন প্রকাশ্যে তারও চেয়ে বেশি গোপনে। ইরান ও আলজেরিয়ার ঘটনা দেখে সাম্রাজ্যবাদ হয়তো আপাতত সামন্তবাদের ব্যাপারে কিছুটা কম উৎসাহ দেখাতে পারে। কিন্তু সেটা আপাতত ও আপেক্ষিক মাত্র, বিশ্বে যতদিন সাম্রাজ্যবাদ আছে ততদিন সামন্তবাদ থাকবে, কোনো না কোনোভাবে, কোথাও না কোথাও। সাম্রাজ্যবাদকে যদি ছাড় দেওয়া যায়, তাহলে তো কথাই নেই, পুঁজিবাদের দৈত্য ও সামন্তবাদের বামন উভয়েই রক্ত খাবে। খাচ্ছে এখনো। ভাষা আন্দোলন দু-কাজই করে, পথ দেখায় না শুধু, নিরিখও তুলে ধরে একসঙ্গে।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়