
রাজনৈতিক নেতাদের অবশ্যই এই সাহসী কর্মসূচি থেকে অনুপ্রেরণা নিতে হবে এবং তাদের নাগরিকদের হতাশার মূল কারণগুলোকে মোকাবিলায় আরও উচ্চাভিলাষী হতে হবে। সুসংবাদটি হলো- প্রতিটি দেশ এবং সম্প্রদায়ের সৃজনশীল ব্যক্তি রয়েছেন, তাদের ভবিষ্যতের জন্য চিন্তা করতে এবং পরিকল্পনা করতে হবে। নেতাদের অবশ্যই এই জাতীয় স্বপ্নদর্শীদের শনাক্ত করতে হবে এবং তাদের কাছে পৌঁছাতে হবে। তাদের নীতি আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং তাদের দক্ষতার ব্যবহার করতে হবে।...
বিশ্বজুড়ে কিছু রাজনৈতিক দায়িত্বশীলকে তাদের পদ থেকে বাদ দেওয়া বা জোর করে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করা হয়েছিল। সংযুক্ত আরব আমিরাতের মন্ত্রিপরিষদবিষয়ক মন্ত্রী মোহাম্মদ আল-গেরগায়ি বিবৃতি দিয়েছেন যে, ‘সরকারের ভূমিকা হলো ভবিষ্যৎ তৈরি করা, যা নাগরিকরা আশা করে।’ ২০২৫ সালে রাজনৈতিক নেতাদের এই বার্তাটি অন্তরে ধারণ করা উচিত এবং তাদের মনোযোগকে ক্রমাগতভাবে সংকটময় অবস্থা থেকে সাহসী ও আশাব্যঞ্জক কর্মসূচির দিকে নিয়ে যাওয়া উচিত।
বিশ্বব্যাপী ক্ষমতাবিরোধী ঢেউ শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত মার্চে সেনেগালের প্রেসিডেন্ট ম্যাকি সাল প্রেসিডেন্ট নির্বাচন স্থগিতের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন এবং অবশেষে পরাজিত হন। আবার জুন মাসে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস; যা বর্ণবাদের অবসানের পর থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা শাসন করে আসছিল। আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস তিন দশকের মধ্যে এই প্রথমবারের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায় এবং দলটি জোট সরকার গঠন করতে বাধ্য হয়। একই মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টিও তাদের সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে।
এই প্রবণতা গ্রীষ্ম এবং শরৎকালজুড়েই চলছিল। জুলাই মাসে লেবার পার্টি ইউকের সাধারণ নির্বাচনে ব্যাপকভাবে জয়লাভ করে। এতে কনজারভেটিভ পার্টির ১৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। অক্টোবরে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ২০০৯ সালের পর এই প্রথমবারের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। তার পর ডিসেম্বরে মিশেল বার্নিয়ার ১৯৬২ সালের পর অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া প্রথম ফরাসি প্রধানমন্ত্রী। কয়েক দিন পরে জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ স্কোলজ তার আস্থার ভোট হারিয়েছেন এবং একটি আগাম নির্বাচনের পথকে বাড়িয়ে চলেছে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো তার অর্থমন্ত্রীকে বরখাস্ত করেছেন এবং তার দেশকে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় ফেলে দিয়েছেন।
অন্যান্য অনেক প্রতিষ্ঠিত নেতা গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হন। আগস্টে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সামরিক হেলিকপ্টারে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান; কারণ বিক্ষোভকারীরা তার সরকারি বাসভবনে হামলা চালিয়েছিল। অন্যদিকে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ গত মাসে তার পতনের পর রাশিয়ায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
কেন ক্ষমতাসীনরা হেরে যাচ্ছে? এর অন্যতম কারণ হলো সোশ্যাল মিডিয়া। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ইন্টারনেট অ্যাক্সেস বৃদ্ধি প্রায়ই সরকারের প্রতি আস্থা নষ্ট করে দেয় এবং রাজনৈতিক মেরূকরণকে গভীর করে তোলে। যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্র্যাটিক এবং রিপাবলিকান ঝুঁকে থাকা ভোটাররা দিন দিন মেরূকরণ হয়ে উঠছে। প্রতিটি পক্ষই তাদের পক্ষপাতিত্বে আরও গভীরভাবে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে।
সোশ্যাল মিডিয়া এমন লোকদের মধ্যে সংযোগ গড়ে তোলে; যারা একই ধরনের বিষয়গুলো কামনা করে। এভাবে তাদের বিশ্বদর্শনকে শক্তিশালী করে তোলে এবং ‘সামঞ্জস্য’ নামে পরিচিত মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবকে বাড়িয়ে তোলে। সোশ্যাল মিডিয়া অ্যালগরিদমে আবেগপূর্ণ বার্তাগুলো মেগাফোনের মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে দেয় এবং এ প্ল্যাটফর্ম ষড়যন্ত্রকে বাড়িয়ে তোলে।
যদিও প্রাথমিক প্রমাণে দেখা যায়, সোশ্যাল মিডিয়া ডানপন্থি জনতাদের সমর্থন করে। সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলগুলোর পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, শুধু এটিই ক্ষমতা অর্জনের জন্য যথেষ্ট নয়। মেক্সিকো, স্পেন, গ্রিস, আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, জাপান এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় ক্ষমতাসীন বা অন্য মূলধারার দলগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে দুর্বল হয়ে পড়লেও তারা বিজয়ী হয়েছে।
২০২৪ সালের পর থেকে পরিষ্কার উপায় হলো সরকারগুলোকে অবশ্যই সামাজিক মিডিয়াকে আরও কার্যকরভাবে ব্যবহার করা শিখতে হবে। কোনো ভালো কাজ শুরু করতে হলে অবশ্যই ভোটারদের সরাসরি জড়িত করতে হবে। ২০২৪ সালে কেয়ার স্টারমারের দুজন উপদেষ্টা উত্তর-পূর্ব ইংল্যান্ডের গ্রিমসবি শহরে গিয়েছিলেন এবং নাগরিকদের এক কথায় সরকারকে বর্ণনা করতে বলেছিলেন। তারা যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন তা আমি অন্য অনেক দেশেও শুনেছি; অপ্রাসঙ্গিকতা, স্বৈরাচারী, দূরবর্তী, অভিজাত, স্ব-সেবামূলক, অভিমানী ও অবিশ্বাসযোগ্য।
আরেকটি বড় উপায় হলো আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য নেতাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং নাগরিকদের ক্ষমতায়নের দিকে মনোনিবেশ করা উচিত। পপুলিজমের রাজনৈতিক অর্থনীতির বিস্তৃত অধ্যয়ন-২০২২ প্রমাণ তুলে ধরেছে যে, অর্থনৈতিক অবস্থা, যেমন- ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব ও সামাজিক ব্যয় সরকারের প্রতি জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি গভীরভাবে প্রভাব ফেলে।
এটি ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে যে, কেন ২০২৩ সালে স্পেন ও গ্রিসের ভোটাররা এবং ২০২৪ সালে আয়ারল্যান্ডের ভোটাররা ক্ষমতাসীন নেতাদের পুনর্নির্বাচন করতে বেছে নিয়েছিল।
অন্যদিকে ফরাসি ভোটাররা ক্ষমতাসীন দলকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। ২০২২ সালে স্পেনের অর্থনীতি ৫.৭ শতাংশ এবং গ্রিসের ৬.২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিপরীতে জার্মানিতে সরকার সংসদীয় অনাস্থা ভোটে হেরে যাওয়ার পর ফেব্রুয়ারিতে আগাম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ২০২৩ সালে জার্মানির অর্থনীতি ০.৩ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে এবং ২০২৪ সালে ০.১ শতাংশ সংকুচিত হবে বলে আশা করা হয়েছিল। ফ্রান্স কিছুটা ভালো করেছে। কারণ, ২০২৩ সালে ০.৯ শতাংশ বৃদ্ধির পর মোট দেশীয় উৎপাদন গত বছর ১.১ শতাংশ বৃদ্ধি হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল।
স্বল্পমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর বাইরেও রাজনৈতিক নেতাদের অবশ্যই তাদের নাগরিকদের ভবিষ্যৎ ভালোর জন্য বিবেচনা করতে হবে। অনেক রাজনীতিবিদ এবং নীতিনির্ধারকের পরিকল্পনা বার্ষিক বাজেট চক্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং মূলত কাটছাঁটের ওপর তারা নির্ভশীল হয়ে পড়েন। ইতোমধ্যে ভোটাররা ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার ব্যয়, মহামারি-পরবর্তী কঠোরতার কারণে তারা তাদের জীবনের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। এমন নেতাদের প্রয়োজন, যারা তাদের আশা দেখাতে পারে।
বাজেটের সীমাবদ্ধতা ভালো ভবিষ্যতের কল্পনা করতে ব্যর্থ অজুহাত হওয়া উচিত নয়। অর্থনৈতিক দুর্দশার সময়ে সরকারি কিছু সাহসী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১৯৩০-এর দশকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্টের নতুন চুক্তি, ব্রিটেনের যুদ্ধ-পরবর্তী কল্যাণ রাষ্ট্র, দুবাইয়ের ১৯৫৮-পরবর্তী অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং ১৯৫৯-এর পরে সিঙ্গাপুরের দ্রুত উন্নয়ন।
রাজনৈতিক নেতাদের অবশ্যই এই সাহসী কর্মসূচি থেকে অনুপ্রেরণা নিতে হবে এবং তাদের নাগরিকদের হতাশার মূল কারণগুলোকে মোকাবিলায় আরও উচ্চাভিলাষী হতে হবে। সুসংবাদটি হলো- প্রতিটি দেশ এবং সম্প্রদায়ের সৃজনশীল ব্যক্তি রয়েছেন, তাদের ভবিষ্যতের জন্য চিন্তা করতে এবং পরিকল্পনা করতে হবে। নেতাদের অবশ্যই এই জাতীয় স্বপ্নদর্শীদের শনাক্ত করতে হবে এবং তাদের কাছে পৌঁছাতে হবে। তাদের নীতি আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং তাদের দক্ষতার ব্যবহার করতে হবে।
গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনতে আশার রাজনীতি অপরিহার্য। গ্রিমসবিতে স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছিলেন যে, তারা এমন রাজনীতি আকাঙ্ক্ষা করেন যা বাস্তববাদী, অর্থপূর্ণ, উৎসাহী, আশাবাদী এবং ক্ষমতায়ন। যে সরকার এই আকাঙ্ক্ষাগুলো পূরণ করতে পারে, সে নিজেকে তার নাগরিকদের আস্থার যোগ্য প্রমাণ করবে।
লেখক: ডিন, ব্লাভাটনিক স্কুল অব গভর্নমেন্ট, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে সংক্ষেপিত
অনুবাদ: সানজিদুল ইসলাম সকাল