ঢাকা ২৪ মাঘ ১৪৩১, শুক্রবার, ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
English
শুক্রবার, ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৪ মাঘ ১৪৩১

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি কেমন হওয়া উচিত

প্রকাশ: ০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৫২ পিএম
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি কেমন হওয়া উচিত
মালিহা লোধি

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের সদস্যপদ মাত্র দুই বছর হয়েছে। এখন বিশ্ব মঞ্চে দেশটির কূটনৈতিক অবস্থান তুলে ধরতে এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার বিষয়ে আলোচনা ও পদক্ষেপে অবদান রাখার সুযোগ পাবে। কিন্তু এর পররাষ্ট্রনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সহজ করার সম্ভাবনা নেই।...

২০২৫ সালে পাকিস্তান পররাষ্ট্রনীতিতে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা, মার্কিন-চীন প্রতিযোগিতা, ইউক্রেন এবং মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ নিয়ে প্রধান শক্তিগুলোর বলয় তৈরি এবং অস্থিতিশীল বৈশ্বিক পরিবেশে তাদের মোকাবিলা করতে হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ায় নতুন করে সংকটে পড়তে পারে দেশটি। 

পাকিস্তানের আঞ্চলিক পরিস্থিতিও অস্থির এবং নিরাপত্তাহীনতার দীর্ঘ ছায়া পড়েছে। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিনের শত্রুতা বিরাজ করছে। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই শোচনীয়। তারা বাইরের আর্থিক সংস্থাগুলোর ওপর অনেকটা নির্ভরশীল থাকে এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশির ভাগই অনিশ্চিত। সে ক্ষেত্রে অনেক কিছুই তাদের মোকাবিলা করতে হবে। যেহেতু পররাষ্ট্রনীতি নিজের দেশ থেকেই শুরু হয়, সে ক্ষেত্রে এই বাস্তবতাগুলো পাকিস্তানের কূটনীতির আচরণের ওপর ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলবে। 

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রগুলোতে সব চ্যালেঞ্জকে দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে এবং তাদের দ্বন্দ্বে আসা যাবে না। আফগানিস্তানের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান অস্থির সম্পর্ক মোকাবিলা করতে হবে। ভারতের সঙ্গে যে প্রতিকূল সম্পর্ক রয়েছে তা সঠিকভাবে পরিচালনা করা উচিত। সৌদি আরব এবং ইরানের মধ্যে সম্পর্কে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক রাখতে হবে। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন প্রত্যাহারের পর ওয়াশিংটনের সঙ্গে পাকিস্তানের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব কমে যাওয়ায় আমেরিকার সঙ্গে কীভাবে সম্পর্ক গড়ে উঠবে তা এখনো অজানা। 

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সময় সম্পর্কটা টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যায়। গত চার বছরে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একবারও পাকিস্তান সফর করেননি। জো বাইডেন পাকিস্তানি নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার জন্য তেমন কোনো আগ্রহ দেখাননি। ট্রাম্পের আগের মেয়াদে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়েছিল, যখন তিনি কোয়ালিশন সাপোর্ট ফান্ডের সহায়তা পাকিস্তানকে বন্ধ করার ঘোষণা করেছিলেন। তার অর্ধেকের বেশি মেয়াদে ইসলামাবাদে কোনো মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন না। ট্রাম্প আফগানিস্তান থেকে মার্কিন প্রস্থানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর তালেবানের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে চাইলে সম্পর্ক আরও খারাপ হয়। দোহায় পাকিস্তানের সঙ্গে চুক্তি করতে গেলে সম্পর্ক আরও তিক্ত হয়। এটি অবশেষে আমেরিকার প্রত্যাহারের পথকে প্রশস্ত করে। এর বাইরেও ট্রাম্প এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের মধ্যে যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল তা ছিল মূলত দ্বিপক্ষীয়। 

এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তান তাদের সম্পর্ক গড়ে তুলতে ওয়াশিংটনের সঙ্গে পুনরায় যুক্ত হতে চায়। যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের বৃহত্তম রপ্তানি দেশ এবং এফডিআইয়ের জন্য বড় উৎস। আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতা পাকিস্তানের সংকটপ্রবণ অর্থনীতির উত্তরণের জন্য বিশেষ প্রয়োজন। 

আমেরিকা কৌশলগত দিক দিয়ে চীনকে আটকানোর ব্যাপারে অগ্রাধিকার দেয়। যেহেতু পাকিস্তান চীনবিরোধী জোটের অংশ হতে পারে না, তাই পাকিস্তান-মার্কিন সম্পর্কের জায়গাটা সীমিত হয়ে যায়। আরেকটি কারণ হলো ভারতের সঙ্গে ওয়াশিংটনের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখা। এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দের অংশীদার ভারতকে চীনের প্রতি পাল্টা প্রভাব বিস্তারে কৌশল হিসেবে সম্পর্ক বজায় রাখে। এই দুটি কৌশলগত বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে পাক-মার্কিন সম্পর্কের জন্য স্থান খুঁজে বের করাই কঠিন চ্যালেঞ্জ। এটা সহজ হবে না। কারণ ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের স্থান পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

চীন অবশ্য পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতিতে অগ্রাধিকারে রয়েছে। এই সময়ের বাস্তবতায় সম্পর্কটি দেশের নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ উভয়ই পূরণ করে থাকে। কিন্তু শক্তিশালী, ইতিবাচক গতিপথ ধরে রাখার জন্য সমস্যাগুলোর সমাধান প্রয়োজন। পাকিস্তানে কর্মরত চীনা কর্মীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগকে কমিয়ে আনতে হবে। গত বছর চীনা শ্রমিকদের হত্যা মামলায় পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী চীন প্রকাশ্যে ইসলামাবাদকে তার হাজার হাজার শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য অনুরোধ করেছে। 

কাশ্মীর সমস্যা মীমাংসা করা ভারতের দাবি। এই ইস্যুতে পাকিস্তানের সঙ্গে কথা বলতে অস্বীকৃতির জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মোদি সরকার সংলাপ পুনরায় শুরু করতে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। স্পষ্টতই এই সিদ্ধান্তের কারণে ভারত নয়, পাকিস্তানকে আঘাত করা হয়েছে। গত এক বছরে পাকিস্তানি নেতাদের শান্তির উদ্যোগের প্রতি ভারতীয় প্রতিক্রিয়া থেকে সেটাই স্পষ্ট বোঝা যায়। এ সময়ে কোনো আন্দোলন না থাকায় তাৎক্ষণিক কাজ হলো ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের উত্তেজনা সামলানো। 

সম্প্রতি নিষিদ্ধঘোষিত তেহরিক-ই-তালেবান আস্তানা লক্ষ্য করে পাকিস্তান আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে বিমান হামলা চালানোর পর আফগানিস্তানের সম্পর্ক আরও খারাপ হয়েছে। আন্তসীমান্ত হামলা চালিয়ে যাওয়া টিটিপির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কাবুলের অস্বীকৃতির কারণে ইসলামাবাদ হামলা করতে বাধ্য হয়; যা ২০২৪ সালে আরও তীব্রতর হয়েছিল।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের সদস্যপদ মাত্র দুই বছর হয়েছে। এখন বিশ্ব মঞ্চে দেশটির কূটনৈতিক অবস্থান তুলে ধরতে এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার বিষয়ে আলোচনা ও পদক্ষেপে অবদান রাখার সুযোগ পাবে। কিন্তু এর পররাষ্ট্রনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সহজ করার সম্ভাবনা নেই।

লেখক: যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও 
জাতিসংঘে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত।
ডন থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদুল ইসলাম সকাল

দ্রুত বিচার নিশ্চিতে আইনি জটিলতা

প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:২৩ পিএম
দ্রুত বিচার নিশ্চিতে আইনি জটিলতা
মাসুদ আহমেদ

গত সরকারের পলাতক ও ধৃত অপরাধীদের নেতা শেখ হাসিনার বিচার এক বছরের মধ্যে করা হবে বলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম দৃঢ়তার সঙ্গে বারবার উল্লেখ করছেন। তিনি তার পেশার ৯১ হাজার মানুষের মধ্যে যে তুলনামূলক খুবই উজ্জ্বল ও দক্ষ তা তার আত্মবিশ্বাস, যুক্তি প্রদর্শন, অভিজ্ঞতার প্রকাশ, আইনের ধারার সঠিক উল্লেখ এবং বাকপটুতায় প্রমাণিত। যেখানে সুপ্রিম কোর্টের অনেক জ্যেষ্ঠ আইনজীবীও বাংলায় একটি সাধারণ সংবাদ সম্মেলন করতে গিয়ে অত্যন্ত বিরক্তিকরভাবে এবং অস্পষ্ট ও পরস্পরবিরোধী আইনের ধারা উল্লেখ করেও তার প্রকাশ তেমন একটা স্পষ্টভাবে করতে পারেন না। সেই তুলনায় তাজুল অনেক প্রাঞ্জল এবং বিশ্বাসজাগানিয়া। তার বক্তব্য প্রমিত এবং একান্ত সহজভাবে বোধগম্য। এক কথায় তিনি স্মার্ট। শেখ হাসিনার বিচারের সময়সীমা সম্পর্কে তিনি যা বলছেন, সেই সূত্রে একান্ত প্রাসঙ্গিকভাবে কিছু প্রতিষ্ঠিত তথ্যের বিবেচনা এ প্রসঙ্গে করাটা প্রয়োজন বলে মনে করি। 

প্রথমত, নিত্যবর্ধমান দায়েরকৃত মামলার সংখ্যায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৫৪টি মামলা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে খুন, হত্যাচেষ্টা, খুনের উদ্দেশ্যে আদেশ দেওয়া, গুম, আহত করা, দৈহিক নির্যাতন, সম্পদ ধ্বংস করা, ষড়যন্ত্র ও দেশকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা। এই মামলাগুলো দেশের ৬৯টি  থানায় দায়ের করা হয়েছে। যেগুলো বিভিন্ন মহানগর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত জেলায় অবস্থিত। মানে বলা যায়, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া। এগুলোয় বাদীর সংখ্যা ১ হাজার ৫৪, সাক্ষী, মূল অপরাধী ও অন্যান্য আসামির সংখ্যা ১ লাখ ৫২ হাজার। আর দণ্ডবিধির ৩০২, ৩০১, ১৬৯, ৫০০, ৫০১ ইত্যাদিসহ আরও গুরুতর ধারা এতে সম্পৃক্ত। আইনে আছে, প্রতিটি মামলায় একজন করে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করতে হবে। এখন এই ১ হাজার ৫৪ মামলায় অভিযুক্ত গড় আসামির সংখ্যা প্রায় ১৪৪ জন। এর সঙ্গে আছে আরও গড়ে ৭২ জন সাক্ষী। 

একেকজন তদন্তকারী কর্মকর্তার পক্ষে প্রথমত, এই ১৪৪ জন অপরাধী ও ৭২ জন সাক্ষীর নাম, পিতার নাম, মাতার নাম, জন্ম তারিখ, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা, পেশা, ঘটনাস্থলের বর্ণনা, অপরাধের ধরন এবং অপরাধ প্রমাণিত হলে দণ্ডবিধির ধারা ও আরোপযোগ্য শাস্তির বর্ণনাসংবলিত একেকটি তদন্ত প্রতিবেদন ও চার্জশিট প্রণয়ন করতে কতদিন সময় লাগবে তা নির্ণয়যোগ্য। নিহত ১ হাজার ৬০০ মানুষ এবং আহত ১ লাখ মানুষের নাম, বাব-মায়ের নাম এবং অন্যান্য তথ্যও তদন্ত কর্মকর্তাকে লিপিবদ্ধ করতে হবে। প্রথমত, হাতে লিখে পরে এ তথ্যগুলো নির্ভুলভাবে টাইপ করে খসড়া করতে কত দিন সময় লাগবে? সেটি বিবেচ্য। আব্দুল কাহার আকন্দ মাত্র দুটি মামলার তদন্ত ও চার্জশিট প্রণয়ন করতে কত বছর সময় নিয়েছিলেন? সেটিও স্মরণ করা যেতে পারে। এদের মধ্যে অনেকের বাব-মা নিহত ও আহত সন্তানশোকে মারা গেছেন কিংবা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বাদী আবার অনেক ক্ষেত্রে তারাই। এদের খুঁজে বের করে এবং শনাক্ত করে জিজ্ঞাসাবাদ, অকুস্থল পরিদর্শন ও আলামত পরীক্ষা শেষে এবং তথ্যের পরস্পরবিরোধিতা পরিহার করে আমলযোগ্য একটি পর্যায়ে আনতে প্রত্যেক কর্মকর্তার কমপক্ষে ৫ মাস সময় প্রয়োজন হবে।

 অভিযুক্ত এবং সংশ্লিষ্ট অনেকে বিদেশে পলাতক। সাক্ষীর অনেকে ঝামেলার ভয়ে পলাতক এবং আহত ও নিহত হয়েছেন। অনেক বাদী আবার মামলার ব্যাপারে অজ্ঞতা প্রকাশ করছেন। বলছেন, তারা এই মামলা করেননি। তাদের নামে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে অন্য কেউ এসব মামলা দায়ের করেছেন। যেগুলোর বাদীকে পাওয়া যাবে না, সেই মামলাগুলো আদালত খারিজ করে দিতে পারবে। কোনো জেলা জজের পক্ষেই এক দিনে ১৫.২৭টি মামলার শুনানি গ্রহণ করা একটি অবাস্তব কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। ওই আদালতের আগের সব কর্মকাণ্ড স্থগিত রেখেও যদি আদালত শুনানি গ্রহণ করেন, তাহলে এক দিনে দুটির বেশি মামলা পরিচালনা করা সম্ভব হবে না।

 ফলে শুনানিকৃত এই দুটি মামলাসহ আরও ১৩.২৭টি মামলার নতুন তারিখ নির্ধারণ করতে হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কতটি মামলার শুনানি এককভাবে করবেন তা এখনো জানা যায়নি। কিন্তু দেশের বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা না থাকায় পলাতক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বিচার নিশ্চিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। যার অর্থ মামলা যেখানেই দায়ের হয়ে থাকুক না কেন, সব মামলাই ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর ও বিচার সম্পন্ন করতে হবে। এর অর্থ, এই একই  আদালতে ১ হাজার ৫৪টি মামলার শুনানি গ্রহণ এবং বিচার সম্পন্ন করতে হবে। তাহলে যেখানে একটি আদালতে প্রতি কর্মদিবসে দুটির বেশি মামলার শুনানি গ্রহণ করা সম্ভব নয়, সেখানে ১ হাজার ৫৪টি মামলার শুনানির দায়িত্ব পালন করা এই ট্রাইব্যুনালের পক্ষে সম্ভব হলেও কত দিন লাগবে তা এখানেই বলা যায়। যদি প্রতি কর্মদিবসে মামলাগুলোর শুনানি করা হয় তবে প্রায় ৫২৭ দিন লাগবে প্রথম শুনানি সম্পন্ন হতে। এর অর্থ ১০৪ দিন ছুটি + বিচার বিভাগীয় অবকাশ ৬০ দিন + ৫২৭ দিন মামলার শুনানি সম্পন্ন করতে ১.৮৯ বছর সময় প্রয়োজন হবে। ৭২ জন সাক্ষীসংবলিত হত্যা ও গুমের মতো ফৌজদারি মামলা ১, ২, ৩ দিনের শুনানিতে সম্পন্ন হওয়ার রেকর্ড বিশ্বের কোথাও নেই। বসনিয়ার গণহত্যার নায়কের বিচার হতে কত দিন লেগেছিল তা এই ক্ষেত্রে স্মরণীয়। তাহলে সম্পূর্ণ আদর্শ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারলেও অর্থাৎ আসামি, সাক্ষী, বাদী, বিচারক, তদন্তকারী, উভয়পক্ষের আইনবিদ ইত্যাদির পূর্ণ উপস্থিতি ঘটার পরও একেকটি মামলায় যদি গড়ে চার দিনের শুনানিও গ্রহণ করতে হয় তাহলে এই আদালতে মামলার রায় হতে মোট সময় লাগবে ৭.৫৭ বছর।

 কোথাও আন্দোলন, বিক্ষোভ ও সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস প্রক্রিয়া আরম্ভ হলে সেটি দমানোর জন্য শেখ হাসিনা তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার স্বরাষ্ট্র সচিবকে কী পদ্ধতিতে কী ধরনের আদেশ দিয়েছিলেন এবং তিনি পুলিশ বাহিনীকে কী কার্যব্যবস্থা নিতে আদেশ দিয়েছিলেন, যার ফলে কার গুলিবর্ষণে বাদীরা হতাহত হয়েছেন, তার সাক্ষ্যপ্রমাণ বিচারকের সামনে তুলে ধরা। এই সূত্র ও সংযোগগুলোর মধ্যে প্রধান আদেশ দানকারীর ভূমিকার সামান্য দুর্বলতা থাকলেও আদালত তা গ্রহণ করবে না। এ-সংক্রান্ত দায়েরকৃত মামলার বেশ কিছু কাগজপত্র বিভিন্ন থানা জনতা কর্তৃক আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার ফলে ধ্বংস হয়েছে, আলামত নষ্ট হয়েছে। এগুলোর অনুপস্থিতি আদালতে মামলাকে দুর্বল করে দেবে। নিহতদের সুরহতাল, ডেথ সার্টিফিকেট এবং হাসপাতাল থেকে রিলিজ অর্ডার ইত্যাদি কাগজপত্রও আদালতে পেশ করতে হবে।

 অথচ পুলিশের ভীতির কারণে অনেক লাশই আত্মীয়-স্বজনরা এসব কাগজপত্র ছাড়াই হাসপাতাল ও ঘটনাস্থল থেকে নিয়ে গিয়ে সন্তর্পণে কবর দিয়েছেন। পলাতক আসামির বিচার করে রায় দেওয়া সম্ভব। কিন্তু অনুপস্থিত, নিখোঁজ এবং অনিচ্ছুক সাক্ষী ও বাদী ছাড়া বিচার করা অসম্ভব। গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে বলা হচ্ছে যে, অর্থের বিনিময়ে অনেক আওয়ামী সমর্থককে অপরাধের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। এর পর আছে রাজনৈতিক পরিবেশের ভয়ে সব বিখ্যাত আওয়ামী আইনজীবী এখনো পলাতক। ফলে তাদের সমমনা আওয়ামী অভিযুক্তদের পক্ষাবলম্বন করছেন মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। তারা এই অর্থের কারণেই যেকোনো আওয়ামী অপরাধীদের ছাড়িয়ে নেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন। এমনিভাবে যাদের মৃত্যুর জন্য প্রধান নির্বাহীকে দায়ী করা যাবে না, তার অপরাধ, দায়িত্ব এবং সম্ভাব্য শাস্তিও সেই অনুপাতে হ্রাস পাবে। এর পর রায় পাওয়া গেলেও দেশের প্রচলিত সিআরপিসির ধারা অনুযায়ী এই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ কিংবা আসামি পক্ষ উচ্চতর আদালতে আপিল করবেন। 

 হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট এবং ডেথ রেফারেন্স ইত্যাদি স্তর পার হয়ে এই দেশে কোনো খুনের মামলা ৮ থেকে ১২ বছরের আগে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি সম্ভব নয়। কারণ উচ্চতর ওই দুটি আদালতে মামলার সংখ্যা এবং বিচারকের সংখ্যার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলার আসামিরা এ কারণেই গত ৯ বছর ধরে চূড়ান্ত রায়ের অপেক্ষায় আছেন। শাজনিন এবং আহাসন উল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলায় এই একই কারণে যথাক্রমে ১৮ এবং ১২ বছর সময় লেগেছিল। মেজর অবসরপ্রাপ্ত রাশেদ সিনহার খুনের মামলায় পুলিশের ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে মামলা একই আদালত একাদিক্রমে শুনানি নিয়ে রায় দেওয়ার পরও আড়াই বছর পার হয়েছে। এই ডেথ রেফারেন্স হতে সাধারণত ৭-৮ বছর সময় লাগে। লে. কর্নেল ফারুক ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে মামলা শুরু হয় ১৯৯৬ সালের জুলাই মাসে এবং রাষ্ট্র পুরোপুরি এর পেছনে ছিল, তার পরও সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে তাদের দণ্ড কার্যকর হয় ১৩ বছর ৬ মাস পর। কক্সবাজারে একজন, নারায়ণগঞ্জে সাতজন, ১৫ আগস্ট ১০ জন, শাজনিন একজন, আহসান উল্লাহ মাস্টার একজনের খুনের সঙ্গে আমরা তুলনা করছি ১ হাজার ৬০০ জনের।  কাজেই যত বিশেষ ব্যবস্থা এবং ডেডিকেটেড আদালতের ব্যবস্থাই করা হোক, স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কোনো রায় বাস্তবায়নযোগ্য পর্যায়ে আনতে কী পরিমাণ সময় লাগবে তা ওপরের বিশ্লেষণ থেকে বোধগম্য হবে বলে মনে করি। 

আর আপিল শুনানির জন্য হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের ডেডিকেটেড বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা করা এ দেশের বিচার কার্যক্রম বিধির সম্পূর্ণ পরিপন্থি। সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড দাবি করলেও জাতিসংঘের প্রধান তদন্তকারী বলেছেন, বিচারের মান আন্তর্জাতিক হলেও তারা মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করেন না। আন্তর্জাতিক মান রক্ষা করতে হবে। কারণ, আমাদের আদালতের প্রতি জাতিসংঘেরও আস্থা নেই, তারা চান বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করুক। অথচ তারাই আবার বলে দিচ্ছেন, তারা মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করবেন না অর্থাৎ রায়টি তারাই দিয়ে দিচ্ছেন। ১ হাজার ৬০০ মানুষকে খুন এবং ১ লাখ মানুষকে আহত করার পরও অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড হবে না। তাহলে আদালতে স্বাধীনতা কোথায় রইল? 

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রজাতন্ত্রের প্রাক্তন কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল 

বিপদের বন্ধু ৯৯৯!

প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:২০ পিএম
আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:৩৩ পিএম
বিপদের বন্ধু ৯৯৯!
ড. সারিয়া সুলতানা

ঢাকার তেজগাঁওয়ে বটমলী হোম বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বার্ষিক শিক্ষা সফর অনুষ্ঠিত হয় রাঙামাটি পার্বত্য জেলায়। বিদ্যালয়টির ম্যানেজিং কমিটির সদস্য হিসেবে আমিও এই সফরে সঙ্গী হয়েছিলাম। সফর ভালোভাবেই সম্পন্ন হলো। কিন্তু ফিরতে গিয়ে বেশ কিছু বিপত্তিতে পড়লাম আমরা। রাঙামাটি ভ্রমণ শেষ করে ফেরার পথে আমাদের বহনকারী বাসটি পাহাড়ি রাস্তায় নষ্ট হয়ে যায়। এ ঘটনা গত ১ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১১টায়। অনেক চেষ্টা করেও গাড়িটি মেরামত করতে ব্যর্থ হন চালক ও চালকের সহকারী। বাসটিতে ৪৫ জন নারী পর্যটক ও পাঁচজন পুরুষ পর্যটক ছিলেন। শহর থেকে বাসটি ৯ কিলোমিটার দূরে শিমুলতলী এলাকায় অবস্থান করছিল। রাত ধীরে ধীরে ভারী হচ্ছিল। সেই সঙ্গে মনের ভেতর দানা বাঁধছিল অজানা আতঙ্ক। স্থানীয় একজন দোকানি আমাদের জন্য তার দোকান খোলা রেখেছিলেন। তার স্ত্রী ও দুই বছরের বাচ্চা রাত দেড়টা পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে ছিল। 

সে সময় আমরা সবাই তার দোকানেই অবস্থান করেছিলাম। তাদের মহানুভবতা এখনো মুগ্ধ করে। দোকানের নাম আদুরী, রাঙামাটি বেতার কেন্দ্র ও পাসপোর্ট অফিসের মাঝখানে দোকানটির অবস্থান। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর থেকে দেশের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ খুব একটা ভালো চলছে না দেখেই এত আতঙ্ক ভর করছিল সবার মনে। এ ছাড়া পাহাড়ে নানা রকমের অস্থিতিশীলতার সংবাদ বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পারি বিভিন্ন সময়। যা আমাদের ভাবনা বা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এরই মধ্যে আমার বান্ধবী ঝিমি চাকমাকে কল দিয়ে কয়েকবার যোগাযোগ করলাম। সেও আমাদের অবস্থা বুঝতে পেরে বারবার সাহস দিল যে, তোমাদের কোনো সমস্যা হবে না। সে যোগাযোগ রাখল যাতে আমরা আতঙ্কে না থাকি। শহর থেকে অনেকটা দূরে চলে আসায় আমরাও রাঙামাটি শহরে ফিরে যাওয়ার ভরসা করতে পারিনি। 

আমাদের বহরটি খুবই সুশৃঙ্খল ছিল। কারণ বহরটির অধিকাংশই ছিলেন মিশনারি স্কুলের শিক্ষক। সবার মধ্যে একতাবদ্ধভাবে চলার সংস্কৃতি লক্ষণীয় ছিল। কোনো বিপদেই তারা ধৈর্যহারা হননি। প্রধান শিক্ষক সিস্টার মেরী সুপ্রীতি এসএমআরএ বাসটির সামনের দিকে বসেছিলেন। প্রত্যক্ষ করলাম তিনি ঢাকা থেকে রাঙামাটি যাওয়ার পথে সারা রাত চালককে সাবধান করছিলেন। চালক প্রায়ই ঘুমিয়ে পড়ছিলেন। ঘুমচোখে চালকদের গাড়ি না চালানোই ভালো। এতে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। এভাবে আমাদের দেশে প্রায়ই দুর্ঘটনায় অনেক প্রাণ ঝরে যায়। 

চালকদের পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা না থাকলে যেকোনো মুহূর্তে বিপদ হতে পারে। কারণ, বেশির ভাগ পর্যটকবাহী বাস সকালে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে। রাতে ঢাকা বা অন্যান্য স্থান থেকে  ছেড়ে আসে। রাতের অন্ধকারে পাহাড়ি উঁচু-নিচু রাস্তা পারাপারের সময় অনেক সময় দুর্ঘটনায় পতিত হয়। তাই চালকদের উচিত এ বিষয়ে সতর্ক থাকা এবং পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালনার ব্যাপারে প্রশিক্ষিত হওয়া। পাহাড়ি এলাকা এমনিতেই জনমানবশূন্য। এর পর রাত হলে চারদিকে থাকে সুনসান নীরবতা। গাড়িগুলোর চাকা মনে হয় কিছু একটায় আটকে যাচ্ছে। আসলে পাহাড় থেকে সমতলে আসতে হলে রাস্তাগুলোর বাঁকে বাঁকে থাকে অজস্র বাধা-বিপত্তি। উঁচু-নিচু পাহাড় কেটেই রাস্তাগুলো তৈরি করা হয়। তাই সমতলের সড়ক থেকে পাহাড়ি রাস্তার চিত্র ব্যাপক বিচিত্র। 

এবার আসা যাক ৯৯৯ জরুরি সেবা কীভাবে আমাদের বিপদের বন্ধু হলো। যখন অন্ধকার বা রাত গভীর হলো, তখন মনে হলো ৯৯৯ জরুরি সেবার কথা। সঙ্গে আবার এও মনে হলো, রাত গভীর হচ্ছে, এত রাতে কি জরুরি সেবায় কল দিলে ধরবে বা তারা কি কেউ আমাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসবে! এত ভাবনার পরও কল দেওয়া হলো ৯৯৯-এ। শিক্ষক পল্লব ডমিনিক দরেছ কল দিলেন, আমিও কথা বললাম। উনারা আমাদের সমস্যার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। ঘটনাস্থল জানতে চাইলেন তারা। তার আগেই আমরা জেনে নিলাম আশপাশে কী কী আছে, চোখে যতটুকু আন্দাজ করা যায়। উনারা সরাসরি রাঙামাটি পার্বত্য জেলার কোতোয়ালি থানার সঙ্গে কল কানেকশন করে দিলেন। আমাদের সঙ্গে কথা হলো, পরিচয় দিলাম, সমস্যার কথা বললাম।

 আমি উনাদের সহযোগিতা চাইলাম। কথা শেষ হলো, ভাবলাম হয়তো উনারা আসবেন না। এ ছাড়া এ দেশের পুলিশ বিভাগের প্রতি এক ধরনের অস্বস্তি রয়েছে জনমনে। যা আমাদের কাছে ভুল প্রমাণিত হলো ১ ফেব্রুয়ারি। রাঙামাটি পার্বত্য জেলার কোতোয়ালি থানা পুলিশ আমাদের ভুল ভাঙিয়ে দিল। ১০ মিনিটের মধ্যে থানা থেকে এসআই মো. তারেক সুমনের নেতৃত্বে আরও তিনজন পুলিশ সদস্য আমাদের মাঝে হাজির হলেন। আমরা সবাই সেদিন অবাক হয়েছি। এত দ্রুত তারা মানুষের সমস্যায় সহযোগিতার হাত বাড়ালেন। তাদের প্রয়োজনীয়তা সমাজ এবং রাষ্ট্রে কেন এত জরুরি আমরা তৎক্ষণাৎ তা উপলব্ধি করলাম। আমাদের বাস চট্টগ্রাম থেকে না আসা পর্যন্ত তারা চারজন সার্বক্ষণিক আমাদের সঙ্গী হলেন। রাত দেড়টা পর্যন্ত উনারা আমাদের বাসের সব যাত্রীর নিরাপত্তায় তৎপর ছিলেন। রাত জেগে নিঃস্বার্থভাবে তারা আমাদের সেবা দিয়ে গেলেন। কোনো রকম বিনিময় ছাড়াই তারা মানুষের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।

 নাগরিক হিসেবেও তাদের জন্য আমাদের সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। যাতে তাদের কাজ মসৃণ হয়। এমনও শুনলাম, অনেক সময় তাদের মিথ্যা তথ্য বা ভুল ঠিকানা দিয়ে ডেকে নেওয়া হয়। এর পর তাদের লোকেশন খুঁজতে খুঁজতে নাজেহাল হতে হয়। অথবা অপ্রয়োজনে অনেক সময় কল দিয়ে বিরক্ত করা হয়। কারণ, ৯৯৯-এ কল দিতে মোবাইলে কোনো পয়সা না থাকলেও চলে। এতে সেবাদানকারী সংস্থাকে মাঝে মাঝে বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। জরুরি পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে পৌঁছে সংকটাপন্ন বা বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোসহ বিভিন্ন জরুরি সেবা  দেওয়া ৯৯৯-এর অন্যতম কাজ। এ সেবা সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত লোকবল, প্রযুক্তি ও সক্ষমতার বিষয়গুলো জরুরি সেবার জন্য অত্যাবশ্যকীয়। দেশে পুলিশ সদস্যের সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে পর্যটন এলাকাগুলোয় টুরিস্ট পুলিশের সংখ্যা বাড়ানোর জোর দাবি জানাচ্ছি।  

সেবা দানকারী ৯৯৯ সংস্থাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি রাঙামাটি পার্বত্য জেলা কোতোয়ালি থানা পুলিশের প্রতি। এসআই মো. তারেক সুমন (নিঃ), কনস্টেবল মো. লিটন মণ্ডল, কনস্টেবল লিটন চন্দ্রনাথ, কনস্টেবল অং মাং থোয়াই মারমা, তাদের কর্মকাণ্ড অবশ্যই প্রশংসনীয়। প্রত্যাশা থাকবে দেশের আদর্শ দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে সততার সঙ্গে তাদের সেবা গ্রহণের। দেশের যেকোনো নাগরিক যেকোনো দুর্ঘটনার শিকার হলে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কল দিয়ে তাদের সেবা পেতে পারেন। বাংলাদেশ পুলিশের অধীনে একটি চৌকস দল এই কল সেন্টার পরিচালনা করে থাকে। যদি কোনো নাগরিক এই নম্বরে কল করে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুলেন্স সেবা কিংবা এ-সংক্রান্ত তথ্য পেতে চান তাহলে ৯৯৯-এ কল দিলে তাদের সেবা পেতে পারেন। সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এটি ২৪ ঘণ্টা অর্থাৎ দিন-রাত চালু থাকে। এই সেবা মানুষের সমস্যা সমাধানে অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছে। বিপদের বন্ধু ৯৯৯! তাই আসুন আমরা এই সেবার ইতিবাচক ব্যবহার বাড়াতে সার্বক্ষণিক সচেষ্ট হই।

লেখক: সহকারী সম্পাদক, খবরের কাগজ এবং 
স্থানীয় সরকার গবেষক

ক্যানসার নিরাময়ে চাই সচেতনতা: ভয় নয়, জয় করুন

প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:২৫ এএম
ক্যানসার নিরাময়ে চাই সচেতনতা: ভয় নয়, জয় করুন
ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ

অনেক ক্যানসারই সময়মতো চিকিৎসায় নিরাময়যোগ্য। ক্যানসারের প্রকারভেদ, কতটুকু ছড়িয়ে গেছে, কী কী সমস্যা করছে, রোগীর বয়স কত আর শারীরিক অবস্থা কেমন- এসবের ওপর ভিত্তি করে ক্যানসারের নানা রকমের চিকিৎসা  দেওয়া হয়। এ জন্য চিকিৎসার আগেই বায়োপসি, টিস্যু পরীক্ষা, নানা রকমের স্ক্যান, রক্ত পরীক্ষা ইত্যাদি করা হয়। আবার অনেক ক্যানসার চিকিৎসায় ভালো হয় না অথবা ছড়িয়ে গেলে চিকিৎসা করার আর উপায় থাকে না। সবচেয়ে বড় কথা ক্যানসারের আধুনিক চিকিৎসা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যয়বহুল এবং দরিদ্র রোগীদের নাগালের বাইরে। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও অনেক বেশি। তাই চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ করাই উত্তম।…

দিন দিন অসংক্রামক ব্যাধির সংখ্যা বেড়েই চলছে, ক্যানসার তার মধ্যে অন্যতম। উন্নত বিশ্বে মৃত্যুর কারণগুলোর মধ্যে ক্যানসার দ্বিতীয়, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তৃতীয়। ক্যানসার শব্দটি শুনলে যে কেউ আঁতকে ওঠেন। অনেকের দৃষ্টিতে ক্যানসার মানেই মৃত্যু। একসময় মনে করা হতো ক্যানসারের কোনো অ্যানসার (উত্তর) নেই। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞান আর প্রযুক্তির উন্নতি ও অগ্রগতির ফলে এ ধারণাগুলো আর মোটেই সত্য নয়, ক্যানসারের চিকিৎসাও আর অজেয় নয়। শুরুতেই দ্রুত শনাক্ত করতে পারলে এ রোগের চিকিৎসা, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ সম্ভব। শুধু দরকার সময়মতো সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা গ্রহণ।

ক্যানসার নিয়ে সচেতনতা তৈরিতে প্রতিবছর ৪ ফেব্রুয়ারি পালিত হচ্ছে বিশ্ব ক্যানসার দিবস। দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো ‘জনগণকে সচেতন করে তোলা, বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা করা, দ্রুত শনাক্তকরণের ব্যবস্থা এবং সময়মতো চিকিৎসা’। ২০০০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি প্যারিসে বিশ্ব ক্যানসার সম্মেলনে দিনটিকে ‘বিশ্ব ক্যানসার দিবস’ বা ‘বিশ্ব ক্যানসার সচেতনতা দিবস’ বা ‘বিশ্ব ক্যানসার প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রতিবছর এই দিবসে একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়। যেমন ‘আমরাই পারি রুখতে’, ‘কুসংস্কার পরিহার করুন’, ‘আমরা পারি, আমিও পারি’। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য- ‘ক্লোজ দ্য কেয়ার গ্যাপ’, বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় ‘আসুন, ক্যানসার সেবায় বৈষম্য দূর করি’।

ক্যানসার বলতে সাধারণভাবে জীবকোষের অনিয়ন্ত্রিত ও অস্বাভাবিক বৃদ্ধিকেই বোঝায়। এ কোষগুলো স্বাভাবিক নয়, বরং পরিবর্তিত বিধায় দেহের সাধারণ নিয়মে এদের সংখ্যা বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। ফলে খুব দ্রুত এসব কোষের পরিমাণ বাড়তে পারে, কখনো কখনো এগুলো টিউমার বা চাকার মতো তৈরি করে এবং একপর্যায়ে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এ অস্বাভাবিক কোষগুলো সুস্থ-স্বাভাবিক কোষগুলোকে ধ্বংস করে ও শরীরের স্বাভাবিক কার্যকলাপে বাধার সৃষ্টি করে। এগুলো ধীরে ধীরে দেহের প্রয়োজনীয় অঙ্গগুলোকে অকেজো করে দেয় এবং রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

ক্যানসারের কারণ: সাধারণত বয়স্কদের মধ্যেই ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বেশি। তবে ক্যানসার যেকোনো বয়সেই হতে পারে। আবার  কিছু ক্যানসার অল্প বয়সেই হয়। আধুনিক যুগে বিজ্ঞানের চরম উন্নতির মধ্যেও ক্যানসারের পুরোপুরি কারণ এখনো জানা নেই। কিছু পারিপার্শ্বিক, পেশা, এমনকি জীবনযাত্রার পদ্ধতি বা কু-অভ্যাস ক্যানসারের কারণ হতে পারে, যেমন:
 প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ধূমপান, তামাকজাতীয় দ্রব্য যেমন সাদা পাতা, জর্দা, গুল সেবন। 
 দীর্ঘদিন মদ্যপানের অভ্যাস, শিরায় ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক গ্রহণ এবং অন্য সব ধরনের নেশা। 
 খাদ্যাভ্যাস, যেমন- খাদ্যে ফাইবারের অভাব, ভিটামিন বা অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের অভাব, প্রিজারভেটিভ, কেমিক্যাল বা রংযুক্ত খাবার এবং আর্সেনিকযুক্ত পানি পান।
 পরিবেশ দূষণ এবং কেমিক্যালের সংস্পর্শে আসা।
 বিভিন্ন ধরনের বিকিরণ, যেমন সূর্যরশ্মি, অতি বেগুনি রশ্মি, এক্স-রে, কসমিক-রে ইত্যাদি।
 কর্মস্থল বা পেশাগত কারণে অনেকের ক্যানসার হতে পারে, যেমন রেডিয়েশন বা কেমিক্যাল নিয়ে কাজ করা, অনেকক্ষণ রোদে থেকে কাজ করা, জাহাজভাঙার শ্রমিক, রং ও রাবার কারখানার কর্মী ইত্যাদি।
 বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা অন্যান্য জীবাণুর দ্বারা ইনফেকশনের ফলে ক্যানসার হতে পারে, যেমন হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস, এপস্টিন বার ভাইরাস, হ্যালিকোব্যাক্টর পাইলোরি, হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাস, এইডস ভাইরাস ইত্যাদি। সিস্টেসোমা-জাতীয় জীবাণু মধ্যপ্রাচ্য বা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে মূত্রাশয় ক্যানসারের কারণ হিসেবে বিবেচিত।  
 অতিরিক্ত শারীরিক ওজন বা স্থূলতা।
 কিছু ওষুধ বা চিকিৎসা ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
 অনিয়ন্ত্রিত যৌন সম্পর্ক, একাধিক যৌনসঙ্গী, পেশাদার যৌনকর্মীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক ইত্যাদি।
 ক্রোমোজম বা জিনের কারণেও ক্যানসার হতে পারে।

 নারীদের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি ব্রেস্ট বা স্তন ক্যানসার। নির্দিষ্টভাবে কোনো কারণ জানা না থাকলেও কিছু ফ্যাক্টর স্তন ক্যানসারের ঝুঁকিকে বাড়িয়ে দেয়, যেমন- স্তন ক্যানসারের পারিবারিক ইতিহাস, হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি, কম বয়সে মাসিক চক্র আরম্ভ বা তাড়াতাড়ি ঋতুস্রাব এবং দেরিতে মেনোপজ, জীবনে বাচ্চা না নেওয়া বা কখনো গর্ভবতী হয়নি বা অধিক বয়সে শিশু জন্ম দেওয়া যেমন ৩০ বছর বয়সের পর যাদের প্রথম সন্তান হয়েছে বা যারা বুকের দুধ পান করাননি তাদের স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি কিছুটা বেশি। বিকিরণের প্রভাব যেমন নারীরা বুকের এলাকায় অন্য ক্যানসারের কারণে, বিশেষ করে মাথা, ঘাড় বা বুকে রেডিওথেরাপি নিয়েছেন, বিশেষ করে অল্প বয়সে, তাদের পরবর্তী জীবনে স্তন ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।

ক্যানসারের লক্ষণ: ক্যানসারের লক্ষণ নির্ভর করে কোথায় কী ধরনের ক্যানসার হয়েছে তার ওপর। অনেক ক্ষেত্রে কোনো লক্ষণই থাকে না। দেখা গেছে যে ক্যানসার ছড়িয়ে যাওয়ার পরেই তা ধরা পড়ে। তার পরও কিছু লক্ষণ বা উপসর্গ থাকলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। যেমন:
 সুস্থ ছিলেন, হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়া ওজন কমে যাওয়া, অরুচি বা ক্ষুধামান্দ্য।
 অতিরিক্ত দুর্বলতা, ক্লান্তি, রক্তস্বল্পতা, দাঁতের গোড়ায় বা নাক দিয়ে রক্তক্ষরণ, চামড়ার নিচে জমাট রক্ত ইত্যাদি।
 শরীরে কোথাও চাকা বা গোটা দেখা দিলে; বিশেষ করে গলায়, বগলে, কুঁচকিতে, পেটে বা নারীদের স্তনে।
 দীর্ঘদিন জ্বর থাকলে, বিশেষ করে যদি রাতের বেলা প্রচুর ঘাম দেয়।
 অনেক দিনের কাশি যা সাধারণ চিকিৎসায় ভালো হচ্ছে না, বিশেষ করে বয়স্কদের বেলায় এবং কাশির সঙ্গে রক্ত এলে, গলার স্বর ভেঙে গেলে বা কাশির সঙ্গে গলার স্বরের পরিবর্তন হলে।
 বয়স্কদের প্রস্রাব করতে সমস্যা হলে, ব্যথা হলে বা প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত গেলে।
 পায়খানার অভ্যাস পরিবর্তন হলে বা পায়খানার সঙ্গে রক্ত গেলে।
 খাবার গিলতে অসুবিধা বা ব্যথা, বদহজম, দীর্ঘদিনের পেটে ব্যথা বা রক্তবমি, পেট ফোলা,  চাকা অনুভব করা, জন্ডিস বাড়তে থাকা। 
 নারীদের ক্ষেত্রে মাসিকের পরিবর্তন হওয়া, যাদের মাসিক বন্ধ হয়ে গেছে তাদের আবার রক্তক্ষরণ হওয়া।
 মাথাব্যথা, মাথাঘোরা, খিঁচুনি, জ্ঞান হারানো, হঠাৎ বমি করা।
 চামড়ায় নতুন করে রঙের পরিবর্তন, তিলের আকার বা গড়ন পরিবর্তন হওয়া, কোনো ক্ষত বা ঘা অনেক দিন নিরাময় বা সেরে যায় না।
 মুখে বা জিহ্বায় কোনো ক্ষত দীর্ঘদিন স্থায়ী হলে।
তবে মনে রাখতে হবে যে এসব লক্ষণ অন্য বিভিন্ন রোগের কারণেও হতে পারে। তাই এগুলো হলেই ক্যানসার হয়েছে ভেবে কেউ যেন অযথা আতঙ্কগ্রস্ত না হয়ে পড়েন। 

ক্যানসারের চিকিৎসা: অনেক ক্যানসারই সময়মতো চিকিৎসায় নিরাময়যোগ্য। ক্যানসারের প্রকারভেদ, কতটুকু ছড়িয়ে গেছে, কী কী সমস্যা করছে, রোগীর বয়স কত আর শারীরিক অবস্থা কেমন- এসবের ওপর ভিত্তি করে ক্যানসারের নানা রকমের চিকিৎসা দেওয়া হয়। এ জন্য চিকিৎসার আগেই বায়োপসি, টিস্যু পরীক্ষা, নানা রকমের স্ক্যান, রক্ত পরীক্ষা ইত্যাদি করা হয়। আবার অনেক ক্যানসার চিকিৎসায় ভালো হয় না অথবা ছড়িয়ে গেলে চিকিৎসা করার আর উপায় থাকে না। সবচেয়ে বড় কথা, ক্যানসারের আধুনিক চিকিৎসা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যয়বহুল এবং দরিদ্র রোগীদের নাগালের বাইরে। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও অনেক বেশি। তাই চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ করাই উত্তম।

ক্যানসার প্রতিরোধ কীভাবে করতে হবে: এক হিসাবে দেখা গেছে, বিশ্বের ১২ শতাংশ মৃত্যুর জন্য ক্যানসারই দায়ী। তাই ক্যানসার হওয়ার আগেই একে প্রতিরোধ করা প্রয়োজন। একটু সচেতন হলেই ক্যানসারকে প্রতিরোধ করা সম্ভব। ক্যানসার নামক এই বিভীষিকার হাত থেকে বেঁচে থাকতে হলে আমাদের দরকার যথাযথ শিক্ষা ও সচেতনতা। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ক্যানসারের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কারণ জীবনযাপনের সঙ্গে জড়িত। সুতরাং এগুলোকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এক-তৃতীয়াংশ ক্যানসারের ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব। 

এ ক্ষেত্রে যে নিয়মগুলো মেনে চলা উচিত:
 ধূমপান সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করা। মনে রাখতে হবে, ধূমপানে বিষপান, অন্যান্য তামাকজাতীয় দ্রব্য যেমন- সাদা পাতা, জর্দা, গুল ইত্যাদি ব্যবহার বন্ধ করা।
 মদ্যপান, শিরায় ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক গ্রহণ এবং অন্য সব ধরনের নেশা পরিহার করা।
 খাদ্যাভ্যাস সুন্দরভাবে অনুসরণ করা, যেমন সুষম খাবার গ্রহণ, পর্যাপ্ত পরিমাণে আঁশ ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্টযুক্ত খাবার খাওয়া, তাজা মৌসুমি ফলমূল ও শাকসবজি খাওয়া, চর্বিজাতীয় ও তৈলাক্ত খাবার কম খাওয়া, প্রিজারভেটিভ বা কেমিক্যালযুক্ত খাবার বর্জন, ফাস্টফুড ও কোমল পানীয় বর্জন, রঙিন খাদ্য ও পানীয় বর্জন ইত্যাদি। আর্সেনিকমুক্ত পানি পান নিশ্চিত করা।

 নিয়মিত হাঁটাচলা, ব্যায়াম এবং সঙ্গে খাদ্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শরীরের ওজন ঠিক রাখা।
 যারা কসমেটিকস ব্যবহার করেন, তারা যেন ভেজাল ও নিম্নমানের কসমেটিকস পরিহার করেন।
 দীর্ঘ সময় সরাসরি সূর্যের নিচে না থাকা উচিত, প্রয়োজনে ছাতা বা হ্যাট ব্যবহার করা ভালো।
 যৌনাভ্যাসের ক্ষেত্রে সামাজিক নৈতিকতা মেনে চলা, বহু যৌনসঙ্গী বা পেশাদার যৌনকর্মীর সঙ্গে যৌনকর্ম এবং অস্বাভাবিক যৌনাচার পরিহার করা।
 রক্তদান বা গ্রহণ অথবা যেকোনো ইনজেকশন গ্রহণের সময় এবং এন্ডোস্কপি, কলোনোস্কপি ইত্যাদি পরীক্ষার সময় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা।
 বেশ কিছু জীবাণুর বিরুদ্ধে টিকা নিয়ে ক্যানসার প্রতিরোধ সম্ভব, যেমন হেপাটাইটিস বি ভাইরাস, হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের টিকা ইত্যাদি।
 যেসব জীবাণু এবং রোগব্যাধি ক্যানসার তৈরি করতে পারে, তা ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী দ্রুত নির্মূল করা।
 কর্মক্ষেত্রে ক্যানসার তৈরিকারী রেডিয়েশন বা কেমিক্যালের সংস্পর্শ পরিহার করা। এ ক্ষেত্রে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করা।
 পরিবেশ দূষণ, বিশেষ করে বায়ু ও পানিদূষণ বন্ধ করা।
 শরীরের কোথাও চাকা বা গোটা, ক্ষত, তিলের রং পরিবর্তন, দীর্ঘদিনের জ্বর, দ্রুত ওজন কমে যাওয়া, খাদ্যে অরুচি, পায়খানার কোনো পরিবর্তন, যেমন পায়খানার সঙ্গে রক্ত যাওয়া, কোষ্ঠ্যকাঠিন্য, হঠাৎ পাতলা পায়খানা, প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যাওয়া, কাশির সঙ্গে রক্ত যাওয়া ইত্যাদি দেখা দিলে অবহেলা না করা।
 প্রত্যেক সুস্থ ব্যক্তিরই উচিত নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো, যাতে শরীরে কোনো ক্যানসার দানা বাঁধতে শুরু করলে তা প্রাথমিক অবস্থাতেই দমন করা সম্ভব হয়। বিশেষ করে বয়স্কদের বৃহদান্ত্র বা কোলন, নারীদের জরায়ুমুখ ও স্তন, পুরুষদের প্রোস্টেট ইত্যাদি নিয়মিত পরীক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে স্বীকৃত। এসব স্থানে ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা থাকে বিধায় এগুলোকে নিয়মিত স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে প্রতিরোধ সম্ভব।

আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে এখন আর ক্যানসার মানেই অবধারিত মৃত্যু নয়। একটু সচেতন হলেই ক্যানসারকে প্রতিরোধ করা সম্ভব। যদি ক্যানসার হয়েও যায়, তবু শুরুতেই দ্রুত শনাক্ত করতে পারলে তার ভালো চিকিৎসা করা যায়, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভও সম্ভব। ক্যানসার নামক এই বিভীষিকার হাত থেকে বেঁচে থাকতে হলে আমাদের দরকার যথাযথ শিক্ষা ও সচেতনতা। তাই এই প্রাণঘাতী রোগটিকে ভয় নয়, জয় করাই হোক সবার লক্ষ্য।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক

কলকাতা বইমেলার হালহকিকত

প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:২০ এএম
কলকাতা বইমেলার হালহকিকত
গৌতম রায়

প্রকাশকরাও যেমন পকেটের টাকা খসিয়ে সাহিত্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে উৎসাহবোধ করেন না, ঠিক তেমনই সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকরাও সাহিত্য সংস্কৃতির দুনিয়ার মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেননি। তারাও বিশ্বায়নের একটি আঙ্গিক তৈরি করেছেন। বইপাড়া যাতে সাহিত্য পত্রিকা দিয়ে খুব একটা আগ্রহী হয়ে ওঠে, তার জন্য সেই সব পত্রিকার কেষ্টবিষ্টরাও তেমন একটা উদ্যোগ এখন 
আর নেন না।…


কলকাতা বইমেলার সেই স্বাদটা হারিয়ে যেতে শুরু করল মেলা যেদিন থেকে ময়দানে হওয়া বন্ধ হয়ে গেল আদালতের নির্দেশে। বইমেলা তো কেবল আর দশটা মেলার মতো কেনাকাটার মহোৎসব নয়। বইমেলা মানে একটা মিলনোৎসব। মানুষে মানুষে মিলন। মানুষ বইতে মিলন। বই মানুষে মিলন। প্রকাশক-লেখক-পাঠকের মিলন। এই গোটা ব্যবস্থার জন্য দরকার সুগম পরিবহন। যেটা ময়দানে মেট্রোরেল এবং হাওড়া-শিয়ালদহ, উভয় স্টেশনের সঙ্গেই স্বচ্ছন্দ বাসের যোগাযোগ। আর দ্বিতীয় দরকার, অপর্যাপ্ত জায়গা। যেখানে কবি আর পাঠক, লেখক আর অনুরাগীর আড্ডা চলবে। একটু আবডালে পুরোনো প্রেম ঝালিয়ে নেওয়া যাবে। হারানো প্রেমের রোমন্থন হবে। আবার নতুন প্রেম জমাট বাঁধবে। সেই সঙ্গেই চলতে থাকবে চা, ভাজা-ভুজি। ময়দানে মেলাকালে বাঙালি ভাজাভুজিই বলত। আজকের মতো ‘পাকোড়া’ লব্জতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। শীত বিদায়ের কালে বইদের গন্ধ আর কমলালেবুর গন্ধ কোথায় মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত সেদিন।

তখন রাজনীতির মানুষজন আসতেন। আড্ডা জামাতেন। অডিটোরিয়ামে বিতর্কে অংশ নিতেন। বই কিনতেন। কিন্তু বইমেলার উদ্বোধন করতেন না। সেটা করতেন সাহিত্য-সংস্কৃতির দুনিয়ার দিকপালরা। সেবার মেলার উদ্বোধন করলেন শামসুর রাহমান। উদ্বোধনের দিনের নানা আনুষ্ঠানিকতার বাইরে কবি তো আমাদের বড় আপনার মানুষ, আত্মার আত্মীয়। 

সেদিনের সেই বইমেলা কলকাতার বুক থেকে হারিয়ে গেছে স্থানচ্যুত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। পরিবেশ রক্ষার যে কথা বলে আদালতের আদেশবলে সেদিন বইমেলাকে স্থানচ্যুত করা হয়েছিল, সেটা যে ছিল একেবারে দলীয় রাজনীতির ক্ষমতার আস্ফালনেরই একটা অংশ আর মেলার কর্মকর্তারা সেদিনও যেমন ছিলেন শাসকপ্রিয়, ক্ষমতা বদলের পরও তারা শাসকের কাছের মানুষই থেকে গেছেন।

কলকাতার বইপাড়া কলেজ স্ট্রিটে অনেকটা বাঙালির শারোৎসব, ঈদের মতোই বইমেলা ঘিরে পেশাদার ব্যস্ততা শুরু হয় দীপাবলি শেষ হলেই। তবে এখন কলকাতার বইয়ের বাজারের রকম-সকম গত কয়েক বছরে যেভাবে বদলে গেছে, তার রেশ বেশ জোরদারভাবেই বইমেলাতে পড়ে। কলকাতার বইপাড়া কলেজ স্ট্রিটে এখন বইয়ের বিষয়ের ক্ষেত্রেও একটা অদলবদল এসেছে। থ্রিলার ছাপিয়ে ভূত-প্রেত-দৈত্য-দানো-তন্ত্র- এসবের দারুণ রমরমা বাজার। বাউল এখন কলকাতা বইপাড়ার বেশ শাঁসালো একটা বিষয়। নতুন গজিয়ে ওঠা প্রকাশক, যাদের কোনো কৌলিন্য নেই, আছে জিনে পাওয়া হিসাববিহীন টাকা আর প্রভূত শাসক সংযোগ- তাদর প্রত্যেকেই প্রায় এখন একদিকে পুরোনো বেশ কিছু বই ছাপছে, যেগুলোর লেখকদের বহুকল প্রয়াণ ঘটেছে বা তাদের তেমন জোরদার দাবিদার উত্তরাধিকারী নেই, অর্থাৎ যাদের বইয়ের জন্য কোনো রয়্যালটি দিতে হবে না। পুরোটাই প্রকাশকের লাভ। এমন কিছু বই। 

শ্যামাপূরসাদ মুখোপাধ্যায়ের মারাত্মক সাম্প্রদায়িক প্ররোচনামূলক বই এখন দেদার ছাপা হচ্ছে কলকাতার বই বাজারে। আর বইমেলাতেও সেসব বিকোচ্ছে ভালোমতোই। ছাপা হচ্ছে এমন সব হিন্দু সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্বদের নানা প্ররোচনামূলক বক্তৃতার বই, যেসব লেখকের আজকের বাঙালি এতকাল মনে রাখার প্রয়োজনই মনে করেনি। বিশ শতকে দাঙ্গার ইতিহাসের আনুপঙ্খিক চর্চাকারী অধ্যাপক সুরঞ্জন দাশের মতো ব্যক্তিত্বরাই একাদেমির চর্চায় তুলে এনেছেন ওই সব লোকের ভয়ংকর ভূমিকা। সুরঞ্জনবাবুর সেই আলোচনার অনবদ্য বাংলা অনুবাদ ও এবারের বইমেলাতে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু তার প্রকাশকের হাতে কাঁচা টাকা নেই। ফলে প্রচারমাধ্যম ঝাঁপিয়ে পড়ছে না সুরঞ্জনবাবুর বই ঘিরে। তার প্রকাশকের রাজনৈতিক সংযোগ নেই। শাসক ঘনিষ্ঠতা নেই। নেই কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা ।নেই খবরের কাগজে জোরদার আলোচনা করানোর জন্য শক্তিশালী লবি। ফলে এই বইয়ের আলোচনা বহুল প্রচলিত কাগজে বইমেলা চলাকালীন এক শ শব্দের বেরোলেও শ্যামাপ্রসাদ বা রমেশচন্দ্র মজুমদারের রাজনৈতিক হিন্দুত্বের পৃষ্ঠপোষকতা করা আর পবিত্র ইসলাম সম্পর্কে বিদ্বেষ ছড়ানো ছোট বইয়ের ও আধা পাতা জোড়া আলোচনা বড় বড় খবরের কাগজে হচ্ছে দেদার।

এখন সাহিত্য পত্রিকায় খুব একটা পয়সা খরচ করে বিজ্ঞাপন প্রকাশকরা দেন না। সমাজ মাধ্যম, অর্থাৎ ফেসবুক এসে যাওয়ার পরে বিনা পয়সায় বিজ্ঞাপন দেওয়ার সুযোগ যেভাবে তৈরি হয়েছে, সেটাই প্রকাশকরা বেশি ব্যবহার করেন। আর তারা সে জন্যই পয়সা খরচ করে, গাঁটের কড়ি খসিয়ে কিছুতেই সাহিত্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন না। ফলে প্রকাশকরাও যেমন পকেটের টাকা খসিয়ে সাহিত্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে উৎসাহবোধ করেন না, ঠিক তেমনই সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকরাও সাহিত্য সংস্কৃতির দুনিয়ার মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেননি। তারাও বিশ্বায়নের একটি আঙ্গিক তৈরি করেছেন। বইপাড়া যাতে সাহিত্য পত্রিকা দিয়ে খুব একটা আগ্রহী হয়ে ওঠে, তার জন্য সেসব পত্রিকার কেষ্টবিষ্টরাও তেমন একটা উদ্যোগ এখন আর নেন না।

এসব কিছুই বইমেলার দুনিয়াকে প্রভাবিত করে। ফলে এখন কোনো একটি সদর বা মফস্বলের রাস্তা ধরে যদি সমীক্ষা করতে পারা যায়, তাহলে দেখতে পাওয়া যাবে, বইমেলার ঠিক আগে আগে ক্ষেত্র সমীক্ষা চালানো কুড়িটা বাড়ির মধ্যে ষোলটা বাড়ির এক বা একাধিক ব্যক্তির বই মেলাতে বের হয়। ভূত-প্রেত, দৈত্য-দানো, তবু জিন নয়! সেটা যে মুসলমানী! পরি ইত্যাদি ঘিরে কোনো না কোনো বই প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু যদি গোটা বছর ধরে সেই সব প্রকাশিত বই ঘিরে লেখক, প্রকাশককে প্রশ্ন করতে পারা যায়; তাদের বই কারা কিনছেন, তাদের গিয়ে প্রশ্ন করা হয় বিক্রির কী অবস্থা, তারা ভুলে যাবেন, তারা কখনো বই লিখেছিলেন বা বই কিনেছিলেন, পড়া তো দূর অস্ত স্থান!

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গল্পকার
[email protected]

আ.লীগের লুটপাটের চিত্র দেখছি

প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:৪৭ পিএম
আ.লীগের লুটপাটের চিত্র দেখছি
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম

প্রথমত, যারা আমলা, তারাই রাজনীতিবিদ। আবার যারা ব্যবসায়ী, তারাও রাজনীতিবিদ। এটা হলো একটা কম্বাইন্ড সিন্ডিকেট। প্রথমে আমি বলতে চাই, আওয়ামী লীগ পিরিয়ডটা আমরা মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখছি। প্রচণ্ড ক্ষোভ ও বিস্ময়ের সঙ্গে দেখছি যে কী ধরনের লুটপাট হয়েছে। এখন যদি কেউ মনে করে যে আগে কিংবা পরে কোনো লুটপাট নজরের বাইরে থাকবে, তারা মারাত্মক ভুল করবে।

দ্বিতীয়ত, যারা আওয়ামী লীগের নেতা, তারাই তো ব্যবসায়ী। যারা ব্যবসায়ী তারাই আওয়ামী লীগ নেতা। বাজার অর্থনীতির কারণে বাজার রাজনীতি প্রতিষ্ঠা হয়েছে। সবকিছুই কেনাবেচা হচ্ছে। দলীয় পদও এখন কেনাবেচা হয়। ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ, লুটপাটকারীদের নিয়ন্ত্রণ, আবার তারাই রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্রের সঙ্গে যোগসাজশ করে এই কাজ করে এবং প্রশাসনের যেসব বড় বড় কর্মকর্তা তারাই লুটপাট করা টাকা দিয়ে রাজনীতির পদ কিনে নেন, এমপি সিট কিনে নেন। পরে তারাই দেশের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। যে ব্যবস্থা আছে সেটাতে কিছুটা হাত দেওয়া হলেও তা পরিপূর্ণ করা হয় নাই। কেননা, যে ব্যবস্থাগুলোগুলো উত্থাপিত হওয়া প্রয়োজন, সেগুলো উত্থাপন করার জন্য যে গণসংগ্রাম অব্যাহত রাখা প্রয়োজন সেটা করা হচ্ছে না। 

সিপিবির সাবেক সভাপতি