
সংস্কারে অনেক কমিশন হয়েছে। অথচ শিক্ষাক্ষেত্রে কোনো কমিশন হয়নি। শিক্ষাবিদ হিসেবে বলতে পারি, দেশে শিক্ষা কমিশন গঠন করা দরকার। কারণ শিক্ষাক্ষেত্রে ধস নেমেছে এবং নৈরাজ্য বিরাজ করছে। শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক বিষয়ে সংস্কার করা দরকার। ’৭৩-এর অধ্যাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের দাবি ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি যারা ছিলেন তারা প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করার জন্য ভিসির নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে দেননি। তার পরও বলতে হয়, এখন ’৭৩-এর অধ্যাদেশ সময়ের দাবি।…
আসন্ন নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের দীর্ঘসূত্রতা ও বিএনপির তড়িঘড়ি করার মধ্যে আপাতত টানাপোড়েন মনে হলেও আসলে তা নয়। বিএনপি বলেছে যে, দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে হলে যতটুকু সংস্কার দরকার, ততটুকু সংস্কার করে যেন দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, যতটুকু জরুরি সংস্কার করা প্রয়োজন, ততটুকু করে আমরা নির্বাচনের ব্যবস্থা করব। আমার মনে হয় না, আগামী নির্বাচন ততটা দেরি হবে। হয়তো সরকারের মধ্যে কেউ কেউ চায় নির্বাচন দেরি করতে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন বিশ্বনন্দিত ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষ। তিনি আগামী নির্বাচন বিলম্ব করার চেষ্টা করবেন না বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আমার মনে হয়, এই বছরের শেষ নাগাদ এবং আগামী বছরের শুরুর দিকে জাতীয় নির্বাচন হতে পারে। তাহলে বিএনপির আপত্তি থাকার কথা না।
সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। এখনই সব সংস্কার করতে হবে তেমন নয়। সব সংস্কার করা সম্ভবও নয়। সংস্কার অতীতেও হয়েছে, বর্তমানে হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। এভাবে সংস্কার চলতে থাকবে। কারণ সমাজ তো পরিবর্তনশীল। সমাজের পরিবর্তন ও সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন সংস্কারের প্রয়োজন হবে। সংস্কারের নামে অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাচনের ব্যবস্থা বিলম্ব করা ঠিক হবে না।
সংস্কারে অনেক কমিশন হয়েছে। অথচ শিক্ষাক্ষেত্রে কোনো কমিশন হয়নি। শিক্ষাবিদ হিসেবে বলতে পারি, দেশে শিক্ষা কমিশন গঠন করা দরকার। কারণ শিক্ষাক্ষেত্রে ধস নেমেছে এবং নৈরাজ্য বিরাজ করছে। শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক বিষয়ে সংস্কার করা দরকার। এই মুহূর্তে সবকিছু সংস্কার করা সম্ভবও নয়। যদি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়, তাহলে তারা কিছু সুপারিশ করতে পারে। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে সেশনজট চলছে। শিক্ষা কমিশন হলে অন্তত শনিবারের ছুটি বাতিল করে ক্লাস নিয়ে সেগুলো মেকআপ করা যেতে পারে। ’৭৩-এর অধ্যাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের দাবি ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি যারা ছিলেন, তারা প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করার জন্য ভিসির নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে দেননি। তার পরও বলতে হয়, এখন ’৭৩-এর অধ্যাদেশ সময়ের দাবি।
শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক জায়গাতেই সংস্কারের প্রয়োজন আছে। ইংরেজি কোন ক্লাস থেকে পড়বে সে বিষয়ে একটা সিদ্ধান্তে আসা দরকার। শিক্ষার মাধ্যম বাংলা হলে বাংলা বইয়ের কারিকুলামেও অনেক পরিবর্তন আনতে হবে। বাংলা একাডেমিকে এ ব্যাপারে অনেক দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। এ ধরনের অনেক সুপারিশ আছে, সব সুপারিশ বাস্তবায়ন করাও সম্ভব নয়। কিছু কিছু সংস্কার করা জরুরি। এই মুহূর্তে ছাত্রছাত্রীদের ক্লাসে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে হবে। তার মানে এই নয় যে, ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন করবে না। অন্যায় যেখানে থাকবে সেখানে অবশ্যই তারা আন্দোলন করবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ খোলা ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও বিশ্ববিদ্যালয় খোলা ছিল। যুদ্ধের সময় ফেনী কলেজে বোমা ফেলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। তখন ফেনী কলেজের ছাত্রছাত্রীরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে এসে লেখাপড়া করল। যুদ্ধের সময়ও লেখাপড়া বন্ধ হয়নি। বর্তমান সময়ে এসে লেখাপড়ার অনেক ক্ষতি হয়েছে। লেখাপড়ার সুষ্ঠু পরিবেশ আবার তৈরি করতে হবে। সে ক্ষেত্রে শিক্ষায় নতুন কিছু সুপারিশ করা যেতে পারে।
আমি বুঝে উঠতে পারি না যে, অন্তর্বর্তী সরকার কী কারণে শিক্ষা কমিশন গঠন করল না। শিক্ষা কমিশন গঠন অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যদি নির্বাচন সংস্কার, স্বাস্থ্য খাতে সংস্কার এবং সংবিধান সংস্কার করতে পারেন। তাহলে শিক্ষাক্ষেত্রে কেন সংস্কার করা যাবে না? সংস্কার মধ্য মেয়াদে বা দীর্ঘ মেয়াদে হতে পারে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে যেগুলো সংস্কার করা খুবই প্রয়োজন, বিশেষ করে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনব্যবস্থার জন্য যতটুকু সংস্কার দরকার ততটুকু করলেই হবে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থাপনার জন্য নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে।
ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে হবে। ভোটার তালিকায় যদি সমস্যা থাকে তাহলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। ভোটারের বয়সের সীমা ১৮ বছরের জায়গায় ১৭ বছর করার কথা শোনা যাচ্ছে। নির্বাচন কমিশন এখন কী সিদ্ধান্ত নেবে সেটা তাদের ব্যাপার। তবে এটা অনেক বড় সিদ্ধান্তের ব্যাপার। তাই এই সিদ্ধান্ত নিতে হলে অনেকটা বুঝে-শুনেই নিতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে এবং এর ওপর কোনো রকম হস্তক্ষেপ চলবে না। তার পরও নির্বাচন কমিশন যদি কোনো অনিয়ম করে থাকে, তাহলে তাদের ওপরও ব্যবস্থা নিতে হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের কথা চিন্তা করছে, এতে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। গণতান্ত্রিক সমাজে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন হতেই পারে। তারা যদি মনে করে রাজনৈতিক দল গঠন করে তারা তাদের কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যাবে। আমি এতে কোনো দোষ দেখি না। এটা হতেই পারে। বরং আমি এদের স্বাগত জানাই।
ছাত্ররা সরাসরি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করবে, তবে সেটা পড়ালেখা শেষ করে করলে ভালো হয়। ছাত্রছাত্রীরা রাজনীতি করতে পারবে না, এমন কোনো কথা নেই। ছাত্রদের প্রধান কাজ কিন্তু জ্ঞান আহরণ ও জ্ঞানচর্চা করা। জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি তারা রাজনীতি করতে পারে।
সংবিধান সংস্কারের কথা শোনা যাচ্ছে। সংবিধান সংস্কার হতে পারে। তবে সংবিধান একদম বাতিল করাটা ঠিক হবে না। সংবিধান সংস্কার, পুনর্লিখন ও বাতিলের এখতিয়ার একমাত্র জাতীয় সংসদের। নবনির্বাচিত জাতীয় সংসদ হলে তারা সংবিধান সংস্কার, নতুন আইন প্রণয়ন ও বাতিলের সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। সংবিধান সংস্কারের যে কমিটি করা হয়েছে তারা বড়জোর সুপারিশের জন্য ডাকতে পারে।
সংবিধান সংস্কার এখন তারা কীভাবে করবে? সংবিধানের কোনো পরিবর্তন করতে হলে জাতীয় সংসদ লাগবে। এখন তো জাতীয় সংসদ নেই। অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধানের সংস্কার করা যেতে পারে, সেটা যদি পরবর্তী সরকার মেনে না নেয়, তাহলে কী হবে? সে ক্ষেত্রে সংবিধান সংস্কার করাটা এখন ঠিক হবে না।
আমি আশা করি, ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সংস্কারের জন্য যদি আরও দু-তিন মাস দেরিও হয়, তাতে সমস্যা নেই। বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হোক, দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসুক, এটাই প্রত্যাশা করি।
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য