
গাছ আছে বলেই আমরা এ পৃথিবীতে বেঁচে আছি। আমাদের আগে এ পৃথিবীতে উদ্ভিদ এসেছে। উদ্ভিদ আসার পর এ পৃথিবী সবুজ গ্রহ হয়ে উঠেছে। জীবন ও জীববৈচিত্র্যের জন্য প্রতিটি উদ্ভিদ প্রজাতিই গুরুত্বপূর্ণ। এ পৃথিবীতে প্রতিটি জীবই একে অপরের সঙ্গে এক অদৃশ্য মধুর বন্ধনে আবদ্ধ। একজন অন্যজনকে ছাড়া চলতে, এমনকি বাঁচতেও পারে না। কোনো একটি গাছের বিলুপ্তি মানে সে গাছের ওপর আত্মনির্ভরশীল আরও অন্তত ৩০ প্রজাতি জীবের বিলুপ্ত হওয়া। অথচ প্রকৃতির এই অদৃশ্য সুতার বাঁধনকে আমরা প্রায় কেউই হয় বুঝি না অথবা বুঝেও অবহেলা করি। যার পরিণাম দিনশেষে আমাদেরই ভোগ করতে হচ্ছে।
পারস্পরিক নির্ভরশীলতার এই মহাজালের কেন্দ্রস্থলে আছে উদ্ভিদ। কেননা উদ্ভিদ প্রতিটি জীবকে অক্সিজেন দান করে বাঁচিয়ে রেখেছে, ফল ও বীজ খাইয়ে পুষ্ট করছে। প্রতিটি জীবের খাদ্য গ্রহণ অনেকটাই উদ্ভিদের প্রজাতি সুনির্দিষ্ট। অর্থাৎ এক এক প্রজাতির জীব এক এক প্রজাতির উদ্ভিদ থেকে আহার ও আশ্রয় পায়। আবার একাধিক প্রজাতির ক্ষেত্রে একটি উদ্ভিদ প্রজাতিরও নির্ভরশীলতা রয়েছে। যেমন- ধানগাছের বীজ আমরা খাই আবার পাখিরাও খায়, ইঁদুর খায়। আবার কোনো কোনো পাখিকে মানুষ খায়, ইঁদুরকে খায় পেঁচা। এভাবে প্রকৃতির খাদ্যচক্র এক সুশৃঙ্খল নিয়মে চলছে সুপ্রাচীনকাল থেকে। হঠাৎ সে শিকলের কোথাও ছিঁড়ে গেলে প্রকৃতিরই তাতে বিপর্যয় ঘটে।
পৃথিবীতে আনুমানিক ৮ দশমিক ৭ মিলিয়ন প্রজাতির জীব রয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত আমরা মাত্র ১ দশমিক ২ মিলিয়ন মানে ১২ লাখ প্রজাতির জীবকে শনাক্ত করতে পেরেছি, যার মধ্যে সাড়ে ৯ লাখ প্রজাতিই প্রাণী। পৃথিবীর এখনো ৮৬ শতাংশ জীব শনাক্ত করা হয়নি। তেমনি সাগরেও আছে অনেক প্রজাতির জীব; যার ৯১ শতাংশ এখনো অশনাক্তিত। পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রজাতির সংখ্যা গণনা যেন অনেকটা সাগরের বেলাভূমিতে বসে বালুকণা গোনার মতোই ব্যাপার। বিশ্বে প্রায় ৩ লাখ ৮২ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে, যার মধ্যে ২ লাখ ৮৩ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ হলো সেসব প্রজাতির উদ্ভিদ যেগুলোতে ফুল ফোটে ও বীজ হয়। প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ২ হাজার প্রজাতির নতুন উদ্ভিদ আবিষ্কৃত ও শনাক্ত হচ্ছে। বাংলাদেশেও সাম্প্রতিক সময়ে অনেক উদ্ভিদ বিদেশ থেকে এসেছে এবং এ দেশে থাকা বেশ কিছু উদ্ভিদকে নতুন হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ভূখণ্ডে থাকা গাছপালার প্রথম প্রণালিবদ্ধ রেকর্ড পাওয়া যায় এ অঞ্চলে ইবনে বতুতার (৯৮০-১০৩৭) ভ্রমণবৃত্তান্ত থেকে। পরবর্তী সময়ে সম্রাট আকবরের মুখ্য সচিব ও সভাসদ আবুল ফজল (১৫৫১-১৬০২) ‘আইন-ই-আকবরি’ গ্রন্থে ভারতবর্ষের অনেক উদ্ভিদের নাম উল্লেখ করে গেছেন। এরপর সতেরো ও আঠারো শতকে অনেক ইউরোপীয় উদ্ভিদবিদ এ দেশের গাছপালা অনুসন্ধান কাজে লিপ্ত হয়ে ব্যাপক কাজ করেন। ফলে আমরা এ দেশের উদ্ভিদ প্রজাতিগুলোর একটি সমৃদ্ধ বিবরণ পাই। বর্তমানে বাংলাদেশে উদ্ভিদসম্পর্কিত সবচেয়ে সমৃদ্ধ বইটি হলো এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ’। সে বইয়ে মোট ৩ হাজার ৮১৩টি উদ্ভিদ প্রজাতির বর্ণনা রয়েছে। বাস্তবে এ দেশে প্রায় ৬ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। প্রতিবছর যে হারে বিদেশি গাছপালা এ দেশে আসছে তাতে সংখ্যাটা আরও বাড়বে। এ দেশের উদ্ভিদবিদরা ও শৌখিন উদ্ভিদপ্রেমীরা এ দেশের উদ্ভিদ প্রজাতির অনুসন্ধানে কাজ করে যাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে এ দেশের উদ্ভিদ প্রজাতিগুলো সাধারণের কাছে পরিচিত করানো ও রেকর্ডভুক্ত করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সংবাদপত্রও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের ১ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ প্রজাতির বর্তমান অবস্থা জানার জন্য আইইউসিএন এক গবেষণা চালিয়েছে। মূল্যায়নের পর ২০২৪ সালে প্রকাশ করেছে বিশাল দুই খণ্ড ‘বাংলাদেশের উদ্ভিদ লাল তালিকা’ বই। দীর্ঘদিনের শ্রমসাধ্য কাজটি করার ফলে আমরা এখন জানতে পেরেছি আমাদের উদ্ভিদ জগতের বর্তমান অবস্থা। এ গবেষণায় দেখা গেছে যে, এ দেশের ৩৯৫ প্রজাতির উদ্ভিদ সম্মিলিতভাবে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে, যা মূল্যায়িত উদ্ভিদের প্রায় ৩৯ দশমিক ৫ শতাংশ।
এ ছাড়া আরও ৭০ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে প্রায় বিপদগ্রস্ত অবস্থায়। যে ৩৯৫ প্রজাতির উদ্ভিদ হুমকিতে রয়েছে তার মধ্যে ২৬৩ প্রজাতি রয়েছে সংকটাপন্ন, ১২৭টি প্রজাতি বিপন্ন ও ৫টি প্রজাতি রয়েছে মহাবিপন্ন অবস্থায়। অন্যদিকে এ দেশের উদ্ভিদজগৎ থেকে ইতোমধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে ৭ প্রজাতির উদ্ভিদ। বনাঞ্চলে বিলুপ্ত হলো তালিপাম গাছ। সারা পৃথিবীর মধ্যে এ গাছ শুধু বাংলাদেশের বনেই ছিল, ছিল ঢাকা শহরেও। সুখের কথা হলো, এ দেশের উদ্ভিদপ্রেমীরা ঢাকা শহরের সে গাছটি মরে যাওয়ার আগে তার ফল থেকে চারা তৈরি করে সেসব চারা ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দিয়েছেন।
এতে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে তালিপাম। এভাবে আঞ্চলিকভাবে বিলুপ্ত হলেও সেসব উদ্ভিদ অন্য দেশে নিশ্চয়ই আছে। সেখান থেকে তা সংগ্রহ করে এ দেশে আবার সেসব প্রজাতিকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া যায়। যে পাঁচটি প্রজাতির উদ্ভিদ মহাবিপন্ন অবস্থায় রয়েছে, সেগুলোও যেন বিলুপ্ত হয়ে না যায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন- এ দেশে মহাবিপন্ন বাঁশপাতা গাছের মাত্র ১১১টি গাছ টিকে আছে। এর মধ্যে বনাঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে বেঁচে আছে মাত্র ১২টি গাছ, বাকি ৯৯টি বিভিন্ন উদ্যানে লাগানো। বলধা গার্ডেন ও জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানেও এ গাছ আছে। এভাবে মহাবিপন্ন গাছগুলোকে তার প্রাকৃতিক পরিবেশে ও লালিত অবস্থায় রক্ষা করতে হবে।
বাংলাদেশে উদ্ভিদ সম্পদের সবচেয়ে বড় স্থান হলো মিরপুরে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান। সেখানে জানা মতে, ১০৪১ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। সেখানে কেন বাংলাদেশের তালিকাভুক্ত প্রায় সব উদ্ভিদই থাকতে পারে না? একই প্রজাতির শত উদ্ভিদ থাকার চেয়ে হাজার প্রজাতির হাজার উদ্ভিদ থাকাটাই বাঞ্ছনীয়। স্থান সংকুলান না হলে এ দেশের যে ৫৩টি রক্ষিত বন ও ১৮টি জাতীয় উদ্যান রয়েছে, সেখানে সংকটাপন্ন ও বিপন্ন উদ্ভিদ প্রজাতিগুলোকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ছোট ছোট উদ্ভিদ উদ্যান করে সেখানে এসব বিপন্ন উদ্ভিদ লাগানোর ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উদ্ভিদ উদ্যান এ ক্ষেত্রে অন্যতম উদাহরণ। পৃথিবীর অনেক দেশেই একাধিক বড় বড় উদ্ভিদ উদ্যান আছে, আমাদের দেশে কেন থাকতে পারে না? বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি উদ্ভিদপ্রজাতির বৈচিত্র্য সমৃদ্ধ এলাকা হলো চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেট। উদ্ভিদ প্রজাতির অনুসন্ধান ও তথ্য লিপিবদ্ধকরণ হালনাগাদ করতে এসব অঞ্চলে ব্যাপক অনুসন্ধান চালাতে হবে।
উদ্ভিদের প্রাকৃতিক বাসস্থান ধ্বংস থেমে নেই। দিন দিন এ দেশে মানুষ বাড়ছে, বনভূমি চলে যাচ্ছে কৃষিজমিতে, ঘরবাড়ি এবং বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণে। প্রাকৃতিক সব সম্পদের ওপরই এতে চাপ বাড়ছে। এর ওপর আছে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত। এসব নানা কারণে বর্তমানে বাংলাদেশের ৮ থেকে ১০ শতাংশ উদ্ভিদ প্রজাতি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। এ ঝুঁকি নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। একটি উদ্ভিদ প্রজাতিও যেন আর এ দেশ থেকে হারিয়ে না যায়।
লেখক: কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক