
আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন কখন হবে, কীভাবে হবে- সেটি নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। নির্বাচন ইস্যুতে দেশে মোটা দাগে ত্রিমুখী পরিস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে একটি খসড়া সিদ্ধান্ত জানানো হলেও সংস্কার প্রশ্নে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ পরিষ্কার হয়নি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি জানিয়েছে যে, বিগত সরকারের অভিযুক্ত নেতা-কর্মীদের তথা আওয়ামী লীগের বিচার না হওয়া পর্যন্ত তারা নির্বাচন চায় না।
বিএনপি যৌক্তিক সময়ের মধ্যেই নির্বাচন বিষয়ে জোড় তাগিদ অব্যাহত রেখেছে। আর জামায়াতের পক্ষ থেকে এখনো নির্বাচন নিয়ে পরিষ্কার করে কোনো কিছু জানানো হয়নি। তা ছাড়া জাতীয় নির্বাচনের আগেই স্থানীয় নির্বাচনের প্রসঙ্গে আলাপ-আলোচনাও শুরু হয়েছে। এমনকি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং সরকারের পক্ষ থেকে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের বিষয়ে সমন্বয় করার বিষয়টি বিভিন্ন মহলে আলোচিত হচ্ছে। এ ছাড়া ছাত্রদের পক্ষ থেকে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের আলোচনাটি এখন বেশ তুঙ্গে রয়েছে। ছাত্ররা ইতোমধ্যে বিভিন্ন জেলায় জনসংযোগের কাজ অব্যাহত রেখেছেন। ফলে এমন ত্রিমুখী সংকট আমাদের নির্বাচনি রোডম্যাপের পথে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি করেছে।
গত ৫ আগস্টের পর সাধারণ জনগণের মধ্যে অনেকেরই একটি প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল যে, দেশে এক ধরনের সুশাসনের বাতাস বইতে শুরু করবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ হবে। চাঁদাবাজি, লুটতরাজ থাকবে না। এমনকি মানুষের মনে যেসব বিষয়ে ক্ষোভ ছিল সেগুলো ক্রমান্বয়ে দূর হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা দেখছি যে, অন্তর্বর্তী সরকারের পাঁচ মাস অতিবাহিত হয়েছে কিন্তু উল্লিখিত সমস্যাগুলো এবং জনগণের প্রত্যাশার যথাযথ রসায়ন তথা সমন্বয় হয়েছে কি না, সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। দেশে বিদ্যমান সংকটগুলোর সুস্পষ্ট সমাধানের কোনো সুনির্দিষ্ট ইঙ্গিত আমরা দেখতে পাচ্ছি কি না, সেটিও ভাবনার বিষয়। সম্প্রতি বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেছেন যে, তাদের হাতে তো কোনো আলাদিনের চেরাগ নেই যে তা দিয়ে দ্রব্যমূল্য সুইচ টিপে কমিয়ে আনবে।
তাহলে ধরেই নেওয়া যাচ্ছে এ বিষয়টির যথাযথ সমাধান শিগগিরই মিলবে না। তা ছাড়া সরকারি চাকরিজীবীদের মহার্ঘ ভাতার প্রসঙ্গ ওঠায় ইতোমধ্যেই বাজারে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আর দেড় মাস পরেই রমজান মাস শুরু। সেটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ হিসেবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সংকট নিয়ে আমরা খুবই শঙ্কায় পড়েছি। সরকারের অনেক কার্যক্রমের জন্য গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা হচ্ছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছে, আমরা কি আশানুরূপ বৈষম্যহীন রাষ্ট্র পাাব? পেলে কখন পাব? নির্দলীয় সরকার আশানুরূপ করতে না পারলে রাজনৈতিক সরকার করতে পারবে কি না- সেটি নিয়েও একটি মহল প্রশ্ন তুলছে।
ইতোমধ্যেই সংস্কার কমিশনগুলো তাদের কার্যক্রম অনেকটা গুছিয়ে নিয়ে আসছে। যেকোনো সময়েই সংস্কার কমিশনগুলো তাদের প্রতিবেদন জমা দেবে। অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন সময়ে দাবি করেছে যে তারা ছাত্রদের এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সাধারণ জনগণের গণ-আন্দোলন-পরবর্তী ম্যান্ডেটে ক্ষমতায় বসেছে। স্বাভাবিকভাবেই সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা বেশি হবে। কিন্তু সরকারের নানাবিধ ভুলত্রুটি, ভালো-মন্দ এবং চাওয়া-পাওয়ার হিসাবে দেশের সাধারণ জনগণের নিজস্ব কী উন্নয়ন হচ্ছে- সেই সমীকরণটিও সবার মনেই সর্বদা বিরাজ করতে শুরু করেছে।
তাত্ত্বিকভাবে রাজনীতিতে একটি দর্শন রয়েছে যে, জনসাধারণের যে ধরনের প্রত্যাশা থাকে সেগুলোর শতভাগ বাস্তবায়ন কোনো সরকারের পক্ষে সম্ভব না। কারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়া কিংবা প্রত্যাশার কোনো সীমা নেই। এ কারণে কোনোভাবেই একজন ব্যক্তির চাওয়া-পাওয়ার হিসাবটি যথাযথভাবে পূরণ করা সম্ভব হয় না। তবে ব্যক্তি চাওয়া এবং রাষ্ট্রীয় চাহিদার একটি বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। এই মুহূর্তে দেশের জনগণের দীর্ঘদিনের চাওয়া হলো একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। আর একটি নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার যেমন জরুরি, তেমনি সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে প্রকৃত নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারও জরুরি। আমরা বিশ্বাস করি, আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন অবশ্যই কোনো ধরনের বিতর্ক ছাড়া সাধারণ জনগণ ভোট দিতে পারবে।
নির্বাচন নিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে খুব বেশি তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। তারা আসলে দীর্ঘদিন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে থাকায় তাদের ধৈর্য নেই বললেই চলে। বিশেষ করে বিএনপির ধারণা, এই মুহূর্তে নির্বাচন হলে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় তারা একচেটিয়া বিজয় লাভ করতে পারবে। ইতোপূর্বে যেমন বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে এবং আওয়ামী লীগের কৌশলগত অপরিবর্তনীয় মনোভাব ও রাজনীতির ফলে একচেটিয়া কয়েকবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল।
ইতোমধ্যেই আমরা লক্ষ করেছি, বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বিএনপি সরকারকে নির্বাচন নিয়ে চাপ সৃষ্টি করছে। সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেছেন, ‘নির্বাচন আগে নাকি সংস্কার আগে এ কথা যারা বলেন, তাদের বলব সংস্কার হচ্ছে একটা অন্তহীন প্রক্রিয়া। যতদিন পৃথিবী থাকবে, এ দেশ থাকবে ততদিন সংস্কার চলমান থাকবে। কিন্তু ১৭-১৮ বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষের যে প্রাণের আকাঙ্ক্ষা, ভোটকেন্দ্রে গিয়ে একটি ভোট দেওয়া, সেটা পূরণ করতে আপত্তি কোথায়?’ তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচনের মাধ্যমে যদি একটি নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, তাদের কাছে যে শক্তি, সাহস ও দক্ষতা থাকবে তা দিয়ে অনেক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।
যেগুলো এ সরকারের (অন্তর্বর্তী সরকার) পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।’ তার এই বক্তব্য থেকে পরিষ্কার অনুমান করা যায় যে তারা খুব দ্রুত একটি নির্বাচন চায়। এমনকি সংস্কারের নামে কালক্ষেপণ তারা মানতে নারাজ। বরং তারা চায় সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া- যেটি শুরু হয়েছে সেটি নির্বাচিত সরকার এসেও করতে পারবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যারা নির্বাচনে অংশ নিতে চায়, তাদের পক্ষ থেকে দেশের উন্নয়নবিষয়ক কোনো পরিকল্পনার কথা শুনতে পাচ্ছি না। কীভাবে দেশকে উন্নত দেশে পরিণত করা যায়, কীভাবে দেশের জনগণের চাহিদা যথাযথভাবে পূরণ করা যায়, সেসব বিষয়ে কোনো রোডম্যাপ তারা দিচ্ছে না।
আমাদের দেশে প্রায়ই যে সমস্যাটি লক্ষ করা যায় সেটি হলো, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নির্বাচন-পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী তাদের আচরণ এবং ভূমিকা পরিবর্তন করে। ক্ষমতায় গিয়ে ক্ষমতাকে আঁকড়ে ধরতে চায়। কাজেই আমরা চাই, পরবর্তী কোনো সরকার যাতে এমন আচরণে সফল হতে না পারে। এ জন্য অধিকসংখ্যক রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে সে-সংক্রান্ত নির্বাচনি সংস্কার প্রস্তুত করা এবং তা কার্যকর করা।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]