
বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে অভিভাবকদের সন্তানের ব্যাপারে জানতে হবে। তাদের সচেতন করে তুলতে হবে। মাদকাসক্তির কারণে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক ক্রিয়া-প্রক্রিয়া নষ্ট হয়ে যায়। এরপরই সন্তান হয়েও মা-বাবাকে খুন করার মতো ভয়ানক কাজটি করতে পারে। এমন কিছু ঘটনা আমরা দেখেছি। এমন পরিস্থিতির আগেই চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। মাদকাসক্তির কারণে অনেকেই ঐশীর মতো হিংস্র হয়ে উঠছে। যেসব পরিবারে হত্যাকাণ্ড ঘটেনি তারাও আছে চরম আতঙ্ক-উৎকণ্ঠায়। মাদকাসক্ত সন্তান তছনছ করছে ঘরের জিনিসপত্র। মারধর করছে স্বজনদের। অতিষ্ঠ হয়ে মা-বাবা নিজেই ছেলেকে পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছেন। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও জাতীয় পর্যায়ে মাদকাসক্তির প্রভাব ভয়াবহ।...
সম্প্রতি সারা দেশ মাদকে সয়লাব হয়ে গেছে। দেশে চার-পাঁচ বছর আগেও ৫০ থেকে ৬০ লাখ মাদকসেবী ছিল। কিন্তু কিছুদিন ধরে ব্যাপক হারে বেড়েছে এই সংখ্যা। গত চার বছরে বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। অর্থাৎ গত চার বছরে দেশে অন্তত ৪০ লাখ মাদকসেবী বেড়েছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা ১ কোটিরও বেশি হবে। ধারণা করা হচ্ছে, ই-সিগারেটের মাধ্যমেও মাদকসেবী বাড়ছে। হাত বাড়ালেই মিলছে মাদক। বাংলাদেশে মায়ানমার থেকে ইয়াবা আর ভারত থেকে আসা ফেনসিডিলের বাজার বহু আগে থেকে। এর সঙ্গে নতুন নতুন মাদকও যুক্ত হচ্ছে, যা রোধ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। এই পরিস্থিতি মাদক কারবার অনেকটাই নির্বিঘ্ন এবং সারা দেশে সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। জাতির সামনে আজ সবচেয়ে বড় অভিশাপের নাম মাদক। এ এক নীরব ঘাতকের মতো ভেতরে ভেতরে শেষ করে দিচ্ছে জাতির সবকিছুকে। সমাজে অস্থিরতা ও পরিবেশের কারণে মাদকাসক্ত হতে পারে যে কেউ। এ ধরনের অপরাধের জন্য মানসিক অসুস্থতা অনেকাংশে দায়ী।
আমাদের দেশের যুবসমাজের একটা বিরাট অংশ মাদকের করাল গ্রাসে নিমজ্জিত। যে সন্তান পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করতে পারত, সমাজ ও দেশের উন্নয়নে নিজেকে সম্পৃক্ত করে, মেধা ও মনন দিয়ে দেশের গর্বে পরিণত হতে পারত, সেই সন্তান আজ মাদকের স্পর্শে, মাদকের করাল গ্রাসে কেবল ধ্বংসই হচ্ছে না, ধ্বংস করে দিচ্ছে একটি পরিবারের কাঙ্ক্ষিত সুখের স্বপ্ন। একটি সুখী পরিবারের সুখ-শান্তি, এমনকি সুন্দর একটি স্বপ্নকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করার ক্ষেত্রেও মাদক অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। মাদকসেবীদের বেশির ভাগ তরুণ-তরুণী। দেশের ৩০ শতাংশ যুবকের মধ্যে বেশির ভাগই মাদকে জড়িয়ে পড়েছে।
এ ছাড়া মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে দেশের বহু পরিবারে চলছে অশান্তি। এরই মধ্যে দেশের কয়েকটি জায়গায় মাদকাসক্ত সন্তানের অত্যাচার সইতে না পেরে বাধ্য হয়ে মা-বাবা তাদের সন্তানকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন। মাদকদ্রব্য হলো একটি দ্রব্য, যা ব্যবহারে বা প্রয়োগে মানবদেহে মস্তিষ্কের সংবেদনশীলতা হ্রাস পায় এবং শরীরে সাময়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করে। মাদকাসক্তি হলো মানুষ এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে এবং নির্দিষ্ট সময় পরপর তা ব্যবহার করতে না পারলে নিজের মধ্যে অশান্তি কাজ করে, তাই মাদকাসক্তি।
মাদকাসক্ত ব্যক্তি হঠাৎ মাদক গ্রহণ না করতে না পারলে তার মধ্যে নানা ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়। গবেষণায় জানা যায়, মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে সাধারণত ১৪ থেকে ৪০ বছর বয়সের মানুষ, যার হার ৭৮ শতাংশ। অন্যদিকে মাদক গ্রহণের গড় বয়স ২০-২২ বছর। দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ ভর করে আছে যে যুবশক্তির ওপর, তার বড় একটি উজ্জ্বল অংশই আজ ‘মরে’ আছে মাদকের বিষে। সমাজের আশীর্বাদের বদলে তারা এখন যেন সমাজের অভিশাপ। সর্বনাশা ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিল, প্যাথেড্রিন, সিসা, মদ, বিয়ার, কোকেন, গাঁজাসহ অনেক কিছু এখন পৌঁছে যাচ্ছে সম্ভাবনাময় তরুণ-তরুণীদের হাতে। হারিয়ে যায় মা-বাবার চোখের ঘুম। অবস্থা এমন হয় যে একেকটি পরিবারে তৈরি হয় বিচ্ছেদের দেয়াল। মা-বাবার আদরের সন্তান হয়ে যায় সবার চোখের বালি। এ জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শিথিলতাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা জানাচ্ছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর আগের মতো নেই। ফলে মাদকসেবী ও কারবারিরা ভয় পাচ্ছে না। প্রায় প্রকাশ্যে চলছে বেচাকেনা।
দেশের মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ যুবক-যুবতী। যাদের বেশির ভাগ মাদকে আসক্ত। এই যুবকদের বাঁচাতে না পারলে দেশ ভয়াবহ এক সংকটের মুখে পড়বে। উচ্চবিত্ত, নিম্নবিত্ত- সব পরিবারেরই এ প্রবণতা দেখা যায়। তবে ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানদের মধ্যে ইয়াবা, সিসা, হেরোইনের ঝোঁক বেশি দেখা যায়। অন্যদিকে নিম্ন আয়ের পরিবারের সন্তানদের মধ্যে গাম, ফেনসিডিল, গাঁজা, ইনজেকটেবল ড্রাগসহ হেরোইনের ঝোঁকও বেশি পাওয়া যায়। ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, এসব ড্রাগ কেবল মানসিক বৈকল্যই নয়, কিডনি-ফুসফুস-লিভার নষ্ট হওয়াসহ আরও অনেক শারীরিক ক্ষতি বয়ে আনে। এদিকে কিশোর বয়সে কেউ মাদকাসক্ত হলে তার সুপ্ত প্রতিভা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়।
সমাজের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা, মূল্যবোধ, ধর্মীয় ও নৈতিক আদর্শ ইত্যাদি থেকে বিচ্যুত হয়ে যখন কেউ মাদক দ্বারা প্রভাবিত হয়, তখন প্রকৃতপক্ষে সে আত্মহননের পথই বেছে নেয়। মাদকাসক্তি হলো বাজার অর্থনীতির কুফল, যেখানে একদল স্বার্থান্বেষী কালোটাকা লাভের আশায় কাজ করছে। এ ছাড়া এর পেছনে রয়েছে আরও নানাবিধ আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক কারণ। আধুনিকতার নামে উচ্ছৃঙ্খল হওয়া, সন্ত্রাস, হতাশা, দ্বন্দ্ব ইত্যাদি মানুষকে মাদকাসক্ত হতে সাহায্য করছে।
এ ছাড়া বন্ধু-বান্ধবের কুসংসর্গ, পারিবারিক, সামাজিক ও মানসিক অস্থিরতা, মাদকাসক্তি ভয়াবহ রূপে ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, সচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েদের মধ্যেই মাদকদ্রব্য সেবনের প্রবণতা বেশি। মাদক মাদকাসক্ত ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক দিককে ক্রমাবনতির দিকে নিয়ে যায় এবং তাকে অর্থনৈতিক দিক দিয়েও পঙ্গু করে দেয়। মাদক বাংলাদেশের জাতীয় জীবনের প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। মাদকাসক্তি একটি নীরব ঘাতক। এটি মানুষকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দেয়। এর করাল গ্রাসে ধ্বংস হয় পরিবার, সমাজ ও দেশ।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের সর্বত্র মাদকের আগ্রাসন এখন অভিশপ্তের ডালপালায় ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। মাদকদ্রব্যের বেদনানাশক ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকে তন্দ্রাচ্ছন্নতা, আনন্দোচ্ছ্বাস, মেজাজ খিটখিটে, মানসিক আচ্ছন্নতা, শ্বাস-প্রশ্বাস অবনমন, রক্তচাপ হ্রাস, স্মৃতিশক্তি হ্রাস ও বমি, কোষ্টবদ্ধতা ইত্যাদি দেখা দেয়।
মাদকদ্রব্যকে সহজভাবে বলা যায়, যা গ্রহণে মানুষের স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক অবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে ও যে দ্রব্য আসক্তি সৃষ্টি করে, তাই মাদকদ্রব্য। সেই সঙ্গে ব্যক্তিকে নিঃসঙ্গ ও মর্যাদাহীনের স্তরে নিয়ে আসে। মাদক-নির্ভরতা ব্যক্তির স্বাস্থ্যহানি ঘটায়, রোগব্যাধি সৃষ্টি করে; ওজনহীনতা, শক্তিহীনতা ও ক্ষুধামান্দ্যতে ভোগায়। এদের কর্মোদ্দীপনা হ্রাস পায়, মতিভ্রম দেখা দেয় এবং ধীরে ধীরে স্বাস্থ্যহীন ও কঙ্কালসার হয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়। মদের প্রতিক্রিয়ায় ধীরে ধীরে মানুষের হজম শক্তি নষ্ট হয়ে যায়, খাদ্য গ্রহণের স্পৃহা হ্রাস পায়, চেহারা বিকৃত হয়ে পড়ে, স্নায়ু দুর্বল হয়ে আসে, সামগ্রিকভাবে শারীরিক অক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, মানুষ অকর্মণ্য হয়ে পড়ে, মদ ধীরে ধীরে যকৃৎ, কিডনি সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট করে ফেলে। বর্তমানের মরণব্যাধি এইডস রোগের প্রাদুর্ভাবের সঙ্গেও মাদকের সম্পৃক্ততা রয়েছে। ধনী-দরিদ্র, উন্নত-উন্নয়নশীল কোনো দেশই মাদকের ভয়াবহ থাবা থেকে মুক্ত নয়।
মাদকাসক্তি আমাদের দেশের শিক্ষাঙ্গন তথা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যেভাবে বিস্তার লাভ করছে, এখনই তার লাগাম টেনে ধরতে না পারলে ভবিষ্যতে তা নিবারণ করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়বে। মাদকাসক্ত ব্যক্তির আচরণ, অভ্যাস এবং চলনে হঠাৎ মনমানসিকতা পরিবর্তন দেখা দেওয়া। ঘরে তামাকের বা সিগারেটের টুকরা পড়ে থাকা। যেমন- প্লাস্টিকের বা কাচের বোতল, কাগজের পুরিয়া, ইনজেকশন, খালি শিশি, পোড়ানো দিয়াশলাইয়ের কাঠিসহ নানাবিধ অস্বাভাবিক জিনিস। লেখাপড়া, খোলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সব সময় অনীহা।
কাপড়চোপড়ে দুর্গন্ধ বৃদ্ধি পাওয়া ও পোড়া দাগ লেগে থাকা ইত্যাদি একাধিক বিষয় পরিলক্ষিত ব্যক্তি মাদকাসক্ত তা নিশ্চিতভাবেই সন্দেহ করা যায়। তরুণদের ক্ষেত্রে হঠাৎ নতুন বন্ধুদের সঙ্গে চলাফেরা শুরু করা। বিভিন্ন অজুহাতে ঘন ঘন টাকা চাওয়া। আগের তুলনায় দেরিতে বাড়ি ফেরা। রাতে জেগে থাকা এবং দিনে ঘুমের প্রবণতা বৃদ্ধি করা। ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর অস্বাভাবিক আচরণ করা। খাওয়া-দাওয়া কমিয়ে দেওয়া এবং ওজন কমে যাওয়া। অতিরিক্ত মাত্রায় মিষ্টি খেতে আরম্ভ করা এবং ঘন ঘন চা-সিগারেট পান করা। অনেক সময় মাদকাসক্ত সঙ্গীদের প্ররোচনায় অপরাধ জগতেও পা বাড়ায়। একশ্রেণির মাদক ব্যবসায়ী এখন বিত্তবানদের সন্তানদের টার্গেট করছে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যেই মাদকাসক্তির হার বেশি। মা-বাবার সম্পর্ক খারাপ থাকলে অনেক সময় সন্তান মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে।
এ ছাড়া বখাটে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে তরুণ-তরুণীরা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে অভিভাবকদের সন্তানের ব্যাপারে জানতে হবে। তাদের সচেতন করে তুলতে হবে। মাদকাসক্তির কারণে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক ক্রিয়া-প্রক্রিয়া নষ্ট হয়ে যায়। এরপরই সন্তান হয়েও মা-বাবাকে খুন করার মতো ভয়ানক কাজটি করতে পারে। এমন কিছু ঘটনা আমরা দেখেছি। এমন পরিস্থিতির আগেই চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। মাদকাসক্তির কারণে অনেকেই ঐশীর মতো হিংস্র হয়ে উঠছে। যেসব পরিবারে হত্যাকাণ্ড ঘটেনি তারাও আছে চরম আতঙ্ক-উৎকণ্ঠায়।
মাদকাসক্ত সন্তান তছনছ করছে ঘরের জিনিসপত্র। মারধর করছে স্বজনদের। অতিষ্ঠ হয়ে মা-বাবা নিজেই ছেলেকে পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছেন। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও জাতীয় পর্যায়ে মাদকাসক্তির প্রভাব ভয়াবহ। মাদকাসক্তি ব্যক্তি, পরিবার, সামাজিক ও জাতীয় জীবনে নানামুখী সমস্যার সৃষ্টি করে। সমাজের সম্ভাবনাময় একটি অংশ যখন নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তখন উন্নত-অনুন্নত যেকোনো দেশের জন্যই তা অত্যন্ত ক্ষতিকর। অতএব, মাদকের এ ভয়াবহতা থেকে জাতিকে মুক্ত করা জরুরি।
লেখক: সাবেক রেজিস্ট্রার, বিএসএফএমএসটিইউ
[email protected]