
আমাদের সরবরাহ লাইন শক্তিশালী করা জরুরি। যেমন- টিসিবি পণ্য আরও বেশি বেশি লোকের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সেদিকে এখন আমাদের খেয়াল করতে হবে। গরিব, নিম্ন-মধ্যবিত্তের মধ্যে বণ্টনের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের কাছে সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য পৌঁছে দিতে হবে। মূল কথা হলো- আমাদের সরবরাহ বাড়াতে হবে। তার জন্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। উৎপাদন বাড়াতে গেলে সুদের হার কমাতে হবে। ব্যবসায়ীদের কথা শুনতে হবে। সব ব্যবসায়ী খারাপ নন, সবাই স্বৈরাচারের দোসর নন। কিছু ভালো ব্যবসায়ীও আছেন যারা গত ১২-১৫ বছর স্বৈরাচারের কাছ থেকে কোনো সুবিধা নেননি বা নিতে পারেননি। সরকারের উচিত তাদের কথা শোনা।...
বর্তমানে দেশের অর্থনীতিতে উত্থান-পতন উভয় রকম প্রবাহ বিদ্যমান। ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশে সরকার পরিবর্তন হয়েছে। বিগত সময়ে অর্থনীতি একজন ব্যক্তির নেতৃত্বে চলত। দীর্ঘ সময় ধরে এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক বলয়ে থাকার ফলে সব ক্ষেত্রেই দুর্নীতি চলেছে ব্যাপকভাবে। স্বৈরাচারী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক বাদে কোনো বড় ব্যবসায়ী অথবা ভালোমানের ব্যবসায়ী এ দেশে তৈরি হয়নি। বিগত ১০-১৫ বছর ধরে যারা সঠিকভাবে ব্যবসা করতে চেয়েছেন, তারা কোনোভাবেই সফল হয়ে উঠতে পারেননি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পাওয়ার সেক্টরে হয়নি, ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রে হয়নি, ট্রান্সপোর্টের ক্ষেত্রে হয়নি- অর্থাৎ কোনো ক্ষেত্রেই ভালো কোনো লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়নি। সুতরাং যারা শুধু সরকারকে তেল দিতে পেরেছে, সরকারের সুনাম করতে পেরেছে, শুধু তারাই এতদিন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ব্যবসা করছিল। এ দুর্নীতির দৌড়ে যারা টেকেনি, যারা ব্যবসা করতে চেষ্টা করেছে, তারাই পিছিয়ে পড়েছে। সেসব থেকে বাংলাদেশ আজ মুক্ত। এই মুক্ত হতে গিয়ে হয়তো অনেকাংশে বিশৃঙ্খলা হয়েছে। কারণ যারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করত, তারা এখন পলাতক। অনেকেই মামলায় জড়িয়েছে। এমনকি তারা এখন অনেক ধরনের অসুবিধার মধ্যে পড়ে গেছে।
সেখানেও দেখা গেছে বাজার সরবরাহে যাদের এখনো কিছু নিয়ন্ত্রণ আছে তাদের দৌরাত্ম্য রয়ে গেছে। এমনকি আজ অবধি সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব হয়নি। সবচেয়ে বড় দুঃখের বিষয় হলো- গত ১৫ বছরের মধ্যে ১০ বছর অর্থাৎ ২০১৭ সাল থেকে যা কিছু হয়েছে তা উচ্চ মহলের ব্যাপক কারসাজির ফসল। এই উচ্চ মহলের মধ্যে প্রথম ছিল সরকারপ্রধান। সে ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো ঢালাওভাবে লুণ্ঠিত হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে বিভিন্ন কায়দায় বের করে নেওয়া হয়েছে। দেশের সরকারপ্রধানসহ তাদের আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে আইনকে পাশ কাটিয়ে কাজগুলো করা হয়েছে। যে কারণে আমাদের রেমিট্যান্স তখন সমস্যার মধ্যে পড়ে ক্রমান্বয়ে কমছিল। এখন তুলনামূলক রেমিট্যান্স বাড়ছে, ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। যেহেতু অর্থ পাচার কমে গেছে, সুতরাং রেমিট্যান্স এখন পুরোটাই বাংলাদেশে আসবে। এখন ব্যাংকগুলোকে পুঁজিবাদের আওতাভুক্ত করা এতটা সহজ নয়। পুঁজিবাদকে পুনর্গঠিত করতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংককে টাকা দিতে হবে।
স্বৈরাচার সরকার যদি ক্ষমতায় থাকত, তাহলে তাদের পক্ষে এই সময় সামাল দেওয়া খুবই কঠিন হতো। কারণ চুরি অব্যাহত থাকত। বৈদেশিক বিনিময় হার আরও তলানিতে থাকত। বৈদেশিক মুদ্রা তলানির দিকে যাচ্ছে না। এটা হয়তো ১৮ বিলিয়ন প্লাস-মাইনাসের দিকে আছে। আমরা আশা করছি, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে রিজার্ভ বৃদ্ধি পাবে। কারণ ওই সময় ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত অনেক টাকা পাওনা ছিল, এয়ারলাইনসগুলোয় পাওনা ছিল- হাসিনা সরকার প্রচুর বকেয়া রেখে দিয়েছিল। এই সরকার সেগুলো পরিশোধ করছে। বিগত সরকারের রেখে যাওয়া বকেয়াগুলো ধাপে ধাপে পরিশোধ হচ্ছে। যা আমাদের অর্থনীতির জন্য ভালো খবর। ব্যাংক লুণ্ঠিত হয়েছে, শেয়ারবাজার লুণ্ঠিত হয়েছে, শেয়ারবাজারের লুণ্ঠিত সব টাকা বিদেশে চলে গেছে। জুয়াড়ির মাধ্যমে কিছু কথিত শিল্পপতি সরকারের সঙ্গে যাদের সখ্য ছিল ওই টাকা তারা বিদেশে পাচার করেছে। ফলে বাজারে টাকা নেই, একই সঙ্গে বিনিয়োগও বাড়নো যাচ্ছে না।
যদি পুনর্বিনিয়োগ করা সম্ভব হতো, তাহলে শেয়ারবাজারে পয়েন্ট অনেক বেশি হারে বাড়ত। বর্তমানে শেয়ারবাজারে তারল্যসংকট দেখা দিয়েছে। কারণ বাজার থেকে টাকা বের করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিশেষ করে আইসিবি শোষিত হয়েছে অনেক বেশি। আবর্জনার মতো মূল্যহীন শেয়ারগুলোর ডাম্পিং করে দিয়েছে। আইপি ঋণে আমরা জর্জরিত। এখন শোষণ বন্ধ হয়েছে, মুদ্রা পাচার বন্ধ হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাড়তির দিকে আছে। আমাদের আমদানি বাড়ছে। গত মাসেও আমাদের আমদানি বেড়েছে। এখন সুদের হারও কমে যাবে। আমরা আশা করছি, সুদের হার আগামী ছয় মাসে কমে আসবে। বিদেশে সুদের হার কমছে। যুক্তরাষ্ট্রে কমছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নেও কমছে। বাংলাদেশে শুধু মূল্যস্ফীতি কমানোটা সম্ভব নয়। এটা প্রমাণিত হয়েছে বারবার। সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোয় ক্ষতি হয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। এসব কারণে কর আহরণ কম হচ্ছে। ব্যাংকে তারল্যসংকট যেটা আছে, সেটা সহজ হবে।
ভবিষ্যতে ব্যাংকগুলো তারল্যসংকট থেকে অনেকটা মুক্ত হবে। তখন এমনিতেই বিনিয়োগ বাড়বে। বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা করলে এটাই হচ্ছে বাস্তব চিত্র। ব্যাংক খাত লুণ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে দেশে যে ১০টি ব্যাংক আছে, তা চলার মতো নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ সরবরাহ করছে। সেটা দিয়ে হয়তো কিছুটা উন্নিত হতে পারে। আমাদের দেশে আগে যে ব্যাংকগুলো অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, সেগুলো অনুমোদন দেওয়ার দরকার ছিল না। এগুলো রাজনৈতিকভাবে সুবিধাভোগীরা দিয়েছে, যা অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর হয়েছে।
আমাদের সরবরাহ লাইন শক্তিশালী করা জরুরি। যেমন- টিসিবি পণ্য আরও বেশি বেশি লোকের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সেদিকে এখন আমাদের খেয়াল করতে হবে। গরিব, নিম্ন-মধ্যবিত্তের মধ্যে বণ্টনের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের কাছে সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য পৌঁছে দিতে হবে। মূল কথা হলো- আমাদের সরবরাহ বাড়াতে হবে। তার জন্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। উৎপাদন বাড়াতে গেলে সুদের হার কমাতে হবে। ব্যবসায়ীদের কথা শুনতে হবে।
আমি সরকারকে অনুরোধ করব ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। সব ব্যবসায়ী খারাপ নন, সবাই স্বৈরাচারের দোসর নন। কিছু ভালো ব্যবসায়ীও আছেন যারা গত ১২-১৫ বছর স্বৈরাচারের কাছ থেকে কোনো সুবিধা নেননি বা নিতে পারেননি। সরকারের উচিত তাদের কথা শোনা। সর্বত্র বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেছে। ভারতে কমেছে, শ্রীলঙ্কায় কমেছে, পাকিস্তানে কমেছে, আমাদেরও কমেছে- এ ক্ষেত্রে অতটা আশা করা ঠিক নয়। তবে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে। আমরা যদি ভালো করতে পারি আমরা সহযোগিতা পাব- সেটাই হচ্ছে আসল কথা।
সরকার টাস্কফোর্স গঠন করেছে, এটা অবশ্যই ভালো দিক। টাস্কফোর্সের মাধ্যমে শেয়ারবাজারের সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত করা বা ভালো শেয়ার প্রাপ্তির ব্যাপারে তারা কাজ করছে। যেভাবে রিপোর্ট দেবে তা আমাদের পলিসি মেকারদের জন্য একটা সহায়ক প্রমাণপত্র হিসেবে কাজ করবে। শেয়ারবাজারের সমস্যাগুলো সম্পর্কে এখন সরকারি উচ্চ মহল অবহিত আছে। শেয়ারবাজার বাইরের কিছু না- এটা আমাদের অর্থনীতিবিদদের একটা অংশ এবং অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সরকারি শেয়ারগুলো বিক্রয় করা, সরকারের অগ্রাধিকারে আছে। বিদেশি কোম্পানি তালিকভুক্ত করা- সেটাও আছে। কীভাবে তা করা যায় সে বিষয়ে আমরা সেমিনার, সিম্পোজিয়াম করেছি। বিদেশি ভালো কোম্পানি আমাদের তালিকায় নিয়ে আসতে হবে। কর্মপ্রণোদনা কীভাবে দিতে হয়, তা আমাদের অর্থ মন্ত্রণালয় জানে, এনবিআর জানে। বিদেশে এসব কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত আছে, কিন্তু আমাদের দেশে তারা নেই।
বাংলাদেশের ১ দশমিক ৫ কোটি মানুষ বিদেশে আছে। তারা আমাদের অমূল্য সম্পদ। তারা যে অর্থ আমাদের পাঠায়, সেটা আগের চেয়ে ভালো অবস্থায় আছে এবং তা আরও ভালো হবে। আগে অর্থ পাচারের কারণে আমরা রেমিট্যান্স কম পেতাম। এখন আমরা অপেক্ষাকৃত বেশি পাব। তার পরও আমরা যখন বলি, রিজার্ভ বাড়ছে না কেন? আমার কথা, আগের যে ঋণ নেওয়া ছিল অর্থাৎ বকেয়া ছিল সেগুলো এখন পরিশোধ করা হচ্ছে, এটাই মূল কারণ। মনে রাখতে হবে, একটি স্থিতিশীল অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে আমাদের আরও অনেক বেশি বেগ পেতে হবে। তবে লক্ষ্য নিশ্চয় অর্জিত হবে, সে ব্যাপারে আমরা আশাবাদী।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও চেয়ারম্যান, আইসিবি