ঢাকা ৪ ফাল্গুন ১৪৩১, সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
English
সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৪ ফাল্গুন ১৪৩১

প্রতিটি প্রজাতির গাছকেই রক্ষা করা দরকার

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩:০৮ পিএম
প্রতিটি প্রজাতির গাছকেই রক্ষা করা দরকার
মৃত্যুঞ্জয় রায়

গাছ আছে বলেই আমরা এ পৃথিবীতে বেঁচে আছি। আমাদের আগে এ পৃথিবীতে উদ্ভিদ এসেছে। উদ্ভিদ আসার পর এ পৃথিবী সবুজ গ্রহ হয়ে উঠেছে। জীবন ও জীববৈচিত্র্যের জন্য প্রতিটি উদ্ভিদ প্রজাতিই গুরুত্বপূর্ণ। এ পৃথিবীতে প্রতিটি জীবই একে অপরের সঙ্গে এক অদৃশ্য মধুর বন্ধনে আবদ্ধ। একজন অন্যজনকে ছাড়া চলতে, এমনকি বাঁচতেও পারে না। কোনো একটি গাছের বিলুপ্তি মানে সে গাছের ওপর আত্মনির্ভরশীল আরও অন্তত ৩০ প্রজাতি জীবের বিলুপ্ত হওয়া। অথচ প্রকৃতির এই অদৃশ্য সুতার বাঁধনকে আমরা প্রায় কেউই হয় বুঝি না অথবা বুঝেও অবহেলা করি। যার পরিণাম দিনশেষে আমাদেরই ভোগ করতে হচ্ছে। 

পারস্পরিক নির্ভরশীলতার এই মহাজালের কেন্দ্রস্থলে আছে উদ্ভিদ। কেননা উদ্ভিদ প্রতিটি জীবকে অক্সিজেন দান করে বাঁচিয়ে রেখেছে, ফল ও বীজ খাইয়ে পুষ্ট করছে। প্রতিটি জীবের খাদ্য গ্রহণ অনেকটাই উদ্ভিদের প্রজাতি সুনির্দিষ্ট। অর্থাৎ এক এক প্রজাতির জীব এক এক প্রজাতির উদ্ভিদ থেকে আহার ও আশ্রয় পায়। আবার একাধিক প্রজাতির ক্ষেত্রে একটি উদ্ভিদ প্রজাতিরও নির্ভরশীলতা রয়েছে। যেমন- ধানগাছের বীজ আমরা খাই আবার পাখিরাও খায়, ইঁদুর খায়। আবার কোনো কোনো পাখিকে মানুষ খায়, ইঁদুরকে খায় পেঁচা। এভাবে প্রকৃতির খাদ্যচক্র এক সুশৃঙ্খল নিয়মে চলছে সুপ্রাচীনকাল থেকে। হঠাৎ সে শিকলের কোথাও ছিঁড়ে গেলে প্রকৃতিরই তাতে বিপর্যয় ঘটে।  

পৃথিবীতে আনুমানিক ৮ দশমিক ৭ মিলিয়ন প্রজাতির জীব রয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত আমরা মাত্র ১ দশমিক ২ মিলিয়ন মানে ১২ লাখ প্রজাতির জীবকে শনাক্ত করতে পেরেছি, যার মধ্যে সাড়ে ৯ লাখ প্রজাতিই প্রাণী। পৃথিবীর এখনো ৮৬ শতাংশ জীব শনাক্ত করা হয়নি। তেমনি সাগরেও আছে অনেক প্রজাতির জীব; যার ৯১ শতাংশ এখনো অশনাক্তিত। পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রজাতির সংখ্যা গণনা যেন অনেকটা সাগরের বেলাভূমিতে বসে বালুকণা গোনার মতোই ব্যাপার। বিশ্বে প্রায় ৩ লাখ ৮২ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে, যার মধ্যে ২ লাখ ৮৩ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ হলো সেসব প্রজাতির উদ্ভিদ যেগুলোতে ফুল ফোটে ও বীজ হয়। প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ২ হাজার প্রজাতির নতুন উদ্ভিদ আবিষ্কৃত ও শনাক্ত হচ্ছে। বাংলাদেশেও সাম্প্রতিক সময়ে অনেক উদ্ভিদ বিদেশ থেকে এসেছে এবং এ দেশে থাকা বেশ কিছু উদ্ভিদকে নতুন হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়েছে। 

বাংলাদেশ ভূখণ্ডে থাকা গাছপালার প্রথম প্রণালিবদ্ধ রেকর্ড পাওয়া যায় এ অঞ্চলে ইবনে বতুতার (৯৮০-১০৩৭) ভ্রমণবৃত্তান্ত থেকে। পরবর্তী সময়ে সম্রাট আকবরের মুখ্য সচিব ও সভাসদ আবুল ফজল (১৫৫১-১৬০২) ‘আইন-ই-আকবরি’ গ্রন্থে ভারতবর্ষের অনেক উদ্ভিদের নাম উল্লেখ করে গেছেন। এরপর সতেরো ও আঠারো শতকে অনেক ইউরোপীয় উদ্ভিদবিদ এ দেশের গাছপালা অনুসন্ধান কাজে লিপ্ত হয়ে ব্যাপক কাজ করেন। ফলে আমরা এ দেশের উদ্ভিদ প্রজাতিগুলোর একটি সমৃদ্ধ বিবরণ পাই। বর্তমানে বাংলাদেশে উদ্ভিদসম্পর্কিত সবচেয়ে সমৃদ্ধ বইটি হলো এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ’। সে বইয়ে মোট ৩ হাজার ৮১৩টি উদ্ভিদ প্রজাতির বর্ণনা রয়েছে। বাস্তবে এ দেশে প্রায় ৬ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। প্রতিবছর যে হারে বিদেশি গাছপালা এ দেশে আসছে তাতে সংখ্যাটা আরও বাড়বে। এ দেশের উদ্ভিদবিদরা ও শৌখিন উদ্ভিদপ্রেমীরা এ দেশের উদ্ভিদ প্রজাতির অনুসন্ধানে কাজ করে যাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে এ দেশের উদ্ভিদ প্রজাতিগুলো সাধারণের কাছে পরিচিত করানো ও রেকর্ডভুক্ত করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সংবাদপত্রও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। 
সম্প্রতি বাংলাদেশের ১ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ প্রজাতির বর্তমান অবস্থা জানার জন্য আইইউসিএন এক গবেষণা চালিয়েছে। মূল্যায়নের পর ২০২৪ সালে প্রকাশ করেছে বিশাল দুই খণ্ড ‘বাংলাদেশের উদ্ভিদ লাল তালিকা’ বই। দীর্ঘদিনের শ্রমসাধ্য কাজটি করার ফলে আমরা এখন জানতে পেরেছি আমাদের উদ্ভিদ জগতের বর্তমান অবস্থা। এ গবেষণায় দেখা গেছে যে, এ দেশের ৩৯৫ প্রজাতির উদ্ভিদ সম্মিলিতভাবে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে, যা মূল্যায়িত উদ্ভিদের প্রায় ৩৯ দশমিক ৫ শতাংশ। 

এ ছাড়া আরও ৭০ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে প্রায় বিপদগ্রস্ত অবস্থায়। যে ৩৯৫ প্রজাতির উদ্ভিদ হুমকিতে রয়েছে তার মধ্যে ২৬৩ প্রজাতি রয়েছে সংকটাপন্ন, ১২৭টি প্রজাতি বিপন্ন ও ৫টি প্রজাতি রয়েছে মহাবিপন্ন অবস্থায়। অন্যদিকে এ দেশের উদ্ভিদজগৎ থেকে ইতোমধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে ৭ প্রজাতির উদ্ভিদ। বনাঞ্চলে বিলুপ্ত হলো তালিপাম গাছ। সারা পৃথিবীর মধ্যে এ গাছ শুধু বাংলাদেশের বনেই ছিল, ছিল ঢাকা শহরেও। সুখের কথা হলো, এ দেশের উদ্ভিদপ্রেমীরা ঢাকা শহরের সে গাছটি মরে যাওয়ার আগে তার ফল থেকে চারা তৈরি করে সেসব চারা ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দিয়েছেন। 

এতে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে তালিপাম। এভাবে আঞ্চলিকভাবে বিলুপ্ত হলেও সেসব উদ্ভিদ অন্য দেশে নিশ্চয়ই আছে। সেখান থেকে তা সংগ্রহ করে এ দেশে আবার সেসব প্রজাতিকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া যায়। যে পাঁচটি প্রজাতির উদ্ভিদ মহাবিপন্ন অবস্থায় রয়েছে, সেগুলোও যেন বিলুপ্ত হয়ে না যায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন- এ দেশে মহাবিপন্ন বাঁশপাতা গাছের মাত্র ১১১টি গাছ টিকে আছে। এর মধ্যে বনাঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে বেঁচে আছে মাত্র ১২টি গাছ, বাকি ৯৯টি বিভিন্ন উদ্যানে লাগানো। বলধা গার্ডেন ও জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানেও এ গাছ আছে। এভাবে মহাবিপন্ন গাছগুলোকে তার প্রাকৃতিক পরিবেশে ও লালিত অবস্থায় রক্ষা করতে হবে। 

বাংলাদেশে উদ্ভিদ সম্পদের সবচেয়ে বড় স্থান হলো মিরপুরে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান। সেখানে জানা মতে, ১০৪১ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। সেখানে কেন বাংলাদেশের তালিকাভুক্ত প্রায় সব উদ্ভিদই থাকতে পারে না? একই প্রজাতির শত উদ্ভিদ থাকার চেয়ে হাজার প্রজাতির হাজার উদ্ভিদ থাকাটাই বাঞ্ছনীয়। স্থান সংকুলান না হলে এ দেশের যে ৫৩টি রক্ষিত বন ও ১৮টি জাতীয় উদ্যান রয়েছে, সেখানে সংকটাপন্ন ও বিপন্ন উদ্ভিদ প্রজাতিগুলোকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ছোট ছোট উদ্ভিদ উদ্যান করে সেখানে এসব বিপন্ন উদ্ভিদ লাগানোর ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।

 বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উদ্ভিদ উদ্যান এ ক্ষেত্রে অন্যতম উদাহরণ। পৃথিবীর অনেক দেশেই একাধিক বড় বড় উদ্ভিদ উদ্যান আছে, আমাদের দেশে কেন থাকতে পারে না? বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি উদ্ভিদপ্রজাতির বৈচিত্র্য সমৃদ্ধ এলাকা হলো চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেট। উদ্ভিদ প্রজাতির অনুসন্ধান ও তথ্য লিপিবদ্ধকরণ হালনাগাদ করতে এসব অঞ্চলে ব্যাপক অনুসন্ধান চালাতে হবে।

উদ্ভিদের প্রাকৃতিক বাসস্থান ধ্বংস থেমে নেই। দিন দিন এ দেশে মানুষ বাড়ছে, বনভূমি চলে যাচ্ছে কৃষিজমিতে, ঘরবাড়ি এবং বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণে। প্রাকৃতিক সব সম্পদের ওপরই এতে চাপ বাড়ছে। এর ওপর আছে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত। এসব নানা কারণে বর্তমানে বাংলাদেশের ৮ থেকে ১০ শতাংশ উদ্ভিদ প্রজাতি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। এ ঝুঁকি নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। একটি উদ্ভিদ প্রজাতিও যেন আর এ দেশ থেকে হারিয়ে না যায়।

লেখক: কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক

ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক দৃঢ় হওয়ার আশা

প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩:০৮ পিএম
ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক দৃঢ় হওয়ার আশা
সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

মোদির এবারের মার্কিন সফর নিয়ে বাংলাদেশেও সমান কৌতূহল। ট্রাম্পের সঙ্গে মোদির আলোচনায় আমেরিকার প্রসাদ ওঠে কি না, তা নিয়ে তুমুল কৌতূহল ছিল। বাংলাদেশের ভার ট্রাম্প পুরোপুরি মোদির ওপর দিয়েছেন। নরেন্দ্র মোদির সফরের মধ্য দিয়ে ভারত ও আমেরিকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও জোরদার হবে। বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা খাতে যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে। একই সঙ্গে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারতের অবস্থান আরও সুদীর্ঘ হবে।...

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ট্রাম্প জানিয়েছেন, বাংলাদেশের বিষয়টি তিনি মোদির ওপর ছাড়ছেন। ওই দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে আমেরিকার কোনো গুপ্ত ভূমিকা নেই বলেও দাবি করেছেন তিনি।

মোদির এবারের মার্কিন সফর নিয়ে বাংলাদেশেও সমান কৌতূহল। ট্রাম্পের সঙ্গে মোদির আলোচনায় আমেরিকার প্রসাদ ওঠে কি না, তা নিয়ে তুমুল কৌতূহল ছিল। বাংলাদেশের ভার ট্রাম্প পুরোপুরি মোদির ওপর দিয়েছেন।

ট্রাম্প প্রথম দফায় প্রেসিডেন্ট হয়ে আসার পরও বাংলাদেশ নিয়ে সরাসরি নাক গলাতেন না। ভারতের সঙ্গে সমন্বয় করে চলত মার্কিন বিদেশ মন্ত্রক। এবারও সেই অবস্থানের পরিবর্তন ঘটালেন না ট্রাম্প। যা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বেশ চাপের বলেই মনে করা হচ্ছে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাবেক মার্কিন বিদেশ সচিব হিলারি ক্লিনটনের ঘনিষ্ঠ। অন্যদিকে হিলারির সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্ক একেবারেই জানা নয়। ঘটনাক্রমে ট্রাম্প এমন একসময় বাংলাদেশ নিয়ে মোদিকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার দিয়েছেন, যখন শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ নিয়ে ভারতের ওপর চাপ গড়াতে চাইছে ঢাকা।

শুধু ট্রাম্প নয়, সদ্য নিয়োগ পাওয়া মার্কিন জাতীয় গোয়েন্দা অধিকর্তা হিন্দু মার্কিনি তুলসী গ্যাবার্ডের সঙ্গে মোদির আলোচনাতেও এসেছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। তুলসী ইতোপূর্বে পাকিস্তান ও বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের ঘটনায় মুখ খুলেছেন।

গত বৃহস্পতিবার ট্রাম্প-মোদির বৈঠকের কিছুক্ষণ আগে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে ফোন করেন ট্রাম্পের বন্ধু ইলন মাস্ক। তাদের মধ্যে কী কথা হয়েছে তা জানায়নি বাংলাদেশ প্রশাসন। তবে মনে করা হয় একটি ব্যবসায়িক ডিল নিয়ে কথা হয়েছে।

ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট বাংলাদেশে তাদের সব প্রকল্পের কাজ বন্ধ করতে নির্দেশিকা জারি করে। বাংলাদেশকে আর্থিক সাহায্য তো বটেই, সে দেশের মাটিতে আমেরিকার তরফে সব উন্নয়নমূলক কাজ বন্ধ করে দেওয়া হবে। এই পদক্ষেপের কয়েক দিনের মধ্যেই দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসেছেন মোদি-ট্রাম্প। সেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট সাফ জানিয়ে দেন, ‘হাসিনার পতনের নেপথ্যে আমেরিকার কোনো ভূমিকা ছিল না। তবে বাংলাদেশ ইস্যু নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি দীর্ঘদিন কাজ করছেন, তাই এই বিষয়টি তার ওপরেই ছেড়ে দিলাম।’ পরে বিদেশ সচিব বিক্রম মিশ্রি জানান, বাংলাদেশ নিয়ে চিন্তার কারণ রয়েছে। সেগুলো মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে জানিয়েছেন মোদি।

মার্কিন মুলুক থেকে প্রত্যেক বেআইনি অনুপ্রবেশকারী নাগরিককে ফিরিয়ে নেবে ভারত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের পর এই কথাই জানালেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তার সাফ কথা, বেআইনিভাবে প্রবেশ করে বিশ্বের কোনো দেশেই থাকার অধিকার নেই। সেই সঙ্গে জানালেন, আমজনতাকে ভুল বুঝিয়ে পাচার করা হচ্ছে।

গত সপ্তাহে হাতকড়া পরিয়ে, পায়ে শিকল বেঁধে আমেরিকা থেকে ফেরানো হয়েছিল ১০৪ ভারতীয়কে। তারপর এই প্রথমবার অনুপ্রবেশকারীদের ফেরানো প্রসঙ্গে কথা বলতে শোনা গেল মোদিকে। মার্কিন মুলুকে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেন, ভারতের দরিদ্র যুবকদের ভুল বুঝিয়ে বিদেশে পাঠানো হচ্ছে। অতি সাধারণ পরিবারের সন্তানদের বড় বড় স্বপ্ন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলা হচ্ছে। অনেকে জানেও না কেন তাদের এভাবে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। অনেককে পাচার করে দেওয়া হয়েছে।

মোদি আরও বলেন, মানব পাচারের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে কাজ করতে হলে ভারত এবং আমেরিকাকে। পাচার চক্রকে নির্মূল করতে ‘যুদ্ধে’ নেমেছে ভারত। প্রধানমন্ত্রীর আশা, এই যুদ্ধে সর্বতোভাবে সাহায্য করবেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। প্রসঙ্গত, প্রেসিডেন্টের কুর্সিতে বসেই ‘অনুপ্রবেশকারী হটাও’ অভিযান শুরু করেছেন ট্রাম্প। মার্কিন মুলুক থেকে ‘তাড়ানো’ হচ্ছে শয়ে শয়ে মানুষ। উল্লেখ্য, মোদি বরাবর ভারত থেকে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের সরানোর কথা বলেছেন। তাই মার্কিন মুলুক থেকে আসা অনুপ্রবেশকারীদের মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।

এদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদি শুল্ক নিয়ে আলোচনা করেন। ভারত-মার্কিন ক্ষুদ্র বাণিজ্য চুক্তি নিয়েও আলোচনা হয়। মোদির সফরের প্রাথমিক লক্ষ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি এড়ানো। 

এ ছাড়া ট্রাম্প ইতোমধ্যে চীন থেকে আমদানির ওপর ১০ শতাংশ হারে ব্যাপক শুল্ক আরোপ করেছেন, ফলে বেইজিং আমেরিকান জ্বালানির ওপর শুল্ক আরোপ করতে বাধ্য হয়েছে। ভারত বিলাসবহুল গাড়ি এবং সোলার সেলসহ ৩০টিরও বেশি পণ্যের ওপর সারচার্জ নিয়ে পর্যালোচনা করছে। ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর ট্রাম্পের শুল্ক পরিকল্পনার খবরের পর ধাতব স্টকগুলোর শেয়ারের দাম কমেছে। ভারতের এক শিল্পপতি মন্তব্য করেছেন, ট্রাম্প প্রস্তাবিত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করলে দেশটির প্রকৌশল পণ্যের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ রপ্তানি ঝুঁকির মুখে পড়বে। এর মধ্যে রয়েছে ইস্পাত এবং অ্যালুমিনিয়াম এবং মূল্য প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার। তিনি আরও মন্তব্য করেন, আমরা অপেক্ষা এবং দেখার নীতিতে রয়েছি এবং আশা করছি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের মধ্য দিয়ে বিষয়টির শান্তিপূর্ণ সমাধান হবে।

আন্তর্জাতিক স্তরে প্রতিরক্ষা বিষয়েও বিশদ আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে ভারতের বিদেশ মন্ত্রক সূত্রে। আমেরিকায় লুকিয়ে থাকা ভারতের শত্রুদের ভালো দিন এবার শেষ হতে চলেছে। যারা আমেরিকায় লুকিয়ে বসে ভারতের মাটিতে অপরাধ ও নাশকতা সংঘটিত করে তাদের কঠিন সময় আসতে চলেছে। তাদের কুকীর্তির কুণ্ডলী তৈরি করেছে নরেন্দ্র মোদি সরকার। আমেরিকার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে বিষয়টি কার্যকরী করার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ কর্মপরিকল্পনাও তৈরি করা হয়েছে। ভারতের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো আমেরিকায় লুকিয়ে বসে ভারতে নাশকতা চালানো ১২ গ্যাংস্টারের তালিকা এবং তাদের কাজকর্মের কুণ্ডলী তৈরি করে।

 নরেন্দ্র মোদি এই তালিকা ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে শেয়ার করেছেন বলে জানা গেছে। আমেরিকাকে ওই সব গ্যাংস্টার সম্পর্কে সচেতন করার উদ্দেশ্যই হলো তাদের বিরুদ্ধে কঠোরতম ব্যবস্থা নেওয়া। আশা করা হচ্ছে, নরেন্দ্র মোদির সফরের মধ্য দিয়ে ভারত ও আমেরিকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও জোরদার হবে। বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা খাতে যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে। একই সঙ্গে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারতের অবস্থান আরও সুদীর্ঘ হবে।

লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক

আয়নাঘর এবং বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি

প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩:০২ পিএম
আয়নাঘর এবং বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু

ভবিষ্যতে কোনো সরকারের আমলেই যেন দেশে এ ধরনের কোনো আয়নাঘরের জন্ম না হয়, তা সুনিশ্চিত করার এখনই উপযুক্ত সময়। আর তা সুনিশ্চিত করতে হবে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই। পাশাপাশি বিনা বিচারে আয়নাঘর বা গুমখানায় আটক রাখার ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করাও অত্যাবশ্যক। মানবাধিকার রক্ষার বৃহত্তর স্বার্থেই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গুম-খুনের রাজনীতি চিরতরে বন্ধ করার যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করবে- এমনটাই সবার প্রত্যাশা।

‘আইয়াম’ শব্দের অর্থ সময় বা যুগ এবং ‘জাহেলিয়া’ শব্দের অর্থ অজ্ঞতা। সুতরাং আইয়ামে জাহেলিয়া বলতে অজ্ঞতার যুগকে বোঝায়। ইসলামের ইতিহাসের ভাষায়, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুওয়াত লাভের আগে আরবের লোকেরা ঐশী বাণীর অভাবে অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। তখন আরবদের মধ্যে নানা ধরনের ধর্মীয় অনাচার ও কুসংস্কার বিরাজ করছিল, তারা নানা পাপাচারে আসক্ত ছিল। যা আইয়ামে জাহেলিয়া বা অন্ধকার যুগ নামে পরিচিত। পি কে হিট্টি ইসলাম আবির্ভাবের পূর্ববর্তী এক শতাব্দীকালকে আইয়ামে জাহেলিয়া বলে উল্লেখ করেছেন। এ সময় আরব দেশে দুর্নীতি ও কুসংস্কার প্রচলিত ছিল। আর এ যুগেই তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় জীবন অধঃপতনের পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল বলে একে আইয়ামে জাহেলিয়া (অন্ধকার যুগ) বলা হয়। তবে বর্তমান সময়ে আরবে আইয়ামে জাহেলিয়া না থাকলেও ১২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় তিনটি ‘আয়নাঘর’ (গোপন বন্দিশালা) পরিদর্শন শেষে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বন্দিশালাকে বীভৎসতা ও নৃশংসতার উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করার পাশাপাশি আয়নাঘর প্রতিষ্ঠা করাকে শেখ হাসিনা সরকারের এক আইয়ামে জাহেলিয়া প্রতিষ্ঠা করার সঙ্গে তুলনা করেছেন। গত ৬ ও ৭ আগস্ট ব্যারিস্টার আহমেদ বিন কাসেম আরমান, সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী এবং ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) নেতা মাইকেল চাকমা কথিত বন্দিশালা ‘আয়নাঘর’ থেকে মুক্তি পাওয়ার পর আয়নাঘরসহ গুম-খুনের বিষয়টি দেশে চাউর হয়। 

রাষ্ট্রীয় গুমের শিকার হওয়া ইউপিডিএফের সংগঠক মাইকেল চাকমা দীর্ঘ পাঁচ বছর তিন মাস এবং ব্যারিস্টার আহমেদ বিন কাসেম আরমান ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী দীর্ঘ আট বছর পর অবরুদ্ধ দশা থেকে মুক্তি পান। ‘মানবতাবিরোধী’, ‘সরকার’ ও ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ কার্যকলাপে ‘জড়িত’- এই ধরনের অজুহাত তুলে শেখ হাসিনা সরকার তাদের বিনা বিচারে তথাকথিত আয়নাঘর বা বন্দিশালায় আটক রাখে। আটকরা বিনা বিচারে কদর্য অবস্থায় বন্দিদশা কাটিয়েছেন বলে তাদের বক্তব্যে উঠে আসে। আর এভাবে কাউকে বিনা বিচারে দীর্ঘদিন ধরে আটক রাখা একই সঙ্গে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক আইনসহ মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং মানবতার পরিপন্থি। অভিযোগ রয়েছে, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে তৈরি এ ধরনের তথাকথিত আয়নাঘরে রাখা হতো গুম করে রাখা মানুষদের। আলো-বাতাসহীন কক্ষ, সেখানে সারাক্ষণ ঘড়ঘড়িয়ে ফ্যান চলে, যার নেপথ্যে যেন থমকে থাকছে অবিমিশ্র ঘৃণা এবং আতঙ্ক।

 শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বলপূর্বক গুমের শিকার সাবেক সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাসিনুর রহমান এবং শেখ মোহাম্মদ সেলিমের অন দ্য রেকর্ড অ্যাকাউন্টের ওপর ভিত্তি করে সম্প্রতি সুইডেনভিত্তিক নিউজ পোর্টাল নেত্র নিউজের একটি অনুসন্ধানী হুইসেলব্লোয়ার প্রতিবেদন প্রকাশ করে। আটকরা সেখানে বলেছেন, তাদের ঢাকার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত কারাগারের ভেতরে রাখা হয়েছিল। ধারণা করা হয়, এখানে কমপক্ষে ১৬টি কক্ষ রয়েছে, যেখানে একসঙ্গে ৩০ বন্দি রাখার সক্ষমতা রয়েছে বলে ভারতের জি নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ঢাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে এ রকম আরও বেশ কিছু নির্যাতন ও আটক স্থান থাকতে পারে বলে অনেকের ধারণা। 

বলা বাহুল্য, দেশত্যাগী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে বিরুদ্ধ মত সহ্য করার খুব একটা রেকর্ড পাওয়া যায় না। তাই তার নির্দেশে রাজনৈতিক বন্দিদের জন্য তৈরি করেছিলেন এ ধরনের আয়নাঘর, যা ছিল রাজনৈতিক বন্দিদের কাছে ত্রাস বা বিভীষিকাময় এক জায়গা। আর এটি ছিল মূলত প্রতিবাদীদের কণ্ঠরোধ করার একটি উপায়। অস্বীকার করার উপায় নেই, শেখ হাসিনার শাসনামলে বিরোধী দলের বহু নেতা-কর্মী নিখোঁজ হন, কোথাও তাদের খোঁজখবর পর্যন্ত ছিল না। নিখোঁজের ওই তালিকা থেকে সেনাবাহিনীর লোকজনও বাদ পড়েনি। এ ধরনের আয়নাঘরে বা গুমখানায় শেখ হাসিনার শাসনকালে (২০০৯ থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) মোট ৬০৫ জনকে গোপনে বন্দি করে রাখা হয়েছিল বলে জানিয়েছে খোদ ভারতীয় গণমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকা। 

মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের তথ্যমতে, ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনা সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদে নিখোঁজ হন ৪০২ জন। ২০১৪ থেকে ২০১৯ সালের জুলাই পর্যন্ত দেশে গুমের শিকার হন ৩৪৪ জন, তাদের মধ্যে ৪০ জনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। আর ৬৬ জনকে সরকারি হেফাজতে গ্রেপ্তার অবস্থায় পাওয়া গেছে। আইন ও মানবাধিকারবিষয়ক সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, ২০৩ জন এখনো গুম রয়েছেন। যারা দীর্ঘদিন গুম থাকার পর ফিরে আসেন, তারা গুমের ব্যাপারে মৌন অবলম্বন করেন। ধারণা করা হয়, এসব মানুষের গুম করে রাখা হতো তথাকথিত সেই আয়নাঘরে। গণমাধ্যম মারফত জানা যায়, মীর আহমদ বিন কাসেম, আবদুল্লাহিল আমান, মাইকেল চাকমা ছাড়াও এ ধরনের আয়নাঘরে যারা বন্দি থেকেছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ মোবাশার হাসান, সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান, ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ কুমার রায় প্রমুখ। দেশে গুম হয়ে যাওয়া পরিবারের সদস্যরা একটা সময় ‘মায়ের ডাক’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেন।

 এখানে যাদের পরিবারের সদস্যরা শেখ হাসিনা সরকারের শাসনামলে সরকারি সংস্থা কর্তৃক বলপূর্বক গুমের শিকার হয়েছেন, সেসব ঘটনাকে সামনে আনার জন্য সৃষ্টি করা হয় এ সংগঠনের। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি এ সংগঠনের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ের সব গুম-খুন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিশদ তদন্তের দাবি জানানো হয়েছে। পাশাপাশি এসব ঘটনায় জড়িত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ অভিযুক্ত রাজনীতিবিদ এবং সংশ্লিষ্টদেরও আইনের আওতায় আনার দাবি জানানো হয় সংগঠনটির পক্ষ থেকে। 

২০২৪ সালের হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্ট অনুযায়ী, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার বছর (২০০৯ সাল থেকে তার পতন হওয়া পতন পর্যন্ত) বাংলাদেশে ৬০০টিরও বেশি গুম হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, এ ধরনের গুমশালা থেকে খুব কমসংখ্যক বন্দিই মুক্তি পেয়েছে। তবে কিছু বন্দিকে দীর্ঘ বিচার-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মুক্তি দেওয়া হয়। অনেকেই আবার এনকাউন্টারের শিকার হয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এ ধরনের ঘটনার তদন্ত প্রায় হয়নি বললেই চলে। আবার আয়নাঘরে রাখা অনেকেই দিনের পর দিন অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে একপর্যায়ে মারা গেছেন, তারপর লাশ সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। যাদের গ্রেপ্তার করা হয় তাদের খাতা-কলমে কোনো তথ্যও রাখা হয় না। আর যারা শেখ হাসিনার আস্থাভাজন ছিলেন, তারাই মূলত এ ধরনের আয়নাঘরের দায়িত্ব পেতেন। আর এখানে বন্দিদের সঙ্গে তাদের পরিবারের সদস্যদের দেখা করা বা যোগাযোগের কোনো উপায়ও ছিল না। এ যেন হিটলারের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের চিত্রকেও হার মানায়। 

বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে গুম, বিনা বিচারে আটক, নির্বিচারে অবৈধভাবে আটক, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ও নির্যাতন, খুন, সন্ত্রাস, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা ইত্যাদি। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ এসব ঘটনার জন্য জাতিসংঘ ও বিভিন্ন মানবাধিকার রক্ষাকারী সংস্থা যেমন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকারকে নিন্দা প্রস্তাব জানালেও তাতে শেখ হাসিনার কর্ণপাত করেননি, যা দুঃখজনক। বলা বাহুল্য, বিনা বিচারে কাউকে আটক বা বন্দি রাখা বা গুম করা সম্পূর্ণরূপে বেআইনি। একই সঙ্গে তা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইনসহ মানবতা ও মানবাধিকারের পরিপন্থি। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এটিকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক আইন, বিশেষ করে মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন বলে বিবেচনা করে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদে গ্রেপ্তার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘গ্রেপ্তারকৃত কোন ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র গ্রেপ্তারের কারণ জ্ঞাপন না করিয়া প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাঁহার মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের ও তাঁহার দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাইবে না।’ সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদে আরও বলা হয়, ‘গ্রেপ্তারকৃত ও প্রহরায় আটক প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে গ্রেপ্তারের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে (গ্রেপ্তারের স্থান হইতে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে আনয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সময় ব্যতিরেকে) হাজির করা হইবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতীত তাঁহাকে তদতিরিক্ত কাল প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না।’ সংবিধান ছাড়াও জাতিসংঘ ঘোষিত মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র, ১৯৪৮-এর ৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কাউকে নির্যাতন করা যাবে না কিংবা কারও প্রতি নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ করা যাবে না অথবা কাউকে এহেন শাস্তি দেওয়া যাবে না।

 মানবাধিকারের সর্বজনীন ওই ঘোষণাপত্রের ৯ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘কাউকেই খেয়ালখুশিমতো গ্রেপ্তার বা অন্তরীণ করা কিংবা নির্বাসন দেওয়া যাবে না।’ দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে এবং জাতিসংঘের মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রে বিনা বিচারে আটক, গ্রেপ্তার সম্পর্কে উপরিউক্ত বিষয় বলা হলেও শেখ হাসিনার সরকারের আমলে তা মোটেও মানা হয়নি। আর এই কারণেই দেশে তৈরি হয়েছিল অসংখ্য গুমখানা বা আয়নাঘর। যেখানে প্রতিনিয়ত ভূলুণ্ঠিত হয়েছে মানবাধিকার, করা হয়েছে মানব অধিকারের প্রতি চরম অবজ্ঞা এবং ঘৃণা। বর্তমান সময়ে জাতির সামনে আয়নাঘরকে ফোকাস করার পাশাপাশি যারা আয়নাঘর বানিয়েছে এবং আয়নাঘরের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত, তাদের দেশের সামনে, দশের সামনে, জাতির সামনে, বিশ্ববাসীর সামনে বেশি মাত্রায় ফোকাস করা প্রয়োজন।

 বর্তমানসহ ভবিষ্যতে কোনো সরকারের আমলেই যেন দেশে এ ধরনের কোনো আয়নাঘরের জন্ম না হয়, তা সুনিশ্চিত করার এখনই উপযুক্ত সময়। আর তা সুনিশ্চিত করতে হবে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই। পাশাপাশি বিনা বিচারে আয়নাঘর বা গুমখানায় আটক রাখার ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করাও অত্যাবশ্যক। মানবাধিকার রক্ষার বৃহত্তর স্বার্থেই (প্রয়োজন হলে পলিটিক্যাল অ্যাক্ট প্রণয়ন করে হলেও) বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গুম-খুনের রাজনীতি চিরতরে বন্ধ করার যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করবে- এমনটাই সবার প্রত্যাশা। কারণ, স্মরণে রাখা প্রয়োজন, শুধু মানব পরিবারের সব সদস্যের সমান ও অবিচ্ছেদ্য অধিকারগুলো এবং সহজাত মর্যাদার স্বীকৃতিই পারে সমাজে শান্তি, স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচারের ভিত্তি গড়তে তুলতে, কোনো আয়নাঘর নয়। 

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
[email protected]

পুঁজিবাদ-সামন্তবাদের বামন উভয়েই রক্তচোষা

প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০১:৩০ পিএম
পুঁজিবাদ-সামন্তবাদের বামন উভয়েই রক্তচোষা
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

বাংলাভাষা এখন মধ্যবিত্তের সেই অংশের মানসিক সম্পদ, যে অংশ রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে দূরে রয়েছে। আর এদের মধ্যেও যে সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা নেই ইংরেজি শেখার, তাও বলা যাবে না। পারলে শিখত। পারে না, তাই শেখে না। সেই ইংরেজ যুগের অবস্থা। সে যুগে বাঙালি মুসলমান ইংরেজি শেখেনি। প্রচার করা হয়েছিল যে, কারণটা মনস্তাত্ত্বিক। অভিমান করে শেখেনি। রাজ্য হারানোর গভীর অভিমানে বাঙালি মুসলমান নাকি ইংরেজি ভাষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, খুব দৃঢ়ভাবে। অথচ আসল খবর এই যে, রাজ্য হারানোর জন্য অভিমানের প্রশ্নটাই সম্পূর্ণ অবান্তর। কেননা রাজ্য না ছিল বাঙালির, না ছিল বাঙালি মুসলমানের।

 রাজ্য ছিল অবাঙালিদের হাতেই। যার আমাত্য ও বড় আমলারাও অধিকাংশই ছিল অবাঙালি। বাঙালি মুসলমানের ইংরেজি না শেখার প্রকৃত কারণ অর্থনৈতিক। তারা বড়ই গরিব ছিল। এ যুগে সে যে বাংলা শিখতে পারছে না তার জন্যও ওই একই দুর্বলতা দায়ী। তারা এখনো বড়ই গরিব। আগে যেমন ছিল, এখনো তেমনি রয়েছে। আমলাতন্ত্রই ‘স্বাধীন’ হয়েছে, গরিব মানুষ স্বাধীন হয়নি। যারা সম্পত্তির মালিক হতে পেরেছে তারা তো আর দেরি করছে না। ভীষণ বেগে ইংরেজি শিখছে। যেন এতদিন না শেখার প্রায়শ্চিত্ত করছে। ধর্মীয় প্রায়শ্চিত্তের তুলনায় ইহজাগতিক প্রায়শ্চিত্ত যে প্রবল হয়, তা প্রমাণিত হচ্ছে বুঝি।

ইংরেজ আমলে রাষ্ট্র ছিল উপনিবেশিক ও আমলাতান্ত্রিক, এখন দু-দুবার স্বাধীন হওয়ার পর সে হয়েছে পুঁজিবাদী ও আমলাতান্ত্রিক। আমলাতন্ত্র ঠিকই রয়েছে। ইংরেজ যে এ দেশকে শাসন করত, সেজন্য সর্বস্তরে তাকে নিজের দেশ থেকে লোক এনে বসাতে হয়নি, স্থানীয়দের দিয়েই কাজ চলেছে। আমলাতন্ত্রের একটি অনড় বেষ্টনী ছিল খাড়া করা, যার অভ্যন্তরে দুর্নীতি খুবই চলত। লুণ্ঠন যে যেভাবে পারে করার ব্যাপারে গাফিলতি করত না, কিন্তু কাঠামোটা ঠিকই থাকত, আমলারাই টিকিয়ে রাখত, তাদের সমষ্টিগত স্বার্থে। সেই আমলাতন্ত্রের সদস্যরা কেউ কেউ রাজনীতি করেছেন, যেমন- সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুভাষ বসু, তবে আমলাতন্ত্রের সদস্য হিসেবে নয়, বাইরে বেরিয়ে এসে। কেউ কেউ সাহিত্যচর্চা করেছেন, যেমন বঙ্কিমচন্দ্র ও নবীন সেন। কেউ-বা অর্থনীতির বই লিখেছেন, যেমন- রমেশচন্দ্র দত্ত। হ্যাঁ, তাদের প্রধান পরিচয় আমলাতন্ত্রী হিসেবে নয়, ব্যতিক্রম হিসেবেই। তবু সত্য তো থেকেই যায় যে, এরা সবাই আমলা হয়েছিল, কিংবা হতে না পেরে খুবই ক্ষুব্ধ ছিল (যেমন- সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়)। আমলাতন্ত্রের সদস্য হওয়ার চেয়ে বড় কোনো লক্ষ্য সে যুগে ছিল না।
আজকেও নেই। 

আজকেও লোক আমলাতন্ত্রের সদস্য হতে চায়। না হলেও তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। মন্ত্রীরাও আমলানির্ভর থাকেন, এবং তাদেরও আমলাই মনে হয়, এক ধাপ ওপরের। সংসদ সদস্যরা যখন নিজেদের মান-মর্যাদার হিসাব-নিকাশ করেন তখন আমলাদের কী প্রাপ্য, কী নয় তার সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েই করেন। অন্য মানদণ্ড দেশে এখন নেই। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করে আমলাদের সহযোগিতা নিয়েই, তা সে আমলা শুল্ক বিভাগের হোন, কিংবা আমদানি-রপ্তানি বিভাগেরই হোন।
বলা বাহুল্য, আমলাতন্ত্রের ভাষাও পুঁজিবাদের ভাষাই। ইংরেজি ভাষা। ফাইলে বাংলা লেখাটা সামান্য ব্যাপার, আনুষ্ঠানিকতা মাত্র, প্রাণ রয়েছে অন্যত্র। আমলাতন্ত্রের মান ভাষা ইংরেজি, মূল ভাষাও সেটাই, প্রাণের ভাষাও বটে।

নিজের দেশে পুঁজিবাদী ইংরেজ, পুঁজিবাদের অনুপ্রেরণা ও শক্তি নিয়েই দেশ-বিদেশে গেছে কিন্তু সেখানে গিয়ে, বিশেষ করে ভারতবর্ষে, স্থানীয় সামন্তবাদকে অত্যন্ত উৎসাহিত করল নতুন জীবন লাভ করার ব্যাপারে। ইতিহাস বলছে, ভারতবর্ষের কোনো কোনো অঞ্চলে যখন পুঁজিবাদী বিকাশের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল তখনই ঔপনিবেশিকরা এসে সেই বিকাশকে ওপর থেকে প্রতিহত করল এবং ভেতরের সামন্তবাদী উপাদানকে শক্তিশালী করতে চাইল, ভারতবর্ষ যেন পুঁজিবাদী পথে এগিয়ে ব্রিটেনেরই সঙ্গে প্রতিযোগী না হতে চায় সেটা নিশ্চিত করার অভিপ্রায়ে। ধর্মের প্রতি যে পক্ষপাত এই উপমহাদেশে বেশ প্রাচীন, তার ভূমিতে নতুন জলসিঞ্চন ঘটল। ব্রিটিশ যুগে এতদঞ্চলে তাই সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা যতটা দেখা গেছে সামন্তবাদবিরোধিতা ততটা দেখা যায়নি।

পাকিস্তানিরা একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রই প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা সেটিকে স্থাপন করেছিল ধর্মের ওপর। তাই নিজেরা ধর্মের ব্যাপারে কেবল উদাসীন নয়, ক্ষেত্রবিশেষে অধর্মচারী হলেও জনগণকে পশ্চাৎপদ ও নেশাগ্রস্ত করে রাখার জন্য ধর্মের কথা খুব বলত। উর্দুকে যখন তারা পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করতে চাইল তখন যুক্তিটা গণতান্ত্রিক ছিল না, কেননা উর্দু পাকিস্তানের অধিকাংশ নাগরিকের ভাষা তো ছিলই না, কোনো অঞ্চলের ভাষাও ছিল না।

 উর্দুর পক্ষে যুক্তিটা ছিল সামন্তবাদী। সেটা হলো এই যে, উর্দু ধর্মীয় ভাষা, আরবির কাছাকাছি, আর বিপরীত দিকে তাদের মতে বাংলা ছিল পৌত্তলিক ভাষা। বাংলা যে পৌত্তলিক, এই কথাটা আগেও বলা হয়েছে। বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা যে বাংলা নয়, সেটা যে উর্দু এই প্রচার পাকিস্তান হওয়ার আগেও করা হয়েছে। অনেকটা যেন তারই সূত্র ধরে পাকিস্তান আমলে বলা শুরু হলো যে, বাংলা ভাষার বর্ণমালা যেহেতু দেবনাগরীর কাছাকাছি, তাই তাকে বদলে আরবি হরফে লেখা দরকার। রবীন্দ্রনাথকে বাদ দাও, নজরুলকে সংশোধিত করো, কিছু কিছু শব্দ বড় বেশি হিন্দুত্ব, তাদের মুসলমানি করো- এসব পরামর্শ দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। পূর্ববঙ্গ রুখে দাঁড়াল। ফলে অন্তত এই রণাঙ্গনে সামন্তবাদী শক্তি পরাভূত হলো।

তা এখানে সে আপাতত পরাভূত হয়েছে বৈকি। এখন আর রাষ্ট্রভাষা উর্দু চাই- এ দাবি ঘোরতর মৌলবাদীরাও করবে না। বরঞ্চ এখন দেখা যাচ্ছে মৌলবাদীরা বলার চেষ্টা করছে যে, ভাষা আন্দোলনে তারাও ছিল। আন্দোলনের সূত্রপাত নাকি তারাই ঘটিয়েছে। এখন নাকি ইতিহাসকে বিকৃত করে তাদের অস্বীকার করা হচ্ছে। বীজটি যখন বপন করা হচ্ছিল, তখন কাছে ছিল, হয়তো মাটিও দু-এক মুঠো ফেলেছে আশপাশে, তাই বৃক্ষটি তাদেরই সম্পত্তি- এই তাদের দাবি। দাবিটি যেমনই হোক, এ যে বৃক্ষটিকে মূল্যবান বলে স্বীকার করছে, তাকে যে কাটতে চাইছে না, অতীতে যেমন চেয়েছিল সেটাই অধিক তাৎপর্যপূর্ণ।

কিন্তু সেই সঙ্গে এও লক্ষ্য করার বিষয় যে, ফেব্রুয়ারি মাস এলেই মৌলবাদীদের অস্বস্তি শুরু হয়ে যায়। নিজেদের দৈনিকে এরা মাতৃভাষা আল্লার শ্রেষ্ঠ দান বলে স্তম্ভ তুলে প্রচার শুরু করে। এমনভাবে যাতে মনে হবে- এই আমাদের মাতৃভাষা মানুষে সৃষ্টি করেনি, আকাশ থেকে ঝরে পড়েছে। সেই সঙ্গে উরস, জলসা, মাহফিল ইত্যাদির ধূম ফেলে দেয়। যেমন একবার একুশে ফেব্রুয়ারি শেষ হতে না হতেই, ২৪ তারিখেই জামায়াতের দৈনিকটিতে একটি ক্রোড়পত্র বের হয়েছে, যার শিরোনাম হচ্ছে, ‘শাহানশাহে তরিকত খাজাবাবা শাহ সুফী এনায়েতপুরী (কুঃ ছেঃ আঃ) ছাহেবের রেছালত দিবস উপলক্ষে পবিত্র উরস শরীফ, বিশ্ব জাকের মঞ্জিল পাক দরবার শরীফ, আটরশি, ফরিদপুর।’ সেই সামন্তবাদের দিকেই টানাটানি বটে, যদিও এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে নয়।

রাষ্ট্রীয়ভাবেও কি টানা হচ্ছে না জনগণকে সামন্তবাদের দিকে? এরশাদ সরকার শাসনতন্ত্রে সংশোধনী এনে রাষ্ট্রীয় ধর্ম প্রবর্তন করেছিল। বাহাত্তরে এ ছিল অকল্পনীয়, কিন্তু অষ্টাশিতে এটা সম্ভব হয়েছে। অন্য কোনো জোরে নয়, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার জোরে। এরশাদ হয়তো আরও এগোতে চাইতেন, যদিও নিজে তিনি ধর্মকর্মের জন্য বিখ্যাত ছিলেন না। লোকে বরঞ্চ উল্টোটাই জানত। তার পতনের পর তার বাসগৃহে জমজমের পবিত্র পানি পাওয়া যায়নি, পাওয়া গেছে ইসলাম-নিষিদ্ধ মূল্যবান সব পানীয় এবং তার বান্ধবীদের সংখ্যা নিয়ে তার উকিল স্বয়ং বড়াই করেছেন, আদালতে। কিন্তু ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে উৎসাহিত করার ব্যাপারে তার আগ্রহ ছিল অধিক। 

ইচ্ছে ছিল ক্ষমতায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত রাখার স্বার্থে জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করা, এবং একটি আধ্যাত্মিক আবরণে নিজের সব অপকর্মকে আচ্ছাদিত রাখা। তার আমলে উরস, মাহফিল, হুজুর কেবলাদের অলৌকিক তৎপরতা মাদক ব্যবসায়ের মতোই গ্রাস করে ফেলতে চাইছিল বাংলাদেশকে। এখনো তা যে শেষ হয়ে গেছে তেমন নয়। সেই সঙ্গে যে জামায়াতে ইসলামী মুক্তিযুদ্ধে পরাভূত হয়ে গিয়েছিল সেও আবার ফেরত এসেছে। বন্ধ জলাশয়ের দুষ্ট মশা-মাছির মতো জাতির স্বাস্থ্যকে সে আবার দংশন করছে, ঘ্যান ঘ্যান করে। যেন আমরা আবার সেই পাকিস্তানে ফিরে গেছি।
অনেকটা যেন সেরকমই। কেননা আসল ঘটনা তো হচ্ছে সেই প্রত্যাখাত আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রত্যাবর্তন। এরই ফলে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হয়েও রাষ্ট্রভাষা হচ্ছে না। এবং সামন্তবাদ বিলীন হয়েও বিলীন হতে চাইছে না। বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের ওপর যেদিন ক্রোড়পত্র বের হয়েছে, সেদিনই তো আমাদের অন্য সবগুলো জাতীয় দৈনিকে বিশ্ব ক্রিকেটের ওপর ক্রোড়পত্র বের হলো। একদিকে সামন্তবাদী বিশ্ব, অন্যদিকে পুঁজিবাদী বিশ্ব। একদিকে জাকের, অপরদিকে ক্রিকেট। 

কোনোটাই আমাদের নয়, মাঝখানে আমরা সত্যি সত্যি তৃতীয় বিশ্বে রয়েছি। আমরা যাব কোথায়? আমাদের বুর্জোয়ারা আত্মসমর্পণ করেছে সাম্রাজ্যবাদের কাছে, সেই আত্মসমর্পণ প্রমাণ করেছে যে, তারা মুখে যাই প্রচার করুক আসলে জাতীয়তাবাদী নয়। একাত্তরে যারা পাকিস্তানি ঘাতকদের মেনে নিয়েছে, তারা যেমন জাতীয়তাবাদী ছিল না এবং যতই তারা জাতীয়তাবাদী বলে দাবি করত, ততই যেমন প্রমাণ হতো যে আসলে তারা জাতীয় বেঈমান, এখনো সেই ঘটনাই চলছে, প্রায় হুবহু। পাকিস্তানিরা নেই, কিন্তু তাদের প্রভু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তো রয়েছে, আগের চেয়ে আরও দাম্ভিক রূপেই।

ভাষা আন্দোলন বলছে যেতে হবে সামনে, পুঁজিবাদী ও সামন্তবাদী উভয় বিশ্বকে ঠেলে দূরে সরিয়ে। যেতে হবে ইহজাগতিকতার পথ ধরে প্রকৃত গণতন্ত্রের অভিমুখে, যে গণতন্ত্রের মূল কথাটা হচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের সুযোগ ও অধিকারের সাম্য। এই পথে আমলাতন্ত্র একটি বড় প্রতিবন্ধক। কেননা আসল ক্ষমতা তার হাতেই, এবং সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত মিত্র সে, যেমন প্রকাশ্যে তারও চেয়ে বেশি গোপনে। ইরান ও আলজেরিয়ার ঘটনা দেখে সাম্রাজ্যবাদ হয়তো আপাতত সামন্তবাদের ব্যাপারে কিছুটা কম উৎসাহ দেখাতে পারে। কিন্তু সেটা আপাতত ও আপেক্ষিক মাত্র, বিশ্বে যতদিন সাম্রাজ্যবাদ আছে ততদিন সামন্তবাদ থাকবে, কোনো না কোনোভাবে, কোথাও না কোথাও। সাম্রাজ্যবাদকে যদি ছাড় দেওয়া যায়, তাহলে তো কথাই নেই, পুঁজিবাদের দৈত্য ও সামন্তবাদের বামন উভয়েই রক্ত খাবে। খাচ্ছে এখনো। ভাষা আন্দোলন দু-কাজই করে, পথ দেখায় না শুধু, নিরিখও তুলে ধরে একসঙ্গে।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সংস্কার অভিযাত্রা কতদূর

প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০১:২৭ পিএম
সংস্কার অভিযাত্রা কতদূর
রায়হান আহমেদ তপাদার

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর জোরেশোরে উঠে এসেছে রাষ্ট্রসংস্কারের বিষয়টি। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর সংস্কারের রূপরেখা নির্ধারণের জন্য সুপারিশ প্রণয়নের লক্ষ্যে এখন পর্যন্ত ১১টি কমিশন গঠন করা হয়েছে। এদিকে বিএনপি বলেছে, এটা শুধু চ্যালেঞ্জের ব্যাপার নয় বরং এখানে বাস্তব বিষয় হলো- সংস্কার হবে কি হবে না- সেটা ঠিক করবে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদ ও জনপ্রতিনিধিরা। দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ হলে সবার সব প্রস্তাব সংসদে যাবে। 

সেখানে এগুলো নিয়ে আলোচনা হবে। তার পর দেশ ও জাতির জন্য যেটা যেমন করা দরকার সংসদ তাই করবে। এজন্যই বিএনপি জুন-জুলাইয়ের মধ্যেই নির্বাচন চায়। অনেকের মতে, সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দরকার হবে সংবিধান সংশোধন করে কোনো কিছু গ্রহণের জন্য। সংসদ ছাড়া এসব আলোচনার গুরুত্ব কতটা, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। বিভিন্ন সুপারিশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাই হবে কেন্দ্রীয় ভূমিকা।

রাজনৈতিক দল, বিশ্লেষক ও সংস্কার কমিশনের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন তাদের কেউ কেউ বলছেন, সুপারিশগুলো সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে কিংবা তাদের মধ্যে যদি ন্যূনতম ঐকমত্য না হয়, তাহলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সুপারিশ শেষ পর্যন্ত কাগজেই থেকে যেতে পারে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য তাদের স্বল্পমেয়াদি অবস্থানের কারণে যেহেতু শুধু প্রস্তাবই পেশ করতে পারবে বলে মনে হয়, তার পরও জরুরি সমস্যাগুলো সমাধানে জরুরি মনোনিবেশ তাদের করতে হবেই। সে জন্য তাদের একটি প্রধান কাজ হবে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির বেঞ্চমার্কগুলো সঠিকভাবে নির্ণয় করা। 

এ ছাড়া ঘাড়ের ওপর পড়ে যাওয়া সমস্যাগুলোর সমাধান করে জনগণকে স্বস্তি দেওয়াও কিন্তু এ সরকারের দায়িত্ব। তাদের বন্ধুরাও এই মুহূর্তে তাই বলছে। সুতরাং, তাদের মূল দায়িত্ব হবে সঠিক ও স্বল্পসংখ্যক পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এ ছাড়া নানা রকম সৃজনশীল অপ্রচলিত সংস্কার প্রস্তাব বর্তমানে উত্থাপিত হয়েছে, সেগুলো বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের টাস্কফোর্স ও কমিশনগুলোও কিছু পেশ করেছে। কিছু সুপারিশ প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে। অর্থনীতির অবস্থানের ওপর যে শ্বেতপত্র প্রকাশিত হয়েছে তার বিভিন্ন তথ্য নিয়েও পক্ষ-বিপক্ষে নানা আলোচনা রয়েছে। এর মানে বিগত সরকারের সবকিছুই ঠিক ছিল না- সেটাও সত্য নয়। সম্প্রতি দুর্নীতি ও বৈষম্য চরমভাবে বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও আসলে কীভাবে চরম দারিদ্র্য হার কমল ও মানবউন্নয়ন সূচকগুলোয় উন্নতি অর্জিত হলো- সেটি বর্তমান উন্নয়নবিদদের তলিয়ে দেখা দরকার। কিছুই অর্জিত হয়নি- এ কথা যেমন সত্য নয়, কিন্তু যেটুকু অর্জন সম্ভব ছিল তা অনেকখানি দুর্নীতি ও বৈষম্যের কারণে অর্জন করা যে সম্ভব হয়নি তা আজ সবাই স্বীকার করেন। 

সুতরাং স্বভাবতই বোঝা যাচ্ছে আগামী যে বাজেট অন্তর্বর্তী সরকার প্রণয়ন করতে যাচ্ছে তাতে তাদের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে- কীভাবে বৈদেশিক খাতে উদ্বৃত্ত ব্যালান্স তৈরি করে ক্রমবর্ধমান ডলার রিজার্ভ তারা তৈরি করবে বা করার সূচনা করবে।

নতুন ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাণিজ্য, বৈদেশিক ঋণ ও বিনিয়োগনীতি কী হবে? বাজেটে যে প্রচুর রাজস্বঘাটতি থাকবে তা কীভাবে পূরণ করবে? ব্যক্তি বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধির হারকে যথাসম্ভব ধরে রাখা যায় কীভাবে, তার উপায় উদ্ভাবন অর্থাৎ বিনিয়োগ আবহাওয়ার উন্নতি করে কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধি কীভাবে অব্যাহত রাখবে? মুদ্রাস্ফীতি ও মন্দা দুই-ই কাটিয়ে অর্থনীতিতে কীভাবে সামষ্টিক স্থিতিশীলতা আনবে? এবং সর্বশেষ, কয়েকটি চিহ্নিত খাতে সুশাসন কীভাবে প্রতিষ্ঠিত করবে? নতুন প্রতিষ্ঠান ও নতুন সৎ ও দক্ষ মানবসম্পদ কোথায় পাবে, যাতে শুধু ভালো আইন বা নীতিই প্রণীত হবে না, তা বাস্তবায়িতও হবে। নিঃসন্দেহে এগুলো খুবই চ্যালেঞ্জিং ও পুঞ্জীভূত কঠিন সমস্যা। কিন্তু এগুলোর জন্য যেসব জরুরি নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন- বিশেষত আর্থিক খাত, জ্বালানি খাত, আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় যেসব আশু জরুরি সংস্কার শুরু করা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়েছে, তা শুরু না করতে পারলে জনগণের মনে প্রয়োজনীয় বিশ্বাস, আস্থা বা স্বস্তি ফিরিয়ে আনা যাবে না এবং গোলযোগ ও সামাজিক বিরোধ আরও বৃদ্ধি পাবে। যার সুস্পষ্ট লক্ষণ এরই মধ্যে দেখা যাচ্ছে।

 সুশাসনের ও শৃঙ্খলার জন্য যে সমস্যাগুলো জরুরিভাবে মোকাবিলা করা দরকার ছিল সেগুলো কতটুকু এগোচ্ছে তাও ক্ষতিয়ে দেখা দরকার। যেমন- জুলাই আন্দোলনকালে নিহত-আহতদের একটি সুস্পষ্ট সঠিক তালিকা প্রণয়ন, চিকিৎসা প্রদান এবং পুনর্বাসন। যেসব পুলিশ, শিক্ষা কর্মকর্তা, আমলা, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য কমবেশি অভিযুক্ত হয়েছেন, তাদের এখন নিরপেক্ষ সুষ্ঠু তালিকা প্রণয়ন করে এদের মধ্যে যারা নির্দেশ পালনে বাধ্য হয়েছিলেন অথবা যাদের অপরাধ লঘু, তাদের শনাক্ত করে মব জাস্টিসের মধ্যে ফেলে না দিয়ে একটি সুষ্ঠু, ন্যায়বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার প্রয়োজন রয়েছে।

ব্যক্তি বা দলীয় গ্রুপের হাতে, রাস্তাঘাটের শক্তির হাতে আইন না তুলে দিয়ে সুষ্ঠু ও দ্রুত বিচারের পদক্ষেপ নিতে পারলে দেশে কিছুটা শৃঙ্খলা এরই মধ্যে ফিরে আসত। পুলিশও আস্থা নিয়ে কাজে ফিরে আসতে সক্ষম হতো বলে মনে হয়। প্রথম স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হঠাৎ বদল কেন হলেন সেটা স্পষ্ট নয়। সংবিধান কমিশনে কেন একজনকে বদলে বিদেশ থেকে আগত একজনকে নিয়োগ দেওয়া হলো তাও বোধগম্য নয়। কেন ধর্মীয় রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে তাও বোঝা মুশকিল। মূলধারার গণতান্ত্রিক রাজনীতিবিদদের শক্তিশালী ভূমিকা তৈরি না করে নতুন পার্টি তৈরি করতে চাইলে সেটাও কাম্য নয়। 

অনেক ক্ষেত্রেই বড় রকমের প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে বিভাজনের দাগ ক্রমেই মোটা করে চলেছে। প্রজাতন্ত্রের মালিক যদি জনগণই হয়ে থাকেন তাহলে আমলারা জনগণের স্বার্থ যেভাবে আমলে নেওয়ার কথা, সেভাবে নেন না কেন? কারণ বাংলাদেশের বাস্তবতায় আমলারাই মূলত অনেক কিছুর কারিগর এবং যুথবদ্ধ। তারা শাসক-প্রশাসক। সাম্প্রতিক আলোচিত সংস্কার প্রশ্নে এসে তারা সেই হিম্মত আবারও দেখিয়ে দিচ্ছেন। কাজকর্মে শাসনের মনোভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, তারা অন্যদের সংস্কার করতে চান।

 নিজেরা সংস্কার হতে চান না। তাদেরই একটা বিশেষ গ্রুপ বিগত স্বৈরাচারকে শক্তি জজোগান দিয়েছে। দানবীয় ফ্যাসিস্ট করে তুলেছে। টানা দীর্ঘ সময় টিকিয়ে রেখেছে। শেষতক ছাত্র-জনতার চরম ধাক্কা খেয়েছে। সরকার বিদায় নিয়েছে। দেশের মানুষ তাদের কাছ থেকে সেবার পরিবর্তে শোষণের শিকারই হন বেশি। যদিও আমলা বা প্রশাসন বাদ দিলে দেশ চলবে না। বখে যাওয়া, বেপরোয়া হয়ে ওঠার লাগাম টেনে একটা বন্দোবস্তে আসা এখন সময়ের দাবি। এ সরকার তা না পারলে ভবিষ্যতে আর পারার আশা থাকবে না। কারণ এমন সুযোগ সব সময় আসে না। এ সরকার প্রশাসনকে একটা বন্দোবস্তের জায়গায় এনে দিতে পারলে ভবিষ্যৎ নির্বাচিত সরকার সেটাকে একটা কাঠমোতে আনতে পারবে।

লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক 
[email protected]

বিশ্বব্যবস্থায় আধিপত্য বিস্তার অবসানের পথে

প্রকাশ: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০১:২৯ পিএম
বিশ্বব্যবস্থায় আধিপত্য বিস্তার অবসানের পথে
মিনোচে শফিক

‘পুরানো পৃথিবী আজ অবসানের পথে এবং নতুন বিশ্ব জন্ম নেওয়ার জন্য সংগ্রাম করছে। এখন সময় হলো দানবদের’। আন্তোনিও গ্রামসির এই বিখ্যাত উদ্ধৃতিটি আজ অনেকটা প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে। কারণ আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গত শতাব্দী থেকে অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। 

দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনার মাধ্যমে এমনটি হয়েছিল। প্রথমটি ১৯৪৫ সালের পরে এসেছিল, যখন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা জাতিসংঘ এবং ব্রেটন উডস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দ্বিতীয়টি ঘটেছিল ১৯৮৯ সালে, যখন বার্লিন প্রাচীরের পতনে স্নায়ুযুদ্ধে পশ্চিমের বিজয় হয়েছিল। তার পর থেকে আমরা উচ্চমাত্রার বৈশ্বিক একীকরণের মাধ্যমে এক মেরুকরণ বিশ্বে বসবাস করছি। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সম্পর্কের গঠনকারী নিয়মাবলি মার্কিন নিরাপত্তা গ্যারান্টির মাধ্যমে নিশ্চিত হতো। ধারণা করা হয়, অর্থনৈতিক পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে অতিক্রম করবে। আজকের পৃথিবীটা সম্পূর্ণই আলাদা। 

এখন বহুমুখী বিশ্ব যেখানে চীন, রাশিয়া, ভারত, তুরস্ক, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো পুরানো আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে যাচ্ছে। এসব দেশ অন্য উদীয়মান শক্তিগুলোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার নিয়মকানুন গঠনে জোর দাবি রাখে। ইতোমধ্যে ‘সর্বজনীন মূল্যবোধ’ এবং ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়’-এর প্রতি মানুষের বিশ্বাস কমে গেছে। গাজা, সুদান এবং অনেক জায়গায় মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালীন ভ্যাকসিন মজুদকারী ধনী দেশগুলো ভণ্ডামি ও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। 

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউরোপ এবং জাপানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা গ্যারান্টিগুলো প্রত্যাহার করা, অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা ছেড়ে দেওয়া এবং বন্ধু ও শত্রুদের ওপর একইভাবে বাণিজ্য শুল্কারোপের হুমকি দিয়েছেন। সিস্টেমের গ্যারান্টার যখন এটি থেকে দূরে চলে যায়, তখন কী হতে পারে? আমরা হয়তো এমন একটি শূন্য-ক্রম জগতের দিকে যাচ্ছি, যেখানে নিয়মগুলো শক্তির মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত হবে। ক্ষুদ্র দেশগুলোর টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে। 

এটি একটি বৃহৎ আঞ্চলিক ব্লকের বিশ্ব হতে যাচ্ছে, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার গোলার্ধে আধিপত্য বিস্তার করছে। চীন পূর্ব এশিয়ার ওপর আধিপত্য বিরাজ করছে এবং রাশিয়া সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করে যাচ্ছে। আদর্শগতভাবে, আমরা একটি নতুন নিয়মভিত্তিক আদেশে আমাদের পথ খুঁজে পেতে পারি, যা আমাদের বহুমুখী বিশ্বকে আরও সঠিকভাবে প্রতিফলিত করবে। সেখানে যাওয়ার জন্য আমাদের আরও ভালোভাবে বুঝতে হবে কেন পুরানো অর্ডার ব্যর্থ হয়েছে। 
উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনা তাদের পর্যাপ্ত সহযোগিতা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। 

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কার বা ব্রেটন উডস প্রতিষ্ঠানে ভোটের মাধ্যমে তা শেয়ার করা হোক। উন্নত অর্থনীতিতে উপেক্ষিত কারণ হলো বিশ্ব অর্থনীতির উন্নয়নের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে জাতীয় পর্যায়ে সামাজিক চুক্তির ব্যর্থতা।

সামাজিক চুক্তি- নিয়ম, অধিকার ও বাধ্যবাধকতা যা জাতীয় সংহতি এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। পরিবারগুলোকে সংগঠিত করা থেকে শুরু করে বেকারত্ব, অসুস্থতা এবং বার্ধক্যের মতো চ্যালেঞ্জগুলো কীভাবে মোকাবিলা করা যায়- সেগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করে। সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তার এই ব্যবস্থাগুলোর ব্যর্থতা উন্নত অর্থনীতিতে তীব্র ছিল। উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো একসময় পুরানো আদেশের মাধ্যমে চলত। 

যে দেশগুলো বিশ্বব্যবস্থা তৈরি করেছিল এবং এটি থেকে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছিল, তারা এখন তাদের সামাজিক চুক্তিতে সবচেয়ে বেশি চাপে আছে। বিশ্বায়ন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হচ্ছে তারা। 

এই গতিশীলতা অর্থনীতিবিদদের পক্ষে উপলব্ধি করা প্রায়শই কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ পেশাটি ইতিবাচক-সমষ্টির ধারণার মধ্যে নিহিত থাকে। দেশগুলো বাণিজ্য থেকে উপকৃত হয়। ভোক্তাদের জন্য প্রতিযোগিতা এবং দক্ষতা বৃদ্ধিকারী নীতিগুলো সমাজকে আরও ভালো করে তোলে। অর্থনীতিবিদরা শূন্য-সমষ্টি চিন্তায় কম পারদর্শী। তারা বিশ্বাস করেন যে, যখন কেউ লাভবান হয়, তখন অন্য কেউ অবশ্যই হারাতে থাকে। এটি সাম্প্রতিক নীতিনির্ধারণের অ্যাকিলিসের হিল যা বণ্টনসংক্রান্ত বিষয়গুলোয় মনোযোগ হারিয়ে ফেলেছে। তারা কীভাবে ইতিবাচক-সমষ্টির অর্থনৈতিক নীতিগুলোর জন্য রাজনৈতিক সমর্থন বজায় রাখা যায় তা বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়েছে। 

আমাদের বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলোর সবচেয়ে বড় উদাহরণটি বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করা সমীক্ষায় পাওয়া যায় যে, তারা মনে করে তাদের সন্তানরা তাদের চেয়ে ভালো বা খারাপ হবে। প্রতিটি উন্নত অর্থনীতিতে- বিশেষ করে ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানে অভিভাবকরা বিশ্বাস করেন তাদের সন্তানদের অবস্থা আরও খারাপ হবে। বিপরীতভাবে, প্রতিটি উন্নয়নশীল দেশে বিপরীতটা সত্য। বেশির ভাগ উন্নত অর্থনীতিতে সহস্রাব্দ এবং জেনারদের প্রকৃত আয় একই বয়সে তাদের বাবা-মায়ের আয়ের তুলনায় খুব কম। তারা উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি ঋণী এবং বাড়ির মালিক হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। ধীর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সীমিত সামাজিক গতিশীলতার সময়কালে বেড়ে ওঠা লোকেদের শূন্য-সমষ্টির মানসিকতা বিকাশের সম্ভাবনা বেশি। যেহেতু উন্নত অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে এবং সামাজিক গতিশীলতা হ্রাস পেয়েছে।  বাম এবং ডান উভয়জুড়েই শূন্য-সমষ্টির রাজনীতির সমর্থন বেড়েছে। 

হাভার্ড এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের অর্থনীতিবিদদের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় আমেরিকানদের চার প্রজন্মের শূন্য-সমষ্টি চিন্তার উৎস এবং প্রভাব পরীক্ষা করেছে। তাতে দেখা যায়,  ‘শূন্য-সমষ্টির মানসিকতা সরকারি পুনর্বণ্টন, জাতি এবং লিঙ্গভিত্তিক ইতিবাচক পদক্ষেপ এবং সীমাবদ্ধ অভিবাসন নীতিগুলোর সঙ্গে যুক্ত’। এই ধরনের চিন্তাভাবনা ব্যক্তি এবং তাদের পূর্বপুরুষদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে চিহ্নিত করা যেতে পারে, যার মধ্যে তারা কতটা আন্তপ্রজন্মীয় ঊর্ধ্বমুখী গতিশীলতা অর্জন করেছে। তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন হয়েছে বা বৃহত্তর অভিবাসী জনসংখ্যার সম্প্রদায়গুলোতে বসবাস করেছে কি না এবং তারা দাসত্ব করেছে কি না।

যদিও বেশির ভাগ দেশে মেয়ে এবং ছেলেদের জন্য শিক্ষার সমান সুযোগ রয়েছে, তবুও কর্মক্ষেত্রে নারীরা অনগ্রসর। কারণ তারা পুরুষদের তুলনায় প্রতিদিন দুই ঘণ্টা বেশি অবৈতনিক শ্রম দেয়; যার মধ্যে রয়েছে গৃহস্থালির কাজ এবং যত্ন নেওয়া। পিতা-মাতার ছুটিতে নমনীয়তা, পরিবারকে সমর্থন করাতে পাবলিক তহবিল বৃদ্ধি এবং বাড়িতে শ্রমের ন্যায্য বিভাজন সমাজে নারী প্রতিভার আরও ভালো ব্যবহার করতে সক্ষম করবে। 
প্রতিটি সমাজে একটি ন্যূনতম আয়ের স্তর স্থাপন করা সম্ভব, যার নিচে কেউ পড়বে না। এটি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নগদ অর্থ-হস্তান্তর প্রোগ্রাম বা উন্নত অর্থনীতিতে স্বল্প মজুরি কর্মীদের জন্য ট্যাক্স ক্রেডিটের মাধ্যমে অর্জন করা যেতে পারে। আমি যেকোনো দেশে সর্বজনীন মৌলিক আয় সম্পর্কে সন্দিহান রয়েছি। কারণ, যাদের প্রয়োজন নেই তাদেরই অর্থ প্রদান করা হচ্ছে। 

অর্থনীতিবিদরা যেমন শূন্য-সমষ্টির চিন্তাভাবনা এবং বণ্টনসংক্রান্ত বিষয়গুলোতে যথেষ্ট মনোযোগ দেন না, তেমনি তারা পরিচয়ের গুরুত্বকে অবমূল্যায়ন করার প্রবণতাও দেখান। আমি বিশ্বাস করি, অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক এবং সামাজিক নীতিগুলো সমাজকে আবার একত্রিত করতে পারে। এই বিশ্বাস থেকেই আমি আমার বইটি ‘ওয়াট উই ও ইচ আদার’ লিখতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম।  

সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো আমাকে একটি কার্যকর সামাজিক চুক্তি তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। পরিচয় হলো এমন একটা বিষয় যা সামাজিক চুক্তিকে একসঙ্গে ধরে রাখে। জাতীয়তাবাদের প্রয়াত পণ্ডিত আর্নেস্ট গেলনার শিক্ষাব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক একতাবদ্ধকরণ, সাধারণ ভাষা এবং জাতীয় পরিচয়ের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছিলেন। 

সুইজারল্যান্ড এবং ভারতের মতো দেশগুলো দেখায় যে, একাধিক ভাষাসহ ফেডারেল সিস্টেমেও একটি জাতীয় পরিচয় গড়ে তোলা সম্ভব। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, পরিচয় কোনো মনোলিথ (পাথরের স্তম্ভ) নয়, বা এটি শুধু জাতিগত বা ধর্ম সম্পর্কও নয়। আমাদের প্রত্যেকেরই শিক্ষা, পেশা, যৌন অভিযোজন এবং ব্যক্তিগত আগ্রহের বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে একাধিক পরিচয় রয়েছে।  কিন্তু ভাগ্যের অনুভূতি যা সমাজকে একত্রিত করে এবং নাগরিকত্বের দায়িত্ব নিতে আমাদের অনুপ্রাণিত করে। অভিবাসনের বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনতাবাদী রাজনীতিবিদদের মাধ্যমে এই সমস্যা উত্থাপিত হয়েছে। 

যদিও বেশির ভাগ অর্থনীতিবিদ যুক্তি দেখান যে, অভিবাসন সাধারণত বৃদ্ধির জন্য ভালো। অভিবাসন নিয়ে অর্থনৈতিক বিতর্ক খুবই কম। পরিচয়ের ওপর কেন্দ্রীভূত হওয়া ঠিক নয়। সমাজিক মানুষ হিসেবে আমরা কে এবং কোথায় থেকে এসেছি এটা বিষয় নয়। সবাইকে সামাজিক চুক্তিতে অংশ নেওয়ার অনুমতি দেওয়া উচিত। এ কারণেই অভিবাসনবিরোধী বক্তব্য প্রায়শই অভিবাসীদের বা উদ্বাস্তুদের আবাসন, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য পরিচর্যার মতো সরকারি পরিষেবাগুলোর ওপর প্রভাব পড়ে। যেগুলোকে কয়েক প্রজন্মের অবদানের মাধ্যমে অর্জিত সুবিধা হিসেবে দেখা হয়। 

আমরা বৈশ্বিক ব্যবস্থাপনায় মৌলিক পুনর্বিন্যাসের মধ্যে আছি, যার ফল এখনো অস্পষ্ট। আমি নিশ্চিত যে,  একটি ইতিবাচক-সমষ্টি আন্তর্জাতিক আদেশ অর্জনের জন্য শক্তিশালী দেশ-স্তরের সামাজিক চুক্তির প্রয়োজন হবে, যা অগ্রগতি ও নিরাপত্তা প্রদান করবে।  যারা শূন্য-সমষ্টি, বর্জনীয় এবং স্বার্থপর তাদের আমরা বৈশ্বিক বিবেচনায় আধিপত্য বিস্তার করতে দিতে পারি না। এই জাতীয় সমস্যাগুলোর ওপর কাজ করার মাধ্যমে, আমরা একটি ন্যায্য আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা তৈরির সম্ভাবনা বাড়াতে পারি, যা সবার জন্য আরও ভালো ফল বয়ে আনবে। 

লেখক: সাবেক সভাপতি, কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স, যুক্তরাষ্ট্র
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল