
দেশ স্বাধীন হলো। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য মুহুর্মুহু ঘোষিত হতে থাকল। এর মধ্যে ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার প্রবল ঘোষণাও এল। আনিসুর রহমান কখনো স্বঘোষিত সমাজতন্ত্রী না হলেও নবসৃষ্ট দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে কাজ করতে অনাগ্রহী নন।...
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে দর-কষাকষিতে অন্য অর্থনীতিবিদরা যখন কেবলই সাফল্যে পুলকিত হচ্ছেন, তখন আনিসুর রহমান দেখছেন এটা জাতিকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার কৌশল, তারপর হঠাৎ আসবে অসহনীয় আঘাত। ১ এপ্রিল ১৯৭১, ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রায় সীমান্ত পার হলেন। দিল্লির পথে আনিসুর রহমান হলেন আবদুর রশীদ, রেহমান সোবহান হলেন দীন মোহাম্মদ। নাম বদলে দুজনকে আবার হতে হলো যথাক্রমে অশোক রায় এবং মোহন লাল। অধ্যাপক নুরুল ইসলাম হলেন অশোক রায়। দিল্লিতে সুহৃদ অশোক মিত্র এবং অমর্ত্য সেন। তাদের সহযোগিতায় আরও এগিয়ে এলেন ডিপি ধর ও পিএন হাকসার।
দেশ স্বাধীন হলো। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য মুহুর্মুহু ঘোষিত হতে থাকল। এর মধ্যে ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার প্রবল ঘোষণাও এল। আনিসুর রহমান কখনো স্বঘোষিত সমাজতন্ত্রী না হলেও নবসৃষ্ট দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে কাজ করতে অনাগ্রহী নন। কিন্তু তার চোখে পড়েছে: একদিকে দেশে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমের প্রতিশ্রুতি আর অন্যদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশে চরম গণদারিদ্র্য ও অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে এলিটদের বিলাসিতা বেড়েই চলেছে...। দেশকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের পথে ধাবিত করার প্রশ্নে তিনি বৈজ্ঞানিক শব্দের পর বন্ধনীতে প্রশ্নবোধক চিহ্ন বসিয়ে লিখেছেন, ‘...কিন্তু আসলে তো দেশ মৌলিকভাবে বৈষম্য বৃদ্ধি ও দুর্নীতির পথেই এগোচ্ছিল, পরিকল্পনা কমিশনের সাধ্য ছিল না এই প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করার’। অনাগ্রহী হলেও ‘অর্থনীতিবিদ অধ্যাপকদের পরিকল্পনা কমিশনে’ প্রথম ছয় মাস পূর্ণকালীন এবং অতঃপর খণ্ডকালীন সদস্যের দায়িত্ব পালন করে প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের পরিণতি আগাম আঁচ করে সবার আগে তিনিই পদত্যাগ করে বেরিয়ে এসেছেন।
বাবার কথা: ময়মনসিংহ জেলার কেন্দুয়ার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে কখনো হেঁটে পুরো ৩২ মাইল পাড়ি দিয়ে মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান ময়মনসিংহ শহরে পৌঁছতেন, এ-বাড়ি ও-বাড়ি জায়গির থেকে জিলা স্কুলে পড়তেন। তার ছেলে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মো. আনিসুর রহমান বাবাকে নিয়ে লিখেছেন:‘প্রত্যেক ক্লাসেই ফার্স্ট হয়ে উঠতে থাকেন হাফিজ। ক্লাস টেনের প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশন মিটিংয়ে ময়মনসিংহের অ্যাডিশনাল ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট খান বাহাদুর আমিনুল ইসলাম প্রিসাইড করতে এসে দেখেন একটি ছেলে ক্লাসে ফার্স্ট হওয়ার জন্য প্রাইজ পেয়েছে এবং প্রায় প্রত্যেক সাবজেক্টের জন্য প্রাইজ পেয়ে বইয়ের বোঝা নিয়ে খালি পায়ে সভাস্থল থেকে বেরোচ্ছে। ছেলেটিকে ডেকে তিনি সব বই নিয়ে তার বাসায় যেতে বললেন।’
তিনিও বাসায় ফিরলেন, ছেলেটিও হাজির হলে বললেন, ‘তুমি যদি ম্যাট্রিক পাস করার পর কলকাতায় গিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে চাও তাহলে আমি কলকাতা যাচ্ছি, সেখানে আমার বাসায় থেকে পড়তে পার।’ হাফিজ ম্যাট্রিক পরীক্ষায় তিনটা লেটার পেয়ে পাস করে কলকাতায় গিয়ে সেখানে আমিনুল ইসলামের বাসায় ওঠেন, তিনি তখন কলকাতায় ইন্সপেক্টর জেনারেল অব রেজিস্ট্রেশন। সেখানে থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজে আইএ পড়েন।
প্রেসিডেন্সির পর চলে এলেন সদ্য প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯২১ সালে প্রথম ব্যাচে অর্থনীতিতে অনার্সে ভর্তি হলেন। সাময়িক নিবাস মাহুতটুলিতে কাজী ইমদাদুল হকের বাড়ি। পড়াশোনার বাকি খরচ পাওয়ার ভরসায় থার্ড ইয়ারে দারোগাকন্যার সঙ্গে বাগদান। বিএ অনার্স ও এমএ দুটোতে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে কিছুকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে ১৯২৬ সালে বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন এবং বউ ঘরে তোলেন। ১৯৩৩-এ যখন তিনি ব্রাক্ষণবাড়িয়ার এসডিও, তখন দ্বিতীয় সন্তান আনিসুর রহমানের জন্ম। হাফিজুর রহমান প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের আমলে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও হয়েছিলেন, তার আগে প্রাদেশিক সরকারের।
নির্মল সেন, দীন মোহাম্মদ ও আবদুর রশীদ ছদ্ম পরিচয়ের অন্তরালে তিনজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ-অধ্যাপক যথাক্রমে নুরুল ইসলাম, রেহমান সোবহান ও আনিসুর রহমান একাত্তরের মার্চে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পৌঁছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করতে থাকেন। আবদুর রশীদ কখনো অশোক রায়ও হয়েছেন। তাদের কাজের শুরুটা আরও আগে, পঞ্চাশের দশকেই পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বঞ্চনা স্পষ্ট হওয়ার পর থেকেই। বিভিন্ন ব্রিটিশ ও মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন দায়িত্ব নিয়ে তারা একসময় ভারতও ছাড়েন।
দিল্লিতে অশোক মিত্রের বাড়িতে অবস্থানকালে সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনার সময় তিনি বলেন: ‘...বাংলাদেশ মুক্ত হওয়ার পর আমরা দেশে ফিরলে দেশের অর্থনৈতিক প্রশ্নে সরকারকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য আমাদের ডাক পড়বে, কিন্তু আমাদের উচিত হবে সরাসরি সরকারে যোগ না দিয়ে বাইরে থেকে পরামর্শ দেওয়া। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তসমূহ রাজনৈতিক বিবেচনা অনুযায়ীই নেওয়া হবে, আমাদের কথামতো নেওয়া হবে না, কাজেই এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমরা পার্টি হয়ে গেলে আমাদের পজিশন কম্প্রোমাইজড হয়ে যাবে। এই কথায় আমার সব কলিগ সায় দিয়েছিলেন।’ বন্ধনী দিয়ে আনিসুর রহমান এর পরপরই যোগ করেন- ‘যদিও আসল ঘটনা অন্য রকম হয়ে যায়’।
দেশে ফিরে জানতে পারেন ১৮ জানুয়ারি ১৯৭২, তার নিয়োগের গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে, গণমাধ্যমেও প্রচারিত হয়েছে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন, নিভৃতেই থাকতে চেয়েছেন।
‘পথে যা পেয়েছি’ প্রথম পর্ব থেকে উদ্ধৃত:
প্রথমে ফোন করলেন পরিকল্পনা কমিশনের ‘মেম্বার ওয়ান’ (অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন)। ‘কী আনিস, তুমি জয়েন করছ না? তোমাকে ভীষণ দরকার, অনেক কাজ।’
আমি বললাম, ‘আমার সঙ্গে তো দিল্লিতে কথা হয়েছিল আমরা জয়েন করব না। আপনারা জয়েন করে ভুল করেছেন। আমি করতে চাই না। তা ছাড়া, সবাই ইউনিভার্সিটি ছেড়ে দিলে ছাত্রদের পড়াবে কে?’
১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ কৃচ্ছ্রসাধনের আদেশ জারি করার লক্ষ্যে ডেপুটি চেয়ারম্যানকে যে নোট দেন তা আমলা-মন্ত্রী সবাইকে তার প্রতি শত্রুভাবাপন্ন করে তোলার জন্য যথেষ্ট। ১৯৭২ সালেই তার মনে হয়েছে ঢাকায় গাড়ির প্রসেশান চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। আমাদের মতো একটা দরিদ্র দেশে এ রকম বিলাসী গাড়ির প্রদর্শন আমাদের দরিদ্র জনগণের জন্য নিদারুণ অপমানকর, সমতানীতির বিরুদ্ধে এবং দেশ গড়ার কাজে দরিদ্র জনগণের উৎসাহের ওপর একটি নেতিবাচক প্রভাব। এসব গাড়ির স্টেয়ার পার্টস আমদানি নিষিদ্ধ করতে চেয়েছেন, যাতে গাড়িগুলোর দ্রুত মৃত্যু ঘটে, অথবা বিদেশে বেঁচে দিতে বলেছেন। গাড়ির ব্যবহার প্রয়োজনভিত্তিক হওয়া প্রয়োজন, স্ট্যাটাসভিত্তিক নয়। একা গাড়িতে যেতে একজন অফিসারের একটি দুই-সিট গাড়িই শুধু প্রয়োজন, একটি সিট তার নিজের জন্য এবং একটি ড্রাইভারের জন্য। গাড়ির বাকি বসার জায়গার অপচয় হয় আর এসব গাড়ি কেনা ও চালু রাখার জন্য পাবলিক ফান্ডের ওপর চার্জ হয়।
তিনি প্রস্তাব করেন, সরকারের মালিকানায় যেসব বড় গাড়ি আছে তাদের বেশির ভাগ জেনারেল পাবলিকের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হোক অথবা সম্ভব হলে বিদেশে রপ্তানি করে দেওয়া হোক এবং সরকারি অফিসারদের একা দুজন বা তিনজন পর্যন্ত সরকারি কাজে যাতায়াতের জন্য ফিয়াট ৬০০ বা বেবি অস্টিনের চাইতে অনধিক সাইজের গাড়ির ব্যবস্থা করা হোক। ‘...আবার বলছি, মন্ত্রীরা এই কৃচ্ছ্রসাধনব্যবস্থা থেকে কোনো ব্যতিক্রম না দাবি করে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন, এ আশা করা যেতে পারে।’
এ আশা তিনি অবশ্যই করতে পারেন, কিন্তু তার নিজের ডেপুটি চেয়ারম্যান ও সদস্যদ্বয়কে রাজি করাতে পেরেছেন কি না, সে সন্দেহ তো রয়েই গেছে। মার্কিনি কিংবা ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতন্ত্রের পাঠ নেওয়া তাত্ত্বিক বিদ্বানদের তাতে ‘হ্যাঁ’ করার কথা নয়। আনিসুর রহমান লিখলেন, ‘কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে যায়, এ দেশ মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশ্রুতি সমতাবাদী/সমাজতন্ত্রী পথে এত সহজে এগোবে না। পরিকল্পনা কমিশনের ভেতরেই এবং সঠিকভাবে প্রশাসনে হায়ারার্কিকাল চেতনা তীব্র। অফিসে আমাদের জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘর এবং মেঝেতে শৌখিন কার্পেটের ব্যবস্থা করা হয়, সে সময় এটাও আবার অহেতুক বিলাসিতা মনে হয়েছিল। আমি এ রকম ঘর নিইনি, কার্পেটবিহীন ফ্যানওয়ালা ঘরেই অফিস করে গেছি।’
তিনি লিখেছেন, শুরু থেকেই প্ল্যানিং কমিশনের সঙ্গে সিভিল সার্ভিসের আমলাদের একটা টেনশনের সম্পর্ক তৈরি হয়। ইউনিভার্সিটির মাস্টাররা মন্ত্রী আর প্রতিমন্ত্রীর র্যাংক নিয়ে র্যাংকের জোরে সচিবদের ডেকে পাঠানোর অধিকার অর্জন করেছেন। তখনকার একটি বাস্তবতা: সিএসপিদের উল্লেখযোগ্য অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন এবং কেউ কেউ পরিকল্পনা কমিশনের প্রফেসরদেরও আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। সামন্ত সংস্কৃতি ও আমলা আচরণের নিবিড় নৈকট্য আনিসুর রহমান তুলে ধরেছেন এবং মর্যাদার হায়ারার্কিতে তার সহকর্মীরাও একই সামন্ত সংস্কৃতির ধারক হিসেবে তা ধরে রেখেছেন, সে ইঙ্গিতও দিয়েছেন।
‘‘‘যুদ্ধবিধ্বস্ত’ দেশে দেশজুড়ে মানুষের এত কষ্টের মধ্যে এলিট শ্রেণির ভোগবিলাসের চাকচিক্য দেখে আমি ৮ মার্চ (১৯৭১) প্রধামন্ত্রীকে ‘প্রথম পদক্ষেপ’ বলে একটি প্রস্তাব লিখে পাঠাই। প্রথাগতভাবে ডেপুটি চেয়ারম্যানের হাত হয়ে পাঠাতে গেলে হয়তো আটকে যেত, সে আশঙ্কা থেকে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে পাঠিয়ে ‘প্রথম পদক্ষেপ’-এর অনুলিপি তাকে দেন। অন্য সব মন্ত্রীকেও দেন। এই কর্মটি ডেপুটি চেয়ারম্যানের ‘অসোয়াস্তি’র কারণ ঘটিয়ে থাকতে পারে।’’
তার কৃচ্ছ্রসাধনের প্রস্তাব কেউই গায়ে মাখেননি, আলোচনারও প্রয়োজন মনে করেননি। ব্যক্তিক্রম ত্রাণমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান। টেলিফোনে তাকে ডাকেন। ‘আমি গেলে তার টেবিলের ওপর রাখা আমার প্রস্তাবটা দেখিয়ে বলেন, তিনি এটা ভীষণ পছন্দ করেছেন এবং প্রায় প্রত্যেকদিনই আলমারি থেকে বের করে এটা একবার করে দ্যাখেন।’
বাহাত্তরের এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঢাকা টেলিভিশনের আগে কেনা কিছু যন্ত্রপাতি স্থাপনের জন্য সোয়া লাখ টাকার বরাদ্দের জন্য আবেদন জানানো হলে আনিসুর রহমান সংগত কারণে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্বাসন অগ্রাধিকারের কথা বললেন এবং গণমুখী টেলিভিশনের সুপারিশমালা নিতে একটি কমিটি করে দিলেন, যা ২২ এপ্রিল গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। বিষয়টা কীভাবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপিত হয়েছে বলা মুশকিল, কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় সদস্যরা যখন ডেপুটি চেয়ারম্যানের অফিস কক্ষে আড্ডার মেজাজে, প্রধানমন্ত্রীর ভারী কণ্ঠ শোনা যায়, তিনি ডেপুটি চেয়ারম্যানকে ফোন করেছেন: ‘ডাক্তার সাহেব আপনারা পরিকল্পনা কমিশনে খুব বাড়াবাড়ি করেছেন। টেলিভিশনের ওপর কমিটি করতে আপনাদের কে অধিকার দিয়েছে? আমি এর রিটেন এক্সপ্ল্যানেশন চাই।’ ডেপুটি চেয়ারম্যান ঘাবড়ে গেলেন।
‘আনিস, প্রধানমন্ত্রী আমাদের কমিটি করার ওপর রিটেন এক্সপ্ল্যানেশন চাচ্ছেন, কী বলব?’
আমি বললাম, ‘এতে তো কোনো সমস্যা নেই- আজ তো শনিবার, কাল ছুটি। আপনি বলেন যে, সোমবার সকালে আমরা তার কাছে গিয়ে রিটেন এক্সপ্ল্যানেশন দিয়ে আসব।’
এর মধ্যে পরিকল্পনা কমিশনের করা কমিটি বাতিল হলো। প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে লেখা পত্রটি একই সঙ্গে এক্সপ্ল্যানেশন এবং আনিসুর রহমানের পদত্যাগপত্র। দীর্ঘ পত্রের শুরুটা ও শেষটা কেবল উদ্ধৃত করছি:
‘‘‘টেলিভিশন ব্যবস্থার র্যাশনালাইজ করার জন্য কমিটি’ নাম দিয়ে যে কমিটির গঠন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে এবং যে ঘটনা নিয়ে মনে হয় বেশ উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে সেটার জন্ম দেওয়ার জন্য আমিই দায়ী।’’ সুতরাং তিনি পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করা ছাড়া আর কোন পথ দেখছেন না।
অতএব, ‘অন্য কোন আদেশ না পেলে আমি ৩০ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে ডেপুটি চেয়ারম্যানের কাছে আমার দায়িত্ব বুঝিয়ে দেব। আমি বরাবরের মতো আমার যোগ্যতা অনুযায়ী সরকারকে যে কোন বিষয়ে আমার মতামত দিতে প্রস্তত থাকব।’
অর্থমন্ত্রী পদত্যাগপত্র পড়ে শোনালেন আর প্রধানমন্ত্রী আনিসুর রহমানকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘ডাক্তার সাহেব আমি সব বুঝতে পেরেছি, আপনি সমস্ত ব্যাপারটা আমার হাতে ছেড়ে দেন, আমি সব ঠিক করে দেব। আর পদত্যাগপত্র- ছি ছি আমাকে এভাবে লজ্জা দেবেন না।... আমি বুঝতে পেরেছি আপনাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খারাপ করার একটা বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে। কারা এটা করছে তাও আমি বুঝে গেছি। আপনি ব্যাপারটা আমার হাতে ছেড়ে দেন, আমি এটা ডিল করব।’
প্রধানমন্ত্রীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে কি আর পদত্যাগ করা যায়?
প্রধানমন্ত্রী চিকিৎসার জন্য লন্ডনে। এ সময় পদত্যাগ করলে প্রধানমন্ত্রী আর তাকে জড়িয়ে ধরে আটকাতে পারবেন না। ২ আগস্ট ১৯৭২ প্রধানমন্ত্রীর চিকিৎসাকালীন অনুপস্থিতির সময় ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। কমিশনের সঙ্গে সম্পর্কচ্যুত হননি তখনো। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দাখিলের পর ২ অক্টোবর ১৯৭৩ তিনি কমিশন থেকে বেরিয়ে এলেন, তার ভাষায় ‘প্রধানমন্ত্রী আমাকে (পরিকল্পনা কমিশন থেকে) ছেড়ে দিলেন’।
এই বর্ণনা থেকে অনুমেয়, পরিকল্পনা কমিশন হয়েছিল বটে, কমিশনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়নি। কাজেই এটা তো না টেকারই কথা।
লেখক: নন-ফিকশন ও কলাম লেখক