
করোনা-পরবর্তী সময়ে দেশে কর্মসংস্থান নিয়ে যথেষ্ট সংকট তৈরি হয়েছে। এরপর সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকটে ব্যবসা-বাণিজ্যে নাজুক পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়েছে। গত জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশে একধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে, যার অভিঘাত এসে পড়েছে অর্থনীতিতেও।...
বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা নিঃসন্দেহে মেধাবী। তারা দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষায় ভালো ফল করছেন। পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এসব মেধাবী শিক্ষার্থী পেশাগত জীবনে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। বিবিএসের ২০২৪ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিবছর ২০ থেকে ২২ লাখ মানুষ চাকরির বাজারে প্রবেশ করে। তাদের মধ্যে ১৩ থেকে ১৪ লাখ মানুষের বাংলাদেশে কর্মসংস্থান হয়। আর বাকিদের বিষয়ে সুস্পষ্ট কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। কেউ বিদেশে যান। কেউ উদ্যোক্তা হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন। অবশিষ্টরা বেকারত্বের সঙ্গে লড়াই করে চলেন।
আমাদের দেশের মেধাবী তরুণরা যেভাবে তাদের স্বপ্ন বাঁধেন, অনেক ক্ষেত্রেই তা পূরণ সম্ভব হয় না। এর মূল কারণ দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা। শিক্ষার্থীরা তাদের মেধা থাকা সত্ত্বেও সঠিক এবং ন্যায্য জায়গায় পৌঁছাতে না পারার অন্যতম কারণ হলো যথাযথ কর্মসংস্থানের অভাব। আমরা জানি, করোনা-পরবর্তী সময়ে দেশে কর্মসংস্থান নিয়ে যথেষ্ট সংকট তৈরি হয়েছে। এরপর সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকটে ব্যবসা-বাণিজ্যে নাজুক পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়েছে। গত জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশে একধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে, যার অভিঘাত এসে পড়েছে অর্থনীতিতেও। বিজিএমইএর হিসাব অনুযায়ী, ১০০টি তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়েছে। মাঝেমধ্যেই শ্রমিক অসন্তোষ চলছে। এ পরিস্থিতি দেশের তরুণদের জন্য কোনোভাবেই সন্তোষজনক নয়।
দেশে বিরূপ পরিস্থিতির কারণে শিক্ষার্থীরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে উঠছে। শিক্ষার্থীদের ক্রমবর্ধমান হতাশা জাতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যখন একজন মেধাবী শিক্ষার্থী তার মেধার যথাযথ মর্যাদা পান না, তখন তিনি এ জাতির জন্য কতটুকুই বা কল্যাণকর হতে পারেন? সাধারণত দেখা যায় যে, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির যথাযথ সমন্বয় না ঘটলে সেখানে সৃষ্টি হয় চরম হতাশা। ফলে সমাজে সৃষ্টি হয় নানাবিধ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।
তরুণদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সঙ্গে আমাদের সামাজিক পরিবেশ-পরিস্থিতির নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। মোটা দাগে বলা যায়, শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সমন্বয় যদি যথাযথভাবে ঘটে তাহলে সমাজে বিশৃঙ্খলা অনেকাংশে কমে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থী তার স্বপ্নগুলো লালন করতে করতে পড়ালেখা যখন শেষ করে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করে, তখনই শুরু হয় তার জীবনের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। অনেক ছোট ছোট যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে সম্মুখীন হয় একটি বড় যুদ্ধের। আর এ যুদ্ধে যথাযথভাবে বিজয়ী হলেই কেবল তার প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির যথাযথ সমন্বয় ঘটতে পারে। এমনকি এমন সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে দেশে একটি স্থিতিশীল সামাজিক শৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে।
প্রশ্ন হলো, শতকরা কতভাগ শিক্ষার্থী তাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সমন্বয় ঘটাতে সক্ষম হন? এ ধরনের সমন্বয় ঘটাতে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীই ব্যর্থ, নাকি আমাদের বিদ্যমান রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থাই দায়ী? আমরা লক্ষ করি, একজন শিক্ষার্থী সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠে অধ্যায়ন শেষে চাকরির বাজারে এসে আশানুরূপভাবে যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পেতে হিমশিম খান। এমনকি অনেকেই মুখ থুবড়েও পড়েন। অনেকেই দিশেহারা হয়ে ওঠেন। এমনও পরিস্থিতি তৈরি হয় যে, তিনি কোথায় কী করবেন তার কূলকিনারা খুঁজে পান না। এমন সময় তাদের সামনে থাকে শুধু হতাশা, লজ্জা আর গ্লানি।
সমাজের যেকোনো স্তরের মানুষই চান তার সন্তানের সফলতা। আর এই সফলতা যখন ধরা দেয় না, তখন অনেকেই চেষ্টা করেন যেকোনো উপায়ে তা ধরার। দেশের মানুষের মধ্যে একটি ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে, ঘুষ না দিলে ভালো সরকারি চাকরি পাওয়া যায় না। শুধু তাই নয়, দেশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, সমাজের প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি ও তাদের নিকটস্থ ব্যক্তি; যারা কিনা চাকরি বিক্রির বাজারে পরিণত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে এসব উচ্চপদস্থের আত্মীয়স্বজন অথবা পরিবারের কোনো অসৎ ব্যক্তির মাধ্যমে এ ধরনের সিন্ডিকেট বা চক্রের কথা শোনা যায়। দেশের লাখ লাখ মেধাবী ছাত্র কর্মসংস্থান সংকটের কারণে যখন নিজের যোগ্যতায় সরকারি চাকরি নামের সোনার হরিণ পেতে ব্যর্থ হন, তখনই তারা চেষ্টা করেন কীভাবে ঘুষ দিয়ে কিংবা যেকোনো উপায়ে সেটি পাওয়ার।
আমার জানা মতে, অনেক অভিভাবক তার সন্তানকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিজের ভিটেমাটি বিক্রির মাধ্যমে অর্থ জোগাড় করে চাকরির প্রত্যাশায় সংশ্লিষ্ট চক্রের হাতে অর্থ তুলে দিয়ে ধরাশায়ী হয়ে পথে বসেছেন কিংবা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
এই সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্রের অধিকর্তাদের কাছে আমার প্রশ্ন- তিলে তিলে লালন করা স্বপ্ন শিক্ষার্থীরা যখন যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে পারেন না, তখন এই সমাজে সৃষ্টি হয় নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা। তা ছাড়া সত্যিই যদি মেধাবী সন্তানরা অর্থের বিনিময়ে চাকরি নামের সোনার হরিণটি কিনতে পান, তার ফলাফলই বা কেমন হতে পারে। তা কি আমরা একবারও ভেবে দেখেছি? তার কাছে আমরা নিশ্চয়ই ঘুষ, দুর্নীতি আর অনিয়ম ছাড়া কিছু আশা করতে পারি না। একজন মেধাবীর কোনো নিশ্চয়তা আমাদের এই সমাজব্যবস্থা দিতে পারছে না। ফলে তৈরি হচ্ছে ভয়াবহ পরিণতি।
আমাদের আরও কিছু বিষয়ে ভাবতে হবে। কারণ আমাদের যে প্রত্যাশা, সে অনুযায়ী শিক্ষাকাঠামো যথাযথভাবে সাজানো হচ্ছে কি না। নাকি গুণগত মান বিবেচনা না করে পরিমাণ বৃদ্ধির প্রবণতায় ঝুঁকে পড়েছি। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়, দেশে উচ্চশিক্ষিতের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। উচ্চশিক্ষার মান বাড়ছে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। প্রচলিত উচ্চশিক্ষা অনেক ক্ষেত্রেই কর্মবাজারের চাহিদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ বিশেষায়িত দক্ষতার ঘাটতি। আর এই দক্ষতা ঘাটতির কারণে উচ্চশিক্ষার পরও ভালো কাজ পাচ্ছেন না স্নাতকরা। সারা বিশ্বে কর্মমুখী শিক্ষাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ বিষয়ে আমরা এখনো পিছিয়ে।
দেশে উচ্চশিক্ষা পরিস্থিতি এখন এতটাই বেহাল যে, এটিকে নাজুক না বলে রীতিমতো ভয়ংকর ও উদ্বেগজনক বলেই অভিহিত করা যেতে পারে। এ কথা বললে ভুল হবে না যে, দেশে প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার ও উচ্চশিক্ষার প্রসার- এ দুটিই যেন অনেকটা সমান্তরাল গতিতে চলছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা দেশের উচ্চশিক্ষা সনদধারীর সংখ্যা বাড়ালেও তাদের কর্মোপযোগী করে গড়ে তোলা হচ্ছে না। ফলে কর্মে প্রবেশের সুযোগ না পেয়ে তারা দেশের বেকারত্ব পরিস্থিতির ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়