
ডলারকে দুর্বল করে অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা জোরদার করার উচ্ছৃঙ্খল প্রচেষ্টাও উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং আর্থিক বাজারকে বিপদে ফেলতে পারে। আমেরিকান ফেডারেল রিজার্ভের স্বাধীনতাকে চ্যালেঞ্জ করার যেকোনো বাস্তব বা হুমকিমূলক প্রচেষ্টাও মুদ্রাস্ফীতি বাড়িয়ে দেবে। ভূ-রাজনৈতিক কারণের প্রভাবও একইভাবে অনিশ্চিত। ট্রাম্প অর্থনীতি ও বাজারকে প্রভাবিত করে, এমন কিছু ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকি নিতে পারেন- যেমন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত।…
অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার পরিপ্রেক্ষিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি তার অশুভ পরামর্শযুক্ত অর্থনৈতিক নীতির প্রস্তাবগুলো অনুসরণ করেন, তাহলে তাকে বিপদের সম্মুখীন হতে হবে। ২০২৫ সালের যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে ভালো হতে পারে। সামগ্রিকভাবে ভালো ধারণাগুলো বিভিন্ন প্রভাবে খারাপ হতে পারে।
পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং মুদ্রাস্ফীতির ওপর কী প্রভাব ফেলবে? উত্তরটি এখনো পরিষ্কার নয়। কারণ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত কিছু নীতির কারণে প্রবৃদ্ধি বাড়বে এবং মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস হবে।
ইতিবাচক দিক বিবেচনা করলে দেখা যায়, ট্রাম্প সামগ্রিকভাবে ব্যবসাপন্থি হবেন। এ কারণেই তিনি ‘অশুভ শক্তি’ থেকে মুক্ত করে অর্থনৈতিক কার্যকলাপকে উদ্দীপিত করতে পারেন; যা ব্যবসায়িক বিনিয়োগ, উদ্ভাবনকে বৃদ্ধি করবে। তিনি এবং কংগ্রেসের রিপাবলিকানরা যদি ২০২৫ সালে করপোরেট এবং ব্যক্তিগত আয়কর বাড়াতে সফল হন, তাহলে প্রবৃদ্ধিও অনেক বাড়বে।
যদি তার নিয়ন্ত্রণহীন এজেন্ডার বাড়াবাড়ি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন, তাহলে আমলাতান্ত্রিক যে জটিলতা, তা দূর হতে পারে। এতে প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং দীর্ঘ মেয়াদে দাম হ্রাস হতে পারে। ট্রাম্প প্রতিদিন ৩ মিলিয়ন ব্যারেলের সমতুল্য আমেরিকার তেল ও গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে চান, যা দাম কমাতে সহায়তা করতে পারে। দেশীয় শক্তির খাতগুলোকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তুলতে পারে। কেউ কেউ মনে করেন পূর্ববর্তী প্রশাসনের বেশির ভাগ ক্ষেত্র ভর্তুকি ছাড়াই সবুজ শক্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব।
ইলন মাস্ক এবং বিবেক রামাস্বামীর (ট্রাম্পের দুই প্রধান প্রচারণাদাতা) নেতৃত্বে একটি বহিরাগত উপদেষ্টা কমিটি ‘সরকারি দক্ষতা বিভাগ’-এর প্রতিশ্রুতিতেও ফেডারেল বাজেট ২ ট্রিলিয়ন ডলার কমানোর কাছাকাছিও আসবে না। যদি সরকারি দক্ষতা বিভাগ ২০০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের কাটছাঁটও শনাক্ত করতে পারে, তাহলে তা সরকারি খাতে অদক্ষতা কমাতে পারে।
প্রযুক্তিবিদরা ট্রাম্পকে পরামর্শ দেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স, অটোমেশন এবং বায়োমেডিকেল গবেষণা থেকে শুরু করে ভবিষ্যতের অনেক শিল্পে আমেরিকা উন্নতি করবে। নতুন প্রশাসনের এই শিল্পগুলোর পথে বসার আশঙ্কাও কম নয়। নিয়ন্ত্রক বা সুশীল সমাজের কাছ থেকে তারা যেকোনো প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে পারেন এবং তা দূর করতে বেগ পেতে হবে।
কিন্তু করনীতি, নিয়ন্ত্রণমুক্তকরণ ও অন্যান্য ব্যবসাবান্ধব পদক্ষেপ থেকে দ্রুত প্রবৃদ্ধি এবং নিম্ন মুদ্রাস্ফীতি বাস্তবায়িত হতে সময় লাগবে। ট্রাম্প প্রশাসনের নেতিবাচক প্রভাবও ফেলতে পারে। বিশেষ করে ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, কয়েকটি নীতি উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, উচ্চ শুল্ক, বাণিজ্যযুদ্ধ এবং চীন থেকে বিচ্ছিন্নতা মুদ্রাস্ফীতি ও প্রবৃদ্ধির জন্য ক্ষতিকর হবে। ক্ষতির পরিমাণ শুল্কের আকার, সুযোগ এবং অন্যান্য সুরক্ষাবাদী নীতির ওপর নির্ভর করবে।
একইভাবে অভিবাসনের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হতে পারে। এতে শ্রমব্যয় বৃদ্ধি এবং মূল খাতগুলোতে শ্রম ঘাটতির ঝুঁকি বাড়বে। যদি ট্যাক্স কমিয়ে দেওয়া হয় এবং অন্য আর্থিক প্রতিশ্রুতিগুলো অর্থ প্রদানের উপায় ছাড়াই কার্যকর করা হয়, তাহলে পরবর্তী দশকে পাবলিক ঋণ প্রায় ৮ ট্রিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পেতে পারে। এটিও মুদ্রাস্ফীতিকে আরও বাড়িয়ে তুলবে যা দীর্ঘমেয়াদি সুদের হার বাড়িয়ে দেবে। এতে ভবিষ্যতের বিনিয়োগকে ব্যাহত করবে এবং প্রবৃদ্ধি হ্রাস করবে।
ডলারকে দুর্বল করে অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা জোরদার করার উচ্ছৃঙ্খল প্রচেষ্টাও উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং আর্থিক বাজারকে বিপদে ফেলতে পারে। আমেরিকান ফেডারেল রিজার্ভের স্বাধীনতাকে চ্যালেঞ্জ করার যেকোনো বাস্তব বা হুমকিমূলক প্রচেষ্টাও মুদ্রাস্ফীতি বাড়িয়ে দেবে। ভূ-রাজনৈতিক কারণের প্রভাবও একইভাবে অনিশ্চিত। ট্রাম্প অর্থনীতি ও বাজারকে প্রভাবিত করে, এমন কিছু ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকি নিতে পারেন- যেমন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত। তিনি চীনের সঙ্গে বৃহত্তর অর্থনৈতিক যুদ্ধও শুরু করতে পারেন; যা বিশ্ব অর্থনীতিকে আরও খণ্ডিত করতে পারে।
ট্রাম্প প্রশাসনের মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব তার ইতিবাচক এবং নেতিবাচক নীতির আপেক্ষিক ভারসাম্যের ওপর নির্ভর করবে। ট্রাম্পের আরও ক্ষতিকর প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বেশ কিছু উসকানিও আসতে পারে। প্রথমত, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বাজারের শৃঙ্খলা: যে নীতিগুলো মুদ্রাস্ফীতি এবং ঘাটতি বৃদ্ধি করে তা বন্ড মার্কেটকে সতর্ক করে তুলবে। সে ক্ষেত্রে নামমাত্র ও দীর্ঘমেয়াদি সুদের হার বাড়াবে এবং শেয়ারবাজারে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। যেহেতু ট্রাম্প স্টক মার্কেটকে প্রেসিডেন্টের পারফরম্যান্সের পরিমাপক হিসেবে দেখেন, তাই এই সংকেত তার সবচেয়ে জ্বরভাবাপন্ন ধারণাগুলোতে ঠাণ্ডা পানি ঢেলে দিতে পারে। যদিও ফেডারেল রিজার্ভ এখনো স্বাধীন। তাই মূল্যস্ফীতি আবার যদি বৃদ্ধি পায়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই তার রেট কমিয়ে দেবে।
আমরা যদি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে ২০২৫-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখি, তাহলে ট্রাম্পের অর্থনৈতিক এজেন্ডার প্রভাব প্রবৃদ্ধির জন্য খারাপ হতে পারে। যদিও ফেডারেল রিজার্ভের ২ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতির লক্ষ্যে অর্থনীতির প্রত্যাবর্তনের গতি কমে যাবে। অনুকূল অবস্থায় থাকলে প্রবৃদ্ধি সম্ভাবনার ঊর্ধ্বে থাকতে পারে। তবে এটি ২০২৪ সালের তুলনায় কম হবে। যতক্ষণ ট্রাম্পের সবচেয়ে উগ্রবাদী নীতিগুলো থাকবে, ততক্ষণ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির উন্নয়ন হওয়াটা কঠিন। কিছু অপ্রত্যাশিত কাজ, যেমন- ভূ-রাজনৈতিক ধাক্কাগুলো থেকে বিরত থাকলে আসন্ন বছরটির মার্কিন অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র। দ্য প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদুল ইসলাম সকাল