
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের সদস্যপদ মাত্র দুই বছর হয়েছে। এখন বিশ্ব মঞ্চে দেশটির কূটনৈতিক অবস্থান তুলে ধরতে এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার বিষয়ে আলোচনা ও পদক্ষেপে অবদান রাখার সুযোগ পাবে। কিন্তু এর পররাষ্ট্রনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সহজ করার সম্ভাবনা নেই।...
২০২৫ সালে পাকিস্তান পররাষ্ট্রনীতিতে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা, মার্কিন-চীন প্রতিযোগিতা, ইউক্রেন এবং মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ নিয়ে প্রধান শক্তিগুলোর বলয় তৈরি এবং অস্থিতিশীল বৈশ্বিক পরিবেশে তাদের মোকাবিলা করতে হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ায় নতুন করে সংকটে পড়তে পারে দেশটি।
পাকিস্তানের আঞ্চলিক পরিস্থিতিও অস্থির এবং নিরাপত্তাহীনতার দীর্ঘ ছায়া পড়েছে। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিনের শত্রুতা বিরাজ করছে। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই শোচনীয়। তারা বাইরের আর্থিক সংস্থাগুলোর ওপর অনেকটা নির্ভরশীল থাকে এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশির ভাগই অনিশ্চিত। সে ক্ষেত্রে অনেক কিছুই তাদের মোকাবিলা করতে হবে। যেহেতু পররাষ্ট্রনীতি নিজের দেশ থেকেই শুরু হয়, সে ক্ষেত্রে এই বাস্তবতাগুলো পাকিস্তানের কূটনীতির আচরণের ওপর ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলবে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রগুলোতে সব চ্যালেঞ্জকে দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে এবং তাদের দ্বন্দ্বে আসা যাবে না। আফগানিস্তানের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান অস্থির সম্পর্ক মোকাবিলা করতে হবে। ভারতের সঙ্গে যে প্রতিকূল সম্পর্ক রয়েছে তা সঠিকভাবে পরিচালনা করা উচিত। সৌদি আরব এবং ইরানের মধ্যে সম্পর্কে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক রাখতে হবে। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন প্রত্যাহারের পর ওয়াশিংটনের সঙ্গে পাকিস্তানের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব কমে যাওয়ায় আমেরিকার সঙ্গে কীভাবে সম্পর্ক গড়ে উঠবে তা এখনো অজানা।
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সময় সম্পর্কটা টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যায়। গত চার বছরে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একবারও পাকিস্তান সফর করেননি। জো বাইডেন পাকিস্তানি নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার জন্য তেমন কোনো আগ্রহ দেখাননি। ট্রাম্পের আগের মেয়াদে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়েছিল, যখন তিনি কোয়ালিশন সাপোর্ট ফান্ডের সহায়তা পাকিস্তানকে বন্ধ করার ঘোষণা করেছিলেন। তার অর্ধেকের বেশি মেয়াদে ইসলামাবাদে কোনো মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন না। ট্রাম্প আফগানিস্তান থেকে মার্কিন প্রস্থানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর তালেবানের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে চাইলে সম্পর্ক আরও খারাপ হয়। দোহায় পাকিস্তানের সঙ্গে চুক্তি করতে গেলে সম্পর্ক আরও তিক্ত হয়। এটি অবশেষে আমেরিকার প্রত্যাহারের পথকে প্রশস্ত করে। এর বাইরেও ট্রাম্প এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের মধ্যে যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল তা ছিল মূলত দ্বিপক্ষীয়।
এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তান তাদের সম্পর্ক গড়ে তুলতে ওয়াশিংটনের সঙ্গে পুনরায় যুক্ত হতে চায়। যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের বৃহত্তম রপ্তানি দেশ এবং এফডিআইয়ের জন্য বড় উৎস। আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতা পাকিস্তানের সংকটপ্রবণ অর্থনীতির উত্তরণের জন্য বিশেষ প্রয়োজন।
আমেরিকা কৌশলগত দিক দিয়ে চীনকে আটকানোর ব্যাপারে অগ্রাধিকার দেয়। যেহেতু পাকিস্তান চীনবিরোধী জোটের অংশ হতে পারে না, তাই পাকিস্তান-মার্কিন সম্পর্কের জায়গাটা সীমিত হয়ে যায়। আরেকটি কারণ হলো ভারতের সঙ্গে ওয়াশিংটনের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখা। এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দের অংশীদার ভারতকে চীনের প্রতি পাল্টা প্রভাব বিস্তারে কৌশল হিসেবে সম্পর্ক বজায় রাখে। এই দুটি কৌশলগত বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে পাক-মার্কিন সম্পর্কের জন্য স্থান খুঁজে বের করাই কঠিন চ্যালেঞ্জ। এটা সহজ হবে না। কারণ ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের স্থান পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
চীন অবশ্য পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতিতে অগ্রাধিকারে রয়েছে। এই সময়ের বাস্তবতায় সম্পর্কটি দেশের নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ উভয়ই পূরণ করে থাকে। কিন্তু শক্তিশালী, ইতিবাচক গতিপথ ধরে রাখার জন্য সমস্যাগুলোর সমাধান প্রয়োজন। পাকিস্তানে কর্মরত চীনা কর্মীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগকে কমিয়ে আনতে হবে। গত বছর চীনা শ্রমিকদের হত্যা মামলায় পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী চীন প্রকাশ্যে ইসলামাবাদকে তার হাজার হাজার শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য অনুরোধ করেছে।
কাশ্মীর সমস্যা মীমাংসা করা ভারতের দাবি। এই ইস্যুতে পাকিস্তানের সঙ্গে কথা বলতে অস্বীকৃতির জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মোদি সরকার সংলাপ পুনরায় শুরু করতে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। স্পষ্টতই এই সিদ্ধান্তের কারণে ভারত নয়, পাকিস্তানকে আঘাত করা হয়েছে। গত এক বছরে পাকিস্তানি নেতাদের শান্তির উদ্যোগের প্রতি ভারতীয় প্রতিক্রিয়া থেকে সেটাই স্পষ্ট বোঝা যায়। এ সময়ে কোনো আন্দোলন না থাকায় তাৎক্ষণিক কাজ হলো ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের উত্তেজনা সামলানো।
সম্প্রতি নিষিদ্ধঘোষিত তেহরিক-ই-তালেবান আস্তানা লক্ষ্য করে পাকিস্তান আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে বিমান হামলা চালানোর পর আফগানিস্তানের সম্পর্ক আরও খারাপ হয়েছে। আন্তসীমান্ত হামলা চালিয়ে যাওয়া টিটিপির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কাবুলের অস্বীকৃতির কারণে ইসলামাবাদ হামলা করতে বাধ্য হয়; যা ২০২৪ সালে আরও তীব্রতর হয়েছিল।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের সদস্যপদ মাত্র দুই বছর হয়েছে। এখন বিশ্ব মঞ্চে দেশটির কূটনৈতিক অবস্থান তুলে ধরতে এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার বিষয়ে আলোচনা ও পদক্ষেপে অবদান রাখার সুযোগ পাবে। কিন্তু এর পররাষ্ট্রনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সহজ করার সম্ভাবনা নেই।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও
জাতিসংঘে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত।
ডন থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদুল ইসলাম সকাল