
রাজনীতির গতিপ্রবাহ বাঁক পরিবর্তনের সময় সমাজে নতুন নতুন কিছু ধারণা ও বিশ্বাসের উদ্ভব ঘটে। আমাদের সমাজ অনুন্নত বলে বস্তুত মৌলিকভাবে নতুন দেশজ কোনো ধারণা এখানে স্থান পায় না। যা স্থান পেয়ে আলোচিত হয়, তার সবই পাশ্চাত্য থেকে আগত। ১৯৭২ সালে স্বাধীন সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পরপরই এমনিভাবে সমাজতন্ত্র, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ, সর্বহারাবাদ, বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্র ইত্যাদি রাজনৈতিক তত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা দেখা যায়। সমাজের মূলধারার ভিন্নধর্মী চাপের কারণে নয়, ওই নতুন তত্ত্বগুলোর নিজস্ব দুর্বলতা এবং জনবিচ্ছিন্নতার কারণে ওগুলো জনমানুষের ওপর কোনো প্রভাব ফেলতেই সক্ষম হয়নি। স্বাধীন দেশের প্রথম নির্বাচন অর্থাৎ ১৯৭৩-এর নির্বাচনে এসব নবীন মতাবলম্বীর কোনো জনস্বীকৃতি ঘটেনি।
সাধারণ গণতন্ত্রীরাই ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মতোই বিপুলভাবে জয়লাভ করে। আবার ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে আইনসংগত পথেই অর্থাৎ ভোটাভুটির মাধ্যমেই সংসদে বাংলাদেশের কৃষক ও শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণের নামকরণে বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক লীগ বা বাকশাল প্রতিষ্ঠিত হয়। এই আইন দেশের অন্য সব রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করে। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর এই ব্যবস্থা অর্থাৎ একদলীয় ব্যবস্থা তার অস্তিত্ব ও শিকড় দুই-ই হারায়। ১৯৭৭-এর পর সেই পুরোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরে আসে। তার পর কালের দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় দুটি নতুন রাজনৈতিক তত্ত্ব এই দেশে শোনা যেতে থাকে। তত্ত্বের একটি হলো অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনব্যবস্থা। এই তত্ত্বের আলোচনা প্রবল জনবিক্ষোভে বিতাড়িত গত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
অন্তর্ভুক্তিমূলক বলতে তারা বোঝাতেন সমাজের সব শ্রেণির মত ও পেশার মানুষের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের আইনসংগত ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। আওয়ামী লীগের বিদায়ের পর ২০২৪-এর গণ-আন্দোলনের পর অধিষ্ঠিত সরকার এবং এর পেছনের মাস্টারমাইন্ড তথা সমন্বয়করা অন্তর্ভুক্তিমূলক তত্ত্বের পাশাপাশি জাতীয় ঐকমত্য নামের আরেক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার কথা জোর দিয়ে বলছেন। যদি অন্তর্ভুক্তিমূলক তত্ত্বের বিশ্লেষণে যাই তাহলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী একদিকে উঁচু শ্রেণির শিক্ষিত আমলা, ব্যবসায়ী, শিক্ষক ও অন্যান্য বুদ্ধিজীবী, প্রকৌশলী, চিকিৎসক ইত্যাদি শ্রেণি বিভাজনে অস্তিত্বমান। অন্যদিকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিপুলসংখ্যক কৃষক, গার্মেন্ট ও বিভিন্ন শিল্পশ্রমিক, সড়ক ও নৌযানশ্রমিক, নির্মাণশ্রমিক, স্বল্পবেতনভুক স্কুলশিক্ষক, গৃহকর্মী রয়েছেন। এই নিম্নোক্ত শ্রেণির জনগোষ্ঠীর হার সামগ্রিক শ্রেণিগুলোর শতকরা প্রায় ৮৫ ভাগ।
অন্তর্ভুক্তির আইনি ভিত্তি হচ্ছে সংসদে সব শ্রেণি ও পেশার মানুষের নির্বাচিত প্রতিনিধি সংরক্ষণের ব্যবস্থা। কিন্তু ১৯৭০ সালের নির্বাচনের শ্রেণিচরিত্র যদি দেখা যায়, তাতে প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত বাঙালি সংসদ সদস্যদের মধ্যে সবাই ছিলেন শিক্ষিত রাজনীতিবিদ, উঁচু শ্রেণির ব্যবসায়ী, সাবেক শীর্ষ আমলা এবং অল্প কিছু বুদ্ধিজীবী। তাদের মধ্যে উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো কৃষক বা শিল্প ও পরিবহনশ্রমিকের একজনও ছিলেন না। এই শ্রেণির কোনো মানুষ কোনো দল থেকে নির্বাচনের মনোনয়নও লাভ করেননি। পরবর্তী প্রতিটি নির্বাচনে সেই একই চিত্র পরিস্ফুট হয়েছে। সমাজ পরিবর্তনের ধারায় বিশেষ করে তৈরি পোশাকশিল্প এবং যানবাহন ও নির্মাণশিল্পে ব্যাপক উন্নয়নের ফলে এই পেশাগুলোতে কর্মরত মানুষের সংখ্যা বিপুলভাবে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু অন্তর্ভুক্তির স্লোগান সত্ত্বেও এই পেশাগত শ্রেণি থেকে কোনো প্রতিনিধি সংসদে নির্বাচিত হয়ে আসতে পারেননি।
আবার বর্তমানে জাতীয় ঐকমত্য শিরোনামে যে আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়োজনীয়তার কথা সমন্বয়ক, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা এবং বিপ্লবী সরকার-সংশ্লিষ্টরা জোর দিয়ে বলছেন, সেখানেও একটি প্রধান বিষয় বিবেচ্য বলে মনে করি। সেটি পরিবর্তন না হলে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার বাস্তবতা অধরা বলে প্রতীয়মান। তা হলো এই যে, দেশে বিতাড়িত আওয়ামী লীগসহ ৫৯টি রাজনৈতিক দল আছে। যদি কেবল বামপন্থিদের কথা ধরি, সেখানে দেখা যায় কোনোটি বামপন্থি আর কোনোটি প্রকৃত বামপন্থি। সর্বহারাদের মধ্যেও দেখা যায় তিনটি উপদল নাম নিয়ে অস্তিত্বমান, সকর্মক না হলেও। সিরাজ সিকদারের গবেষণা পরিষদ নামেও একটি সংস্থা আছে। লে. কর্নেল আবু তাহেরের ভাই অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন অপর একটি বাম দলের শীর্ষে আছেন। ওয়ার্কার্স মানে যারা কাজ করেন। সেখানে দেখা যাবে এর একটি হচ্ছে ওয়ার্কার্স পার্টি এবং আরেকটি বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি।
এই দুটির পার্থক্য তিন দশকেও বোঝা যায়নি। তেমনি কমরেড ফরহাদ, বাসদ, জিকু গ্রুপ, ইনু গ্রুপ, মার্কসের অনুসারী, লেনিনের অনুসারী, কমরেড মাওসেতুং-এর অনুসারী ইত্যাদি শ্রেণিতে সমাজতান্ত্রিক এবং সাম্যবাদীরা বিভাজিত। আর এর বাইরে একেবারে নবীন আমার বাংলাদেশ পার্টি, আমজনতার পার্টি এবং নিত্য উদীয়মান অন্যান্য দলের অস্তিত্ব সমাজকে স্বীকার করতে হচ্ছে। যেখানে পুরোনো জাতীয়তাবাদীদের দল বিএনপি প্রবলভাবে উপস্থিত। তার পাশে আবার লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টিও তার কর্মচাঞ্চল্য প্রকাশ করে থাকে।
আরেকদিকে আরেক গুচ্ছে দেশের জনগণের ৯০ ভাগ মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে কেবল জামায়াতে ইসলামী যথেষ্ট নয়। তরীকত, হেফাজত, জাকের পার্টি এবং ইসলামের নামে আরও অন্তত সাতটি রাজনৈতিক দল জনগণের প্রতিনিধিত্ব দাবি করছে। বিভিন্ন সংবাদ সম্মেলনে দেখা যায়, এসব দলের অনেক নেতা বক্তব্য রাখছেন দলের একাংশ/প্রকৃত অংশ/ রিট আবেদন করে অফিসের দখল পাওয়া অংশ হিসেবে। সেই সঙ্গে আছে বহিষ্কার, পাল্টা বহিষ্কার (আলাল ও দুলাল গ্রুপ, ফোরকান ও শাহেরজাদী গ্রুপ ইত্যাদি)। গণতান্ত্রিক যুক্তির স্বার্থে কেউ বলতেই পারেন যে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার নিশ্চিতকল্পে মানুষ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্ল্যাটফর্মে সমবেত হতেই পারেন।
কিন্তু কথা হলো, তাহলে জাতীয় ঐকমত্য কীভাবে, কার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হবে? আর যেখানে বাংলাদেশের মানুষ তাদের শিক্ষা এবং সম্পদের মালিকানার বিপুল বিভাজনের দ্বারাই মৌলিকভাবে বিভক্ত, সেখানে রাজনীতির ক্ষেত্রে ঐকমত্য এক অবাস্তব কল্পনা ছাড়া আর কী হতে পারে? যে দল নির্বাচনে জয় লাভ করবে তারা জাতীয় ঐকমত্যের জন্য আর কোনো কাজ করার কোনো যুক্তি খুঁজে পাবেন কি? অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থায় নারী, তৃতীয় লিঙ্গ এবং উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিপুলসংখ্যক কৃষক ও শ্রমিকের প্রতিনিধিত্ব কোথায়? বাস্তব ক্ষেত্রে এর কোনো সামাজিক ও আইনি সমর্থনের ভিত্তি তৈরি না করে এই দুটি ধারণা নিয়ে কেবল কথামালার রাজনীতি করার উদ্দেশ্য জাতির কাছে পরিষ্কার হওয়া দরকার। দেশের বৃহৎ দুটি রাজনৈতিক দল যে শ্রেণিবিভক্ত মানুষকে দীর্ঘদিন শাসন করে এসেছে, সামরিক শাসকরাও সেই একই কাজ একই পদ্ধতিতে করেছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু অংশ ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দলকে সমর্থন করে বলে প্রমাণ রয়েছে।
তবে তা জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ করার মতো শক্তি এই ৫৩ বছরে অর্জন করতে পারেনি। সমাজ একজন কাস্তে হাতে কৃষক, গাড়িচালক, গার্মেন্টশ্রমিক কিংবা একজন গৃহকর্মীকে সংসদের আসনে বসতে দেওয়ার ঔদার্য এবং যুক্তি গ্রহণ করার মতো অবস্থায় এসেছে কি না? এমনকি তারা সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে একই আসনে বসার ও একই আনুষ্ঠানিক পোশাক পরার স্তরেও আসেননি।
তাহলে বিভাজনের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী? আমরা কি কখনোই রাজনীতিতে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি করতে পারব না!
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রজাতন্ত্রের সাবেক কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল